![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অচেনা দেশ, অচেনা শহরের অচেনা বালক আমি। অচেনা ছায়ার সাথে করি খেলা সারাক্ষণ...।। জানতে চাই, জানাতে চাই অচেনাকে চিনতে চাই...।।
আমার মনে হয় এখন আমি পুনরায় জন্ম নিয়েছি। এখনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না মুক্ত হিসেবে। মনে এখনো ভয় জাগে। ইরানে আন্তর্জাতিক অপহরণকারীচক্রের হাতে অপহরণ হওয়ার পর নির্যাতনের কাহিনী এখনো চোখের সামনে ভাসে। ওরা আমাদের ১১ বার বিক্রি করেছে। দেশ থেকে টাকা না দিলে বলত কিডনি বিক্রি করে টাকা নেবে। চোখের সামনে অনেককে মরতে দেখেছি। অপহরণকারীচক্র আমাদের আটকে রেখে কোটি কোটি টাকা পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে।'
এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী সময়ে ইরানের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেলহাজত থেকে পুলিশের মাধ্যমে বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখানকার কর্মকর্তারা সহযোগিতার বদলে গালাগাল করতেন। কথাগুলো বলেন দুবাইভিত্তিক অপহরণকারীচক্রের গোপন আস্তানা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসা বাংলাদেশি যুবক তুহিন।
তিনি বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামের সামছুল হকের ছেলে। তাঁর পুরো নাম এমরান হোসেন তুহিন।
অপহরণকারীচক্রের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসার পর গত ৩ জানুয়ারি তুহিনের বাড়িতে গেলে তাঁর মুখ থেকে শোনা যায় অপহরণ-পরবর্তী নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'গত বছরের রমজান মাসের প্রায় ১৫ দিন আগে দুবাইতে অবস্থানরত দালালরা আমাদের সব সময় ফোন দিয়ে বলত গ্রিসে যাওয়ার জন্য। তাদের চাপাচাপিতে রঙিন স্বপ্নে পড়ে ফাঁদে পা দিই আমিসহ ৩৭ জন বাংলাদেশি যুবক। প্রত্যেকের সঙ্গে সাত লাখ টাকায় চুক্তি হয়। রোজার তিন দিন আগে গ্রিসগামী জাহাজে আমাদের ওঠানো হয়। জাহাজের নিচতলায় আমাদের নামিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রচণ্ড গরমে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, পিপাসায় ময়লা বরফের পানি পান করেছি। ইরানের কাছাকাছি আসার পর দালালরা আমাদের জাহাজ থেকে সাগরে রাখা স্পিডবোটের ওপর ফেলে দেয়। এতে অনেকের হাত-পা ভেঙে যায়। স্পিডবোট নিয়ে পালাতে গিয়ে ইরানি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। ধরা পড়ার পর দালালরা আমাদের পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। পরবর্তী ঘটনায় বুঝতে পারি, এটা দালালদের কৌশল। আমাদের ৩৭ জনকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। প্রতিদিন এক বেলা খাবার দিত। পাঁচজনের খাবার আমাদের ৩৭ জনকে দেওয়া হতো। ১০ থেকে ১৫ দিন পর গোসল করার ব্যবস্থা হতো। আটকের দুই দিন পর আমাদের সবার বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে অভিভাবকদের টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। টাকা না দিলে আমাদের হত্যা ও কিডনি বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেয়। আবার তাদের দেশীয় দালালদের মাধ্যমে আমাদের বাড়িতে যোগাযোগ করত। তৃতীয় দিন আমাদের দালাল এসে বলে, যারা টাকা দিতে পারবে তারা এক পাশে যাও, যারা পারবে না অন্য পাশে যাও। আমাদের মাঝ থেকে ঢাকার কাঞ্চন নামের একজন টাকা দিতে পারবে না বলে জানায়। এ কথা বলার পর তাকে লোহার রড ও ইস্ত্রি গরম করে নির্যাতন চালিয়ে আমাদের চোখের সামনে মেরে ফেলে। এ নির্যাতনের ভয়ে সবার বাড়ি থেকে কয়েক দফা টাকা দেওয়া হয়। এর পরও আমাদের মুক্তি মেলেনি। বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম আমরা। এভাবে আমাদের এক দালাল থেকে অন্য দালালের কাছে ১১ বার বিক্রি করে এই চক্র।'
তুহিন জানান, তাঁদের সঙ্গে থাকা মৌলভীবাজারের রুবেল ছিল যাত্রীবেশী দালাল। সে মৌলভীবাজারের কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে ইরানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত তার মামা খুরশেদ আলমের কাছে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেয়। এক রাতে এই দালালের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নিয়ে রুবেলের মামার কাছে ফোন করেন তাঁরা। তখন খুরশেদ আলম গাড়ি পাঠিয়ে তার বাসায় নিয়ে যায় তাঁদের। সেও তাঁদের আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে পালিয়ে তাঁরা একটি ইরানি বাড়িতে আশ্রয় নেন। ইরানি পুলিশ তাঁদের আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। জেলহাজত থেকে পুলিশের মাধ্যমে তাঁরা ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দূতাবাসের কর্মকর্তারা সহযোগিতার বদলে গালাগাল করতেন বলে জানান এ যুবক। এভাবেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তাঁরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে পা রাখতে সক্ষম হন।
তুহিন আরো জানান, তাঁর সঙ্গে মুক্ত হয়ে আসা ঢাকার মাছুম ও রিয়াদ, কুলাউড়ার ভাটেরগাঁও-মাইজগ্রামের সুমন, বড়লেখার কলারতলীপারের মনু মিয়া ও সুজাউল গ্রামের এনাম আহমদ, রাজশাহীর এমদাদ, বাগেরহাটের ফয়ছল, নাটোরের কাদিরসহ ২২ জন দুর্বিষহ বন্দিজীবনের সঙ্গী ছিলেন।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর বড়লেখা থানা পুলিশ অপহরণকারীচক্রের দেশীয় সহযোগী স্থানীয় বর্ণি ইউনিয়নের আলম উদ্দিনকে (২৫) গ্রেপ্তার করে। সে ইরানের অপহরণকারীচক্রের সদস্য ইমরান আহমদের ছোট ভাই।
বড়লেখা থানার ওসি কামরুল হাসান জানান, একটি মামলায় আলম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে আন্তর্জাতিক অপহরণকারীচক্রের অন্যতম সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র ঃ সংবাদপত্র
©somewhere in net ltd.