নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমাকে খুঁজে ফিরি

হুয়ায়ুন কবির

হুয়ায়ুন কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্লান্ত পথিক

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:৩০




ক্লান্ত পথিক
(হুমায়ুন কবির)

সাধারণত যা হয় না, দূরে কোথাও একাই যেতে হচ্ছে। একেবারেই একা। যাত্রার প্রস্তুতিটা নেহায়েত সাদামাটা। এক চেইন কাটা পুরনো ব্যাগ, ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট। গোছানো ছিলাম না কখনোই। ঘরের আপনজন আমার অতি জরুরি, কম জরুরি এবং হয়তো প্রয়োজন হতে পারে এমন সবকিছুই ব্যাগের ভিতর ভরে দিয়েছেন। ব্যাগের সামনের দিকের ফাঁকা দিয়ে বিস্কুটের পিচ্চি ডিব্বাটা ভ্যাবলার মতো উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বিরক্তিকর একটা জিনিস। চেঁচিয়ে উঠার কথা মনে হলেও বৃথা চেষ্টা না করাই শ্রেয়তর বলে ক্ষান্ত দিলাম। ভালোবাসার উপহার অবহেলা করার ক্ষমতা এই অধমের কোনকালেই ছিলো না এবং সেটা সম্পর্কে আমি সবসময়ই সচেতন। আমি শ্রেয়তর কাজটিই করলাম। একেবারে চুপ মেরে অসহায় ভঙ্গীতে ব্যাগের ভিতর কি কি আছে সেটার দীক্ষা নিতে থাকলাম। যাই হোক, বিদায়-টিদায় নিয়ে রাস্তায় নামলাম।

ভালো থেকো শুভ- বেশ দূর থেকেও ভালোবাসার আশীর্বাদ শুনতে খুব ভালো লাগলো।

বাসের নাম রকেট+। এলাকাতেই রকেট এর লঞ্চিং প্যাড! এখান থেকে রকেটে চড়ে স্বল্পপাল্লার যাত্রা বিরতি। বিরতির স্থানে টিকেট কাউন্টার। রাত ৯.৪৫ এ রকেট এর প্রথম যাত্রা শুরু হবার কথা। আমি সহ সাকুল্যে জনাদশেক যাত্রী। বাসের বাকি যাত্রীরা টিকেট কাউন্টার থেকে উঠবেন। ড্রাইভার সাহেবের জন্য অপেক্ষায় আছি। কিছুক্ষণ আগেই ঝুম বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টির স্থায়িত্বকাল স্রেফ পাঁচ মিনিট। সর্বনাশ ঘটার জন্য লম্বা সময়ের দরকার নেই। বৃষ্টি মহোদয় পাঁচ মিনিট উড়াদুড়া ঝাঁপটাঝাঁপটি করে সর্বসাধারণ এবং সবধরনের যানবাহন একেবারেই স্থবির করে দিয়ে গেলেন। ইঞ্জিনের আওয়াজতো দূরের কথা, গাড়ির হর্নের প্যাঁ পোঁ, রিক্সার টুং টাং আওয়াজটাও বন্ধ। পুরো এলাকাটা যেন গভীর রাতের সুনসান নীরব কবরস্থান। জানালার পাশে সিটে অস্থায়ীভাবে অসে আছি। জানালাটা সামান্য খুলে নির্মল বাতাসে বাসের দমবদ্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর চারিদিকে লক্ষ্য রাখার ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসের বশে বাইরে তাকিয়ে আছি।

বেশি দূরে যাবেন অথবা কাছেই নামবেন তাদের মধ্যে অসীম ধৈর্যবান যারা, তারা গাড়িতে বসে ঘুমুচ্ছেন, নয়তোবা কিছুক্ষণ পর পর জানালা দিয়ে মাথা বের করে ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। যারা পায়ে হেঁটে সামনে এগুতে চাচ্ছেন, তারা ইঁদুর, বিড়ালের মতো ফাঁকফোকর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গাড়ির ঠাস বুননের কারনে ইঁদুর, বিড়াল হবার সাধনাতেও ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। মানুষের জটলাও তাই স্থির, নিষ্কম্প। কি আশ্চর্য! অকল্পনীয় ক্ষমতাধর, বুদ্ধিমান মানব জাতি তাদের নিজেদের তৈরি ছোট গণ্ডিতে অসহায়ভাবে আটকা পরে আছে! একবার মনে হলো হো হো করে বিদ্রুপের বিকট একটা হাসি দেই। কিন্তু চিন্তাটা বাদ দিতে হলো, কারন, আমিও মানুষ এবং এ অবস্থায় আমিও পরি মাঝে মধ্যে- অসহায়, স্থবির মানুষজনের একজন হয়ে।

অন্য রুটের এক গাড়ি বাসের আকালের সুযোগটা ভালোভাবেই গ্রহন করেছে। বাস বোঝাই করে আমাদের এলাকার দিকেই চলে এসেছে। চামে অতিরিক্ত কিছু কামাইয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকেই উল্টা পথে গাড়িটির আগমন। গন্তব্য থেকে বেশ দূরে গাড়িটি স্থবির হয়ে পড়ে আছে। গাড়ির সব যাত্রী নেমে গেছেন, এই আশায় যে, পায়দল বাড়ি ফিরবেন। কষ্টকর নির্দোষ আশাগুলিও বিমুঢ়। সবাই, সবকিছুই থমকে আছে। দেখার বিষয়, কত সময় ধরে পঙ্গু হয়ে বসে থাকবে সবকিছু।

উল্টা পথে আগত গাড়ির সব বাতি জ্বালানো। শুধুমাত্র হেডলাইট দু’টি বন্ধ। গাড়ির ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অবধারিত মৃত্যুদণ্ডের আদেশপ্রাপ্ত কেউ কেউ বজ্রআঁটুনি থেকে মুক্তি পাবার আপ্রাণ চেষ্টার সময় যেভাবে আওয়াজ করে তেমনি করে বাসের ভিতর থেকে কিশোর কণ্ঠের একটা তীব্র, তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসছে- ‘হুহ, হুহ, ছাড়েন, আমারে যাইতে দেন’।

ঘটনা কি? চক্ষুদ্বয় আরও প্রসারিত করে আওয়াজ লক্ষ্য করে দৃষ্টিতে তেজ দেবার চেষ্টা করলাম। বেশ মোটাতাজা এক লোক দুই হাতে কিশোর বয়সের দুবলা পাতলা ধরনের ছেলেটির বেল্ট ও গলার কলার চেপে ধরে আছেন। ছেলেটা প্রাণপণে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে আর তার গলা বিরতিহীনভাবে আওয়াজ দিচ্ছে- ছাড়েন, আমারে যাইতে দেন, হুহ, হুহ। সর্বজনের নির্লিপ্ততায় একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছি। রকেটের আরামদায়ক সিট ছেড়ে অভাজনদের পশ্চাৎদেশ সহজে উঠতে চায়না। আমি কোন বিশেষ ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ নই। তাই আমজনতার সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজ আসনে চেপে বসে আছি। চেপে বসলেই কি আর মন মানে? মনে মনে বলতে থাকি- বেটা, হুহ, ফুহ না করে ‘ইয়া আলী’ বলে ঠাটায়া একটা চিক্কুর দে। ছুটে পালানোর সম্ভাবনা শতকরা ৯৯.৫ ভাগ- টেলিপ্যাথিক সংযোগ সাধনার একটা চেষ্টা বলা যায়। সংযোগটা হতে হতেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারন, যে বন্দির নিকট বার্তা পৌঁছাতে চেষ্টা করছি তার সকল ধ্যান-জ্ঞান, একাগ্রতা এখন বন্ধনমুক্তির জন্য সম্পূর্ণ নিবেদিত। নতুন করে আরও কিছু বাক্য কানে ঢুকছে- ভাই, আমার পকেটে আর টাকা নাই। বিশ্বাস করেন কোন টাকা নাই।

- ঐ শালার ঘরের শালা, চোরার বাচ্চা চোর, টাকা না থাকলে পকেট চেক করতে সমস্যা কি?

আমি ভাবছি, রাগের চোটে মোটাতাজাজন সম্পর্কের সমীকরণটা ভুলে গেছেন। চোরের ঘরে চোর জন্মাতেই পারে, তবে শালার ঘরে কখনো শালা জন্ম নেয় না- ভাগ্নে বলে ডাকাটাই স্বাভাবিক। সম্পর্কের ডাকটা অন্য কিছু।

- ছাড়েন, ছাড়েনতো, হুহ, হুহ।

- তরে আইজকা ছাড়তাছিনা। আইজ তর একদিন কি আমার একদিন। ঠিকঠাক মতো হিসাব না দিলে তর খবর আছে আইজকা।

বিষয়টা যতটুকু ভেবেছিলাম ততোটা সরল মনে হচ্ছে না। দুনিয়াটা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে সরলীকরণের সহজ হিসাব বাদ দিতে হবে। দুনিয়াটা বড্ড জটিল। ঘটনাগুলিও জটিল। কোন কিছুই আর সহজ সরল নয়। দুনিয়ার সাথে তাল মিলাতে বা ঘটনা অনুধাবন করতে নিজেকেও জটিল করে তুলতে হবে! সারল্যের দিন ফুরায়ে গেছে। নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকি- জটিল হবার জন্য তৈরি হও বাহে। নইলে ইহজাগতিক বিষয়ে তুমি অজ্ঞ, অক্ষম, অচল- এমনে করলে কেমনে হবে হে? নিজের উদ্ভাবিত দীক্ষামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চোর-পুলিশ খেলা দেখছি। প্রথমে মনে হয়েছিল চোর-পুলিশ খেলা! নাহ, ভাবসাবে মনে হচ্ছে বিষয়টা অন্য কিছু, অন্য কোন খেলা- হয়তো চোর-গৃহস্থের বিদ্বেষপূর্ণ বিবাদ।

‘হুউউহ হুহ’ জোর চিৎকারে ভাবনার স্বপ্নময় জগৎ থেকে জটিল পৃথিবীতে ধরাম করে আছড়ে পরলাম। চোর-গৃহস্থের ঝাঁপটাঝাঁপটি খেলা বন্ধ- All quiet on the Northern front । উত্তরে অবস্থানরত গাড়ির সিটে গৃহস্থের লম্বা চওড়া দেহটা চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। চেহারা দেখা না গেলেও বিশাল ভুঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। আর দুবলা পাতলা ছেলেটা দরজা দিয়ে মেশিনগানের গুলির মত ছিটকে বেরিয়ে দিলো দৌড়। কি অসাধারণ দৌড় রে বাবা! দৌড় যাত্রায় গাড়ির তলা দিয়ে হামাগুড়ি, রিক্সার উপর দিয়ে হাইজাম্প, ভিড় সরাতে কনুইয়ের গুঁতা কিছুই বাদ যাচ্ছে না- দুরন্ত সব এথলেটিক কসরত। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের কর্তা মহোদয়গণকে ছেলেটার খোঁজ নেবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। একটু ঘষামাজা করে দিলে ছেলেটা ১০০ মিটার দৌড়ে উসাইন বোল্টকে অন্তত এক গিব্বা পিছনে রেখে Finish Line পার করতে পারবে ইন শা আল্লাহ্‌। কেউ গ্যারান্টি চাইলে লিখিত দিতে রাজি আছি।

পেছনে মোটাতাজা লোকটা নিজেকে কোনমতে দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চোরের পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলেন। শারীরিক স্থূলতা বা বয়সের ভারে দৌড়ের ব্যাপারে ছেলেটার মতো অতোটা দক্ষ নন তিনি। কিন্তু জোশে তিনি হুঁশ হারিয়ে দৌড়াচ্ছেন তো দৌড়াচ্ছেনই। আর নাকমুখ দিয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো শ্বাস ফেলছেন। আমি আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছি- কি হয়? কেমনে হয়? ছেলেটাকে যদি ধরেই ফেলে আর কিলিয়ে, গুঁতিয়ে তক্তা বানিয়ে দেয়! মিনিট কয়েক পর গৃহস্থ হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়ির দরজার সামনে এসে মোবাইল ফোনে কাকে যেন বলতে লাগলেন- ভাই, আমার হেল্পার ...... পোলায় আমারে কয় ৩৫০ টাকা ভাড়া উঠাইছে। ভাই, আপনে জানেন আমার পাচ্চল্লিশ সিটের বাস। খাড়ায়া আইছে ত্রিশজনের মতো। পার হেড দশ টাকা হইলেও তো ৭৫০ টেকা। ...... পোলায় আমারে ২৫০ টেকা দিয়া যাইতেছিলগা। আমি ধইরা ফালাইছিলাম .......। কিছুক্ষন চুপ থেকে অন্য প্রান্তের কথা শুনে আবারো বলতে শুরু করলো, আপনেগো লাইগ্যাইতো...... গো সাহস বাড়ে। আমারে খামছাইয়া, ধাক্কা দিয়া দৌড়াইয়া পালাইছে। টার্মিনালে আইলে এর বিচার করতে হইব। নাইলে আমি আর আপনের গাড়ি চালামু না এই বইলা দিলাম- বলেই লাইন কেটে দিল। একেবারে ১০ নম্বরী মহা-বিপদ সংকেত।

এর মধ্যে রকেটের দরজা দিয়ে স্বপরিবারে একজন যাত্রী উঠলেন। স্বামী-স্ত্রী দুইজনের হাতেই ছোট থেকে একটু বড় মানে মাঝারি সাইজের চার চারটি প্লাস্টিক কন্টেইনার- রংয়ের ডিব্বা। কন্টেইনারের গায়ে Asian Paint লেখাটা ঝকঝক করছে। ধারনা করা যায়, পরিধেয় জামাকাপড় বা অন্যান্য মালামাল কন্টেইনারের ভিতর অবস্থান নিয়েছে। দম্পতির সাথে তিনজন ছেলে-মেয়ে, ক্রমানুপাতে যাদের আনুমানিক বয়স হতে পারে ৮, ৬, ৪ বছর। বেশ কসরত করে কন্টেইনারগুলি সিটের চিপায় চাপায় ঢুকিয়ে নিজেরা দুইজনের সিটে পাঁচজন বসে পড়লেন। দারুণ সমন্বয়! একেবারে হাত তালি পাবার মতো। তাঁদের বসা দেখে বহুবছর আগে তিন ব্যাটারির রেডিওতে তিন নম্বর ব্যাটারি বসানোর কায়দাটা চোখের সামনে বসে উঠলো। আগেকার সময়ে রেডিওর পিছন দিক দিয়ে দুপাশে দুটি ব্যাটারি ঢুকিয়ে মাঝখানে তিন নম্বর ব্যাটারিটা ঢুকাতে যে ধৈর্য আর জটিল দক্ষতার পরিচয় দিতে হতো, গৃহকর্তা চোখের সামনে অবলীলায় সেই দক্ষতার প্রামাণিক স্বাক্ষর স্বর্ণাক্ষরে আমার মনের মধ্যে গেঁথে দিলেন। তিন ব্যাটারির যায়গায় পাঁচ ব্যাটারি- কম কথা না! নিজের অজান্তেই কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এলো, শাবাশ ওস্তাদ। জব্বর খেল দেখাইলেন। আরও কিছু বলার ছিল, ভদ্রতার খাতিরে কথাগুলি পাকস্থলীতে চালান করে দিলাম।

