![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মাঝে দূদ্যোল্যমান এক যাযাবর পথিক।
আবারও নতুন তারিখ। বেশ বিরক্তিকর; উকিলসাহেব বলেছিল আজকের তারিখেই মামলাটার একটা রফাদফা হয়ে যাবে। বেটা বদের হাড্ডি, মামলার রায় হউক বা না হউক টাকা পকেট থেকে খসাবেই! উকিলরা যে কীভাবে টাকা নেয় টেরই পাওয়া যায়না। একেবারে চীনাজোঁকের মতন, একবার লাগতে পারলে এই জনমে আর নিস্তার নাই। নিযেও টাকা খসাবে আবার ছেলেপেলেকে উকিল বানায়ে নতুন করে চোষার ব্যবস্থা করে দিবে।
শালা বজ্জাত, বিরবির করে একটি গালি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আমজাদ লস্করের। নওয়াবপুর গ্রামের তালুকদার এই আমজাদ লস্কর। তালুকদার হরকতুল মজিদ লস্কর ছিলেন তার দাদা। জাঁদরেল জমিদার ছিলেন হরকতুল মজিদ। শুনা যেত তার ভয়ে নাকি বাঘে গরুতে এক ঘাটে পানি খেত। খাজনা আদায়ের জন্য কৃষককে জীবন্তও পুতে ফেলতে দ্বিধা করত না। গর্ভবতি মায়ের বাচ্চা প্রসব হয়ে যেত অসময়ে এই হরকতুল লস্করের ভয়ে। সবাই তাকে নাকি নস্কর চন্ডাল নামে ডাকত। অবশ্য এখন আগের ঠাঁট আর নেই বললেই চলে। আমজাদ সাহেবও কম যায়না। চর দখল, জমি দখল, মানুষ গুম তার নিত্য দিনের ব্যাপার। গত বছর একটা চড় দখল করতে গিয়ে সাতজন মানুষকে খুন করতে হল। আমজাদ লস্করের খুনখারাবি একদমই নাকি পছন্দনা। জমিদারের সন্তান জমিদারী করবে, আর প্রজারা জ্বী-হুজুরগীরী করবে, এটাই নিয়ম। ইদানিং দুই কলম শিক্ষা ছেলে ছোকরাদের দিছে মাথা নষ্ট করে। আমজাদ লস্করের কাজে বাগড়া দেয়! জনমের মত শোয়াইয়া দিছি। এবার পরকালে মুনকার নাকিরের ছাওয়াল জওয়াব দাওগে, যত সব নাস্তিকের দল। একটারে ধরতে পারে নাই সেই শালার বেটাই মামলা করে দিছে। ফৌজদারী মামলা। সমস্যা নাই, মামলা মোকাদ্দমা জীবনেরই অংশ, দাদাও মামলা লরেছে, বাবাও, এখন তার পালা।
বয়সটা বেশি হয়ে গেছে তাই আর আগের মত শক্তি পায়না এইযা।
বুঝলি ছগীর, আরেকজন উকিল লাগাইতে হবে, খুবই বড়মাপের উকিল প্রয়োজন। বাটপারটারে দিয়া কোন কাজ হবেনা।
হুজুর বেয়াদবি নিবেন না, হেরে বাদ দেওন ঠিক অইবনা। মামলার অনেক বিষয় বেটা জানে।
হুম, তা ঠিক। ঠিক আছে খোঁজ লাগা, ভাল একজন উকিল বাইর কর।
তা চল দেরি কইরা লাভ নাই। কলিমউদ্দিরে নৌকা ঘাটে ভিরাইতে বল। আর শুন আমি নৌকায় বসে একখিলি পান খাব, পান খাওনের সময় আবার একটু ভাবনা চিন্তা করব। অনেকেরেই নানা কিসিমের অভ্যাস আছে। কেউ কেউ নাকি পায়খানায় বইসাও ভাবে। এসব খাছরামী আমার পছন্দনা। পান খাইয়া ভাবনার মধ্যে একটা জমিদারী ভাব আছে। সাথে হালকা হুক্কা টানা, গড়গড় শব্দটাও শুনতে চমৎকার। পূর্বপুরুষেরা অবশ্য সুরাটুরা পান করত। তবে এখন আর নবাবী সুরা পাওয়া যায়না। তাই চাহিদাও তেমন নাই। তবে বিলেতি সুরা পান করার খায়েস আছে। মনে মনে ভাবনায় নিজেকেই এসব শুনাল আমজাদ লস্কর। স্বপ্ন বিষয়ক কোন কথা মুখে আনলেনা, দিলের খায়েস দিলে থাকতে হয়। গোপন কথা যত কম প্রকাশ পায় ততই মঙ্গল।
হুজুর কি আমারে কিছু বললেন?
