![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনির্দিষ্ট
(হুমায়ুন কবির)
চারজনের ছোট সংসারটা ওদের বেশ ভালই কাটছে- মতি শেখ, সখিনা, বড় মেয়ে বকুল আর দুই বছরের ছোট ছেলে বাদল। কামরাটা অবশ্য বেশ ছোট, কিন্তু ভালবাসার বন্ধনটা খুব শক্ত। মাঝে মাঝে ভালবাসার ব্যাপ্তিটা এত বিশাল মনে হয় যে, দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেও এর দেয়ালগুলি ছোঁয়া যায় না, এত দূরে একেকটা দেয়াল, এত বড় ঘর!
গত দুই বছরে বাদল, খোকন, রাশেদ, তুহিন কতভাবে কতরকমের নাম স্থির করা হল, কিন্তু বাদল নামটাই বুঝি শেষমেশ বহাল থেকে যাবে। একজন শিশু যার কাছে দিন-রাতের বেশিক্ষন কাটে তার মুখ থেকেই যখন বাদল নামটা সারাক্ষণ খৈ ফোঁটার মতো ফুটতে থাকে তখন অন্যান্যদের ডাকাডাকির ভিন্নতা খুব একটা পাত্তা পায় না। সখিনা নামের তরুণী বধূটি প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশী করেই ছেলেকে নাম ধরে ডাকেন। আমার ময়না পাখি, সোনা যাদু, কিটিকিটি সহ অদ্ভুত সব শব্ধের ডাকগুলি এখানে খুব বেশী উচ্চারিত হয় না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে অম্লমধুর একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলছে সেই কবে থেকে। মতি শেখের খুব শখ তিনি ছেলের নাম রাখবেন তুহিন শেখ। এর পিছনে ছোট একটা কারনও আছে, সেটা হচ্ছে- ওনার এলাকার একজন বিশাল মাপের মানুষের ডাকনাম তুহিন। পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক না কেন; অর্থ, বিত্ত, প্রভাব, প্রতিপত্তিতে এখনো নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে রেখেছেন তিনি। এমন মানুষের নামে নাম রাখলে ওনার মতো হলেও হতে পারে। নাম অনেক কিছুকেই টানে। অথচ সখিনা বলে ভিন্ন কথা, আমার ছেলে হবে ওর মত, আর কারো মত হবারও দরকার নেই, কারো নামে নাম রাখারও দরকার নেই। লড়াইটা দু’বছর যাবৎ যখন টিকে আছে, তখন আরও বেশ কিছুদিন চলবে বলেই ধারনা করা যায়। নিজের দেয়া নামে ডাকতে না পারলেও সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার বিষয়ে অর্থের প্রয়োজনীয়তা মতি শেখ খুব ভাল করেই অনুমান করে নিতে পারে। আগে যখন ওদের কোন সন্তান হয়নি- ঢাকাতে এসে ছোট একটা ঘুপচি ঘরে সংসার শুরু করে, তখন মতি শেখ একবেলা রিক্সা চালাত। প্রথম সন্তান হবার পর থেকেই দু’বেলা রিক্সা চালায়। নতুন, তুলনামূলকভাবে বড় আয়তনের এক রুমের বাসা ভাড়া নেয়। থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু সঞ্চয়ের খাতে জমা পড়ে। সপ্তাহে একদিন ছেলে-মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে দুজন ডানোর ডিব্বাটা খুলে জমানো টাকার হিসাব মিলায়। টাকার পরিমাণ বাড়তে দেখে দুজনেই উৎফুল্ল হয়; আনন্দের এই অংশটায় পরস্পরের ভালবাসার গভীরতাটা ডানা মেলে উড়তে থাকে। স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে টাকা গুনতে কি যে আনন্দ সেটা মতি শেখ কখনো বলে বুঝাতে পারবে না কাউকে। আরও কিছু টাকা বাকি আছে, সেটা হলেই নতুন একটা রিক্সা কিনবে। হ্যাঁ, একেবারে নিজের রিক্সা। কোহিনুর মিয়ার গ্যারেজে কথাও বলে রেখেছে, সেখানে রিক্সা রাখবে। সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত। কারন সখিনারও এতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আল্লাহ্ ভরসা। এভাবে চললে, আর মাস দুয়েকের মধ্যেই নতুন রিক্সা কেনা হয়ে যাবে।
