![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সে একজন
(হুমায়ুন কবির)
চারিদিকে অসহ্য গুমোট ভ্যাপসা গরম। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। গরমে শরীরের প্রতিটা অংশ জ্বলে যাচ্ছে। সারাদিনে পচা গমের তৈরি কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে বানানো তিন কাপ চা আর দুইটা নোনতা বিস্কুট পেটে পরেছে। এই মুহূর্তে পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। ক্ষুধার কারনে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্ষণে ক্ষণে পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করলেই যে কোন রেস্তোরাঁয় ঢুঁকে কিছু খেয়ে নেয়া যায়। টাকা তেমন কোন সমস্যা না, পকেটে চলনসই টাকা আছে। সমস্যাটা হচ্ছে নিজেকে কষ্ট দেয়ার অদম্য এক বুনো ইচ্ছা। বুনো ইচ্ছাকে গলা টিপে ধরার কোন আগ্রহই নেই যুবকের। মার্কেটগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গড়গড় করে দোকানের শাটার নামার শব্ধগুলি জানিয়ে দিচ্ছে রাত বাড়ছে। রাস্তাঘাট এরই মধ্যে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। যুবকটি নিজের মধ্যে বাড়ি ফেরার বিন্দুমাত্র তাগাদা বোধ করছে না। বাড়ি ফিরেই কি হবে; সেই একই পরিবেশ, একই ধরণের ক্লান্তিকর জীবনযাত্রা- অভিযোগ, অনুযোগ। ভাল লাগে না, কিচ্ছু ভাল লাগে না। যুবক একটানা হেঁটেই চলছে। ক্লান্তি বা অবসাদের কোন অভিব্যক্তি যেন কারো চোখে না পরে সেই সচেতন চেষ্টার নিরন্তর ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রেখেছে নিজেকে।
মাথার লম্বা, ঘন চুল ভেদ করে একেবারে খুলিতে ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ টের পেলো যুবক। প্রথমে এক ফোঁটা, তারপর দুই ফোঁটা, তিন ফোঁটা অবশেষে অগুনিত ফোঁটা অঝোর ধারার বৃষ্টির নির্মল শীতলতায় শরীর ভিজতে থাকে। অনিচ্ছার বাঁধ ভেঙ্গে নিতান্তই প্রবৃত্তির অলঙ্ঘনীয় টানে পাশের মার্কেটের সামনের খালি অংশে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়ায় সে। কিছুক্ষণ পরই মনে হল, এখানে এসে দাঁড়ানোটা মোটেই ঠিক হয়নি। গাদাগাদি মানুষের ভিড়, উচ্চস্বরে কথাবার্তা, ঘামের তীব্র গন্ধ অসহ্য লাগছে। এতরাতে এমনতর ভিড় অবাক করার মতো। রাত কটা বাজে- দশ কিংবা এগারো? অঝোর ধারাগুলি ক্লান্তিহীন উচ্ছ্বাসে মাটির আলিঙ্গনে আছড়ে পড়ছে। যেন কতকালের বিরহ যন্ত্রণার অনিঃশেষ আবেগটা খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হবে না। কতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে হিসেব করার কোন তাগাদা অবশ্য নেই। সময় যতটুকুই কাটুক না কেন বৃষ্টির তোড়ে এরই মধ্যে রাজপথে হাঁটু পানি জমে গেছে। ছোট আঙ্গিনায় আটকে থাকা শখানেক মানুষের মাঝে কয়েকজনের চিন্তিত অভিব্যক্তি, রাজনীতির চর্চা, সরকারের উন্নয়ন, দেশের জনগণের প্রতি সরকারের ভালবাসাহীনতা, প্রেমের গল্প, তর্ক-বিতর্ক সবকিছুই জমে উঠেছে। ভিতরের দিকে কয়েকটি মেয়ে চড়ুই পাখির মতো বিরতিহীনভাবে কিচিরমিচির করে যাচ্ছে। দুই একজন বাদে সবার মাঝেই কেমন উৎসব উৎসব ভাব। গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে থেকেই ফস করে পাশের একজন সস্তা ধরনের সিগারেট জ্বালালেন। বড় করে আয়েশি টানে এক লহমায় আশপাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দুর্গন্ধের ঝাপটাটা নাক বেয়ে সোজা মগজে ঢুঁকে যায়। ক্লান্তি আর মানসিক অবসাদে পা দু’টি এতক্ষনে শরীরের ভার বহনের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। একটু সামনে এগিয়ে এসে যুবক বসে পরল। বসতে না বসতেই হড়হড় করে বমি করা শুরু দেয়। কাছাকাছি থাকা মানুষগুলি আতংকে ছিটকে সরে পরে। উপস্থিত ভিড়ের দৃষ্টির শরজালে আচ্ছন্ন হয়ে আছে পরিবেশ। বিব্রত, লজ্জাকাতর দৃষ্টি দিয়ে উপস্থিত সবার দিকে ঘোলা চোখে অসহায়ভাবে একবার তাকায় যুবক। বিষয়টা সবাই বুঝলেও সমবেদনার উদারতা দেখানোতে সকলের প্রচণ্ড আপত্তি। ভিতর থেকে একটা মেয়ের পরিহাসের হাসি শুনতে পাওয়া গেল। অনেকেই প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠলো। যুবকের ইচ্ছে করছে ওখানেই শুয়ে পড়ে। সারা শরীরে কেমন কষ্ট কষ্ট আলস্য। রাস্তায় জমে থাকা পানির উপর নাক ভাসিয়ে শুয়ে থাকতে পারলে মন্দ হতো না।
রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় একটা রিকশা এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই গন্তব্যে যাবার জন্য রিকশা চালককে পিড়াপীড়ি করতে থাকে। প্রয়োজনে দ্বিগুণ ভাড়ার প্রস্তাবও দিচ্ছে কেউ কেউ। পলিথিনের আবরণে সারা শরীর ঢাকা রিকশাচালক বিকারহীন। অতি কষ্টে রিকশা টেনে ঠিক যুবকের সামনে এসে দাঁড় করায়। নির্বাক রিকশাচালক যুবকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। শরীর আর মুখের উপর পলিথিনের আবরণটা এমন নিচ্ছিদ্র নয় যে, হাত বা চেহারা আন্দাজ করা যাবে না। অথচ যুবক কিছুই দেখছে না, শুধু অনুভব করছে রিকশাওয়ালা শক্ত হাতে তার ডান হাতটি মুঠো করে ধরল। যুবকের সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। এ কার হাত! স্পর্শটা এতো পরিচিত, এতো আপন লাগছে কেন? হাতের মালিকের মুখটা দেখার জন্য উপরে তাকাতেই পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠলো। মাথা ঘুরে বাড়ানো হাতের উপর এলিয়ে পরে যুবক।
অর্ধ অচেতন অবস্থায় রিকশায় বসে আছে যুবক। রিক্সার হুড খোলা। এক হাতে রিক্সার হুড ধরে কোনমতে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টির ফোটা সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিক বোধটা পুরোপুরি জাগ্রত না হলেও যুবক বুঝতে পারছে রিক্সাটা টেনে নিতে চালকের প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। পলিথিনের আবরণে মোড়া চালকের বিশাল শরীরটায় কেমন যেন হাঁপ ধরা একটা অভিব্যক্তি। দূরে কোথায় যেন খুব জোরে বাজ পড়লো। সামনের দিক থেকে অতি পরিচিত উৎকণ্ঠিত ভরাট কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ ভেসে এলো-
বাবা, শরীরটা এখন কেমন? কিছু খাবেন? সামনের কোন দোকান থেকে কিছু খেয়ে নেন।
না, কিছু খাওয়া লাগবে না। শরীর ভালো আছে। রিক্সা টানতে খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি আপনার? বৃষ্টির মধ্যে এত রাতে রিক্সা নিয়ে বের হওয়াটা আপনার ঠিক হয় নি। এই বয়সে ঠাণ্ডা জ্বর কিছু একটা হয়ে গেলে আর রক্ষে নেই।
মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে যুবক স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে চালকের মুখে নিঃশব্দ বিচিত্র এক হাসির ঢেউ খেলে গেল। এটা কিভাবে হচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। চোখে দেখা গেল না, অথচ হাসিটা এতো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়লো কিভাবে!
