![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাত্রির শেষ ভাগ।ভোর হবো হবো করছে।পাখিরা এখনও তাদের প্রথম ডাকের জন্য তৈরী হয় নি।ঢাকা শহরের মানুষেরা ঘুমের মধ্যে তাদের শেষ রাতের স্বপ্নে বিভোর।সেই ঘুমন্ত মানুষেরা যেমন নানা শ্রেনীর,তাদের স্বপ্নেরাও তেমনি নানা শ্রেনীর।সেখানে উচ্চবিত্তের স্বপ্ন আছে,মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের স্বপ্ন আছে,নিম্নবিত্তের স্বপ্ন আছে।আবার রেললাইনের পাশে ছাউনি তুলে বসবাস যে ছন্নছাড়াদের,তাদের স্বপ্নেরাও আছে।মিল একটাই।সব স্বপ্নওয়ালারাই গভীর ঘুমে বিভোর।
ঘুম নেই শুধু মাহিনের চোখে।নীল পলিথিনের ছাউনি দেয়া ছোট্ট বেড়ার ঘরেতে ঘুমহীন স্বপ্নহীন চোখে সে তাকিয়ে আছে তার রোগাক্রান্ত ছোটভাইটির ঘুমন্ত মুখের দিকে।ভাইটির নাম শাহীন।তবে এ নামগুলো শুধু তাদের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।বাইরের জগতে তাদের সর্বজনস্বীকৃত একটা নাম আছে।তা হল “টোকাই”।
শাহীনের মাথার পাশে কুপি জ্বলছে।তারপাশে পরে আছে কপালে জলপট্টি দেয়ার যাবতীয় সরন্জাম।আরেক পাশে ঠাই পেয়েছে সামান্য কিছু ঔষধের শিশি,আর কয়েক পিস অভুক্ত পাউরুটি।ঘরের এককোনে একটা জলন্ত ধূপ বৃথাই মশা তাড়ানোর চেষ্টা করছে।জ্বরের মধ্যে মশার কামড়ে শাহীন কিছুক্ষন পরপরই নড়েচড়ে উঠছে।বহু ব্যবহারে জীর্ন,শীর্ন কাথাটি দিয়ে মাহিন হাফপ্যান্ট পরা ভাইয়ের খালি গা টা ভালভাবে জড়িয়ে দেয়।কপালে হাত দিয়ে পরখ করে জ্রর কমলো কিনা।
কিছুক্ষন আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।তারই ফলস্বরূপ এখনও মাথার উপরের পলিথিনের ছাদের ফুটো হওয়া না না প্রান্ত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে।ক্লান্ত,হতাশ চোখে সেগুলোর দিকে তাকাতেই মাহিনের পেটের ভিতরটা হঠাৎ তীব্র যন্ত্রনায় মোচর দিয়ে ওঠে।হ্যা ক্ষুধার যন্ত্রনা।জীবন এখানে বড়ো নির্মম।১৪ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে মাহিন তার সবটকু দেখে ফেলেছে।আজও ১০ বছরের ভাইটির ঔষধ পথ্য কেনার অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে তার খাওয়া হয়ে ওঠে নি।পানি খেয়েছে।তাতে পিপাসা মিটেছে,ক্ষুধা মেটে নি।তাই খালি গা,শীর্ন দেহে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রনা নিয়ে মাহিন নিশ্চুপ বসে থাকে।
তবে বিশাল সব পাথরখন্ডের ফাঁটলে যেমন মাঝে মাঝে সবুজের জন্ম হয়,তেমনি চরম নির্মমতার গাঢ় স্তুপেও মাঝে মাঝে ভালবাসা জন্ম নেয় তার আপন মহিমায়।আর সেই ভালবাসার পরশ বোলাতেই ভোরবেলা মাহিনদের ছাউনি তলে এসেছিলেন রহিমা খালা।শাড়ীর আচলের খুঁট থেকে নিজের সঞ্চয়ের শেষ কয়টা টাকা বের করে তুলে দিয়েছিলেন মাহিনের হাতে ভাইয়ের ঔষধ কেনার জন্য।কৃতজ্ঞতায় সজল হয়ে উঠেছিলো মাহিনের দুচোখ।খালার শরীর থেকে কেমন জানি মা মা ঘ্রান ভেসে আসছিলো।বড়ো তীব্র সে ঘ্রান।মাহিন চেয়ে দেখলো খালার কপালের কোনটা ফুলে আছে ভীষনভাবে।এরকম মাঝে মাঝেই দ্যাখে সে।কপালে ফোলার চিহ্ন,গালে চড়ের দাগ।শুধু দেখে যায়।কোনো প্রশ্ন করে না।দারিদ্রতা আর নির্মমতাই যেখানে জীবনে চলার পথের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী,সেখানে এসকল প্রশ্ন করে নিঃসন্তান খালার ভেতরের ঘা টা আর উস্কে দিতে চায়না মাহিন।শুধু নীরবে নতমুখে খালার উপর শাহীনের দেখাশোনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বস্তা কাঁধে পথে বের হয়ে যায় জীবিকার তাগিদে।
