নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মু, আমজাদ হোসেন

মানুষ পশুকে তখনই ছাড়িয়ে যায় যখন সে অন্য মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবে । আমি একজন মানুষ ।

মু, আমজাদ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন প্রিজাইডিং অফিসার বলছি ।

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৫০

সকাল ৮ টার মধ্যেই আমার কেন্দ্রের ৭টি বুথ ভোট গ্রহনের জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত ।

কিন্তু বাইরে গিয়ে আমারতো আক্কেল গুরুম । সব শুনশান ফাঁকা ! ভোটারদের কোন লাইন দূরে থাক কোন ভোটারের টিকিটিও কোথাও দেখা যাচ্ছে না ।



আগের দিন চৈত্রের ভয়াবহ তাপদাহে উপজেলা নির্বাচনী অফিসের চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর সময়ন্বয়হীনতায় নির্বাচনী মালামাল সংগ্রহের জন্য ৫ ঘন্টার উপর দুঃসহ ছুটাছুটি আর ক্লান্তিকর অপেক্ষা, ভ্যাপসা গরমে বিদ্যুতহীন অন্ধকার কেন্দ্রে দরদর করে ঘামতে ঘামতে কেন্দ্র প্রস্তুত করা এবং প্রায় নিদ্রাহীন ও উদ্বিগ্ন রাত কাটানোর পর ভোটারদের এই অপ্রত্যাশিত অনুপস্থিতি দেখে থ’ বনে গেলাম । এর পূর্বে জীবনে ছ’ বারের মতো প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বপালন করার সময় আর কখনো এমন অভাবনীয় অভিজ্ঞতা ঘটেনি আমার ।



কিন্তু হায়, কে জানতো আরো কত বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে সামনে !



আগের দিন রাত দশটার পর এই প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষাবঞ্চিত কর্মক্লান্ত মানুষের কাঁচা ঘুমকে চূর্ন করে দিয়েছিল দিকবিদিক কাঁপিয়ে হঠাৎ বিস্ফোরিত হওয়া দশ বারোটি ককটেলের পিলে চমকানো শব্দ । এখন বুঝতে পারলাম, সেগুলো ছিল দেহাতি ও সরল মানুষদের ভোটাধিকার প্রয়োগের খায়েসের প্রতি এক প্রচ্ছন্ন চোখ রাঙানি ।



তবুও বেলা বাড়ার সাথে সাথে দু’চার জন বোকা এবং সাহসী ভোটার আসতে লাগলো । কিন্তু প্রতিটি বুথেই কিছু সরকারসমর্থক এজেন্ট এবং মাসলম্যান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোটারদেরকে তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যালটব্যাপারে সিল মারতে বাধ্য করতে থাকলো ।



আমার সহকারীরা দু’চারজন ছুটে এসে নালিশ জানালো তৎক্ষনাৎ । আমি পুলিশকে কঠোর হাতে শৃংখলা বিধানের নির্দেশ দিলাম । কিন্তু ততক্ষনে পুলিশকে ক্ষমতাধর সরকার দলীয় জেলা পর্যায়ের নেতা ফোন করে সাহায্য কামনা করে ফেলেছে । পুলিশ সবিনয়ে ও বিব্রত হয়ে আমাকে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানালো ।



ইতোমধ্যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে গেছে । আমার সকল নির্বাচনী কর্মকর্তাদেরকে বুথ থেকে থেকে বের করে দিয়ে সরকারসমর্থকরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার উৎসব শুরু করে দিয়েছে । আমি উঁকি দিয়ে সে দৃশ্য একবার দেখে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্রোধে বিহ্বল হয়ে পড়লাম ।



তৎক্ষনাৎ ফোন করলাম সহকারী রিটার্নি অফিসার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে । দু’চারবার ব্যর্থ হওয়ার পর সফল হলাম । তিনি বিব্রত কন্ঠে বললেন, ‘কী করবেন বলুন ? বুঝেনইতো অবস্থা । যদি অবস্থা বেশী খারাপ দেখেন তবে ভোট বন্ধ করে দিন’ ।



বেশী খারাপ বলতে তিনি কী বুঝালেন আমি বুঝলাম না । আমি ফোন করলাম আমার কয়েকজন কলিগ ও বন্ধুদেরকে যারা অন্যান্য কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে ভোটগ্রহনে ব্যস্ত । তাদের কাছ থেকে জানলাম, সব যায়গাতেই কমবেশী একই অবস্থা ।



স্থানীয় মেম্বার সা’ব এলেন । তিনি আগের রাতে অঞ্চলের ‘ঐতিহ্য’ অনুযায় কেন্দ্রের সকল পুলিশ, আনসার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাকে রাতের আহার যুগিয়েছিলেন । আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমার রুমে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হাজির হয়ে বিনয় ও সৌজন্যের অবতার হয়ে অতিথিসেবার চরম পরাকাষ্টা দেখিয়েছিলেন ।