শুনুন- আপনি কি আমার পরিচিত কেউ?
অবশ্যই আমরা পরিচিত। বহু বছর আগে থেকেই আপনার, আমার পরিচয়। আপনি রফিকুল ইসলাম, ডাকনাম রফিক। পরিচিত বলেই তো আপনার কাছে আসা। পনের বছর আগে আপনার মা মারা গেছেন। মায়ের মৃত্যুতে আপনি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট থেকে দূরে সরে থাকতে গিয়ে নিজের শরীরের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। কষ্টের সাথে নিজের তৈরি করা আরো কষ্ট যোগ করে সবকিছুকে অসহনীয় করে তুলছেন। একটানা কথাগুলি বলেই রিক্সাচালক অ-দেখা ঠোঁটে আন্তরিকভাবে হাসলেন।
একজন রিক্সাওয়ালার মুখে এমনতর কথাবার্তা কেমন যেন বেখাপ্পা গোছের। কিন্তু রফিকের কাছে এই মুহূর্তে এটাই খুব বেশি স্বাভাবিক লাগছে।
আচ্ছা, আপনিতো আমার নাম জানেন। মনে হয় আমার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানেন। আমি কি আপনাকে চিনি বা জানি?
আমিতো আগেই বলেছি, বহু বছর আগে থেকেই আপনার, আমার পরিচয়। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না? একেবারে যে চিনতে পারছি না, তা না। কিছুটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে- চেনা-অচেনার মাঝামাঝি কেমন একটা ধোঁয়াশা। অবশ্য মনে হওয়াটা ভুল করেও হতে পারে।
রিক্সাচালকের কাছ থেকে কোন উত্তর এলোনা। চুপচাপ ক্লান্ত ভঙ্গীতে অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রিক্সার প্যাডেল চাপতে চাপতে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
রফিক অবাক হয়। আস্তে আস্তে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করে সে। বোধ বুদ্ধির বদ্ধ দেয়ালটা খুব দ্রুতই খসে পরছে। এখন সে বুঝতে পারছে রিক্সা স্বাভাবিক চেনা রাস্তা ধরে যাচ্ছে না। অন্য কোন এক পথে তারা ছুটে চলছে। পথটা চেনা চেনা লাগছে, আবার পরক্ষনেই সম্পূর্ণ অচেনা, দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। বৃষ্টিহীন শুকনো খটখটে রাস্তা। বৃষ্টিটা থামলো কখন! বৃষ্টির বদলে নরম শীতল হাওয়া। জনমানবহীন স্তব্দ নীরবতা। নীলাভ জ্যোৎস্নার বন্যায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে- অপূর্ব, অপার্থিব সেই আলো! নিজেকে ফিরে পেতে পেতে নতুন করে অন্যরকমের এক ঘোরের ভিতর চলে যায় সে।
রফিক দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠের উপর আলোকিত একটা গাছের নিচে। গাছের সব পাতা সাদা, যেন প্রতিটা পাতায় একটি করে ছোট বাতি সাদা বাতি লাগানো। গাছের আলোয় নিজেও আলোকিত হয়ে আছে। দূর কোথা থেকে নাম না জানা পাখিদের কাঁপাকাঁপা সোনালি সুরের ঝর্ণা ঝরে পড়ছে। আকাশে ঘন মেঘ। মেঘ এতো ঘন হয়! মেঘের উপর সাদা মেঘ, তার উপর মেঘ। মেঘের সাদা ঘন আবরণ ভেদ করে কোথা থেকে যেন আলো আসছে, নীল রংয়ের নেশা জাগানো আলো। তবে সেটা সূর্যের আলো না জ্যোৎস্নার বুঝা যাচ্ছে না। ক্ষুধাবোধহীন, ক্লান্তিহীন অসাধারণ ভাললাগা সময়টা যেন স্থির হয়ে আছে। একটু দূরে ধবধবে সাদা পোষাকে শ্মশ্রুমণ্ডিত; পোষাকের মতোই ধবধবে ফর্সা লম্বা সুগঠিত একজন রফিকের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বহুবছর আগের এক টুকরা স্মৃতি ঝলক দিয়ে যায় রফিকের মস্তিষ্কে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। প্রশ্ন করে- আমি কোথায়?
