![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
instagram.com/fatih.solaiman facebook.com/Fatihsolaimanofficial
গল্পের শুরুটা ১৪৯৪ সালে এক গ্রীষ্ণের বিকেলে । আকস্মিক ভুমিকম্পে দূর্গের ছাদ ধ্বসে পিতার মৃত্যু হলে মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি বেষ্টিত টেনেটুনে মাত্র ২০০ মাইল লম্বা আর ১০০ মাইল চওড়া পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক উপত্যকা রাজ্য 'ফারগানা'র সিংহাসনে অভিষিক্ত হন 'বাবর' । তখন বয়স তাঁর মাত্র ১২ বছর ! ছোট্ট বালকের স্বপ্নে তখন 'হিন্দুস্থান' কিংবা 'ভারতবর্ষ' এর নামগন্ধও নেই । তাঁর পুরো স্বপ্নজুড়ে বরং তখন 'সমরখন্দ' শাসনের ইচ্ছা, যেটি ছিল বালক বাবরের সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল পূর্বপুরুষ 'তৈমুর লং' এর নিজের হাতে গড়া এক সময়কার রাজধানী ! সেই থেকে শুরু - তৈমুরের বাঘ-আঁকা আংটি আংগুলে পরে সমরখন্দ থেকে বরফঘেরা হিন্দুকুশ পর্বতের ভয়াবহ মৃত্যুকুপ পারি দিয়ে কাবুল । কাকতালীয় ভাবেই কাবুলের দূর্গে এক অলস সন্ধ্যায় বসে একশ বছর আগে তৈমুরের সেনাবাহিনীতে চাকরী করা এক অধিকারীকের বৃদ্ধা নাতনীর মুখে হিন্দুস্থানের নরম মাটি, সবুজ পরিবেশ আর অপরিসীম ঐশ্বর্যের গল্প শুনে হিন্দুস্থানের স্বপ্ন দেখা শুরু । আর সেখান থেকে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদী কে হারিয়ে দিয়ে দিল্লীর মসনদ দখল করে নেয়া । ভারতবর্ষের মাটিতে শুরু হলো মোঘল শাসন ।
.
তারপর ভাগ্যবিড়ম্বিত সম্রাট হুমায়ুনের খামখেয়ালীপূর্ণ আচরণের খেসারত হিসেবে রাজ্য হারিয়ে ফেলা, তারপর আজীবন নিদারুণ সংগ্রামের মাধ্যমে মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে আবার রাজ্য ফিরে পাওয়া । ৬ মোগল সম্রাটের মধ্যে রাজত্ব উপভোগের সুযোগ তিনিই সবচেয়ে কম পেয়েছিলেন । যদিও নরম হৃদয়ের এই সম্রাট বারবার আঘাত পেয়েছেন তাঁর কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকেই কাছ থেকে । তারপরও বারবারই ক্ষমা করে দিয়েছেন সবাইকেই । 'মসনদ কিংবা কবর' মন্ত্রের অভিশাপ তাঁকেও তাড়া করছে বারবার ।
.
তারপর এলো 'আকবর' এর রাজত্বকাল, যেটিকে মোঘলশাসনের সুবর্ণকাল বলা চলে । রাজত্ববৃদ্ধি আর দক্ষ শাসনে সবচেয়ে সফল এই মোঘল সম্রাটের নামের সাথে তাই যোগ করা হয় 'দ্য গ্রেট' কিংবা 'মহান' শব্দমালা । জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য এক মহান সময় ছিল সেটি । মৈত্রী, বন্ধুত্ব আর আত্নীয়তার বন্ধনে পুরো ভারতবর্ষ মনে হয় শেষবারের মত এক হয়েছিল এই মহান শাসকের রাজত্বকালেই ।
.
