নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সেই মহানায়ক

১৬ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:৪২

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সেই মহানায়ক

ফকির ইলিয়াস

_________________________________



হ্যাঁ, জীবনটা তাঁর অসমাপ্তই থেকে গেছে। দেখে যেতে পারেননি অনেক কিছুই। তারপরও করেছেন একটি মহান কাজ। তিনি বাঙালি জাতিকে একটি রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। এই জাতিসত্তাকে দিয়েছেন আত্মপরিচয়ের সন্ধান।

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম না নিলে পাকিস্তানের গোলামির শিকল থেকে বাঙালিরা মুক্তি পেতো কিনা- সেই প্রশ্ন আরো হাজার বছর পরও উঠবে। আর সেজন্যই তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের আলোর দিশারী।

তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি পড়ে আমরা জেনেছি অনেক ইতিকথা। তিনি ছিলেন একজন মননশীল পাঠকও। নিজ দেশেরই কিছু সেনাসদস্যের হাতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ যে ভোরে তিনি নিহত হলেন তার ঠিক আগের রাতেও তিনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পড়ছিলেন বার্নার্ড শ’র ‘মানব এবং অতিমানব’ বইটি। তিনি কেবল পড়তেনই না, সমস্ত বিশ্বের নামজাদা সব লেখক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদদের মনের ভেতরে উচ্চ সম্মানের আসনে রাখতেন। ভালোবাসতেন বার্ট্রান্ড রাসেল, আব্রাহাম লিঙ্কন, উইন্সটন চার্চিল আর মহাত্মা গান্ধীর লেখা। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে আজ আমরা দেখি তাঁর গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা গড়ে তুলতে কী বিপুল পড়াশোনা ছিল তাঁর! এটা আমাদের জন্য খুব আশ্চর্যের এবং দুর্ভাগ্যের হতো, যদি আমরা আমাদের এই মহান নেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার কোনো স্বহস্তে লিখিত দলিল না পেতাম।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি লেখা হয় জেলখানায় বসে, ’৬০-এর দশকের শেষের দিকে, এমন একটা সময়ে যখন শেখ মুজিব পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। আর এর রাজনৈতিক গুরুত্ব এতোটাই, যা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখা একজন মানুষের বয়ান। সেই সময়ের পাকিস্তানের কথাই এখানে উঠে এসেছে, যখন একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এর গড়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মুছে দেয়া হচ্ছিল।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বইটির নামেই উল্লিখিত এটি বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ জীবনী নয়, বরং এর মাঝে আমরা আমাদের জাতির পিতার জীবনের একটি অংশই পাবো কেবল। কিভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, কিভাবে নেতৃত্ব দিলেন বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের তার উল্লেখ এই বইয়ে নেই, এ বইটি বঙ্গবন্ধুর একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার ইতিহাস। চল্লিশের দশকের শুরুতে অন্য অনেকের মতোই শেখ মুজিবুর রহমান সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের সমর্থন দেন, যাদের রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে অনেকটা অবধারিতভাবে শেখ মুজিব জড়িয়ে পড়েন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে। অসমাপ্ত স্মৃতিকথায় শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর ছায়ায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করেছেন। কিভাবে তখন শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতার জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করছিল। কলকাতা থেকে পাটনা গিয়ে দেখেন, সেখানেও একই অবস্থা। আমরা দেখতে পারি এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা, রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই এতো ধাক্কার পরও শেখ মুজিবের সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা এতোটুকুও কমেনি কখনই। ১৯৬৩-এর শেষদিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত বলা যায় তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত এবং সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। জিন্নাহর প্রতি শেখ মুজিবের শ্রদ্ধার নিদর্শন পেলেও, পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী খানের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল প্রত্যাশিত। শেখ মুজিবের বুঝতে দেরি হয়নি এই উদ্ধৃত রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক বাস্তবতায় অজ্ঞতার কথা। ১৯৪৯ সালে, যে বছর কিছু অসন্তুষ্ট বাঙালি মুসলিম লীগ নেতা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত করেন, লিয়াকত ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ কী, তা তিনি জানেনই না!

