নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না তবু কেউ কেউ বেঁচে থাকে।

হাবিব শুভ

হাবিব শুভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ- \' সাহেব ছেলে \' ( A Story of sad)

৩১ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:০২

আমার মা-বাবা ছিলেন গরিব। টাকার অভাবে আমাকে ওনারা পড়ালেখা শিখান নি। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর এই ঢাকা শহরে আসি। তারপর দুই-তিন বছর এই শহরে অনেক কষ্ট করলেও এর পরেই আমি সাফল্যের দেখা পাই। এর পরে আস্তে আস্তে বাড়ি, গাড়ি, বিয়ে, সংসার সব হয়। ছোট্ট সংসারে একটা ফুটফুটে ছেলে হয়। দেখতে অনেক সুন্দর। আমার বংশের সব চাইতে সুন্দর ছেলে। গায়ের রঙ ফর্সা। সাহেবের সন্তানের মতো। ভাবলাম আমার পূর্বপুরুষ গরিব ছিলেন তাই আমরা গরিবের মতো দেখতে ছিলাম। আর আমি বড়লোক তাই আমার সন্তান সাহেবের মতো হয়েছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ছেলের মাঝে গরিবের কোন চিহ্ন রাখবো না। সাহেবের মতো বড় করবো। ছেলে একটু বড় হওয়ার পর ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করলাম। ছেলে বড় হচ্ছে ভাবলাম ছেলে বড় হয়ে যদি আমার কথা বার্তা, চাল-চলনের এমন অবস্থা দেখে তাহলে বন্ধুদের সামনে লজ্জা পাবে তাই কথা-বার্তা, চাল-চলনের বেশ বদলালাম। বড় দের পড়ালেখা শিখানো হয় এমন স্কুলে গিয়ে আমি নিজেও পড়ালেখা শিখলাম। ছেলে আমার আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে তার সাথে ওর চাল-চলন ও বদলাচ্ছে। বদলাবে না কেন ওর সব বন্ধু যে বড়লোক শ্রেণীর। একদিন দেখলাম, দরজার সামনে এসে বললো, Open the door. আমি শোনে খুব খুশি হই। ছেলে ইংরেজি শিখছে। এতো আনন্দের খবর। কয়েকদিন পর আমি ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে ওকে আদর করার জন্য জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম ছেলে আমার নাক উষ্কাচ্ছে। আরও একটু বড় হয়ে ত বলেই দিয়েছিল " Don't touch me Daddy, it's disgusting." আমি ইংরেজি বেশ বুঝি না। ছেলের এই কথার ইংরেজি ও বুঝি নি। আমি ত আরও খুশি। ছেলে দেখছি আরও ইংরেজি বলা শিখছে। সেদিন আমার এক শিক্ষিত বন্ধু পাশে ছিল, সে আমাকে বললো, এই কথাটার অর্থ, তাকে যেন আমি স্পর্শ না করি, সে বিরক্ত বোধ করছে। আমি সেদিন একটুও মন খারাপ করে নি। ছেলে আমার সাহেব হচ্ছে, একটু আধটু ত নাক উশখুশ করবেই। সত্যি ই ত আমার সেদিন ঘামে ভেজা শরীর ছিল। আমার ঘামে ওর এত দামী শার্ট নষ্ট হচ্ছে এটা আমার ভাবা উচিত ছিল।
আস্তে আস্তে যুগ পাল্টালো। ও ভর্তি হলো বড় বিদ্যালয়ে। এটা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়। পাশের ফ্লাটের এক ভাড়াটিয়া বললো, আমার ছেলে নাকি ওর মেয়েকে রাস্তায় ডিস্টার্ব করে। এটা নাকি ইভটিজিং। আমি বললাম, বয়সের দোষ। ঠিক হয়ে যাবে।