তিনি স্নেহভরা চোখে রফিকের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন। বললেন, আমি জানি না। এটা কোন জায়গা, আপনি জানেন না, অথচ আমাকে নিয়ে এসেছেন। এসব কি বলছেন? হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। তবে এটাও সত্যিই আমি জানি না এটা কোন জায়গা। আমার প্রিয়জনদের কিছু সময়ের জন্য এখানে আসতে দেয়া হয়। অনুমতি পেলে নিয়ে আসি। তারপর যে যেখানে ছিল সেখানেই ফিরে যেতে পারে। অনুমতিটা কে দেয়? আমি জানি না। সত্যিই জানি না। তবে এখানে এসে এমন কিছু পাওয়া যায়, যা আপনাদের স্বাভাবিক জীবনে শুধুই কল্পনার একটা উপাদান মাত্র।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আপনি আমাদের মতো কেউ না? আমি আপনাদের মতোই, আবার আপনাদের থেকে অনেকখানি আলাদা।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি ব্যাখ্যা করে বলবেন। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। আর হাতেও খুব সময় নেই। আপনার যদি কোন ইচ্ছে থাকে তবে সেটা বলতে পারেন। আপনার ইচ্ছা পূরণ করা হবে।
ইচ্ছাটা কি আপনি পূরণ করবেন?
লোকটি হাসে। হাসির অর্থটা রফিকের কাছে অস্পষ্ট। আপনি কয়েকদিন যাবৎ প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কল্পনায় বারবার মায়ের মুখটি দেখতে চাইছেন- মায়ের মুখ, মা কিভাবে আদর করতো, ভালোবাসতো এসব মনে করতে না পারার প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় আপনি ভেঙ্গে পরেছেন। ব্যাপারটা হঠাৎ ই বড় বেশি করে আপনার ভিতরে তোলপাড় করে সৃষ্টি করছে।
লোকটার কথাগুলি রফিকের সারা শরীরে তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ যেন অমোঘ কোন কথা। তাঁর বলা প্রতিটা শব্দ অলঙ্ঘনীয়- সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। রফিক তির্যক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকায়। কি এক স্বর্গীয় অনুভূতি সারা দেহ জুড়ে। কোমল কণ্ঠে বলে উঠে, আমাকে একটিবার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন? আমার ইচ্ছে এটাই।
শুধুই মায়ের কাছে যাবেন? হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা উষ্ণ আর সহমর্মিতার এক অনাবিল সুরে কথাগুলি বললেন তিনি। তিনি হাসলেন- নিস্পাপ মানবশিশুর মতো সারল্যে- দৈন্যতাহীন আত্মিক সমৃদ্ধির ঝলমলে উচ্ছলতায়।
যুবকের ইতস্তত ভাব দেখে লোকটা বলে উঠে- আপনার পরিচিত কিছু মানুষের কাছে আপনি যাবেন- তবে সামান্য অতীত সময়ে। আপনার চেতনায় সদা জাগ্রত একজন, আরেকজন আপনার অবচেতন মনে গুটিসুটি হয়ে লুকিয়ে আছে, সে আরেকজন। আপনি ইচ্ছে করলেই অবচেতন মনের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে মিশে থাকা ওনাকে বুঝতে পারবেন না।
আমি যাব।
লোকটি হাসেন। বলেন, আপনি শুয়ে পড়ুন।
লোকটার এবারের কথায় কি যেন একটা জোরালো ভাব আছে এমন এক প্রচণ্ড, নির্মোঘ কথা- যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রফিক বিনা বাক্যব্যয়ে মোলায়েম সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে। আশেপাশের সবকিছুই সংগীতময়, মৃদু, কোমল। সুখকর কত চিন্তা, রঙ্গিন আবরণে সজ্জিত স্মৃতিরাজি মনের অতল গহবরে নেচে বেড়াচ্ছে; কি এক অদ্ভুত শান্ত অনুভূতি। নিজের অজান্তেই রফিকের দু’চোখ ভারী হয়ে আসে।
কতক্ষন, কতকাল পেরিয়েছে বুঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ বহুদিন আগের দুই রুমের ছোট এক ঘরে নিজের অবস্থান অনুভব করতে পারে। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই, সবকিছুই কেমন অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে- কিন্তু অনুভূতিতে একেবারে স্বচ্ছ, জীবন্ত। মাটির উপর পাটি বিছানো, এর উপর একটা চাদরে শুয়ে থাকা অসম্ভব সুন্দর একটা মুখ। কি এক অসহ্য যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত হয়ে পরছে। চোখগুলি লাল, জ্বলে ভরা। তিরতির করে কাঁপতে থাকা গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে। খুব ভয়ংকরভাবে শ্বাস নিচ্ছেন। যন্ত্রণা সইতে দাঁতে দাঁত ঘষছেন। রফিক একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা জন্ম-জন্মান্তরের পরিচিত। হ্যাঁ, উনিই তো সুফিয়া খাতুন- ওর মা।
ঘরে হুড়মুড় করে কয়েকজন মহিলা ঢুকলেন। বয়স্ক একজন মহিলা ত্রস্তব্যস্ত হয়ে হাঁক দিলেন- সময় হয়ে গেছে। কেউ একজন বাটিতে করে পানি নিয়া আস। বাড়ির সব গেলো কই? সব কি মরে গেছে?