হ্যাঁ, না তেমন কিছুনা। তুই বরং কলিমরে লইয়া চারটা ভাত খাইয়া আয়, আমি ততক্ষণ নায়ে জিরাইয়া লই। ঘাটে ছগীরের ডাক শুনে কলিমউদ্দিন নৌকা থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। হাড় জিরজিরে শরীর, কাল গায়ের রং। ঠিক কাল বলা যাবেনা রোদে পুরে হালকা বাদামি ভাব চলে এসেছে। টকটকে লাল চোখের চাহনি হাড্ডিসার শরিরেও যেন কেমন একটা অদৃশ্য শক্তির আবেশ ছরিয়ে দেয়। কেউ একবার কলিমউদ্দির চোখে তাকালে আর দ্বিতীয়বার তাকাবার সাহস করবেনা। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যপার হল কলিমউদ্দির ঠোঁট। কাল শরীরের সাথে লালরঙ্গের ঠোঁট, একেবারেই আলাদা, বেমানান। এই কলিমউদ্দিকে আমিজাদ লস্করও কেন যেন ভয় পায়। এই কথাটা যদিও কেউই জানেনা। সদা গম্ভীর কলিমকে দেখলে আমজাদ লস্করের মনে হয় সে কোন মানুষ না!
কলিমউদ্দির অতীত সর্ম্পকে কেওই তেমন জানেনা। হঠাৎ এক ঝড়ের রাতে কোথা থেকে যেন উদয় হল এই কলিম, সারা রাত মসজিদেই ছিল নাকি। ইমাম সাহেব ফজরের আযান দিতে গিয়ে দেখে এক লোক বসে আছে মসজিদের দরজায়। ইমাম সাহেব ভয়ে ভয়ে দোয়া দুরূদ পরে কোন রকমে আযান দিয়ে মুসল্লিদের অপেক্ষা করে। মুসল্লিরাও এই অনাহুত আগন্তককে দেখে অবাক হয়।
নওয়াবপুর মূলত একটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম, মেঘনার পাড় ঘেঁসে গড়ে উঠেছে। বর্ষায় চর্তুদিকে শুধু পানি আর পানি। আশে পাশে আর কোন গ্রাম নেই, বিরান ভূমি। সুদিনে যেদিকে চোখ যায় শুধু ধানি জমি। বর্ষায় নৌকা ও গ্রীষ্মে গরুর গাড়ি যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন । এখন ভরা বর্ষা। এমন দিনে কলিমউদ্দির আগমন এক জটিল রহস্য। অবশ্য এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ তেমন মাথা ঘামায়না, তবে পেছনে পেছনে সবাই কলিমউদ্দিকে ভয় পায়, আর ভয় পায় বলে কেউ তাকে গ্রাম ছাড়া করতে সাহস পায়না। তবে কলিমের প্রথমে যে সমস্যাটি হয়েছিল তা আবাসনের, অনেকেই তাকে গ্রামে রাখার পক্ষপাতী ছিল না। তালুকদার চালাক মানুষ। তিনি কলিমকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। গ্রামের মানুষদের বশে রাখতে কলিমের মতন একজন মানুষের তার যে বরই প্রয়োজন। প্রথম কয়েকদিন কলিম মসজিদেই থাকত, বারান্দায় শুয়ে থাকত। মসজিদ মেরামতের সময় লস্কর বাড়িতে চলে এসেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল লস্কর বাড়িতে থাকলেও তাদের দেয়া কোন খাবার সে খায় না। নুন খাইলে নেমক হারামি করা যায়না। দাম দিতে হয়। প্রথম প্রথম আমজাদ লস্কর তার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে দুচারখানা কথা বলেছে, কোন কাজ হয়নি বলে আর কথা বারায়নি। কোথা থেকে যে খাবার তা আরেক রহস্য। অবশ্য গ্রামের লোকেরা এ বিষয়ে কিছুই জানেনা। তারা ভাবে সে বোধয় লস্কর বাড়িতেই থাকা খাওয়ার কাজটা সেরে নেয়।
নৌকায় বসে থাকতে থাকতে আমজাদ লস্করের কেমন যেন একটা ঘুমঘুম ভাব চলে আসে। বসার জন্য তার একটা আরাম কেদারা আছে, নৌকার পাটাতনের সাথে আটকানো। উপরে চালা দেয়া। রোদ বৃষ্টি কোনটাই ছুঁতে পারেনা। পাশে কোথাও গান বাজছে। গানের আওয়াজে ঘুম ঘুম ভাবটা কিছুটা কেটে গেছে। হাটে কোন দোকানি হয়ত উচ্চ স্বরে গান বাজাচ্ছে।
শয়তানের বাচ্চা! বিরবির করে একটা গালি দেয়। কত সাধ ছিল দেশটার নাম হবে পাকিস্থান। র্পূব পশ্চিম কিছুইনা। শুধু পাকিস্থান। পাক মানে পবিত্র আর স্থান মানে দেশ, পবিত্র দেশ হবে এই পাকিস্থান। আর কিছু আহাম্মকের কারনে আজ পাকিস্থান নামটা পাওয়া যায়নাই, পাওয়া যায়নাই সাধের উর্দু ভাষা। অন্তরে সাধ অন্তরের থেকে গেল। আফসোস, বরই আফসোস।
