![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জল পড়ে পাতা নড়ে
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমবন্দী উপর্যুক্ত চরণদুটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জগত সংশ্লিষ্ট মানুষই কেবল নন, জেনে-শুনেও সাধারণ মানুষও এই বাক্যযুগল আত্মস্থ করেছেন। কারো সামনে যদি কেউ ভুল করেও বলে ফেলেন- জল পড়ে, পাশের লোকটি নিঃসন্দেহে সাথে সাথে বলে উঠবেন- পাতা নড়ে। কী মধুর সম্পর্ক এই যুগলবন্দীতে। রহস্যটা এমন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে যেন কেউ জল পড়তেও দ্যাখেন নি, পাতা নড়তেও দ্যাখেন নি। জল পড়লে, পাতাতো নড়বেই ! আশ্চর্য কি ? আশ্চর্যের বিষয় বৈ কি ! তাহলে এর চমৎকারিত্বটি কোথায় ? জলবাড়ি গ্রন্থের নামকরণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে জল পড়ে, পাতা নড়ে সম্পর্কে আলোচনা এসেই যায়। চলুন, তাহলে একটু জল পড়ে, পাতা নড়ে বিষয়ে সামান্য আলোচনা হয়ে যাক।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি। কি দেখেছিলেন জলে, আর পাতায় ? তিনি কি কেবল বৃষ্টির জল গাছের পাতায় পড়লে- পাতা নড়ে সেই কথা বুঝিয়েছেন ? নাকি, এর ভেতরে আরো কোন মন্ত্র আছে। যেই মন্ত্রণার উন্মাদনায় আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরা গেয়ে ওঠে- জল পড়ে, পাতা নড়ে। বর্ণিত চরণদুটি এ যাবৎকাল বহুবার উচ্চারণ করেছি, শুনেছিও বহুবার। কখনো কখনো এর মমত্ব আমাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কখনো তুলেছে আকাশে, কখনো নামিয়েছে গহীনে। মুখ ফুটে কারো কাছে কোনদিন উক্ত মহান বাণীর ব্যাখ্যা জানতেও চাইনি, আর জানাবার দুঃসাহসও দেখাই নি। কিন্তু, কবি ফিরোজ আহমেদ এর জলবাড়ি কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করতে বসে বারবার কেবল এই চরণদুটির কোলেই যেন মাথা রাখার ব্যাকুলতা ভর করে যায়। আর তাই মহান কবির মহান বাণী সম্পর্কে আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব মত তুলে ধরলাম। সুধী পাঠক আমার দুঃসাহসকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। প্রাসঙ্গিক না হলে আমি কখনোই এই দুঃসাহসিক কাজ করতে উদ্যোগী হতাম না।
প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে। জল পড়ে, পাতা নড়ে। আমরা জানি, জলের এক নাম জীবন। আবার এও জানি জীবনের মানে হলো জ্ঞান। কিন্তু জলের সাথে বা জীবনের সাথে কিংবা জ্ঞানের সাথে পাতার কি সম্পর্ক ? বৃক্ষে থাকে পাতা। আমরা পাতার সাথে জলের, কিংবা জীবনের সম্পর্ক কি দেখতে গিয়ে জানতে পারি মরা বৃক্ষে কখনো পাতা গজায় না। অর্থাৎ বৃক্ষের জীবন থাকলেই কেবল পাতা । আমরা জীবনের সাথে পাতার সম্পর্ক পেয়ে যাই। বীজের অঙ্কুরোদ্গমের বিষয় আমাদের সকলের জানা। আমরা বৃক্ষ দেখার আগে পাতা দেখে থাকি। এখানে জীবনের সাথে পাতার সরাসরি সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। জীবন বৃদ্ধির সাথে সাথে পত্র পল্লবিত হয়। আমরা নতুন পত্র পল্লবকে তারুণ্যের সাথে তুলনা করতে পারি। কারণ, তারুণ্যই জীবনকে প্রদর্শনযোগ্য করে তোলে। পত্র পল্লবহীন বৃক্ষ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মৃত মনে হলেও- ঐ বৃক্ষে যদি প্রাণ থাকে তাহলে পাতা গজাবেই। নিষ্প্রাণ বৃক্ষে যেমন পাতা গজায় না। জ্ঞানহীন প্রাণেও তেমন কোন তারুণ্য থাকে না। আলোচনাটিকে সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশে আমরা একটি সমীকরণে যেতে পারি, আর তা হলো- জ্ঞান তারুণ্যকে পরিচালিত করে। জ্ঞান নাও, তারুণ্য পাও।
