নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমাকে খুঁজে ফিরি

হুয়ায়ুন কবির

হুয়ায়ুন কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

চাচী

২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪১



চাচী
(হুমায়ুন কবির)

অভাবের সংসার। সপ্তাহ বা মাসের বাজার একসাথে করা সম্ভব হয় না। বাড়ির পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলে দোকান। রোজই ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস; চাল, ডাল, আলু পেঁয়াজ কেনার প্রয়োজনে আমাকে সে পথ দিয়েই দোকানে যেতে হয়। রাস্তার পাশে কালু চাচার বাড়ি- আমার দুঃসম্পর্কের চাচা। কালো থেকে কালু হতে পারে। কিন্তু কালু চাচা মোটেই কালো নন, যদিও চেহারাটা বিদঘুটে, দেহটা অত্যন্ত দুর্বল; উজ্জ্বল বর্ণের অসম্ভব ভদ্র একজন মানুষ। মানুষের সাথে তাঁর ব্যবহার অত্যন্ত মধুর। বাজারে গেলে পরিচিতজন যারা, তারা ওনার পয়সাতেই চা, বিড়ি খেতে পারে; হোক সে চেয়ারম্যান, মেম্বার অথবা অতি প্রভাবশালী কেউ। তার মধ্যে রহস্যময় একটা ব্যাপার আছে। তিনি এমন কোন ব্যবসা বা চাকুরী করেন না যে এমন উদারহস্ত হওয়া সম্ভব। বাপেরও জমিদারীও নেই যে জায়গাজমি বেচে টাকাপয়সা উড়িয়ে বেড়াবেন। অবশ্য গ্রামের সাধারন মানুষের মধ্যে এসব নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। বিনা পয়সায় চা, বিড়ি খাওয়ার আনন্দেই তারা কালু চাচার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অবশ্যম্ভাবীভাবে যাদের মাথাব্যাথা হবার কথা তারা কেমন যেন কালু চাচাকে দেখে মিটিমিটি হাসেন, কেমন যেন অদ্ভুত রকমের দৃষ্টি বিনিময় হয় নিজেদের মধ্যে।

বেলা প্রায় একটার মত বাজে। মা আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে দোকান থেকে এক সের চাল, আধা সের আলু আর এক পোয়া মসুরির ডাল আনতে বলে দিয়েছেন। রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যাবার পর আমি লক্ষ্য করলাম কালু চাচার স্ত্রী তাদের বাড়ির মরিচা পড়া টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই শুভ, ভর দুপুরে কোথায় যাস?

দোকানে, সদাই কিনতে। বলেই মাথা নীচু করে দ্রুত পা চালাতে থাকি।

কি সদাই কিনতে যাস?

আমাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। বললাম, চাল, ডাল, আলু এসব কিনতে হবে।

দুপুরে তোদের রান্না হয়নি?

মা কিছুক্ষণ আগে টাকা দিলেনতো। সদাই কিনলে তারপর রান্না হবে।

আজ কি স্কুল বন্ধ?

না।

যাসনি কেন? গাড়ি ভাড়া ছিলনা? প্রশ্নের দুটি বাক্যই বুকের মাঝে কুড়ালের ঘা মারল। প্রচণ্ড রকম মন খারাপ করার জন্য এমন দু’টি বাক্যই যথেষ্ট। তাছাড়া নিজেদের অভাবের কথা বলে বেড়াতে কার ভাল লাগে?

তুই কোন ক্লাসে যেন পড়িস; ও হ্যাঁ, ক্লাস সেভেনে। ঠিক না? আচ্ছা, স্কুলে যাওয়া-আসার গাড়ি ভাড়া কত রে শুভ?