আরও কিছু বড় হলো, দেখলাম মুখে সিগারেট আর একটা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ঘরে ঢুকলো। আমি বললাম, ও কে রে বাবা??
বললো, " She is my girlfriend daddy.." আমি চুপ রইলাম। যদি বলি বাপ রে আমি ত ইংরেজি বুঝি না।য় বাংলায় ক। তাহলে ঐ মেয়ের সামনে ছেলের মাথা কাটা যাবে। তারপর মেয়েটাকে নিয়ে ছেলে তার রুমে ঢুকলো। বয়স ত আর কম হয় নি, ইংলিশ টা না বুঝলেও এটা ঠিকি বুঝলাম এই মেয়ের সাথে আমার ছেলে খুব ই ঘনিষ্ঠ। লজ্জার বিষয় কি আর বলবো, ছেলে দেখতাম প্রায় ই মেয়ে নিয়ে বাড়ি আসতো।
আশেপাশে এটা নিয়ে জানাজানি হয়ে গেলো। সবাই আমাকে লজ্জা দেয় এটা নিয়ে, আমি তখনো বুক উঁচা করে ওদের বলতাম, ছেলে আমার ডিজিটাল। টাকা থাকলে এই সকল ফুর্তি করা দোষের না। তদের টাকা নাই তাই হিংসে হচ্ছে। আমি এসব লোককথা কানে নিতাম না। একদিন আমার বন্ধু আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো," One day You will suffer" আমি এ কথাটার মানেও বুঝলাম না। তবে ওর মুখ দেখে অনুমান করলাম, আমার জন্য খারাপ কোন সংবাদ দিচ্ছে। আমি সব কিছু এড়িয়ে চললাম। কিছু বুঝলাম না, নাকি বুঝার চেষ্টা করলাম না সেটাও বুঝি নি।
আমার সাহেব ছেলে কত বড় হয়েছে তা খেয়াল করি নি। তবে, খেয়াল করে দেখলাম ওর মুখে দাড়িগোঁফের নমুনা। কাটাকাটা দাঁড়ি আর গোঁফের নমুনা দেখে সত্যি আমার ছেলেকে আজ আমার ছেলে বলে লাগছে না। কোন সাহেবের ছেলে লাগছে।
ঘুমিয়ে ছিলাম রাতে, বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল একটাবার ছেলের ঘুমন্ত মুখ খানা দেখি। আহ! কত দিন ছেলেটাকে ছুঁয়ে দেখি নি। বুকে জড়িয়ে ধরে বলি নি, আয় বাবা বুকে আয়, ইচ্ছে করছিল নিজের হাতে চুল আঁচড়ে দেই, ভাত মাখিয়ে মুখে খাইয়ে দেই। রাতে দরজা খুলে ওর রুমে ঢুকলাম। ছেলে আমার ঘুমিয়ে আছে। লাইট টা জ্বালালাম না যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়। আঁতকে উঠে ভয়ে?? না আমি আস্তে আস্তে রুমে ঢুকলাম। একি?? ছেলের ঘরে সিগারেটের গন্ধ ছাড়াও আরও কিসের গন্ধ আসছে। এটা কি মদের গন্ধ?? না আমার ছেলে রিকশাওয়ালা, ট্রাক ড্রাইভারের মতো মদ খাবে?? এটা হতে পারে না। চুপচাপ রুম থেকে চলে গেলাম। ভাবলাম, কালকে সকালে গন্ধ টা কিসের জিজ্ঞেস করবো ক্ষণ। এখন থাক। বাবা আমার ঘুমিয়ে থাকুক।
সকালে উঠলো জোহরের আজানের পর। ততোক্ষণ আমি ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করলাম ওর জন্য। ও ঘুম থেকে উঠার পর বললাম, বাবা তোমার ঘরে কিসের একটা গন্ধ গন্ধ করে। কেমন জানি মদের মতো, এটা কি বাবা???
'এটা বিয়ার, মদ না'
' এটা খেলে কি হয়??'
' এনার্জি, এটা তুমি বুঝবে না'
সত্যি আমি বুঝি নি এটা কি। তবে অনুমান করলাম এটা খাওয়া ভাল কিছু না। নেশা জাতীয়। তবু বললাম না কিছু। বুঝতে পারলাম ছেলেকে হয়তো আমি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছি।