মেম্বার সা’ব তার আগের বিনয় নিয়েই বললেন, ‘স্যার আমাদের ব্যালট পেপার শেষ । বাকি ব্যালটপেপারগুলো দিয়ে দেন স্যার’ ।



আমি দু’চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । বেশ কিছুক্ষন পর সম্বিত ফিরতেই তাকে জানালাম এমন অবস্থা চললে তো আমি ভোটগ্রহন স্থগিত করে চলে যাবো ।

তিনি খপ্ করে আমার হাত ধরে ফেললেন । ‘স্যার, স্যার,’ আগের মতো বিনয়ের অবতার সেজেই বললেন তিনি, ‘ভোট বন্ধ করবেন না স্যার । বুঝেনইতো স্যার, একটা দল করি । উপরের নির্দেশ শুনতে হয় । আর সারা দেশেতো একই অবস্থা স্যার । কী করবেন ?’



আমি মেম্বার সা’বের দিকে পূর্ন নজরে তাকালাম । বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছূঁই লোকটার সাথে আগের রাতে খেতে খেতে কথা হয়েছিল । চরাঞ্চচলের সহজ সরল মানুষ । চার সন্তানের জনক, কৃষিজীবি এবং মোটামুটি সচ্ছল । প্রকৃতই বিনয়ী এবং আন্তরিক । বাংলাদেশের সকল আত্মকেন্দ্রিক ও অবস্থাসম্পন্ন মানুষের মতো নিজের সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রু বাঁচাতে হয়তো তাকেও একটি রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকতে হয়, তাদেরকে তোয়াজ করে চলতে হয় । নিজের বৈষয়িক স্বার্থরক্ষায় আমাদেরকেওতো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর কারও না কারও সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতে প্রতিনিয়ত । প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের এই মেম্বারের আর দোষ কী ? সত্যি কথাই বলেছেন তিনি ।



অসহায়ভাবে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের দিকে তাকালাম । তারাও সম্মতিসূচক মাথা নোয়ালো । সে সম্মতির পেছনে লুকিয়ে থাকা তাদের অসহায়ত্ব ও বিরক্তি আমার নজর এড়ালো না ।



২৬৯০ জন ভোটার ঐ এলাকায় । আমাকে ব্যালট পেপারও দেয়া হয়েছে সমসংখ্যক । কিন্তু সবতো দেয়া যায় না । শতভাগ ভোট কাস্ট হলেতো নাটকও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে । বুঝিয়ে বললাম মেম্বার সা’বকে । মেম্বার সা’ব সামান্য গাঁইগুই করে শেষতক মেনে নিলেন । মেনে নিল তার পেছনে থাকা বলিষ্টদেহী কয়েকজন মাসলম্যানও ।



সর্বমোট দু’হাজার ব্যালট পেপার দিলাম তাদেরকে । তারপর কান পেতে শুনতে থাকলাম পাশের কক্ষে থেকে আসা বিরতিহীন সিল মারার শব্দ । ছপ ছপ । ছপ ছপ । একঘেয়ে একটানা সে শব্দে কেমন যেন ঘোর লেগে গেল একসময় । আমার মনে হতে থাকলো পাশের রূম থেকে ভেসে আসা এ শব্দ ব্যালট পেপারে পড়া মার্কিং সিলের শব্দ নয়, এ শব্দ ব্র্যান্ডিং এর শব্দ । গনতন্ত্র ও ষোলকোটি মানুষের ভোটাধিকারের গায়ে গনগনে আগুনে লাল হয়ে উঠা লোহা দিয়ে অপমানজনক দাসত্বের ছাপ দেয়া হচ্ছে । আরেকবার মনে হলো এ বুঝি চপেটাঘাতের শব্দ । প্রতিবাদহীন, নির্বোধ ও আত্মকেন্দ্রিক জাতির গালে একের পর এক পড়ছে বাকশালী স্বৈরাচারের নিষ্ঠুর হাতের চড় ।



এক সময় থামলো লজ্জা ও কলংকের সেই শব্দ । ঘর্মাক্ত কলেবরে হাসিমুখে সবকিছু জমা দিল ওরা । ওদের চেহারার দিকে তাকালাম । মনে হলো যেন কোন কুমারী নারীকে মাত্র ধর্ষন করা একদল বর্বর ধর্ষককে দেখছি আমি সামনে । ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত ।