খালার কথা ভাবতে ভাবতে মাহিনের হঠাৎই মনে পরে যায় তার নিজের মায়ের কথা।আর সেকথা মনে হলেই মাহিনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শান্ত,কোমল,স্নিগ্ধ,স্নহময়ী এক নারীর মুখচ্ছবি।জলন্ত উনুনের সামনে ভেজা কপালে একটু পরপর ছুয়ে যায় যার শাড়ীর আচল।পদ্মারতীরে ছোট্ট একটা কুটির।সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়ানো,চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা,নদীর সাথে মিতালী পাতানো,আর বেলা হলেই ঘরে ফিরে আসা।অন্যের জমিতে মজুরী খাঁটা দরিদ্র বাবার কষ্টার্জিত শাঁকান্ন গভীর তৃপ্তিভরে মায়ের হাতে খাওয়া।ছোটভাইটাকে দুপায়ের উপর নিয়ে ঘুম পাড়ানো।কি চমৎকার একটা জীবন।রাত্রিবেলা মায়ের কোলে মাথা রেখে উন্মত্ত পদ্মার দিগন্তের সাথে যখন তারাগুলোর মিতালী করাতো,তখন একবারও মনে হতোনা সেই চমৎকার সময় গুলো একসময় বিদায় নেবে।কিন্তু একদিন যখন হঠাৎ করে মাহিনের মা বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে চিরতরে,তখন সেই সময় গুলোকে আর আটকে রাখা গেল না কোন ভাবেই।
তীব্র পেটের ব্যাথায় আক্রান্ত মাহিনের মাকে অনেক কষ্টের পর যখন সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হলো,তখন ডাক্তাররা দেখেশুনে কিসের যেন একটা নাম বললো।অ্যাপেনডিসাইটিস না কি যেন।ওটা কেটে ফেলে দিতে হবে।ছোট্ট একটা অপারেশন লাগবে।অল্প কিছু টাকার মামলা।কিন্তু সেই অল্পটাই মাহিনের দরিদ্র বাবার কাঁধে চেপে বসলো বিরাট বোঝা হয়ে।ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরে,এর ওর কাছে ধর্না দিয়ে যখন কিছুতেই কিছু হলো না।তখন চেষ্টা হতে লাগলো ভিটেবাড়ি বিক্রি করার।কিন্তু পদ্মাপারের জমি।ভাঙ্গন আসন্ন।এই আছে এই নেই।কে কিনবে?তাই মাহিনের মাকে মরতে হয়েছিলো।অখ্যাত এক সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে বরন করতে হয়েছিলো যন্ত্রনাময় মৃত্যু।শুধু মৃত্যুর আগে ব্যাথা ভুলে মাহিনকে বলেছিলো
-যাইরে বাপ।বাপেরে কষ্ট দিস না।ভাইডারে দেহিস।
তারপরই সব শেষ।সবকিছু মাহিনের কাছে কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো সেদিন।তার মা সামনে শুয়ে আছে।কিন্তু আর কোনোদিন কথা বলবে না,খাইয়ে দেবে না,”মাহিন সোনামানিক আমার” বলে আর ডাকবে না ভাবতেই কিছু একটা যেন গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছিল তার।না,সে কাঁদেনি।কাদতে পারেনি।শুধু বড্ড অভিমান আর ক্ষোভ হয়েছিলো টাকা নামে ঐ কাগজের টুকরো গুলোর উপর।ওগুলোর জন্যই যে মরতে হলো তার মাকে।
তারপর অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে।বিশাল পদ্মা গ্রাস করে নিয়েছে ওদের ভিটেবাড়ি।ঢাকা শহর অনেক বড়।সেখানে গেলে কিছু একটা উপায় না হয়েই পারে না।এই আশায় মাহিনদের বাবা তাদের নিয়ে এলেন ঢাকা শহরে।তারপর একের পর এক ধাক্কা।কিভাবে কিভাবে যেন তাদের ঠাই হলো রেল লাইনের ধারের এই বস্তিতে।বাবা রোজ রাতে খাবার নিয়ে আসতো।কিভাবে আনতো মাহিন জানে না।কিন্তু আনতো।একদিন রাতে সেই বাবা আর ফিরলো না।পরদিন ভোরে বস্তির একধারে এক নর্দমায় আবিস্কার করা হলো মাহিনের বাবার রক্তাক্ত লাশ।যেই বাঁকা পথকে অবলম্বন করে নিজের ভাগ্যসংস্থানের বৃথা চেষ্টা করে বিপথগামী ছন্নছাড়া মানুষগুলো,সে পথেও সুবিধা করতে পারেনি মাহিনের সহজ সরল বাবা।তাই সঙ্গীদের সাথে টাকার বনিবনা না হতেই পেটে ক্ষুরাঘাত।অতপরঃ,সব শেষ।ছোটভাইটাকে জড়িয়ে ধরে মাহিন সেদিন খুব কেদেছিলো।কতটা তার সহজ সরল বাবার জন্য আর কতটা তার অভাগী মায়ের জন্য,সে জানে না।
শাহীনটা কাশছে। এই তো আবার কাশি বন্ধ হয়ে গেল।কি আবার সুন্দর ঘুমাচ্ছে। মাহিন ভাইয়ের কপালে হাত রাখে।জ্বরটা একটু কমলো বোধহয়।পাগল ভাই একটা।সেদিন কি খেতে ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতেই শুয়ে থেকে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললো
-কিচ্ছু খাইতে ইচ্ছা করেনা ভাইজান।সব খালি তিতা লাগে।
ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসতেই সামনে পরলো রহিমা খালা
-কেমুন বলদ দ্যাখছসনি তর ভাইয়ে।তুই তো বাইরে গেলিগা।মাতায় পট্টি দেওনের সময় আমারে কয় কি হুন।কয় দ্যাহো তো খালা ঝামেলাডা কি হইল-
আমি কই,ক্যারে কি হইছে?
