![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিক্ষাজীবন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাজতত্ত্ব বিভাগে। অনেকপরে আবার একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম,বি,এ,করি। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে কর্মজীবনের শুরু। উন্নয়ন সংস্হায় প্রথম কাজ করি। এই সময় দেশের বিভিন্ন স্হানে ঘুরাঘুরির সুযোগ হয়। দেশের মানুষ ও প্রকৃতির রঙ, আর বিচিত্র পেশার মানুষে সাথে দেখা হয়। অতঃপর পোশাক শিল্পে কাজ করি। ২০০০-২০০৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে কর্মরত ছিলাম। ২০০৪ সালে আবার ফেরৎ আসি আমার প্রাণের কর্মক্ষেত্র পোশাক শিল্পে। সেই থেকে আজ অবদি কাজ করছি এখানে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানান দেশে ভ্রমণ করি। কাজের ফাঁকে পড়ি। মন চাইলে লিখি। ভাষার দক্ষতা তেমন নেই। চেষ্টা করছি ভাষা আয়ত্ত্ব করতে। কিছু বিচিত্র বিষয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। লেখার কাজে হাত দিয়েছি। দেশে দেশে পোশাকের বিবর্তন নিয়ে লিখছি। এই নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালই লাগে। যাপিত জীবনের কথা, ক্লেদ, প্রেম অভিজ্ঞতা লেখব ভাবছি।
১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের আগে একদিন, ভিসি স্যারের অফিসে স্যারকে ঘেরাও করে রাখা হল। মাঝরাতে ফজলে হোসাইন স্যারের সহযোগীতায় তার একটা নিষ্পত্তি হয় বটে। সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদ তাদের অবরোধ তোলে নেয়। আমাদের আশংকা ছিল, ছেলেরা রাতে হলে ফিরলে শিবির উৎপাত করবে। আমাদের আশংকা যে নিজেদের জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানত।
অবরোধ শেষে ভোর বেলা হলে ফিরছি। আমি ও সেলিম ভাই ( পরিসংখ্যান বিভাগ), তিনি ফাইনাল ইয়ারে ছিলেন। পরিক্ষা হবে সামনে। সুঠাম দেহি। অনেক লম্বা, মাথার চুল কোঁকড়ানো। গলা ফাটিয়ে গান করেন, গীটার বাজান। ক্যাম্পাসে সেই সময় অনেক পরিচিত মুখ। বর্তমানে কলেজ শিক্ষক। আমারা সোহরাওয়ার্দী হলের গেইটে পৌছেছি। সেলিম ভাই জিজ্ঞেস করলেন দেখ গেইট কেউ আছে কিনা। আমি গেইটে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। গেইট ভেতর থেকে তালা মারা। ছোট পকেট গেইটও বন্ধ। আমি জিজ্ঞেস করলাম এখন কি করব। সেলিম ভাই বললেন চল, গেইটের উপর দিয়ে ভেতরে চলে যাই। এত রাতে আর কোথায় যাব। আমিও রাজি হলাম। আমার দেহখানা যেহেতু অনেক হালকা ৪৮ কেজি ওজনের মাত্র। লিকলিকে, গ্রামের ছেলে। আম গাছ, জাম গাছে চষে বেড়িয়ে ঘুরেছি। কাজেই চার পাঁচ ফুটের দেয়াল পাড়ি দেয়া খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম কেউ নেই। আসপাশের কারো আওয়াজ, ঘুরাফেরা বা কোন শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। আমার অভিমত নিয়ে সেলিম ভাই ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢোকার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শিবির ঝাপিয়ে পড়ল। প্রতিটি হলে শিবিরের ক্যাডাররা পাহারা দিত। ছাত্রাবাস গুলো ছিল দুর্গেরমত। রাতে হলে তালা ঝুলিয়ে রাখত। হল থেকে বাইরে গেলে বলে কয়ে তালা খুলতে হত। শিবিরের পাহাড়া চলত ২৪ ঘন্টা। পালাক্রমে ছিল সেই পাহাড়ার কাজ। আমরা গেইটে তালা দেখে ওয়াল ডিঙ্গিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। ভেতরে ঢুকেই যেন পড়লাম বাঘের খপ্পরে। বাঘ যেমন থাবা দিয়ে ধরে, তেমনি শিবিরের ছেলেরা আমাদের কে খেয়ে ফেলার উপক্রম হল।