ভোট শেষ । প্রায় শতকরা চুয়াত্তর ভাগ ভোট কাস্ট হয়ে গেছে । অথচ বেলা তখন দুপুর সাড়ে বারোটা মাত্র । বিকেল চারটায় ব্যালট বাক্স খুলে ভোট গুনতে হবে । প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা বাকি । কী করবো এতক্ষন বসে থেকে । চলেওতো যেতে পারি না নিয়মরক্ষার খাতিরে ।



হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো । কী দরকার হারাম ভোটকে হালালভাবে গোনার ? একটা মনগড়া ফলাফল বানিয়ে নিলেইতো চলে । যেই ভাবা সেই কাজ । ডাকলাম মেম্বার সা’বসহ অন্যান্য দলের দু’চারজনকে । প্রস্তাবে সম্মত হলেন তারা । মোট দু হাজার ভোটের মধ্য থেকে আওয়ামীসমর্থক চেয়ারম্যান প্রার্থীকে দেয়া হলো ১৯৫০ ভোট । বিএনপি সমর্থিত এবং অন্যান্য প্রার্থীদেরকে দেয়া হলো ৩০ ভোট আর বাকি ভোট দেখানো হলো বিনষ্ট বা অবৈধ ভোট হিসাবে । আফটার অল, একটা বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপার আছে না ।



ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভোটের বেলায় আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত আপোষরফায় এসে ভাগাভাগি করে নিল । বলাবাহুল্য, এলাকায় বিএনপির টিকিটি দেখা না গেলেও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল । তাদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে পাশ করানোর জন্য তারা আওয়ামলীগকে ছেড়ে কথা কয়নি । সিল মারার মহাউৎসবে আওয়ামীলীগের সাথে বাধ্য হয়ে তারাও সক্রিয় ছিল ।



বেলা দু’টোর মধ্যেই সমস্ত কাগজপত্র তৈরী করে প্যাক আপ করে নিলাম । কিন্তু সমস্যা হলো বিকেল চারটার আগে ফিরে যাই কি করে । শত হলেও নিয়ম এবং চক্ষুলজ্জা আছে না । তাই অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন চারটা বাজে । কিন্তু সাড়ে তিনটা বাজতেই আর তর সইলো না পুলিশ এবং আমার অফিসারদের । অগত্যা গাড়িতে উঠতেই হলো ।



কেউ ফলাফলের জন্য ভিড় করলো না । কারন ফলাফল তৈরী করেছে তারা, আমি নই । এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় গাড়িতে ধীরগতিতে আসতে আসতে অস্পষ্টভাবে দু’একবার মনে হলো যেন রাস্তার গরীব ও সাধারন শ্রেনীর মানুষের বিদ্রূপের হাসি শুনতে পেলাম । এ বিদ্রূপ আমাকে নাকি তাদের নিজেদের ললাটকে কে জানে !



উপজেলা নির্বাচনী অফিসে যখন উপস্থিত হলাম অত্যন্ত স্বস্তি এবং কিঞ্চিৎ বিব্রতবোধ করে দেখলাম প্রথমবারের মতো আমি প্রথম স্থান অর্জন করেছি এখানে । মানে আর কেউ ফলাফল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারেনি । স্বস্তি এজন্য যে আমাকে আরও দু’ ঘন্টা প্রচন্ড হ্যাপা সামলে ফলাফল জমা দিতে হবে না । আর বিব্রত এজন্য যে বেলা চারটায় ভোটগ্রহন শেষ হওয়ার পর পাঁচটার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে পনেরো কিলোমিটার দূরের দুর্গম অঞ্চল থেকে চলে আসাটা একমাত্র বোরাক দিয়েই সম্ভব । অথচ আমি এসেছি লক্কর ঝক্কর বাসে উটের পিঠের মতো এক অমসৃন রাস্তা দিয়ে ।



কিন্তু নির্বাচনী অফিসাররা এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করে আমাকেও বিব্রত করলেন না আর উত্তর শুনে নিজেরাও বিব্রত হলেন না । তাদের মুখের মিটিমিটি হাসিই বলে দিচ্ছিল তারা বেশ ভালোভাবেই পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন ।



‘এ্যাই রিক্সা,’ বলে হাঁক ছাড়লাম আমি । তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে । টিটুয়েন্টিতে আয়ারল্যান্ড অহংকারী ইংলেন্ডের কী দশা করছে কে জানে এতক্ষনে । ইস্ কতগুলো খেলা মিস হয়ে গেল ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৫৮

জনৈক রুয়েটিয়ানের ব্লগ বলেছেন: ভাল লিখেছেন।

২| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৩:৫৫

ফোর টোয়েনটি বলেছেন:


৭০ এ ভোট কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোয় পাকিস্তানের ইতিহাস পাল্টে গেছে,
এখন সরকার দলীয়দেরকে জনগন কুত্তার বাচ্চা মনে করে !!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.