জীবনটা জীবনের মতোই চলতে থাকে। সুখে, হাসিতে পরিপূর্ণ। মাঝে মাঝে সখিনার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। নদীর স্রোতের মতো নিটোল বহমান ধারায় কোন অজানা ঢেউ এসে সবাইকে ভাসিয়ে না দেয়।
দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় সামান্য গড়াগড়ি করে নেয় মতি শেখ। তখনকার সময়টায় ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীর সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠে মতি শেখ। মাথার লম্বা চুলে আট বছরের মেয়ের নরম হাতের বিলি কেটে দেয়া- অদ্ভুত আবেশে মনটা ভরিয়ে দেয়। কেমন ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয় সে। ঘুম থেকে উঠে মেয়ের হাতে দুই টাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয় সবসময়। এটা হচ্ছে চুল টানার বকশিস। ঘুমন্ত ছেলেটার কপালে খুব আস্তে চুমু খেয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্যারেজের দিকে রওনা দেয়। জেগে থাকলে ‘ও আমার তুহিন শেখ’ বলে স্ত্রীকে খেপানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে ছাড়ে না। ছেলেও তখন বেশ খিলখিল করে হেসে উঠে। অদ্ভুত আনন্দের সেই হাসি। বিকাল চারটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত রিক্সা চালিয়ে ঘরে ফিরে আসে। ছকে বাঁধা সুখী জীবনটা সত্যিই অসাধারণ। নিজেদের সুখ আর আনন্দের সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু একটা করার আপ্রাণ চেষ্টাটা দুজনের মনেই সারাক্ষণ নিজের অবস্থানকে জানিয়ে দিতে থাকে।
আজ কয়েকদিন যাবৎ মতি শেখের রুটিনের কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। আগে দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে তিনটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়তো। আর এখন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টানা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ঘর থেকে বের হয়।
কি গো ইদানিং এতো দেরি করে বের হও কেন?
দুপুরে কোন প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায় না। খালি খালি রিক্সা নিয়ে এদিক ওদিক করতে হয়।
আগে তো এমন ছিলনা। তুমি না বলতে বিকেলের দিকে প্যাসেঞ্জাররা ভাড়া নিয়ে খুব বেশি দর কষাকষি করে না?
বেশ রুক্ষ কণ্ঠে মতি শেখ বলে- এত কথা বল কেন? রিক্সা চালানোর বিষয়ে তুমি কি বুঝ? আমার কাজ আমি ভালই বুঝি। আমার কাজ আমার মত করে করে যেতে দাও।
মতি শেখের রুক্ষ কণ্ঠে সখিনা আহত হয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। হয়তো কোন সমস্যা আছে। নইলে খালি খালি অলস সময় কাটানোর মানুষ নন বকুলের বাবা। সখিনার কষ্টের মাত্রাটা খুব বেশী না হলেও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। মানুষটাকে এখন কেমন যেন আগোছালো আর উগ্র মনে হয়। স্বাস্থ্যটাও আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানুষটার হয়েছে কি? আপন মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেন সখিনা বেগম। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তরটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু স্বামীর আকস্মিক এই পরিবর্তনের কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পায় না।
দিনে দিনে মতি শেখের পরিবর্তনটা এমন বিপরীতধর্মী হয়ে পড়ে যে, এক গভীর রাতে সখিনা স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়-
তোমার সমস্যাটা কি? এত রাতে কোথা থেকে আসলা?
আমার আবার সমস্যা কি, ভাত দাও, ঘুম পাইছে।
আজকের কামাইয়ের টাকা কোথায়?