ফিরোজ আহমেদ রচিত-
জলবাড়ি
প্রকাশক : ঘাসফুল
পরিধি : তিন ফর্মা
চার রঙা জলীয় প্রচ্ছদে ৮০ গ্রাম অফসেট সাদা কাগজে মুদ্রিত
জলেই সৃষ্টি, সৃষ্টি জগত। তারপূর্বে কুয়াশা। তারও আগে শূন্যতা। সৃষ্টির উৎসে জল, সৃষ্টি লালনে জল, পালনেও ঐ জল। জলবাড়ি কাব্যগ্রন্থের লেখায় সেই গন্ধ পাওয়া যায়, যেই গন্ধ রয়েছে জল পড়ে পাতা নড়ে চরণ যুগলে। জলবাড়ি গ্রন্থ এর কবিতার গতি প্রকৃতি এবং বক্তব্যের সাথে খাপ খাইয়ে গ্রন্থখানির জলবাড়ি নামকরণ যথেষ্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। এ থেকে একদিকে যেমন গ্রন্থের নামের সাথে কবিতার এবং কবিতার সাথে কবি’র মন ও মননের সম্পর্ক বুঝার সুযোগ হয়েছে, অন্যদিকে কবিতাগুলির সাথে পাঠকের নিজের মতো করে সম্পর্ক স্থাপনেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাব্যগ্রন্থের জলবাড়ি নামকরণ সার্থক হয়েছে বলা যায়। কৃষকের হাতে লাঙ্গল, তবেই না জাতির মঙ্গল।
উদীয়মান তরুণ কবি ফিরোজ আহমেদ এর এটি তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ। ২০১৫ বইমেলায় এ বছর প্রকাশিত হয়েছে দু’টি। গ্রন্থটিতে মোট ৪০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতাগুলিতে ভাবনার খোরাক রয়েছে প্রচুর। নিজেকে আবিষ্কার করার মন্ত্রও যেন লুকানো আছে শব্দ গঠনের ভাঁজে। বাইরে থেকে যেমন করে প্রতিটি মানুষ দেখতে এক রকম হলেও ভেতর থেকে সবাই আলাদা, ঠিক তেমন করে কবি ফিরোজ আহমেদ এর কবিতাগুলি বাইরে থেকে শব্দ বিন্যাশ এবং উপস্থাপনা ভিন্নতর হলেও ভেতর থেকে দেখলে প্রতিটি কবিতা-ই গহীনের মণি-মানিক্য দ্বারা সুসজ্জিত। লালন সাঁইজি যেমন হাতের কাছে মেঘনা নদী থাকতেও জল পিপাসায় মরার কথা বলেছেন, একইভাবে কবি ফিরোজ আহমেদ জলের মধ্যে বাস করেও জলবাড়ি অনুসন্ধানে প্রয়াশ পেয়েছেন। অসুন্দরের মাঝে নান্দনিক সুন্দরকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টায় কবি অনেকখানি সফলও হয়েছেন বটে।
জলবাড়ি গ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে ০৯ পৃষ্ঠার- জলের বিবাদ, ১৩ পৃষ্ঠার-জলবাড়ি, ১৬ পৃষ্ঠার- শরীরের রাত, ১৭ পৃষ্ঠার- জলের বয়ান, ১৯ পৃষ্ঠার- ভালোবাসা, ২০ পৃষ্ঠার- মগজপোড়া গন্ধ, ২৫ পৃষ্ঠার- আদিম পুরুষ, ২৭ পৃষ্ঠার- আকাশ আর উঠোনের গল্প, ৩২ পৃষ্ঠার- অভিশপ্ত ভূমিপুত্র, ৪২ পৃষ্ঠার- অবেলার গান, ৪৬ পৃষ্ঠার- সীমারেখা, ৪৭ পৃষ্ঠার- গন্দম খাই নি তবু বেশ ভালো লেগেছে। ভালো লাগা কবিতার মধ্য থেকে কয়েকটি কবিতার বিশেষ অংশ গুণী পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করা হলো। যেমন-
জলের বিবাদ কবিতায়-
জলবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো উদ্যানের ধূলো
প্রথমে সে গলেছিলো জলের প্রেমে
তারপর নুড়ির প্রত্যাবর্তন ঘাসের টানে,
তবু কিছু জল গোপনে বসত করে নুড়ির পাঁজরে।
মগজ পোড়া গন্ধ শিরোনামের কবিতায়-
মহাকাশ সেঁচে আনা ঈশ্বরকণা থেকে
পোড়ামাটির মন নিয়ে কবিরা পৃথিবীতে আসে
আর পতাকার রঙ মাখে ঘাসের শরীর
কবিতা তবু তোমার সতীনই হলো ?