সেই ১৯৪৯ সালেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিকের সূত্রপাত ঘটে, যেসব দিক পরবর্তী বছরগুলোতে তাঁর জীবনে অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে থাকবে। পুলিশ ক্রমাগত তাঁর পিছে লেগে থাকে; সরকার আওয়ামী মুসলিম লীগের ওপর আরোপ করে কড়া বিধিনিষেধ। এক পর্যায়ে পুলিশ যখন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হকের ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, ভাসানী মুজিবকে বলেন, পুলিশের কাছ থেকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। তিনি শেখ মুজিবকে আরো বলেন লাহোরে গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলাপে বসার জন্য। শেখ মুজিব মাত্র দুই রুপি সঙ্গে নিয়ে লাহোরে যান এবং গিয়ে দেখেন সোহরাওয়ার্দী সেখানে নেই, ফিরবেনও না আরো কিছু দিন। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী ফিরলে মুজিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তাঁর প্রিয় নেতা লাহোরের তীব্র শীতে কাঁপতে থাকা মুজিবকে গরম কাপড় দেন পরার জন্য।

এরপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুজিব যুক্তফ্রন্টের হয়ে অংশ নেন। যুক্তফ্রন্ট নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে হারায়। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক যেদিন শেখ মুজিব কেবিনেটে যোগ দেন, ঠিক সেদিনই কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে আদমজী জুটমিলে হত্যা করা হয় কমপক্ষে পাঁচশ জন বাঙালি ও অবাঙালিকে। কিছুদিন পর বিশেষ আইন জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়। কোনো মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী প্রতিবাদে একটা কথা বললেন না। মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবই গ্রেপ্তার হন।

এভাবেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটির বর্ণনা সারা বইটি জুড়ে। আছে অসংখ্য মানুষের পরিচয়, মুজিবের প্রাথমিক রাজনৈতিক ভাবনা, সবকিছুই এক সুখপাঠ্য ভাষা ভঙ্গিতে। বইটা পড়ে শেষ করবার পরই যে কারো মনে হবে, যদি শেখ মুজিব তাঁর জীবনের পুরোটুকুই লিখে যেতে পারতেন! সত্যিই এই মহান রাজনীতিকের জীবনের তুলনায় বড় বেশি ক্ষুদ্র এর আয়তন। তবু আমরা এ গ্রন্থে পাই এই মহান নেতার এক তরুণ রাজনীতিবিদ থেকে একজন জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার পেছনের গল্প। বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ধর্মভীরু নেতা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বইতে তাঁর ইসলামপ্রিয়তা সম্পর্কে বেশ তথ্য পাওয়া যায়। ভাসানীর সঙ্গে এক জেলে থাকার বর্ণনায় তিনি বলেন ‘মওলানা সাহেবের সঙ্গে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কুরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল’। জেল জীবনের সময়-পার সম্পর্কে বলেন ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কুরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কুরআন শরিফের বাংলা তর্জমাও কয়েক খ- ছিল আমার কাছে’।

তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল সম্প্রীতির। আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর সহযোদ্ধা, প্রতিপক্ষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বস্তুনিষ্ঠ প্রশংসা ও সমালোচনা করেছেন তিনি বইটিতে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানের জন্ম এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের অবদানকে তুলে ধরার পাশাপাশি সময় সময় তাঁদের দুর্বল চিত্ত, দোদুল্যমান মনোভাব এবং যুক্তফ্রন্টে নেতৃত্ব দানে ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনা করেছেন। অপরপক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদার, ত্যাগী, অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বকে বাহবা দিলেও তাঁর অতি উদারতাকে খাজা নাজিমুদ্দীন গংদের নেতৃত্বে আসার অন্যতম ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখিয়েছেন (১৯৩৭ এর নির্বাচনে শহীদ সাহেবের সিটে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে নাজিমুদ্দীনকে জেতানো হয়)। তাঁর মতে ‘উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সঙ্গে উদরতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি হয়।’ খান আতাউর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ইয়ার মোহাম্মদ খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামছুল হক সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ সহযোদ্ধাদের অবদান বইয়ের পৃষ্ঠায় বারবার এসেছে। আজকের এই বাংলাদেশ গড়ে উঠতে যে পথপরিক্রমা পার হতে হয়েছে, তার বর্ণনা আছে শেখ মুজিবের জবানীতে। পড়া যাক তাঁর লেখার কিছু অংশ।তিনি লিখছেনÑ