শ্মশ্রুমণ্ডিত মাঝারি উচ্চতা আর শক্ত গড়নের চালক মহোদয় রকেটের পাইলটের জন্য নির্ধারিত আসনে সমাসীন হলেন। ঠোঁট নাড়া দেখে মনে হলো দোয়াদরুদ পড়ছেন। আবার স্টিয়ারিংকেও ভক্তিভরে সালাম করছেন। আমি মনে মনে বললাম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম; যাত্রা হোক যন্ত্রণামুক্ত, নির্বিঘ্ন। যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হোক, আমীন।

ও হ্যাঁ, যাওয়ার কারণটা একটু বলে নেয়া দরকার। ভ্রমণটা নিছক আনন্দভ্রমন নয়; অতি দরকারি এবং অতি স্বাভাবিক জঠরের উত্থিত তাড়নায় পূর্ণ। অতি ধার্মিক (!) এক হুজুর আমার নিকট থেকে বড় অংকের টাকা ধার নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। আমি একা না, কামেল হুজুর(!) আরও বহুজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন এবং সুযোগ বুঝে মসজিদের ইমামতি ছেড়ে ভেগেছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আমি একটু বেশিই দরিদ্র। তাই টাকার অংকটা অনেকের কাছে ছোট মনে হলেও আমার নিকট সাকা হাফং- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এর ভরের সমান বিধায় হুজুরে কামেলের বাড়ি শেরপুরের উদ্দেশ্যে রকেট যাত্রা। ক্ষীণ হলেও মনে আশা- টাকাটা যদি পাওয়া যায়।

কোণা-কানছি দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আমাদের রকেট মাইল দেড়েক দূরে অবস্থিত টিকেট কাউন্টারে পৌঁছায়। জায়গাটা বেশ ঝলমলে। বিভিন্ন কোম্পানির শো-রুমের বাইরে লাগানো বাতির নীলাভ আলোতে জায়গাটা ঝলমল করছে। আলোর এমন খেলা সাধারণত খুব একটা দেখা যায়না। সবখানে কেমন চঞ্চল, চনমনে একটা ভাব। উচ্ছল তরুণেরা কিছুদূর পর পর দু’জন, চারজনের দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনায় মগ্ন। আলোচনার বিষয়বস্তু নিষ্কলুষ। দোষ ধরার মতো একটা শব্দও কেউ উচ্চারণ করছে না। নির্মল আনন্দ কণ্ঠের ঝংকারে পরিবেশটা প্রাণপ্রাচুর্যময়। যতই দেখছি, শুনছি, ততোই ভাল লাগছে। মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতার উচ্চমার্গে উঠা শুরু করে দিয়েছি। মনে মনে কামনা করতে থাকি, এমন বিশুদ্ধতার মাঝেই বেড়ে উঠুক ওরা। বেঁচে থাকুক ওদের হাসি আজীবন- আনন্দ আর পঙ্কিলতাহীন নির্মলতায়।

ড্রাইভার তাড়া দিলেন- টিকেট বুকিং দেন নাই, এমন কেউ আছেন? জলদি আওয়াজ দেন। আমি বিনীত ভঙ্গিতে হাত তুললাম, জোরে আওয়াজ দিলাম- ইয়েস স্যার, আমি বুকিং দেই নাই। একজন ভদ্রলোক, তিনিও কাছে কোথাও সিট থেকে বিকট আওয়াজ দিলেন। হাত তুললেন কিনা দেখতে পেলান না।

আমার সাথে আসেন। আগে আগে ড্রাইভার আর পিছনে আমরা দুইজন। ড্রাইভার গজর গজর করতে লাগলেন- আপনাগো মতো মানুষগো নিয়া যত সমস্যা। আগে টিকেট বুকিং দিবেন না? এমন আকালের সময় সিট পাওয়া যায়? যা করেন না আপনারা!

ওনার কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লাম। তিরস্কার করলাম- বেটা, তুই একটা ফালতু, ঠন ঠনাঠন, বে-আক্কেল। ড্রাইভার আমার দিকে কঠিন চোখে তাকাতেই বললাম- ড্রাইভার সাহেব, আপনাকে বলিনি, আমি এসব নিজেকেই বলেছি।

ঠিক আছে, আমার নামে দুইটা সিট বরাদ্দ আছে। ওগুলা আপনাগো দিমু। বলেই জোর তাগাদা দিলেন, দ্যান, টাকা দ্যান, তাড়াতাড়ি করেন। ভাবটা এমন যেন আরেকটু দেরি হলেই সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দু’জনে মোট সাতশ টাকা তার হাতে তুলে দিলাম। উনি আগে, আমরা দু’জন পিছে পিছে। আমাদেরকে পিছন পিছন আসতে দেখে ড্রাইভার সাহেব ক্ষেপে গেলেন- পিছনে আসতাছেন ক্যান? চুপ কইরা খাড়ায়া থাকেন। শালার মানুষ! আপনাগো কি মনে হয়? চল্লিশ লাখ টাকার বাস ফালাইয়া সাতশ টাকা নিয়া ভাইগ্যা যামুগা। সব টিকেট বুকড- বলেই আমার দিকে সাতশ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। হয়তো নাকে, মুখে ছুঁড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল। কেন, কে জানে, ঘটনাটা সেরকম পর্যায়ে গড়াল না। ওনার চ্যাত দেখানোর কারণটা স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে চুপিচুপি গোপন কোন স্বার্থ জড়িত আছে সেটা বুঝতে পারছি। মনে মনে খেদ ঝাড়ানোর উপায় আছে বলেই জীবনটা টিকে আছে। মনে মনেই বলি, শালা, চল্লিশ লাখ টাকার গাড়ি কি তর বাপের টাকায় কেনা? তুইতো বেতনভুক কর্মচারী, ঠুঁটো জগন্নাথ, আমার মতো নিধিরাম সর্দার, ঠন ঠনাঠন।

ড্রাইভারের ফাঁপরবাজিতে এক টেবিল, এক চেয়ার বিশিষ্ট উন্মুক্ত টিকেট কাউন্টারের পাশে দাঁড়ানো চার-পাঁচজন লোক ফিচফিচ করে হাসতে লাগলো। ভাবসাবে গাড়ির স্টাফ বলেই মনে হচ্ছে। ড্রাইভারের মাস্তানি মার্কা কথাবার্তা আর স্টাফদের মিচকা ধরনের ফিচকা হাসি যে কারো চান্দি গরম করার জন্য যথেষ্ট। টিকেট বিক্রির ধরনধারণ দেখে যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, এটা আলগা ফাঁপর; গরম চান্দির পুরো তাপটাই তখন ঢেলে দিলাম ড্রাইভার বেটার উপর। সবাইকে শুনিয়ে চেচিয়ে বললাম- ঐ, তোদের মধ্যে কোন হমন্দির পুতের হ্যাডম বেশি রে? কাউন্টারের স্টাফদের না ড্রাইভারের? এক্ষুনি বল, নাহলে ......। এমন গুণ্ডামি মার্কা ধমক বলশালী বা প্রতিষ্ঠিত মাস্তান টাইপের কাউকেই মানায়। আমার শরীর-স্বাস্থ্য দেখে অনেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে গিয়েও চোখের দিকে তাকিয়ে আক্রোশের জোশটা আন্দাজ করে নীরবে আমার বড় বড় কথাগুলি হজম করে নিল। কয়েক মিনিটের জন্য টিকেট বেচা বন্ধ। নায়িকাদের রূপে আগুন, আর আমার চোখে আগুন। এসব আগুন বেশিরভাগ লোকই সহ্য করতে পারে না। আমি ড্রাইভারের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কণ্ঠটা যথাসম্ভব কঠিন করে আবারো বলতে লাগলাম, বেটা টিকেট তুই ই কাটবি। তোর নিজের ডান হাত দিয়ে কাটবি। অন্য কেউ কাটলে খবর আছে। স্রেফ থোতনা বাড়াইয়া ঘুষামু। শালা শূয়রের বাচ্চা, ফাঁপরবাজির জায়গা পাওনা? তোর ফাপরবাজির কাঁথা পুড়ি আমি ..................?

হুমকির প্রতিক্রিয়ায় ধমকি; লোকটা একটু ভড়কে গেছে মনে হল। হুমকি খেয়ে ভিমরি খাবার বদলে ধমকি দেয়া লোকদের সমীহ করতে হয়। সকলের হাভভাবে সাইকোলজির এই বিষয়টা স্পষ্ট হলো। ড্রাইভার নতমুখে টিকেট কিনে দেয়। চোখে, মুখে চিমসা ভাবের পাশাপাশি বাড়াবাড়ি রকমের সমীহ। ভাবে মনে হছে জনৈক রাজার পাঠানো চরম অপমানজনক কোন পত্র সম্রাট হুমায়ূনের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। চিঠি পড়ে হয়তো সম্রাট কোতোয়ালকে ডেকে চিঠির বাহকের ধর থেকে মোটা মাথাটা বিচ্ছিন্ন করার তাৎক্ষনিক নির্দেশ দিয়ে দেবেন।

আমার সঙ্গী চুল, দাঁড়িতে কলপ দেয়া বেঁটেখাটো লোকটাও ভালোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে বলে মনে হলো। আড়চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। সুযোগ হারায় কোন গাধায়? আমিও খুব ভাব নিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানছি আর ভাবভঙ্গিতে নিজেকে কেউকেটা ধরনের একজন হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। চেষ্টা মনে হয় সম্পূর্ণ ফ্লপ খায়নি। সঙ্গী লোকটাকে সিগারেট সাধতেই তার সমস্ত অবয়বে তীব্র আতঙ্ক ফুটে উঠলো; যেন সিগারেট না, তার দিকে গুলি ভর্তি পিস্তল তাক করেছি- এখুনি ট্রিগার চেপে তার বাম বুক ছেঁদা করে দেব। লোকটা সভয়ে অনেকখানি পিছিয়ে একটা গলিতে ঢুঁকে গেল।

ড্রাইভার সাহেব দ্বিতীয়বারের মতো গাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পুরো বাসে দৃষ্টি বুলালাম। আশ্চর্য, এখনও দশ থেকে বারটা সিট খালি। আমার সফর সঙ্গীর জন্য নির্ধারিত পাশের সিটটাও খালি। লোকটা কোথায়? জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, হয়তো সিগারেট বা পান খাচ্ছেন। না, কোথাও দেখা যাচ্ছে না। লোকটার জন্য সামান্য মমতা বোধ করছি। রকেট কি ওনাকে রেখেই ছুটে যাবে? সামনে তাকাতেই দেখলাম ভদ্রলোক ড্রাইভারের সিটের ঠিক পিছনে কাঠের বাক্সের উপর গুটিসুটি মেরে চুপচাপ বসে আছেন। আরামের সিট রেখে এমন জায়গায় বসে আছেন, এটা মোটেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

মোটামুটি মানের চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, ভাইসাব, আপনার সিটে আসেন। সিটগুলি অনেক আরামের। এতদূর যাবেন, নিজের টাকায় ভাড়া করা সিটে আরাম করে বসে যান। খালি খালি কষ্ট করার দরকার কি?

আমার ডাক আর কথা শুনে ভাইসাব সাট করে এমন করে তাকালেন যেন কাছে পেলেই আমি তার গলা চেপে ধরে কণ্ঠনালি ভেঙ্গে ইহলীলা সাঙ্গ করে দেব। তিনি ভীত চোখে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়েই ঝট করে চোখ সরিয়ে নিলেন। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে রইলেন। ওনার বসায় আড়ষ্ট ভাবটা অত্যন্ত প্রকট। অতি সামান্য, নগণ্য একজন মানুষ আমি। আমাকে ভয় পাবার আছেটা কি? ঠিকমতো নিজের লুঙ্গির গিঁট দেবার যোগ্যতা যার নেই, সে আবার পরের টাই বাঁধতে সাহায্য করবে! চলুক, যে যার মতো। সামনের কাঠের বাক্সে বসে যদি আরাম পান, স্বস্তি পান, তাহলে তিনি তা পেতে থাকুন। আমার দাদার তাতে কি আসে যায়?

আমার ডাক চিৎকার কয়েক সারি সামনের একজনের দৃষ্টি প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করল। তিনি আমাদের স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক। আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক- নিখাদ, এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি আমার দিকে ফিরে সরল হাসিতে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন-

কোথায় যাবেন শুভ ভাই?

বাস যখন শেরপুর যাবে, তখন শেরপুরেই যেতে হবে। আমি শেরপুর যাব।

অমায়িক হেসে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কোন কাজে যাচ্ছেন?