এরপর এলেন জাহাংগীর । কিছুটা খেয়ালী আর মানসিকভাবে কিছুটা দূর্বল, যার সুযোগে রঙ্গমঞ্চের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন সম্রাটের স্ত্রী 'মেহেরুন্নেসা' । জাহাংগীর-মেহেরুন্নেসা'র প্রণয়গাঁথাও কিন্তু কম আকর্ষনীয় নয় । এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রথম মেহেরুন্নেসাকে দেখা, তাও মাত্র কয়েক পলকের জন্য; জাহাংগীর তখন বিখ্যাত 'আনারকলী'র উপখ্যানের শাস্তি মাথায় নিয়ে ক্ষিপ্ত আকবরের নির্দেশে কাবুলে নির্বাসন কাটাচ্ছেন বলা যায় । তারপর দীর্ঘ অনেক বছর পর জাহাংগীরের সিংহাসনে আরোহণ । ততদিনে মেহেরুন্নেসার বিয়ে হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই । কিন্তু তাতে কি ! বিদেশী এক গুপ্তঘাতককে দিয়ে জাহাংগীর হত্যা করালেন মেহেরুন্নেসার স্বামী কাবুলের প্রাদেশিক শাসক শের আফগানকে । তারপর মেহেরুন্নেসাকে আগ্রায় নিয়ে গিয়ে অনেক ঘটনার পর অবশেষে বিয়ে করা ! ভুল-শুদ্ধের বিচার নয়; তবে এটুকু বলা যায় নাছোড়বান্দা প্রেমিক হিসেবে শাহ্জাহানের বাবা জাহাংগীরও কম ছিলেন না ! যাই হোক সেই মেহেরুন্নেসাই একসময়ে হয়ে উঠলেন মোঘল সাম্রাজ্যের আসল ক্রীড়ানক; পর্দার আড়ালে জাহাংগীরের ছত্রছায়ার তীক্ষ্ন বুদ্ধির অধিকারিনী এই রমনী যে অপরিসীম প্রভাব আর ক্ষমতার অধিকারীনি হয়ে ছিলেন তা সেই সময়ের পর্যালোচনায় অবিশ্বাস্যই মনে হয় ।
.
এরপর শাহজাহান । শাসক-প্রেমিক শাহজাহান । রাজকীয় এক মিনাবাজারের সন্ধ্যার আলো-আঁধারে সদ্য কিশোরী 'আরজুমান্দ বানু'কে প্রথম দেখা । প্রথম দেখাতেই প্রেম । মোঘল হিসেবে 'খুররম'ই একমাত্র একমাত্র রাজপুত্র যিনি বাবা সম্রাট জাহাংগীরকে সরাসরি আরজুমান্দ বানুর প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা জানিয়ে তাঁকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তখনকার প্রক্ষাপটে যা অভাবিতই বলা যায় ! এই খুররমই পরবর্তিতে নতুন নাম ধারণ করেন 'শাহ্জাহান' হিসেবে, সেই আরজুমান্দ বানুকে আমরা চিনি 'মমতাজ' হিসেবে । রাজ্যের নীতি অনুযায়ী পরবর্তিতে আরও কয়েকবার বিয়ে করতে বাধ্য হলেও মমতাজই ছিলেন শাহজাহনের একমাত্র আত্নার বন্ধন । আরামদায়ক হেরেম থেকে নিষ্ঠুর-কঠিন যুদ্ধের ময়দান, যখন রাজপুত্র শাহজাহান বাবা সম্রাট জাহাংগীর বিরাগভাজন হয়ে মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে মরুভূমি-জংগলে নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখন থেকে আবার সম্রাট শাহ্জাহান হওয়া পর্যন্ত - প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি উত্থান পতনে মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের ছায়াসংগীর মত, নিবিড় ভালবাসায় । তাইতো মমতাজের আকস্ণিক মৃত্যুতে শাহ্জাহান ভেংগে পড়েছিলেন একজন সাধারণ মানুষের মত । সেই হাহাকার তার সারাজীবন আর যায় নি । তবে সেই 'মসনদ কিংবা কবর' অভিশাপ কিন্তু ছাড়ে নি শাহ্জাহানকেও । নিজের দুই ভাইকে হত্যা করে রক্তাক্ত রাজ্যভিষেক ছিল তাঁরও । তাই হয়ত, শেষ বয়সে নিজেও ভোগ করেছেন সেই একই পরিণতি - নিজের ছেলের কাছ থেকে ।
.
