![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
সমঅধিকার ও সামাজিক মিশ্রসংস্কৃতি
ফকির ইলিয়াস
__________________________________________
মানুষ সমাজ নির্মাণ করে। মানুষই প্রণয়ন করে আইন। এ আইন মানুষের কল্যাণে। রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সব দেশেই আছে। একটি সমাজ নির্মাণে সে সমাজের মানুষের পরিশুদ্ধ অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর দিন। আর সে অংশগ্রহণ কিন্তু নারী ও পুরুষের সমানভাবেই হতে হয়। এমন এক সময় ছিল যখন নারী-শিশু জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত পুঁতে রাখার আদিমতা ছিল সামজে। অথচ মানুষ সে সময়ও ছিল বিবর্তনবাদী। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ যদি সভ্যতা, সুন্দর ও সত্যের পক্ষে বিবর্তনবাদীই হবে, তবে মাঝে মধ্যে এখনও আদিমতা গ্রহণ করে কেন?
আমরা কতগুলো উদাহরণ দেখি এখনও প্রাচ্যের সমাজে। পুরুষতান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার কখনও কখনও আমাদের ভুলিয়ে দেয় এ সমাজে নারী নামের আরেকটি লিঙ্গের মানুষ আছে। শাসনের বিভিন্ন জাঁতাকলে আছে তারা। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয়, তত্ত্বীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক শাসনগুলোই প্রধান। আমরা দেখব যারা ফতোয়া দিয়ে বেড়ান, তারা ফতোয়াগুলোর ৯৯ ভাগই জারি করেন নারীদের বিরুদ্ধে। পুরুষের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে তাকে বড়জোর একঘরে করে রাখা যায় কয়েক মাস। তারপর সে আবার সমাজে উঠে আসে। কোনো পুরুষকে দোররা মারার ঘটনা আমরা কখনও শুনিনি। অথচ নারীকে দোররা মেরে মাটিতে পুঁতে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনাও আমরা দেখেছি। ধর্ম ও সমাজের মিশ্রণে এই যে পেশিশক্তির দাপট, তা একটি শুদ্ধ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণে হুমকি বৈকি।
যেসব নারী গণিকাবৃত্তি করে, সমাজ তাদের পতিতা বলে আখ্যায়িত করে খুব সহজে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে এ আখ্যায়ন চলছে এখনও। কিন্তু যে পুরুষ গণিকালয়ে যায়, তাকে পতিত আখ্যা দেয় না সমাজ। দিতে পারে না। কেন পারে না? এতে বাধা কোথায়?
আজ থেকে তিন দশক আগেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নারীদের কর্মসংস্থান বিষয়ে নানা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা এখন ক্রমশ সরতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সরকারি দফতর, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, ডাকঘরসহ অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠানে এখন নারীদের কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে সামাজিক চেতনার কারণেই। সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্যের বিভিন্ন ধাপ আমরা বিভিন্ন দেশে লক্ষ করি। ইসলাম ধর্মে এক ছেলেসন্তানের সমান পরিমাণ সম্পদ দুই মেয়ে সন্তান পাবে এমন একটি রেওয়াজ ছিল। তা বিভিন্ন দেশে এখন সংস্কার করা হয়েছে। একটি মেয়ের যদি একটি ভোট হয়, একটি ছেলেরও তেমনি একটি ভোট। তাহলে রাষ্ট্রে পৈতৃক সম্পত্তি পেতে বৈষম্য হবে কেন? বলা যায় বিয়ের প্রথার কথাও। একজন পুরুষ একসঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখতে পারবে। কিন্তু একজন নারী একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখতে পারবে না। এই যে স্বীকৃত প্রথা, এর সহজ কোনো সমাধান আপাতদৃষ্টিতে নেই। যদি সামাজিকভাবে মানুষ তা গ্রহণ কিংবা বর্জনে রাজি না হয়।