শ্যামলা মতো লম্বা একজন তরুন ঘরে ঢুকলেন। চোখেমুখে তার বিষাদ, দিশেহারানো অভিব্যক্তি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন, চাচী আমাকে ডাকছেন।
কই ছিলা এতক্ষণ? তাড়াতাড়ি বাটির পানিতে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ডুবাও। এই পানি খেলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা বেরিয়ে আসবে।
নিজেকে সবসময়ই যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে গণ্য করে এসেছেন রহমত আলী। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ডুবানো পানি খেলে মায়ের পেট থেকে তাড়াতাড়ি বাচ্চা বেরিয়ে আসবে ব্যাপারটা হাস্যকর লাগছে। কিন্তু তিনি হাসতে পারলেন না। সুফিয়া খাতুনের চাপা গোঙ্গানির শব্দে তার হৃদয়ের অনুভুতির সবগুলো তন্ত্রীতে সাড়া জাগিয়ে দিলো। তিনি তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন এবং নিঃশব্দে পেয়ালায় ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ছুঁয়ে দিলেন।
বয়স্ক মহিলাটি বললেন, তুমি অহন বাইরে যাও। এই সময় পুরুষ মানুষের কাছে থাকতে নেই। রহমত আলী হাঁটু গেঁড়ে সুফিয়া খাতুনের মাথার দিকে বসলেন। মাথায় হাত রাখতেই ভয়ানক কষ্টে বিকৃত হওয়া রক্তচক্ষু মুখটি সহজ হয়ে এলো। চাদর খামছে ধরা হাত তুলে স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। হাত ধরতেই মুহূর্তের জন্য সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলো তার। মনের মধ্যে লজ্জা, ভয়ের ছিটেফোঁটা নেই। অথচ শরীরের প্রতিটি আড়ষ্ট পেশী তিরতির করে কাঁপছে। টানাটানা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদের সন্তানকে কখনো কষ্ট দিও না। রহমত আলী সবার অলক্ষে চোখ মুছে হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। সামান্য দুরত্বটুকু পার করা মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং অমানুষিক ক্লান্তিকর এক অধ্যায়। তিনি বসে আছেন। বাইরের যে কেউ হঠাৎ করে দেখলে স্থির মূর্তি ভেবে ভুল করতো। কিন্তু এই মুহূর্তে গভীর অস্থিরতায় তিনি কাতর হয়ে আছেন। ক্লান্ত একটা কণ্ঠ দূর থেকে ভেসে আসছে- ফুপু কি যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটু ধৈর্য ধর মা এইতো বাচ্চার মাথা বেরিয়ে আসছে। রহমত আলী দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। রফিকের খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাবার হাতটা ধরে বসে থাকে।
সবার সরব কণ্ঠের সম্মিলিত তানের মাঝেই বুঝা গেলো ছেলে হয়েছে। প্রায় আধঘণ্টা পর মোটা কাথায় মুড়িয়ে একটা মানব শিশুকে এগিয়ে দেন বয়স্ক মহিলা- এই নাও, তোমার বংশের প্রদীপ।
রফিক আশ্চর্য হয়ে যায়, আরে এটাতো আমি। বাচ্চার মনের কথাটাও নিজের অনুভূতিতে বেজে উঠছে। কুঁচকানো চোখ দুটি পিটপিট করতে থাকে- এ আমি কোথায় এলাম। এতো ঠাণ্ডা লাগছে কেন? চারিদিকে এতো আলো! এতো আলো! বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে উঠে সদ্যজাত রফিক। ফুপু এসে তাড়াতাড়ি রফিককে নিয়ে ওর মায়ের কাছে যাবার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন রহমত আলীকে। অতি সন্তর্পণে, সযত্নে আত্মজকে নিয়ে উঠে দাঁড়ান।
বিশাল এক খাটে সুফিয়া খাতুন আর তার স্বামী রহমত আলী শুয়ে আছেন। মাঝখানে তাদের একমাত্র সন্তান সাত বছরের রফিক। দুই একবার আলাদা শোয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাবা-মায়ের মাঝখানে না শুলে ওর ঘুম আসে না। পাশের ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে মটকা মেরে কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। তারপর নিজের ছোট বালিশটা নিয়ে দুজনের মাঝখানে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিজের জায়গাটা করে নেয়। সকালে উঠে মাঝখানে ছেলেকে দেখে দুজনে অবাক হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকবার এমন ঘটনার পর ওর শোয়ার জায়গাটা আগের স্থানেই বহাল থেকে যায়।
লেখাপড়ার প্রাথমিক ধাপ পেরুনোর পাশাপাশি পাড়াগাঁয়ের অবাধ স্বাধীনতার পুরোটাই ভোগ করার সুযোগ পায় রফিক। এমনিতে শান্ত আর নির্বিরোধী হলে কি হবে, মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে যে তখন কঠিন শাসন করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না সুফিয়া বেগমের। এইতো কয়দিন আগে কয়েকজন ছেলের সাথে মিলে মার্বেল খেলছিল। খেলার এক পর্যায়ে মতি নামের ছেলেটা অশ্লীল ভাষায় রফিককে গালি দেয়। গালির অর্থ বা মর্ম রফিক বা মতি বুঝে না। কিন্তু গালিটা যে চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সেটা ঠিকই বুঝে। গালি দেওয়াটা অন্যায় এবং খারাপ কাজ এটাও একটু আধটু আন্দাজ করতে পারে। তো, গালিটা মুখ থেকে বের হতে না হতেই হাতের কাছে থাকা মাটির শক্ত ঢেলাটা শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে মতির মুখে ছুঁড়ে মারে। একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। নাক ফেটে, ঠোঁট কেটে রক্ত পরছে। ও মারে, বাবারে ত্রাহি চিৎকারে রফিক ভয় পেয়ে যায়। ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে সেই দূরের বেঁটে হিজল গাছটার একটা শাখায় উঠে পড়ে। একটু স্থির হতেই কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। দুপুরের শান্ত নির্জনতায় ঘেরা জায়গার উপর বেঁটে হিজল গাছটা নাকি জ্বীন, পরীদের আস্তানা। ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ের হীমশীতল একটা স্রোত সর্বাঙ্গে ছুটোছুটি করতে থাকে। যত ভয়ই হোক, বাড়ি ফেরা যাবে না। মা যেন কেমন! কোথাও কোন কিছু ঘটলে- যেমন আজকের ঘটনাটাই যদি মা জানতে পারেন তাহলে কি হবে? বিচার আসার আগেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত না জেনে হাতের কাছ যা পেতেন তা দিয়েই একচোট পেটাতেন। বিচার আসার পর দ্বিতীয় দফা মারপিট। দ্বিতীয় পর্বের মারটা প্রথম পর্বের চেয়ে অবশ্যই বহুগুণ বেশি কঠিন হতো। এসব চিন্তা করতে করতে রফিকের খুব কষ্ট হতে থাকে। সবসময়ই এমন হয়। আজকে মতি শুধু শুধু যে খারাপ গালিটা দিল, সেটা কি সহ্য করার মতো? এসব বিবেচনা মা করবেন না। শুধু শাসন আর শাসন। যত ভয়ই লাগুক আর বাড়ি ফিরে যাব না। স্থির সিদ্ধান্ত নেয় রফিক। যদি পরীরা এসে ওদের দেশে নিয়ে যায় তাহলে আরও ভাল হয়। ও কোন বাঁধা দেবে না। ওরা হয়তো বাচ্চাদের এভাবে কখনো মারে না। চোখের নোনা জল ঠোঁট পর্যন্ত গড়িয়ে আসে। থুঃ করে থুতুর সাথে চোখের পানি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কতবার এমন করা যায়? চোখ থেকে পানি পড়া যে কিছুতেই বন্ধ হয় না। সময় গড়িয়ে যায়। একসময় ক্লান্ত, বিপর্যস্ত রফিক বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরের হিজল গাছের একটা মোটা শাখার উপর শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা প্রায় ছুঁইছুঁই। রফিকের ঘুম ভাঙ্গে। পশ্চিমের আকাশটা কেমন লালচে হয়ে আছে। দুপুরের নীরব প্রকৃতি কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হিজল গাছের স্থায়ী বাসিন্দা পাখিরা রফিকের উপর বেশ বিরক্ত মনে হচ্ছে। তারা ডাক চিৎকার আর ডানার জোর ঝাঁপটায় তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। রফিক আবার চারিদিকে তাকায়- শস্যবিহীন বিরান মাঠ। এতক্ষণে ক্ষুধাটা টের পাওয়া যাচ্ছে, সাথে পানির পিপাসা। পাশের আরেকটা হিজল গাছের আড়াল থেকে কিছু একটার টানা আর্তনাদে গা ছমছম করে উঠে। এটা কি শেয়াল না কুকুর? খুব কি কাছে এসে গেছে? এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ করছে না। খোঁজ করলে অবশ্যই কেউ না কেউ এখানে আসতো। বাড়ি থেকে কেউ আসলে সে কি না যেত! ক্লান্তি, ক্ষুধা আর প্রচণ্ড মন খারাপ মিলেমিশে কেমন যেন নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কতকাল ধরে এখানে পরে আছে। না, কেউ আমাকে ভালবাসে না, আমাকে দেখতে পারে না- আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকে রফিক। একরোখা একটা জেদ চেপে বসে- আর বাসায় যাব না। রাতেই দূরে কোথাও চলে যাব। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গালের ডান পাশটা কেমন সুড়সুড়ি দিয়ে উঠে- মুষ্টিবদ্ধ দুহাতের উল্টো দিক দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকে। অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা পানির বেগ কি আর হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়। হাতের চেটোয় বাঁধাগ্রস্ত চোখের পানির একটা ক্ষীণ ধারা হিজল গাছের গোঁড়ায় ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকে। কান্নার অদম্য বেগটা থামতেই শরীরটা আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পরে। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর দেহের চোখ দুটি আপনা আপনিই বুজে আসে। আবারো গাছের ডালে শুয়ে পরে সে। এই মুহূর্তে সে ভয়হীন সদ্য কৈশোরে পা দেয়া রফিক।
চারিদিকের অন্ধকারের আর একটা কোলাহলের মাঝে রফিকের ঘুম ভাঙ্গে। কয়েকজনের হাতে হারিকেন। দূর থেকে হারিকেনের ক্ষীণ আলোতে দলটার সামনে থাকা উদ্ভিঘ্ন চেহারায় ত্রস্ত হেঁটে আসা মা’কে চিনতে একটুও ভুল হলো না। তারা কি ওর অবস্থানটা দেখে ফেলেছে? আঁচল দিয়ে বারবার দুচোখ মুছা দেখে রফিকের মনে হলো মা কাঁদছেন। এতোগুলি লোকের সামনে ছেলের জন্য অসংকোচ কান্না রফিকের কাছে কেমন বেখাপ্পা লাগে। শত কষ্ট, জীবনের বাঁকে বাঁকে শত দুঃখের মাঝেও যে মা’কে কখনও কাঁদতে দেখেনি সে এমন করে এক দঙ্গল লোকের সামনে কাঁদবে!
সময় কাটতে থাকে, কোলাহল আরও জোরাল হয়। একজন চেঁচিয়ে উঠে ঐ তো গাছে কে যেন বসে আছে। সবার মাঝেই সন্ত্রস্ত একটা ভাব। আবছা অবয়বটার দিকে তাকিয়ে দলটা স্থির হয়ে যায়। একেবারে নিশ্চুপ হয় যায় পুরো একটা দল। কি এক অজানা ভীতি ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। শুধু একজন দৌড়াতে থাকে গাছটার দিকে। গাছের গোঁড়ায় এসে তীব্র চোখে একবার তাকিয়ে কান্নাজড়িত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠেন- নাম, হারামজাদা, এক্ষুনি নাম। রফিক ভয়ে ভয়ে ছোট একটা লাফ দিয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল প্রায়। সুফিয়া খাতুন এক ঝটকায় পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে বুকে টেনে নেন। এতো জোরে বুকে চেপে ধরেন যে রফিকের শ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে। বাঁধভাঙ্গা চোখের পানির তীব্রতায় রফিকের শার্টের বুকের দিকটা ভিজে উঠে। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। বাড়ির দিকে ছুটে চলা দল থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা ভেসে আসছে-
ছেলেটাকে নিশ্চিত জ্বীনে আছর করেছে। জ্বীন ই ছেলেটাকে হিজল গাছে উঠিয়ে রেখেছে। হুম ...... আশু মিয়ার ছেলেটারে কি আছাড়টাই না মারল গত বছর। তিনদিন জ্বরে ভুগে পোলাটা একেবারে মইরাই গেলো।
এমনতর অর্ধ সত্য, রং চড়ানো কথাবার্তা চালাতে চালাতে সবাই বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে। একজন বয়স্ক মহিলা জোরাল কণ্ঠে বলে উঠলো- কবিরাজরে খবর দেও কেউ। ঝাড়ফুঁক না দিয়া ঘরে যেন না উঠায়। আর কিছু যেন না খাওয়ানো হয়। এ যেন এক অমোঘ নির্দেশ। সুফিয়া বেগমের ভয় করতে লাগলো। ছেলেটার শুকনো মুখ আর এলিয়ে পড়া অবস্থা দেখে প্রাণটা ছটফট করতে থাকে।
লম্বা উঠানটা লোকে লোকারণ্য। বয়সভেদে জনা পঞ্চাশেক লোক জড়ো হয়ে আছে। কবিরাজ আসলেন। সাথে বিরাট এক কাপড়ের ঝোলা। পাটির উপর বসে সামনে থাকা রফিককে নির্দেশ দেন- আমার সামনে বস। সফেদ দাঁড়ি আর চওড়া গোঁফের আড়াল থেকে আসা ‘বস’ শব্দটা শুনে কেমন যেন হাসি পেয়ে যায় রফিকের। হাসিটা জোর করে থামিয়ে কবিরাজের নির্দেশ পালন করে- সরিষার তেল, শুকনা মরিচ, ঘিয়ের প্রদীপ জোগাড় হয়েছে?
