![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রচন্ড রোদের মধ্যে পিয়াস হেঁটে যাচ্ছে। আশেপাশে ছায়া নেই, মাথায় ছাতাও নেই। রোদে যেন পিচঢালা রাস্তাও গলে যাচ্ছে। যদি পায়ে চামড়ার জুতোজোড়া না থাকতো তাহলে হয়তো গাড়ির টায়ারের মতো পা দুটি ঠাশ করে ফুটে যেতো নয়তো রিকশার টায়ারের মতো কিছুক্ষণ গিয়ে লিক হয়ে যেতো। পিয়াস হাঁটার স্পিড একটু বাড়িয়েছে। এর বেশি বাঁড়ালে আর হাঁটা বলা যাবে না। বলতে হবে দৌঁড়াচ্ছে। রিকশা বা বাস ধরলে হবে না। মধ্যবিত্তদের পকেটে হাত না দিয়ে চট করে বাস বা রিকশায় উঠলে হয় না। পকেটে দেখতে হবে কতটাকা আছে। যাওয়ার সময় রিকশায় গেলে আসার সময় পকেট খালি থাকবে কি না তার সমীকরণ একবার মিলিয়ে নিতে হবে। গন্তব্য ধানমন্ডি লেক। নিলা সেখানে একা বসে আছে। ওদের প্রথম দেখা কলেজে হয়েছিল। দেখা হয়েই প্রেম হয় নি। মধ্যবিত্তদের সাথে প্রথম দেখায় প্রেম হয় না। যেটা হয় সেটা হলো ঝগড়া। ঝগড়া থেকে বন্ধুত্ব হয় তারপর আস্তে আস্তে প্রেম। গভীর প্রেম হয়। প্রশান্ত সাগরের চেয়েও গভীর। পিয়াস লেকে পৌঁছে গিয়ে দেখল নিলা ব্রেঞ্চের এক কোণে একা বসে আছে। কেউ ব্রেঞ্চের এক কোণে বসে আছে তার মানে কারো জন্য সে অপেক্ষা করছে সে মানুষটি পাশে এসে বসবে। পিয়াস নিলার পাশে গিয়ে চুপ করে বসলো। নিলা দূরে সরে গিয়ে বসলো। নিলা খুব বেশি ক্ষণ হয় নি এসেছে। কিন্তু তবুও আগে এসেছে। একটু হলেও আগে এসেছে কিন্তু এমন ভান করছে যেন গতকাল রাত থেকে বসে অপেক্ষা করছে।
.
নিলার ভান করাটাও পিয়াস বুঝতে পারছে। নিলা এই মাত্র এসেছে তার প্রমাণ নিলার নাক ঘামছে। নিলা হয়রান হলে নাক ঘামে। এখন ও ওর নাক ঘামছে। যদি আগে আসতো তাহলে এতক্ষণে লেকের খোলা বাতাসে ঘাম শুকিয়ে যেত। কিন্তু পিয়াস ওর ভান করাটা বুঝতে পেরেও নিজের মধ্যে রেখে দিল। ভালবাসায় কিছু কিছু জিনিশ প্রকাশ করতে নেই এতে পাগলামি হয় না। আর পাগলামি ছাড়া ভালবাসা লবণহীন তরকারির মতো। পিয়াস নিলার সামনে গিয়ে কান ধরে বললো, আর লেইট হবে না। নিলা তবুও কথা বলছে না।
পিয়াস কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। নিলা ক্ষাণিকটা পর মুখ খুলে বললো, হয়েছে বসো।
"রাগ কমলো তাহলে?"
"জানিনা। গতকাল কে তোমার সাথে কথা বলার সময় আমার মা সব কথা শুনে ফেলেছেন। উনি আড়ালে থেকে সব কথা কান পেতে শুনেছেন। এমনভাবে শুনেছেন টিকটিকিও এমন চুপ করে কথা শুনে না"। কিছুক্ষণ পর টিকটিক করে তার উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। কিন্তু মা একেবারে শ্বাস বন্ধ করে চুপ হয়ে কথা শুনছিলেন।
"তারপর??"
"তারপর কি হতে পারে জানোনা?? আমার উপর তেড়ে আসলেন। এক গালে ঠাশ করে চড় মেরেছেন। যাতে আমার তোমার সাথে বিয়ে না হয়। এই দেখো এখনো লাল হয়ে আছে।" তারপর আমাকে তিনবার তওবা করিয়েছেন আর যাতে তোমার সাথে কথা না বলি।"
"তোমার বাবাকে কিছু বলেন নি??"