কোন রাখঢাক না করে চেঁচিয়ে উঠলাম- কাজতো অবশ্যই, বাটপার ধরতে যাচ্ছি।

আমার কথার ধরনে তিনি আহত হলেন কিনা বুঝতে পারছি না। তবে আর কথা না বাড়িয়ে একেবারে চুপ করে গেলেন। কিছু যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চেহারাটা দেখে নিলেন। স্যারের মনে কোন বেদনার উদ্রেক করলাম কিনা ভেবে মনটা খচখচ করতে লাগলো।

অবশেষে সাড়ে দশটার রকেট সাড়ে এগারটায় চার চাক্কায় গড়াতে শুরু করল। ড্রাইভার সাহেব দক্ষতার সাথে বেশ কসরত করে গলাচিপা থেকে চাষাঢ়া মোড় পার হলেন। তারপর আমাদের বহনকারী রকেট দড়ি ছিঁড়া ষাঁড়ের মত সাইনবোর্ডের দিকে ছুটতে লাগলো। মাতাল হাওয়া হুড়মুড় করে জানালা দিয়ে ঢুকছে। শীত শীত লাগছে। সিটের উপর হাত-পা তুলে আরাম করে হাওয়া খাচ্ছি, আবার গুটিসুটি মেরে নিজেকে ওম ও দিচ্ছি। দুই সিটে যাত্রী আমি একজন। আরাম তো হবেই। কিছুদূর যেতে না যেতেই নাক-নাকশা সই করে কিছু একটা জোরে জোরে ঘুষি মারতে লাগল। ঘুষির চোটে মাথাটা ভনভন করে উঠে। বমি বমি ভাব নিয়ে বাইরে তাকিয়ে আধো অন্ধকারে পচাগলা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ দেখলাম। কি সৌভাগ্য! আমাদের শহর নাকি শীঘ্রই হাতিরঝিলের মত ঝলমলে হয়ে উঠবে। বাসের ভিতরে থাকা যাত্রীরা রুমাল, ফুলহাতা শার্টের অংশবিশেষ, হাফহাতা শার্ট বা গেঞ্জি পরিধানকারীরা কনুইয়ের উল্টা পিঠ, মহিলারা শাড়ির আঁচল এবং ওড়না দিয়ে যার যার নাসারন্দ্র বন্ধ করায় ব্যস্ত। নাক ঢাকা থাকায় ‘নাকি কণ্ঠের’ অভিসম্পাতগুলি বড্ড পীড়াদায়ক লাগছে। নারায়ণগঞ্জ- এটা যে আমার প্রাণের শহর। কেউ আমার প্রিয় শহরের বিষয় নিয়ে নাক সিটকাবে ভাবতেই BP বেড়ে যায়। যত কঠিনই হোক, নির্মম বাস্তবতার দুর্ভোগ থেকে উত্থিত নেতিবাচক মন্তব্য চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। BP বাড়তে বাড়তে চূড়ায় উঠে যাক, কিচ্ছু করার নেই। কারন, নমুনা বা ধরনে হতাশার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

রকেটে গান-বাজনা মনে হয় নিষিদ্ধ। কোন গান নেই। চুপচাপ বসে বসে নানা ধরনের চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছি। মহাখালি বাস স্ট্যান্ড পেরিয়ে যাবার পর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। বাধ্য হয়ে জানালা বন্ধ করে বসে আছি। দ্রুত গতির রকেটের ভিতর থেকেও ছাদের উপর ঝরতে থাকা বৃষ্টির অপূর্ব সুন্দর শব্দগুলি সারা দেহমনে মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পিছনের সিটে নব-দম্পতি। দাম্পত্য জীবন একেবারে আনকোরা মনে হলো না, তারপরেও পরস্পরকে বিভিন্নভাবে মুগ্ধ করার প্রাণপণ চেষ্টার মধুর খুনসুটির সময়টা এখনো শেষ হয়নি। বৃষ্টির সাথে ঐকতান করে তাদের হাসি, আনন্দের শব্ধগুলি শুনতে ভালই লাগছে।

বৃষ্টি শেষ। এবার যাত্রা বিরতি। আমরা রকেট কোম্পানির নির্দিষ্ট করা রেস্তোরাঁয় উঠলাম। অবাক হয়ে ভাবছি, চাষাঢ়া থেকে গাজীপুর জেলার সীমানা পার হতে এত কম সময় লাগলো! ড্রাইভার সাহেব ওস্তাদ আছে বটে। খাবার আগে টয়লেটে বিশাল লম্বা লাইন। একই সাথে চার চারটি গাড়ির যাত্রী তো আর কম নয়। রাখ তোর ঘোড়ার লাইন, আগে খেয়ে নেই। বেয়ারাকে দুইটি পারাটা আর সব্জি আনার কথা বলি। পারাটাগুলিও মাশাআল্লাহ। এক একটা পারাটা আমাদের নারায়ণগঞ্জের তিনটা পারাটার সমান হবে। খাবারের মাঝখানে হাইস্কুলের শিক্ষক আমার সামনের বেঞ্চে বসে বেয়ারাকে একটা রুটি আর সব্জি দিতে বললেন। খাবারের পাশাপাশি দু’জনে টুকটাক সৌজন্য কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। উনি বেশ সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। মনের খচখচানিটা তাতে কিছুটা কমলো। উনি মনে কোন কষ্ট পেয়ে থাকলে এতো সহজ ভঙ্গিতে কথা বলতেন না। সোয়া একটা পরাটা খাবার পর আর খেতে ইচ্ছে না করায় হাত ধুয়ে শিক্ষকের দৃষ্টি এড়িয়ে দু’জনের খাবার বিল মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পাশেই চা, পানের দোকান। আমি এক বোতল পানি আর এক কাপ চা চাইলাম। চা খেয়ে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে বিল দেবার জন্য পকেটে হাত দিতেই কাঁধে মোলায়েম একটা হাতের স্পর্শ টের পেয়ে পিছু ফিরে তাকালাম। স্যার চোখের ইশারায় বিল দিতে নিষেধ করলেন। আমিও চোখের ভাষায় প্রশ্ন করলাম- কেন দেব না? উত্তরে আবারো মিষ্টি, নিষ্পাপ হাসি। বুঝলাম, ঋণ শোধ করে দায়মুক্তি চাচ্ছেন। একবার ভাবলাম বলি, ভাইজান, এত ভাল, ভালোনা। আমি বিল দিয়েছি আন্তরিকতার কারণে। আন্তরিকতাকে ঋণের দায় বানিয়ে শোধ করা কাজের কাজ নয়। মনে মনে কিছুক্ষণ ভ্যানভ্যান করলাম। লাভ হলো না। বিলটা উনিই দেবেন- ঋণমুক্ত হবেন। হার মেনে দ্রুত তাঁর কাছ থেকে সরে পরলাম। যে যেমন, তাকে সেভাবেই থাকতে দেয়া ভাল- তবে ভালোবাসা, শ্রদ্ধার মত কাজে কোন দায় বা ঋণ থাকে না, আর সেটা শোধ করার জন্য এত বাড়াবাড়িও ভাল না।

খাওয়া-দাওয়া শেষ। প্রাকৃতিক ডাকটাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক কাজের ডাকে সারা দেবার প্রয়োজন হলে সেটা সবার জন্যই বিব্রতকর হবে। টয়লেটের দিকে রওনা দিলাম। হাতে খাবার পানির বোতল নিয়ে টয়লেটে যাওয়া যায় না। ভাবছি, কার কাছে রাখা যায়? আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে দোকান এবং দাঁড়িয়ে থাকা রকেট অনেকখানি দূরে। মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। ‘হতে পারতো’ পাশের সিটের সঙ্গীকে দেখলাম একা দাঁড়িয়ে আছেন। খুব আরাম করে পান চিবুচ্ছেন। তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছি দেখতে পেয়েই কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকবার জন্য গর্ত খুঁজছেন কিনা কে জানে। আমি বললাম, ভাইসাব, আমার পানির বোতলটা একটু ধরবেন। প্রকৃতি খুব জোরে জোরে ডাকছে। আপনি নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন? ভাইজান একবার বোতলের দিকে, আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। অকারণ জোর দিয়ে বললেন, আমিও এখন টয়লেটে যাব- স্পষ্টভাবে না বলে দেয়া। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতিউতি তাকিয়ে একজন ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখতে পেলাম। চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছেন- এই ঝালমুড়ি। হরেন্টের মাল, কারেন্টের ভাজা, যতো খাইবেন, ততো মজা। ফুরাইলে শেষ, চাইলেও পাইবেন না। ডাক-চিৎকার, চাপাবাজিতে আকৃষ্ট হবার মতো লোকের সংখ্যা একেবারেই কম। আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে মুড়ির বিশাল পলিথিনের ব্যাগের পাশে পানির বোতল গুঁজে রেখে টয়লেটের দিকে রওনা দিলাম। ঝালমুড়িওয়ালা একবার শুধু আমার মুখের দিকে তাকালেন। টয়লেটে থেকে ফিরে এসে পাশের সিটের ‘হতে পারতো’ সঙ্গীকে দেখলাম এখনো একমনে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। ওনাকে বললাম-

ভাই টয়লেটে যাননি? নাকি চিপাচাপায় ছোট-বড় দু’টাই সেরে নিয়েছেন। এমনই তো মনে হচ্ছে। দুর্গন্ধটা খোলা বাতাসেই অসহ্য লাগছে। বাসে উঠলে যাত্রীদের কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখেছেন। আপনিতো আবার ড্রাইভারের পিছনে বসেছেন। গন্ধে বমি করতে করতে ড্রাইভার সাহেব না আবার রকেটটাকে চলন্ত কোন ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। আপনার কারনে এমনতর দুর্ঘটনা ঘটবে সেটা কি ঠিক হবে? ভদ্রলোকের চিমসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো বলি, এসব টাটকা জিনিস আর তাজা গন্ধ কুকুরদের খুব পছন্দ। ওরা হয়তো আশেপাশেই আছে। সাবধান না হলে অসুবিধা আছে। যা করার তাড়াতাড়ি করেন। গাড়িও প্যাঁ পোঁ শুরু করে দিয়েছে।

লোকটার অভিব্যক্তিতে অপমানিত হবার চেয়ে ভীতির ছায়াটা প্রকট হয়ে দেখা দিল। আমি ঝালমুড়িওয়ালার কাছে গিয়ে বোতলটা উঠিয়ে হাতে নিলাম। ঝালমুড়িওয়ালা একবার শুধু চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। নিশ্চিত হয়ে নিলেন সঠিক মালিক বোতলটা নিচ্ছে কিনা। বাসে উঠতে গিয়ে রকেটের দরজার সামনে স্যারের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই প্রাণ কোম্পানির ভাজা ডালের ছোট একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, খান, ভাল লাগবে। খুব বেশি আন্তরিকতা নিয়ে কিছু দিলে সেটা গ্রহন করতে হয়। জিনিসের মূল্যমান বা আকার, ধরণ এসব ঐচ্ছিক বিষয়। জিনিসটার সাথে ভালবাসার স্বর্গীয় অনুভূতির মিশেলকে তুচ্ছ করার মত এত বিশাল (!) মাপের মানুষ আজও হতে পারিনি। এই ব্যর্থতাই আমার সম্পদ, আমার অর্জন। ভাষাহীন অন্তর্নিহিত ধন্যবাদটা উনি বুঝলেন কিনা জানি না, জানতেও চাই না। হেসে বললাম, স্যার, আমি নকলা নামব। তিনি বললেন, আমি এর পরের স্টপেজে নামব। স্যার বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। বাস নকলা স্টপেজে থামলে আপনাকে আমি ডেকে দেব। আলাপচারিতা আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রকেটের টানা হর্ন বাজানোর কারনে দু’জনকেই তাড়াহুড়া করে বাসে উঠতে হলো।

আমার পাশের সিট খালি দেখে বিশালদেহী যুবক বয়সী টিকেট চেকার ধাম করে বসে পরলেন। ওনার দিকে কঠিন দৃষ্টি দেবার চেষ্টা করলাম, কারন পাশের সিটটা দখল করার কারনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকার আনন্দটা মাটি হবার সমূহ সম্ভাবনা। আমি কিছু বলার আগেই ঘোরৎ, ঘেরৎ শব্দের সাথে বিশাল ভপু উপরের দিকে উঠছে আর নামছে। ঘোরৎ, ঘেরৎ শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁপানি রোগীর যাই যাই সময়ের মতো ঘড়ড়ড়ড়ড়ড়ড় শব্দে চমকে উঠি। শব্দের ঝাঁঝালো তাড়নায় মনে হচ্ছে আজরাইল (আঃ) আশেপাশেই ঘুরঘুর করছেন। যে কোন সময় হ্যাঁচকা টানে জানটা কবচ করে চুপটি করে সটকে পড়বেন। একবার ভাবলাম, অল্পবয়সী ছেলের এমন বিশাল পেট সচারাচর চোখে পড়ে না। হাতটা পেটের উপর বুলিয়ে বুলিয়ে যদি বলতে পারতাম- বাবা গোসাই, ও বাবা গোসাই? আমরা যা ভাবি, সবসময় কি আর তা করা যায়? তারপরেও আমার কল্পনার বেলুনে হাওয়া ভরলাম, আর মনে মনে ওর সুবিশাল ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে যাচ্ছি- বাবা গোসাই, ঘুমাও। আরাম করে ঘুমাও। কি সুন্দর করে নাক ডেকে ডেকে ঘুমায় লক্ষ্মী গোসাই মামুটা!

কল্পনাটা ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। এমন আনন্দময় মুহূর্তে বাজখাঁই কণ্ঠ শুনতে পেলাম- নকলা নামবেন কে? নামেন, নামেন, তাড়াতাড়ি নামেন। এমন তোরজোড় হাঁক চিৎকার উপেক্ষা করার মতো না। নিজের ছোট ব্যাগটা নিয়ে রকেটের দরজার দিকে হাঁটা ধরলাম। রকেটের সামনের দিকে স্যারকে দেখলাম। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মিষ্টি হেসে আমাকে বিদায় জানালেন। বললেন- ভাল থাকবেন। গাড়ি থেকে নামার সময় ঘুরে ইংরেজদের ভঙ্গিতে ড্রাইভার সাহেব কে হাত সটান করে বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচিয়ে দেখালাম- মানে, আপনার গাড়ি চালানোর দক্ষতায় আমি খুবই প্রীত হইয়াছি। বেটাকে দেখালাম কি, আর বুঝল কি? আমার উঁচিয়ে ধরা বুড়ো আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে চোখ, মুখ লাল হয়ে উঠলো তার। বিড়বিড় করে কি কি যেন বলে যাচ্ছে- নিশ্চিত, কুৎসিত গালাগালি। আমার ঠিক পিছনে আরেকজন নামার যাত্রী না থাকলে আচানক গাড়ি চালিয়ে নিশ্চিত পিছনের চাকার তলায় চ্যাপ্টা করে ইহলীলা খতম করে দিতেন। শালার দুনিয়া, আমি দেখালাম ইংরেজিটা আর উনি বুঝলেন বাংলাটা। মিয়া সাব, আপনাকে চালক না বলে ড্রাইভার বললে তো বুঝেন পুরাটাই। আমার Thumbs-up দেখে না বুইঝ্যা এতো চ্যাত দেখান কেন? ড্রাইভারের তাকানোর ভঙ্গিটা সময়ের সাথে সাথে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তর্কের চেয়ে জান বাঁচানো উত্তম। নিজের এবং পিছনে দাঁড়ানো আরেকজনের জান বাঁচানোর নিশ্চিত উছিলা হয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে পড়লাম।

নকলা স্টপেজে আমরা মাত্র দু’জন নেমেছি। যার বাড়িতে উঠবো তাঁকে ফোন দিলাম। রাত সোয়া তিনটা বাজে। কল দেয়ামাত্র রিসিভ করায় যারপরনাই বিস্মিত হলাম। আমার জন্য ভদ্রলোক জেগে আছেন! আবারো নিশ্চিত হলাম, খুব ভাল একজন মানুষের সহযোগিতা পেতে যাচ্ছি। উনি আমাকে ভাড়া করা মোটর সাইকেলে চড়ে নালিতাবাড়ি আসতে বললেন।

আমার সাথে যিনি নেমেছেন, তিনিও নালিতাবাড়ি যাবেন। বেটেখাটো গড়নের পলকা দেহের একজন তরুণ। দুহাতে প্রমাণ সাইজের চটের ব্যাগ। ব্যাগের ওজন বইতে ভীষণ কষ্ট হবার কথা। কিন্তু চোখ, মুখে কি এক অজানা উত্তেজনায় অনায়াস ভঙ্গিতে ওজনদার ব্যাগ দুটি নিয়ে রাস্তা পার হলেন। মোটর সাইকেল চালক নকলা থেকে নালিতাবাড়ি যেতে মাথাপিছু আশি টাকা করে ভাড়া দাবি করলেন। ভাড়া পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা হবার কথা। সহযাত্রীর ব্যাগের ওজন বাদ দিলে আমাদের দুজনের ওজন দেড়জনের সমান হবে হয়তো। মোটর সাইকেল চালকের চোখে চোখ রেখে মনে মনে হিসাবের সাদা খাতা, ক্যালকুলেটর আর বলপয়েন্ট বের করলাম। চোখে, মুখে যুদ্ধের নেশাভাব জাগিয়ে তুললাম- বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী। বাঁধ সাধলেন উত্তেজনায় চকচক করতে থাকা ‘হবে হয়তো’ সহযাত্রীর মুখ। তিনি বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ভাই কয়টা টেকা আর বেশি, চলেন তো। সারা শরীর তার আনন্দ, উত্তেজনায় কাঁপছে। আমি এতো পাষাণ প্রাণ না যে, এমন উচ্ছসিত কণ্ঠকে অবজ্ঞা করে হিসাব নিয়ে বসবো। ওনার দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ কণ্ঠে বললাম, চলেন ভাই। আমার ম্রিয়মান কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়া হতাশা দেখার সময় নেই তার। দ্রুত ড্রাইভারের পিছনে উঠে বসলেন। দুহাতে দুইদিকে প্রসারিত অবস্থায় ভারী চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিনি শঙ্কিত, যদি ব্যাগ মোটর সাইকেলের চাকায় বেঁধে যায়। আমি উঠলাম তার পিছনে। মোটর সাইকেল চলতে থাকে। সামনে ব্যাগ হাতের সহযাত্রীকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। হাফহাতা হলুদ গেঞ্জির বাইরে হাতের সবগুলি পেশি, রগ ফুলে উঠেছে দেখতে পাচ্ছি। রগেরও তো জান আছে। এত্তো ভারী ব্যাগ! কিন্তু লোকটার উত্তেজনা এতোই চরমে যে, হাত থেকে কব্জি ছুটে গেলেও তিনি বুঝতে পারবেন না, কখন কি হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

ভাই, আপনার গ্রামের বাড়ি কি এদিকেই?