নিম গাছের বেত, সেটা কই? ঘি না থাকলে মোমের প্রদীপ হলেও হবে।
কিছুটা সময় অপেক্ষার পর সমস্ত উপকরণ এনে হাজির করা হয়। উপস্থিত সবাই আতঙ্ক আর রহস্যভেদ দেখার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। কবিরাজ তেলের বাটিতে কিসব বলে জোরে ফুঁ দেয়। বাতিটা কানায় কানায় ভরা থাকলে নিশ্চিত কিছুটা তেল ছলকে মাটিতে ছিটকে পড়তো। কবিরাজ রফিকের নাকের ফুটোতে তেলের ছোঁয়া লাগিয়ে দেয়। মাথার চুলে, হাতে পায়ে কপালেও একটু করে তেল মেখে দেয়। রফিকের নাকটা কেমন যেন সুড়সুড়ি দিয়ে উঠে। ফিক করে হেসে ফেলে। কবিরাজ সামান্য মাথা দোলায়। মাথা দোলানোর মধ্যে বুঝিয়ে দেয় রফিকের মধ্যে যেটা আছে সেটা বড় বজ্জাত জ্বীন। একে ছাড়ানো সহজ হবে না। মরিচ পোড়া ধোঁয়া দিতে হবে। সরিষার তেলের মধ্যে দুটি শুকনা মরিচ চুবিয়ে মোমের প্রদীপের আগুনে পোড়াতে লাগলো। ঝাঁঝালো গন্ধে পুরো ঘরটা কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠে। রফিক কেশে উঠে। কবিরাজ মশায়ের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠে। এখন প্রশ্নপর্ব চালানো যায়।
তুই কোথা থেকে আসছস? কোথায় থাকিস?
রফিকের তরফ থেকে কোন উত্তর আসে না।
আরেকবার জিজ্ঞেস করব- বল, কোথা থেকে আসছস? এবারো নিরুত্তর থাকে রফিক। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এইতো কিছুক্ষণ আগে সবাই মিলে হিজল গাছ থেকে ওকে নিয়ে আসলো। এটাতো সবারই জানা।
সপাং করে বা হাতের উপরের দিকটায় বেতের তীব্র আঘাতটা টের পায় রফিক। সারা শরীরটা জ্বলে উঠে। চিৎকার করে উঠতে মন চাইছে। কিন্তু এতোগুলি লোকের সামনে সেটা বড় লজ্জার। অস্ফুট কণ্ঠে শুধু উফ করে উঠে। উফ শব্দের আড়ালে নিজের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়া তীব্র আঘাতটা লুকিয়ে রাখতে চায় যেন।
বল, তুই কোথা থেকে আসছস? কোথায় থাকিস?
এবারো আঘাতগুলি নীরবে সয়ে যেতে থাকে। শুধু চোখ দিয়ে সমস্ত কষ্ট গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। রফিক অপেক্ষায় থাকে কতক্ষণে আবার আঘাত শুরু হবে। চারিদিকে চোখ তুলে একবার দেখে নেয় মা কোথায়? কোথাও দেখতে পায় না। বেতের প্রথম আঘাতের পরপরই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না- তিনি অন্য ঘরে চলে গেছেন। মায়ের মন যে। এতোগুলি লোকের জ্বীন তাড়ানোর কঠোর প্রতিজ্ঞাকে তিনি কোন শক্তিতে ভাঙবেন? নিজে না হয় মাঝে মধ্যে শাসনের জন্য রফিককে পেটান। কিন্তু আরেকজনের হাতে ছেলেকে এমন মার খেতে দেখে কোন মায়ের প্রান সয়। মনেপ্রাণে রফিকের বাবার আসার প্রতীক্ষায় থাকেন।
কি, এই এসব কি হচ্ছে এখানে? ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন উত্তর দেয়- রফিকরে জ্বীনে ধরছে। কবিরাজ জ্বীন তাড়াচ্ছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে রহমত আলী কবিরাজের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকায়।
রহমত আলীর চোখের দিকে তাকিয়ে কবিরাজের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। রহমত আলীর সাথে কবিরাজের শেষ দেখাটা মোটেই মধুর ছিলনা। এইতো কয়দিন আগে একজনের জ্বীন তাড়াতে গিয়ে রহমত আলীর কি দাবড়ানিটাই না খেলো। বেত মারার জন্য উঁচিয়ে রাখা হাত উপরেই থেমে থাকে। রহমত আলীর মুখ বা হাত ব্যবহারের আগেই এক ঝটকায় নিজেকে কোনমতে দাঁড় করিয়ে পোঁটলা পাটলি নিয়ে পড়িমরি করে বেরিয়ে যায়। তার যাবার ভঙ্গিতে হাস্যকর কিছু একটা অবশ্যই ছিল, নইলে সবার হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা হবে কেন। বদ্ধ ঘরের গুমোট, ভীতিকর আবহাওয়াটা অকস্মাৎ কেটে যায়। সবার চোখে মুখে কেমন একটা উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি। রহমত আলী ছেলেকে কোলে তুলে কলতলা নিয়ে যান। নিজ হাতে গোসল করিয়ে ঘরে নিয়ে আসেন। সুফিয়া বেগমকে ভাত দেবার তাগাদা দেন।
ভাত খেতে খেতে ছেলের মুখ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নেন। রফিক আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে ওর বাবার মুখে চমৎকার এক হাসি ফুটে রয়েছে।
তো হিজল গাছে উঠলি কিভাবে? সবচেয়ে নিচু ঢালটাও তো দশ হাত উপরে?
কি জানি কিভাবে, কখন যে উঠে গেছি টের ই পাইনি। রহমত আলী হো হো করে হেসে উঠেন। তাহলে কোন জ্বীন না হয় পরী তোকে উঠিয়ে দিয়েছে। পরে এসে নিয়ে যেত। এবার বাপ-বেটার হাসিতে ঐকতান আসে। দুজন মাখা ভাত রেখে প্রচণ্ড হাসতে থাকে।
সুফিয়া খাতুন আঁচলে মুখ ঢেকে কপট রাগে বলে উঠেন- হয়েছে এবার দুজনে ভাত খাও। তোমাদের জ্বীন, পরীরা তো আর রফিককে কিছুই খাওয়ায়নি। কিরে রফিক কিছু খাইয়েছে নাকি- বলেই শব্দ করে হেসে উঠলেন।
জ্বীন, পরীরা তো আসেই নি। খাওয়াবে কি? মা, কবিরাজ বেটা বাবাকে দেখে কিভাবে দৌড় দিয়েছে দেখেছ?