এক টাকা। বাসে করে গেলে আট আনা করে আসতে যেতে একটাকা লাগে।

আর বলতে হবেনা। হিসাব বুঝেছি, ঘরে আয়।

সদাই কেনাটা খুব জরুরী। একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। তারপরেও চাচীর ডাকটা যেন অমোঘ কোন নির্দেশ। আমি চাচীর পিছু নিলাম।

বড়সড় টিনের ঘরের মাঝখানে একটা খাট। কি সুন্দর করে চাদর বিছানো। চাদরটা একেবারে টানটান হয়ে আছে। পাশে ড্রেসিং টেবিল। চাচী টিনের কৌটা থেকে অনেকগুলি বিস্কুট বের করে একটা প্লেটে করে আমার সামনে এমনভাবে রাখলেন, যেন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। আমি পড়লাম প্রচণ্ড অস্বস্তিতে। চাচীর দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। কোন রংয়ের চুড়ি বাদ পড়েনি। বিস্কুট দেবার সময় সাদা হাতে চুড়ির টুং টাং শব্দগুলি খুব মিষ্টি হয়ে কানে বাজছে। বিস্কুট দেখে সকালের নাস্তা না খাওয়ার খিদেটা চাগিয়ে উঠলো। গোগ্রাসে একটার পর একটা বিস্কুট খেতে লাগলাম।

আরে আস্তে খা, গলায় আটকে যাবেতো পাগল। বিস্কুট তো চলে যাচ্ছে না। নে একটু পানি খেয়ে নে- বলেই গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন।

চাচী কি সুন্দর করেইনা পাগল বলে ডাকলেন! আমার মন খারাপ ভাবটা এক নিমিষেই বদলে গেলো। এত ভাল লাগছে! আচ্ছা চাচীর নামটা জানি কি? নাম যাই হোক উনি আমার চাচী এটাই যথেষ্ট। আমি মুগ্ধ চোখে চাচীর দিকে তাকিয়ে আছি। কি যে সুন্দর, শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।

চাচী, কালু চাচা কই?

চাচী জবাব না দিয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে চাচার কথা জিজ্ঞেস করাতেই চাচীর চোখ দু’টিতে আগুন জ্বলে উঠেছে। চাচীর অসম্ভব সুন্দর চেহারাটা কেমন যেন অশুভ, ভয়ঙ্কর লাগছে। আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। চাচীর বড় বড় চোখ দু’টিতে কি অশ্রু জমতে শুরু করেছে?

চাচী হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, খাওয়া শেষ হয়েছে? এখন তাহলে চলে যা। আর একটা কথাও বলবি না। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। খাওয়া বন্ধ করে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বেরিয়েই কেমন একটা স্বস্তির পরশ টের পেলাম সারা শরীর জুড়ে। সামনের দীর্ঘ পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ডানদিকে ডোবামত জায়গাটা বেতুন আর বেতঝারে পূর্ণ। জায়গাটা দিন-রাত সবসময়ই অন্ধকার থাকে। রাতে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় জায়গাটাতে কেউ যেন কালো আলকাতরা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ওখান থেকে দু একটা শেয়াল মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দেয়। অনেকেই ভয় পায়। কিন্তু দিনরাত প্রায়ই আমাকে এপথ দিয়ে হাঁটতে হয় বলে ভয়টা কবে যে কেটে গেছে নিজেই ভুলে গেছি।

ইদানীং প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে- তুফান বৃষ্টি। সবাই বলাবলি করছে এবছর মারাত্মক বন্যা হবে। এমনভাবে পানি বাড়লে বুড়িগঙ্গার পাড় ছাপিয়ে পানি নামতে শুরু করবে। তখন বাড়িঘর ডুবতে একদিনও লাগবে না। মানুষের এসব কথাগুলি মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে সদাই কিনতে দোকানের দিকে রওনা দেই।

হপ্তাখানেকের মধ্যে চাচীর সাথে দেখা হয়নি। কাদামাটিতে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলব বলে ভর দুপুরে বেড়িয়ে পরেছি। ওই শুভ, ছাগলের বাচ্চার মত লাফাতে লাফাতে দৌড়াচ্ছিস কেন? আমি একটু আড়াল নেবার চেষ্টা করছি দেখে চেঁচিয়ে বললেন। এদিক আয়। এদিক আয় বলছি।

আমি থমকে গেলাম- যাক বাবা, শিয়াল বলে ডাকে নাই, ছাগলের বাচ্চা বলেছে।

ওই ছেমড়া, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলি কেন? মুরব্বীদের সালাম দিতে হয় জানিস না?

