![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের দেশে যে সব মানুষ কাজের যাবার উদ্দেশ্যে, চিকিৎসা কিংবা লেখাপড়ার প্রয়োজনে, মামলা মোকদ্দমায় হাজিরা দিতে অথবা আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে যাবার জন্যে পথে বের হন প্রতিদিনই তাদের মধ্যে দু চারজন, এমন কি কখনো কখনো দশ বারজন শেষপর্যন্ত আর বাড়িতে ফেরেন না। নিয়তি নির্ধারিত গন্তব্য হিসাবে হাসপাতালের লাশকাটা ঘর হয়ে কবরে অথবা শ্মশান ঘাটে পৌঁছে যান তাঁরা। ভাগ্যবানদের ক্ষেত্রে নিকটজনের চোখের পানি এবং আহাজারি জুটলেও হতভাগ্যদের বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে সৎকারের ব্যবস্থা করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এই যখন আমাদের সড়ক পথে চলাচলের নিত্যদিনের চিত্র তখন সড়ক মহাসড়কের হত্যাকা-গুলো এক রকম গা সওয়া বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নিহত অথবা আহত ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজন ছাড়া এ সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
সম্প্রতি নাটোরের বড়াইগ্রামে একটি মাত্র ‘দুর্ঘটনা’য় একসঙ্গে ৩৬ জন মানুষের প্রাণহানির ফলে সম্ভবত সরকারের কোনো একটি বা একাধিক কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। টনক জিনিসটি কি এবং কর্তৃপক্ষের টনক কিভাবে নড়ে তা আমার জানা নেই, তবে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রতিবেদন উপস্থাপন করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রিপোর্টে ‘দুর্ঘটনা’ কবলিত অথৈ পরিবহন ও কেয়া পরিবহনের চালক ও সহকারী এবং পরবর্তীতে সড়কে পড়ে থাকা আহত যাত্রীদের উপর দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে নতুন হত্যাকাণ্ড ঘটাবার জন্যে হানিফ পরিবহনের একটি বাসের চালককে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনটি বাসের মালিককেও সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে যথার্থ বলে ধরে নিয়েও প্রথমেই বিবেচনা করা যেতে পারে প্রতিবেদনে উল্লিখিত ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ আদৌ কোনো দুর্ঘটনা কিনা! আভিধানিক অর্থে ‘দুর্ঘটনা’ হচ্ছে সচারচর ঘটে না এমন কোনো আকস্মিক এবং অনভিপ্রেত ঘটনা, সংঘটিত অনিচ্ছাকৃত ও অমঙ্গলজনক পরিস্থিতি ইত্যাদি। যে কোনো সভ্য দেশে সকল সাবধানতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরেও যদি আকস্মিক এবং অনিচ্ছাকৃত কোনো অমঙ্গলজনক ঘটনা ঘটে যায় তাহলেই তাকে দুর্ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু যেখানে প্রথম দুটি বাহনের কোনোটিরই ফিটনেস নেই, রাস্তায় চলাচলের রুট পারমিটি নেই, এমন কি একটি গাড়ির নম্বর প্লেটে লাগানো নম্বর পর্যন্ত ভুয়া- সেখানে ৩৬ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে হানিফ পরিবহনের গাড়িটির চালক ও তার সহকারী। প্রথম ঘটনাটি দুর্ঘটনার মোড়কে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা কিছুটা সফল হলেও হানিফ পরিবহনের চালকের অপরাধ অমার্জনীয়।
‘সড়ক দুর্ঘটনা’র জন্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে এককভাবে চালককে দায়ী করা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান প্রতিবেদনে মালিককেও দায়ভার থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, মালিক তো গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে মহাসড়কে উপস্থিত ছিলেন না, তাহলে তাকে কেন এর সাথে সম্পৃক্ত করা হলো! যে মালিক বৈধ কাগজপত্র ছাড়া তার ফিটনেস বিহীন এবং ভুয়া নম্বরপ্লেট যুক্ত গাড়ির চাবি চালকের হাতে তুলে দিতে পারেন দায়িত্বের প্রধান দায়ভার তার ওপরেই বর্তায়। তবে আমাদের দেশে খুনির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যেমন প্রকৃত অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, অথবা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোঁকর গলে বেরিয়ে আসে এই ঘটনাতেও শক্তিশালী পরিবহন মালিকদের গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না সে কথা মামলা শুরু হবার আগেই বলে দেয়া যায়।
ঘটনার শুরুতেই অথৈ পরিবহনের চালক পঁয়ত্রিশজন যাত্রীসহ আইন ও শালিসের উর্ধ্বে চলে গেছেন। হানিফ পরিবহনের বাস ও তার চালককে সনাক্ত করাই সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শেষপর্যন্ত আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত করানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। অন্যদিকে নিহতের পরিবার প্রতি সরকারের দেয়া এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ভিন্ন আর কোথাও থেকে কোনো সাড়া লক্ষ করা যায়নি। দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের জীবনের মূল্য খুব সামান্য ধরে নিলেও ঘটনার মূল দায়ভার যাদের ওপর বর্তায় সেই মালিক পক্ষও এ ব্যাপারে নিরব থেকে কৌশলে দায়িত্ব এড়াবার চেষ্টা করছেন।
কমিটির তাঁদের দেয়া সুপারিশমালার শুরুতেই গাড়ি চালকদের লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বিআরটিএকে দায়িত্বশীল হবার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ বিআরটিএ যে দায়িত্বশীল কোনো কর্তৃপক্ষ নন সে কথাই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকদের যোগ্যতা পরীক্ষা না করে তাদের হাতে দুর্ঘটনাজনিত হত্যার লাইসেন্স তুলে দেন সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এই কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা কর্মচারী এবং তাদের নিয়োজিত দালালদের দৌরাত্মে যানবাহনের মালিক, বিশেষ করে হালকা যানবাহনের প্রকৃত মালিক ও যোগ্যতা সম্পন্ন চালকদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। অন্যদিকে শুধুমাত্র নগদ অর্থের বিনিময়ে ফিটনেস বিহীন গাড়িকে চালাচলের উপযোগী হিসাবে ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দায়িত্ব পালনে পিছপা হন না তাঁরা।
সড়ক পরিপহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট হাতে পাবার পরপরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ‘দুর্ঘটনা’র জন্য দায়ী বাস মালিক, চালক ও সহকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের কথিত ‘আইনানুগ’ ব্যবস্থায় আইন নিশ্চয়ই তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সড়কে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইনের গতি সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরসহ পাঁচজন নিহত হবার বহুল আলোচিত মামলার শুনানি শুরু হয়েছে ঘটনার তিন বছর পরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর। মামলার ৩৯ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে এবং পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ১৬ নভেম্বর। অর্থাৎ মামলাটির নিষ্পত্তি কবে হবে, আল্লা মালুম!
বিচারে বিলম্ব যে ন্যায় বিচার পাবার ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সে কথা জানার পরেও আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের আশ্বাসে আস্থা রাখতে চাই। সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে আগামীতে হয়তো সড়ক মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের মধ্যে আরও অনেকেই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
©somewhere in net ltd.