মহাজনের ভাড়া দিয়ে কিছু বাঁচেনাই।
এটা কেমন কথা! কয়েকদিন যাবৎ শুনে আসছি মহাজনের জমা দিতে দিতে টাকা শেষ। মানুষ কি রিক্সায় চড়তে ভুলে গেছে? সবাই কি একটা করে গাড়ি কিনে ফেলেছে? রিক্সায় চড়ার দরকার হয় না।
এতো কথা বলিস ক্যান। ভাত দে হারামজাদী, নাহলে আমি গেলাম- বলেই উঠে দাঁড়াতে গেলেন। সখিনা স্বামীর কাঁধে হাত রেখে তাকে থামায়। ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে তর্ক করাটা বোকামি হবে ভেবে সখিনা চুপ করে যায়। আগে কিছু খেয়ে নিক, তারপর ঠাণ্ডা মাথায় স্বামীর সাথে আলোচনা করা যাবে।
কেরোসিনের চুলায় দ্রুত একটা ডিম ভেজে, ডাল গরম করে স্বামীর সামনে ভাত সাজিয়ে দেয়। সখিনা লক্ষ্য করে, মতি শেখ স্বাভাবিকের চেয়ে অতি দ্রুত আর বড় বড় মুঠ করে খাবার খাচ্ছে। একবারও সখিনার দিকে ফিরেও তাকায় না। একবার জিজ্ঞেস করল না, সখিনা খেয়েছে কি না।
ভাত আর আছে?
হু, আছে- বলেই ভাতের গামলাটা মতি শেখের দিকে ঠেলে দেয় সখিনা। গামলা থেকে সব ভাত নিজের প্লেটে নিয়ে আবারো গোগ্রাসে খেতে লাগল- যেন মতি শেখের পেটের ভিতর কোন ক্ষুধার্ত রাক্ষস বসে আছে। ভাতের শেষ দানাটা শেষ করে হাত ধুয়ে পানি খায়। একটা সিগারেট জ্বেলে ঘরের ভিতর বসেই টানতে থাকে। সিগারেটে টান দেবার সময় মাঝে মাঝে পট পট আওয়াজ হয়। কটু গন্ধে ছোট ঘরটা ছেয়ে যায়। গন্ধটা যেন কেমন! ছোট বাদল ঘুমের মধ্যেই দুইবার কেশে ওঠে। সখিনা বলে,
আপনাকে না বলেছি ঘরের ভিতর সিগারেট খাবেন না। আর এটা কি সিগারেট, এত গন্ধ কেন?
চুপ মাগী, আরেকটা কথা বলবি তো ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দেব। আমার টাকায় আমি কি খাই, না খাই তার কৈফিয়ত কি তোকে দিকে হবে? বলেই কঠিন চোখে সখিনার দিকে তাকান। সখিনা বেগম ভয় পেয়ে যায়- ও দুটো যেন চোখ নয়, সেখানে রক্ত জমে আছে- লাল টকটকে রক্ত। আর কথা না বাড়িয়ে ভাতের গামলা, প্লেটগুলি ছোট উঠানের পাশের কলপাড়ে নিয়ে ধূতে চলে গেলেন।
ধোঁয়া মোছার কাজ শেষে ফিরে এসে দেখেন মতি শেখ বাদলের পাশে হাত, পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। হালকা নাক ডাকার শব্দে নিশ্চিত হলেন, মতি শেখ এখন গভীর ঘুমে। সখিনা স্বামীকে আর ডাকল না। ঘুমের ঘোরে ছেলের উপর পা তুলে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে ভেবে চৌকির পাশে নীচের খালি জায়গাটায় পাটি বিছিয়ে খোকনকে তুলে এনে ঘুমুতে গেলেন। শুরু হল ভয়ংকর, দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, ক্ষুধার্ত রাত। সখিনা বেগম চিৎকার করে কাঁদতে চায়। কিন্তু কান্নাটা গলার বেয়ে মুখ দিয়ে বের হয় না। কিসে যেন আটকে যায়! শুধু দু’চোখ বেয়ে অবিরাম পানি ঝরতে থাকে- এই কান্নার হয়ত শেষ নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে, কান্নার যাত্রা শুরু হল মাত্র।
এই শুনছ, তাড়াতাড়ি ওঠ। এতবেলা পর্যন্ত ঘুমালে রিক্সা নিয়ে বের হবে কিভাবে?