অকারন লজ্জায় কালো চেহারায় লালচে ভাবটা এমন প্রকট হয়ে উঠলো যে, অনন্ত আসমানের উপর মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয়া গুঁটি কয়েক তারার আলোতেও সেটা পড়া যাচ্ছে।

না, আমার বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। এখানে আমার স্ত্রীর বাপের বাড়ি। দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের দুইদিন পর ঢাকায় ফিরে যেতে হয়েছে। পরের চাকরি করি ভাই। ছুটি নিছিলাম এক সপ্তাহের আর দুইদিন পরই ম্যানেজার সাবের ফোন, বড় সাব আমারে খোঁজতাছেন। আমি স্যারের খাস লোকতো, আমারে ছাড়া স্যারে আর কারো হাতে পানি পর্যন্ত খান না। এখন ওরে দেখতে যাচ্ছি। ওরে- মানে, ও টা কে?

সলজ্জ হাসি দিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা কণ্ঠে বললেন, আমার ইস্ত্রীকে দেখতে যাচ্ছি।

ও আচ্ছা, আপনার স্ত্রী কি দেখতে খুব সুন্দর?

পর স্ত্রীর সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা খুব স্বাচ্ছন্দময় না। কিন্তু লোকটার আনন্দিত কণ্ঠ শুনতে এতো ভালো লাগছে যে কথা চালিয়ে যাবার জন্য নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা করে ফেললাম।

লোকটা উত্তর দিলোনা। লজ্জায় আরো বেশি বেশি রাঙা হতে লাগলেন।

ভালবাসাবাসির এমন প্রকট উত্তেজক বহিঃপ্রকাশ বর্তমান সময়ে বড়ই বিরল, অন্তত আমার দেখা বর্তমানের ছোট গণ্ডিতে। আমি বললাম, ভাই আমার হাতে একটা ব্যাগ দেন।

তিনি বললেন, না ভাই ঠিক আছে, ‘এটা কোন ব্যাপার না’।

আমি বললাম, অবশ্যই ‘ব্যাপার হাঁ’। দুটা ভারী ব্যাগ এভাবে ঝুলিয়ে রাখতে আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। দেন তো ভাই, একটা ব্যাগ আমার হাতে দেন। কোন এক সময় হয়তো দেখা যাবে আপনার কব্জি ছুটে যাবে।

তিনি ব্যাগ দিলেন না, আর কোন জবাবও দিলেন না- আমার প্রতি তার কোন কৌতূহল, অসন্তোষ বা এমনতর কোন অনুভূতির খেলা ভাবভঙ্গির কোন অংশেই প্রকাশিত হলোনা। তিনি আপনাতেই ব্যস্ত আছেন। উচ্ছ্বাসের প্রচণ্ড জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছেন। শারীরিক কষ্ট সেখানে ধুলসম। ওনার প্রসারিত যে কোন হাতে আমার পিঠের উপর অবহেলায় ঝুলতে থাকা ব্যাগটাও যদি ধরিয়ে দেই, তাতেও কোন রকমফের হবে না। ওনার ভাবসাবে মনে হচ্ছে ভালবাসাবাসির এই কষ্টের আনন্দে কাউকে ভাগ দেয়া ঠিক না বলেই বিশ্বাস করেন তিনি। চুপচাপ সামনের কয়েক ঘণ্টায় অসাধারণ যে ঘটনাগুলি ঘটবে সেটা কল্পনা করতে করতেই ঘোরের মধ্যে ঢুঁকে পড়েছেন। মনের অজান্তেই বেশি কিছু না জেনেও মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে ভদ্রলোক আর তাঁর সহধর্মিণীর জন্য দোয়া করে ফেললাম। আল্লাহ্‌ যেন তাদের (!) এই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসকে চিরস্থায়ী করেন।

নিশুতি রাতের গভীর স্তব্ধতাকে ছিন্ন করে আমাদের মোটর সাইকেল নতুন নির্মিত মসৃণ পথে মৃদু শব্দে ছুটে চলছে। বাইক চালকের একাগ্রতা, সহযাত্রীর বাঁধভাঙা মৌন উচ্ছাস আর আমার মন ভালো থাকার আহরিত উপাদান নিয়ে খেলে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াটাকে বাঙময় করে তুলেছে। রাস্তার ঠিক পাশেই এতো রাতে ধান সিদ্ধ হচ্ছে। শেষ রাতে কিষাণিদের ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা আর নতুন ধানের সোঁদা, ম ম গন্ধে পরিবেশটা নৈসর্গিক হয়ে আছে। কোন কোন কৃষাণি খড় কূটো রাস্তায় বিছাতে লেগে আছেন। কি অসুরিক শক্তিরে বাবা! তাঁদের নড়াচড়ার প্রতিটি ক্ষণ, পল, অণুপল অনাবিল আনন্দে ভরে উঠেছে- সবকিছুই কি এক অপার্থিব, রহস্যময়তায় ঘেরা। এইতো ‘আমার সোনার বাংলা’র চিরন্তন ঘ্রাণ আর মাটির মনোভূম। বড় করে শ্বাস নিলাম। সেই ছোটবেলার মত পিছন থেকে চুলার আগুন ঠিক করায় ব্যস্ত মায়ের গলা জড়িয়ে বানরের বাচ্চার মতো ঝুলে ঝুলে যেভাবে সেদ্ধ ধানের অপূর্ব সোঁদা গন্ধটাকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দিতাম, আনন্দটা এমনি চরমে উঠে গেছে। আমি এখন আর মোটর সাইকেলে নেই, মায়ের ঘর্মাক্ত ঘাড়ের গন্ধে উন্মাতাল এক অবোধ শিশু যেন। চোখটা কেমন জ্বালা করে উঠছে।

অবশেষে নালিতাবাড়ি পৌঁছলাম। উপচে পড়া আনন্দ ছড়াতে ছড়াতে সফরসঙ্গী বিদায় নিলেন। মুজাহিদ সাহেবকে (আমার সাহায্যকারী হুজুর) ফোন করলাম। তিনি আমাকে কোন এক রিক্সাওয়ালার কাছে ফোনটা দিতে বললেন। আমি কাছাকাছি থাকা রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ভাই আপনাদের এলাকার একজন আপনার সাথে কথা বলতে চায়। বেশ সতেজ ভঙ্গিতে মোবাইল নিলেন। এত রাতে সতেজ ভাব সত্যই অবাক করার মত। আমিও অবাক হলাম, নির্বাক হবার মত অবাক। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আমাকে ফোনটা ফেরত দিয়ে বললেন, ওঠেন যাই। আমি উঠলাম এবং দুজনে মিলে গরুর খাঁটি দুধ বা খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে চা খেয়ে রওনা দিলাম।

ভাইজানের দেশ কোথায়?

বুঝলাম, তিনি আমার জেলার নাম জানতে চাচ্ছেন। কথার কথা দিয়ে দীর্ঘ আলাপের প্রস্তুতি। বললাম, আমার দেশ বাংলাদেশ- আমার সোনার বাংলা।

রিকশাওয়ালা অতি সহজেই রসিকতাটা ধরে ফেললো। একগাল হেসে বলল, কোথা থেকে আসছেন।

আমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সেখান থেকে আসছি।

আচানক কথার মোড় ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন-

এই যে মোটর সাইকেল দিয়ে আসলেন, এতে কোন চিন্তা নাই। আপনি যদি দশ লাখ টাকা নিয়াও আসেন, কেঊ জিজ্ঞাসা করবে না কিসের টাকা। যে রাস্তা দিয়ে আসছেন, খেয়াল করছেন, এক্কেবারে সোজা রাস্তা। কোন মোচড়া মুচড়ি নাই।

হু, খেয়াল করেছি, কোন মোচড়া মুচড়ি নাই, সোজা রাস্তা, একেবারে সটান।

অকারণ কথায় শেষ রাতের দৃশ্য দেখায় বিঘ্ন ঘটছে। আমি কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধ করছি। তবুও তার কথায় মোটামুটি প্রীত ভঙ্গি ফুটিয়ে তূলে বললাম, রাস্তা সোজা হইলো কেমনে? একটা বিদঘুটে উত্তরের প্রতীক্ষায় আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ভাই, যে রাস্তা দিয়ে আপনারা মোটর সাইকেলে আসছেন ঐটা একেবারে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গেছে। রাস্তা বানাতে কারো বাড়ির মাঝখান দিয়ে গেলেও কেঊ কোন পরোয়া করে নাই। এজন্যইতো কোন ত্যাড়াব্যাকা নাই। একেবারে সোজা। ঠিক ইয়ের মতো।

ইয়ের মতোটা কি?

ইয়ের মতো মানে ইয়ের মতো, মানে ......।

আচ্ছা, কোন বাড়ির চৌকির অর্ধেক যদি রাস্তার উপর পড়ে সেটাও কি দুই টুকরা করে দেয়া হয়েছে, না ঠেলা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিয়েছে?

রিকশাওয়ালা হেসে উঠে। আমিও হাসি। দুজনের ডুয়েট হাসির ঐকতানে রাতের নিস্তব্ধতায় কিছুটা ছেদ পড়লো। রিকশাওয়ালা বলতে লাগলো, এই রাস্তাটা মন্ত্রী আপা করে দিয়েছেন। ইণ্ডিয়া থেকে পাথর আনতে অনেক সুবিধা হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন কিভাবে? আমিতো জানি এখানকার লোকেরা, ‘কা-কা, জলদি কায়ালা! কাইত্যেনা ত্যে আইছিলি ক্যারে?- এভাবে কথা বলে? আপনার গ্রামের বাড়ি কি এখানেই?

হ্যাঁ, আমার বাড়ি এখানেই। তবে এগারো বছর ঢাকা শহরের মিরপুরে রিক্সা চালাইছি। ছয়মাস আগে ফিরে এসেছি। ঢাকা থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে এলাকার মানুষের সাথে নিজের ভাষায় কথা বলি। ঢাকা থেকে কেঊ আসলে শুদ্ধভাবে কথা বলার চেষ্টা করি।

কেন ফিরে এসেছে, ঢাকায় এগারো বছর কাটালেই শুদ্ধ করে কথা বলা যায়- যুক্তির জোরটা কোথায় জিজ্ঞেস করতে না করতেই বেশ দূরে একটা আলো নির্দেশনামূলকভাবে দুলতে দেখা গেল। রিক্সাওয়ালা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো, হুজুর আমরা এসে গেছি।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ...... বলেই দুহাত প্রসারিত করে দিলেন। প্রচণ্ড আবেগে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছেন ভাই?

জবাবে ওয়া আলাইকুম আস সালাম বলে জড়ানো অবস্থাতেই জানালাম, ভাল আছি। এমন আন্তরিকতাপূর্ণ অভ্যর্থনায় কোন মানুষ ভাললাগার তাল পুকুরে না ভাসবে। আমি তালপুকুর না, একেবারে সমুদ্রের বিশালতায় ডুবে আছি। এ এক অভূতপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতি। সামান্য চেনাজানা মানুষের প্রতি এমন মমত্ববোধের প্রকাশটা যদি সব জায়গায়, সবার ক্ষেত্রে দেখানো হতো, তাহলে অবশ্যই পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত। সেখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। অনেকেই হয়তো আনন্দের একঘেয়েমি কল্পনা করে ‘নাকি কান্না’ কাঁদতে পারেন। কিন্তু অস্থায়ী জীবনের স্বল্প সময়টাতে আনন্দময়তার একঘেয়েমির যাঁতাকলে পিষ্ট হবার সুযোগ কেউ পাবে না। কারন অমরত্ব পাওয়ার সুযোগ কোন মানব-মানবীর পক্ষে সম্ভবপর নয়, কোন প্রাণীর পক্ষেই নয়- “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে”- মহান আল্লাহ্‌ ‘র এই অমোঘ বানী উনার প্রেরিত আসমানি কিতাবেই নিশ্চিতরূপে উল্লেখিত আছে।

বিশ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকায় পরিশোধ করেও দেখি শুদ্ধ ভাষা বলা রিক্সাওয়ালার মন পাওয়া দায়। বদ কিছু শব্দ ঠিক ঠোঁটের বাইরে বের হবার আগেই গিলে নিলাম। আমার সাথে অসাধারন ভাল একজন মানুষ আছেন যে। শুধু বললাম, শুদ্ধভাবে কথা বলার উছিলায় আড়াইগুণ এর বেশি ভাড়া চাওয়া ঠিক না। যা পেয়েছেন, বহুত বেশি পেয়েছেন। আধো অন্ধকারেও রিক্সাওয়ালার জটিল হাসি টের পেলাম।