হঠাৎ করে একদিন আমার ছেলে কে খুঁজে পাওয়া গেলো না। থানায় মিসিং জি.ডি করার আগে আমার বাসায় এক ব্যক্তি থানা থেকে পুলিশ নিয়ে আসলো। আমার ছেলে উনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমার টাকার অভাব ছিল না। টাকা দেখে মেয়ের বাপও অমত করার কথা না। টাকা দিয়ে পুলিশি কেইস হ্যান্ডল করে নিলাম। ছেলে আমার বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। হায়রে! কত আশা ছিল এক ছেলেকে ধুমধাম করে বিয়ে দিবো। রাজকন্যা দেখে বিয়ে দিবো। ছেলে আমার এর আগেই রাজকন্যা না, নাচকন্যা কে বিয়ে করেছে। নাচকন্যা বললাম কারণ বিয়ের পর বাসায় প্রায় ই উচ্চ শব্দের মিউজিক বাজিয়ে নাচ গানের আয়োজন করা হতো। আমার ছেলের সাথে ধেইধেই করে নাচতো। আমার সামনেই এসব হতো। এসব সহ্য করতে না পেরে একদিন ওর মা ও মারা গেলো। ঘুমের মধ্যে হার্ট এটাক। ডাক্তার বলেছিল, অতিরিক্ত টেনশন করায় এই হার্ট এটাক হয়েছিল।
ওর মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর, একদিন আমার কাছে এসে বললো, ও নিজে ব্যবসা করবে, আমার এই বিশাল সম্পত্তি নাকি ওর মনে ধরছে না। তাই সে এই সম্পত্তি কে দ্বিগুণ করার প্ল্যান করলো। কিন্তু ব্যবসা করতে ত টাকা লাগবে। তাই আমাকে বললো টাকা দিতে। আমি ভাবলাম, হয়তো এতদিনে আমার কষ্ট টা কমবে। যাক ছেলের হাতে সব বুজে দিয়ে আমি একটু আরাম করবো। একদিন একটা দলিলে সে জন্য কতগুলো সাইন করিয়ে নিলো। আমিও না দেখে সাইন দিলাম। নিজের ছেলে ত আর বেইমানী করবে না। আর একদিন ত ওই হবে সম্পত্তির মালিক। আমিও কোন ধরাবাঁধা করলাম না। কিন্তু হায়! ছেলের কোন উন্নতি নাই। টাকা উড়াচ্ছে। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। এতদিনে বুঝলাম ছেলে গোল্লায় গেছে। বউ এনে আরও বেশি বিপথে গেছে। একদিন বউ এর কথায় বাড়ি থেকে বের করে দিলো। বললো আমি শুধু শুধু একটা রুম জুড়ে রেখেছি। মেহমান এলে নাকি জায়গা হয় না। আমি বললাম, আমার বাড়ি আমি থাকবো না??
ছেলে বললো, সেদিন একটা দলিলে সব আমার থেকে ওর করে নিয়েছে। এতে আমার কোন অধিকার নাই। আমার ছেলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে ঠিকি কিন্তু পথে বসিয়ে দেয় নি। এই যে এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। মাস হলে কিছু টাকা পাঠায়। এসবে চলে যায়। আমি ভাবলাম ভালই আছি। এখানে আমার বয়সী আরও কতজন আছে ওদের সাথে গল্প করে সময় ঠিক পার হয়ে যাবে। আমার ছেলে ভালই করেছে। বাবার প্রতি কত বড় দায়িত্ব পালন করেছে। কজন করে এমন দায়িত্ব?? বলে রফিক মিয়া মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে চোখ দুইটা মুছলেন।
তিনি আর শামসুদ্দিন কে কিছু বলতে পারছেন না। উনার গলায় যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিছে।
শামসুদ্দিন ও এতক্ষণ ধরে রফিক মিয়ার এই বৃদ্ধাশ্রমে আসার গল্প শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারলো না। বললো, থাক চাচা আর কইতে হইবো না।