আবারো হাসির ফোয়ারা। সামান্য কথাতেই তিনজনের সম্মিলিত হাসিতে ঘরটা ঝলমল করে উঠে।
রফিকের বয়স এখন দশ বছর। নিরুদ্বিগ্ন জীবনে যে ছোটখাটো কোন ঝড় বয়ে যায়নি তা না। কিন্তু তাতে ওদের শান্ত জীবনে গভীর কোন আঁচড় ফেলতে পারেনি। এই যেমন গত বছর ওর বোনের জন্ম হলো। নাম রাখা নিয়ে তিনজনের সেকি হুলস্থূল! রহমত আলী চেয়েছিলেন মেয়ের নাম রাখবেন- পারুল। সঙ্গে সঙ্গে মা, ছেলের তীব্র প্রতিবাদ। এটা আবার কেমন নাম। এ নাম রাখা যাবে না। সুফিয়া বেগম স্বামীর নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখতে চাইলেন রাহেলা। রহমত এর ‘র’ টা থাকায় নামের মিলটাও স্পষ্ট। এবার রাহেলা নাম নিয়ে বাপ, ছেলের তীব্র অনীহা প্রকাশ পেতে থাকে। নামটা কেমন যেন- ক্ষেত ক্ষেত লাগে। সুফিয়া বেগম মুখ অন্ধকার করেন। কিন্তু বাপ, ছেলের মন তাতে বিন্দুমাত্র গলে না। অবশেষে ছেলে তার মতামত দিল- আমার বোনের নাম হবে মিতা।
লেখাপড়ার ব্যাপারে রফিকের অপরিসীম আগ্রহ দেখে সুফিয়া বেগম আর রহমত আলীর মনটা সবসময়ই চনমনে থাকে। কোন এক শীতের সকালে রহমত মিয়া ছেলেকে ডেকে বললেন, তোর মা’র নাস্তা বানানোর কতদূর?
রান্নাঘর থেকেই সুফিয়া বেগম উত্তর দেন, দেরি হবে। বেশী ক্ষুধা লাগলে বাজার থেকে খেয়ে এসো।
কথা শেষ হতে না হতেই রহমত মিয়া রফিককে বললেন, চল বেটা, আজ তোকে দারুন একটা খাবার খাওয়াবো।
কি খাবার বাবা?
আগে চলতো। তারপর দেখবি কি খাবার!
রফিকের গায়ে ফুলহাতা লাল সোয়েটারটা পড়িয়ে নিজে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলেন। রাস্তায় বেরিয়েই ঠাণ্ডা বাতাস বাপ-ছেলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দু’জনে বাজারের দিকে রওনা দেয়।
কিরে বেটা, শীত লাগছে?
রফিকের অদেখা, অজানা বিশেষ খাবারের উত্তেজনায় ঠাণ্ডাটা খুব বেশী অনুভব করছে না। কিন্তু শরীরের কয়েকটা প্রত্যঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। রহমত মিয়া চাদরটা গা থেকে খুলে ছেলের গায়ে জড়িয়ে দিলেন। রফিকের তরফ থেকে আসা বাঁধাটা তিনি মোটেই আমলে নিলেন না। রফিক আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে, তার বাবার কাঁপুনিটা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রাণপণে দুহাত ঘষছেন আর কিছুক্ষন পরপর দুহাত মুঠো করে মুখের সামনে নিয়ে ফু দিচ্ছেন। বাবার জন্য রফিকের খুব মায়া হতে লাগলো। বাবাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়- চাদরের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে এবার নিশ্চিত কড়া কিছু শুনতে হবে।
মনা মিয়ার রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রথমে পরাটা বানানোর তাওয়ার উপর হাত রেখে হাত দুটি সেঁকে নিয়ে রহমত মিয়া স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মালাই হয়েছেরে আওলাদ?
হইছে চাচা।
আমাদের বাপ-বেটাকে দুই প্লেট মালাই আর কড়া ভাজা পরাটা দে।
আওলাদ দুই প্লেট মালাই আর সদ্য কড়াই থেকে নামানো আগুন গরম পরাটা রেখে যায়। রফিক পারাটায় হাত বাড়াতেই রহমত আলী হা হা করে উঠেন। রফিক হাত সরিয়ে নেয়। রহমত আলী রফিকের প্লেট থেকে পারাটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছেলের প্লেটে দিলেন- এইবার খা। আরেকটু হলেতো হাতটাই পুড়িয়ে ফেলতি। রফিক মালাইয়ে পারাটার টুকরা মিশিয়ে মিশিয়ে মুখে দিচ্ছে। কিরে, খেতে কেমন লাগছে।
মুখভরতি পারাটা নিয়েই কোনমতে বলে খুব ভালো, অনেক অনেক ভালো। বাবা, মা’র জন্য নেবে না?
হুম, মা’র জন্য এক প্লেট নেয়া যায়।
খাবার পর্ব শেষ হতেই মালাই চায়ের অর্ডার করেন রহমত আলী। কিরে চা খাবি?
কি?
মা জানলে ধোলাই দেবে।
তুই না বললে তোর মা বুঝবে কিভাবে?
মাকে তো চিন না। আমার দিকে তাকিয়েই বুঝে ফেলবে কি খেয়েছি। তাই নাকি। তাহলে তো পরীক্ষা করতে হয়।
আওলাদ এক কাপ চা এনে রাখে রহমত আলী আর রফিকের সামনে। রহমত আলী অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আধাকাপ চা পিরিচে ঢাললেন। পিরিচটা সামান্য ঠেলে দিয়ে রফিককে বললেন চা খা।
দু’হাতে পিরিচের দুইপাশ ধরে মুখের সামনে নিয়ে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে ফুঁ দেয় রফিক। ছলকে কিছুটা চা টেবিলের উপর পরে যায়।
রহমত আলী হেসে ফেলেন। আরে বোকা, হুজুররা পানি পড়া দেবার সময়ও এতো জোরে ফুঁ দেয় না। আস্তে ফুঁ দে। বাবার কথায় রফিকের হাসি এসে যায়। হাসতে গিয়ে চায়ের পিরিচটা টেবিলের উপর ফেলে দেয়। চায়ের কিছুটা অংশ রফিকের সোয়েটারের হাতায় এসে লাগে। রফিকের অপ্রস্তুত মুখ দেখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে রহমত আলী জিজ্ঞেস করলেন- এটা কি হলো?
বাবা, ভুল করে হয়ে গেছে। ভুল যখন হয়েছে তখন আরেক কাপ চা আনাই। এই আওলাদ, আরেক কাপ চা দে। তার আগে টেবিলটা মুছে দে।
দ্বিতীয় কাপের চায়ের অর্ধেকটুকু আবার পিরিচে ঢেলে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দেন। আলতো করে ছেলের পিঠে হাত রাখেন। একটা ভরসার হাত। রফিক স্বাভাবিক হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে ফুঁ দিয়ে চা ঠাণ্ডা করে পিরিচের চা খেতে থাকে। একসময় চা শেষ হয়। পিতার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি দেয়। হঠাৎ করেই রফিকের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সোয়েটারে চায়ের দাগ- মা দেখলে আজ বাপ-বেটা দুজনেরই খবর আছে। পুত্রের দুশ্চিন্তা টের পান রহমত আলী। বলেন- দূর বেটা, চিন্তা করে কি হবে। যখনকার যা ঘটবে তখন দেখা যাবে। আগেভাগে দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কি দরকার। বাবার প্রতিটা কথার মধ্যে কি এক দৃঢ় আশ্বাস আছে। পুত্রের দুশ্চিন্তা দূর হয়। রহমত আলী বলেন- আজকের নাস্তাটা কেমন হলো রে রফিক?