হুম, বলেই মতি শেখ ঘুরে পাশ ফিরে ঘুমালেন।
বেশ কয়েকবার ডাকাডাকিতে কাজ না হওয়াতে সখিনা ছোট ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা অভিমানের পাহাড় মনের ভিতর কিভাবে যেন গড়ে উঠেছে। সেই পাহাড় সরিয়ে কিছুতেই সহজ হতে পারছেন না। তা নাহলে মতি শেখ এতক্ষণে রিক্সা নিয়ে দুএকটা খেপ দিয়ে দিত।
রাত প্রায় এগারটা। রকমত মিয়ার গ্যারেজে আট-দশ জনের বিরাট জটলা। সেই জটলার একটা অংশ হয়ে আধো অন্ধকারে মতি শেখের জ্বলন্ত সিগারেটের গমগমা আগুনটা দীর্ঘ সময় ঠোঁটে ঝুলে থেকে আবার নীচের দিকে নামছে। আরেকটা জটলায় চলছে তাসখেলা। সিগারেট শেষ করে মতি শেখ সেই তাসখেলার আসরে যোগ দেয়। চোখগুলি টকটকে লাল। মহাজনের জমা শেষে লুঙ্গির ভাঁজে রেখে দেয়া অবশিষ্ট টাকা নিয়ে বসে পড়ে জুয়ার মচ্ছবে। এ এক জগত! এ জগতে সখিনা, বকুল আর বাদলের কোন অস্তিত্ব নেই। মতি মিয়া বেটে দেয়া তাসগুলির দিকে তাকিয়ে হিসেব কষতে থাকে আজকে জেতা যাবে তো। আজকের কামাইটা বেশ ভালই ছিল। শালার বলদ টাইপের প্যাসেঞ্জারদের একটু মোচড় দিয়ে কিভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা যায়, সেটা আজ ব্যবহার করেছে। এতে একটু আধটু ঝামেলা হলেও জমা দেবার সময় টাকার সংখ্যাটা দেখে ভালই লাগে।
তাস খেলা শেষে আজ অনেকদিন পর বিশেষ আসর বসবে। তরল পানীয়ের আসর। আগামী পরশু সুলতান মিয়ার ছেলের বিয়ে। উপলক্ষটা ইয়ার দোস্তদের সাথে উদযাপনের একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে তরল, কড়া মদ। দুএকজনের ফিসফিস করে বলা কথাগুলি থেকে যা বুঝা গেল, আজ মতি মিয়াকেও খেতেই হবে। বহুদিন পর আজ বেটাকে ভাবের মধ্যে পাওয়া গেছে। হলে আজ, না হয় আর কোনদিন না।
রাত একটা বাজে। শার্টের পকেটে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ঘরের দিকে হাঁটা ধরল। মনে মনে একটা হিসাব কষছে- বাসায় হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগে। পাঁচ মিনিট না পঞ্চান্ন মিনিট? পাঁচ+পাঁচ= পঞ্চান্ন। হি হি হি। দারুন! পাঁচের প্যাঁচ ছুটে গেছে। শরীরটা এতো হালকা লাগছে- একটা লাফ দিয়ে সেই দশ তলা দালানের ছাদে উঠে পড়া যাবে। রাস্তার একেবারে মাঝপথ দিয়ে হাঁটা শুরু করে মতি মিয়া। ‘আমি এই রাস্তার রাজা, উহু, আমি এক পাহারাদার ......’ চিৎকার করে বেসুরায় গান গাইতে গাইতে টলমল পায়ে বাড়ির দিশা খুঁজতে থাকে। ট্রাকের ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি আর বেশী সাইডে নিতে পারলনা। মতি মিয়ার মাথায় একটা মৃদু টোকা দিয়ে ছুটে পালানোর জন্য ট্রাকের ড্রাইভার এক্সিলেটরে চাপ বাড়ায়।
