![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনিশ্চিত
(হুমায়ুন কবির)
এলোমেলোভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকা অতি পরিচিত মানুষটাকে দেখেই মতিন মিয়া চায়ের দোকানের বেঞ্চের উপর অর্ধেক খাওয়া কাপটা রেখে ডাকতে লাগলেন,
ও মাষ্টার, এমন দৌড়াইয়া যাও কই? সমস্যাটা কি?
আনিস মাষ্টারের কানে শব্দগুলি পৌঁছালো কি না কে জানে। কোন উত্তর না দিয়ে আগের মতোই খুব দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। সবকিছু অসহ্য লাগছে। এই যে মতিন মিয়ার উদ্বিঘ্ন কণ্ঠের প্রশ্ন, সেটাও অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে ডাঁসা দিয়ে মতিন মিয়ার মাথায় ঠাশ করে একটা বাড়ি দিলে হয়। মাথা ফেটে ভলকে ভলকে রক্ত পড়ত, আর চারিদিকের মানুষেরা হায়হায় করতে থাকতো- এইটা কি হইল, হ্যাঁ, এইটা কি হইল। দৃশ্যটা কল্পনা করে আপন মনেই কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন- এইটা হইলো একটা রক্তারক্তি কাণ্ড, অ্যাটেম্পট টু মার্ডার। অনেক বড় অপরাধ। ইচ্ছা করলে এখন আপনারা আমাকে গণধোলাই দিতে পারেন। গণধোলাইয়ের কেইস খুব দুর্বল হয়।
উত্তর না পেয়ে মতিন মিয়া গলাটা আরেকটু চড়াল-
ও মাষ্টার, তোমার হইছেটা কি? জবাব দেওনা ক্যান?
ঝাঁঝালো কণ্ঠটাও আনিস মাস্টারের চলার গতিটাকে শ্লথ করতে ব্যর্থ হলো। মতিন মিয়া অতি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বল্পভাষী, নিরহংকার ভালমানুষটির দিকে। এমন অভদ্রের মতো এড়িয়ে যাওয়াটা তার স্বভাবগত আচরণের সাথে মিলে না। ডেকে জবাব পায়নি এমন অপবাদ এই অঞ্চলের কেউ দিতে পারবে না আনিস মাষ্টারকে। এই যুগে এমন মানুষ পাওয়াটা মুশকিল, খুবই মুশকিল। কত বড় বংশের পোলা। অথচ একটুও দেমাগ নাই। অথচ চারিদিকে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কি এক ভীষণ প্রতিযোগিতায় সবাই যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্ধী হয়ে গেছে। যখন নিজের উন্নতি বা সাফল্য সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে যায়, তখন মানুষ তার স্বভাবজাত প্রীতির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। সবাই একেকজন ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়। আশেপাশে কেউ না থাকলে বাতাসেই অদৃশ্য তলোয়ার চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কি যুগ পরেছে! আনিস মাস্টারের এমন অস্বাভাবিক আচরণে মতিন মিয়া এমনই ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মানুষটার সমস্যা কি? অবশ্যই জটিল কিছু। চিন্তিত মনে অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দেয় মতিন মিয়া।
দিনটা অগ্রহায়নের মাঝামাঝি সময়। দু’বছর আগের যে অগ্রহায়ন আর আজকের অগ্রহায়নের মধ্যে কেমন যেন অমিলের ছড়াছড়ি। তখনকার সময়টাতে শীত তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চারিদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আপ্রান চেষ্টা করে যেত। আর এখন কেমন যেন এক অকারন আলস্যে মৃদু পায়ে এই আসে এই যায় অবস্থা। সন্ধ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম দিকটা কেমন যেন লালচে হয়ে আছে। লালচে আভার সাথে হলুদের মিশেল- এক অদ্ভুত রকমের রংয়ের ছোঁয়া, সময়টাও অদ্ভুত। আনিস মাষ্টার উঁচু রাস্তা থেকে ঢালু হয়ে যাওয়া পথে নামলেন। আর মিনিট দশেক হাঁটলেই বাড়িতে পৌঁছাবার কথা। তিনি যেভাবে প্রায় দৌড়ে চলছেন তাতে মনে হয় মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাবেন। এসব চিন্তা ছাপিয়ে আজকের ঘটনাটাট মৌমাছির মতো সারাক্ষণ এখানে ওখানে হুল ফুটিয়ে যাচ্ছে। ভয়ানক অপমানের জ্বালাটা বয়ে চলা এই সময়টা এতোটা কঠিন হবে নিজেও ভেবে উঠতে পারেনি। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। ‘সকল সুখ-দুঃখ সহনীয় হয়ে উঠেছি’ এই ভাবনার জগতে এতদিন পর কুঠারাঘাত সত্যিই আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে।
একটু দম নেবার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। চারিদিকে গুমোট ভাব আর ভ্যাঁপসা গরমের আঁচটা এতক্ষণে টের পেতে শুরু করেছেন আনিস মাস্টার। হয়তো জোর কদমে হাঁটার কারনে। মিয়া বাড়ির সামনে আসতেই উল্টোদিক থেকে অনেকটা দূরে বেশ কিছু মানুষের দৌড়ঝাঁপের শব্ধ শুনতে পেলেন। ছেলে, বুড়ো, যুবক বয়সী মানুষগুলির সাথে আট-দশ বছর বয়সী বাচ্চারাও আসছে। যুবক আর তরুণদের কারো হাতে ডাঁশা জাতীয় কাঠের টুকরা, কারো হাতে রড, কেউ কেউ আবার মাছমারার টেঁটা নিয়ে এসেছে। একজনকে বড় একটা শাবল নিয়ে তেড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। সবার চোখেই প্রতিহিংসার আগুন। শান্ত, কিন্তু ভয়ানক এক হিংসার ঝড় সবার আচার আচরণে। চিৎকার, চেচামেচি না থাকলেও তাদের অন্তরের ভাষাগুলি বুঝে নিতে খুব কষ্ট হয় না। নিশ্চিত কোন অঘটন প্রত্যক্ষ করার অনিচ্ছাকৃত উদ্বেগ আনিস মাস্টারের চিন্তা বা দুঃখের সূতাটা কে যেন একটানে ছিঁড়ে ফেলে। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলি নিঃশব্দ জপের মালার মত অশুভ চিন্তার ভেতর দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে।
তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার পাশ দিয়ে চলা মেঠো পথটার উল্টাদিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা। বড় বাড়ির হোসেন মিয়ার দোতলা দালানের কাজ চলছে। দ্বিতীয় তলার ছাদের জন্য ইট ভাঙ্গা সিপটিন একজায়গায় স্তুপ করে রাখা। স্তুপের ক্ষুদ্র পরিসরের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে আশ্রয়ে আবাস গড়েছে একটা মা কুকুর আর ওর চারটা বাচ্চা। কুকুরটা শুয়ে আছে আর বাচ্চাগুলির মধ্যে দু’টি মায়ের দুধ খাওয়ায় ব্যস্ত। অন্য দু’টি একটা আরেকটার উপর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অনাবিল আনন্দের প্রশান্তিকে নিজেদের করে নেয়ায় ব্যস্ত। কুকুরটা কান খাঁড়া করে আছে। দৌড়ঝাঁপের মাঝে উন্মত্ততার নিঃশব্দ গর্জনটা এতক্ষনে টের পেল বুঝি। বিরাট এক সর্বনাশের অভিসন্ধির সাথে যুক্ত প্রচণ্ড হিংস্রতার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য গর্ভের সন্তানদের একপাশে আলগোছে সরিয়ে দূরে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। পরিশ্রান্ত ও মলিন একটা ভাব যেন সারা শরীরে ছড়িয়ে পরেছে। ওর সমস্ত স্বত্বা যেন এক অসহায়তার মধ্যে ডুবে আছে। কিন্তু চারিদিকে সাবধানে তাকিয়ে দেখার শক্তিটুকু এখনও অটুট, অচঞ্চল, ছটফটে। দুধ পানরত কুকুর ছানাগুলি মনে হচ্ছে একটু বিরক্ত। সরিয়ে দেয়াতে কুই কুই শব্দে মায়ের প্রতি অভিমানটা প্রকাশ করেই যাচ্ছে। এতখানি দূর থেকেও খুঁটিনাটি সবকিছুই স্পষ্ট দেখতে পেলেন আনিস মাস্টার।
দলটা কুকুরের অস্থায়ী আবাসের একেবারে কাছে এসে পড়েছে। ইটের ছোট একটা টুকরার আঘাতে কুকুরটা আচমকা দৌড় দিল। প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে একেবারে দোতালার ছাদে উঠে যায়। পেছনে বয়স্কদের তাড়া। ক্ষিপ্রতার তেজ তাদেরই বা কম কিসে। তারাও দোতালার ছাদে উঠে। কেঁউউউ আওয়াজটা শুনে বুঝা গেল শক্ত কিছু দিয়ে দলের কেউ একজন কুকুরটাকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। নিচে থাকা কুকুর ছানাগুলির উপর অল্প বয়সী শিশুরা একটু দূর থেকে বৃষ্টির মতো ঢিল ছুড়তে থাকে। প্রতিবাদহীন, প্রতিরোধ অক্ষম কুকুর ছানা চারটি নিঃশব্দ থেকেই আস্তে আস্তে নেতিয়ে পরতে থাকে। ছটফট করার মতো সামর্থ্যটুকুও ওদের নেই।
কুকুরটার পিছনের পা দু’টি মনে হয় ছাদের কিনারায় রাখা জঞ্জালের সাথে আটকে গেছে। নীচে থাকা বাচ্চাগুলির করুণ পরিণতি দেখে অমোঘ কিছু একটার তাড়া খেয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পরার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। শরীরের উপর স্বশব্দে ভারী সস্রের আঘাতের যন্ত্রণা অনুভবের চেয়ে নীচে থাকা আত্মজের করুণ পরিণতিতে শেষ বার লাফানোর চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার ফলটাও শুন্য। দলের একজন লুব্ধ শ্বাপদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কুকুরটির উপর। নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। কুকুরটির তীব্র, তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত চিৎকারগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটা যেন একটা পশুর সামান্য চিৎকার নয়- চেনাজানা জগতের বাইরে থেকে আসা বিস্ময়ভরা করুণ ও তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ। মর্ম ভেদ করা অনিঃশেষ আবেগের ঝড় মিশে আছে এতে। প্রকৃতিও যেন করুণ আকূতির মর্মস্পর্শী অক্ষম বেদনায় জেগে উঠে। প্রচণ্ড এক বাতাসের ঝাঁপটায় গাছের শাখাগুলি নড়ে উঠে, জীর্ণ পাতাগুলি এক ঝটকায় ভূমিশয্যা নেয়। পাখিরা হঠাৎ করেই ডানা ঝাঁপটাতে থাকে। অদ্ভুতরকমের একটা গম্ভীর শব্ধের করুণ শিহরন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। আরেকদিকে একদল অমানুষ বীভৎস হাস্যের উচ্চকিত উল্লাসে ফেটে পড়তে থাকে।
আনিস মাষ্টার কেঁপে উঠেন। প্রবাহিত ঘটনার বয়ে যাওয়া শেষ মুহূর্তগুলি ভাবতে লাগলেন- দ্বিতীয়বার চিৎকার করার সময় মা কুকুরটা তার দিকে তাকিয়েছিল কি? হয়তোবা, কেমন অপার্থিব সেই চাওয়া- কষ্টের আর শোকের, আশ্রয় আর রক্ষার আবেদন, অক্ষমতার অসহ্য জ্বালাময়ী সে দৃষ্টি। কুকুর আর ওর বাচ্চাগুলিকে দড়িতে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দলটা। দূরের জংলার পাশের ডোবায় ফেলে দেয়া হবে নিষ্প্রাণ দেহগুলিকে। আনিস মাষ্টার সেদিকে তাকালেন না। এতোটা বয়স পার হলো, তবুও এমন বীভৎসতা, হীনতা সহ্য করার মতো হয়ে উঠতে পারেননি আজও। অসহ্য কষ্টে চোখ দুটি জ্বালা করে উঠে আনিস মাষ্টারের।
পায়ে সুড়সুড়ি লাগতেই আনিস মাষ্টার সম্বিৎ ফিরে পান। নিচের দিকে তাকিয়ে কুকুরের বাচ্চাটাকে দেখতে পেলেন। পায়ে মুখ লাগিয়ে কি যেন খুঁজছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ওর সর্বনাশের কথাটা বুঝে উঠতে পারেনি হয়তো। নির্মমতা বুঝার জন্যও বয়সী হতে হয়! আনিস মাষ্টার পরম মমতায় কুকুরের বাচ্চাটিকে কোলে তুলে দুহাত দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি চান না খুনে দলটার কেউ বাচ্চাটিকে দেখে ফেলুক।
কখন, কিভাবে যে বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছালেন নিজেও জানেন না। জাহানারা বেগম উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। আজ বাড়ির কাজ করতে করতে উঠোন ঝাড়ু দেবার কথা মনেই ছিল না। প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা অতি পরিচিত মানুষটির উপস্থিতি টের পেয়ে হাতের ঝাড়ু ফেলে দৌড়ে ছুটে এলেন। চেহারাটা স্পষ্ট করে ধরা পরছেনা, কিন্তু কোন এক অজানা কারনে মানুষটার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে বয়ে চলা ঝড়টাকে ঠিকই উপলব্দি করতে পারছেন। এ এক অন্যরকমের অনুভূতি। ভালবাসার মানুষের উপস্থিতিই জানান দিয়ে যায় তার মনের অবস্থা।
কি গো, তোমার কি হয়েছে, এমন লাগছে কেন তোমাকে? তোমার কোলে এটা কি? পাঞ্জাবী দিয়ে কি ঢেকে রেখেছো?
