নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায় ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিকে এক উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যঞ্জনা দান করা হয়েছে । তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী একটি মতলববাজ মহল এই শব্দটিকে অসৎ ব্যঞ্জনা দিয়ে এ জাতির মধ্যে অকারন বিভেদ ও বৈষম্যকে উস্কে দিতে চাচ্ছে ।
পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে বাদ দিলে আমাদের বাঙালী জাতিসত্ত্বা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে নিয়ে গঠিত হয়েছে । ঐতিহাসিক কারনে এ জাতিসত্ত্বায় ওপার বাংলায় হিন্দুরা প্রধান শক্তি হলেও এপার বাংলায় মুসলমানরা প্রবল । তবুও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত গাঙেয় বদ্বীপ এই সোনার বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পারস্পরিক আন্তরিকতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অনন্য নজির স্থাপন করে এক অখন্ড ও অবিভক্ত জাতি হিসাবে বহুকাল ধরে টিকে আছে ।
সামাজিক জীবনে কিছু কিছু খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে বাদ দিলে নিজেদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বোধ করি না আমরা এ জাতির বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষরা । ধর্মীয় পরিচয়টুকু বাদ দিলে স্বভাবে, চরিত্রে, আবেগে, অনুভূতিতে, চিন্তায়, চেতনায়, মননে তেমন কোন ফারাক নেই আমাদের মধ্যে । এই বাংলার, আকাশ, বাতাস, মাটি, জল আমাদেরকে একইভাবে প্রভাবিত করেছে, একই ছাঁচে আমাদের বৈশিষ্ঠ্যগুলো গড়ে উঠেছে, একইভাবে বেড়ে উঠেছি আমরা ।
ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য দু’ দশটি মানব সমাজের মতো এ জনপদেও দেখা যায় পারস্পরিক বিবাদ, বিসম্বাদ, মনোমালিন্য, প্রতারনা, জুলুম, নির্যাতন । দেখা যায় দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার । মূলতঃ এসব যে কোন মানব সমাজেরই স্বাভাবিক আচরনের অংশ, চিরন্তন ও অনাকাংখিত বাস্তবতা । বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশে এ বাস্তবতা আরও তীব্রভাবে প্রকট ।
এ দেশের বঞ্চিত, অত্যাচারিত এবং অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার মানুষদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ সকল ধর্মের মানু্ষই অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমান ছাড়া অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা কখনও এ ধরনের অনাকাংখিত ঘটনার শিকার হলে এ দেশের একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল এসব ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জিত করে, এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিকৃতভাবে, প্রচার করার মাধ্যমে নিজেদেরকে ঐসব অপ্রধান ধর্মীয়গোষ্ঠীগুলির কাছে অতি দরদী ও হিতাকাঙ্খী বন্ধু হিসাবে প্রমান করতে উঠে পড়ে লেগেছে কিছুকাল যাবৎ ।
এই কুচক্রী মহলটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মিথ্যা দোহাই দিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশের অপ্রধান ধর্মাবলবম্বীদেরকে ‘সংখ্যালঘু’ অভিধায় আখ্যায়িত করে তাদের অধিকারকে সাধারন ও জাতীয় অধিকার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে । আর এভাবেই তারা আবহমান কাল ধরে চলে আসা এক ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজে অনৈক্য ও অশান্তির বীজ বপন করতে চাইছে, উস্কে দিতে চাইছে অনুদার ও উগ্র এক সাম্প্রদায়িক চেতনাকে ।
ধর্মহীন বা ধর্মবিদ্বেষীদের নিয়ে গঠিত এই মহলটি ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করে মূলতঃ ধর্মে ধর্মে বিভেদ ও শত্রুতা তৈরীর মিশনে নেমেছে । প্রকৃতপক্ষে এরা কোন ধর্মেরই বন্ধু নয় ।
একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মানসিক ক্রীতদাস এই মতলববাজ মহলটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধুয়া তুলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করছে বিভিন্ন ধর্মালবম্বী মানুষের মধ্যে, বিশেষভাবে মুসলমানদের সাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের । এর ফলে মিছেই ভীত, সন্ত্রস্ত ও অসহায় বোধ করছে ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীরা । নিজেদেরকে বিপন্ন ‘সংখ্যালঘু’ ভেবে মনে মনে একঘরে হয়ে যাচ্ছে তারা । চিড় ধরছে হাজার বছরের লালিত এদেশের অখন্ড বাঙালী জাতিসত্ত্বায় ।