শিরোনাম- জলবাড়ি
তোমার জলবাড়ি পরিচিত হয়ে গেলে
উঠোনে পিছলে গেলে কাদার মাখনে-
তবু সেখানেই পাবে তুমি ইন্দ্রিয়ের
সর্বোচ্চ বর্ণ পরিচয়।
অভিশপ্ত ভূমিপুত্র কবিতার-
অথচ, জীবনের পাটীগণিতটা
আমার শেখাই হলো না।
ভূমিকে ভালো না বেসেই লাঙ্গল ধরা
ভূমি-পুত্রের সমীচীন নয়, জেনে রাখা ভালো।
ভালোবাসা কবিতায়-
হাঁড়ির সবটুকু জল উপুড় করে না দিলে
ভালোবাসা জমে না
বিড়ালটা বেশ জানে,
আর আমি জানি।
এবার তুমি জেনে নাও।
আলোচ্য গ্রন্থে কবি ফিরোজ আহমেদ বেশ কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। মনের আবেগকে পাঠকের দরবারে তুলে দিতে তিনি নেতিবাচক বিষয়গুলোকে ইতিবাচক, আর ইতিবাচক বিষয়গুলোকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। যেমন- আমরা প্রকৃতির যা কিছু দেখি, আপাত দৃষ্টিতে তা সোজা দেখলেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের চোখে পড়া উল্টো ছায়াটাই দেখতে পাই। এ কথার প্রমান মেলে আয়নার দিকে তাকালে। আমরা আমাদের প্রতিবিম্বকে যেমন উল্টো দেখি, প্রকৃতিকেও উল্টোই দেখি। কিন্তু কবি প্রকৃতির গহীনের সাথে নিঃশেসিতভাবে একাকার হয়ে গেছেন এবং সব কিছু প্রকৃতির মতো সোজা করে দেখেছেন। সাধারণ দৃষ্টিসম্পন্ন পাঠক বিষয়টিকে উল্টো করে দেখলেই কবিতার স্বাদ উপভোগ করতে সক্ষম হবেন।
কবি তার কবিতার শব্দচয়নের মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই পাঠককে থমকে দাঁড় করানোর কাজে বেশ সফলই হয়েছেন বলবো। হাঁড়ির সবটুকু জল উপুড় করে না দিলে/ভালোবাসা জমে না, বাক্যটি সেই দক্ষতারই পরিচয় বহন করে। এছাড়া, কবির অন্য একটি কবিতায়- কিছু জল গোপনে বসত করে নুড়ির পাঁজরে/ এ বাকটির মাধ্যমেই পূর্বে উল্লেখ করা- হাঁড়ির সবটুকু জল উপুড় করে ঢেলে দিয়ে হাঁড়িকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার যে ভয় দেখিয়েছিলেন, এই কবিতায় এসে আবার কবি সেই অশনি সংকেত থেকে উদ্ধার করেছেন। সেই পূর্বের কথায় ফিরে যেতে হয়। সকল সৃষ্টির উৎসই হচ্ছে জল। সুতরাং জল নিঃশেষের কোন আশংকা নেই। সুন্দর ও নান্দনিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে লালন ও পালন করার দীক্ষা দানই কবির মুখ্য উদ্দেশ্য সে কথা বলতেই হয়।
জলকে চলে রাই বিনোদিনী যমুনায়। ভেসে যায় আঁখিজলে বক্ষ। শোকে কেঁদে ওঠে বৃন্দাবনের বৃক্ষলতাপাতাপশুপাখি। কানাইয়ার বাঁশির সুর তরঙ্গের ঢেউ লাগে রাধার কাঁখের কলসীতে। এতো কিছুর পরেও রাধা কৃষ্ণের, আর কৃষ্ণ রাধিকার। শাশ্বত এই জীবন ঘণিষ্ঠ প্রেম-ভালোবাসা যমুনা জলের বাসিন্দা যত যুগের পর যুগ বয়ে চলেছে। এ যেন হাত বদলের খেলা। কখনো মনে হয় আনন্দের, কখনো মনে হয় বেদনার। মোস্তাফিজ কারিগরের আঁকা প্রচ্ছদ জলবাড়ি বিদগ্ধ পাঠকের জল তেষ্টা দূর করবে সেই প্রত্যাশা করি। বইমেলা ২০১৫ তে ঘাসফুল প্রকাশনীর ২১৮-২১৯ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। নিজের সংগ্রহে রাখা বা প্রিয়জনকে উপহার দিতে জলবাড়ি বইখানি আপনিও সংগ্রহ করতে পারেন। সবশেষে, গ্রন্থখানির সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
-
সাগর আল হেলাল
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:১৫
ঘুমখোর বলেছেন: লেখাটি আমার এক বন্ধুর। কেমন লেগেছে মতামত জানতে চাই।