“১৯৫০ সাল। আমরা দিন কাটাচ্ছি জেলে। তখন আমাদের জন্য কথা বলারও কেউ ছিল বলে মনে হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর থেকে একটা বিবৃতি দিলেন। আমরা খবরের কাগজে দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে মওলানা সাহেব ও আমি খুব বিপদে পড়লাম। তাঁর স্বাস্থ্যও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় বাইশ পাউন্ড ওজন কম হয়ে গেছে। তারপরও রাতভরই জিকির করেন। মাঝে মাঝে গরমের দিন দুপুরবেলা কম্বল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। মওলানা সাহেব ও আমি অনেক আলোচনা করলাম। আর কিছুদিন থাকলে পাগল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দুএকদিন আমার ওপর রাগ হয়ে বলে, ‘আমাকে না ছাড়লে বন্ড দিয়ে চলে যাবো। তোমার ও ভাসানীর পাগলামির জন্য জেল খাটবো নাকি?’ একদিন সিভিল সার্জন আসলে মওলানা সাহেব ও আমি শামসুল হক সাহেবের অবস্থা বললাম। তার যেভাবে ওজন কমছে তাতে যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। তিনি বললেন, ‘সরকার আমার কাছে রিপোর্ট না চাইলে তো আমি দিতে পারি না অথবা হক সাহেব দরখাস্ত করলে আমি আমার মতামত দিতে পারি।’ শামসুল হক সাহেব এক দরখাস্ত লিখে রেখেছিলেন, আমি ওটা দিতে নিষেধ করলাম, তিনি আমার কথা রাখলেন। তিনি আরেকটা লিখলেন মুক্তি চেয়ে, স্বাস্থ্যগত কারণে। যদিও দুর্বলতা কিছুটা ধরা পড়ে, তবুও উপায় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব সত্যিই তার শরীর যে খারাপ হয়ে পড়েছিল তা লিখে দিলেন। পাঁচ-সাত দিন পরেই তার মুক্তির আদেশ আসলো। তিনি মুক্তি পেয়ে চলে গেলেন। ভাসানী সাহেব ও আমি রইলাম। কোর্টে হক সাহেবের সঙ্গে আমাদের দেখা হতো। সরকার ভাবলো, হক সাহেবের মতো শক্ত লোক যখন নরম হয়েছে তখন ভাসানী এবং আমিও নরম হবো। আমার মেঝ বোন (শেখ ফজলুল হক মণির মা) ঢাকায় থাকতেন, আমাকে দেখতে আসতেন। আমি বাড়িতে সকলকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, তবুও আব্বা আমাকে দেখতে আসলেন একবার।

একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেতে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, ‘নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউই নাই। আমি কী আর করতে পারবো, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কী বলেন।’ আমি বললাম, “মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ বোধহয় থাকবে না।” আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, ‘না, যাবো না আপনাদের জেলে রেখে।’

মওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মানিক ভাইকে বললেন, ‘কী করে চলবে, টাকা কোথায়, তবুও চেষ্টা করে দেখবো।’ আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম, ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন তবুও বাংলাদেশকে ও তার জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন। আমার কথা বললে কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে, কাগজ তিনি চালাবেন। কাগজ বের করলেন। অনেক জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল। নিজেরও যা কিছু ছিল এই কাগজের জন্যই ব্যয় করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কাগজটা খুব জনপ্রিয় হতে লাগলো। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাঁকে সাহায্য করতে লাগলো। এ কাগজ আমাদের জেলে দেয়া হতো না, আমি কোর্টে এসে কাগজ নিয়ে নিতাম এবং পড়তাম। সমস্ত জেলায় জেলায় কর্মীরা কাগজটা চালাতে শুরু করলো। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের কাগজ হিসেবে জনগণ একে ধরে নিলো। মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালোবাসতেন, বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিস্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন। নিজেই ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে ছাত্রলীগের দুই-তিনজন কর্মী সাহায্য করতো। টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমার বন্ধুই তাঁকে বেশি সাহায্য করতেন। বিজ্ঞাপন পাওয়া কষ্টকর ছিল, কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য কোথায়? আর সরকারি বিজ্ঞাপন তো আওয়ামী লীগের কাগজে দিতো না। তবুও মানিক ভাই কাগজটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন একমাত্র তাঁর নিজের চেষ্টায়।”

এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস, এ দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস এভাবেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন জাতির জনক।

রাজনীতিতে টানাপড়েন সে সময়ও ছিল। তিনি লিখছেনÑ “১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সম্পাদক হন। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মনোনীত ছিলেন। আর খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খুলনার আবুল কাশেম সাহেব। হাশিম সাহেব তাঁকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন। এর পূর্বে সোহরাওয়ার্দী সাহেবই সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকরা মুসলীম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকেও লীগে আসতে দিতো না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।” [অসমাপ্ত আত্মজীবনী:: পৃ: ১৭ ]

আজো আমরা আওয়ামী লীগের সেই পরিণতি কি দেখছি না? কেন দেখছি? এর জবাব আমাদেরকে খুঁজে নিতে হবে। সেই সৌহার্দ্যরে রাজনীতি আজ বিরল। শেখ মুজিব যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ আমাদেরকে খুঁজে পেতে হবে। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর আদর্শকে হত্যা করা যায়নি। তা প্রতিদিনই প্রমাণিত হচ্ছে। আর তাঁর মৌলিক চেতনাকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গঠন করা সম্ভব তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

---------------------------------------------------

দৈনিক ভোরের কাগজ॥ ঢাকা ॥: ১৬/আগস্ট/২০১৪ শনিবার প্রকাশিত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.