![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশ এবং মওকা বিজ্ঞাপন প্রসংগ
- সাগর আল হেলাল
’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’’
সম্প্রতি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে- "India created BANGLADESH in 1971". এ বিষয়টি এড়িয়ে গেলে দেশপ্রেম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে সেই অনুভূতি থেকে লেখা “স্বাধীনতা আমার অহংকার”।
.
জনৈক ভারতীয় বন্ধুর উদ্ভাবিত বাক্যটি বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ব্যথিত করেছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে স্বাধীনতার চেতনা। লজ্জার অবগুণ্ঠনে মুখ লুকিয়েছে ২ লক্ষ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের লজ্জা। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে কোন জাতি-রাষ্ট্র এমন নিষ্ঠুর রসিকতা করতে পারে, ভাবাই যায় না। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে আজকের বৃহৎ মানচিত্রের ভারত একজন ক্ষুদিরামের জন্ম দিতে ব্যর্থ ছিলো সেদিন। একজন হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, তিতুমির, মাস্টার দা সূর্য সেন ? সারা ভারতে এক ভগৎ সিং ছাড়া আর কে লড়েছে বৃটিশের বিরুদ্ধে ? মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতির পিতা। আজ ইতিহাস বলছে- তিনি ছিলেন বৃটিশের এজেন্ট। স্বাধীনতার স্বাদ তিতা না মিঠা, তা হয়তো ভারতীয়রা জানেন না বলেই- এমন মন্তব্য করার প্রয়াস পেয়ে যান।
.
স্বাধীনতা পাওয়া এবং অর্জন করা যে এক নয়, উপরের বাক্যটিই তার যথার্থ প্রমাণ বহন করে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্ট। পাকিস্তানের ১৪। এই দুই দেশের স্বাধীনতা কিন্তু অর্জিত স্বাধীনতা নয়। প্রাপ্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের সূর্য না ডোবা রাজত্বের অবসান হলে- লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এর নেতৃত্বে নেহেরু পরিবারের তত্বাবধানে পাক-ভারত উপমহাদেশের ব্যবচ্ছেদ ঘটে এবং ঐ দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। এখানে অর্জনের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ইতিহাস কখনো মিথ্যে বলে না, আমরা যতই তাকে মিথ্যের চাদরে ঢাঁকতে চাই না কেন !
.
কিন্তু বাংলাদেশ ? ঘোষণা দিয়ে, যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতের যদি বাংলাদেশ সৃষ্টির সক্ষমতা থাকতো, তাহলেতো ১৯৪৭ সালেই তা হতে পারতো ! কারণ, নেহেরু পরিবারতো ভারত উপমহাদেশ ভাগাভাগিতে সম্পৃক্ত ছিলোই। সুতরাং তখন যেহেতু করে নাই, পরে করবে কোন যুক্তিতে ?
.
কিছুদিন আগে পশ্চিম বাংলা (যা এখন সাংবিধানিকভাবে বাংলা) থেকে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী আসেন। সঙ্গে আসেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক শিল্পীবৃন্দ। ওনারা দুই বাংলা এক করার কথা বলেছেন। গান গেয়েছেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। তারা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতেও সংকোচ বোধ করেন হয়তো বা। খোদ পশ্চিম বঙ্গেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আদলে গাওয়ার জন্য সমালোচনার ঝড় ওঠে। কেউ কেউ ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছেন। আমার বন্ধু তালিকায় ভারতের অনেক বন্ধু রয়েছেন। আমি ওনাদের টাইম লাইন প্রায়শই দেখে থাকি। কই, কারো টাইম লাইনে এমন কোন বাক্য দেখিনি, যাতে ওনারা ভারত সরকারের কাছে দুই বাংলা একত্রিত করার কোনো মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তাহলে বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে ওনারা এই প্রস্তাব কার কাছে রাখলেন ? কার সাথে করলেন এমন নিষ্ঠুর রসিকতা ?
.