রাত শেষের দিকে। সূর্য উঠতে অবশ্য এখনও অনেক দেরি। তারপরেও আকাশটা কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে আছে। আশেপাশের সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে আছে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে এমন অসাধারন পরিবর্তন মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আমার মনটা মনে হয় একটু বেশিই নাড়া খেয়েছে। নিজেই বুঝতে পারছি আমার সারা শরীর অপার্থিব এক উল্লাসে ফেটে পড়তে চাইছে। ভোরের ভেজা নরম মাটি দেখে জুতা জোড়া খুলে খালি পায়ে হাঁটতে লাগলাম। মেঠো পথে কোন কাঁদা নেই, তারপরেও জুতা খোলার ব্যাপারটায় হুজুর একটু অবাকই হলেন। তাঁর টানা চোখ জোড়ার উৎসুক ভাবটা আমার Average Size চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। লক্ষ্য করলাম, তিনি মিটিমিটি হাসছেন। সকালের মোহময় শান্ত পরিবেশকে নাড়িয়ে দিয়ে একেবারে স্পষ্ট আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ট-ক করে কি একটা ডেকে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। আবারও সেই ট-ক। নিয়মিত বিরতিতে একই সুরে একবার করে শব্দটা চলতেই থাকলো। আমি হুজুরকে বললাম, এটা কি কোন পাখির ডাক? তাঁকে মনে হয় লজ্জায় ফেলে দিলাম। বললেন, এটা পাখির ডাক ঠিক আছে। কিন্তু নামটা বলতে পারছি না। আসলে খুব অল্প বয়স থেকেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় থেকে পড়াশুনা করেছি তো। গ্রামের বাড়িতে খুব বেশি থাকা হয় নি। তিনি সঠিক জবাব দিতে না পারায় বেশ বিব্রত হলেন। তাঁর বিব্রতভাব দেখে আমি পরলাম চরম লজ্জায়।

মেঠো পথে কয়েক মিনিট হাঁটতেই ওনার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। এর মধ্যেই দূর থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠ ভেসে এলো- আল্লাহু আকবর ..................। যে বাড়িতে পৌঁছলাম এর সবগুলি ঘরই টিনের তৈরি। চমৎকার গঠনশৈলী। দৃষ্টিনন্দন জিনিস আমার চোখকে তৃপ্ত করলো। তিনি লোহার সদর দরজাটি খুললেন। দরজা খোলার শারীরিক অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো জিনিসটা অনেক শক্ত আর ভারি। সোজা পশ্চিমে টানা প্যাসেজ। তিনি আমাকে ডানদিকের বারান্দামতো অনেকখানি খালি জায়গা হাঁটিয়ে মাঝারি আকারের এক ঘরে নিয়ে বসালেন। ওনার এক ভাই বিছানায় শুয়ে আছেন। হুজুর তাঁর ছোট ভাইকে ডাকলেন, তাড়াতাড়ি উঠো। আজান দিয়েছে। অজুখানায় যেতে যেতে জানতে পারলাম ওনারা তিন ভাই। তিনজনই মাওলানা। দুজন আবার কুরআনে হাফেজ। মাঝারি এবং ছোটজন এবার তারাবীর নামাজ পড়াবার জন্য ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের দুটি মসজিদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। ঘরের চারিদিকে বই আর বই- সব ধর্মশিক্ষার বই। একসাথে থরে থরে সাজানো এতো ধর্মীয় বই কোন বাসায় দেখেছি কিনা ভাবছি। হুজুর বললেন, ওজু করে আসেন। তিনজনই জামাত করে নামাজটা সেরে ফেলি। মসজিদ খুব কাছে নয়, আবার বেশি দূরেও নয়। হয়তো আমার ভ্রমণ পরবর্তী আচ্ছন্নতার কথা চিন্তা করেই প্রস্তাবটা দিলেন। বড় এবং ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে ইমামতি করার ব্যাপারে আন্তরিকতাপূর্ণ মৃদু বচসা হলো। অবশেষে হুজুর ইমামতির দায়িত্ব নিলেন।

নামাজ শেষে হুজুর হালকা নাস্তার প্রস্তাব করলে আমি না করি। উনি একটু ব্যথিত হলেও মেনে নিয়ে বললেন, আপনি ঘুমান। আবহাওয়াটা একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। আমি কাঁথা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। নরম কাঁথায় অনেকদিন পর চমৎকার একটা ঘুম দিলাম- স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নহীন আরামের ঘুম।

সকাল দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে। একাকী ঘরে সারা শরীরে কাঁথা জড়িয়ে আবিষ্ট হয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখছি। উপরে টিনের চালে বৃষ্টির স্বপ্নময় অদ্ভুত শব্দ। হুজুর কখন যে আমার পিছন দিকটায় এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি।

কি ভাই, বৃষ্টি দেখছেন?

হুম, বৃষ্টি দেখছি, আবার শুনছিও।

বৃষ্টি শুনছেন মানে! বৃষ্টি কি শুনা যায়?

আমি হেসে উপরের দিকে তাকালাম। তিনিও হাসলেন। বুদ্ধিমান মানুষটি সাথে সাথে বুঝে ফেলেছেন যে, আমি টিনের চালে অঝোরে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ শুনছি।

যান হাত, মুখ ধুয়ে আসুন। বৃষ্টি দেখুন, শুনুন আর নাস্তা খান। বলেই স্বভাবগত নিঃশব্দ হাসির বদলে একটু জোরেই হেসে ফেললেন। হাসিতে সারা মুখে কি এক পবিত্র ভাব ফুটে উঠেছে। দেখতে খুব ভাল লাগে।

বৃষ্টি শেষ হতে অনেক সময় নেয়। ঝপ করে বৃষ্টি বন্ধ হতেই জুম’আর নামাজের আজান শুনতে পেলাম। বেশ দূর থেকে টানা টানা সুরে অসম্ভব সুন্দর করে আজানের শব্দগুলি উচ্চারিত হচ্ছে। আমাদের অঞ্চলের মতো মসজিদ ভিত্তিক আজানের প্রতিযোগিতা নেই। গজ হিসাবে মাপা যায় এমন দূরত্বে এক একটা মসজিদ। বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের সময় এক এক মসজিদের তিন, চারটা মাইক আর মুয়াজ্জিনদের সম্মিলিত কণ্ঠের তীব্রতায় আজানের মাহাত্ম বা সৌন্দর্য অনেকখানি বিঘ্নিত হয় বলেই আমার ধারনা। মাইকের কারনে শব্দের দৌড় যেহেতু অনেক লম্বা, সেক্ষেত্রে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে আসবে আজানের মহোত্তম শব্দের কোমল, মোলায়েম, নরম আর বিনীত অথচ উদাত্ত আহবান। আর এর মাধ্যমে মুসলমানদের আবশ্যিক কর্ম সালাত আদায়ের কথা চমৎকারভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে কাজের কাজ।

যাক, বাড়ির তিনজন (হুজুর, হুজুরের ছোট ভাই আর আমি) একত্রে জুম’আর নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নিঃশব্দ এক বাড়ি। বাড়ির ভিতর বা বাইরে থেকে কোন মহিলার আওয়াজ তো দূরের কথা, চুড়ির টুংটাং আওয়াজও শুনা যায় না। ধর্মীয় অনুশাসন তাঁদের জন্য শেকলের বন্ধন নয়, পবিত্র কর্মের প্রতি নিবেদনের আকুলতা। ভালমানুষদের প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠলো। ওনাদের তুলনায় অনেক তুচ্ছ আর অপাংক্তেয় মনে হতে লাগলো নিজেকে।

নামাজ শেষে বাইরে এসে অপেক্ষা করছি। মসজিদের দুইপাশ দিয়ে দুটি আর.সি.সি. ঢালাই রাস্তা। নিরিবিলি স্বল্প ঘনত্বসম্পন্ন এলাকায় দুই দুইটা প্রশস্ত রাস্তা- স্থানীয় এম.পি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদর্শীতা দেখে ঈর্ষার বদলে নিজকে/নিজেদেরকে বড় বেশি অভাগা আর অভিভাবকহীন মনে হলো। একে একে সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছেন। হুজুরের ছোট ভাই স্থানীয় কয়েকজন মুরব্বীর সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলতে দেখছি। হুজুরকে দেখছি না, মনে হয় হুজুর এখনও মসজিদের ভিতরে। বিরক্তি ধরার আগেই হুজুর বাইরে এসে মসজিদের ভিতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন।

মসজিদের ভিতরে কমিটির সভাপতি এবং সেক্রেটারি জুম’আর নামাজ শেষে মুসল্লিদের দেয়া দানের টাকা গুনছেন। এলোমেলো ছড়ানো টাকার মধ্যে সর্বচ্চো একশ টাকার একটা পুরনো নোট উঁকিঝুঁকি মারছে। টাকা গোনা, ভাজ করার মধ্যে ওনাদের আন্তরিকতা এবং দক্ষতা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। আমিও মুগ্ধ হয়ে ময়লা, তোবড়ানো টাকা ভাঁজ করা দেখছি। অত্যন্ত ফর্সা, টিকালো নাক আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারার ছোটখাটো মানুষটির দিকে তাকিয়ে মুজাহিদ সাহেব বললেন- আব্বা, আসসালামু আলাইকুম ............, উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। ভদ্রলোকের মৃদুভাবে মাথা আর ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝা গেল সালামের উত্তর দিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ছেলে কিংবা আমার দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকালেন না। নিবিষ্ট মনে টাকা গুনে গুনে খাতায় হিসাব উঠাতে লাগলেন। ইমাম সাহেব, সভাপতি, সেক্রেটারি সাহেব এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত যুবক বয়সী ফর্সা, সুঠাম দেহদারী একজনের কথাবার্তায় বুঝা গেল মুজাহিদ সাহেবের বাবা হচ্ছেন মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি। ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত আচরণে মনের ভিতর ক্ষীণ একটু কষ্ট বেজে উঠলো। অন্য কোন পরিস্থিতি বা পরিবেশ হলে দুই মিনিট বসে থাকতাম কিনা সন্দেহ। কিন্তু ঠ্যাকা বড় দায়; আমি অধৈর্যের স্রোত ঠেকাতে নিজের স্বার্থেই মনের আবেগের বিরুদ্ধে ‘তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজল ডোবার বাঁধ’ এর মতো কঠিন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নিলাম। নোট গোনা-বাছা শেষে ছোট নোটের বড়সড় এক তোড়া ইমাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে সেক্রেটারি সাহেব ঠাট্টাচ্ছলে বলে উঠলেন-

কি হুজুর এতো বড় টাকার বোঝা একা নিয়ে যেতে পারবেন তো, নাকি সাথে একজন দিতে হবে?

ইমাম সাহেবই বা কম যাবেন কেন? তিনি বললেন, পকেটে নিতে না পারলেও কাঁধে করেতো নিতে পারবো।

খুব সাধারন এবং বিশুদ্ধ পরিহাসের কয়েকটা বাক্য পরিবেশকে একেবারে আন্তরিক ও নির্মল করে তুললো।

সেক্রেটারি সাহেব এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আন্তরিকভাবে হেসে বললেন- তা, আপনি কেমন আছেন?

জ্বী, আমি ভালো আছি।

মুজাহিদ সাহেব সেক্রেটারি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আব্বা উনিই সেই লোক, নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন।

ও আচ্ছা। তা, থাকা খাওয়ায় কোন অসুবিধা হয়নি তো?

জ্বী না, কোন অসুবিধা হয়নি।

এর মধ্যে মুজাহিদ সাহেব আমার ওখানে যাবার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন। উপস্থিত সকলেই বিষয়টি চুপচাপ একটানা শুনে গেলেন। ব্যাপারটা অঞ্চলের সুনামহানিকর ভেবেই কিনা কে জানে, উপস্থিত সকলের চেহারায় কেমন একধরনের বিদ্বেষপূর্ণ উত্তেজনা। উচ্ছল আলাপচারিতার মধ্যে আমার বিষয়টি সবাইকে আবেগের উল্টো দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই একটু মন খারাপের মতো বুকের ভিতর ছোট সাইজের পাথরের চাপ অনুভব করলাম।

আকস্মিক একটা উগ্র ধরনের আওয়াজে ভাবের জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। তাকিয়ে দেখি সুঠাম দেহের সুশ্রী চেহারার যুবকটি বলে যাচ্ছেন- আপনি তো ভাই বেশ ধনী মানুষ মনে হচ্ছে! টাকা আছে ভালো কথা, কিন্তু সেটা সঠিক পাত্রে দান না করে অপাত্রে দিলেন কেন?

উনি আমার উপর রেগেছেন, মানে ওনাদের; মন খারাপ - রাগ উগড়ে দেয়া= শূন্য। খারাপ ভাবের পুরোটাই উবে গেল আমার। সবকিছুই খুব স্বাভাবিক লাগছে। তারপরেও নিজের অজান্তেই মনে মনে বলে ফেললাম- ভাই, যিনি টাকা নিয়েছেন, তিনি দেখতে আপনারই মতো, শুধু গায়ের রংটা আপনার মতো ফর্সা নয়। আর জনাব, সাদা-কালো গায়ের রং দেখে পাত্র বিবেচনা কি গ্রহণযোগ্য? জবাব চাই, জবাব দেন। মনে মনে কথা বলাটা জোর করেই বন্ধ করলাম- কখন না জানি আবার গলা বেয়ে মুখ দিয়ে প্রতিবাদের বাক্যগুলি বেরিয়ে আসে। সেটা অবশ্যই আমার উদ্দেশ্যের সফলতার বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে।

আমার হয়ে মুজাহিদ সাহেব সবকিছু বললেন। বর্ণনাটা মনোযোগ দিয়ে শুনাতে বুঝতে পারলাম, উনি হচ্ছেন এই মসজিদের পেশ ইমাম এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। বেশ, আমিও খোশ দিলে আরও কিছু না বলা কথা বয়ান করলাম। পেশ ইমাম সাহেবের চোখে, মুখে আন্তরিকতার উজ্জ্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তিনি বললেন-

টাকা নেয়া ইমাম (!) যে ইউনিয়নের সে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেবকে আত্মীয়তার সূত্রে চিনি। আমি বললে অবশ্যই কোন একটা ব্যবস্থা করে দেবেন ইন শা আল্লাহ্‌। তবে নারায়ণগঞ্জের একজন এস.ই. এখানকার থানায় চাকরি করতেন। উনি থাকলে খুব ভালো হতো। সরকারি কর্মকর্তার সামর্থ্যের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বলে উনি স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার লেবু চিপরে ছেবরা বানিয়ে ছেড়েছেন। ব্যাপারটা পুরোপুরি ব্যাখ্যা না করলেও পেশ ইমাম সাহেবের সাবলীল উপস্থাপনা ভঙ্গীর কারনে সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ জাগানিয়া অনুভূতি টের পেলাম। নারায়ণগঞ্জের ছেলের কীর্তি বলে কথা।

পেশ ইমাম সাহেব মুজাহিদ সাহেব এবং আমাকে প্রথমে টাকা ধার নেয়া হুজুরের (!) বাড়িতে যেতে বললেন- দেখেন ঐ বাড়ি থেকে কেমন ব্যবহার করে। আসার পথে জেনে আসবেন চেয়ারম্যান সাহেব এলাকায় আছেন কিনা।

মুজাহিদ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা করতে করতে বেলা পড়ে যাবে বলে না খেয়েই দু’জন ইমাম (!) সাহেবের বাসায় রওনা দিলাম।