আমজাদ লস্কর শান্তি বাহীনির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বহু কুকর্ম ঘটিয়েছে এই আমজাদ লস্কর। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে কত মানুষযে জীবন্ত পুরিয়ে মেরেছে তার ইয়াত্তা নাই। যুদ্ধের সময় একটি পরিবার নওয়াবপুর গ্রামে আশ্রয় নিতে এসেছিল। একজন স্কুল শিক্ষক, সঙ্গে তার স্ত্রী, ঊনিশ বছর বয়সের এক মেয়ে ও মেয়েটির বার বছর বয়সের ভাই। এক দূর সম্পর্কের আত্মিয়ের বাড়িতে উঠে মাস্টার সাহেব। মসজিদের পাশেই বাড়ি। প্রায়ই উঠানে দেখা যেত মাস্টার সাহেব ছেলে ছোকরাদের নিয়ে বৈঠক করছেন। বিষয়টা সহজভাবে নেয়নি আমজাদ লস্কর। গোপনে মাস্টারকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন। তাতে তার সম্মানও বাড়বে এবং কুচক্রি মাস্টারেরও একটা উচিত শিক্ষা হবে। কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করায় কমান্ডার মাস্টারেকে ধরে পরিবার সহ ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলে।
মাস্টার সাহেব মনে প্রাণে একজন বাঙ্গালী ছিলেন। ভেবে ছিলেন এই গ্রামে সহজে হানাদার বাহিনী আসবেনা, তাই বউ বাচ্চাকে নিরাপদে রেখে যুদ্ধে যাবেন। মাস্টার সাহেবের মেয়েটা ছিল অসম্ভব সুন্দরী। এক সকালে বাড়ি যাওয়ার পথে মেয়েটির উপর চোখ পরে লস্করের।
মেয়েটি কে রে?
হুজুর মাস্টারের মাইয়া!
বাহ, বড়ই সুন্দর। বুঝলি ছগীর মেয়ে মানুষের সৌন্দর্য হল পুরুষ মানুষের জন্য। জেনানাদের সৌন্দর্য যদি পুরষে মাইনসের কামে না লাগে তয় তা ষোলআনাই বৃথা। বুঝলি!
জ্বী হজুর।
আয়, এ বিষয়ে পরে কিছু করব।
সেদিন রাতেই মাস্টারের লস্কর বাড়িতে ডাক পরে। মাস্টার লস্করের শান্তিবাহিনিতে যোগদানের খবর ভালই জানতেন। এ গ্রামে থাকাকে তিনি আর নিরাপদ মনে করেননি। গোপনে তার আশ্রয়দাতাকে একটা নৌকা ঠিক করতে বলেন। তিনি ফিরে আসলেই চলে যাবে এ গ্রাম ছেড়ে। মস্টার সাহেবের আর গ্রাম ছেড়ে যাওয়া হয়নি। সপরিবারে ধরা পরে লস্কর বাহিনির হাতে। আমজাদ লস্কর মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মাস্টার রাজি হয়নি।
গ্রামের লোকজনকে বোঝানো হয় মাস্টার গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। সে রাতে লস্কর নিজে তার নৌকা নিয়ে বিলের মধ্যে যায়। মাস্টারের দুই হাত-পা, চোখ ও মুখ বেঁধে জীবন্ত পানিতে ফেলে দেয়। তার বউয়ের ভাগ্যেও জোটে একই পরিণতি। ছোট ভাইটির হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখে নৌকার পাটাতনে। মেয়েটিকে জোর করে ধর্ষণ করে। ছিন্ন ভিন্ন কাপর আর ভূষনে মেয়েটি ঝাপ দেয় অথৈ জলে। ছেলেটিকে আর বাচিঁয়ে রাখার কারন খুঁজে পায়না লস্কর। তার ভাগ্যেও জুটে সলিল সমাধী। এই সত্য আজও গ্রামবাসি জানেনা। শুকনার সময়ে অবশ্য বিলে একটা বার চৌদ্দ বছরের ছোকরার কঙ্কাল পাওয়া গিয়ে ছিল। যেখানে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল আজ সেখানে বিরাট এক বট বৃক্ষ। সবার কাছে দূষিবট নামে পরিচিত। দিনে দুপুরেও ওই বটগাছের ধার কেউ ঘেঁসেনা। সেখানে নাকি ভূতের বাস।
বেলা অনেক হল। এখনও ছগীর আর কলিমউদ্দিনের দেখা নাই। নাহ্ দুইটারে নিয়া আর পারা গেল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছগীরকে দেখা গেল বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আসছে।
কিরে কলিমউদ্দি কই?