এক্সিডেন্টের পর আজ তিনমাস। এই তিনমাসে পরিবারটির আয়-রোজগার একেবারেই বন্ধ। জমানো টাকা আর নিজের গায়ের গয়না যা ছিল সেগুলি বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা আর সংসারের ভারী ঘানিটা বয়ে চলেছে সখিনা। হাত যতই খালি হচ্ছে, দুশ্চিন্তার বোঝাটা ততই ভারী হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবকিছু ছেঁড়েছুঁড়ে কোন একদিকে চলে যায়। বিকট চিৎকার করে বিলাপ করতে মন চায়। ছোট, অবুঝ দুটি শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে পারে না। শক্ত জমিনের উপর জোর করে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখে। শক্ত পাথুরে জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। মাঝে মাঝে স্বামীর শুন্য দৃষ্টিতে কিছু একটা খোঁজে। কিছু না দিক অন্তত চোখের দৃষ্টিতে ওদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুক। একটু ভালবাসা- স্ত্রী, সন্তানদের প্রতি একটু মমতা ভেসে উঠুক চোখের দৃষ্টিতে। না, দৃষ্টিটা ওদের দিকে পড়ে না। কোন দূরে তাকিয়ে থাকে- অন্য কোন জগতের দিকে। ডাক্তার একেক সময় একেক কথা বলে। সখিনা ভরসা পেতে চায়, কিন্তু মনের ভিতর কে যেন বলতে থাকে- তোকে নামতে হবে। দুনিয়ার এই জটিলতার মোকাবেলা তোকে একাই করতে হবে। হাঁ, একেবারে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে।
বাড়িওয়ালার কর্কশ কণ্ঠে বাস্তবে ফিরে আসে সখিনা- কি গো বকুলের মা, তিনমাসের ভাড়া বাকি রাখলে আমার সংসার চলব কেমনে?
চাচা, আপনি তো সবই জানেন। আগামী মাসের মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। ডাক্তার বলেছে বকুলের বাবা আবার সুস্থ্য হয়ে উঠবে।
মাগো, এই ভাড়া দিয়ে আমার সংসার চলে। ভাড়াটা ঠিকঠাক মতো দিতে না পারলে ঘর ছেড়ে দাও। অন্যজনের কাছে ভাড়া দিয়ে দেই। এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। ভাড়াটা ঠিকমতো দিয়ে দিও। নাহলে, আমি পাষাণের মতো আচরণ করতে বাধ্য হব।
চাচা, আপনে আমার বাবার মতো। আর কয়টা দিন সবুর করেন। দয়া করেন চাচা।
মা’রে দয়া কইরা পেট চলে না। আমার ভাড়া আগামী মাসের মধ্যে না দিলে ঘর ছেড়ে দিবা। এইটাই আমার শেষ কথা।
বাড়িওয়ালা চলে যাবার পর ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে সখিনা। বহু চেষ্টা করে লুটিয়ে বিলাপ করতে। কিন্তু চোখ দিয়ে একফোঁটা পানিও বের হয় না।
আকাশে মেঘ জমেছে। বিকট শব্দে কাছে কোথাও বাজ পরল। বাদল উঠে বসে কান্না জুড়ে দেয়। ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। একটু পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির সাথে সাথে সখিনা বেগমের চিন্তাও বাড়তে থাকে। মেয়েটা গেল কোথায়? বকুলের বাপও ঘরে নেই। এই ঝড় বৃষ্টির সময় ওরা সব কোথায় গেল। একবার মনে হল বের হয়ে ওদের খুঁজতে। এতটুকুন বাচ্চাকে একা ঘরে রেখে যেতেও ভরসা পাচ্ছে না। বাদল নিশ্চিন্ত মনে মায়ের কোলে শুয়ে আছে। পাশের ঘরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সখিনা ডাকে, ও বুবু, ও জমিলা বুবু?
কি হইছেরে সখিনা?
বুবু আমার ঘরে একটু আসবা?