আনিস মাষ্টার কোন জবাব দিলেন না। কোল থেকে কুকুরের বাচ্চাটিকে জাহানারা বেগমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জড়ানো, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন- বাচ্চাটির দিকে খেয়াল রেখো। খুব ক্লান্তি লাগছে। আমি একটু ঘুমাব।
পানি দেই। গোসলটা করে নাও, ভাল লাগবে।
আনিস মাষ্টার চুপ করে আছেন। তিনি বুঝতে পারছেন গোসল করাতে তার স্বামীর আপত্তি নেই। জাহানারা বেগম রানুর বাবার প্রতিটি আচরণ খুব ভালোভাবে ধরতে পারেন। আসলেই কি পারেন, জাহানারা বেগম নিশ্চিন্ত হতে পারেন না।
তিনি রানুকে ডাকলেন- রানু মা, তোর বাবার লুঙ্গি আর গামছাটা এনে দে তো। আর চাপকল থেকে তাড়াতাড়ি এক বালতি পানি তুলে দে।
মায়ের মধুর ডাকে রানুর মন গলে না- মা, আমি এখন পড়তে বসেছি। সামনে পরীক্ষা। আমি পড়া থেকে উঠতে পারবোনা।
সামনে পরীক্ষা, কথাটা সত্য। কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কল চেপে কাজ করে সময় নষ্ট না করার মতো ব্যস্ততা অবশ্যই নেই। তাছাড়া ছাত্রী হিসাবেও এমন আহামরি কেউ না যে, ফার্স্ট, সেকেন্ড হবার জন্য সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে নাকের সামনে বই নিয়ে বসে থাকতে হবে। সারাক্ষণই যে বই নিয়ে পড়ে থাকে তাও তো নয়। পায়ে আলতা, হাতে মেহেদি, মাথার চুলের নানা কায়দাকানুন এসব করে করেইতো দিন পার করে দেয়। মাকে টুকটাক সাহায্য করলে কি এমন ক্ষতি হয়। জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন- এই মেয়েকে নিয়ে ঝামেলা হবে, বড় ধরনের ঝামেলা।
গরু দুটিকে এখনো খাবার দেয়া হয়নি। খাবার চাড়িতে খৈল, ভুষি মেশানো আছে। খৈলটা নরম হলে নেড়ে পানির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এতক্ষণে হয়তো খৈলগুলি নরম হয়ে গেছে। জাহানারা বেগম কিছু ঘাস গরু দুটির সামনে রাখলেন, যাতে গরুগুলি খিদেয় খুব বেশি কষ্ট না করে। এর মধ্যে একটা আবার গাভীন। আর মাস দুয়েকের মধ্যেই বাচ্চা দেবে। এসময় খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম ঠিক না। খৈল, ভুষি গুলে ওদেরকে পরে খাওয়ালেও হবে। ঘাসগুলি খেলে কিছু সময়ের জন্য হলেও গরুগুলিকে খিদেয় কষ্ট করতে হবে না। গোয়ালে মশার কয়েল জ্বালানো, রাতের খাবার রান্না করা- শতেক ঝামেলা। রানুর বাবার গোসলটা শেষ হলে এসব কাজ সারতে হবে।
রানুর বাবা হাঁটু মুড়ে কলপাড়ে বসে আছেন। বসার ভঙ্গিটা কেমন যেন; সব হারিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টিতে অসহায় মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমন। জাহানারা বেগম লুঙ্গি, গামছা কাপড় শুকানোর তারের উপর রেখে কল চাপতে লাগলেন। কল চাপার আওয়াজে আনিস মাষ্টারের ঘোর ভাঙ্গে।
তুমি কল চাপছো কেন? আমি নিজেই পানি উঠাতে পারবো, তুমি যাও। জাহানারা বেগম কথাটা মধ্যে এক ধরনের মায়ার আবেশ অনুভব করলেন। ও হ্যাঁ, কুকুরের বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দিয়েছ? বাচ্চাটা অনেকক্ষণ যাবৎ না খেয়ে আছে।
জাহানারা বেগম একটু বিব্রত হলেন। কাজের চাপে এতক্ষণ কুকুরের বাচ্চাটার কথাটা একেবারেই ভুলে গেছেন।
আনিস মাষ্টার বললেন, ওটাকে এক বাটি দুধ দিয়ে আস। আমি নিজেই পানি তুলে গোসল করে নেব।
জাহানারা বেগমের ইতস্তত ভাব দেখে আনিস মাষ্টার বলতে লাগলেন, তুমিতো জানোই, বাচ্চাটা অনেকক্ষণ যাবৎ না খেয়ে আছে। ওর উপর কতবড় একটা ধকল গেল। কিসের ধকল গেছে এটা জাহানারা বেগমের জানার কথা না; বিষয়টা আনিস মাষ্টার খেয়ালই করলেন না। কথাগুলি এমনভাবে বললেন যেন জাহানারা বেগম ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। জাহানারা বেগমকে সরিয়ে নিজেই ধীরলয়ে কল চাপতে লাগলেন।
জাহানারা বেগম ঘরে ঢুকে বালিশগুলি ঠিকঠাক করে দিলেন। বিছানার চাদরটা উঠিয়ে ভালমতো ঝেড়ে টানটান করে বিছিয়ে দিলেন। রানুর বাবা টানটান করা বিছানায় ঘুমাতে খুব পছন্দ করেন। শোবার সব আয়োজন শেষ করে বাইরে এসে দেখেন রানুর বাবা গামছায় মাথা মুছতে মুছতে ঘরের দিকে যাচ্ছেন। জাহানারা বেগম বললেন-
একটু চা বানিয়ে দেব? চা খেলে শরীরটা ভালো লাগবে।
না, এখন চা খাব না। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। চা খেলে ঘুমটা কেটে যাবে। আর শোন, আমি ঘুমিয়ে গেলে আমাকে ডেকো না।
রানুর বাবা এলোমেলো পায়ে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় কুকুরের বাচ্চাটার সাথে খেলতে থাকা খোকনের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। লোকটার কি হলো! কুকুরের বাচ্চাটার জন্য এত দরদ দেখালেন, অথচ ওটার দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। অদ্ভুত একটা মানুষ! জাহানারা বেগমের খুব ইচ্ছে হচ্ছে রানুর বাবার সাথে যেতে; মাথায় হাত বুলিয়ে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। কিন্তু হাতে এখনো অনেক কাজ বাকি। দিনে দিনে সংসারের বোঝাগুলি এতো ভারী হয়ে যাচ্ছে যে, ভালোবাসার এই প্রকাশগুলি ইদানিং অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রানু একটু সহযোগিতা করলে সংসারের কাজগুলি আরও সহজ হতো।
কলপাড়ে রেখে যাওয়া রানুর বাবার পাজামা, পাঞ্জাবী কেঁচে টানা তারে শুকাতে দিলেন। পানিটা ঝরলে ঘরে নিয়ে টানিয়ে দেবেন। গরুগুলি এখনো খায়নি। তিনি দ্রুত গোয়ালঘরে গিয়ে দেখেন গরুগুলি একটি ঘাসও মুখে তোলেনি। কেমন অভিমানভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি দ্রুত চাড়িতে দেয়া খৈল, ভুষি গুলাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন দেখলেন গরুগুলি চাড়িতে মুখ দিচ্ছেনা, তিনি বাচ্চাদের যেমনভাবে গলা, মাথায় হাত বুলিয়ে অভিমান ভাঙায় তেমনি করে ওদেরকেও আদর করে বলতে থাকেন-
এতো অভিমান করলে হয়? এমন অবস্থায় একটু দেরি দেখে একেবারে গাল ফুলিয়ে আছিস। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। গরু দুটি- লালি আর কালি একসাথে জাহানারা বেগমের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে চাড়িতে মুখ ডুবায়। জাহানারা বেগমের মনে হলো ওদের চোখগুলি কেমন ভেজা ভেজা। আচ্ছা, গরুর চোখ কি সবসময়ই ভেজা থাকে? আগামীকাল খুব ভালো করে খেয়াল করতে হবে।
গরুর খাওয়া শেষ হতে যেটুকু সময় লাগে এর মধ্যেই কুকুরের বাচ্চাটির জন্য দুধ গরম করতে হবে। এখন মাটির চুলা জ্বালাতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে দুধ গরম করতে করতে বারান্দায় হারিকেনের হালকা আলোতে জাহানারা বেগম লক্ষ্য করলেন কুকুরের বাচ্চাটিকে- কেমন নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে। খোকন খুব হালকাভাবে ওকে কোলে নেবার চেষ্টা করছে। ছোট প্রাণীটাকে কোন কায়দায় কোলে নিতে হয় সেটা জানা না থাকায় কয়েকবার চেষ্টার পর খোকন চুপচাপ ওটার সামনে বসে আছে। হালকা গরম দুধের বাটিটা নিয়ে রহিমা বেগম কুকুরের বাচ্চাটির কাছে যেতেই ওটা কোনমতে চার পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। দুধের গন্ধটাই হয়তো ওকে বাটির একেবারে কাছে নিয়ে যায়। একটু ইতস্তত করে কুঁইকুঁই করতে করতে দুধের বাটি থেকে চুকচুক করে দুধ খেতে থাকে। একবার মুখ তুলে জাহানারা বেগম আর খোকনের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়। কোন ভয় নেই এটা নিশ্চিত হয়ে বাটির সবগুলি দুধ শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মা, কুকুরটা কি বারান্দায় ঘুমাবে? ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাই? আমার যে জামাগুলি ছোট হয়ে গেছে ঐগুলি দিয়ে ওকে ঢেকে দেব?
এখনো রান্নাবান্না বাকি আছে। এসব আলোচনা করার মতো ধৈর্য নেই জাহানারা বেগমের। তিনি উত্তরে শুধু বললেন, তোর যা খুশি কর।
শোবার ঘরে গিয়ে দেখেন রানুর বাবা বাচ্চাদের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছেন। মুখের দিকে তাকিয়ে একটু চমকে উঠেন। গভীর ঘুমের তৃপ্তির বদলে কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। স্বপ্ন দেখছে নাকি। মাঝে মাঝেই মুখের পেশীগুলি কুঁচকে যাচ্ছে। পূর্ণ কোন বাক্য নয়, অস্পষ্ট কিছু শব্ধ কানে আসছে। এতো অস্পষ্ট যে মুখের কাছে ঝুঁকেও জাহানারা বেগম বুঝতে পারেন না। ক্ষীণস্বরে ‘মা’ বলে কাউকে ডাকলেন? নিশ্চিত হওয়া গেলো না। তিনি রানুর বাবার পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দিলেন।
আজ খোকনের ছুটির দিন। দুপুরের খাবার শেষে আনিস মাষ্টার বিছানায় শুয়ে আছেন। মুখে পান। অভ্যাসের না, মাঝে মাঝে শখ করে খাওয়া আর কি। আজ বাসায় ফেরার সময় দোকান থেকে দুটা পান নিয়ে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন জাহানারা বেগমকে একটা দেবেন, আরেকটা নিজে খাবেন। মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান। খেতে নাকি খুবই মজা। পানটা মজা কিনা বুঝা যাচ্ছে না। কারন জাহানারা বেগমকে পান সাধতে গিয়ে বেমক্কা কথাবার্তা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে আছে। মন খারাপ অবস্থায় কোন কিছুর স্বাদ স্পষ্ট বুঝা যায় না।
তুমি আবার পান ধরলে কবে?
পান খাওয়া ধরিনি তো, শখ করে কিনে আনলাম। দুজনে মিলে খাব।
দু’জন কে? তুমি একজন বুঝলাম, আরেকজনটা কে?
আনিস মাষ্টার হেসে ফেলেন। কেন তুমি- তুমি আর আমি।
কোন দুঃখে ছাগলের জিনিস খেতে যাব? আমি কি ছাগল? মুখে ঘাসপাতা নিয়ে ছাগলের মতো চিবোতে থাকা, অসহ্য। একবার খাবে, দুবার খাবে শেষে দেখা যাবে সারাদিনই ছাগলের মতো ঘাসপাতা চিবিয়ে যাচ্ছ। পাতার রস ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে তোমার জামাকাপড়ে অসাধারন সব চিত্রকর্ম তৈরি করে যাচ্ছে। সেই চিত্রকর্ম মুছতে আমাকে প্রাণপণে সাবান ঘষতে হবে, তারপর আছড়াতে থাকবো। কাপড় ফেটে যাবে, কিন্তু চিত্রকর্মের দাগগুলি রয়ে যাবে। এই শেষ আর কখনও যদি পান ফান খেতে দেখি তবে ...............।।
তবে কি?