আসলে আমাদের জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিল শিবির। লাঠিশুটা নিয়ে গেষ্টরুমে আগে অপেক্ষা করছিল। অবরোধ শেষে যারা হলে আসবে তাদের কে ধোলাই দেয়ার একটা মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে এই সময়টা বেছে নেয় শিবির। আমরা দুইজন ভেতরে প্রবেশ করে যেই মাত্র রুমের দিকে হাটা দিলাম শিবির লাঠি নিয়ে তেড়ে আসল। ওদের চিৎকার ধর ধর আওয়াজ শোনে আমি লাফিয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে বাইরে চলে এলাম খুবই ক্ষিপ্রতার সাথে। কিন্তু সমস্যা হল সেলিম ভাইকে নিয়ে। তিনিও চেষ্টা করলেন দেয়াল পাড়ি দিতে। এর মাঝেই শিবিরের ছেলেরা উনার পিঠে লাঠি পেটাতে আরম্ভ করল। বাইরে থেকে আমি সেলিম ভাই’র হাত ধরে টানছি। অনেক টানাটানির পর বাইরে নামাতে পারলাম। তারপর সেলিম ভাইকে কোনমতে শাহ আমানত হলের পূর্বপাশের একটি কটেজে নিয়ে যাই। সেখান থেকে পরে সেলিম ভাই শহরে পৌছান। কমরের দিকে, পায়ে উনি অনেক আঘাত পেয়েছিলেন। অনেক দিন শরীরে ব্যথা ছিল। অনেক কষ্ট করে পরিক্ষা দিয়েছেন। হলের বাইরে এসে কোনমতে জান বাঁচালাম। ভয় অনেক দিন তাড়া করেছে। ক্লাশ করতে ক্যাম্পাসে গেলে এদিক সেদিক নজর রেখে চলতে হত। আস্তে আস্তে এই রক্তে মাংশে মিশে গেছে। ভয় পেলেইত আরো বিপদ। সাহস করে চলতে হবে। যখন যা হবে দেখা যাবে; এই নীতি অবলম্ভন করে চলা আরম্ভ করলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে সেলিম একটা কলেজে শিক্ষকতা আরম্ভ করেছেন। হঠাৎ একদিন ষোল শহর দুইনম্বর গেইটে দেখা। নিয়ে গেলেন উনার বাসায়। কাছেই ছিল উনার বাসা। গেলাম সেখানে। চা পানি খেয়ে গল্প করছি। অনেক কথার মাঝে উনি সেই ভোরের কথা মনে করলেন। বললেন, আজও মনে হলে শরীরে ব্যথা পাই।
আমাদের দেশে শিবিরের রাজনীতি আরম্ভ হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জামাত আর ইসলামী ছাত্র সংঘের বিতর্কিত ভূমিকা পালনের কারনে। জামাত সহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তারপর ধর্মীয় দলগুলো নিজ নামে দেশে রাজনীতি করতে পারছিল না। কিন্তু তাদের তৎপরতা বন্ধ ছিল না। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে রাজনীতির যে নয়া সমীকরণ তৈরি হচ্ছিল সেই প্রেক্ষাপটে ইসলামী ভাবধারার কর্মীরা, যারা ইসলামী ছাত্র সংঘের সাথে জড়িত ছিল তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির ( সংক্ষেপে শিবির নামেই পরিচিত ছিল) সংগঠিত হয়। দলটি গঠিত হয়েছিল মাত্র ৬ জন কর্মী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় মসজিদে বসে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম আলী ( যুদ্ধাপরাধের দায়ে যায় সর্বোচ্চ শাস্তি হয়)। এখানে উল্লেখ যে পর পর দুজন সামরিক শাসনের আমলে শিবিরের জন্ম থেকে বিকাশ হয়েছিল। বর্তমানে তার কার্যক্রম কিছুটা শিথিল থাকলেও নিঃশেষ হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আধিপত্য তৈরি করেছিল একটি বর্বর ঘটনার মধ্য দিয়ে। সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন হিসাবে জাতীয় ছাত্র সমাজে গঠন করতে চেয়েছিলেন। তার কাঠামো, গঠন এবং কার্যক্রম তৈরি হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছিল তার কার্যক্রম। ১৯৮৬ সালে শিবিরের সাথে জাতীয় ছাত্র সমাজের সরাসরি সংঘাত হয়। সেখানে শিবিরের ছেলেরা জাতীয় ছাত্র সমাজের নেতা হামিদের হাত কেটে, কাটা হাত নিয়ে মিছিল করেছি। সেই তাদের দখলের রাজত্ব তৈরি হয়। তারপর ক্রমাগতভাবে অন্য সংগঠন গুলোকেও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। তৈরি হয় ক্যাম্পাসে এক রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব। শিবির ছাড়া আর কারো কোন কার্যক্রম ছিল না।