আমি মাথা নীচু করে আছি। লজ্জায় চেহারাটা লাল হয়ে আছে এটা বুঝতে পারছি।

চাচী বললেন, তোর ভাব দেখেত মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবি। ঐদিনের কথায় রাগ করেছিস? মনটা ভাল ছিলনারে বাবা- বলেই আমার হাত ধরে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

আমি চোখে জল নিয়ে আলেয়া বেগমের মুখের দিকে চেয়ে আছি। কি এক অপার্থিব মমতাভরা চোখ। বুঝতে পারছিনা চাচী কাঁদছেন কেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠেই আলেয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, দাদা বাসায় রে?

দাদা, কোন দাদা?

আমার বোকামিতে আলেয়ে বেগম হেসে ফেললেন। আরে গাধা, আমার দাদা মানে তোর বাপ। বাপ কি সেটাও বুঝিস না, নাকি? মানুষ এত সুন্দর করে হাসতে পারে! আমার কাছে আশেপাশের সবকিছুই আলোকিত মনে হতে লাগলো।

আব্বা বাসাতেই আছেন। আমি যাই, বলেই দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের দিকে রওনা দিলাম। মাঠে বর্ষার পানি জমেছে। আমি পিছনে না তাকিয়েও টের পাচ্ছি, চাচী একদৃষ্টিতে আমার চলার পথের দিকে তাকিয়ে আছেন।

কালু চাচার সাথে চাচীর বিয়ে বিয়ে হয়েছে এই মাত্র সাত মাস আগে। এর আগে কালু চাচা দু’টি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তিন বছরের মাথায় দুজনেই মারা যান। কিভাবে মারা যান, তা কেউ জানে না। কিছুটা কানাঘুষা হলেও একসময় তা স্তিমিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনমাসও পার হয়নি, তিনি আলেয়া চাচীকে বিয়ে করলেন। অনেককেই ফিসফিস করে বলতে শোনা গেছে যে, চাচার ভাগ্যটা খুব ভালো। শালার যুবক ছেলেপুলের জন্য একটা বউ জোগাড় করতে আত্মীয় পরিজনেরা পেরেশান হয়ে যায়, আর কালু মিয়া এই বয়সে তিন তিনটা বিয়ে করে ফেলল, তাও একেকজনের রূপ মাশাআল্লাহ! কালু চাচার বয়স কত হবে আন্দাজ করা মুশকিল। তবে এখনো তাকে যুবকদের মতো দেখায়। কালু চাচার সব ঠিক আছে, শুধু কেমন যেন একটু অলস- একটু না, একেবারেই অলস। সংসার কিভাবে চলে এমন গভীর চিন্তা শুভর মাথায় না আসলেও দু’একজনের রসালো, অশ্লীল মন্তব্য মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়। কেন মনে হয় নিজেও বুঝতে পারেনা।