জাহানারা বেগম চুপ করে থাকেন। ছোটবেলায় পান খেতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার ছায়াটা এখনও গাঢ় হয়ে মনে গেঁথে আছে। জাহানারা বেগমের দাদী কমলা বানু প্রচুর পান খেতেন। তিনি দেখতে অসাধারন সুন্দরী ছিলেন। পানের রসে ঠোঁটগুলি যখন লাল হয়ে ভিজে উঠতো, সেটাও দেখার মতো একটা বিষয় ছিল। পান খাওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য তাকে বেশ মানিয়ে যেত। যখন পান চিবুতেন, মনে হতো এ জগতে পান খাওয়ার মতো সুস্বাদ আর আনন্দের জিনিস দ্বিতীয়টি আর নেই। তার পান খাওয়ার আয়োজনটা ছিল ঝকমারি। বিশাল পানের বাটার ভিন্ন ভিন্ন খোপে কতরকমের জর্দা যে ছিল। দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজ হাতে পান বানিয়ে দীর্ঘক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর মাথাটা একটু উপরের দিকে উঠিয়ে দুই আঙ্গুলে পানটা চেপে ধরে হা করে মুখে পুরে দিতেন। কিছুক্ষণ চাবানোর পর চারিদিকে কেমন সুন্দর একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো। নয় কি দশ বছর বয়সী জাহানারা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে পান খাবার আয়োজন দেখতো। কিছুক্ষণ নীরবে একটানা পান চিবিয়ে প্রিয় নাতনীর সাথে গল্প করতেন। অর্থহীন মজার মজার গল্প। একদিন কমলা বানু নাতনীকে বললেন, কিরে সুন্দরী কইন্যা পান খাবি, ‘পান খাওনি, চুন খাওনি কবিরাজের বউ ...... হি হি হি’। নিষিদ্ধ আকর্ষণ এড়ানোটা দুরূহ। ঘাড়টা কাত করে সম্মতি জানিয়ে দিতেই কমলা বানুর পানের কাজ শুরু হয়ে যায়। কি একটা জর্দা দিতে গিয়ে ইতস্তত করলেন। সিদ্ধান্তে এলেন- কি আর হবে এতটুকু দিলে। পানটা নাতনীর হাতে তুলে দিয়ে বলতে গিয়ে আবার ছড়া কাটতে লাগলেন- ‘পান খাওনি, চুন খাওনি কবিরাজের বউ’। জাহানারা পানটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। দাদী ধমক দিলেন, পান নিয়ে বসে আছিস কেন? খাইলে খা, না খাইলে ফালাইয়া দে। এক্কেবারে বাড়ির বাইরে ফালাইয়া দিয়া আয়। দাদীর ধমকে পান মুখে দিয়ে চিবুতে লাগলো। পানটা মুখের ভিতর কেমন যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর থু করে মুখের ভিতরের সবটুকু পান ফেলে দেন। ক্রমাগত হেঁচকি দিতে থাকেন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একসময় চোখমুখ উল্টে বিছানায় এলিয়ে পড়েন জাহানারা। মাথায় পানি ঢালা, ডাক্তার সাহেবের উদ্ভিঘ্ন চোখ, দাদী আর বাড়ির সকলের ফ্যাকাসে করুণ মুখগুলি আবছা আবছা খেয়ালে আসে। দাদীর দিকে মিয়া ভাইয়ের অগ্নি দৃষ্টিটাও চোখ এড়ায় না। কিন্তু কোনকিছুই জাহানারাকে স্পর্শ করে যায় না। ঘোরের ভিতর এসব দেখতে দেখতে অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। টানা নয় ঘণ্টা বেহুঁশের মতো পড়ে ছিলেন।
রানুর বাবার কথায় সম্বিৎ ফিরে পান জাহানারা বেগম।
এই, কি ভাবছো। ভাবাভাবি বাদ দিয়ে একটু বসবে? সারাদিনতো এইটা সেইটা করেই কাটিয়ে দাও। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিলে ক্ষতি কি?
জাহানারা বেগম ভ্রু কুঁচকে, চোখে মুখে সূক্ষ্ম হাসি নিয়ে একদৃষ্টিতে রানুর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্বামীর মতলবটা বুঝতে চাচ্ছেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও যে মতলবটা বুঝতে চাইছেন- সেটার সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারায় মৃদু কষ্টের একটা ঝাপটা বুকে এসে লাগলো। মানুষটা তার কাছে এখনও সেই আগের মতোই রহস্যময় হয়ে আছে। এই রহস্যের কারনেই আজও ভালবাসার শক্ত বন্ধন এতোটুকু আলগা হওয়ার সুযোগ হয়নি। অভিমান আছে, কিন্তু অভিযোগের খোঁচাটা নেই। তারপরেও ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানার কোণা থেকে উঠে বসলেন। রানুর বাবা বললেন- চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ, অনেক কাজ বাকি আছে। থালাবাসন ধোয়া, লালি, কালির জন্য সন্ধ্যার খাবার দিতে হবে।
খোকন কি করছে? ওকে একটু আসতে বলো।
ও এখন কুকুর ছানার পাশে বসে আছে। নামকরণ নিয়ে ব্যস্ত। আসবে কিনা বলতে পারছি না। বলে দেখি, নবাবজাদা আসে কিনা।
বিছানায় উঠতে উঠতে খোকন বলল, বাবা, কুত্তার বাচ্চার নাম কি দিলে ভাল হয়?
তার আগে কুত্তার বাচ্চার বদলে কুকুরের বাচ্চা বল। আনিস মাষ্টার ভাবলেন, কথাটা বলার সময় কণ্ঠটা কঠিন হয়ে গেল নাকি?
সবাই তো কুত্তার বাচ্চাই বলে বাবা।
তুই তোর মত, সবার মত না। কুকুরের বাচ্চা একটা প্রানী। ওর প্রাণ আছে, আমাদের মত চিন্তা করার ক্ষমতাও আছে হয়ত। সব বাদ দে, ও এখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মত। কুত্তার বাচ্চা বলে ওকে নিচু করার কোন মানে নেই। বল, কোন মানে আছে?
না বাবা, কোন মানে নেই। এখন বল- ওর কি নাম দেয়া যায়।
তুই কি কি নাম ভেবেছিস আমাকে বল। আমি ওখান থেকে একটা বেছে দেই। তুইই নাম রাখ।
বাবা?
হুম, বল শুনছি।
বাঘা নামটা কেমন হয়? আগে অবশ্য টাইগার রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে মনে হল টাইগারও তো একটা প্রাণী। টাইগার টাইগারের মত, আর কুকুরের বাচ্চা কুকুরের মত। অবশ্য, বাঘা নামটা টাইগারের খুব কাছাকাছি। বাবা, এই নামটাই রাখি।
আচ্ছা খোকন, ওটার নাম ভোলা রাখলে কেমন হয়? ওর নিজের একটা নাম- একেবারে নিজের?
ঠিক আছে। আজ থেকে বাচ্চাটির নাম হল ভোলা। বাবা, সবাইকে বলে আসি নামটা?
না, এখন আমার সাথে ঘুমাবি।
খোকনের একটু মন খারাপের মত হল।
এই খোকন, এমন রামগরুরের ছানার মত হয়ে গেলি কেন? গান শুনবি?
বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে খোকন বাবার বুকে উপুড় হয়ে লুটিয়ে পড়ল। ওর জীবনে আনন্দের সময়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আনন্দের জিনিসটা হচ্ছে বাবার বুকের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে গান শোনা। তবে সেই শুনাটা অদ্ভুত। সে একি সাথে দুইভাবে গান শুনে। একটা কান বাবার বুকের উপর রাখে। বাবা যখন গান করেন তখন ভরাট গলার চমৎকার একটা কণ্ঠ শুনতে পায়, আর বাবার বুকের ভিতরেও সে গান বাজতে থাকে- আরও সুন্দর, আরও বেশি চমৎকার। বাবা যখন ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা ......’ গানটা শুরু করেন তখন দু’কান দিয়ে দুই যায়গা থেকে গান শুনে। একটু পর উপরের দিকের কানটা হাত দিয়ে চেপে ধরে। তখন শুধু বুকের ভিতর থেকে- না, মনে হয় দূর বহুদূর থেকে অসম্ভব গমগমে কণ্ঠে কে যেন গান গেয়ে যাচ্ছে। দুঃখের গান। শুনলেই কেমন মন খারাপ হয়ে যায়, তারপরেও শুনতে এত ভাল লাগে, এত ভাল লাগে!
খোকন কাত হয়ে বুকের উপর এক কান রাখার আগে আনিস মাষ্টার বললেন, কিরে পান খাবি?
হ্যাঁ বাবা, দাও পান দাও বলেই বাবার পেটের একটু উপর দুইপাশে দুই পা ছড়িয়ে বলে- পান দাও। চিবানো পানের অংশ মুখ থেকে বের করে খোকনের হাতে দেন আনিস মাষ্টার।
বাবার চিবানো পান চিবাতে চিবাতে খোকন বলে, বাবা, আজকের পানটা অনেক মিষ্টি। প্রতিদিন আমাকে এভাবে পান খাওয়াবে কিন্তু।
আনিস মাষ্টার মৃদু হাসেন। তিনি খোকনের পান চিবানো শেষ করার অপেক্ষায় আছেন। পান চিবানো শেষ হলেই খোকন একটা কান তার বুকের উপর দিয়ে শুয়ে পড়বে।
আনিস মাষ্টার ছোট চাচা সোহরাব মিয়ার বাড়িতে ঢুকলেন। বাড়ির আভিজাত্যের ঝলকটা এখনও অটুট। দোতলা বাড়িটি দেখে মনে হয় আজই রং করা হয়েছে। রং মিস্ত্রীরা কিছুক্ষণ আগে কাজ শেষ করে মজুরীর টাকা-পয়সা নিয়ে চলে গেছে। বসার ঘরটি বিশাল। জনা ত্রিশেক লোক অনায়াসে বসে আলাপ করতে পারবে। তিনি বাড়ির ভিতরের অংশে বাইরের কোন মেহমানকে আনেন না। এটা শুধুমাত্র একান্ত আত্মীয়-পরিজন যারা, তারাই বসতে পারে। বাইরের লোকদের জন্য বেশ খানিকটা দূরে আলাদা দুই কামরার আরেকটি দালান ঘর- একটি আকারে বিশাল বড়, আরেকটি তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট। বড় ঘরটি বিভিন্ন বৈঠকের সময় খোলা হয়। ব্যক্তিগত বিশেষ প্রয়োজনে ছোট ঘরটি প্রায় প্রতিদিনই ব্যবহার করা হয়। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলি ঘরের লোকজনকে দেখিয়ে বেড়ানোর কোন মানে নেই। তাই ভিতর বাড়িতে তিনি বিশেষ প্রয়োজনের কাজগুলি কখনোই করেন না। বাইরের ছোট ঘরে কি ঘটে না ঘটে সবাই বুঝে, কিন্তু চোখে দেখা আর বুঝে নেওয়ার আড়ালটা তিনি সবসময়ই ধরে রাখেন। এ দু’টির পার্থক্য সবার কাছে সরল মনে হলেও এর জটিল অংশের পূর্ণ ব্যবহারের ক্ষমতা বা যোগ্যতা তার আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এটা অবশ্যই ব্যতিক্রমী একটা যোগ্যতা।
আসসালামু আলাইকুম চাচা।
সোহরাব মিয়া মাথা নাড়লেন। সালামের জবাব দিলেন কিনা বুঝা গেলনা। ইশারায় আনিস মাস্টারকে সামনের চেয়ারটাতে বসতে বললেন। সামনাসামনি, চোখে চোখ রেখে কথা বলাতে সুবিধা হয়।
তা, তোর স্কুলের সমস্যাটা কি?