১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচন দিয়ে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, শিবির তা বানছাল করার সব চেষ্টা করছিল। উসকানি দেয়া, মারপিট করা। সুযোগ পেলেই ভয় দেখানো, ইত্যাদি। সেলিমভাই’য়ের উপর হামলার ব্যাপারটি নিয়ে তেমন কোন হৈচি ছিল না। সেলিম ভাই নিজেই নিষেদ করেন যে এই নিয়ে মিটিং মিছিল না করতে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে আর কোন কথা হয় নাই। চাকসু নির্বাচনের আগে আর হলে যাইনি। নির্বাচন হল। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য জিতে যায়। আমরা অত্যন্ত আনন্দে হলে গেলাম। বেশি দিন আমাদের আনন্দ ধরে রাখতে পারিনি। কেননা ধীরে ধীরে শিবির আবার তাদের হল কেন্দ্রিক আধিপত্য তৈরি করতে লাগল। ভয়ভীতি দেখিয়ে হল থেকে প্রগতিশীল নানা সংগঠনের ছেলেদের বের করে দিতে লাগল। আমরাও নিরপত্তার কারণে হলের বাইরে থাকতে লাগলাম। পরিবেশ একটু উন্নতি হলে আসি আবার কিছু একটা গন্ডগোল হলে আবার হল ত্যাগ। এই হচ্ছে ক্যাম্পাস রাজনীতির ধর্ম। এই সময় হলের ছেলেদের কাছ শিবির তাদের চাঁদা আদায় করত। চাঁদা আদায়ের কৌশলটা ছিল তাদের রশিদ বই গুলো ছিল দশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা, একশ টাকার আর পাঁচশ টাকার নোটের মতন। যার কাছে থেকে যতটাকা নিবে, তাকে তত টাকার একটা রশিদ ধরিয়ে দিত। না করলে দ্বিতীয়বার চাইবে না, কিন্তু আপনাকে দেখে নেবার হুমকি দিত। নিরীহ ছেলেরা এই চাঁদার খপ্পরে পড়ত বেশি।
কোন কিছু নিয়ে প্রক্টর অফিসে গেলে দেখা যেত সেখানে আগে থেকে একদল শিবির কর্মী বসা আছে। অভিযোগ না করে ফেরৎ আসতে হত। আর অভিযোগ করলেও প্রমাণ করা যেত না। ফলে বিচারও হত। মার খেয়ে,চাঁদা দিয়ে হলে থেকেছে অনেক নিরীহ ছেলে। কোন প্রতিকার ছিল না। একবার অধ্যাপক হাসান স্যার ( রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ) যিনি জামাতের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। শোনেছি উনি নিজেও জামাত সমর্থিত রাজনীতির সাথে জড়িত, তিনি বলে ছিলেন একটা সেমিনারে শিবির তার রাজনৈতিক কৌশলে ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র ইউনিয়নের কৌশল কে কাজে লাগাচ্ছে আর তার সাথে যোগ করেছে, লাঠি, অস্ত্র, ছোরা ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধুক। আমরা ক্যাম্পাস জীবনে যা দেখেছি কিংবা শোনেছি তা অনেকটা এই রকমই ছিল।
আদর্শের সাথে অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল ছিল শিবিরের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে যে গৌরব ছিল স্বাধীনতার আগে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের তাদের যে বীরত্ব গাঁথা ছিল, অহংকার ছিল। সামরিক শাসকদের হাতে তা ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র নেতারা আবার মাথা উচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছিল; সেই শিক্ষা আর এখন বিন্দুমাত্র বেঁচে নেই। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তার মৃত্যু হয়েছে। আজ ছাত্র রাজনীতি মৃত; যা আছে তা ব্যবসার করার একটা অবলম্ভন মাত্র।জাতীয় রাজনীতির অবক্ষয়ের মাঝে এই ছাত্র রাজনীতি আরো ক্ষয়িষ্ণু, কদাকার, কুৎসিত চরিত্র নিয়ে বিরাজ করছে।