ঐ কুচক্রী মহলের ধূর্ত কারসাজিতে বিয়াল্লিশ বছরের পুরানো দুঃখজনক ও অনাকাংখিত এক ঘটনা ভয়ংকর ‘জুজু’ হয়ে ‘সংখ্যালঘু’দের মনে ভয় ও অনিশ্চয়তা ছড়াচ্ছে । ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে যেভাবে ভয়ে চমকে উঠে, ঠিক সেভাবেই ভয়ে স্বাভাবিক হতে পারছে না তারা । এ দেশকে আপন ভাবার মনের জোর হারিয়ে ফেলছে তারা ক্রমশঃ ।
অথচ শুধুমাত্র হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিপন্ন বোধ করা অপ্রধান ধর্মানুসারী এই মানুষগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহন করা হচ্ছে । কারন যতই তারা ভীত ও বিপন্ন বোধ করবে, ততই দরদী ভালমানুষ সেজে তাদের আন্তরিক ভালবাসা ও আস্থা অর্জন সম্ভব হবে ঐ দুর্জনদের ।
আর এজন্যই সাম্প্রতিক কালে রহস্যজনকভাবে অপ্রধান ধর্মাবলম্বীদের জীবন ও সম্পদ ‘অজ্ঞাত’ দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে বারবার । শুধু তাই নয়, এইসব অনাকাংখিত ঘটনা ঘটার সংগে সংগেই বিশেষ কুচক্রী মহলটির সরব হয়ে উঠা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনরূপ প্রমানাদি ব্যতিরেকেই তাৎক্ষনিকভাবে এসবের দায়ভার একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা আজকাল একটি নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে ।
নদীতে ঝাঁক বেধে চলা কিছু খুদে মাছকে ধরার জন্য জেলেরা এক দিকে জাল পেতে উল্টো দিকে গিয়ে নৌকো থেকে বিশেষ কায়দায় শব্দ করতে থাকে । এই ছন্দময় শব্দ শুনে প্রাণভয়ে ভীত মাছেরা উল্টো দিককে নিরাপদ ভেবে পালাতে গিয়ে সদলবলে ধরা পড়ে জেলেদের মিহি জালে । ভীতি সঞ্চার করার মাধ্যমে নিজেদের পাতা জালে বিপন্ন বোধ করা মাছদেরকে টেনে নিয়ে আসার এই চতুর কৌশল বাংলার জেলেরা অনাদিকাল থেকে ব্যবহার করে আসছে । বাংলাদেশের ‘সংখ্যলঘু’প্রেমী ধূর্ত মহলটিও এই একই কায়দায় অপ্রধান ধর্মাবলম্বী মানুষদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তাদেরকে নিজেদের স্বার্থের জালে বন্দী করতে চাইছে বলেই বিশ্বাস করেন অনেকে আজ ।
দেশব্যাপী প্রায়ই ঘটে যাওয়া এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান কিছু মানুষ এই তিক্ত সত্যটিকে যে বুঝতে পারে না তা নয়, কিন্তু আড়ালে থাকা এক নীরব রক্তচক্ষুর ভীতিকর শাসন অথবা নগদ সুবিধার রসালো লাড্ডু তাদের প্রতিবাদী মুখকে বন্ধ করে রাখছে ।
বলতে দ্বিধা নেই, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় হয়তো আসবে যখন আমাদের জাতিসত্ত্বার অন্যতম প্রধান শক্তি মুসলমানরা নিজেদের প্রতি করা ভিত্তিহীন সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনাস্থায় বিব্রত, বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে সত্যি সত্যি অন্যান্য অপ্রধান ধর্মাবলবম্বীদেরকে একঘরে করার মাধ্যমে বিমাতাসূলভ আচরনে তাদের জীবনকে দুঃসহ করে তুলবে । তখন তাদের সাহায্য ও উদ্ধারের জন্য মোটেও খুঁজে পাওয়া যাবে না সেইসব শকুনি মামাদেরকে আজ যারা অতি দরদে কথায় কথায় তাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছেন ।
সত্যিকারের বৈষম্য ও অশান্তি তখন অস্থির করে তুলবে এই শান্তিপ্রিয় জনপদের জীবনকে, অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠবে অকারনে ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করা মানবগোষ্ঠীর ।
উপসংহার টানতে চাই এইটুকু বলে যে, দুর্জনের দুর্বুদ্ধিতে প্ররোচিত না হয়ে, চিলে কান নিয়েছে শুনে নির্বোধের মতো ছুটতে না শুরু করে, সুস্থ বিচার-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ব্যবহার এবং পরিস্থিতির নিরাবেগ বিশ্লেষন করার মাধ্যমে এ সমাজের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতিটুকু অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আজকের ‘সংখ্যালঘু’ অভিধা অর্জন করা বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকেই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে ।
--মু, আমজাদ হোসেন ।
২০ শে নভেম্বর ২০১৩ খৃষ্টাব্দ ।
©somewhere in net ltd.