রফিক মিয়া শামসুদ্দিন কে বললেন, তা বাবা তোমার ঘরে কে কে আছে??
'আমার মা অন্ধ আর বাপ প্যারালাইজড হয়ে ঘরে পইড়া আছেন। মা-বাপ ছাড়া আর কেউ নাই।'
' তা বাবা তাদের চিকিৎসা করো কিভাবে?? এই বৃদ্ধাশ্রমের দারোয়ানির কাজ করে আর কত টাকাই পাও'
' চাচা এইখান থাইকা সন্ধ্যার পর গিয়া রিকশা ছালাই। আল্লার বান্দা আল্লাহ মারে না, ঠিকি হইয়া যায়'।
রফিক মিয়া ভাবলেন, সাহেব ছেলে জন্ম না দিয়ে যদি এমন একটা দারোয়ানির কাজ করা কোন ছেলে কে জন্ম দিতাম তাহলে আজ ওনার বৃদ্ধাশ্রমে থাকা লাগতো না। সব দোষ উনার নিজের। ছেলেকে সাহেব বানাতে গিয়ে অমানুষ বানিয়েছেন। রফিক মিয়া শামসুদ্দিনের মাথায় হাত রেখে বললেন, "বেঁচে থাকো বাবা"।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। রফিক মিয়া বললেন যাই বাবা, নামাজ পড়তে হবে আজান হচ্ছে।
শামসুদ্দিনঃ- আইচ্চা চাচা যাই। কালকে আবার আসবো।
শামসুদ্দিন চলে গেলো। রফিক মিয়া আবার মোটা ফ্রেমের চশমা চোখ থেকে খুলে সাদা পাঞ্জাবীর কাপর দিয়ে চশমা টা পরিষ্কার করলেন। এখন তিনি সব কিছু ঝাপসা দেখেন, সাহেবের মতো কাউকে দেখলেই ভাবেন উনার ছেলে আসছে কিন্তু কাছে গেলেই তিনি দেখেন না ইনি উনার সাহেব ছেলে না।তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, আজকাল উনার চশমাটার পাওয়ার নষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি উনার চোখটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
শামসুদ্দিন দরজা-জানলা লাগিয়ে চলে যাচ্ছে। আরেকটা রুম থেকে আরেকজন বৃদ্ধা ডাক দিয়ে বললেন, শামসুদ্দিন, চইলা যাচ্ছো বা'জান। যাওয়ার আগে ঐ গান টা একটু বাজাইয়া দও না রে বাপ,
শামসুদ্দিন গিয়ে টেপের মধ্যে ক্যাসেট লাগিয়ে গান টা চালিয়ে দিলো,
গান বাজছে আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা গুলোর চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল পড়ছে- গানটা হলো,
" ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার,
মস্ত ফ্লেটে যায়না দেখা এপারওপার,
নানারকম জিনিশ আর আসবাব দামীদামী,
সব চেয়ে কমদামী ছিলাম একমাত্র আমি,
ছেলের আবার আমার উপর অগাধ সম্ভ্রম,
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম "
.
( বিঃদ্রঃ- গল্পে রফিক মিয়া ইংরেজি জানেন না, গল্পের উনার উক্তিতে যে ইংরেজী লাইন গুলো তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো গল্পের সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫১

কালীদাস বলেছেন: সিম্পল এবং কমন একটা কাহিনী ঝরঝরে লেখনিতে বেশ সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। চমৎকার :)

০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০০

হাবিব শুভ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.