![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল পরিবর্তন কেন প্রয়োজন
ফকির ইলিয়াস
_________________________________________________
১৯৭১ থেকে ২০১৪। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এর কম সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পারেনিÑ সেটা বলছি না। কিন্তু এই দেশটি আরো শান্তিময় হয়ে উঠতে পারতো। আরো নিরাপদ থাকতে পারতো এ দেশের মানুষ।
একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল বিবর্তন সবসময়ই কাম্য হয়। কারণ নান্দনিক পরিবর্তন, ভাঙচুরের মাধ্যমেই এগিয়ে যায় মানবসমাজ। গেলো এক যুগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ফিল্ডে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বলা যায়। এর পাশাপাশি অবশ্য নানা শঙ্কা-সংকটও বেড়ে উঠেছে নানাভাবে। মনে পড়ছে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয় শওকত ওসমান একটি সেমিনারে বলেছিলেন, সংস্কৃতির আবিষ্কার এবং আগ্রাসন দুটিই আছে। প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা গ্রহণ করবে। আর অভিভাবককে গাইড দিতে হবে সে আলোকেই, তারা তাদের সন্তানদের কী শেখাতে চান। বাংলাদেশে ধনীর দুলালদের বখাটেপনার বেশ কিছু খবর আমরা পত্রপত্রিকায় পড়ছি। এদের কেউ কেউ মাত্র ক’ হাজার টাকার একটি সেলফোনের জন্য মানুষ খুন করতে পর্যন্ত উদ্যত হচ্ছে। মোবাইল ফোনের বিল মেটাতে গিয়ে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি করছে কিশোর-যুবকরা। ভাবলে অবাক হতে হয়, এমন দরিদ্রতম একটি দেশে নাকি প্রায় আট কোটির কাছাকাছি মোবাইল গ্রাহক রয়েছে। কোনো কোনো মধ্যবিত্ত একের অধিক মোবাইল বহন করে। আর উচ্চবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম।
একটি দেশে প্রযুক্তি শিল্পের প্রসার বাড়বে, তা আনন্দের সংবাদ বৈকি। কিন্তু এর পাশাপাশি জনস্বার্থ সংরক্ষণ আইনগুলো কি কঠোরতর করা হচ্ছে? না, হয়নি। হচ্ছে না। মোবাইল ফোনে সংকেত দিয়ে মানুষ খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। অথচ সে ফোন দ্রুত এবং সহজে খুঁজে বের করার ট্র্যাকিং সিস্টেম বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শক্তিশালী এবং পর্যাপ্ত নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষও খুব জোরালো ভূমিকা রাখছে না। একটি দেশে দুর্বৃত্তপনা ছড়িয়ে দেয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে, সে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করা। আজ বাংলাদেশের রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ফেনসিডিলের পর ‘ইয়াবা’ নামের নতুন মাদকদ্রব্য তৈরি, বাজারজাত করার খবর আমরা দেখছি। এদের নেপথ্য হোতা কারা, তাদের শিকড় কতো দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা খতিয়ে দেখা দরকার সরকারের।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন এবং সামাজিক জীবন দুটোই আজ এতোটা বিপন্ন যে, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে ভাবলে লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছা যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর, ক্ষমতাসীন সরকার পক্ষের জবাবদিহিতা করার মতো প্লাটফর্ম অতীতে থাকতো তবে হয়তো দেশ এতোটা লুটেরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি পতিত হতো না। একাত্তরের পরাজিত রাজাকার শক্তি, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নানাভাবে আনুকূল্য পেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। তারাই গলা বাড়িয়ে বলছে, দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী নেই। আর কিছুদিন পর হয়তো তারা বলতে শুরু করবে, মুক্তিযুদ্ধ তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল! এই দেশ তারাই স্বাধীন করেছিল! এই যে সামাজিক আস্ফালন, তা তারা সম্ভব করতে পেরেছে শুধু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতার কারণে।
