নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাষ্ট্রকাঠামো উন্নয়নে শ্রম আইন ও বাস্তবতা

০২ রা মে, ২০১৪ সকাল ৭:০৪

রাষ্ট্রকাঠামো উন্নয়নে শ্রম আইন ও বাস্তবতা

ফকির ইলিয়াস

____________________________________________



যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় না। অথচ এর সূচনা হয়েছিল শিকাগো শহর থেকেই। মে দিবসে যে বিষয়টি আমাকে বেশি পীড়া দেয়, তা হচ্ছে শিশুশ্রম। বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধে কোনো সরকারই আন্তরিক ছিল না। এখনো নয়। একটি শিশু, শ্রমিক হয়ে রাস্তায় নামার দায় সরকারের, সমাজের। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে লুটপাট হয়, সে দেশে শিশুসদন, পুনর্বাসনে, শিক্ষায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ হয় নাÑ তা খুবই লজ্জাজনক।



চার দশকেরও বেশি বয়সী বাংলাদেশে আমরা শুধু সেøাগানই শুনেছি। সেমিনার দেখেছি। বাস্তবতা শূন্যের কোঠায়। প্রবাসী বাঙালিদের এ ব্যাপারে থাকতে পারতো বিশেষ ভূমিকা। আমরা দেখি, প্রবাসের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আঞ্চলিক সংগঠনের চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় কোনো কোনো নেতা খরচ করেন লাখ লাখ ডলার। কোনো কোনো সংগঠনের মোট নির্বাচনী খরচ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই অর্থ বাংলাদেশের শিশুদের উন্নয়নে ব্যয় করা যেতো। তা করা হচ্ছে না।



বলতে দ্বিধা নেই, প্রজন্মের কল্যাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা উন্নাসিক। দেশে বিপুল সংখ্যক শিশু বিভিন্ন সেক্টরে অকাতরে শ্রম দিয়ে গেলেও তারা প্রকৃত শ্রমের অধিকার পায় না। যদিও শিশুর অধিকার তার প্রকৃত শ্রমের মর্যাদা পাওয়া। কিন্তু দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও শিশু অধিকার আইন প্রয়োগের অভাবে শিশু শ্রমিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুশ্রম বন্ধে অনেক এনজিও সংস্থাসহ দেশীয় অনেক সংস্থা শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করলেও বাস্তবায়নের কোনো রূপরেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি শিশু শ্রমের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।



প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা আর নিরাপদ বাসস্থানের অধিকার। যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ও প্রত্যাশা নিয়ে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘটে বিপরীত। অভাব অনটন নিঃস্বতার মধ্যে পড়ে শ্রম বিক্রি করতে হয়। পারিবারিক নিঃস্বতার কারণে অসংখ্য শিশুকে শ্রমের জন্য ঘর ছাড়তে হয়। এদের মধ্যে পিতা-মাতাহীনই বেশি। যাদের বলা হয় পথশিশু। এসব পথশিশু হোটেল, রেস্তোরঁাঁয় বয়, রিকশা-ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ির হেলপার, পাথর কোয়ারী ছাড়াও ইটখোলার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এবং সবাই কিন্তু অভাবের তাড়নায়ই শ্রম বিক্রি করছে। একজন পূর্ণ শ্রমিকের সঙ্গে জোগাড়ি হিসেবে ৮/১০ ঘণ্টা কাজ করেও মজুরি পায় একজন পুরো শ্রমিকের অর্ধেক। আর হোটেল রেস্টুরেন্টে গ্লাস বয় হিসেবে কাজ করেও কোনো কোনো শিশুশ্রমিক মজুরির বদলে শুধু খাওয়াটায়ই তার পাওনা কেটে যায়। অনেক কথা বলা হয়েছে। অনেক লেখালেখি হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি।



‘শ্রম অধিকার’ পরিস্থিতি নিয়ে বহির্বিশ্বের চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। শ্রম অধিকার পরিস্থিতি অবনতির অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা গত বছর ২৭ জুন স্থগিত করে। এরপর থেকে অন্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করে। অবশ্য এ শ্রম অধিকার পুরোপুরি ঠিক না হলে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এটা হলো বিদেশীদের চাওয়া। এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের সংবিধান কিভাবে শ্রম আইন ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করছে।



সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ বলছেÑ ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ অনুচ্ছেদ ১৫ বলছেÑ ‘কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার ; যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।’ অনুচ্ছেদ ২০ বলছে- ‘কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’ অনুচ্ছেদ ৩৪ বলছে- ‘সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হইলে তাহা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।’ অনুচ্ছেদ ৩৭ বলছে- ‘জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ অনুচ্ছেদ ৩৮ বলছে- ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংগঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ এই যে আইনের ধারা-উপধারা, তা কি বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে? কেন হচ্ছে না?



সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সমাজের মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করতে হবে। শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। আমরা দেখছি, আমেরিকায় মে দিবস ঘটা করে পালিত হয় না। কিন্তু শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন আমেরিকানরা ঠিকই করে নিয়েছে। প্রতি ঘণ্টা মজুরি, প্রতি সপ্তাহান্তে বেতন নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। ন্যূনতম ঘণ্টাপ্রতি মজুরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়াচ্ছে ফেডারেল ইউএস গভর্নমেন্ট। আর আমরা বাংলাদেশে ডাকহাঁক দিয়ে ‘মে দিবস’ পালন করছি। কিন্তু আমাদের দেশে ন্যূনতম বেতনের স্কেল অত্যন্ত নড়বড়ে। তা কেউ মানছে, কেউ মানছে না। অনেক কোম্পানি মাসে মাসে বেতনও দিচ্ছে না তাদের কর্মচারীদের। সমাজের বিবেকদর্পণ বলে পরিচিত যে সাংবাদিক সমাজ, মাসের পর মাস তারাও বেতন ভাতাহীন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। এমন সংবাদও আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি। ধনতান্ত্রিক ধারায় কর্পোরেট বিজনেস হাউজগুলো সংবাদ মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করছে। আবার সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে মিডিয়া বন্ধও করে দিচ্ছে। তাদের এই যে মানসিকতা, তা তো সামাজিক চরম অবক্ষয় মাত্র। আর এসব অনৈতিকতা, যে কোনোভাবে লুটপাটের মানসিকতা গোটা রাষ্ট্রের নৈতিক অবকাঠামোকে ক্রমশ দুর্বল করে ফেলছে। প্রজন্ম পরিশুদ্ধ মননের চর্চা করার সুযোগ না পেয়ে ‘বৈধ কিংবা অবৈধভাবে হোক’ সস্তা টাকাকড়ির পিছু হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।



মুখে আমরা নীতির অনেক আপ্তবাক্য আওড়াই। সভা, সমাবেশ করি। অধিকারের স্বচ্ছতা চাই। কিন্তু বাস্তবতার কথা ভুলে যাই অবলীলায়। সমাজের সীমাবদ্ধতা ভাঙতে চাই যদিও, কিন্তু সাধ্য নেই। সাধ্য না থাকার অন্যতম কারণ ধনিক শ্রেণীর রক্তচক্ষু। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা, বৈষম্যের স্তরকে বরাবরই পাকাপোক্ত করে। এর পরিমাপ ক্রমেই বাড়ায়। বাংলাদেশে গেলো দুই দশকে আমরা সে প্রমাণ পাচ্ছি কড়ায় গ-ায়। একটি নব্য ধনিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। যারা ‘কেমন বাজেট চাই’ মার্কা শেরাটনমুখী অনুষ্ঠান করে রাষ্ট্রের শোষিত শ্রেণীকে ‘টকশো’ দেখায়। লুটেরা শ্রেণীর প্রতিনিধিরা পাশাপাশি চেয়ারে বসে মুচকি হাসে। আমাদের ক্ষমতাসীনরা আশার বাণী শোনান। আর বিরোধীরা ‘কর্তব্যের খাতিরে’ তা খণ্ডন করেন কিছুটা। কারণ তারা জানেন, ক্ষমতায় তারাও ছিলেন। কিছুই করতে পারেননি। আবারো যদি ক্ষমতায় যান তবুও তেমন কিছু করতে পারবেন না। তার কারণ সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই ভোগবাদী।



সমস্যাটা অন্যখানে। বৈষম্যের এই যে কালো পাথর তা কেউ সরাতে চায় না। তারা তা রেখে দিতে চায়। স্তর তৈরি করে মানুষের যাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলতে চায়। বাংলাদেশে অর্থের দাপট এখন যে কয়েকটি ক্ষেত্রকে চরমভাবে দখলে নিয়েছে তার একটি হচ্ছে- শিক্ষা ব্যবস্থা। তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় এখন প্রাইভেট স্কুল, কলেজ সেক্টরগুলো এগিয়ে গেছে বহু গুণ। ফলে গ্রাম থেকে উঠে আসা, গ্রামের স্কুলের মেধাবী ছাত্রটিও এখন আর টিকে থাকতে পারছে না। টাকার খেলা, ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে মেধাবীদের স্বপ্ন।



বেনিয়া গোষ্ঠী কখনই চায় না শ্রমজীবী মানুষ কাজকর্ম করে নিজ পায়ে দাঁড়াক। তারা চায় না মজুর, চাষি, কুলি, মালি, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমারের মতো নিম্ন কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পেশার মানুষরা শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা পাক। এর কারণ হলো বুর্জোয়া শ্রেণী সবসময়ই শ্রমিক শ্রেণীকে ভয় পায়। তাই তারা মনে করে এই শ্রেণী যদি মেরুদ- শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তো সমাজের অলিখিত ‘দাসপ্রথা’ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।



বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। দুঃখের কথা, বাংলাদেশে একটি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় থাকলেও শ্রমিকের ন্যায্য বিচার পাওয়ার জন্য শ্রম আদালত নেই। অথচ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে ফ্যামিলি কোর্টের মতো লেবার কোর্টও একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, একজন শ্রমিক কাজ করে বেতন পাননি এমন অভিযোগ ইউএস লেবার কোর্টে করার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি আমলে নিয়ে আদালত খুব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে শক্তিমান বুর্জোয়া শ্রেণী, দরিদ্র শ্রমিকের টুঁটি এমনভাবে চেপে ধরে, যাতে তারা কথা বলারও সাহস না পান। সময় এসেছে, বড় বুলি না আওড়িয়ে মানুষের শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কাজটি করতে না পারলে রাষ্ট্রের মঙ্গলব্রত সম্ভব নয় কোনোভাবেই।

-------------------------------------------

দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ০১/মে/২০১৪ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.