"বলেছেন, বলবেন না কিন্তু আমি জানি রাত্রেই সব বলে দিয়েছেন। মেয়েদের পেটে কথা হজম হয় না। এই যে আমি মনে মনে মা কে টিকটিকির সাথে তুলনা করেছি সেটাও তোমাকে বলে দিলাম। ছিঃ! কোন মেয়ে বয়ফ্রেন্ডের সামনে নিজের মা কে টিকটিকি বলতে পারে?? আমার জিহ্বা খসে পড়া উচিৎ।"
" এই ঘটনার পর তোমার বাবার সাথে তোমার কথা হয় নি??"
" হয়েছে। সকালেই হয়েছে। নাস্তা করতে করতে অনেক কথা হয়েছে। বাবা আজ কে আমাকে রূপকথার রাজকুমারের গল্প শুনিয়েছেন।"
"তাহলে ত আর কোন সমস্যাই রইলো না। তোমার বাবা এসব শুনেন নি। শুনলে ত কিছু বলতেন কিন্তু উনি উল্টো গল্প শুনিয়েছেন।"
" গল্প শুনিয়েছেন বলেই ত সন্দেহ হচ্ছে।তা না হলে হঠাৎ করে রাজকুমারের গল্প শোনাবেন কেন??"
" থিংক পজিটিভ নিলা"
" ইউ বি সেনসিটিভ" তুমি কিচ্ছু বুঝতে পারছো না।"
হঠাৎ চললাম বলে নিলা ব্রেঞ্চ থেকে উঠে চলে গেলো। পিয়াস পিছু ডাকলো কিন্তু শুনলো না। পিয়াস বাদামওয়ালা কে ১০ টাকার বাদাম দেয়ার জন্য বলেছিল। নিলা চলে যাওয়ায় বাদাম আর খাওয়া হলো না। পিয়াস একটা বাদাম ও খায় নি। তাই বাদাম ফেরত দিয়ে ২ টাকা কমিয়ে ৮ টাকা ফেরত এনেছে। এই ৮ টাকার সাথে ২ টাকা যোগ করে আরেকদিন নিলাকে নিয়ে বাদাম খাওয়া যাবে। টাকাটা ফেরত আনার পর বাদামওয়ালা আড়চোখ করে কেমন তাকিয়ে ছিল। নিশ্চয়ই এই কথা টা অন্যদের কাছে গিয়ে গিয়ে বলবে। তবে নাও বলতে পারে ওদের কাজ শুধু "এই বাদাম, বাদাম লাগবে বাদাম" এসব বলে বাদাম বিক্রি করা। অন্যদের সাথে গল্প করা নয় আর ও বললেই অন্যরা তা বিশ্বাস করবেই বা কেন।
.
সন্ধ্যায় নিলার মা নিলার রুমে ঢুকে বললেন, তুই আজ ঐ ছেলেটার কাছে গিয়েছিলি??
"হে"
"তকে না কাল কে তওবা করালাম। তুই তওবা ভাঙ্গলি??"
"আমি মনে মনে তওবা করি নি। আল্লাহ বলেছেন মুখে আর মনে দুইটা থেকেই স্বেচ্ছায় তওবা করলে তওবা হয়। অন্যথায় হয় না।"
"তর বাবাকে আমি সব বলে দিয়েছি। বলতে চাইছিলাম না কিন্তু মেয়ে কি করে বেড়াচ্ছে তা বাবা হিসেবে ওর জানা দরকার"
" আমি জানি বলে দিয়েছ। কাল রাত্রেই বলে দিয়েছ।"
"চুপ! বেহায়া মেয়ে। আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস্।"
"বাবা কি বলেছেন??"
"খুব খেপে গেছে। খেপে গেলে কি করে তুই জানিস না?? মনে মনে ইয়া নফসি, ইয়া নফসি কর।"
নিলার স্পষ্ট মনে আছে ওর বাবা একদিন ওর মায়ের উপর রেগে গিয়ে মায়ের মুখে মুখে গরম চা ফেলে দিয়েছিলেন। কি ভয়ানক কান্ড হয়েছিল তখন। মায়ের ভাগ্য ভালো ছিল তাই গরম চা মুখে না পড়ে গলায় পড়েছিল। গলায় অনেক অংশ পোড়ে গিয়েছিল। এক মাস পোড়া অংশে মলম লাগাতে হয়েছিল। এখনো গলায় সেই পোড়া দাগ টা আছে। ওর মা মাঝে মাঝে আয়নায় পোড়া অংশটা দেখলেই বাবার সেই ভয়ানক কান্ডটার গল্প করেন আর নিলাকে ভয় দেখান।
.
