নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইট-কাঠ-পাথরের শহরে চার-দেয়ালের আরামদায়ক বন্দীশালায় ফার্মের মুরগীর মতো বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা । কালে-ভদ্রে নরোম মাটির সাথে ওদের পায়ের ছোঁয়াছুয়ি হয়, ওরা মুক্ত প্রকৃতিতে ছুটে বেড়াতে পারে ।
বিস্তৃত ফসলের মাঠের ওপারে পূব দিগন্তে কী করে ডিমের কুসুমের মতো সকালের লাল সূর্য্য ঘুম জড়ানো চোখে উঁকি দেয় তা ওদের কখনোই জানা হয়ে উঠে না ।
ওদের জানা হয়ে উঠে না ঋতু বৈচিত্রের এই বাংলাদেশে বর্ষার ঘনঘটায় কেমন করে কদম কামিনী কেয়ারা সবুজ পাতার ফাঁকে সুরভিত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে । কেমন করে শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলো মেঘেরা স্কুল ফেরা চপলমতি বালিকাদের মতো হাত ধরাধরি করে চলে যায় । কেমন করে হলুদ ফসলের ক্ষেত সন্ধ্যের আগে আগে নীল কুয়াশার চাদর গায়ে টেনে নেয় । খেজুর গাছে ঝুলতে থাকা রসের হাড়িতে চঞ্চু ডুবিয়ে কেমন করে শীতের শালিক তার তৃষ্ণা মেটায় আয়েস করে ।
বসন্তের পদধ্বনিতে রঙের মেলা বসে নিসর্গে, সবুজের দাপটে কুজনমুখর পাখীরা বন-বনানীকে উৎসবমুখর করে তোলে । তারপর বসন্তের এই উৎসবে গর্ভবতী বাংলার প্রকৃতি গ্রীষ্মের দাবদাহে ঘেমে নেয়ে মধুময় ফল প্রসব করে । সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এক সংসারে ।
এসবতো ওরা জানে না ।
আমাদের সন্তানেরা ঘাসের বিছানায় শুয়ে তারা ভরা রাতের নির্মেঘ আকাশে কালপুরুষ আর সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে থাকেনি কখনো । শয়তানকে ছুঁড়ে মারা উল্কার আচানক আলোকিত ছোটে চলা দেখে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে উঠেনি কখনো ওরা । ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে জ্বোনাকির নিঃশব্দ আলোকসজ্জার সৌন্দর্য্যে আত্মবিস্মৃত হওয়া কিংবা ভরা জোছনার মায়াবী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে আচানক নাকে আসা গোপন হাস্নাহেনার পাঠানো গন্ধে বিবশ দাঁড়িয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন হয় তাও কি জানে ওরা ?
ওরা কি জানে স্কুল পালিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিঁজে ফুটবল খেলে কাদায় মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খাওয়ার মজা কতো বেশী হতে পারে ? জানে কি ওরা প্রতূষ্যে মক্তবে কোরাস করে সুরা মুখস্ত করার আনন্দ কেমন হয় ?
চৈত্রের দাবদাহে বহুদিনের তৃষ্ণার্ত মাটিতে আচমকা বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে যে সোঁদা গন্ধ বের হয় তাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তা চিনতে পারবে না কখনোই । বৈশাখী ঝড়ে আম বাগানে আম কুড়ানো, ডুমুর পাতার ফাঁকে টুনটুনির ছোট্ট বাসা খুঁজে ফেরা, কুকুরের তুলতুলে বাচ্চার সরল আনুগত্যে পিছু হাঁটার গর্ব নিয়ে বাড়ি ফেরার শিহরিত আনন্দতো চিরদিনই অজানা থেকে যাবে ওদের কাছে ।
ওরাতো বই আর জ্ঞানের বোঝার নীচে চাপা পড়ে কুঁজো হয়ে বেড়ে উঠছে । ভার্চূয়াল ওয়ার্ল্ডের সিনথেটিক আনন্দে ওরা বুঁদ হয়ে আছে । মেকি সভ্যতার কসমেটিক সৌন্দর্য্য ওদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে ।
ওদের কলমে তাই কবিতা জন্ম নেয় না । কুত্রাপি নিলেও তাতে মাটির গন্ধ, শেকড়ের গন্ধ পাওয়া যায় না । ওদের কবিতায় ফুটে উঠে নাগরিক জীবনের জটিলতা আর যন্ত্রনা । বেঁচে থাকার আনন্দ মহৎ হয়ে ধরা দেয় না ওদের জীবনে ।
নিয়ম আর শৃংখলার এক নির্দয় নিগড়ে বাধা পড়ে আছে ওদের হাত-পা । মৃত্যুর আগে এ থেকে নিস্তার নেই ওদের ।
নিস্তার নেই ।
©somewhere in net ltd.