আনিস মাষ্টার কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। সমস্যাটার কথা যাকেই বলা হোক না কেন, সবাই বিষয়টাকে ছেলেমানুষি অভিমান বলে ভাববে। তাছাড়া পুরো ঘটনাটা চাচা জানবেন না বা এতক্ষণে জানতে পারেননি, এটা একেবারেই অসম্ভব একটা ঘটনা। ঘটনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিষয়টা আনিস মাষ্টারের আত্মমর্যাদায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে যাচ্ছে বারবার। জানা ঘটনা শুনানোর কোন মানে আছে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
সোহরাব মিয়া বললেন, আমি হেডমাস্টার সাহেবকে আসতে বলেছি। কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে মাফ টাফ চেয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু কর। এই বয়সে চাকরি চলে গেলে নতুন চাকরি পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে। তবে, কথায় আছে না- যত মুশকিল, তত আসান। তুই কোন চিন্তা করবি না। আমি তোর পাশে আছি। আর হেডমাস্টার আমার কথা ফেলতে পারবে না।
সোহরাব মিয়া স্কুলের বড় মাপের একজন দাতা সদস্য। তার ক্ষমতা হেডমাস্টারের খুব ভালো করেই জানা আছে। তিনি ডাকবেন আর হেডমাষ্টার সাহেব আসবেন না- এটা একেবারেই অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। তারপরেও কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে কোন একটা চালাকি আছে- হেডমাস্টার সাহেব আজ এখানে আসবেন না। ভাবতেই মনটা বিষিয়ে উঠছে।
চাচা, এটা বলার জন্যই আমাকে ডেকেছ? অনেক সময় হয়েছে, এবার আমি উঠি। হেডমাস্টার সাহেব মনে হয় আজ আসবেন না।
সোহরাব মিয়ার কণ্ঠ গমগম করে উঠলো- তুই কি মনে করে বললি হেডমাস্টার আসবে না। হেডমাস্টারের কাঁধে মাথা কয়টা? যদি না আসে, যতোটা মাথাই থাক না কেন সবগুলো মাথা কেটে আলাদা করে দেব।
সোহরাব সাহেবের স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে আনিস মাষ্টার নিজের ধারনা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। চাচা কোন ব্যাপারেই খুব বেশি উত্তেজনা প্রকাশ করেন না। উত্তেজনাটা নিজের মধ্যে চেপে রাখেন এবং সময় সুযোগ মতো নিজের মতো করে বিচার আদায় করে নেন- কঠিন এবং ভয়ংকর শাস্তি। হঠাৎ রেগে উঠায় নিশ্চিতভাবে বুঝা যায় স্কুলের পুরো ঘটনাটাই সাজানো এবং এতে চাচার বিশাল ভূমিকা আছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই মুহূর্তে বিস্ময় বা দুঃখবোধের কোনটাই আনিস মাষ্টারকে স্পর্শ করে না। শুধু অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
দোতলার একটি ঘর থেকে অমানুষিক একটা বন্য চিৎকার ভেসে আসছে। আর্তচিৎকারের ভয়াবহতায় আনিস মাষ্টারের গায়ের প্রতিটা অংশে ছড়িয়ে পড়ে। কেমন যেন অস্থির লাগতে থাকে।
চাচা, ঢাকায় নিয়ে আরেকবার ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না?
সোহরাব সাহেব আবারো চেঁচিয়ে ওঠেন- এতো ধৈর্য নেই আমার। বহুবার চিকিৎসার জন্য জলের মতো টাকা, সময় দু’টাই নষ্ট করেছি। বহুত হয়েছে, আর না। কয়েকদিন ঠিক থাকে তারপর আবার ঐসব ছাইপাঁশ গিলতে থাকে- সলিম, এই সলিম, ঐ শালা সলিমের বাচ্চা।
সলিম নামের শক্তসমর্থ একজন লোক লাঠি হাতে দৌড়ে সোহরাব সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতের লাঠিটা এমনভাবে ধরা মনে হয় এটা শরীরেরই একটা অংশ।
আচমকা সোফা থেকে উঠে সলিম নামের লোকটাকে টেনে একটা চড় মারেন সোহরাব সাহেব- শুয়োরের বাচ্চা, আসতে এতক্ষণ লাগে!
আনিস মাষ্টার এই পরিবেশেও সময়ের ছোটখাটো একটা হিসাব মিলিয়ে নেন। লোকটা প্রথম ডাকের ঠিক দশ সেকেন্ডের মাথায় হাজির হয়েছে। এতে কোন দোষ হবার কথা না। এখান থেকে ঘরের বাইরের দরজার দূরত্বটা অনেক।
জানোয়ারের বাচ্চাটারে পাঁচটা ট্যাবলেট দিয়ে আয়।
জ্বী মাদবর সাব, যাইতাছি।
জানালা দিয়ে দিবি। দরজা খুললে শুয়োরের বাচ্চাটা আবার বের হয়ে যাবে। শালার পুতের জন্য এলাকায় মুখ দেখান যায় না।
জ্বী আচ্ছা।
আনিস মাষ্টার মাথা নিচু করে বলেন- চাচা, আমি এবার যাই।
আরেকটু বসে যা। হেডমাস্টার অবশ্যই আসবে। না আসলে সলিমকে দিয়ে কান ধরে নিয়ে আসব। আচ্ছা তুই এমন করছিস কেন, দরকারটা কার বলত- আমার না তোর? আমার সামনে বসতে কি কোন সমস্যা হয়। এমন উসখুস করছিস কেন?
চাচা, আমার এসবের দরকার নেই। আমি ওখানে আর চাকরি করবো না।
চাকরি করবি না মানে! চাকরি না করলে কি করে খাবি? চুরি করবি?
চাচা, আমি চুরি করি না। আর না খেয়ে মরলেও চুরি করব না এটা তুমি ভাল করেই জানো। এসব বাদ দাও চাচা। যদি মনে কিছু না কর, অন্য বিষয়ে একটা কথা বলি?
বল, আবিদ তো এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। আমার ধারনা ও ভালভাবেই পাশ করবে। ওকে ভাল কোন কলেজে ভর্তি করে দিও। আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশে আবার না জয়নালের মত হয়ে যায়।
আবেদের কথা শুনে সোহরাব সাহেবের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খুব ভাল ছেলে, মেধাবী- অবশ্য বৈষয়িক বিষয়ে একটু ছাড়া ছাড়া ভাব। আশা করা যায় সময়ে এটা ঠিক হয়ে যাবে। এত বিশাল সহায়, সম্পত্তি- এগুলি তো ওকেই দেখেশুনে রাখতে হবে। জয়নালকে দিয়ে হবে না। ওর সময় আর সামর্থ্য দুটাই শেষ। পশুর মত যতদিন বাঁচে বাঁচুক। ওকে নিয়ে আর চিন্তা করার দরকার নেই। ও শেষ। ওর বউটি দীর্ঘদিন নীরবে স্বামীর অত্যাচার সয়ে সয়ে টিকতে না পেরে সেই যে গেল বছর বাপের বাড়ি গেছে আর ফেরার নাম নেই। আজ ঠিক এগার মাস তিন দিন পার হচ্ছে। তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু জয়নালের শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলেছে, সোহরাব সাহেব নিজে এসে নিয়ে না গেলে মেয়েকে পাঠাবে না। কুত্তার বাচ্চাগো সাহস কত্ত বড়। শর্ত দিয়ে মেয়ে পাঠাবে। আমার লোক যাওয়া মানে আমি যাওয়া। না, আমাকে স্বশরীরে যেতে হবে, শালা শুয়োরের বাচ্চারা।
চাচা, কিছু বললে?
না, কিছু বলি নাই।
আবেদ এবার ম্যাট্রিক পাস করলে ওকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দেব, কি বলিস?
চাচা, আমাকে যেহেতু বলেছ, তাই উত্তরটা হচ্ছে না,- এই বয়সেই এমন জিনিস পেলে আবার না জয়নালের মত বখে যায়। বারবার ভুল করার কোন অর্থ হয় না।
কি বললি, আমি ভুল করি, আমি! আবেদ কি তোর মত ফকিন্নির পুত নাকি? নাকি তোর হিংসা হয়? তোর বাবা তোকে মোটর সাইকেল কিনে দিতে পারেনি বলে কি আমি আমার ছেলেকে দেব না? এত হিংসা কেন?
চাচা, তুমি বিষয়টা এভাবে নিচ্ছ কেন? ও আমার ছোট ভাই। ওকে হিংসে করার কি আছে। ওর ভাল দেখে আমার ভাল লাগবে। ওর খারাপে আমার খারাপ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমিতো আগ বাড়িয়ে কিছু বলিনি। তুমি জিজ্ঞেস করাতে আমার মন্তব্য দিলাম। আরেকটা কথা, বাপ, মা তুলে গালি দেওয়াটা ঠিক হল না চাচা। ঝগড়াঝাঁটি যা ছিল, তা বাবা আর তোমার মধ্যে। বাবা মারা যাবার পর ওটা ধরে রেখে লাভ কি? আর ঝগড়ার পুরো ফায়দাটা তুমিই নিয়েছ, এবং তা খুব কঠিনভাবেই নিয়েছ।
কি বললি, ফকিন্নির পুত? আমাকে জ্ঞান দেয়! ঐ সলিম, এই শালার ফকিন্নির পুতেরে এক্ষুনি ঘাড় ধরে আমার বাড়ি থেকে বের করে দে।
চাচা ঘাড় ধরতে হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি। আর তোমার মুখে একটু লাগাম দাও। অন্তত বড় ছেলেকে দিয়ে একটু বিবেচনা করে দেখ। অহংকারের পরিণাম কিন্তু ভয়াবহ।
তবে রে ফকিন্নির পুত- বলেই তেড়ে আসতে লাগলেন আনিস মাষ্টারের দিকে। এই সময় আবেদ ঘরে ঢুঁকে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা আন্দাজ করে নেয়। সে বাবাকে পিছন দিক থেকে ঝাপটে ধরে। আনিস মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিতভাবে বলে ওঠে, দাদা, তুমি এখন যাও। দোতলার সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে চাচী শূন্য দৃষ্টিতে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই শূন্য দৃষ্টিতে জেদ, দুঃখবোধ, আনন্দ কোনটাই ধরা যায় না। শুধু মমতার ক্ষীণ একটা আভা চোখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
ঐ ফকিন্নির পুত কই যাস, দাঁড়া। আজ জুতিয়ে তোর গাল, চাপা ফাটিয়ে দেব। শালার পুত, আমারে জ্ঞান দেয়। সলিম মিয়াকে লাঠি হাতে এগিয়ে আসতে দেখে চাচী চিৎকার করে বলে উঠেন, সলিম, যেখানে আছিস সেখানেই থাক। এক পা আগে বাড়বি না। চিৎকারের তেজটা সহ্য করার মতো মানসিক দৃঢ়তা সলিমের নেই। তবে মুনিবের ইশারা অমান্য করার কঠিন শাস্তির কথাটা মাথায় বিঁধে আছে।
আনিস মাষ্টার মাথা নিচু করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তার চোখ, মুখ লজ্জা আর অপমানে লাল হয়ে আছে। বাড়ির পথ ছাড়িয়ে নদীর পাড়ের দিকে রওনা দিলেন। নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসলে মনটা যদি একটু শান্ত হয়। নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। নদীর পাড়ে হাত, পা ছড়িয়ে বসে আছেন আনিস মাষ্টার। অনেক স্মৃতিই এলোমেলো হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সোহরাব চাচার সাথে বাকবিতণ্ডার জের, নাকি অদ্ভুত অন্য কোন কারনে এমনটা হচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর কেমন ঠাণ্ডা আর অবশ হয়ে আসে। নদীর ওপারে দূরে গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই স্মৃতির পাতাগুলি একটা একটা করে উল্টে যান আনিস মাষ্টার-
কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছুটিতে বাড়ি এসেছে আনিস। পরশু সোহরাব সাহেবের মেয়ে শিউলির বিয়ে। সোহরাব সাহেব পুরো এলাকায় ধূমধাড়াক্কা কাণ্ড লাগিয়ে দিয়েছেন। সোহরাব মিয়ার মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সারা এলাকার মানুষ আনন্দ করবে, খাবে- কি বলিস আনিস। জ্বী চাচা, অবশ্যই।
ছেলেটা খুব ভাল বংশের, বুঝছিস। ওদের এলাকায় একচেটিয়া দাপট। ব্যবসাবাণিজ্য করে খায়। আসলে ব্যবসায়ী মানুষের তুলনা হয় না। দুই হাতে কামাবে, দুই হাতে খরচ করবে। এটাই তো জীবন- কি বলিস। তা, জয়নালের সাথে দেখা হয়েছে?
না, কাল রাতে বাড়ি এসেছি, এখনো দেখা হয়নি।
যা দেখা করে আয়। হারামজাদা মনে হয় এখনো ঘুমিয়ে আছে। শালার পুত হয়তো ভুলেই গেছে যে, আজকে ওর বোনের বিয়ে। কথাটা বলেই অকারনেই হা হা করে হাসতে থাকেন। আনিস একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। জয়নালের করুণ অবস্থার কথা বলতে বলতে এমন জোরে জোরে হাসার মানেটা তখুনি বুঝে উঠতে পারে না। পরক্ষনেই মনে হল, মেয়ের বিয়ে। এ কারনেই আনন্দ। এমন প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে অনেকদিন কাউকে হাসতে দেখেনি আনিস মাষ্টার। সোহরাব চাচার মনের মধ্যে বয়ে চলা আনন্দের বাঁধভাঙা স্রোতের আওয়াজটা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মেয়ের ভাল বিয়ে দিচ্ছেন আনন্দ তো হবেই।
কিরে জয়নাল, এতবেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিস কেন? এখন বাজে এগারটা।
জয়নাল বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসে। জড়ানো কণ্ঠে বলে, দাদা তুমি!
হ্যাঁ, কাল রাতে বাড়ি ফিরেছি। তোর অবস্থা এমন কেন? চোখ দুটি তো গর্তে ঢুঁকে গেছে, চেহারাও ভেঙ্গে পড়েছে।। সত্যি করে বলতো, কোন সমস্যা? কোন অসুখ বিসুখ হয়নি তো?
না, কিসের সমস্যা আবার? সব ঠিক আছে।
তা, চাচার আড়তে বসছিস, ব্যবসাপাতি কেমন হচ্ছে?