সবাই বলাবলি করছে আর দুটা দিন পানি বাড়লে পানি গ্রামের দিকে গড়াতে থাকবে। সবার মধ্যে কি একটা অস্থিরতা। সবার চোখে, মুখে কি এক আশঙ্কার কালো মেঘ জমে আছে। সত্যি সত্যিই একদিন নদীর পাড় উপচে গ্রামে পানি ঢুঁকে পড়ে। এখন আমাকে সচারাচর দোকানে যেতে হয় না। কারন, আব্বা কিভাবে যেন এক বস্তা চাল, দশ সের এর মতো আটা আর রান্নার দরকারি উপকরণ কিনে এনেছেন। খাওয়া দাওয়ার চিন্তা আপাতত শেষ। আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে এখন ছোট ছোট নৌকা যায়। দারুন তো। মাঝি পাকা হলে কারো ঘরের টিনের কোথাও এতোটুকু টক্কর লাগে না। আমি পানিতে নেমে দেখেছি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আমার বুক সমান পানি। কোন কাজকর্ম নেই। কাঁহাতক শুয়ে, বসে কাটানো যায়। একদিন দুপুর বেলা আমি আমাদের খেলার মাঠটা দেখতে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে কালু চাচাদের বাড়ি পর্যন্ত কোমর পানি। আরেকটু সামনে গেলে যেখানে বেতুন আর বেতঝারে ভরা একটা জায়গা। সেখানকার রাস্তাটা নিচু বলে পানি আমার গলা ছুঁইছুঁই করে। আরও এগিয়ে পানির স্রোত দেখতে পেলাম। বড় রাস্তা পার হয়ে গ্রামের দিকে নদী উপচে প্রচণ্ড গতিতে পানি নামছে। মাঠে যেতে হলে স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে হবে। আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে মোটামুটি শান্ত ধারায় প্রবাহিত পানির দিকে এগুলাম। আসলে নদী উপচে যে জায়গাটা দিয়ে প্রচণ্ড স্রোত তৈরি হয়েছে তার আশেপাশে অনেক বাড়িঘর- যার বেশিরভাগ ইট কাঠের তৈরি। তাই তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে পানি নামছে বলে স্রোতের এই তীব্রতা। সারাটা বেলা পানিতে ডুবাডুবি, পানিতে ভেসে ভেসে ফুটবল খেলা। বিকেল হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের বকুনি বা মারের ভয় সবারই আছে। ক্লান্ত হতেই এসবের ভয় সবাইকে গ্রাস করে ফেলে। সবাই একে একে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আমি একটু ধীরেসুস্থেই রওনা দিলাম, কারন মায়ের কাছে বলা আছে যে, আজ মাঠে আসব। কালু চাচাকে দেখলাম উঁচুমতো জায়গায় রমিজ মিয়ার দোকানে চা খেতে খেতে লোকজনের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে।

কালু চাচার বাড়ির সামনে আসতেই একটা মাঝারি সাইজের নৌকা ওনাদের বেড়ার গেইট দিয়ে বেরুতে দেখলাম। মাদবর সাব নৌকার সামনের গলুইয়ে বসে আছেন। তার সারা শরীর জুড়েই কেমন যেন তৃপ্তির আভা। পান চিবুচ্ছেন। মনে হচ্ছে স্বর্গীয় কোন জিনিস খাচ্ছেন। লোকটাকে কখনো আমার ভাল লাগেনি। ওনার আনন্দিত ভাবভঙ্গি দেখে মেজাজ খিচড়ে গেল। বেটা আমাকে দেখেও কেমন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। পাগল হয়ে গেছে নাকি! খাটাশটা কালু চাচার অনুপস্থিতিতে এই বাড়িতে কি করছিল! একবার মনে হলো ভিতর বাড়ি গিয়ে চাচীকে দেখে আসি। আবার ভাবলাম এমন সময় যাওয়াটা ঠিক হবে না। না যাবার সিদ্ধান্তটাই বেছে নিলাম।

এরপর প্রায়ই এমন ঘটনা মানে কালু চাচার অনুপস্থিতিতে নৌকায় করে মাদবরের আসা-যাওয়াটা চোখে পরতে লাগলো। একদিন পানি ভেঙ্গে চাচী আমাদের বাড়িতে আসলেন। সময়টা দুপুর ছুঁইছুঁই। আমি কিছুক্ষণ এদিক ওদিক সাঁতরে বাহিরের ঘরে জামাকাপড় পাল্টানোর জন্য দাঁড়াতেই ভিতরের ঘর থেকে চাচীর কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। অস্ফুট কান্না না, একেবারে হাউমাউ করে কান্না। মা ওনাকে কি বলে যেন স্বান্তনা দিচ্ছেন। আব্বার গমগমে কণ্ঠটা শুনতে পেলাম- মতি মাদবরের টাকাপয়সা, লোকবলের অভাব নেই। ওর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে সবাইকে বিপদে পরতে হতে পারে। বর্ষার পানিটা একটু কমুক। সবাইকে নিয়ে এ বিষয়ে একটা কিছু করবো। আমি একজন সর্বহারা মহিলার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে পেলাম- দাদাগো, আপনার পায়ে পড়ি। আমি আর পারছি না। কি কর, আরে কি করো, পা ছুঁতে হবে না। আমি দেখছি কি করা যায়।

আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। চাচী বের হয়ে আমাকে যেন দেখতে না পায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। সাঁতরে সাঁতরে ঐ দূরের উঁচু ডিবিটার দিকে রওনা দিলাম। আমি সাঁতরাচ্ছি কিনা জানি না, তবে বুঝতে পারছি, একটা বন্য আক্রোশ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে

দুই দিন পর মা আমাকে দরকারি কিছু সদাই আনতে বললেন। সন্ধ্যা প্রায় ছুঁইছুঁই। আকাশে মেঘ। সন্ধ্যা না হতেই রাতের আঁধার নেমে এসেছে যেন। কালু চাচার বাড়ির সামনে আসতেই মনটা কেমন হু হু করে উঠলো। মনের অজান্তেই একবার গেইটের দিকে তাকালাম। সব চুপচাপ- পানির একটা ফোঁটা পরলেও আওয়াজটা শোনা যাবে এমন।

কালু চাচার বাড়ির সামনের বড় আমগাছটা ছাড়িয়ে ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছি। পায়ে একটা কিছু ঠেকল। মনে হয় গাছের কোন ডাল পানিতে ডুবে আছে। গলা পর্যন্ত পানি। হাত দিয়ে সরাতে গেলে ডুব দিতে হবে। পা দিয়েই জিনিসটাকে সরিয়ে দেই। জিনিসটা উল্টে আবার আমার পায়ের পাতার উপর পড়ে। মনে হয় প্রশাখা নিয়ে বড় কোন ডাল পরেছে। আমি এবার বেশ জোরেই লাথি মারলাম- অনেকটা ফুটবল মারার ভঙ্গীতে। কিন্তু একই অবস্থা। অবশেষে মাথাটা নামিয়ে ডালটা ধরতে গেলাম। উদ্দেশ্য ওটাকে হাত দিয়ে ঠেলে দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলব। অবশেষে ডালটা উঠিয়ে আনলাম। একি! এটা যে একটা হাত। ধবধবে সাদা, হরেকরকম চুড়ি পড়া। আশ্চর্য, একটা চুড়িও ভাঙ্গেনি। আমার ভয় পাওয়া উচিৎ। কিন্তু আমি চলে গেছি ঘোরে। আরেকটু টেনে উঠাতে দেখতে পেলাম, মুখটা চাচীর। পানির মধ্যে পাঁজা কোলে করে কোনমতে বাড়ির গেইটের সামনে আসলাম। আশ্চর্য তো, কাপড়টা একেবারে পরিপাটি করে পড়া অবস্থায় আছে।

কিভাবে কে কি করে চাচীকে তার ঘরের ভিতর শুইয়ে রেখেছে নিজেও জানি না। খাটের চারপাশে মানুষ। নিজেকে চাচীর মাথার কাছাকাছি বসা অবস্থায় আবিস্কার করলাম। মনে হলো খোলা চোখে চাচী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথা কাজ করছে না। স্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষকের পানিতে ডুবন্ত মানুষের চিকিৎসা বিষয়ক কিছু কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। বড় করে শ্বাস নিলাম। বাম হাত দিয়ে চাচীর নাক বন্ধ করে মুখের মধ্যে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিলাম। কয়েকবার এমন করেও প্রাণের কোন সাড়া পেলাম না। প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারনে কেমন যেন সব ঘোলাটে লাগছে। বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ কানে আসছে- হিটার জ্বালাতে গিয়ে শক খেয়েছে নাকি? নাতো, ঘরে তো কোন হিটার নেই। তাহলে মরল কিভাবে? ঐ যে মাদবর সাবরে নিয়া কালু আসতাছে। কে যেন আমাকে পাঁজা কোলে করে পানি ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্টভাবে বলছেন, ভয় পেয়েছিস বাবা? কণ্ঠটা গমগমে- আব্বার কণ্ঠ।

আমি কোন উত্তর দেই না। চোখের সামনে শুধু সাদা একটা হাত আর হরেকরকমের কাঁচের চুড়ির টুং টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছি অবিরাম।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৭

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: চাচী

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.