![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুরক্ষিত আধার
ঘুম ভাঙতেই মনটা কেমন হু হু করে উঠলো আদিবা চৌধুরির। ঘামে লেপ ভিজে জবজব। বয়স হয়েছে তা মানতেই হয় আজকাল। রোগ-শোকে এখন শরীর আর নিজের বশে থাকে না। কাল রাতে দফায় দফায় চিৎকার করে জেগে উঠেছেন। তিন বছর ধরে পার্কিনসন্সের কারনে হাত কাঁপে তার। তারপর থেকে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। কেবল ছেলে সায়েমের অতিরিক্ত তদারকিতে ডাক্তার দেখানো সার হয়েছে। এমন হেন স্পেশালিস্ট নেই ঢাকায় যাকে চেষ্টা করা হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক পথ্য লিখে দেন। কিছু ওষুধ হাত কাঁপা কমায় তো ভুলো মন, অ্যাংজাইটি বাড়িয়ে দেয়। তার রোগ যে আসলে কি তা নিজে বুঝতে পারেন না। আর ডাক্তাররা বোঝে কিনা তাও সন্দেহ থেকে যায় - একেকবার একেকজন নতুন অসুখের নাম বলে সাথে উপহার দেয় এক গাদা ওষুধের ভার! পার্কিনসন্স, আল্ঝাইমার্স ঘুরে শেষমেষ স্কিৎসোফ্রেনিয়া মানে পাগল বানিয়ে ছাড়লো তাকে। এত শত ওষুধেও তাকে ধরলো না। তার হাত কাঁপাকাঁপি তো আর থামেনি।
সতের বছর হলো আবিদা রিটায়ার্ড করেছেন। শহরের নামকরা মেয়েদের স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন। এককালের জাঁদরেল শিক্ষিকা এখন নিজের কাছেই কাবু হয়ে বেঁচে আছেন। এক ছেলে এক মেয়ের মাঝে বড় ছেলে এক ফার্মাসিউটিক্যালে ডিরেক্টর। মেয়ে তামান্না শাহজালালে পড়ায়। গেলো ডিসেম্বরের শুরুতে তামান্না সিলেট থেকে ছুটি কাটাতে এসেছিলো নাতনি তনিমাকে নিয়ে। মেয়ে জামাই নাসের গত বছর কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। কিন্তু তিনি পরিস্কার দেখলেন মেয়ে আর নাতনির সাথে জামাইও ঘরে ঢুকলো। এমনিতে গত কয়েক মাস হলো ভুলভাল দেখছেন। হ্যালুসিনেশনে তিনি সব ভুল দেখছেন যাকেই বলেন সে-ই একই কথা বলছে। তিনি দিব্যি জলজ্যান্ত কালো বিড়াল দেখেছেন তার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকতে। একবার না বেশ কয়েকবার। একবার হলে নাহয় ভুল দেখছেন মানতেন কিন্তু বার বার কিভাবে ভুল দেখবেন তিনি। হ্যালুসিনেশনের বাড়াবাড়ির তারতম্য হয় সময়ে সময়ে। প্রথম প্রথম ছেলে - ছেলের বউকে অকপটে সব বলতেন। তারা শোনে মানে কানে নিতো ব্যাপারগুলো যার ফল টের পেতেন নতুন ডাক্তারের সাক্ষাতে। এরপর এসব বলা ছেড়ে দিয়েছেন। তো মেয়ের জামাইকে দেখে তিনি দাঁত কপাটি দিয়ে বেহুশ। জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে। কাউকে বলতেই পারছেন না তিনি কি দেখেছেন আবার নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না যা দেখেছেন তা ভুল। এমন ভুলভাল দেখেন হরহামেশা - অপরিচিত মানুষ চেয়ে থাকে জামরুলের গাছের ডাল থেকে তার ঘরের জানালা গলে। সেদিন কাবার্ড খুলতেই দেখলেন উসকো-খুসকো চুলের দুই বুড়ো মতো লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে। কিন্তু মরা মানুষ তো এর আগে দেখেননি। সায়েমের বাবাও তো আট বছর হলো মারা গেছেন। কই তাকে তো আদিবা দেখেননি ফিরে আসতে।