এইতো হচ্ছে আর কি?
এইতো হচ্ছে আবার কেমন কথা? ব্যবসাপাতি মন দিয়ে করিস। চাচা অনেক কষ্ট করে এসব ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয়সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। মন দিয়ে কাজ করিস। চাচার পর তোদের দুই ভাইকেই তো সব সামলাতে হবে, নাকি?
দাদা, সকাল সকাল এসব বক্তৃতা ভাল লাগে না। এসব কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কথার মধ্যে কেমন রুক্ষ একটা ভাব।
জয়নাল আনিসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কাজের বুয়াকে চা দেবার জন্য ডাকাডাকি শুরু করে দেয়- এমন কর্কশ সুরে ডাকাডাকির কারণটা যে অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানো, সেটা আনিসকে বুঝিয়ে দেয়া।
আনিস বুঝে এবং বলে, আমি যাই, তুই আরাম করে চা খা।
ঠিক আছে যাও।
আনিস চিন্তিত মুখে জয়নালের শোবার ঘর থেকে বের হয়। বের হতে না হতেই তীব্র, কটু একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দেয়। একবার পিছু ফিরে জয়নালের দিকে তাকায় আনিস। সিগারেটের এই গন্ধটা চেনা। কলেজের কিছু বখে যাওয়া বন্ধুদের আড্ডায় এমন গন্ধওয়ালা সিগারেট খেতে দেখেছে সে- গাঁজা। একবার মনে হল জয়নালের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। কঠিন একটা ধমকে জয়নালের পিলে চমকে দেবার ইচ্ছেটা বহু কষ্টে চেপে রাখে। আজ শিউলির গায়ে হলুদ। কালকে ওর বিয়ে। আজকের দিনে এসব নিয়ে ঝামেলা করার সময় না।
তোকে তো একেবারে রাজরানীর মত লাগছে রে। কিরে পাগলী শরীরে বিয়ের হাওয়া বেশ লাগিয়েছিস মনে হচ্ছে।
আমি এমনিতেই সুন্দর। নতুন করে সুন্দর হবার কিছু নেই।
তা অবশ্য ঠিক। তুই এমনিতেই রাজরানীদের মত।
তুমি কখন এসেছ দাদা?
আর বলতে পারব না। অনেককে বলে ফেলেছি। তুই একটা কিছু আন্দাজ করে নে কখন এসেছি।
এত কথা না বলে এক বাক্যেই তো বলতে পারতে, ‘রাতে ফিরেছি’।
তোর তো অনেক বুদ্ধিরে পাগলী। একেবারে সঠিক হিসাব দিয়ে দিলি।
রাতে এসেও তো একবার দেখা করে যেতে পারতে। তুমি যখন বাড়িতে এসেছ তখন রাত দশটা। এমন কোন গভীর রাত না যে দেখা করলে মানুষ খারাপ ভাববে।
তুই তো খুব কথা শিখে গেছিস। তোর খুব আনন্দ লাগছে না রে?
হুম, খুব আনন্দ লাগছে। দেখনা কেমন খাবি খাচ্ছি ভাব, বলেই তেলাপিয়া মাছের মত খুব দ্রুত ঠোঁট দুটি একবার খুলছে আর বন্ধ করছে।
আনিস ওর ছেলেমানুষি কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। মুখে বলছিস ঠিক আছে। কিন্তু চেহারাটা এমন ভোঁতা করে রেখেছিস কেন?
আমার ভোঁতা মুখে কার কি আসে যায়?
একজনের তো অবশ্যই কিছু আসবে যাবে- সে হচ্ছে তোর হবি হচ্ছে বর। বর পছন্দ হয়েছে?
না পছন্দ হবার মত কিছু নেই ওর মধ্যে।
তাতো শতভাগ সত্যি। চাচা তার আদরের কন্যার জন্য যেনতেন বর আনবেন না। বর হবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
শিউলি প্রসঙ্গ পাল্টে কেমন বেদনামাখা কণ্ঠে বলে, দাদা, তোমাকে একটা কথা বলব?
কি বলবি তাড়াতাড়ি বল। বাসায় গিয়ে গোসল টোসল করে খেয়েদেয়ে তারপর তোর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের তদারকি করতে হবে।
না দাদা, কিছু না। তুমি যাও।
আনিস পূর্ণ দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকায়। চোখগুলি কেমন ভেজা ভেজা। কণ্ঠটাও কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গ। বিষয়টা আনিসের কাছে মোটেই ভালো লাগছে না।
আনিসের অবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে শিউলি হেসে ফেলে। হাসিটাও কেমন যেন মেকি।
না দাদা, কিছু না। আমি যা বলব তুমি তা জান।
আমি আবার কি জানি?
দাদা, তুমি অনেক কিছুই জান। শুধু না জানার ভান করে থাক। আচ্ছা, জানাজানি শেষ, তুমি এখন যাও। গোসল করে আমার গায়ে হলুদের আয়োজন করতে থাক।
খোকন দরজার দিকে হাঁটা ধরতেই বাম হাতটা টেনে ধরে শিউলি। পিছন থেকে জোরে চেপে ধরে আনিসকে। দাদা, আমি, আমি তোমাকে- এই পর্যন্ত বলতেই চোখে পানি এসে যায় শিউলির। আনিস অবাক হয়ে শিউলির দিকে ঘুরে তাকায়। হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে একবারও পিছনের দিকে না তাকিয়ে বেড়িয়ে আসে। শিউলি দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে। বিলাপ করে কাঁদে। ও জানে এই কান্নার শব্দ ঘরের বাইরে যাবে না।
সন্ধ্যা মেলাবার সাথে সাথেই এলাকার সব মেয়েছেলে একজোট হয়ে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। হৈ হুল্লোড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নাকি সুরের গান, ছোট বাচ্চাদের আনন্দ চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি, বয়স্কদের মৃদু ভৎর্সনার শব্দে চারিদিক মুখর হয়ে আছে। শিউলিকে দাদী আর ভাবী সম্পর্কের দুইজন ধরে নিয়ে ষ্টেজের দিকে নিয়ে আসছে। ধরার দরকার ছিল না। কারন শিউলির প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল দৃঢ়, সতেজ। সে এসে নিজের আসনে বসল। প্রচণ্ড কোন আক্ষেপ বা জেদ ওকে এমন করে রেখেছে। আনিস আর তার মা ষ্টেজের সামনের দিকে বসে আছে। শিউলি কোন দ্বিধা ছাড়াই একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আনিসের দিকে তাকিয়ে থাকে। আনিসের মা সামনে গিয়ে হাতে সামান্য হলুদ নিয়ে শিউলির গালে ছুঁয়ে দেন। মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন। শিউলি শক্ত পাথরের মত হয়ে পরে। শুন্য দৃষ্টিতে আনিসের মায়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আনিসের মা বিব্রত ভঙ্গীতে স্মিত হাসেন। না শুনলেও শিউলির অন্তরের কথাটা তিনি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছেন।
আনিসের মায়ের শরীরটা কেমন যেন লাগছে। আনিসকে বললেন, বাবা, আমার শরীরটা কেমন যেন করছে। আমাকে একটু বাড়িতে দিয়ে আয়।
তোমার কি খুব খারাপ লাগছে মা?
খুব বেশি খারাপ না, তবে এখানে থাকতে ভাল লাগছে না।
মা, আরেকটু থাকতে পারবে? আমি হলুদটা লাগিয়ে দুজন একসাথে যাই।
না, আমাকে দিয়ে এসে তুই হলুদের অনুষ্ঠান পুরো শেষ করে তারপর যাবি। কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন, ভেজা আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা!
আনিস আর কিছু বলতে পারে না। মাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। শিউলি ভাবতে থাকে আনিস দাদা কি চলে যাচ্ছে? ও কেন যাচ্ছে? একবার মনে হল চিৎকার করে ডাকে। মনে হওয়া দরকারি কথাগুলি পরিবেশ, পরিস্থিতির কারনে বদলে যায়। শিউলি সময়ের হাতে বন্দি হয়ে অবিচল তাকিয়ে থাকে ওদের চলার পথের দিকে। গলায় কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। অমোঘ নিয়তির হাতে বন্দিনী একজন সে। বন্দিত্বটা কাটাতে যে সাহায্য করতে পারত সে নিজেই সরে গেছে। ওর দোষ নেই। যদি কোন সাহসী পদক্ষেপ সে নিতে যায়, তাহলে ওদের পরিবারের উপর কেয়ামত নেমে আসবে। সোহরাব মিয়া মায়ের পেটের ভাইকেই ছাড়েননি, ভাইপো আর ভাইয়ের বউ, সেতো অনেক দূরের ব্যাপার।
মাকে বাড়িতে রেখে এসে আনিস গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে হাজির হয়। ওকে দেখতে পেয়েই যেন নিজেকে আবার ফিরে পায় শিউলি। আনিস ধীর পায়ে ষ্টেজের দিকে এগিয়ে আসে। থালা থেকে এই এতটুকু হলুদ নিয়ে শিউলির কপালে ছুঁয়ে দেয়। এক অদ্ভুত অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে শিউলির। আনিসের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বলে, আমার গালে একটু হলুদ দেবে না? আনিস একরাশ অস্বস্তি নিয়ে চারিদিকে তাকায়। না, কেউ শিউলির কথা শোনেনি। সবাই আনন্দ করছে। দাদী সম্পর্কীয় কেউ একজনের রসালো মন্তব্যে সবাই যখন মাতাল হাসিতে মেতে উঠেছিল ঠিক সেই সময় আবদারটা করে শিউলি। আরেকটু হলুদ নিয়ে শিউলির গালে আলতো করে মেখে দেয়। শিউলির খুব মন চাইছে আনিসের হাতটা এমনি করে ওর গালে ধরে রাখুক কিছুক্ষণ। যদি সম্ভব হত সারাজীবন এভাবে থাকতে! চোখের কোণটা জ্বালা করছে। খুব দ্রুতই তাতে পানি জমতে শুরু করেছে। আনিস হাত সরিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসে। শিউলি মুখটা নিচু করে নেয়। আনিস খেয়াল করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু শিউলির বিছানো হাতের উপর পরল। আনিসের মন খারাপ করে দেবার জন্য এই দৃশ্যটাই যথেষ্ট। চেয়ার থেকে উঠে অন্ধকার এক কোণে নিজেকে সরিয়ে নেয়। শিউলি ভেজা চোখে অপলক ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। চলে যাবার দৃশ্যটা কেমন যেন ঝাপসা লাগছে।
রাত সাড়ে আটটার দিকে বাসা থেকে খবর আসে আনিসের মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। আনিস দৌড়ে বাসার দিকে রওনা দেয়। সোহরাব সাহেব তার স্ত্রীকে ডেকে আনিসদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। আনিসের মা একজন মহিলাকে নিয়ে আনিসদের বাড়ির দিকে রওনা দিতে দেখে শিউলি পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করে- সবাই এমন অস্থির হয়ে পরেছে কেন, কোন সমস্যা? মহিলা আনিসের মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা বলে। শিউলি উঠে দাঁড়ায়। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠান থেকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সোহরাব মিয়া এগিয়ে এসে বলেন- মা, কোন সমস্যা?
বাবা আমি জ্যাঠি আম্মাকে দেখতে যাব।
এটা কেমন কথা। এমন সময়ে অনুষ্ঠান শেষ না করে কোথাও যাওয়া যাবে না। আশেপাশে থাকা মহিলাদের একাংশ কথা বলে উঠে- বিয়ের কন্যার বিয়ে শেষ হবার আগে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। শিউলি অগ্নিদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়। সোহরাব সাহেব মেয়ের দৃষ্টিটাকে ভয় পেতে থাকেন- দৃষ্টিটা কেমন যেন- একটা পাথরের মূর্তি জীবন্ত চোখে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পুনরায় না করার আগেই ষ্টেজ থেকে নেমে আনিসদের বাড়ির দিকে রওনা দেয় শিউলি। সোহরাব সাহেব কাজের মহিলাকে ধমক দিয়ে শিউলির সাথে যেতে বললেন।
আনিসের মা প্রচণ্ড ঘামছিলেন। হাপরের মত বুকটা উঠানামা করছে। আনিস আঁতকে উঠে-
মা, তোমার কি হয়েছে?