আমি আসতাছি। কোন সমস্যা হইছে।
না বুবু, তুমি একটু তাড়াতাড়ি আস।
কয়েক ফুট ব্যবধানের ঘরের দরজা বদল করতে গিয়ে জমিলা ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। ঘরে ঢুকতেই ছেলেকে চৌকিতে শুইয়ে সখিনা ভেজা কণ্ঠে বলল, বুবু বাদলকে একটু দেখে রেখ। আমি বকুল আর ওর বাবাকে খুঁজতে বেরুলাম। আল্লাহ্ জানেন, ওরা এখন কোথায় আছে, কি করছে- বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সখিনা।
সখিনা মোটামুটি আন্দাজ করে রওনা দেয়। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে প্রায় দৌড়ে চলল সে। বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য আশেপাশের দোকানের সামনে ভিড় করা মানুষগুলি অবাক হয়ে দেখছে- একজন তরুণী প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের উল্টোদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে কোন তরুণীর দৌড়ে যাবার দৃশ্য খুব একটা স্বস্তিকর দৃশ্য নয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ভেজা শরীর নয়, বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আসা অসহায় একটা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলি ভাবছে- এটা কি হচ্ছে! মেয়েটা রাস্তার অদূরে ডাস্টবিনের দিকে যাচ্ছে কেন?
ডাস্টবিনের আড়ালে থাকা মতি শেখ আর বকুলকে দেখতে পায় সখিনা। মা’কে দেখে বকুল পিছন ফিরে তাকায়। টকটকে লাল চোখ, কেমন যেন নেতিয়ে পড়া একটা ভাব। মনে হয় বাতাসের একটা ঝাঁপটায় দূরে উড়ে যাবে পলকা দেহটা। মতি মিয়া হো হো করে হেসেই যাচ্ছে। বকুল দুহাতে বাবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে উঠাতে চেষ্টা করছে- তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধু একটা শব্দই বারবার শোনা যাচ্ছে, বাবা, বাবা ............। সখিনা এসে স্বামীর হাত ধরে একটা ছোট টান দেয়। মতি শেখ আরও জোরে হেসে উঠে সখিনাকে টেনে পাশে বসিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ এভাবে থেকে সখিনা বেশ জোরের সাথে স্বামীকে টেনে তোলে। স্বামীর ডানহাতটি নিজের কাঁধের উপর ফেলে বেশ শক্ত করে কোমর পেঁচিয়ে ধরে। বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ে। রাস্তায় এখন প্রায় হাঁটু সমান পানি। ছোট বকুল মায়ের ডানপাশে ওর ডান হাতটি ধরতেই সখিনা চমকে উঠে। এই ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির মধ্যেও মেয়েটির হাত যেন পুড়ে যাচ্ছে। এবার একটু ভালো করে মেয়ের দিকে নজর দেয় সখিনা। কেমন যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে ওদের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। ওর গন্তব্য যেন সেই কোন কালের ভালবাসায় পূর্ণ ঘরটি নয়। অন্য এক জগতের দিকে রওনা দিয়েছে মেয়েটা। রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় বকুল। মেয়েটিকে এক হাতে তুলে কাঁধের উপর ফেলে রওনা দেয় সখিনা। দুটিমাত্র মানুষ নয় দুইটি অস্তিত্বকে টিকাতে ধীরে ধীরে পানি ভেঙ্গে এগিয়ে চলে সখিনা। মেয়েটা একেবারে নির্জীব হয়ে আছে। এর মধ্যে শুধু একবার ‘মা’ বলে ডেকেছে।
আবার প্রচণ্ড জোরে কোথাও বাজ পরল। বাজ পরার বিকট শব্দ আর মতি শেখের অট্টহাসিতে জেগে উঠে ঘোরের মধ্যে থাকা সখিনা। এইতো, আর কিছুক্ষণ পরেই ঘরে পৌঁছে যাবে, যেখানে জমিলার কাছে তুহিন শেখকে রেখে এসেছে- হ্যাঁ, তুহিন শেখের মতোই টিকে থাকার লড়াইয়ে অপরাজিত একজন। চারজন আবার একসাথে থাকার প্রাণপণ ইচ্ছেটা ওকে অসুরিক শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে সখিনাকে। কখন পথের শেষ হবে! পথের শেষে কি, ওরা কেউ জানে না।
(অসমাপ্ত)
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২২
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: অনির্দিষ্ট