আগেই বলেছি- পশ্চিম বাংলার বর্তমান নাম বাংলা। এটার জন্য সেখানের ভাই-বন্ধুরা অনেক খুশি। দুই বাংলা একত্রিত করার ইচ্ছে থাকলেতো ওনাদের খুশি হওয়ার কথা ছিলো না ! বরং পশ্চিম বাংলা নামটি না থাকাতে ১৯০৫ সালের আগে যে দুই বাংলা এক ছিলো তার প্রমাণও নষ্ট হয়ে গেলো। আসলে সেখানের মানুষ ভারত পরাশক্তির সাথে থাকতেই বেশি আগ্রহী এবং খুশিও। এ বিষয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় আমার অন্তত খুশি বা বেজার হওয়ার কোন কারণ নেই। সেখানের মানুষ ভালো থাকবেন, একজন মানুষ হিসাবে সেটাই কাম্য। কিছু ভার্চুয়াল পন্ডিত পূর্ব-পশ্চিমের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করেই চলেছেন।
.
প্রশ্ন হলো, কেন ভারতের মিডিয়া বা কিছু ব্যাক্তি এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন-আশাকে পদদলিত করে তাদের হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে ? এখানে এসেই মুলত প্রতীয়মান হয় যে, প্রাপ্ত স্বাধীনতা উদযাপন করার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। সেটা পালন করতে দান-দক্ষিণা গ্রহণের অনুরূপ দুঃখবোধের সৃষ্টি হয়। যা ভারত ১৫ আগস্ট ও পাকিস্তান ১৪ আগস্ট পালন করে থাকে। ফলে, বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতা উদযাপন দেখে ঐ সকল ব্যাক্তিদের চোখের নিদ্রা মনের শান্তি নরকের যাত্রী হয়ে যায়। তারা ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে খাক হতে থাকেন। আর সুযোগ পেলেই নিজেদের দুঃখবোধটাকে এ দেশের সহজ সরল জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
.
এ প্রসঙ্গে আমার স্কুল জীবনের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। গল্পটি বিদগ্ধ পাঠকের সাথে শেয়ার করলাম-
.
ক্লাস নাইনে পড়ি। তখনো মুখে গোঁফ দাঁড়ি উঁকি দিতে আরম্ভ করে নি। আমাদেরই ক্লাসমেট, এক বন্ধু যার নাম ছিলো কালাম। খুব সুন্দর ছিলো ওর চেহারা। লাল টকটকে। ওর টসটসে গালকে আমরা লেডিসের গালের সাথে তুলনা করতাম। একদিন হলো কি, আমার এবং অপর এক বন্ধুর মাঝখানে বসেছে কালাম। উঠে গেলো রাঙ্গাগাল প্রসঙ্গ। কেন এবং কিভাবে ঘটে গেলো, ঘটনা বুঝতে পারলাম না। আমরা দুই বন্ধু দুদিক থেকে কালামের টসটসে গালে কামড় বসিয়ে দিলাম। দাগটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। কালামও কাঁদতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
.
এদিকে স্কুলের সবাই ঘটনাটি জেনে গেছে। বিজ্ঞান পড়াতে খলিল স্যার এলেন। যেন কিছুই জানেন না তিনি, এমন ভঙ্গিতে বললেন- হেড স্যার তোমাদের দু’জনকে দেখা করতে বলেছেন। যা বুঝার বুঝে গেলাম। যাই হোক- দুই জন ক্লাসরুম থেকে বের হলাম। আমার সেই বন্ধুর নাম ছিলো রবিউল। রবিউল হেড স্যারের কক্ষের দিকে আর আমি আমার বাড়ির দিকে মুখ করেছি। এরই মধ্যে দেরি দেখে হেড স্যার বেত হাতে বের হয়ে এসেছেন। আর যাই কোথায় ! এবার লুঙ্গি তুলে স্কুলের পাশের ধান ক্ষেত দিয়ে দৌড়। ক্ষেতে পানি ছিলো। দু’জনে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ধানের ছড়ার আঘাতে পা দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই।
.
নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে হাঁফ ছাড়ি। রবিউলকে বলি- শোন, আর কয়েকদিন পর রমজানের ছুটি। এই ছুটি পাড় করেই তবে স্কুলে আসবো। হেড স্যারতো তোর আত্মীয়। তোকে হয়তো ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমাকে ? দরকার হলে আজ থেকে স্কুলকে গুডবাই। জোড়া বেতের বাড়ি খেতে আমি কিছুতেই রাজি নই। তারপর দু’জন দুজনের বাড়ি চলে গেলাম।
.
পরদিন স্কুলে না গিয়ে বাড়ির সামনের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় দেওয়া ধানের খড় শুকানোর কাজ করছি। ছোট চাচা খুব খুশি। সে রাস্তার পাশের আম গাছ তলায় বসে গামছা নেড়ে বাতাস খাচ্ছে। খুব ক্লান্ত ! আমি বাঁশের কাঁদাল দিয়ে খড়গুলো ওলট পালট করছি। রবিউল হাজির ! কাজ ফেলে ওকে বাড়িতে গেলাম। আমাদের বাড়ির চতুর্দিকে আমগাছ। ফজলি গাছ তলায় মাদুর পেতে ওকে বসালাম। বেতের সাজিতে নাড়ু-মুড়ি আর সিলাভারের জগে পানি নিয়ে এলাম ওর আপ্যায়নে। এ সবে কেন জানি ওর কোন আগ্রহ ছিলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম- বল, কি খবর ? কি জন্যে এসেছিস ? ও খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো- কই নাহ্, কিছু না। শহরে যাচ্ছি- ভাবলাম তোর সাথে একটু কথা বলে যাই। আমি অনেক চেষ্টা করলাম স্কুলের ঘটনা জানার জন্য। রবিউল কিছুতেই মুখ খুলছে না। তার একই কথা হেড স্যার তাকে কিছুই বলেন নি। মারা দূরে থাক। তবে সে বারবার আমাকে স্কুলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলো। বোঝাচ্ছিলো- স্কুল কামাই করলে পড়া-লেখার ক্ষতি হয়ে যাবে, রেজাল্টও খারাপ হয়ে যেতে পারে, সামনেই হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মন সায় দিচ্ছিলো না ও সবে।
.
শেষ পযন্ত রবিউলকে বললাম- শোন দোস্ত, তুই যা-ই বলিস আমি স্কুলে যাচ্ছি না। দরকার হলে লেখা-পড়া ছেড়ে দেবো। নিশ্চিৎ কিছু হবে না, এমন না বুঝলে আমি স্কুলে যাবো না। রবিউল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। এই এক কথায় সে ভেঙে চূরমার হয়ে গেলো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলো- বেটা শালা আমার ! অন্যায় করলাম দুই জন, আর মাইর খাইলাম আমি একা ! এই বলে সে তার শার্ট খুলে ফেললো। বললো- এই দ্যাখ !
.
রবিউলের শরীরের অবস্থা যা সেদিন দেখেছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা আজ অসম্ভব। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। পরবর্তী ২ মাস আমি আর স্কুলে যাই নি। রবিউলকে অতোটা মেরে হেড স্যারও হয়তো পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি নিজে এসে কিছু বলবেন না নিশ্চয়তা দেওয়ার পরই আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি যে, তিনি সেদিন নিজে এসে আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। না হলে হয়তো আমার পড়ালেখা-ই বন্ধ হয়ে যেতো।
.
আমার ভারতীয় ঐ সকল বন্ধুদের মতামত দেখলে রবিউলের কথা মনে পড়ে যায়। যেন ওনারা কতো সুখে আছেন। আমাদেরকে সেই সুখের অংশীদার বানাতে চান। রবিউলের মতো ওনাদের শার্ট ওল্টালেও দেখা যাবে আঘাতের চিহ্ন কতোটা গভীর !
-
১৮.০৩.২০১৫
©somewhere in net ltd.