আনিসের মা কেমন উদ্ভ্রান্তের মত ছেলের দিকে তাকান। ইশারায় কাছে ডাকেন। মায়ের বিছানার পাশে বসে বাম হাতটি মুঠো করে ধরে। ভেজা কণ্ঠে বলে, মা, তোমার খুব খারাপ লাগছে? অস্থিরভাবে চাচাত ভাই আলমকে রিক্সা ডাকতে পাঠায় আনিস। ঠিক এই সময় গায়ে হলুদের সজ্জায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে আনিসের উলটোদিকে আনিসের মায়ের মাথার কাছে বসে আরেকটি হাত ধরে। চাচী, তুমি কোন চিন্তা কর না। আনিস দাদা, আমরা সবাই আছি। তুমি একটু স্থির হয়ে থাক। পাশে রাখা গামছা দিয়ে চাচীর মুখটা আলতো করে মুছে দেয় শিউলী।
খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, আমি সব বুঝি। বড় শখ ছিলরে মা। তোদের দুজনকে একসাথে। কথার বাকিটুকু শোনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কারোরই হল না। আনিসের মা মারা গেলেন রাত নয়টার দিকে। আনিস মূর্তির মত বসে আছে। মূর্তিও মনে হয় এমন অচঞ্চল হয়ে থাকে না। না বাতাসে একটু দুলে উঠা, না হৈ চৈ, না কোন গোঙ্গানি। যেন ধ্যানমগ্ন এক ঋষি। স্থির হয়ে থাকা দেহটার প্রানের অস্তিত্ব বলতে একটানা ঝরতে থাকা অশ্রুর ধারা। আনিসের দিকে তাকিয়ে শিউলির বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। খুব ইচ্ছে করছে, পাথরের এই মূর্তিটাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে। কোন সান্ত্বনার কথা নয়, শুধু জড়িয়ে ধরে থাকা। যদি লোকলজ্জা আর সামাজিকতার কঠিন শৃঙ্খলে বন্দি না থাকত! এতকাছে, এত আপন একজন মানুষকে স্বান্তনা দেবার ইচ্ছেটাকে গলাটিপে ধরে বসে থাকে শিউলি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এত ক্ষমতা দিয়েও সময় সময় কি অক্ষম করে রাখেন।
রাত বারটার মধ্যেই দাফন কাফনের কাজ শেষ হয়। পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আনিসের মাকে। ঠিক আনিসের বাবার বামপাশে। এসব আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগের কথা।
চোখ জ্বালা করে উঠতেই আনিস বর্তমানে ফিরে আসে। এখন রাত কটা বাজে? হাত ঘড়ি নেই, সময়টাও ঠিক ধরা যাচ্ছে না। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। আজ মনে হয় আমাবস্যার কোন এক রাত। খুব ধীরে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। চলার ভঙ্গিটা যেন কেমন। মাতাল লোকজন সম্ভবত এভাবে টলোমলো পায় হাঁটে।
আনিস মাষ্টারের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে জাহানারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন- এত রাত করে বাড়ি ফিরলে যে? চাচার সাথে কথা হয়েছে।
আনিস মাষ্টার খুব সংক্ষেপে জবাব দিলেন- হ্যাঁ, কথা হয়েছে।
জাহানারা বেগম বিস্তারিত জানার জন্য উসখুস করতে লাগলেন। আনিস মাষ্টার জানতে চাইলেন, রানু আর খোকন খেয়েছে কিনা। কুকুরের বাচ্চাটা সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না। ওটার যেন কোন অস্তিত্বই নেই, কখনো ছিলোনা।
ওরা খেয়েছে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। রাত কয়টা বাজে জানো? সাড়ে বারটা বাজে। কুকুরের বাচ্চাটাকে খাওয়ানো হয়েছে।
ওটা কোথায়?
এইতো বারান্দায়। পুরানো কাপড়চোপড় দিয়ে ভালমতো ঢেকে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করো না।
তুমি খেয়েছ?
জাহানারা বেগম নিরুত্তর থাকেন।
চল একসাথে খাই। তোমার থালা কোথায়?
সামান্য কিছু কথাবার্তা। এ থেকেই জাহানারা বেগম আন্দাজ করে নেন যে, জটিল কিছু হয়েছে। কারন, চাচার সাথে দেখা করার পর কি হল নিজ থেকে কিছুই বলছেন না। বিয়ের পর থেকে একজন আদর্শ স্ত্রীর মত আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইলেন না জাহানারা বেগম। সময় হলে আনিস মাষ্টার নিজেই সব খুলে বলবেন। মনে মনে আল্লাহ্ তায়ালা’র কাছে স্বামীর জন্য দোয়া করতে থাকেন।
জান জাহানারা, আমার জীবনে আমি এক মহাপাপ করেছি। হত্যা করেছি।
কি করেছ?
হত্যা করেছি।
এসব কি যা তা বলছ?
স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে আনিস মাষ্টার বলতে থাকে-
আমি তখন খোকনের বয়সী। শবে বরাতের আগের রাতে আমার ছোট মামা আমাকে এক প্যাকেট তারাবাতি কিনে দিয়ে যান। আমার বয়সী সবার হাতেই তারাবাতি। সবাই তারাবাতি জ্বালিয়ে আনন্দ করছে। আমিও সবার সাথে মিশে আছি। দূর থেকে আমাদের কুকুর ভোলাকে দেখলাম। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। ওকে খুব আদর করে কাছে ডাকলাম। গলা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ভোলা আরামে, সোহাগে নেতিয়ে পড়েছে। আমি খুব আস্তে আস্তে একটা তারাবাতি ওর লেজে বেঁধে দেই। দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ভোলা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তারাবাতির মাথায় আগুন দিলাম। ফুলের মতো আগুনের ফুলকি ছুটতে লাগলো। ভোলা ভয় পেয়ে যায়। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়াতে থাকে। আমাদের বাড়ির উঠানে একটা খড়ের গাদা ছিল। ওখানে আমরা ছোটরা কিছুটা অংশ খালি করে গুহা বানিয়ে খেলি। ভোলা দৌড়াতে দৌড়াতে ওটার ভিতর ঢুঁকে যায়। এক মুহূর্তেই পুরো খড়ের গাদায় আগুন লেগে যায়। কুকুরটা এত অস্থির হয়ে পরেছিল যে খোলা জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে আসার কথা হয়তো ভাবতে পারেনি। খড়ের গাদার সাথে সাথে ভোলাও পুড়ে যায়। জাহানারা বেগম উঠে এসে পেছন থেকে স্বামীকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন- ছোটবেলার অনিচ্ছাকৃত ভুল- তুমি তো আর ইচ্ছে করে ওকে মারনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- খোকনের মতো ভোলা সারাক্ষণ আমার পিছন পিছন ঘুরত। ওটাকে আজ খুব মনে পড়ছে। অনেক বড় একটা পাপ আমি করেছি। এ পাপ আমি খণ্ডানো যায় না।
তুমি কুকুরের বাচ্চাটিকে বাঁচিয়েছ। এতেই তোমার পাপমোচন হবার কথা।
মাঝে মাঝে আমার কেমন জানি লাগে। এত বছর আগের ঘটনা, অথচ এখনও আমাকে মাঝে মাঝে এমন তাড়িয়ে বেড়ায়।
জাহানারা বেগম চুপ করে স্বামীর কথা শুনতে থাকেন।
জীবন থেকে আরও দুটি বছর কিভাবে যে কেটে যায়! আনিস মাষ্টার এখন এলাকায় নতুন গড়ে উঠা কাগজকলের হিসাবরক্ষক। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। যতটুকু সম্ভব নিজের মেধা আর সততা দিয়ে মুখ বুঝে কাজ করে যান। এটা নিজেকে তৈরি করে নেয়া নয়। স্বভাবজাত প্রবৃত্তির বশে কোম্পানির হিসাবনিকাশের দিকটা আন্তরিকভাবে করে যান। এরই মধ্যে বহু শত্রু তৈরি হয়েছে। সুহৃদের সংখ্যাটাও কম নয়। তবে জীবনে সুহৃদের সখ্যতার নির্মলতা ছাপিয়ে শত্রুর অহর্নিশ তীর ছোঁড়াছুঁড়ি এখানে খুব বেশি প্রকট। মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়। আবার নিজের স্বভাবজাত অমায়িক আচরণ আর সততার বর্মে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষমও হন। মাঝে মাঝে যে ভয় হয় না, তা না।
প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য স্থানীয় একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তির ছায়া খুব জরুরী, আর সেটা সোহরাব সাহেব প্রতিষ্ঠানের মালিককে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সোহরাব সাহেবের সরব পদচারনায় আনিস বিব্রত হয়। জয়নাল একদিন মিল্লাত বামের কৌটার সবটুকু খেয়ে দুইদিন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ইহধাম ত্যাগ করে। আবেদ মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে খোঁড়া হয়ে একমাস যাবত বিছানায় পরে আছে। সুস্থ হতে নাকি আরও মাসদুয়েক লাগবে। এসবের কোন ছায়া সোহরাব সাহেবের চোখে, মুখে ফুটে উঠে না। কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না সোহরাব সাহেবের আচার আচরণে বা কথাবার্তায়- এমনকি অসতর্ক অবস্থাতেও।
গাভীন গরুটা বাচ্চা দিয়েছে আজ অনেকদিন হলো। ওটা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ বড়, চঞ্চলা হয়ে উঠেছে- ভোলার খেলার সাথী। খোকনের তো কথাই নেই। এই দুই প্রাণীর আত্মা যেন এক সুতোয় বাঁধা পরে আছে। স্কুল আর পড়ার সময়টুকু বাদে ভোলা হচ্ছে ওর ছায়াসঙ্গি। খোকন যেখানেই যাক আশেপাশে ছায়ার মতো চলতে থাকে ভোলা নামের কুকুরটি। কোন অসঙ্গতি বা বেখাপ্পা কিছু ঘটার মুহূর্তে কোথা থেকে কিভাবে যেন ছুটে আসে খোকনের সামনে। দেহরক্ষীর দায়িত্বটা যেন ওকে দেয়া হয়েছে। একটুও উনিশ বিশ করা যাবে না।
আনিসের ছুটির দিনটা বেশ যায়। অবশ্য আলসেমি বা আয়েশ করার সুযোগ নেই। জাহানারা বেগমের তাড়া খেয়ে ভোরবেলা উঠে বাজারের ব্যাগ সহ দৌড়াতে হয় সাপ্তাহিক বাজারের জন্য। সঙ্গী খোকন আর ওর ভোলা নামক কুকুরটি। নটার মধ্যে বাজার নিয়ে হাজির হতে হয় তিনজনকে।
অলস দুপুরে ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে গল্প করতে বসেন আনিস। রাজ্যের গল্প। একেকদিন একেকজনের পালা। আজ রুনুর পালা। কিন্তু সে কেমন যেন উদাসীন হয়ে আছে। এবছর এসএসসি পরীক্ষা দেবার পর থেকে আরও বেশি গম্ভীর হয়ে আছে সে। তাকে গল্প বলার কথা বলতেই বেশ জোরের সাথে বলে উঠে- আমি গল্প জানিনা। তোমরা করো। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।
মেয়েটার ব্যাবহার দেখেছ! মনে হচ্ছে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে ওর ভূত ছাড়িয়ে দেই।
আনিস মাষ্টার বলেন, কি যে বলোনা, মেয়ে বড় হয়েছে। একটু বুঝিয়ে, মানিয়ে চল। এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলাটা কি ঠিক হবে?
তোমার লাই পেয়েই মেয়েটার এত সাহস হয়েছে। এই মেয়ের জন্য একদিন সবার মুখে চুনকালি পড়বে এই আমি বলে দিলাম।
এসব কি জাহানারা। মায়ের মুখ থেকে এসব কথা বের হওয়া সন্তানের জন্য খুব খারাপ।
গল্পের আসর আর জমে না। অসময়ে একগাদা কাপড়চোপড় নিয়ে কলপাড়ের দিকে রওনা দেন জাহানারা বেগম।
বাবা, অনেকদিন যাবত গান শুনাও না। আজ শুনাবে?