হেরে দেখলাম জাম গাছের নিচে বইসা আছে। খাইতে কইলাম, খায় নাই।
যা খুইজা নিয়া আয়। তারাতারি আসিস, দেরি করিস না। বেলা পইরা আসতাছে। এবেলা রওনা দিতে না পারলে বিলের মধ্যেই রাত হইয়া যাইব।
ছগীর কলিমউদ্দির খোঁজে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর কলিমকে নিয়ে ফেরে। কলিমকে দেখে অদ্ভুত লাগে আমজাদ লস্করের, কেমন একটা নিষ্ঠুর হাসি তার মুখে। চোখে খেলা করছে এক হিংস্র নিষ্ঠুর দৃষ্টি। আর ভাবতে চায়না আমজাদ লস্কর। নৌকা ছাড়তে বলে।
ঈষাণ কোনে হালকা মেঘ জমতে শুরু করেছে, সেই সাথে দমকা বাতাস। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ঢেউগুলো যেন ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে বিলে, শান্ত বিলটা যেন মুহুর্তে পাল্টে যেতে থাকে। আমজাদ লস্কর ভয় পেয়ে উঠে। ছগীরও ভয়ে তটস্থ। কলিম যেন কেমন নির্বিকার। বাতাসের বেগ ক্রমসই বেড়েই চলছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে নৌকার দোলনি। নির্বিকার কলিম যেন খুব মজা পাচ্ছে ঝড়ো বাতাসের উন্মত্ত খেলায়। হালকা মেজাজে গান ধরে কলিম,
“গৃহে তোমার আঁধার তত, মনে তোমার আধাঁর যত,
গঙ্গা স্নানে কায়া হয় শ্বেত, অন্তর মনোহর কোন স্নানেতে?
নিত্য যদি না রয় সত্য, কানা কড়িতে রইলে মত্ত-
মিলবেনা যে জীবনের অর্থ, করবে বেঁচে কী এই সংসারে!”
গানের পক্তিগেুলো কেমন যেন ভয়ংকর শোনায় আমজাদ লস্করের কানে। মনে হচ্ছে কেউ যেন উচ্চ স্বরে হাসছে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে তার কৃতকর্ম। ঝড় থেমে যাওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। নৌকার দোলনি যেকোন সময় নৌকাকে উল্টে দিতে পারে।
লস্কর পেছন ফিরে দেখতে চাইল কলিম কী করছে?
বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল তার। কলিমের দিকে চোখ ফেরাতেই আকাশে বিদুৎ চমকাল, কলিমের মুখ দেখার জন্য যেন স্রষ্টা নিজেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছুক্ষণের জন্য দেখা গেল কলিমের মুখ।
এ কী? এ তো কলিমের মুখ নয়।
সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এক দশ বার বছরের ছেলের মুখ কলিমের ধরে। সাদা, ফ্যাকাসে। তবে ঠুঁট ও চোখগুলো লাল, ভয়ংকর রকম লাল। পরক্ষণেই মিলিয়ে যায় আলো। কলিম নির্বিকার ভঙ্গিতে হাল ধরে আছে। ভয় পেয়ে যায় আমজাদ লস্কর। দূরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছগীর, তাকে ডেকে পাশে নিয়ে আসে।
আজ রাজ্যের ঘুম হারমজাদার চোখে, বাড়ি গিয়ে চোখে শরষের তেল ঢেলে দিব, জীবনের ঘুম ভুলিয়ে ছারব হারামজাদা। ভ্রুক্ষেপ করেনা ছগীর। কেমন যেন নেশাগ্রস্থের মত পরে থাকে। কষে এক লাথি মারে লস্কর ছগীরের বুকে। ব্যাথায় কুকরে উঠে ছগীরের শরীর। উঠে দাড়ায়, তাল সামলাতে পারেনা, পড়ে যায় পাটাতনে। উঠে দাড়াতে চেষ্টা করে আবারও, পারেনা। অসম্ভব ধারালো ভাবে বেকেঁ আছে টিনের তৈরী নৌকার চালাটা। সামনের দিকটা অত্যান্ত তিখ্ন ও ধারাল, চালাটার নিচে একটা দরজার মতন আছে নৌকার ভিতরে ঢোকার জন্য। এক পাটি বন্ধ অন্যটা খুলা। দরজার মাথায় একটা হুক বিশ্রিভাবে ঝুলে আছে। মূলত দরজাটা চালার সাথে ভিতরে আটকানোর জন্য এই ব্যবস্থা। ভারসাম্য রাখতে পারেনা ছগীর পরে যায়। হঠাৎ এক হেচকানে টানে কউ যেন ছগীরের দেহটাকে একটু শূণ্যে তুলে দেয়। ছিটকে ফেলে দেয় বেঁকে থাকা হুকটার দিক। ধপ করে একটা শব্দ হয়। বিশ্রি ভাবে হুকটা ছগীরের বাঁচোখে বিধে যায়। দরজার সামনে ঝুলে থাকে ছগীরের নিথর দেহ। বাতাসের প্রচন্ড শক্তি দরজাটাকে একবার সামনে একবার পিছনে ঠেলে দেয়। তাল মিলিয়ে ছগীরের নিথর দেহও আগে পিছে আসা যাওয়া করে। রক্তের একটা চিকন ধারা নৌকার মেঝে বেয়ে নিচে নেমে আসে। কেউ একজন এই রক্ত শোষে ফেলতে চাইছে। অত্যাচারীর রক্তে জল দূষিত হউক চাইছেনা। হতবিহবল আমজাদ লস্কর বুঝে উঠতে পারেনা কিছু। মুখ দিয়ে বমি বের হয়ে আসতে চায়, আটকাতে পারে না। বমি করে দেয়। পাটাতন ভেসে যায়। রক্ত বমি। রক্তে ভেসে যায় নৌকার পাটাতন। তার রক্ত, তার কর্মের মতই কাল। ধীরে ধীরে মুখ তুলে আমজাদ লস্কর, চোখদুটো তার কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। তার সামনে দাড়ানো কলিম, ধীরে ধীরে এক বার বছরের কিশোরে বদলে যাচ্ছে সে। ভয়ংকর এক অপার্থিব হাসি ফোটে উঠেছে কিশোরটির চেহারায়। চেহারাটা আমজাদ লস্করের পরিচিত।
পরদিন সকালে একজন জেলে গ্রামে খবর দেয় আমজাদ লস্করের নৌকা দূষিবটের ডালে বাধাঁ। গ্রামবাসি দল বেঁধে যায়। নৌকার গুলুইয়ের কাছে বিশ্রিভাবে পরে আছে ছগীরের মৃত দেহ। আমজাদ লস্কর চেয়ারে বসা। সাদা পাঞ্জাবী বেয়ে একটা রক্তের চিকন ধারা নিচে নেমে গেছে। ঘারটা যেন কেউ প্রচন্ড ঘৃণায় মুচরে দিয়েছে। হা করা মুখের পাশে কয়েকটা মাছি বনবন করে উরছে। একবার মুখের ভিতরে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। লাশ দুটা নৌকায় তোলার কথায় কয়েকজন আপত্তি তোলে। অপঘাতে মৃত্যু। থানা পুলিশের ব্যাপার। পুলিশ এসে যা করার করবে। লাশ আপাতত পরে থাক, থানায় খবর দিতে হবে। সকলের অলক্ষ্যে একটা দাঁড়কাক বট গাছের মগডালে বসে তিখ্ন নজর রাখছে। সবাই চলে যেতে দাঁড়কাকটি উরে আসে। নৌকার চালায় বসে। ঠিক লস্করের মাথার কাছে। দাঁড়কাকটির চোখ এবং ঠোঁট অসম্ভব লাল। লাল খুনে চোখে কেমন এক প্রশান্তির ছায়া।
©somewhere in net ltd.