রিক্সা করে মাইল দুয়েক দূরে হুজুরের (!) বাসায় দাখিল হলাম। ওনার বাপ, ভাই, উপস্থিত বোন জামাইয়ের আচরণে মনে হলো আমার ওখানে যাবার কথাটা সবাই আগেভাগেই জেনে বসে আছেন। তাই মানসিক প্রস্তুতিটাও জোরাল।

হুজুরের (!) আব্বাজান বললেন,

তা, আপনারা খাওয়া-দাওয়া করেছেন তো? মিথ্যে করে খাবার কথাটা বলতে যাব, এই সময় মুজাহিদ সাহেব বললেন, না আমরা এখনও খাইনি। আপনার সাথে দেখা করে বাসায় গিয়ে খাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ওনার কথা শুনে হুজুরের (!) আব্বাজান বিমর্ষ হলেন। অভিনয় কিনা জানি না। তবে অভিনয় হলে সেটা দশে দশ পাবার মতো হলো।

- কি লজ্জা, আপনারা আগে জানিয়ে আসবেন না! এতদূর থেকে মেহমান আসছে, দুটা ভাল-মন্দ খাওয়াবো; বলেই ভিতরের ঘরে কি কি যেন বলে এসে আমাদের সামনে বসলেন। তার বসার ভঙ্গিতে বুদ্ধির খেলা খেলবার একটা ভঙ্গি ফুটে উঠলো।

এক, দুই করে অনেকগুলি মিনিট পার হলো। সবাই চুপচাপ। টাকার প্রসঙ্গটা দু’পক্ষই চাচ্ছি- আমি না, আপনি তুলুন। মনের ভিতর টানটান উত্তেজনা। কেউ হারতে চায় না। না, ওনারা, না আমি। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। এরই মধ্যে বেশ লম্বা, একহারা গড়নের এক ছেলে ভাতের বল, প্লেট, তরকারি নিয়ে আসতে লাগলো। খাবার পর্বের মাঝেই মানসিক দৃঢ়তার খেলাটা জমে উঠছে। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আছি- কিছুতেই এ বাড়ির খাবার খাব না। আসছি টাকার তাগাদায়, আর শুরু করে দিয়েছেন মানসিক মল্লযুদ্ধ। আমার অনিচ্ছার আবরণে ঢাকা শরীর ও মনে ওনার বারবার খাবার অনুরোধগুলি পিছলে পিছলে যাচ্ছে। এবার ওনার পরাজয়। মোটামুটি জোর করে আমার হাত টেনে পানি ঢেলে ধুয়ে দিলেন। এবার আমার পরাজয়- পরাজয়টা পরাক্রমের অভাবের কারনে নয়, বাবা-মায়ের শেখানো বর্তমানে অচল আচরণবিধি; খবরদার, কখনো মুরব্বীদের সাথে বেয়াদবি করবি না। বাবার গমগমে কণ্ঠটা যেন সমস্ত অস্তিত্বটাকে আলোড়িত করে দিলো। এবার আমি হারলাম। হ্যাঁ, হারলাম। বহুবছর আগে শুনা সেই কণ্ঠের তীব্রতায় পরাজিত এক সৈনিকের মতো মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম। ভাত নয়- যেন কাঁচা আওলা চাল চিবুচ্ছি।

আরে, কি করেন। দু’মুঠো ভাত খেলে কি মানুষ বাঁচে?

জ্বি চাচা, আমার মতো গর্দভ যারা, এরা বাঁচে।

আপনে কি রাগ করছেন?

না, রাগ করিনি। রাগ করবো কেন? আমার টাকা ফেরত দেবার কি করবেন?

কথাটা বলেই মনে হলো, গেলাম হেরে। শুরুটা আমাকে দিয়ে শুরু মানে শেষটা ওনার। উনি এখন দীর্ঘ মহাভারত শুনাতে থাকবেন। আমি অমনোযোগী হয়ে এক সময় বলে ফেলবো, সীতা কার বাপ?

ঘটনাটা অনেকটা এমনি ঘটলো। আলোচনার একপর্যায়ে হুজুরের (!) বাপজান বললেন, ছেলেতো আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করে না। যোগাযোগ করলে আপনার কথা বলবো। তারপর একটা ব্যবস্থা করবো।

আপনার ছেলের সাথে কি কথা বলবেন?

এই, আপনি আসলেই টাকা পান কিনা, বা কত পান এটা নিশ্চিত হবার জন্য।

আপনি না বললেন, ছেলের সাথে আপনার কোন যোগাযোগ নেই!

ভদ্রলোক আমার কথার উত্তরে নীরবতাটা বেছে নিলেন।

আমি ওনার মোবাইল নাম্বার চাইলাম। উনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নাম্বার বললেন। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা বা ধৈর্যের খেলা খেলবার সময় নেই। এখানে কিছু পাওয়া যাবে না।
আমি মুজাহিদ সাহেবকে বললাম, হুজুর চলেন যাই।

বিমর্ষ মুখে মুজাহিদ সাহেব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হলো কষ্টটা আমার চেয়ে উনার মনে বেশি আঘাত করেছে।

রিক্সা নিয়ে নালিতাবাড়ি বাজারে আসলাম। রিক্সায় করে মোটামুটি লম্বা পথটা দুজনে নীরবেই কাটিয়ে দিলাম। স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবের মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসে মুজাহিদ সাহেব আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে পাশের মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করতে গেলেন। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলেন- ভাই, চেয়ারম্যান সাহেব কি এলাকাতে আছেন?

না উনি ঢাকায় গেছেন।

ফিরতে কি দেরি করবেন?

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে জবাব দিলেন, চার, পাঁচদিন তো লাগবেই।

ওনার ইতস্তত ভাবটা সন্দেহ জাগানিয়া। মিথ্যা বলার সময় মানুষ যেমন অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলে তিনিও সেভাবে কথা বললেন।

আমি বললাম- ভাইজান, চেয়ারম্যান সাহেবের কোন কার্ড আছে।

উনি কিছু বলার আগেই রিসিপশন ডেস্ক থেকে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, এই যে স্যারের কার্ড।

আমি কার্ড নিয়ে ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আড়চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তার চোখে ভদ্রমহিলার প্রতি স্পষ্ট বিরক্তি আর আক্রোশের ছাপ ফুটে আছে। ধরে নিলাম ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। ভদ্রলোক চান না আমরা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলি। মানে হুজুরের আব্বাজান আর তার মামা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তাদের খেল শুরু করে দিয়েছেন।

মুজাহিদ সাহেব বললেন, ভাই চলেন আমাদের ভোগাই নদী দেখতে দেখতে যাই। বিশৃঙ্খল মনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এরচে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে! আমিও সোৎসাহে বললাম, চলেন ভাই। নদীটা খুব বড় তাই না। তিনি মুখে কিছু বললেন না, তবে ঠোঁটে মিটিমিটি হাসিটা ঝুলিয়ে রাখলেন।

স্বাভাবিক চলাচলের রাস্তা ছেড়ে বামদিকের একটা রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে যাচ্ছি। শীতল বাতাসে শরীর, মন কেমন যেন করে উঠলো। অনুভূতিটাকে আঁকড়ে ধরে কল্পনায় উড়ে উড়ে পথ চলছি। হুজুরের ডাকে মাটিতে নামলাম। এই যে এটা হচ্ছে আমাদের ভোগাই নদী। নদী দেখে মনের অজান্তেই বলে উঠলাম,

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’

আমার আবৃত্তির ঢং দেখে মুজাহিদ সাহেব গলা খুলে হেসে উঠলেন। আমিও হাসলাম। আমাদের ঠিক এক ফুট সামনে থেকে খাঁড়া দেড়শ ফুটের মতো নীচে হাঁটু সমান পানি বুকে নিয়ে ভোগাই নদী নিশ্চল হয়ে আছে। একটু সামনে এগুতে যাব, মুজাহিদ সাহেব আমাকে টেনে ধরলেন- আরে ভাই কি করেন, করেন কি, সামনের মাটি সহ একেবারে নিচে তলিয়ে যাবেন তো। আসলেই তাই; নদীর দুই কূলের চারিদিক তাকিয়ে দেখছি আর কোন এক অতল গহবর থেকে ভাঙ্গনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে লক্ষ্য করতেই আন্দাজ করা যায়, আমরা যে যায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সে পাড় টা কেন ভাঙ্গে। উত্তর দিক থেকে পানির তোড় দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এসে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নেয়। সেখানে পানির স্রোত ধাক্কা খেয়ে প্রবল আক্রোশে এদিকের পাড় ভাঙ্গতে থাকে। ঐ কোণাটায় আবার বালুচরের মতো কিছু একটা হয়েছে। কারন সম্ভবত, না, নিশ্চিতভাবেই এটা।

মুজাহিদ সাহেব, ঐ যে ওখানে চরের মতো হয়েছে, ওখান থেকে বালু তুলে গভীর করলে পানির বিপরীত ক্রিয়াটা মানে এপারে ধাক্কাটা একটু কম লাগতো না?

আমার কথা তিনি বুঝেছেন, কিন্তু চুপ করে গেলেন। হয়তো এটা না করার পিছনে অদৃশ্য কোন হাত আছে। যার নাম মুখে নেয়াটাও বিশাল অপরাধ। ওপারে গাছ-গাছালির এমন ঠাস বুনট অনেক বছর দেখিনি। গাছের ফাঁকফোকর ভেদ করে দূরের কোন কিছু দেখার সুযোগ নেই। আমি মোহিত হয়ে উঠি। কেমন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ি। আশেপাশের মানুষের কথাবার্তা, বাচ্চাদের ছুটোছুটি, হল্লা কিছুই খেয়ালের ধারে কাছে নেই। মুজাহিদ সাহেব বলে উঠেন- এই যে আমাদের বাড়ি।

আপনাদের বাড়ি এই টা! নদীর গজ দশেক ভিতরে বাড়ির পিছন দিকটা দেখিয়ে বললাম, এতো সুন্দর একটা নদীর পাশে আপনাদের বাড়ি, সামনের দিক থেকে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আশ্চর্য তো! তিনি বললেন, পূর্ণ বর্ষার সময় আসলে স্রোতের আওয়াজে নদী টের পেতেন। আমি বললাম, তখন কি পাড় ভাঙ্গা শুরু হয়? এবার হলেতো আপনাদের বাড়িরও খবর আছে।

না, কয়েকবছর যাবৎ পাড় ভাঙছে না। এবারও ভাঙবে না ইন শা আল্লাহ্‌। ওনার উচ্চারিত ইন শা আল্লাহ্‌ বাক্যটায় অতিরিক্ত জোর আর বিশ্বাসের ভাবটা প্রকট। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস আর ভালবাসায় বিশ্বাসগুলি সবার মধ্যে যদি এমন প্রকট হতো, তাহলে হয়তো পৃথিবীর চেহারাটা আমূল বদলে যেত। এই যে, আমাকে শত শত মাইল পেরিয়ে তাগাদায় ছুটে আসতে হতো না- তাও একজন ইলমের শিক্ষায় শিক্ষিত জনের কাছে। দীর্ঘশ্বাসটা একটু জোরেই ফেললাম মনে হয়। মুজাহিদ সাহেবের অতিদ্রুত ঘাড় ফেরানো। তাঁর চমকে উঠা চেহারা দেখে মনে হলো তিনি যেন আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি বললেন, চলেন বাড়িতে যাই। আমি কিছু না বলে ওনার পিছু নিলাম।

মুজাহিদ সাহেবের বাড়ির গেস্ট রুমে বসে আছি। কতক্ষণ? সময়ের হিসাবটা রাখতে পারছি না। কেমন স্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে আছে। খোলা জানালায় চোখ রেখে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছি। মুজাহিদ সাহেবের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম- ভাই, আমাদের গাছের কাঁঠাল, মুড়ি দিয়ে খান ভাল লাগবে।

কাঁঠাল পাকার সময় হয় নি এখনো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুজাহিদ সাহেবের তাকালাম। তিনি আমার চোখের ভাষা পড়তে পারলেন, বললেন- ভাই, আমাদের এখানে যে কাঁঠাল গাছটা আছে, সেই গাছে মৌসুমের দুই তিন মাস আগেই কাঁঠাল পাকে। আমি বললাম, অকালপক্ব নাকি?

মুজাহিদ সাহেব স্বভাবের বিপরীতে মোটামুটি মানের উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন, না মানে, কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে আমাদের কিছু কাঁঠাল আর লিচু গাছ দিয়ে গিয়েছিল। ঐ যে, পুকুরের কাছ ঘেঁষে যে দু’টি গাছ আছে সেগুলি লিচু গাছ। আর কাঁঠাল গাছটা বাড়ির ভিতর। লিচু গাছ সম্পর্কে আরও কি কি যেন বললেন। আমি তাঁর পুরো কথাগুলি শুনতে পেলাম না। আমি দুটি লিচু গাছকে ভালমতো দেখতে চাইলাম। মুজাহিদ সাহেব তাড়া দিলেন- তাড়াতাড়ি খান, মাগরিব ওয়াক্তের সময় হয়ে গেছে। নামাজ পড়ে পেশ ইমাম সাহেবের মাধ্যমে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলতে হবে।

আমি বললাম, ভাই, খুব একটা ভরসা তো পাচ্ছি না। চেয়ারম্যান সাহেব এলাকাতে নেই। তা ফোন করে তো আর এসব আলোচনা করা যাবে না।
মুজাহিদ সাহেবের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি খেলে গেলো। খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু গভীরভাবে তাকিয়ে থাকায় হাসিটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। মনে মনে ভাবলাম, যা হবার হবে। রাতের বাসে বাড়ি ফিরে যাব। অবশ্য অসফল যাত্রার জন্য এখন থেকেই মনটা কেমন এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।

মাগরিব নামাজ শেষে পেশ ইমাম সাহেবের সামনে বসলাম। উনি আমাদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে বললেন, আপনার মোবাইল থেকে কার্ডে দেয়া নাম্বারে কল দিন। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। মনে মনে অনেক কথাই বলছি, যেমন- কল রেট এতো কম, তারপরেও আমার প্রয়োজন দেখে আমাকেই কিনা কল দিতে বলছেন? আচ্ছা লোক তো ভাই আপনি!

আমি কল দিয়েই পেশ ইমাম সাহেবের কাছে মোবাইল ফোন দিয়ে দিলাম। ওনাদের কথাবার্তায় বুঝা গেল যে চেয়ারম্যান সাহেব এলাকাতেই আছেন এবং আমাদেরকে তাঁর অফিসে যেতে বলেছেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে পেশ ইমাম সাহেব বললেন, চলেন। চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর অফিসেই আছেন। তিনজন হেঁটেই রওনা দিলাম।

হাঁটতে ভালোই লাগছে। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থাকায় নিজেকে কেমন পর্যটক পর্যটক লাগছে। পাশাপাশি তিনজন গেলে রাস্তার অর্ধেকটা প্রায় দখল হয়ে যায়। ওনাদের সামনে এগুতে দিয়ে পিছু পিছু হাঁটছি। ওনারা সামনে বেশ জমিয়ে দিয়েছেন। সব নির্দোষ, নিষ্কলুষ আলোচনা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টা কানে খুব বাজে। এমন আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা বর্তমান সময়ে খুবই বিরল- তা সেটা হুজুর হোক বা সাধারন জনদের মধ্যেই হোক না কেন। ভালোলাগার মধ্যেও অস্বস্তির একটা কাঁটা মনের মধ্যে খোঁচাখুঁচি চালিয়েই যাচ্ছে- আলোচনা কতটুকু সফল হবে? নিজ এলাকার কয়েকজন ভোটারের বিপক্ষে যাবার মতো কতটুকু মানসিক দৃঢ়তা আছে চেয়ারম্যান সাহেবের?