আনিস হেসে বলেন, আজতো পান ছাড়াই গান শুনতে হবে।
পান লাগবে না। তুমি গান করো, বলেই বাবার বুকের উপর শুয়ে পড়ে খোকন।
আনিস সাহেব খোকনের লম্বা কোঁকড়ান চুলগুলিতে হাত বুলিয়ে দেন। একেবারে দেবদূতের মত চেহারা। খোলা মাঠে বা রাস্তা ধরে যখন দৌড়ে যায়, তখন খোকনের বড় বড় চুলগুলি ঝাঁকাতে থাকে। খোকনের বড় চুল রাখার কৃতিত্ব অথবা দায়ভার আনিস সাহেবের। জাহানারা বেগম তো আর জানেন না খোকনের লম্বা চুলগুলি যখন বাতাসে এলোমেলোভাবে পিছনের দিকে উড়তে থাকে- পিছনে ভোলা। কি সুন্দর, অপার্থিব সেই দৃশ্য। দেখে দেখে মন ভরে না।
জীবনের সময়গুলি খুবই অদ্ভুত। ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে চলা এর স্বভাব নয়। আনিস সাহেব আর জাহানারা বেগমের শান্ত, স্নিগ্ধ জীবনে রানুর খেয়ালী কাজটা কঠিন একটা ঝড়ের ঝাঁপটা দিয়ে যায়, এলোমেলো করে দিয়ে যায় সবকিছু। এসএসসি পরীক্ষার পরপরই সুমন নামের পাশের গ্রামের এক ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যদি বাড়ির সবাইকে জানাতো বা সবাই একটু টের পেতেন, তাহলে হয়তো এমন লজ্জার ভারে নুয়ে থেকে হাঁটতে হতো না। পাড়ার সবাই ছিঃ ছিঃ করতে থাকে। ছিঃ ছিঃ বলার শব্দটা হাজার গুণ বেশি হয়ে আনিস সাহেব আর জাহানারাকে অহর্নিশ কাঁপিয়ে যায়। আনিস সাহেব ভাবেন সময় হয়তো এমন লজ্জাকর ঘটনাকেও আড়াল করে দেবে। কিন্তু এর মাঝের সময়টুকুর যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা যে তাদের নেই। জাহানারা দিনরাত চোখের পানি ফেলেন। পুরো সংসারটাই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এখানে চিৎকার আছে, সেটা নিঃশব্দ, এখানে দুঃখ আছে, প্রকাশের মাত্রাটা শান্ত। গভীর রাতে ভোলা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বাউউউউউউউউ উউউউউউ আর্ত চিৎকার করে উঠে, বাড়ির সবার বুক কাঁপতে থাকে। সংসারে খোকনেরই শুধু ভাবান্তর নেই। সে আছে তার মতো। সেই আগের খোকনটা। এসব দুঃখবোধের ব্যাপারস্যাপারগুলি সম্পর্কে এখনো কোন ভাবালুতার সময় হয়নি যেন তার।
শীতের এক মধ্যরাতে ভোলার ত্রাহি চিৎকার আর ধস্তাধস্তির আওয়াজে আনিস মিয়া ধরমর করে জেগে উঠেন। এই প্রথম টের পান কোমরের পিছন দিকটায় প্রচণ্ড ব্যাথা। ব্যাথা অগ্রাহ্য করে আনিস মিয়া আর জাহানারা বেগম গোয়ালঘরের দিকে ছুটে যান। ঘরের দরজা খোলার সাথে সাথে কুয়াশার আবরণে ঢাকা দুটো ছায়ামূর্তিকে ছিটকে বের হতে দেখেন। একজন বেশ জোরে দৌড়ালেও কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আনিস মিয়া ওদের পিছু নেবার জন্য রওনা দিতেই হাতে জাহানারা বেগমের টানটা অনুভব করলেন। ঘরের নিভু নিভু হারিকেনটা উস্কে দিয়ে গোয়ালঘরের দিকে রওনা দেন দুজন। কখন যে খোকন ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ টের পায়নি। সদ্য ঘুম থেকে উঠা বিস্ময়ভরা চোখে বাবা-মায়ের উদ্ভিঘ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গোয়ালঘরের ভিতর ঢুঁকে প্রথমে নজর পড়ে ভোলার দিকে। কেমন নেতিয়ে পরে আছে। ডান পায়ের উপরের দিকটায় গভীর কাটা একটা দাগ। সেখান থেকে দরদরিয়ে রক্ত পড়ছে। গরুগুলির দড়ি ধারালো কিছু দিয়ে কাটা। গরুগুলি নিজেদের কথা ভুলে ভোলার রক্তাক্ত ক্ষতের দিকে তাকিয়ে আছে। জাহানারা বেগম ঘর থেকে পুরনো কাপড়ের বেশ বড় একটা টুকরা দিয়ে ভোলার ক্ষতটা বেঁধে দেন। আপাতত রক্ত পড়া বন্ধ হোক। ভোরে পশু চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভোলার কুই কুই ব্যাথার আওয়াজটা আনিস মিয়ার মগজে ঢুঁকে যায়। এ এক অসহায় সময়। এখন হাসপাতালে গেলেও কাউকে পাওয়া যাবে না। ক্ষতের যে গভীরতা, ভয় হয় ডাক্তারের কাছে নেবার আগেই না কিছু ঘটে যায়।
ভোর হতেই আনিস সাহেব পশু হাসপাতালের দিকে রওনা দেন। তার কোলে বিশাল কুকুরটা শুয়ে আছে। খোকন সাথে আসার জন্য বেশ জেদ ধরে। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই তাকে সঙ্গে নেন না আনিস সাহেব। ডাক্তার সাহেবের ঘুম তখনও ভাঙ্গেনি। হাসপাতালের দোতলার একটা রুমে তিনি থাকেন। বেশ অনেক্ষন ডাকাডাকির পর দরজা খুলে বিরক্ত মুখে আনিস সাহেব আর তার কোলে নেতিয়ে পরে থাকা কুকুরটাকে দেখেন। ডাক্তারের সহজাত সেবার মানসিকতা তাকে কঠিন হতে দেয় না। ডাক্তার সাহেব বেশ যত্ন নিয়েই ভোলাকে দেখেন। সেলাই, ব্যান্ডেজ করে ঔষধ দিয়ে দেন। আনিস সাহেবের উদ্ভিঘ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসার হাসি দেন। আনিস সাহেব আশ্বস্ত হন। বাড়ি ফিরে এসে জাহানারা বেগমকে ঔষধ পথ্যের বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ঠিকঠাক মতো জানিয়ে কর্মস্থলের দিকে রওনা দেন।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই আনিস সাহেব বাড়ি ফিরে আসেন। কোনমতে হাত মুখ ধুয়ে কুকুরটার দিকে একপলক তাকিয়ে শার্টের দিকে হাত বাড়ান।
কোথাও বেরুচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ, অস্পষ্ট হলেও কালকে দুইজনের মধ্যে একজনকে চিনতে পেরেছি।
কে?
রমিজ মিয়া। একটু যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছিল। মনে হয় ভোলা ওর পায়ে কামড় দিয়েছে।
তুমি কি রমিজ মিয়ার বাড়ি একা যাবে?
হ্যাঁ, একাই যাব। কেন?
সাথে কাউকে নিলে ভাল হতো না।
কার কথা বলছ?
আলমকে নিয়ে যাও।
ঠিক আছে। আলম, এই আলম- জোরে জোরে পাশের বাড়ির আলমকে ডাকতে থাকেন আনিস সাহেব।
আলম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। দাদা, কিছু হয়েছে নাকি?
হ্যাঁ, আমার সাথে একটু রমিজের বাড়ি যেতে হবে।
চোরের বাড়ি গিয়ে কি হবে?
রাতে গোয়ালঘরে ঢুকেছিল। মনে হয় লালি, কালি আর বাছুরটাকে চুরি করতে এসেছিল। ভোলাকে চাকু দিয়ে মেরেছে।
সেটা জানি। তুমি কি রমিজকে দেখেছ?
হুম, আমি একশভাগ নিশ্চিত।
তাহলে ওর শরীরে কুকুরের কামড়ের দাগ থাকলে আমি সালিশ বসাবো।
সেটা দেখা যাবে। এখন চল।
রমিজের বাড়িতে হাজির হয়ে আলম চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, এই রমিজ বাইর হ।
হারিকেন হাতে রমিজের মা বের হয়ে আসে।
দুজনের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আলমের দিকে ফিরে আলমের চেয়েও জোরে বলে উঠেন- এত চেঁচামেচি করছ ক্যান? কেয়ামত লাগছে নাকি।
হ, কেয়ামত। তোমার পোলা কই? তোমার যেই পোলায় গত রাতে আনিস দাদার গরু চুরি করতে গিয়েছিল সেই রমিজ চোরা।
কি? আমার পোলা চোর! চোর তর বাপে, চোর তর চৌদ্দগুষ্ঠি।
এত কথা বাদ দিয়া কও, পোলারে কোথায় লুকায়া রাখছ।
আমার পোলায় বাড়িত নাই। সকালে নানার বাড়িত গেছেগা।
ধরা পড়ার ভয়ে নানা বাড়িতে পাঠাইছ?
চুপ হারামজাদা। আমার পোলারে নিয়া একটা কথা কবি তো জিবলা টান দিয়া ছিঁড়া ফালামু। ও মাস্টর, তুমি কথা কওনা ক্যান? গরু চুরির ব্যাপার তোমার। এই শুয়োরের বাচ্চায় কথা কয় ক্যান।
কোমরের পিছনের দিকটায় প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। ব্যথাটা সাড়া শরীরে ছড়িয়ে পরেছে। এই মহিলার সাথে কথা বলে কোন লাভ হবে না। কথা বলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
কোনমতে আলমকে বললেন, চল আলম বাড়ি যাই। অন্য একদিন আসব।
পনের দিন পর আসবা। রমিজ পনেরদিন পর বাড়ি আসব। তখন কথা কইও। অহন ত্যক্ত কইর না। তোমরা যাও।
আলম বলে উঠে- চিকিৎসা করাইয়া পনেরদিন পর আনবা। সবই বুঝি রমিজের মা।
আলম টের পায় আনিস সাহেবের ডানহাতটি ওর কাঁধ জড়িয়ে আছে। চাপটা এমন যে, শরীরের সবটুকু ভর আলমের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। কোমরের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ব্যথাটা পেছনের পাঁজরের নীচের অংশে। বমি বমি ভাব হচ্ছে- খুব অসুস্থ আর দুর্বল মনে হচ্ছে। শরীরে জ্বর জ্বর ভাবটা ফিরে এসেছে।
দাদা, কোন সমস্যা? বাজারে চল। ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি যাব।
নারে, বাসায় গিয়ে একটু গরম ছ্যাঁক নিলে ঠিক হয়ে যাবে। সামান্য বিষয় নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি ভাল লাগে না।
আলম চুপ করে থাকে। বিষয়টাকে মোটেই সামান্য মনে হচ্ছে না। দাদার উচিৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়া। কিন্তু দাদার কথা অমান্য করার মতো মনের জোর তার নেই।
আনিসকে নিয়ে আলম বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
আলম আনিসকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। জাহানারা বেগম দৌড়ে এসে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার মুখটা রক্তশূন্য- ভয়ার্ত কণ্ঠে আলমকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দাদার কি হয়েছে?
আলম কিছু বলার আগেই আনিস বলে উঠলো- আরে তেমন কিছু না। কারখানায় সারাক্ষণ বসে থাকি তো, এ কারনেই হয়তো কোমরে ব্যথা হয়। জাহানারা বেগম মাথার কাছে বসে আনিস সাহেবের কপালে হাত রাখেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
আলম শীঘ্রই বাজার থেকে ডাক্তার সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়। আনিস সাহেব হাত তুলে বাঁধা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু বমির ভাব হতেই থেমে গেলেন। খাটের নিচ থেকে চিলিমচি বের করে খুব সতর্কতার সাথে আনিস সাহেবকে পাশ ফেরালেন। জাহানারা বেগম নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছেন। বিষয়টা না দেখেও আনিস সাহেব তা ধরতে পারলেন।
আরে, কাঁদছ কেন? কাঁদার মত কিছু হয়নি তো। রাখতো তোমার কান্নাকাটি। আমাকে একটু পানি দাও। মুখটা কেমন তেঁতো হয়ে আছে।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জাহানারা বেগম দৌড়ে পাশের ঘর থেকে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে এলেন। সাথে গামছা আর একটা বাটি। আনিস সাহেবের মুখ ধুইয়ে পানি খাওয়ালেন। বাটিতে পানি ঢেলে কপালে পানি পট্টি দিতে লাগলেন।
আনিস সাহেব কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পরে আছেন। তিনি খেয়াল করলেন খোকন আলনায় ঠেশ দিয়ে কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দুচোখে শুধু ভয় না, কি যেন এক অজানা কষ্ট লুকিয়ে আছে। আনিস সাহেব খোকনকে কাছে আসার জন্য হাত তুললেন।
কি রে বেটা, ভয় হচ্ছে?
না, কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট! কিসের কষ্ট?
তুমি কেমন যেন করছিলে। তোমার কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে বাবা।
দূর বেটা, মানুষের জীবনে অসুখ বিসুখ হয় না।
বাপ-বেটার কথার মাঝেই বাইরের উঠান থেকে ভোলার করুণ ভাঙ্গা ভাঙ্গা আর্তস্বর ভেসে আসে- বাউউউউউউ, উউউউউ। খোকন ভয় পেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আনিস সাহেব বলেন, আরে ওটা কিছু না। তুই এত ভীতু তাতো জানতাম না!