সংবিধান বলছে, ভূমি-মানুষ-সার্বভৌমত্ব-সমাজ রক্ষা এবং এর উন্নতি সাধন করাই একটি সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এর প্রয়োজনে তাদের যতোটা দরকার জবাবদিহি করতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত দেশে যেসব দল টিকে থাকবে এবং যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের সবারই এ চিন্তাটি মাথায় রাখার সুযোগ উন্মুক্ত হলে পাল্টে যেতে বাধ্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আজাদের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’। হ্যাঁ, নিজ সত্তা নিয়ে অন্যদের সময়ে বেঁচে থাকা বড় দুঃখজনক এবং কঠিন কাজ।
আমরা দেখেছি, ওয়ান-ইলেভেনের সময় বাংলাদেশের বড় বড় নামকরা রাজনীতিক এবং শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা যারা কারাগারে অন্তরীণ হয়েছিলেন, তারা তো অন্যদের সময়ে বেঁচেছিলেন, তা বলতে পারবেন না। তারা ঐ সময় অনেক অঙ্গীকার করেছিলেন। নাকি তাদের ক্ষমতাও ছিল অন্য কোনো নেপথ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে? তা না হলে আজ তাদের পোষ্য হিসেবে দেশে হাজার হাজার সশস্ত্র সন্ত্রাসী বেড়ে উঠলো কী করে? কী করে বিভিন্ন মার্কেটিং, বিলবোর্ড, টেন্ডার ব্যবসার নামে কেউ কেউ হাজার কোটি টাকার নেপথ্য মালিক হলো? সরকার ঘনিষ্ঠরা কিভাবে পুকুরচুরি করলো? বাঙালি জাতির এটা চরম দুর্ভাগ্য, মিডিয়াগুলোও দেয়া হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। বিশেষ করে টিভি মাধ্যম। একটি ভালো সিনেমার বদলে দলীয় পোষ্যদের নির্মিত চলচ্চিত্র, টেলিফিল্ম, নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় গায়ের জোরে। ফলে সুস্থ, মেধাবী নির্মাতারা ক্রমেই মাঠ ছেড়েছেন। গ্রন্থ প্রকাশ এবং বিপণনেও দলীয় পক্ষপাত, পথে নামিয়েছে সৃজনশীল প্রকাশক-লেখকদের। অন্যদিকে নগদকড়ি কামানোর ধান্ধায় প্লট, ফ্ল্যাট, মোবাইল ব্যবসা, ইজারাদারিসহ বিভিন্ন ‘হট’ ব্যবসায় দেশের রক্ষকদের এজেন্টরা বসিয়েছে কমিশনের ভাগ। একটি দেশে যখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় তখন সবাই লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, যা শতভাগই ঘটেছে বাংলাদেশের বেলায়। এই সুযোগে সব শ্রেণীর কালোশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মানুষকে অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত করে রাখার এই যে বনেদি প্রচেষ্টা তা বাস্তবায়িত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রাইভেট স্কুল-কলেজ বনাম সরকারি স্কুল-কলেজের দুটি শ্রেণী বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠলেও সামাজিক শান্তি দু’পক্ষের কেউই পায়নি কিংবা পাচ্ছে না। প্রজন্মের পথচলায় সংস্কৃতির বিবর্তন অবশ্যই অপরিহার্য। কিন্তু সে পথে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং সামাজিক আইনি নিরাপত্তা বিধানও জরুরি। কারণ একটি অন্যটির পরিপূরক। দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এ বিষয়ে সচেতন হলে জাতি তাদের কাছে আরো দায়বদ্ধ থাকবে।
আমাদের সমাজে আমরা দেখি কিছু কিছু পেশা এবং তা থেকে পেশাজীবীর পদবিটিও একটি বিশেষ ভাবমূর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তা শুধু একটি নির্দিষ্ট পেশা বা কাজ হিসেবে নয়, ঐ কাজের সঙ্গে কিছু বিশিষ্ট গুণাবলীর ধারক হিসেবেও। যেমন ‘শিক্ষক’ শব্দটির সঙ্গে সততা, সামাজিক নেতৃত্ব, একইভাবে ‘চিকিৎসক’ শব্দটির সঙ্গে সেবা, মহত্ব এসব গুণাবলী যুক্ত হয়েই ঐসব শব্দ ও পেশায় এক একটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। বাঙালির সমাজ ব্যবস্থায় এক সময় ‘শিক্ষক’ পেশাটি ছিল অত্যন্ত সম্মানীয়। ‘চিকিৎসক’ পেশাটির কথা উঠলেই একজন সেবকের মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে। বর্তমানে সেই ধ্যান-ধারণার বিয়োগাত্মক পরিবর্তন হয়েছে।