আমাদের বিশ্বাস ছিল দেশে গণতন্ত্র আসলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। মানুষের মূল্যবোধের বিকাশ হবে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। কিন্তু হচ্ছে তার সম্পর্ণ বিপরীট ঘটনা। পারস্পারিক অশ্রদ্ধা, গালমন্দ বাড়ছে। অগণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভয়ভীতি, বেআইনি কার্যকলাপ যেন সবজায়গায় শিকড় গাড়ছে। ছাত্র রাজনীতিতে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে। কোন উন্নতি নেই। বরং উল্টোপথে হাঁটছে আমাদের দেশ।
১৯৯০ সালে চাকুসু নির্বাচনের আগে একদিন, ভিসি স্যারের অফিসে স্যারকে ঘেরাও করে রাখা হল। মাঝরাতে ফজলে হোসাইন স্যারের সহযোগীতায় তার একটা নিষ্পত্তি হয় বটে। সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদ তাদের অবরোধ তোলে নেয়। আমাদের আশংকা ছিল, ছেলেরা রাতে হলে ফিরলে শিবির উৎপাত করবে। আমাদের আশংকা যে নিজেদের জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানত।
অবরোধ শেষে ভোর বেলা হলে ফিরছি। আমি ও সেলিম ভাই ( পরিসংখ্যান বিভাগ), তিনি ফাইনাল ইয়ারে ছিলেন। পরিক্ষা হবে সামনে। সুঠাম দেহি। অনেক লম্বা, মাথার চুল কোঁকড়ানো। গলা ফাটিয়ে গান করেন, গীটার বাজান। ক্যাম্পাসে সেই সময় অনেক পরিচিত মুখ। বর্তমানে কলেজ শিক্ষক। আমারা সোহরাওয়ার্দী হলের গেইটে পৌছেছি। সেলিম ভাই জিজ্ঞেস করলেন দেখ গেইট কেউ আছে কিনা। আমি গেইটে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। গেইট ভেতর থেকে তালা মারা। ছোট পকেট গেইটও বন্ধ। আমি জিজ্ঞেস করলাম এখন কি করব। সেলিম ভাই বললেন চল, গেইটের উপর দিয়ে ভেতরে চলে যাই। এত রাতে আর কোথায় যাব। আমিও রাজি হলাম। আমার দেহখানা যেহেতু অনেক হালকা ৪৮ কেজি ওজনের মাত্র। লিকলিকে, গ্রামের ছেলে। আম গাছ, জাম গাছে চষে বেড়িয়ে ঘুরেছি। কাজেই চার পাঁচ ফুটের দেয়াল পাড়ি দেয়া খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম কেউ নেই। আসপাশের কারো আওয়াজ, ঘুরাফেরা বা কোন শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। আমার অভিমত নিয়ে সেলিম ভাই ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢোকার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শিবির ঝাপিয়ে পড়ল। প্রতিটি হলে শিবিরের ক্যাডাররা পাহারা দিত। ছাত্রাবাস গুলো ছিল দুর্গেরমত। রাতে হলে তালা ঝুলিয়ে রাখত। হল থেকে বাইরে গেলে বলে কয়ে তালা খুলতে হত। শিবিরের পাহাড়া চলত ২৪ ঘন্টা। পালাক্রমে ছিল সেই পাহাড়ার কাজ। আমরা গেইটে তালা দেখে ওয়াল ডিঙ্গিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। ভেতরে ঢুকেই যেন পড়লাম বাঘের কপ্পরে। বাঘ যেমন থাবা দিয়ে ধরে, তেমনি শিবিরের ছেলেরা আমাদের কে খেয়ে ফেলার উপক্রম হল।
আসলে আমাদের জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিল শিবির। লাঠিশুটা নিয়ে গেষ্টরুমে আগে অপেক্ষা করছিল। অবরোধ শেষে যারা হলে আসবে তাদের কে ধোলাই দেয়ার একটা মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে এই সময়টা বেছে নেয় শিবির। আমরা দুইজন ভেতরে প্রবেশ করে যেই মাত্র রুমের দিকে হাটা দিলাম শিবির লাঠি নিয়ে তেড়ে আসল। ওদের চিৎকার ধর ধর আওয়াজ শোনে আমি লাফিয়ে দেয়ালের উপর দিয়ে বাইরে চলে এলাম খুবই ক্ষিপ্রতার সাথে। কিন্তু সমস্যা হল সেলিম ভাইকে নিয়ে। তিনিও চেষ্টা করলেন দেয়াল পাড়ি দিতে। এর মাঝেই শিবিরের ছেলেরা উনার পিঠে লাঠি পেটাতে আরম্ভ করল। বাইরে থেকে আমি সেলিম ভাই’র হাত ধরে টানছি। অনেক টানাটানির পর বাইরে নামাতে পারলাম। তারপর সেলিম ভাইকে কোনমতে শাহ আমানত হলের পূর্বপাশের একটি কটেজে নিয়ে যাই। সেখান থেকে পরে সেলিম ভাই