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ ......। জোরাল শব্দে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে সালামের উত্তর দিলেন। সামনের দুজন থমকে দাঁড়িয়েছেন তো আমাকেও থমকে দাঁড়াতে হলো।

তা, হুজুররা কোথায় যাচ্ছেন?

চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাচ্ছি।

ওনার কাছে আবার কি, কোন সমস্যা?

হ্যাঁ, একটু সমস্যা, তবে আমাদের না। এই যে, এই ভাই নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন, ওনার একটু সমস্যা আছে।

ওনার সমস্যা তো আপনাদের কি?

শব্দগুলি বেশ রোখাচোখা- মনে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।

পেশ ইমাম এবং মুজাহিদ সাহেব কোন প্রত্যুত্তর করলেন না। পেশ ইমাম সাহেব প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনার শরীর স্বাস্থ্য কেমন?

নারে ভাই, বয়স হয়ে গেছে, আজকে ঠাণ্ডা, তো কাল কোমর ব্যাথা, পরশু বুকে ব্যথা .........।

তো তো দিয়ে ভদ্রলোক কতক্ষণ যে চালালেন! এইবার থাম না ভাই, লক্ষ্মী ভাই আমার, তোকে চাচা না ডেকে ভাই ডাকছি, তবুও একটু থাম! আন্তঃনগর চলন্ত ট্রেনের ব্রেকে চাপ পড়লো বুঝি। আহ কি শান্তি। ভদ্রলোকের বয়স কত হবে। এই, আনুমানিক ৬০ থেকে ৬৫ বছর। এমন ধারাবাহিক কথা বললে তো কোমর, ব্যথা, বুক ব্যাথা করবেই।

তা হুজুর আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনারা দুইজন আলেম আছেন। আমাকে কুরআনের অথবা সহি হাদিসের রেফারেন্স সহকারে বুঝিয়ে দেবেন প্লীজ।

তোর প্লীজের গুষ্ঠি কিলাই ...... শব্দগুলি মুখ ফসকে বেড়িয়েই যেত যদি না পেশ ইমাম সাহেবের ভরাট কণ্ঠ ওনার প্রশ্নের জবাব দেয়া শুরু না করতো।

আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, মানে আপনার নাবালক নাতিকে নিয়ে প্রথম কাতারে নামাজে দাঁড়াতে পারবেন কিনা, সেটার সরাসরি কোন রেফারেন্স দেয়া মুশকিল। তবে আনুষঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনা করে বলা যায় যে ...।

ভদ্রলোক একটু কঠিন সুরেই বাঁধা দিলেন- আনুষঙ্গিক বিষয় জানতে চাচ্ছি না। ডাইরেক্ট রেফারেন্স বলুন।

পেশ ইমাম সাহেবের ধৈর্য দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারলাম না। স্মিত হাসি দিয়ে তিনি বললেন, দেখুন আমার চোখে সরাসরি কোন রেফারেন্স পরেনি। আমি আজ থেকে এ বিষয়টা নিয়ে আবারো দেখবো। দেখি কোন রেফারেন্স পাই কি না।

ভদ্রলোক এমনভাবে পেশ ইমাম সাহেবের দিকে তাকালেন যেন তিনি ইমাম হবার সামান্যতম যোগ্যতাও তাঁর নেই। ভদ্রলোকের চোখের চাহনি দেখে আমি খানিকটা ভড়কে গেলেও পেশ ইমাম সাহেবের মুখের হাসি এখনও অম্লান। দ্রুত সময়ের হিসাবটা করে নিয়ে বললাম, ইমাম সাহেব চেয়ারম্যান সাহেব না আবার চলে যান।

ইমাম সাহেব আমার কথায় ইশারাটা ঠিকই বুঝে নিলেন, বললেন, আজ যাই। এই ভাই সেই নারায়ণগঞ্জ থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলতে এসেছেন। দেরি হলে আবার হয়তো চেয়ারম্যান সাহেব চলে যাবেন। যাই তাহলে, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। তিনজন লোক এতক্ষণ কিভাবে যে বাঘবন্দিতে পড়ে ছিলাম! মুক্তির আনন্দে ছোটখাটো একটা উল্লাস মাখা শব্দ উচ্চারণ করলাম, ইয়া হু। পেশ ইমাম সাহেব এবং মুজাহিদ সাহেব দুজনেই হেসে ফেললেন।

চেয়ারম্যান সাহেবের বিচার, বৈঠকের জন্য মার্কেটে দুখানা দোকানঘর নির্দিষ্ট করা আছে। সেখানেই চেয়ার, টেবিল বসিয়ে সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে বসেন। এ সম্বন্ধে যা জানা গেল সেটা হচ্ছে যে, মার্কেটটি তাঁর মালিকানাধীন। নিজেকে ব্যবসায়িক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে জনগণের জন্য অফিস খুলেছেন। মুগ্ধ হয়ে বলার মতো একটা বিষয়।

আমরা তিনজন ঢুঁকেই সালাম বিনিময় করলাম। চেয়ারম্যান সাহেব অমায়িক কণ্ঠে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। ভদ্রলোকের বয়স কত? ৪৫ না ৫০ বছর? বয়স ধরাটা বেশ মুশকিল। সারা অবয়বে চমৎকার, চটপটে, ব্যক্তিত্ব ফুটে আছে। বেশ কয়েকটা সালিশ বৈঠকের তারিখ দিলেন। ছুঁচোমুখো একজন সহকারী বেশ নিখুঁতভাবে একটা খাতায় বৈঠকের বিবরনাদি টুকে রাখছেন। এতোটুকুন চেহারায় বিশাল একটা ভারী কাঁচের চশমা। মুখের প্রায় অর্ধেকটা চশমার কারনে ঢাকা পড়ে আছে।

তা আপনাদের খবর কি? কেমন আছেন? ভরাট কণ্ঠের আওয়াজে চারিদিকে চোখ বুলানো বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।

পেশ ইমাম সাহেব বলে উঠলেন, জ্বী চেয়ারম্যান সাহেব, আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমার দিকে ইশারা করে বললেন, উনি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। ওনাদের এলাকার মসজিদে ইমামতি করার সময় ......।।

হ্যাঁ জানি। ওর বিষয়ে আরও কিছু অভিযোগ এসেছে।

ছুঁচোমুখো সহকারী চিঁ চিঁ করে উঠলো-

আজকে বলে কি হবে! সে কি এলাকায় থাকে?

চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, আপনি চুপ করেন তো। আপনাকে কথা বলতে বলেছে কে?

আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাই, আসুন। বাইরে আসুন।

আমরা বাইরে একটু অন্ধকারমতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। চারজনের মধ্যে উনিই বেশ অনেকটা লম্বা। তিনজন ফরিয়াদির মাঝে বিচারক মহোদয়ের উচ্চতা আর স্বতঃস্ফূর্ত চলনটা অসম্ভব মানিয়ে গেল। বাকি দুজনের মনের অবস্থা বুঝতে না পারলেও ভদ্রলোকের সামনে নিজেকে বেশ অপাংক্তেয় মনে হলো। আমি আমার ঘটনাটা সংক্ষেপে বললাম। মনে হয় বলাটা বেশ গুছিয়েই ওনার কাছে পেশ করতে পারলাম।

তিনি সিগারেট টানতে টানতে টানতে বেশ মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। আমি যখন কথা বলছিলাম তিনি আমার মুখের উপর থেকে একবারের জন্যও চোখ সরালেন না। সিগারেট খাওয়া আর একনাগাড়ে কারো দিকে তাকিয়ে মনোযোগ ধরে রাখা চমৎকৃত হবার মতো ঘটনাই বটে।

আমার কথা শেষ হতেই তিনি বললেন, এখন আপনার জন্য কি করতে পারি? খুব কুশলী প্রশ্ন।

আমি বললাম, আপনি একজন জনপ্রতিনিধি। এলাকার মানুষ দোষী হলেও সেটা সরলভাবে দেখবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে, এতদূর থেকে আপনার নিকট আসা আর আমার প্রয়োজনের বিষয়টা যদি মানবিক দৃষ্টিতে আমলে নেন, সেটাই প্রচণ্ডভাবে আশা করছি।
চেয়ারম্যান সাহেব কিছু বলার আগেই পেশ ইমাম সাহেব বললেন, ঐ লোকটার জন্য আমাদের এলাকার বদনাম হয়ে যাচ্ছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে চেয়ারম্যান সাহেব।

চেয়ারম্যান সাহেব আরেকটা সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন। তারপর বললেন, আপনারা কি ওর বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানেই আগে যাওয়া দরকার ছিল।

আমার আগেই মুজাহিদ সাহেব বললেন, দুপুরে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। ও বাসায় নেই। ওর বাবা, ছোট ভাই আর বোন জামাইয়ের সাথে আলাপ করলাম......।

আমি যুক্ত করলাম, যাদের সাথে আলাপ করেছি তারা কোন দায়িত্ব নেবে এমনটা মনে হলো না।

চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর সহযোগীকে ডাকলেন। ছুঁচোমুখ চশমা ঠিক করতে করতে দৌড়ে বাইরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

ঐ মোল্লার বাবার নাম্বারে ফোন লাগান।

আমার কাছে নাম্বার নেই। কথাটা শুনার সাথে সাথে আধো অন্ধকারেও চেয়ারম্যান সাহেবের চোখমুখে ক্রুদ্ধ ভাবটা স্পষ্ট টের পেলাম।

চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেলন, আপনাদের কাছে ওর বাবার নাম্বার আছে। আমি দ্রুত বললাম, জ্বী, আমার কাছে আছে বলেই ডায়াল করলাম। মিষ্টি মেয়েলী কণ্ঠ জানালো ‘......... এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয় .........”।

স্যার, ওনার মোবাইল নাম্বার বন্ধ।
চেয়ারম্যান সাহেব সহযোগীর দিকে ফিরে বললেন, গ্রাম পুলিশ কে আছে অফিসে?

জ্বী না, কেউ নেই। আজ ছুটির দিন।

ঠিক আছে যান। ভিতরে গিয়ে কাজ করুন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর আপনি আজকের দিনটা থেকে যান। কাল সকালে ওর বাবাকে ধরে আনার ব্যবস্থা করছি। আপনার টাকা আপনি পেয়ে যাবেন। অর্থবোধক আশাজাগানিয়া কথাটা শুনে ভালই লাগলো। কিন্তু সময়ের হাতে বাঁধা আমাকে বলতে হলো, স্যার, মাফ করবেন, আজ রাতেই আমাকে ফিরে যেতে হবে। অফিসের একটা জরুরী কাজ না করলেই নয়। চেয়ারম্যান সাহেব আমার কথায় বিরক্ত হলেন কিনা বুঝা গেলো না। তিনি বললেন, থাকলে ভালো হতো। আপনি না থাকলেও একটা বিহিত হবে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যান। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও দিলাম। করমর্দনে তাঁর আন্তরিকতাটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, উনি কথা রাখবেন।

পেশ ইমাম সাহেব, মুজাহিদ সাহেব আর আমি বাইরে এসে চায়ের দোকানে গেলাম; চা খেলাম, পান খেলাম।

হুজুর বিলটা আমিই দেই?

কি বলেন, আপনি আমাদের এলাকার মেহমান। যতটুকু প্রাপ্য তার বিন্দুমাত্র মেহমানদারি করতে পারলাম না। আর সামান্য চা, পানের জন্য ...... লজ্জা দেন কেন ভাই।

আমি ওনাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালাম। ওনাকেই বিল দিতে দিলাম।

হুজুর, আমি বাসের টিকেট কাটতে যাচ্ছি।

টিকেট করেননি এখনও! ওনার কথায় বেশ একটা অস্থিরতার ভাব ফুটে উঠলো।

তার অস্থিরতা আমাকেও স্পর্শ করলো। বললাম, না, কোন সমস্যা আছে?

সমস্যা বলতে সমস্যা। আজ শুক্রবার। টানা তিন দিন পর কাল থেকে অনেকের অফিস খুলবে। বাসে কোন টিকেট আছে কিনা আল্লাহ্‌ জানেন।

আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে মুজাহিদ সাহেবের দিকে তাকালাম। তাকেও বেশ বিমর্ষ মনে হচ্ছে। বললেন, একটু অপেক্ষা করেন। বলেই একটার পর একটা ফোন করতে লাগলেন। প্রতিবার ডায়ালের আগে ওনার ভঙ্গিতে অস্থিরতা আনুপাতিক হারে বেড়েই চলছে। পাশাপাশি তিনজন মানুষ একই বিষয় অর্থাৎ বাসের টিকেট নিয়ে ভাবনায়। ওনার অস্থিরতা তিনগুনা হয়ে পেশ ইমাম সাহ্বে আর আমার ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে। আঙ্গুল দিয়ে নখ কাটতে কাটতে পেশ ইমাম সাহেবের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ওনার ভাবসাবে মনে হচ্ছে এখুনি সব ফেলেটেলে আর্কিমিডিস স্যারের মতো ‘ইউরেকা’ জাতীয় কোন চিৎকার দিয়ে দৌড় লাগাবেন। অস্থিরতার বিপরীতমুখী অনুভবে আমরাও উচ্ছল হতে শুরু করে দিয়েছি।

চলেন, মেয়র সাহেবের তিনটা গাড়ি এখান থেকে মহাখালি পর্যন্ত যায়। ওখানে একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই ইন শা আল্লাহ্‌।

আমরা মেয়র সাহেবের অস্থায়ী কার্যালয়ের সামনে থাকা টিকেট কাউন্টারের দিকে রওনা দিলাম। কাউন্টারে যেতে যেতে যতটুকু জানা গেলো, সেটা হচ্ছে, এই বাস সার্ভিসে মোট তিনটি বাস আছে। সময় সুযোগমতো আরও বাড়বে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে। কাউন্টারের পাশে বিশাল একটা দালান উঠছে। মুজাহিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ওটা পৌর ভবন হবে।
আমরা কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতেই টিকেট বিক্রেতা বললেন, হুজুর আপনি? কি দরকার বলেন। কাউন্টারের ছেলেটা বিনয়ে গলে গলে পড়তে লাগলো- হুজুর আপনারা কয়জন যাবেন? সীট খালি আছে মাত্র একটা।

