নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘এই নাও ভালোবাসা,’
ধপ্ করে বাজার ভর্তি ব্যাগ মেঝের উপর ফেলে বললাম গিন্নীকে ।
গিন্নী বাজারের ব্যাগ খুলে এক এক করে বের করতে লাগলো টম্যাটো, গাজর, শিম, ফুলকপি, আলু, মটরশুঁটি, রুই মাছ । আমার আরেক হাতে ছিল ছোট্ট একটা পলিথিনের ব্যাগ । তাতে ছিল বিস্কুট, চকোলেট, চিপস্ আর কমলা । সে ব্যাগ ইতোমধ্যে হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিজেরাই খুলে ফেলেছে আমার ছ’ এবং সাড়ে তিন বছরের দু’ ছেলে-মেয়ে । তারপর মুখে চকোলেট ফেলে আর চিপস্ এর প্যাকেট ছিঁড়ে ধেই ধেই করে নাচ জুড়েছে ঘরময় ।
গিন্নী মুখ কালো করে বললো,
'এই তোমার ভালোবাসা ? আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস । কয়েকটা গোলাপতো অন্তত আনতে পারতে ! সব প্রেমিক প্রেমিকারা আজ একে অন্যকে ফুল দিয়ে ‘আই লাভ ইয়্যূ’ বলে ভালোবাসা প্রকাশ করবে ।
বিয়ের পর দু’একবার বলা ছাড়া তোমার মুখ দিয়ে আর কখনো কি বেরিয়েছে ‘আই লাভ ইয়্যূ’ ?
ধ্যত্ ! তুমি আসলেই একটা বেরসিক ।'
আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘আমার ভালোবাসা মুখের নয় গো, নগদে । গোলাপের ভালোবাসাতো পেট ভরায় না । ফুলকপি, শিম, টম্যাটোর ভালোবাসা পেট ভরায় ।'
‘হুহ্’ বলে মুখ বাঁকিয়ে অবজ্ঞার ভেংচি কেটে চলে গেল আমার স্ত্রী । বাচ্চারা অবশ্য নগদ ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দে ইতোমধ্যে কয়েকবার চকাম্ চকাম্ করে গালে চুমু বসিয়ে দিয়ে গেছে ।
কি করে বুঝাই আমার গিন্নীকে যে, ভালোবাসাতো কেবলমাত্র মুখের মিষ্টি কথায় উজার করে ঢেলে দেয়ার বস্তু নয় । ভালোবাসা এক দায়িত্বশীলতার নাম । ভালোবাসায় গভীর মমত্ববোধ থেকে আপনজনের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় । সারাক্ষন তাদের কল্যান কামনায় ব্যাকুল থাকতে হয় । কিছু গোলাপ আর মিষ্টি কথা মাঝে মাঝে ভালোবাসাকে সুবাসিত করলেও, কানে সুধা ঢাললেও চিরকাল তা ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না ।
কি করে বুঝাই তাকে যে, অবিবাহিত প্রেমিক প্রেমিকার যে রোমান্টিক ভালোবাসা সেতো প্রকৃত ভালোবাসা নয় । সেতো এক অন্ধ ও প্রবল ভাবাবেগের প্রচন্ড বিস্ফোরন মাত্র । শরীরী আকর্ষনের এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ । ক্ষনিকের মুগ্ধতা থেকে যার জন্ম ।
তাদের ভালোবাসা সদ্য রোপন করা চারাগাছের মতো । সকাল-বিকাল তার পরিচর্যা করতে হয়, পানি ঢালতে হয় । নইলে কচি সে ভালোবাসা শুকিয়ে যায়, নেতিয়ে গিয়ে মরে যায় ।
কিন্তু গভীর ও পরিনত ভালোবাসা এক সুবিশাল বৃক্ষের মতো । হৃদয়ের অনেক গভীরে যার শেকড় ছড়িয়ে থাকে । সে ভালোবাসাকে ‘আই লাভ ইয়্যূ’র ঠুনকো মন্ত্রে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখার কসরৎ করতে হয় না । উল্টো সে বিশাল ভালোবাসাই তার ঘন ও শীতল ছায়া আর সুমিষ্ট ফল দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, জীবনকে সুন্দর ও মধুময় করে তোলে ।
ভালোবাসা হৃদয়ের ব্যাপার, মুখের নয় । হৃদয়ে ভালোবাসা কম থাকলেই বারবার তা মুখের ভাষায় ব্যক্ত করতে হয়, জাহির করতে হয় । ভালোবাসার মানুষের আস্থাটি সারাক্ষন ধরে রাখার চেষ্টা করতে হয় । কখন সামান্য আঘাতে কাঁচের মতো সে ভালোবাসা ঝনঝন করে ভেঙে যায় সে ভয়ে অহোরাত্রি অস্থির থাকতে হয় ।
আল্লাহ্র পর পৃথিবীতে মানুষকে সবচে’ বেশী ভালোবাসে যে মা-বাবা, কই তারাতো সন্তানকে প্রতিদিন বা কোন বিশেষ দিবসে ‘আই লাভ ইয়্যূ’ বলে সন্তানের জন্য তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন না ।
ভালোবাসার মানে যদি হয় কল্যান করা এবং কল্যান কামনা করা তবে সামান্য ফুল কিংবা মুখের মিষ্টি কথায় নয়, কর্ম ও আচরনেই তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে । সন্তানের জন্য বাবা-মা’র চরম আত্মত্যাগ আর প্রার্থনাতেই মিশে থাকে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট ভালোবাসাটি ।
সংসারে এই যে পুরুষটি সারাদিন খেটেখুটে জীবিকা নির্বাহ করছে, স্ত্রী-সন্তানদের প্রয়োজনগুলি পূরণ করছে, তা-তো নিখাঁদ ভালোবাসার বৃক্ষ থেকেই জন্ম নেয়া সুমিষ্ট ফল । অন্যদিকে স্ত্রীটি দিনরাত রান্নাবান্না করা থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম, আর সন্তান লালন-পালন করার মতো কঠিন যে কাজগুলি অম্লান বদনে করে যাচ্ছে সেওতো অকৃত্রিম ভালোবাসারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ।
মূলতঃ ভালোবাসা কোন এক বিশেষ দিনে বিশেষভাবে প্রকাশ করার বস্তু নয়, আমৃত্যু হৃদয়ে ধারন করে কর্মে ও আচরনে উজার করে ঢেলে দেয়ার বস্তু ।
--মু, আমজাদ হোসেন ।
১৪ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ খৃষ্টাব্দ ।
©somewhere in net ltd.