ডাক্তার আসেন। তিনি বেশ যত্ন আর আন্তরিকতার সাথে ব্যাথার নির্দিষ্ট জায়গাগুলি পরীক্ষা করেন। শারীরিক অন্যান্য উপসর্গগুলি সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞেস করে কিছু একটা নিশ্চিত হতে চাইছেন যেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর শোনার সাথে সাথে তিনি গম্ভীর হতে থাকেন।
ঘরের বাইরে এসে ডাক্তার সাহেব অতিরিক্ত গাম্ভীর্য নিয়ে যা বললেন, তাতে জাহানারা বেগমের কলজের পানি শুকিয়ে যায়। তিনি ফুঁপিয়ে উঠেন। পাছে খোকনের বাবার কানে কান্নার শব্দ যায়, এজন্য মুখে শক্ত করে আঁচল চাপা দিলেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ভয় পাবার মতো কিছু হয়েছে বলাটা বোধহয় ঠিক হয় নি। কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। আর আপনি, জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি ভেঙ্গে পরবেন না। ওনাকে যথাসম্ভব নিশ্চিন্ত রাখতে হবে যে, তেমন কিছু হয় নি। এসব ক্ষেত্রে মনের জোরটাও অনেক কাজে দেয়। ডাক্তারের কথা শুনে মাথা নাড়েন জাহেদা বেগম। ডাক্তার সাহেব আলমের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি আমার সাথে চেম্বারে আসেন। আপাতত কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন টেস্টগুলি করিয়ে নেবেন। দেরি করবেন না।
জাহানারা বেগম ঘরে ঢুঁকে দেখেন, বাপ-ছেলে কি একটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। বেশ অনেকদিন পর তিনি স্বামীর ভাল করে লক্ষ্য করেন। লম্বা চওড়া লোকটা অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। পায়ের গোছাটা কি একটু ফোলা ফোলা মনে হচ্ছে না। তাইতো, গালটাও বেশ ফুলে গেছে। একটা প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠেন জাহানারা বেগম। ডাক্তারের কাছ থেকে শুনা কথাগুলি সব মিলে যাচ্ছে।
সবকিছু ঠিক আছে, আবার কেমন যেন ঠিক নেই। চারিদিকে সেই দূরে যেখানে দৃষ্টির তেজটা পৌঁছায় না, সেখানে কোথাও কালো হয়ে আসছে। সেই কালোর মধ্য থেকে অপরাজেয় একটা কিছু হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছু তছনছ করার জন্য শুধু সময় নিচ্ছে। কতটুকু সময় পাওয়া যাবে সেটা জাহানারা বেগম জানেন না। এটাও জানেন না এই বিরূপ পরিবেশ প্রতিরোধের কতটুকু সামর্থ্য তার আছে।
আনিস বাসায় নাকি? উচ্চকণ্ঠে হাঁক দেন সোহরাব সাহেব। সন্ধ্যা মেলাবার পরপরই সাথে দুজন- সলিম মিয়া আর কুলি মতো একজন, যার মাথায় ফলের একটা বোঝা।
বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে যান আনিস। ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, চাচা ভিতরে এসো।
ঘরের ভিতর ঢুঁকে কুলি মাথার বোঝাটা নীচে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে যায়। সলিম ঘরের দরজার কাছে নিজের অবস্থান নেয়। হাতে শক্ত একটা লাঠি।
আনিস আবারো উঠতে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জাহানারা বেগম ঘোমটা দিয়ে খাটের পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্বামীর অবস্থা দেখে দ্রুত বিছানায় উঠে খুব যত্নের সাথে আলগোছে আনিস সাহেবের মাথাটা বালিশে রাখেন। জাহানারা বেগম পাশের ঘর থেকে একটা চেয়ারে এনে দেন। সোহরাব মিয়া তাতে বসলেন।
আনিসের সাথে কথা বলে লাভ কি। ও তো আর উঠতে পারছেনা। কথাও মনে হয় গুছিয়ে বলতে পারে না। তা বৌমা তোমার সাথেই কথা বলি, কি বলিস আনিস? আনিস ইশারায় সম্মতি দেয়।
আনিসের অবস্থা নাকি খুব খারাপ। খুব শীঘ্রই ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। শুনলাম বহুত টাকার ব্যাপার। তা টাকাপয়সার জোগাড় হয়েছে নাকি? মানুষের মুখে শুনছি উত্তরপাড়ার ক্ষেতটা নাকি বেঁচে দিচ্ছ বৌমা? জীবনের চেয়ে সম্পদের মূল্য বেশী নয়। জীবন থাকলে সম্পদ করতে আর কতক্ষণ লাগে। কথাগুলি কেমন যেন খোঁচা দেবার জন্য বলা। জাহানারা বেগম উত্তর দেন- হ্যাঁ চাচা, উত্তর পাড়ার পনের শতক জমি পুরোটাই বিক্রি করতে হচ্ছে।
তা মা একটা কথা বলি। জায়গাজমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের অগ্রাধিকার থাকে। জমি যদি বিক্রি করতে চাও তাহলে আমার প্রস্তাব হচ্ছে আমাকে দিও। বাজার দর যা আছে তাই দেব। আত্মীয়ের দাবীতে ফুঁটা পয়সাও কম দেব না। তা বাড়িটাও কি বিক্রি করবে নাকি?
এবার আনিস গলায় যতটুকু জোর পেল তার সবটুকু দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, আমি মরে গেলেও এ বাড়ি বিক্রি করব না। এটা আমার খোকনের জন্য।
কেন রানু কি তোর মেয়ে নয়, এখানে ওর দাবী নেই?
জাহানারা বেগম মৃদু কণ্ঠে বলেন, চাচাজান এসব বলার সময় এখন না। জমির ব্যাপারে আপনার কথা রাখবো। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটার একটা বিহিত করতে হবে।
তুমি যদি বল মা, তবে কালকেই উকিল এনে দলিল করে নেই। তা কত টাকা নেবে ঠিক করেছ? কালকেই টাকা পয়সার ঝামেলা মিটিয়ে দেব।
ওরা দেড় লাখ টাকা বলছে। আমরা সোয়া দুই লাখ বলেছি। ওরা বলেছে কালকে জানাবে।
ওদের জানাজানির দরকার নেই। আমি দেড় লাখ টাকাই দেব। একদাগে দেড় লাখ। বেচাকেনার ব্যাপারে আমি মা একেবারে একটু হিসাবী। আত্মীয় হিসাবেও তো একটা দাবী আছে আমার। দেড় লাখের বেশী কিন্তু মা এক পয়সাও দেব না। আমার সাফ কথা, আত্মীয়ের দাবিও বলতে পার। আরেকটা কথা, অন্যান্য জমির বিষয়ে যদি সিদ্ধান্ত নাও, মানে বিক্রি করতে চাও, আমাকে অবশ্যই সবার আগে জানাবে। কাউকে কিন্তু কথা দিয়ে ফেলো না আবার।
ও ঘর থেকে খোকন দৌড়ে এ ঘরে দৌড়ে এসে দাদাজানকে দেখে স্থির হয়ে যায়। সোহরাব মিয়া খোকনকে সামনে ডেকে এনে কোলে বসান। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে দুটো পাঁচশত টাকার নোট বাড়িয়ে ধরেন খোকনের দিকে। খোকন মা’র দিকে একবার, বাবার দিকে একবার তাকায়। তাঁদের চোখে কিছু খুঁজে না পেয়ে হাতদুটি মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। সোহরাব মিয়া মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। জাহানারা বেগম বলে উঠেন- খোকন দাদা যা দিতে চায় তা নাও। খোকন হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেয়।
যাবার আগে সোহরাব সাহেব আনিসের কঙ্কালসার হাতটি ধরে বলেন- সাহস হারাবি না। আল্লাহ্ যা করেন, তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। তার স্বান্তনার কথা শুনে আনিসের মনে হচ্ছে ডাঁশা দিয়ে ঠাস করে চাচার মাথাটা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দেয়। তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে সোহরাব সাহেব ঘর থেকে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যান। আনিস বিড়বিড় করে বলতে থাকে, আল্লাহ্ যা করেছেন, তা তোর মঙ্গলের জন্য করেছেন। একেবারে পানির দরে জমি কিনে নিচ্ছিস। একবারও তো বললি না, চিকিৎসার যা খরচ লাগে আমি দেব। তুই তো বেটা জানিসই আমি তোর টাকা নেব না। অন্তত বলতে তো পারতি।
এই তুমি বিড়বিড় করে কি বলছ? আনিস জবাব দেন না। জ্বলজ্বলে চোখে উপরের আড়ার বাঁশের কঞ্চির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
খোকনের ফুপু সম্পর্কের একজন বাড়িতে এসেছেন। বিধবা মহিলা। স্বামী মারা যাবার পর শ্বশুরবাড়িতে আশ্রিতের মত পড়ে আছেন। জাহানারা বেগম তাকে ডেকে এনেছেন। ঢাকায় থেকে যতদিন চিকিৎসা চলবে আপাতত ততদিন তিনি এ বাড়িতে থাকবেন।
বাবা, তোমরা লালি, কালিকে বিক্রি করে দিচ্ছ?
হ্যাঁ বাবা।
তোর মা থাকবে না, আমরা থাকবনা। ওদেরকে দেখবে কে বল?
ওরা কি লালি, কালিকে জবাই করে দেবে। জবাই করে মাংস বিক্রি করবে?
তা ঠিক জানি না।
পিতা-পুত্রের কথার মাঝখান থেকে জাহানারা বেগম উঠে চলে গেলেন। গোয়ালঘরে গিয়ে লালি, কালির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওদের পিঠে হাত রেখে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। লালি, কালি বুঝে কিনা কেউ জানে না, ওরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের চোখের দিকে তাকালে জাহানারা বেগম দেখতে পেতেন চারটি চোখ থেকে অবিরল পানি ঝরছে। বোধহয় ওরাও ওদের নিয়তি জেনে গেছে- ভালবাসার এই বন্ধন থেকে ওদের কেউ এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে তিনজন লোক আসে। ঘরে বসেই ত্রিশ হাজার টাকা গুনে নেন জাহানারা বেগম। ছোট গরুটাও বেঁচে দিলে পারতেন।
জাহানারা বেগম বললেন, ওটা থাকবে লতিফা আপা ওকে দেখেশুনে রাখতে পারবে।
কসাই লোকটা জানতে চায়- আপনি গোয়ালঘরে একটু আসেন। গরুগুলি আপনার হাত দিয়ে দেন।
না, আমি যাব না। আপনারা নিয়ে যান।
লোকগুলি ঘর থেকে বেরিয়ে গোয়ালের দিকে রওনা দেয়। কিছুক্ষণ পর গোয়াল ঘর থেকে লালি, কালির তারস্বরে হাম্বা রব কানে এসে বাজে। জাহানারা বেগম ব্যাকুল হয়ে কাঁদেন। যেন তার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। খোকন দৌড়ে ঘরে আসে। দুজনেই কি এক আকুলতা নিয়ে জাহানারা বেগমের দিকে তাকায়। জাহানারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে খোকনকে জড়িয়ে ধরেন। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ভোলার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হাম্বা রবের চিৎকারটা দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ক্ষীণ একটা প্রতিধ্বনি সাড়া বাড়িতে ছড়িয়ে পরে। আল্লাহ্ গো বলে জাহানারা বেগম মূর্ছা যান। ফুপু সম্পর্কের মহিলাটি ঘরে এসে জাহানারা বেগমে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। খোকনের পিছু পিছু ভোলা ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ির বাইরে এসে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। অনিশ্চিত হাঁটা। গন্তব্যটাও অনিশ্চিত।
জাহানারা?
বলো।
আমি যদি মারা যাই, তোমার কি খুব কষ্ট হবে?
চুপ করতো, কে বলেছে তুমি মারা যাবে। যতোসব আজাইরা প্যাঁচাল।
সবকিছুই একদিন না একদিন শেষ হয়। এই তুমি, আমি, আমরা সকলেইতো একদিন মারা যাব। শুধু শেষের মুহূর্তটা আমরা জানি না। জানা থাকলে ভালো হতো, তাই না? আমার যদি কিছু হয়ে যায়, খোকনকে মানুষের মত মানুষ করবে।
স্কুলের ঘটনাটা কিছু জান?
তুমি তো কখনও বলোনি।
জানই তো- এতোটুকু বলেই কেমন আচ্ছন্নের মত পড়ে রইলেন। স্কুলের ঘটনা আর শুনা হলো না। জাহানারা বেগম বললেন,
একটু চুপ করতো, এখন তুমি ঘুমাও। যখন মরার সময় হবে তখন সবাইকে মরতে হবে। মরার আগেই মরে যাওয়ার মানে নেই। পরশু ভোরে এ্যাম্বুলেন্স আসবে। ঢাকায় হাসপাতালে যেতে হবে। আর একটা কথাও বলবে না। চুপ করে ঘুমিয়ে থাক। কথাগুলি বলতে বলতে জাহানারা বেগমের গলাটা ধরে আসে। কান্নাটা চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বুকের মধ্যে কি যেন একটা চেপে বসে আছে। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। রানুর বাবার সামনে তা করা যাবে না। লোকটা এমনিতেই ভেঙ্গে পরেছে। দূরে সরে যেতেও পারছে না। রানুর বাবা শক্ত করে তার একটা হাত ধরে আছে। একজন ডুবন্ত মানুষের হাত- অবলম্বনের হাতটি কোনভাবেই ছাড়া যাবে না। এই হাত ধরেই উপরে উঠতে হবে।
জাহানারা বেগম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এই হাত দিয়েই তোমাকে তুলে আনবো। যদি তাতে নিজেকে বিসর্জন দিতে হয়, তবুও পিছপা হবো না। আমি জানি তোমার বেঁচে থাকার মধ্যেই আমি থাকবো। তুমি, আমি আলাদা কেউ নই। একই স্বত্বার দুটি দেহ মাত্র।
বাইরের উঠোনটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে সেই আলোর কয়েকটা ধাঁরা ঢুঁকে ঘরটাকে আলোকিত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আজ যেন জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে। কি এক খুশির ঢেউ চারিদিকে। খুশির ঢেউকে অগ্রাহ্য করে বাইরে থেকে কাঁপা কাঁপা, বিস্ময়ভরা করুণ ও তীক্ষ্ণ প্রলম্বিত একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। আরে, কুকুরটার সাথে খোকনও একই সুরে ডেকে যাচ্ছে- বাউউউউউউউউ উউউউউউউউউউ ...........................।।
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:২৪
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: অনিশ্চিত