কাজের মধ্যে কাজ হয়েছে ডিসেম্বরেই ব্যাংকক ঘুরে আসতে হয়েছে। সেখানকার ডাক্তার আরো এক কাঠি সরেস। তারা আদিবার অসুখের নতুন নাম দিয়েছে লুই বডি ডিজিজ। সব মিলিয়ে তার অবস্থা বিতিকিচ্ছিরি হয়ে গেছে। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম দিনের চব্বিশ ঘন্টাই খ্যাপাটে লাগে। প্রাইমারি স্কুলের দূরন্ত দিন গুলো তার আজও মনে পড়ে। জায়েদা, মমতা, ফাতিহাসহ সবার কথা মনে আছে তার। পঞ্চান্ন বছরেরও আগের বিয়ের দিনে সেই ঝড়-বৃষ্টি মনে হয় যেন এই সেদিনের কাহিনী। কিন্তু এখন নিজের চশমা ঠাহর করতে পারেন না কই রেখেছেন। বইয়ের ভাঁজে গুছিয়ে রাখা টাকা খুঁজে পেতে হুলস্থুল বাধিঁয়ে দেন। এই সেদিনও মাঝরাতে টাকার কথা মনে হতে খুঁজে না পেয়ে ছেলে সুদ্ধ পুরো বাড়ি জাগালেন। ছেলে একদিকে ডাক্তার দেখিয়ে দেয়ার দায় শোধ করে মাকে বকা ঝকা করে। আদিবা ঠিক বেঠিক হিসেব গুলিয়ে ফেলেন প্রায়ই। একদিন ভালো কাটে তো পরদিন ঘুম ভাঙে কোমর ব্যথা নিয়ে, নাহয় অকারনে দুশ্চিন্তা করে ব্লাড প্রেশার বাড়ে। হাত কাঁপার ওষুধ খেলে হ্যালুসিনেশন বাড়ে, হ্যালুসিনেশনের নেক্রোলেপ্টিক ওষুধ তার পায়ে পানি আনে, হাটতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেদিনও দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে পিঠে-মাথায় ব্যথা পেলেন। তবে ব্যাংকক থেকে ফিরে ভালোই চলছিলো।
গতরাতে খুব অদ্ভুদ ঘটনা ঘটলো। হ্যালুসিনেশনের অত্যাচার শুরু হবার পর থেকে তিনি আর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেন না। কারণ তার দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই কেমন ঘোরের মধ্যে কাটে। জেগে থেকে চোখ খোলা অবস্থায়ও আশেপাশে অপরিচিত লোকের আনাগোনা দেখেন। মাঝে মধ্যে হাঁক ডাক চেঁচামেচি করে তাড়াতে চান এই অবাস্তব শরীরীদের। ঘুমের ঘোরে সেই একইরকম অশরীরীদের আনাগোনা। এরা বিভিন্ন বয়সের কিন্তু সবাই অপরিচিত। তারা কেউ কখনও তার কোনো কথার জবাব দেয় না। কাল রাতে তার ঘরে যেনো এই অপরিচিতদের পল্টন ময়দানের সমাবেশ হয়ে গেলো। দফায় দফায় তাদের তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর ভোর রাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে অনেকদিন পর শান্তিমতো ঘুমের আয়োজনে শ্রান্ত আদিবা। দেখলেন ভীড় ঠেলে হাত ছোঁয়া ব্যবধানে সামনে হাজির খুব পরিচিত একটি চেহারা। সেই স্বপ্ন ছোঁয়া চোখ, বাবরি দোলানো চুল ভেদ করা উন্নত গ্রীবা। আদিবা চিৎকার করে বললেন: 'এত বছর পর তুমি কোন সাহসে?'