সূরা ইখলাস তিনবার পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নীলা ওর বাবার রুমে গিয়েছে। আজকে কি হবে সেটা আগে থেকেই বুঝতে পারছে। নীলা মনে মনে বলছে সত্যি ই ত মেয়ের এমন কীর্তি কোন বাবা মেনে নিতে পারে।
"বাবা আমাকে ডেকেছ??"
"হে। বসো এখানে"
নীলা তারপরও দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে হাত পা শিউরে উঠছে।
"কি হলো বসতে বললাম না??"
" জ্বী বাবা" ( নীলা চুপচাপ সুফায় বসলো)।
" পড়াশোনা কেমন চলছে??"
"জ্বী বাবা ভালো"
" গ্রেজুয়েশন কম্পলিট হতে আর কত দিন লাগবে??"
" দুই বছর"
"শুনলাম ইদানীং খুব বাইরে ঘোরাফেরা করো"
" কই না ত। একটু আধটু বান্ধবীদের সাথে যাই"
"বন্ধু না বান্ধবী?? ছেলেটা কে??"
"কোন ছেলেটা??"
" যে ছেলেটার সাথে পার্ক থেকে বের হলে আজ।"
নীলা চুপ হয়ে গিয়েছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
"আমি সব জানি। তোমার মা বলার আগেও জানি। বিকেলে ছাদে যাওয়ার নামে ফোনে কথা বলা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু ভাবা, মাঝে মাঝে তোমার মার আর আমার মোবাইল থেকে টাকা কেটে যাওয়া। আমি সব জানি, কেন কি কারণে এসব ঘটছে। ছেলেটার নাম কি??"
"পিয়াস"
" কিসে পড়ে??"
"এবার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হবে"
"বাবা কি করে?? বিজনেস??"
" না স্কুল টিচার"
"তোমার বাবা মানে আমি কি করি?? "
"বিজনেস"
" তুমি জানো তোমার বাবার গুলশান, বসুন্ধরায় কয়টা বাড়ি আছে??
নীলার চোখে জল। একফোঁটা জল চোখ বেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে। নীলা সে জল পা দিয়ে মুছবার চেষ্টা করছে। কোন কথা বলতে পারছে না।
"তুমি ওকে বলবে যে ওর বাবা যেন কালকে আমাদের বাসায় আসেন। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।"
.
পরিশিষ্টঃ- আজ দুই যুগ পরে ওদের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে নীলা আর পিয়াস বসে আছে ধানমন্ডি লেকের খোলামেলা বাতাসে এক পড়ন্ত বিকেলে। সেদিন নীলার চোখের জল দেখে ওর বাবা পিয়াসের বাবাকে ডেকে এনে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পিয়াসের বাবা রাজী হলে পিয়াসের চাকরি আর নীলার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার পর ওদের বিয়ে হয়। আজ দেড় যুগ পর পিয়াস আর নীলার চুলে একটু আধটু পাক ধরেছে। নীলা ব্রেঞ্চে পিয়াসের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। পিয়াসের চোখ অন্যদিকে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ব্রেঞ্চে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ মেয়েটি রাগ করে চলে যাওয়ার পর ছেলেটি হাতে বাদাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি চলে যাওয়ার পর ছেলেটি বাদামওয়ালার কাছে বাদাম আবার ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিচ্ছে। বাদামওয়ালা আড়চোখে তাকাচ্ছে। পিয়াস এদের দেখে নিজের পুরনো ঘটনাকে মনে পড়ে গেলো। মুচকি হেসে মনে মনে বললো, সত্যি মধ্যবিত্তরাই পারে তাদের জীবন পেন্সিল দিয়ে সুন্দর করে আঁকতে। তাদের হাতে পেন্সিল থাকে আবার রাবার ও থাকে। যেখানে ভুল হয় সেখানে রাবার দিয়ে কেটে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু বড়লোকের জীবন সাজানো থাকে পেইন্টিং পেপারসে। ভুল হলে সংশোধন না করে পেপারস ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন পেইন্টিং পেপারস কিনে আনে।
পিয়াস নিলার কাঁধে হাত রেখে দুজনে সূর্যাস্ত দেখছে। এভাবেই আজ ওরা সন্ধ্যা অবধি বসে থাকবে। :-)
©somewhere in net ltd.