বিতর্কিত অনেক প্রথা অনেক ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্মের সতীদাহ, অকাল বৈধব্যের পর আর বিয়ে না করা প্রভৃতি কার্যক্রম কোনো সভ্য সমাজেই গৃহীত হতে পারে না। যারা কট্টরপন্থী ইহুদি ধর্মাবলম্বী, সে সমাজের নারীদের বিয়ের পরই তাদের চুল কেটে ফেলতে হয়। তারপর তাদের পরচুলা ব্যবহার করতে হয়। স্বামীর মনোরঞ্জন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের যাতে দৃষ্টি কাড়তে না পারে সেজন্য হাইহিল জুতা, টাইট ফিটিংস পোশাক তারা পরতে পারে না। এমনকি প্রচলিত আছে, ইহুদি ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থী পুরুষরা তাদের স্ত্রীকে সন্তান ধারণে বাধ্য করে অনেকটা বলপূর্বক। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।
ইউরোপ-আমেরিকার ইহুদি ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থীরা তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদীর ব্যাপারেও পরিবারের অগ্রজদের মতামত চাপিয়ে দেয়। অ্যারেঞ্জড কিংবা সেটেল ম্যারেজ প্রথা শুধু বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় নয়, আইরিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, ইহুদি, রুশ সমাজেও আমরা প্রত্যক্ষ করি। আর এসব সমাজের দাম্পত্য জীবনে শান্তি ও অশান্তি দুটিই থেকে যাচ্ছে সমানভাবে। এসব দায় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সমঝোতাপূর্ণ জীবনযাপন। তা যে কোনো দেশে যে কোনো সমাজেই হোক।
লিঙ্গের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের কিছুদিন আগের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এক দম্পতি ডিভোর্স চেয়ে পারিবারিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। এ সময়ে স্বামী স্টেট লটারিতে পাঁচ মিলিয়ন ডলার জিতে যায়। স্ত্রী আইনানুযায়ী তার অর্ধেক দাবি করে। স্বামী বলে, আমরা ডিভোর্স ফাইল যেহেতু করেছি, তাই স্ত্রী অর্ধেক অর্থমূল্য পাবে না। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচে হেরে যায় স্বামী। আদালত রায় দেয়, যেহেতু ডিভোর্স প্রক্রিয়াটি এখনও সম্পন্ন হয়নি তাই স্ত্রী লটারির অর্ধেক অর্থমূল্যের ভাগীদার। একটি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু আইনি বিচার ও সততা থাকলেই সমঅধিকারের বিষয়টি পূর্ণতায় রূপ নেয়া সহজ হতে পারে।
ধরা যাক বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামের কথা। এ স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর যে স্বর্ণোজ্জ্বল অবদান, তা কি সরকারিভাবে ব্যাপক স্বীকৃত হয়েছে? না, হয়নি। এমনকি যারা বীরাঙ্গনা, যারা তাদের মহামূল্যবান সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন আমাদের বিজয়ের জন্য, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা তাদের যথাযথ সম্মান দেয়নি।
ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা আধুনিকতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আধুনিকতার লেবাসে উগ্রতা, বেহিসেবীপনা কোনো সমাজই গ্রহণ করে না। যেসব কর্ম সমাজ কিংবা প্রন্মজকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তাকে তো আর ব্যক্তি স্বাধীনতা বলা যায় না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইউরোপের কিছু দেশে যৌন উগ্রতার নামে মানব সভ্যতা ধ্বংসের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। যেমন অবৈধ মাদকদ্রব্য বিক্রি।
সমঅধিকার সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যা নারী-পুরুষের অধিকারের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দেবে। মানুষ মানুষের হাতে নিগৃহীত হবে না। মানুষ মানুষের কাছে প্রতারিত হবে না। এর পরের শর্তটি হচ্ছে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীল বিবর্তনই মানুষকে এজন্য সাহায্য করেছে। এর পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতাই হতে পারে সমাজ নির্মাণের মূলমন্ত্র। মানুষকে তা মানতে হবে। সম্মান করতে হবে।
----------------------------------------------
দৈনিক যুগান্তর ॥ ঢাকা ॥ প্রকাশিত : ০১ মে, ২০১৪ বৃহস্পতিবার
©somewhere in net ltd.