ভরাট পুরুষ কন্ঠে জবাব এলো, 'এতো ঘেন্না দিয়ে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছো দিবা?'
সতের বছরের কিশোরী আদিবা ঝাপিয়ে পড়লো আসুরিক জিঘাংসায়।
ঘুম ভাঙার পর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছেন আদিবা। তার বামপাশে কাঠের বাটওয়ালা ছুরিটা পড়ে আছে। হালকা নীল ফুলের নকশায় ছাপা লেপের কভারে কয়েক জায়গায় হালকা রক্তের ছোপ। হাত আর কাঁপছে না তার।
২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৪:৫১
গার্ডেড ট্যাবলেট বলেছেন: ধন্যবাদ নয়ন ভালোলাগা জানিয়ে যাবার জন্যে। আপনার মন্তব্যে অনুপ্রানিত হলাম।
২| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:৪০
জুন বলেছেন: আপনার গল্পের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত এক পরিবারের সম্পুর্নটাই মিল খুজে পেলাম। পার্কিনসন রোগটা প্রথমে একজন বাবার ছিল, তারপর তার দু ছেলে মেয়ের । বাবার মত তাদেরও ষাটোর্ধ বয়সে হয়েছিল। বাংলাদেশে এর কোন চিকিৎসা নেই, বাংলাদেশের সাধারন মানুষতো দূর, এমনকি অনেক ডাক্তারও এই রোগের নাম শুনেছে বলে মনে হয় না। বিদেশে যদি যেতে পারে তো ঔষধ খেয়ে বডি জার্কিং, হ্যালুসিনেশন ,ফ্রিজ, ম্যুভমেন্ট ডিজওর্ডার ইত্যাদি নিয়ে যতদিন বেচে থাকা আরকি। মাইকেল যে ফক্সের কথা মনে হলে দুঃখ হয় । কি অল্প বয়স থেকেই এই মারাত্নক রোগের সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন।
+
২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৯:১২
গার্ডেড ট্যাবলেট বলেছেন: জুন আপু ধন্যবাদ জানবেন। আমার খুবই কাছের আত্মীয় মোটামুটি তিন বছর ধরে লুই বডি ডিমেনশা'র স্বীকৃত রোগী। রোগ হিসেবে মানুষের শরীরে লুই বডি ব্যাপারটা বলা যায় আনকোরা মেডিক্যাল ডিসকাভারি। এতটাই নতুন যে ১৯৯৬ সালে কয়েকজন ডাক্তার বিজ্ঞানী মিলে এই রোগ নির্ণয় পদ্ধতির consensus report প্রণয়ণ করেছেন যা ২০০৭ এ পরিবর্ধিত হয়েছে। রোগীর স্মৃতি, অনুভুতি, শারিরীক সক্ষমতা (নড়াচড়া), মানসিক বিভ্রান্তি এমনকি ঘুমের পরিবর্তন এতটাই সর্বব্যাপী যে দিনে দিনে রোগী অন্য মানুষে পরিণত হয়। হাসি খুশি মানুষ প্রগ্রেসিভলি নির্জীব, অনুভুতিশুন্য হয়ে পড়ে। এই অদ্ভুতুড়ে রোগ সামলাতে ডাক্তারেরা সব এক্সপেরিমেন্টাল ওষুধ নির্ভর চিকিৎসাপত্র দিয়ে থাকেন। অ্যান্টি সাইকোটিক ড্রাগ ভীষন প্রভাব ফেলে রোগীর শরীরে। আবার বিনা ওষুধে রোগী ও তার আশপাশের সবার জীবন নরকতুল্য হয়ে পড়ে! কঠিন জীবন!
৩| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
জীবনের গল্প।
২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৯:১৩
গার্ডেড ট্যাবলেট বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৮
নয়ন বড়ুয়া বলেছেন: চমৎকার হয়েছে। পুরোটা পড়লাম। ভালো লাগলো পড়ে...