মানুষ এই চলমান সময়ে ‘শিক্ষক’ কিংবা ‘চিকিৎসক’ পেশাজীবীদের আর আগের মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখতে দ্বিধাবোধ করেন। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে, এই পেশা দুটিকে কিছু মানুষ খুবই ঘৃণ্য পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষকের যে জ্ঞান-গরিমা থাকার কথা ছিল, তা ধারণ না করে এক একজন শিক্ষক পরিচিত হচ্ছেন এক একজন বিদ্যাবিক্রেতা হিসেবে। পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছিল, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। যেসব কোচিং সেন্টার প্রতারণা করে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের ঠকিয়েছে কিংবা এখনো ঠকাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। প্রাইভেট চিকিৎসা ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারেও বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গিয়েছিল। এ পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান সরকার।
ইউরোপ-আমেরিকাসহ সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এই রেওয়াজ চালু আছে, রোগী যেই হোক তাকে জরুরি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দিতেই হবে। চিকিৎসার বিল কে দেবে তা প্রাথমিকভাবে বিবেচ্য বিষয় কখনই হয়নি। অথচ বাংলাদেশে আমরা দেখি মুমূর্ষু রোগী সামনে রেখে দরদাম হাঁকছেন চিকিৎসক। চিকিৎসকরা সাংবাদিক পেটাচ্ছেন! এমন খবরও আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে। মানুষ স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি হিসেবে বিভিন্ন সৃজনশীল পেশাকে বেছে নেয়। সমাজ লজ্জা পায়, যখন দেখা যায় তেমনি সৃজনশীল কোনো পেশাকে ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ হাসিলে কেউ ব্যবহার করছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে ‘সাংবাদিকতা’ পেশাটিকে একটি মননশীল ধারায় রূপ দিতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু অন্যদিকে এই পেশাকে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেও ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। সামরিক জান্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাড়ি-গাড়িসহ নানা সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি রাজনীতিকদের খাস আনুকূল্যও নিয়েছেন কেউ কেউ।
ভাবতে অবাক লাগে বর্তমানে ধস নামা রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত সাংবাদিক, সম্পাদকরা এখন দুর্নীতিবিরোধী সেজে নানা নসিহত শুনাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষকে। এখন তাদের লেখালেখি, রিপোর্ট দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই এক সময় তারা রাজ সম্পাদক (রাজ্যের পোষ্য সম্পাদক) ছিলেন। এরা আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে তরিকা, বিএনপির আমলে জাতীয়তাবাদী তরিকা গ্রহণ করে ‘রাষ্ট্রের কল্যাণে’ নিজেদের ব্রত রেখেছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপা, তাদের ঢাল মাত্র। এ লজ্জা জাতি রাখবে কোথায়!
রাজনীতিতেও ভারত যে গণতন্ত্র চর্চার ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছেÑ তা কেন অনুসরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ? ভারতের রাজনীতিকরা ‘ভারতবাদী’। তা কংগ্রেস হোক আর বিজেপিই হোক। তা এবারের নির্বাচনেও আমরা দেখেছি। বলে রাখি, পররাষ্ট্রনীতিতেও নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে ভারত। যে যাই বলুক না কেন- ভারত এমন কোনো চুক্তিই করবে না নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে। একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল পরিবর্তন এজন্যই প্রয়োজন- যাতে দেশের মানুষ বিশ্বপরিম-লের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শান্তিতে থাকতে পারে। আজ যারা বাংলাদেশের রাজনীতি-সমাজকে অশান্ত করে তুলেছে, তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। তারপরও রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা এদেরকে কাটগড়ায় দাঁড় করাতে কেন পিছপা হচ্ছে- সেটাই চরম বেদনার বিষয়।
---------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ০৭/জুন/২০১৪ শনিবার
©somewhere in net ltd.