তারপর গ্রেট মোঘলদের শেষ সম্রাট 'আওরংগজেব' । নিষ্ঠুর, গোঁড়া আর সুচতুর ! ধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এই লোক শুধু তিন ভাইয়কেই চরম নিষ্ঠুরতার হত্যা করে ক্ষ্যান্ত হয়নি, পিতা শাহ্জাহানকেও মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আটকে রেখেছিলেন চরম নির্দয়তায় । শেষ জীবনে আটকে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ প্রায় ১২ বছরে শাহ্জাহান অসংখ্যবার তাঁর বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলের সাথে দেখার করার মিনতি জানালেও আওরংগজেব একবারও বৃদ্ধ পিতার সাথে দেখা পর্যন্ত করেন নি ! শাসক হিসেবে আওরংগজেবের নীতি ছিল কঠোরতা । সেটি পরিবারে হোক কিংবা রাজ্য পরিচালনায় । তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরী করা শুরু করেন । তাঁর একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ মোঘল সাম্রাজ্যের মুসলিম ছাড়া অন্য সব ধর্মালম্বিদের বিদ্রোহী করে তোলে; যার ফলাফল হিসেবে মোঘল সাম্রাজ্য এগিয়ে যেতে থাকে এক অবশ্যম্ভাবী করুণ ভাংগনের দিকে ! শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর আগে সাম্রাজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়ে মোঘল সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয় । যদিও তাঁর এই পদক্ষেপে শেষ রক্ষা হয় নি । তাঁর মত তাঁর ৩ ছেলেরাও ভ্রাতৃঘাতি লড়াই শুরু করে - 'মসনদ কিংবা কবর' মন্ত্রেই যবনিকা ঘটে এশিয়ার এক সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী আর পরাক্রমশালী মোঘল শাসনের !
.
শেষ করলাম 'অ্যালেক্স রাদারফোর্ড' সুবিখ্যাত ৬ পর্বের 'এ্যাম্পেয়ার অফ দ্য মোগল' এর পুরোটা । নভেম্বর থেকে শুরু, মার্চে শেষ । গেল পাঁচ মাসে আমিও যেন ডুবে ছিলাম মোঘলদের সাথে - ফারগানা, সমরখন্দ, কাবুল, দিল্লী, আগ্রা, দাক্ষিণাত্ব্য, ফতেহপুর সিক্রী, বাংলা, পারস্য… … … ধুলার মেঘ উড়িয়ে, রণতূর্য আর নাকাড়া বাজিয়ে পাগলা ঝড়ের মত ছুটে চলা মোঘল বাহিনীর সাথে যেন আমিও ছিলাম - কখনও ঘোড়ায় পিঠে সৈন্যদের সাথে, কখনও হাতির হাওদায় সম্রাটের ঠিক পেছনটাতে বসে, কখনও তোপচীদের সাথে তাড়াহুড়ো করে শত্রু দূর্গের গায়ে কামান দাগায়, আবার কখনও লাল তাবুর ভেতর যুদ্ধসভায় ! গত পাঁচ মাসে কখনও নিষ্ঠুর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত জর্জরিত হতে দেখেছি, আবার দেখেছি শত বাঁধা-বিপর্যয়-প্রতিকুলতা কাটিয়ে কিভাবে একেকজন ব্যক্তি সাধারণ মানুষ থেকে সম্রাটের আসনে উঠে আসেন সাহসিকতা, ধৈর্য্য, একাগ্রতা, মেধা আর ভাগ্যের সহায়তায় ! অবাক হয়েছি বাবরের দাদী এসান দৌলত, বোন খানজাদা, হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা, জাহাংগীরের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা, বোন গুলবদন, আকবরের দুধ-মা মাহাম আগা, শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ, বড় মেয়ে জাহানারা এরকম আরোও অসংখ্য রমণীর আত্মত্যাগ, সাহসীকতা, বুদ্ধি-বিবেচনা আর কূটকৌশল দেখে । পর্দার আড়ালে থাকলেও এঁদের কোন একজন ছাড়া মোঘল সাম্রাজ্য তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে যেতে পারত । নজরুল ঠিকই লিখেছিলেন "… … …অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ।" আবার কখনও অজানতেই চোখ ভিজে উঠেছে সবছাড়িয়ে একজন সামান্য বাবা হিসেবে ছেলের জন্য সম্রাটের হাহাকার, ভালবাসা; কিংবা অমিত ঐশ্বর্য আর ক্ষমতাবান একেকজন সম্রাট যখন মৃত্যুশয্যায় একজন অতিসাধারণ মানুষের মতই হাহাকার করেছেন আরেকটু বেঁচে থাকার জন্য, নিজের সকল অর্জনের বিনিময়ে কিনতে চেয়েছেন নশ্বর জীবনের আরেকটু আয়ু কিন্তু পারেননি আর অন্য সকলের মতই !
.
সবমিলেয়ে এক অভুতপূর্ব যাত্রা ছিল এটি ! বর্ণনাতীত আবেগমথিত ! রোমাঞ্চকর ! রোমহর্ষক !
©somewhere in net ltd.