আমার একটা সিটই দরকার।

হুজুর আপনার কপাল ভালো। এই একমিনিট আগে একটা বুকিং ক্যানসেল হলো।

ঐ একটা সিটই আমার দরকার।

আমাকে দেখিয়ে পেশ ইমাম সাহেব বললেন, ইনিই যাবেন।

জ্বী আচ্ছা। ওনার নামেই খালি সিটটা বুকিং দিয়ে দিলাম।

আমি পকেট থেকে টাকা বের করে খতিব সাহেবের হাতে দিলাম। উনি টিকেট নিয়ে আমার হাতে দিলেন। কাউন্টারের স্টাফকে বললেন, উনি আমার ভাই। যাতায়াতে কোন অসুবিধা যেন না হয়।

আরে, কি যে বলেন হুজুর। আপনার মেহমান, উনার কোনরকম তকলিফ হবে না। বাস ছাড়বে এই ধরেন রাত এগারোটায়।

টিকেট সংক্রান্ত ঝামেলা চুকিয়ে শুরু হলো বিদায় নেবার পালা। আমি মুজাহিদ সাহেবের সাথে করমর্দন করলাম। পেশ ইমাম সাহেবের দিকে হাত বাড়াতেই তিনি হাত ধরে আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় তিনি মুখে কিছুই বললেন না। কিন্তু আমি তার অন্তরের কথাগুলি শুনতে পাচ্ছি- আপনি ভালো থাকবেন। এই কয়েক ঘণ্টায় আপনাকে অসম্ভব আপন মনে হচ্ছে। আল্লাহ্‌ তায়ালা আপনাকে হেফাজত করুন। জড়ানো অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ভেজা কণ্ঠটা বলে উঠলো- আল্লাহ্‌ হাফেজ। বলেই পিছনে একবারও না তাকিয়ে নিজ এলাকার দিকে হাঁটা ধরলেন। অকস্মাৎ তীব্র একটা আবেগে অভিভূত হয়ে পরলাম। চোখদুটি আপনা আপনিই ভেজা ভেজা হয়ে উঠলো। মুজাহিদ সাহেব বললেন,

চলেন ভাই, কিছু খাই।

না, না, এইমাত্র চা খেলাম। এখন আর কিছু খাবো না। আপনি যান।

এতো লম্বা সময় একা একা কি করবেন? আমি বললাম, রিক্সা করে অন্ধকার দেখতে বেরুবো- ঘুটঘুইট্যা আন্ধার।

কি দেখবেন?

ঘুটঘুইট্যাঁ আন্ধার- নিজের হাত দেখা যায় না এমন অন্ধকার।

কি যে বলেন না ভাই!

আচ্ছা, আমি তাহলে যাই। আবার দেখা হবে ইন শা আল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

আমিও বললাম, আল্লাহ্‌ হাফেজ।

যদি বাস কর্তৃপক্ষের জবান ঠিক থাকে তবে বাস ছাড়তে আরও ঘণ্টা তিনেক বাকি। রিক্সায় আরও পরে চড়লেও হবে। আমি কাউন্টারের পাশের RFL নামের চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে বসে সিগারেট টানছি আর গরুর মতো পানের ছিবড়ায় জাবর কাটছি। আমাদের বাস ধোয়ামোছা হচ্ছে। পিচ্চি হেল্পার নানা কসরত করে কি একটা সিডি চালিয়ে দিলো। একটু দূরে থাকায় মিহি সুরে গানের বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ অস্পষ্টভাবে শুনা যাচ্ছে- ও শা আ লী, ও শা আ লী। শালীকে নিয়ে মজার মজার গান তৈরি হয় এ অঞ্চলে। তাই গানে খুব বেশি অবাক বা মনোযোগ দেবার দরকার পড়ে না। কিন্তু খটকাটা তখনি লাগলো যখন হাঁপানি রোগীর চরম মুহূর্তে শ্বাস নেবার মতো করে উহ হু, উহ হু, উহ হু বলে কয়েকজন কোরাস গাইতে লাগলো। উহু, কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। শালীকে নিয়ে গান করার সময় কোরাসে হয়তো শিয়ালের মতো খিক খিক করে ভেটকি মারবে, উহ হু, উহ হু, উহ হু করবে কেন? আমার ভ্রু যুগল কুঁচকে উঠে। আমি দেখতে না পারলেও আশেপাশের কয়েকজন ভ্রু কুঁচকে থাকাটা খেয়াল করছে নিশ্চয়ই। নইলে এভাবে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন?

মনের খটকা দূর করতে গাড়ির কাছাকাছে খোলা জানালার পাশে গিয়ে গানের কথায় মনোযোগ দেই। গানের কথাগুলি শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না। তবে মনে মনে যে একচোট হেসে নিলাম সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গাতক গাইছেন- ও শা হ আলী, ও শা হ আলী (শাহ আলী নামের পীর বা বুজুর্গ কেউ হবেন হয়তো)। আর কোরাসে হাঁপানির টান যারা দিচ্ছেন তারা জনৈক প্রভাবশালী পীরের মুরিদেরা যেমন উহ হু, উহ হু, উহ হু করেন, সেরকমটা করে যাচ্ছেন।

হাসিতে নাকি মন ভালো হয়। আমি বুঝে উঠতে পারছি না, আমার মন ভালো হয়েছে কি না। তবে মনের গতিধারার যে একটু পরিবর্তন হয়েছে সেটা নিশ্চিত। আমার কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত গজ দূরে দুটো পলিথিনের বস্তা। যতটুকু আন্দাজ করতে পারছি- একেকটা চল্লিশ কেজি ওজনের চালের বস্তা। বস্তার কিছুটা পর পর আঁশ ছাড়ানো। এর মধ্যেই গলা লম্বা করে একটা লাল মোরগ কক কক করে উঠে। অন্ধকার থেকে একজন এসে থাবড়া দিয়ে ওটাকে বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।

কাউন্টার থেকে একজন বলে উঠে- ঐ রমজান, এক বস্তায় কয়টা মাল?

একেকটা বস্তায় সত্তর টা মুরগী আছে।

মুরগী গুলি ছাদে উঠায়া দেও না ক্যান?

হ দিতাছি। ভ্যান গাড়িটা আইলেই উঠাইয়া দিমু।

ভ্যান গাড়ি আসে। দুজন লোক বস্তার দুই পাশের দুই কোণা আগলে ধরে। উদ্দেশ্য বস্তাগুলিকে ভ্যান গাড়িতে তুলবে। দুদিক থেকে যখন দুজন বস্তা আগলে ধরে মুরগীগুলি বস্তার মাঝখানে ছোট অতি ছোট হয়ে নির্জীব অবস্থায় পড়ে থাকে। দশ কেজি চাল কিনলে পলিথিনে যতটুকু জায়গা হয় ঠিক ততটুকু জায়গায় সত্তরটা মুরগী জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে। এভাবে আরও একটি বস্তা ভ্যানগাড়িতে তোলা হয়। তোলার সময়টুকুতে বস্তার ভিতর থেকে ক্ষীণ শব্দের আওয়াজটুকুও শুনা গেলো না। ভ্যানগাড়িতে তোলার পর চাপড়ে চাপড়ে মুরগীগুলিকে বস্তার ভিতরে ছড়িয়ে দিল। সেই লাল মোরগটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল চোখ, কেমন যেন ভেজা ভেজা। হয়তো চোখের ভুল। তবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা ভাবতেই কেমন যেন দুমড়ে উঠলো মনটা। মোরগটার চোখ ভরা কি আকুতি। নিঃশব্দ কিন্তু অসহ্য, অসহনীয় সেই আকুতির ধরন। সম্মোহিতের মতো ওটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু করার নেই- নাহ, সত্যিই কিছু করার নেই। কেমন যেন ঠাণ্ডা মতো লাগছে। আবহাওয়া এতোটা শীতল নয় যে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগবে। মনের সাথে সাথে শরীরটাও কি বিবশ হয়ে গেলো?

ঐ, রশি ধর- জোর চিৎকারে উপরের দিকে তাকালাম। উপর থেকে সন্তর্পণে দুইটি দড়ি নেমে আসছে। দড়ির দুই মাথা বস্তার দুইপাশে বেঁধে উপর থেকে দুইজন বাস হেল্পার টানতে লাগলো। এবারের আকারটা সাত কেজি ওজনের চালের পোঁটলার আকার ধারন করলো। বস্তার ভিতর থেকে কোন শব্দই আসছেনা- আগের মতোই নিথর, নিশ্চুপ। পরপর দুটি বস্তা উঠানো হলো। উপর থেকে বস্তায় চাপড় মারার শব্দটা প্রচণ্ড এক বিদ্রুপ হয়ে কানে বাজতে লাগলো। আমি রাস্তা পার হয়ে ঠিক উল্টা দিকের একটা চায়ের দোকানে বসলাম। চায়ের অর্ডার দিয়ে নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছি। চা খেতে খেতে নিজেকে ধাতস্থ করতেই একটু দূরেই ডাস্টবিন দেখতে পেলাম। ডাস্টবিনের পাশেই এক পাগল আর কুকুর একসাথে ময়লা খুঁটে খাবার তুলে খাচ্ছে। পাগল লোকটা স্খলিত কণ্ঠে অশ্লীল গানি গেয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে হয়তো বমি টমি করে ভাসিয়ে দিতাম। কিন্তু ইন্দিয়গুলি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। চেতনার একটা অংশ হয়তো এখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় নি। তা হলে হয়তো অন্তঃস্থল থেকে দীর্ঘশ্বাসটা বের হতো না।

হাতে এখনও আড়াই ঘণ্টার মতো সময় আছে। ঘণ্টা হিসাবে একটা রিক্সা নিয়ে অনেক দূরে কোথাও ঘুরে আসতে মন টানছে। সারিবদ্ধ আট থেকে দশটি রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলিই ব্যাটারিচালিত। বুড়োমতো একজন রিক্সাওয়ালাকে ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই রাজী হয়ে গেলো।

তা, এক ঘণ্টায় কত টাকা নেবেন?

রিকশাওয়ালা মনে হয় চালবাজিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। একটু ইতস্তত করে বললো, ঘণ্টায় একশ টাকা দিয়েন।

পাশের চ্যাংড়া, ঢ্যাঙা এক রিকশাওয়ালা বলে উঠলো, চাচা মিয়া, আমিতো দেড়শ টাকার নিচে যাইতাম না। বুড়ো রিক্সাওয়ালার চোখেমুখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠলো- কি ভুলটাই না সে করেছে। মনে মনে হয়তো কপাল চাপড়াচ্ছে। একবার যখন ভাড়ার কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে রিক্সাওয়ালাকে সুযোগ দেবার কোন মানে নেই। রিক্সায় উঠেই বললাম- চাচা চলেন। রিক্সা চলতে শুরু করে।

চাচা, আমাকে কোন এক অন্ধকার এলাকার দিকে নিয়ে যান। রিক্সাওয়ালা সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে পিছন ফিরে চাইলেন।

আমি বললাম, চাচা, ভয় নেই। আপনার কাছে নেবার মতো কিইবা আছে? আজাইরা চিন্তা না করে কোন এক অন্ধকার রাস্তা ধরে রিক্সা চালান।

আমার কথায় তিনি আশ্বস্থ হলেন না, বরং সোজা বড় রাস্তা ধরে এগুতে লাগলেন। রাস্তা চওড়া হলে কি হবে, একেবারেই নিরিবিলি। তবে ঘুটঘুইট্যা আন্ধার দেখার কোন সুযোগ নেই। অন্ধকারে ঢাকা দূর কোন ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে মিটিমিটি আলো আসছে। মসৃণ রাস্তা, শুধুমাত্র দুয়েকটা স্পীড ব্রেকার তুচ্ছ করে গতির হেরফের ছাড়াই নির্দিষ্ট ছন্দে রিক্সা চলছে। ছন্দটা এমন যে ঝিমুনি এসে যায়। ঝিমানোর মাঝেই সেই কৈশোরের এক তরুণী বঁধুর ফর্সা, মোমের মতো পেলব হাত দেখতে পাই। পানির গাঢ় অন্ধকার বুক থেকে থেকে যে হাত তুলে এনেছিলাম- নিথর, প্রাণহীন। সবাই ভুলে গেছে- কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। ঐ হাতদুটি আজও কল্পনায় বা স্বপ্নে এসে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। শুভ্র হাতের মায়াবতী তরুণী প্রায়ই বলে যায়, আমি আছি, তোর সাথে আমি আছি।

হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি বিশাল, বিকট একটা অন্ধকারের স্তূপ। আমার ভয় হতে লাগলো। ভয়টা আমার সমস্ত চেতনাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি প্রাণপণে ভয় তাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জমাট অন্ধকারের স্তূপ থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। আকাশ কই? আকাশের পরিবর্তে সেখানে বিশাল কালো মহাশূন্য- কালো মেঘে ঢাকা এক অনন্ত, অসীম অধরা শূন্য। হঠাৎ করেই আকাশের ছোট একটা দরজা খুলে যায়। দরজার ভিতরে অসংখ্য নক্ষত্র- উজ্জ্বল, কিন্তু রক্তিম নক্ষত্রগুলি কেমন যেন অচেনা। স্বাভাবিকতার বাইরে অস্বাভিক কি যেন আছে তাতে। নক্ষত্রভরা সেই দরজা দিয়ে ভয়ংকর সব দৈত্য আমার দিকে তেড়ে আসছে। আরে ওগুলি তো সেই বস্তা ভরা মুরগীর দল- কি কুৎসিত, কিম্ভুত-কিমারকার দেখা যাচ্ছে এদের- একেবারে দৈত্য একেকটা। ওদের পাখার ঝাঁপটায় সবকিছু ঝনঝন করে কাঁপতে থাকে। ওরা আমার দিকেই তেড়ে আসছে। আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের বিকট অট্টহাসির উল্লাসে আমার সমস্ত অন্তরাত্মা কাটা দিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। এমনি সময় বহুবছর আগে দেখা অপূর্ব মায়াময় মুখের এক নারী আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। দুহাতের প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে দলে দলে নেমে আসা দৌত্যগুলিকে, ওদের বীভৎস ভয়ংকর মুখ গুলিকে ঝটকে সরিয়ে দিচ্ছে। হাতের কাঁচের লাল, নীল, সবুজ চুড়িগুলি ভেঙ্গে চুরচুর হতে থাকে। রক্তাক্ত হাত তবুও থামে না। ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে একেকটা কুৎসিত, ভয়ানক দৈত্যকে নিদারুণ আক্ষেপে চিৎকার করছে- আমি আছি, শুভ, আমি আছি, তোর কিছু হবে না।

আমি দৌড়ে পালাতে চাইছি। কিন্তু সারা শরীর অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। পা দুটি আটকে আছে। কিছুতেই নাড়াতে পারছি না। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে বুঝতে পারছি না। শুধু চোখের ঠিক উপরে উদ্ভিঘ্ন বয়স্ক, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ থেকে একটা বাক্য শুনা যাচ্ছে- বাবা, আপনে এতো ঘামতাছেন ক্যা? আপনের কি হইছে?

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৬

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ক্লান্ত পথিক

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.