হেরপরে কয়,
-রুই মাছের পেডি দিয়া ধুয়া উডা গরম ভাত খাইতে মনে চায়।আইচ্ছা তুমিই কও এডি কি আমগোর লাইগ্যা।ভাইজানরে কইয়োনা কইলাম।কিড়া কাডো যে কইবানা-
মাহিন নীরবে খালার মুখে দিকে তাকায়।ওর চোখের ব্যাথাতুর দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে খালাও আর কথা বাড়ায় না।
আচ্ছা পুরু করে ভাজা রুই মাছের পেটির কয়েকটা টুকরা কি জোগাড় করা যায় না?করিম চাচা কে বললে ভাঙ্গারী বেচার কয়েকদিনের কয়টা টাকা কি অগ্রিম দেবে না?নামাজি মানুষ।সাথে গায়ে গতরে খেঁটে বাড়তিকিছু কাজ করে-
মাহিন ভাবতে থাকে।ভাবতে ভাবতেই বেড়ার ফাঁকা দিয়ে দ্যাখে বাইরে ভোর হচ্ছে।সূর্যের প্রথম পবিত্র আলো এসে ধুয়ে দিচ্ছে সব অন্ধকার।শহরের মানুষগুলোর দিনলিপিতে যুক্ত হচ্ছে আরেকটা নতুন দিন।নতুন অনেক আশার বার্তা নিয়ে।ভাঙ্গা বেড়ার দরজা ঠেলে রহিমা খালা ভেতরে ঢুকছে।খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে মাহিনও তার ময়লা প্লাস্টিকের বস্তাটা কাঁধে তুলে নেয়।বাইরে বেরোতে হবে।শহরের মানুষেরা তার দিকে নানা দৃষ্টিতে তাকাবে।কারও চোখে থাকবে স্নেহ,কারও চোখে করুনা।কারও চোখে বা শুধুই ঘৃনা।মাহিন সবার চোখের ভাষা পড়তে পারবে।চরম ভাবে সার্থপর কিছু মানুষের দিকে তাকিয়ে ভাববে,”ওরা এমন কেন?”
শুধু অন্যকোন মানুষ তার চোখের ভাষা পড়তে পারবে না।যেই চোখে খেলা করে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে কড়া করে ভাজা রুই মাছের পেটি দিয়ে খাওয়ারত এক বালকের হাসিমুখের লাল নীল স্বপ্নঘুড়ি।
২৮ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫০
সাফিউল ইসলাম দিপ্ত বলেছেন: বলেছেন: চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।আমার ব্লগে স্বাগতম।সবসময়ই ওদের জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে।কিন্তু এখন যা করতে পারব তা হবে ছোটখাটো পদক্ষেপ।একসময় যখন নিজের পায়ে দাড়াতে পারব তখন ওদের জন্য বড় কিছু করার চেষ্টা করব।আর তখন সবাইকে আমার পাশে চাই।
২| ২৯ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:২৬
হাসান মাহবুব বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো।
২৯ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২২
সাফিউল ইসলাম দিপ্ত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।আমার ব্লগে স্বাগতম।
৩| ২৯ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৫
শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: বেশ ভালো লিখছেন। শুভকামনা রইলো।
২৯ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:৫৮
সাফিউল ইসলাম দিপ্ত বলেছেন: অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।আমার ব্লগে স্বাগতম।
৪| ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:২০
অবিবাহিত জাহিদ বলেছেন: Koster golpo gulo aro kosto dey
০৫ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৫
সাফিউল ইসলাম দিপ্ত বলেছেন: আর এই কষ্টের গল্পগুলো যখন বাস্তব হয়ে ধরা দেয় তখন তা আরও বেশী কষ্ট দেয়।মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।আমার ব্লগে স্বাগতম।
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৩১
বেদনার বালুচরে বলেছেন: খুব ভাল লাগল। তবে লিখনী ভাল করাই আমাদের একমাত্র ব্রত না হওয়াটাই কাম্য। এসমস্ত মাহিনদের সেবা করতে হবে যে আমাদের।
ভাল থাকুন এবং কলমের ধার আরো বাড়াতে থাকুন আপাতত:।