শহরে পৌছান। কমরের দিকে, পায়ে উনি অনেক আঘাত পেয়েছিলেন। অনেক দিন শরীরে ব্যথা ছিল। অনেক কষ্ট করে পরিক্ষা দিয়েছেন। হলের বাইরে এসে কোনমতে জান বাঁচালাম। ভয় অনেক দিন তাড়া করেছে। ক্লাশ করতে ক্যাম্পাসে গেলে এদিক সেদিক নজর রেখে চলতে হত। আস্তে আস্তে এই রক্তে মাংশে মিশে গেছে। ভয় পেলেইত আরো বিপদ। সাহস করে চলতে হবে। যখন যা হবে দেখা যাবে; এই নীতি অবলম্ভন করে চলা আরম্ভ করলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে সেলিম একটা কলেজে শিক্ষকতা আরম্ভ করেছেন। হঠাৎ একদিন ষোল শহর দুইনম্বর গেইটে দেখা। নিয়ে গেলেন উনার বাসায়। কাছেই ছিল উনার বাসা। গেলাম সেখানে। চা পানি খেয়ে গল্প করছি। অনেক কথার মাঝে উনি সেই ভোরের কথা মনে করলেন। বললেন, আজও মনে হলে শরীরে ব্যথা পাই।
আমাদের দেশে শিবিরের রাজনীতি আরম্ভ হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জামাত আর ইসলামী ছাত্র সংঘের বিতর্কিত ভূমিকা পালনের কারনে। জামাত সহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তারপর ধর্মীয় দলগুলো নিজ নামে দেশে রাজনীতি করতে পারছিল না। কিন্তু তাদের তৎপরতা বন্ধ ছিল না। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে রাজনীতির যে নয়া সমীকরণ তৈরি হচ্ছিল সেই প্রেক্ষাপটে ইসলামী ভাবধারার কর্মীরা, যারা ইসলামী ছাত্র সংঘের সাথে জড়িত ছিল তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির ( সংক্ষেপে শিবির নামেই পরিচিত ছিল) সংগঠিত হয়। দলটি গঠিত হয়েছিল মাত্র ৬ জন কর্মী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় মসজিদে বসে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম আলী ( যুদ্ধাপরাধের দায়ে যায় সর্বোচ্চ শাস্তি হয়)। এখানে উল্লেখ যে পর পর দুজন সামরিক শাসনের আমলে শিবিরের জন্ম থেকে বিকাশ হয়েছিল। বর্তমানে তার কার্যক্রম কিছুটা শিথিল থাকলেও নিঃশেষ হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আধিপত্য তৈরি করেছিল একটি বর্বর ঘটনার মধ্য দিয়ে। সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন হিসাবে জাতীয় ছাত্র সমাজে গঠন করতে চেয়েছিলেন। তার কাঠামো, গঠন এবং কার্যক্রম তৈরি হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছিল তার কার্যক্রম। ১৯৮৬ সালে শিবিরের সাথে জাতীয় ছাত্র সমাজের সরাসরি সংঘাত হয়। সেখানে শিবিরের ছেলেরা জাতীয় ছাত্র সমাজের নেতা হামিদের হাত কেটে, কাটা হাত নিয়ে মিছিল করেছি। সেই তাদের দখলের রাজত্ব তৈরি হয়। তারপর ক্রমাগতভাবে অন্য সংগঠন গুলোকেও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। তৈরি হয় ক্যাম্পাসে এক রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব। শিবির ছাড়া আর কারো কোন কার্যক্রম ছিল না।
১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচন দিয়ে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, শিবির তা বানছাল করার সব চেষ্টা করছিল। উসকানি দেয়া, মারপিট করা। সুযোগ পেলেই ভয় দেখানো, ইত্যাদি। সেলিমভাই’য়ের উপর হামলার ব্যাপারটি নিয়ে তেমন কোন হৈচি ছিল না। সেলিম ভাই নিজেই নিষেদ করেন যে এই নিয়ে মিটিং মিছিল না করতে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে আর কোন কথা হয় নাই। চাকসু নির্বাচনের আগে আর হলে যাইনি। নির্বাচন হল। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য জিতে যায়। আমরা অত্যন্ত আনন্দে হলে গেলাম। বেশি দিন আমাদের আনন্দ ধরে রাখতে পারিনি। কেননা ধীরে ধীরে শিবির আবার তাদের হল কেন্দ্রিক আধিপত্য তৈরি করতে লাগল। ভয়ভীতি দেখিয়ে হল থেকে প্রগতিশীল নানা সংগঠনের ছেলেদের বের করে দিতে লাগল। আমরাও নিরপত্তার কারণে হলের বাইরে থাকতে লাগলাম। পরিবেশ একটু উন্নতি হলে আসি আবার কিছু একটা গন্ডগোল হলে আবার হল ত্যাগ। এই হচ্ছে ক্যাম্পাস রাজনীতির ধর্ম। এই সময় হলের ছেলেদের কাছ শিবির তাদের চাঁদা আদায় করত। চাঁদা আদায়ের কৌশলটা ছিল তাদের রশিদ বই গুলো ছিল দশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা, একশ টাকার আর পাঁচশ টাকার নোটের মতন। যার কাছে থেকে যতটাকা নিবে, তাকে তত টাকার একটা রশিদ ধরিয়ে দিত। না করলে দ্বিতীয়বার চাইবে না, কিন্তু আপনাকে দেখে নেবার হুমকি দিত। নিরীহ ছেলেরা এই চাঁদার খপ্পরে পড়ত বেশি।
কোন কিছু নিয়ে প্রক্টর অফিসে গেলে দেখা যেত সেখানে আগে থেকে একদল শিবির কর্মী বসা আছে। অভিযোগ না করে ফেরৎ আসতে হত। আর অভিযোগ করলেও প্রমাণ করা যেত না। ফলে বিচারও হত। মার খেয়ে,চাঁদা দিয়ে হলে থেকেছে অনেক নিরীহ ছেলে। কোন প্রতিকার ছিল না। একবার অধ্যাপক হাসান স্যার ( রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ) যিনি জামাতের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। শোনেছি উনি নিজেও জামাত সমর্থিত রাজনীতির সাথে জড়িত, তিনি বলে ছিলেন একটা সেমিনারে শিবির তার রাজনৈতিক কৌশলে ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র ইউনিয়নের কৌশল কে কাজে লাগাচ্ছে আর তার সাথে যোগ করেছে, লাঠি, অস্ত্র, ছোরা ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধুক। আমরা ক্যাম্পাস জীবনে যা দেখেছি কিংবা শোনেছি তা অনেকটা এই রকমই ছিল।
আদর্শের সাথে অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল ছিল শিবিরের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে যে গৌরব ছিল স্বাধীনতার আগে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের তাদের যে বীরত্ব গাঁথা ছিল, অহংকার ছিল। সামরিক শাসকদের হাতে তা ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র নেতারা আবার মাথা উচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছিল; সেই শিক্ষা আর এখন বিন্দুমাত্র বেঁচে নেই। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তার মৃত্যু হয়েছে। আজ ছাত্র রাজনীতি মৃত; যা আছে তা ব্যবসার করার একটা অবলম্ভন মাত্র।জাতীয় রাজনীতির অবক্ষয়ের মাঝে এই ছাত্র রাজনীতি আরো ক্ষয়িষ্ণু, কদাকার, কুৎসিত চরিত্র নিয়ে বিরাজ করছে।
আমাদের বিশ্বাস ছিল দেশে গণতন্ত্র আসলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। মানুষের মূল্যবোধের বিকাশ হবে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। কিন্তু হচ্ছে তার সম্পর্ণ বিপরীট ঘটনা। পারস্পারিক অশ্রদ্ধা, গালমন্দ বাড়ছে। অগণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভয়ভীতি, বেআইনি কার্যকলাপ যেন সবজায়গায় শিকড় গাড়ছে। ছাত্র রাজনীতিতে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে। কোন উন্নতি নেই। বরং উল্টোপথে হাঁটছে আমাদের দেশ।
২| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:১৮
চাঁদগাজী বলেছেন:
ছাত্র রাজনীতির অবসান ঘটানোর জন্য আরেকটা যুদ্ধের দরকার।
৩| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:১৯
জুয়েল তাজিম বলেছেন: তখনকার শিবির আর বর্তমান শিবির, আসলেই একটা কথা যে বাঘের বল নাকি ১২ বছর থাকে !!
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:১০
এ.আর. আকাশ বলেছেন: aroo likha asha korchi... vlo hoyece