দারুন।
ওদের মালাই পারাটা আরেকদিন খেতে হবে তাই না? উচ্ছসিত কণ্ঠে রফিক বলে, হুম, আবারো খেতে হবে।
রহমত আলী আওলাদকে ডেকে বললেন, আরেক কাপ মালাই দে বাড়িতে নেব।
মালাই শেষ।
মালাই শেষ কথাটা যেন প্রচণ্ড আঘাত করে রফিককে। মনে হয় এই দুঃখ রাখার জায়গা ওর ছোট দেহটাতে নেই। কেঁদে ফেলবে মনে হচ্ছে।
রহমত আলী আওলাদকে বললেন, সন্ধায় দুই কাপ মালাই রাখবি। কোন ভুল যাতে না হয়। বাবা, আজ বাজার করবে না। তোর মা তো কিছু বলল নারে। চল খালের ওদিকে যাই। যাবি?
চল যাই।
দুজনেই দক্ষিণমুখী হাঁটতে শুরু করে। অনেকটা সময় পর রফিকরা একটা নালার মতো জায়গায় এসে দাঁড়ায়। বাবা খালের পানি কই?
পানি শুকিয়ে গেছে। বর্ষা আসলে একেবারে ভরে যাবে। এখন শীতকালতো, তাই হাঁটু পানি।
রফিক পানির দিকে তাকিয়ে দেখে একেবারে ঘোলা, কাদামাটিতে ভরা। একেবারে নীচের কাদামাটি, ছোট পাথরের টুকরা, ইটের টুকরা কিছুই দেখা যায় না। বয়স্কদের সাথে ওর সমবয়সী কয়েকজন ছেলে-মেয়ে হাঁটু পানিতে উপুড় হয়ে কি যেন খুঁজছে।
বাবা, ওরা কি করছে?
ওরা মাছ ধরছে। এই পানিতে খালি হাতে মাছ ধরা যায়। কি, মাছ ধরবি?
রফিক একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। পানিতে নামতে শতেক বাঁধা, এর মধ্যে আবার মাছ ধরার কথা বলছেন। ব্যাপারটা কেমন যেন। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে রফিক বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। এবার যেন সাহস ফিরে পায় রফিক। গায়ের সোয়েটার আর শার্ট খুলে বাবার হাতে দিয়ে সেন্ডো গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট হাঁটু অবধি গুঁটিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত দলটার সাথে মিশে যায়। সবাই দুই হাত নামিয়ে উপুড় হয়ে মাছ ধরছে। পুঁটি, খলসের মতো মাছ। রফিক হালকা স্রোতের বিপরীতে ওদের পিছে পিছে দুহাত নামিয়ে উপুড় হয়ে হাঁটতে থাকে। দু’একটা মাছের ছোঁয়া হাতে লাগলেও ধরতে পারে না। আস্তে আস্তে মন খারাপ ভাবটা বাড়তে থাকে- এতক্ষণ হলো, সবাই কত মাছ ধরল আর ও একটা মাছও ধরতে পারল না। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে পাড়ে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকায়। বাবা মিটিমিটি হাসছেন। হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। রফিকের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। বাবা কি আর সময় দেবেন না?
তুই তো আচ্ছা বোকারে- দলের পিছনে থাকলে মাছ পাবি? তোকে সামনে থাকতে হবে। স্রোতের টানে যে মাছগুলি আসে ওগুলি তো সামনের সবাই ধরে ফেলে।
যা, চেষ্টা করবি সামনে থাকতে।
রফিক আবার খালের ঘোলা, কাদামাটিতে নামে। এইবার সবার সামনে গিয়ে দু’হাত পানিতে নামিয়ে দেয়। কতরকমের মাছ হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। একটা মাছ ওর ডানহাতের তালুতে আটকে যায়। ওটা মুঠোবন্ধ করে ধরে উপরে উঠে আসে। বাবা মাটিতে লেপটে বসে আছেন। মাঝারি আকারের পুঁটি মাছটি দেখিয়ে রফিক চেঁচিয়ে বলে- বাবা এই যে, মাছ ধরেছি। এটা রাখবো কোথায়?
রহমত আলী এবার নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। রফিক এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা তালগাছ দেখতে পায়। মাছটা একটু দূরে রাখলেই ভালো হয়। নয়তো ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে পানিতে চলে যাবে। তালগাছের গোঁড়ায় একটা ছোট মতো গর্ত। গর্তে মাছটা রেখেই আবার পানিতে নামে। প্রতিবারই দু’হাত দিয়ে নানা রকমের মাছ এনে গর্তে রাখে। এইবার একটা ছোট শোল মাছ পেয়েই উঠে গর্তে রেখে আসে। গোনাগুনতি না করে কতবার যে মাছ আনল- গর্তটা একেবারে ভরে ফেলেছে প্রায়। রফিক হাঁপিয়ে উঠেছে। এবার আর পানিতে না নেমে বাবার পাশে এসে বসে। খালি গা, সারা গায়ে কাদা মাখামাখি। উপরের সূর্যটা মৃদু আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সূর্যের তাপে শরীরটাও যেন আলস্যে ভরে গেছে। বাবার কোলে মাথা রেখে কাদামাটি মাখা শরীরটা ছেড়ে দেয়। রহমত আলী ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর রফিক কঠিন এক অস্থিরতার মধ্যে জেগে ওঠে। বাবা, আমার মাছগুলি?
তোর মাছগুলি সব ঐ তালগাছের পাশের গর্তে আছে?
তুমি খেয়াল রেখেছ? কেউ নিয়ে যায়নি তো।
আমি খেয়াল রেখেছি। কেউ নেয়নি।
বাবা, মাছগুলি দেখলে মা খুব খুশি হবেন, তাইনা?
কি জানি, কিছুই বলা যায় না।
বাবা, মাছগুলি কিভাবে নেয়া যায়?
তাইতো, এখন মাছগুলি কিভাবে নেয়া যায়?
আমার শার্টে করে নেই?
তা নিতে পারিস। তবে, তোর মা শার্ট নষ্ট করলে কি করে কে জানে।
চল মাছ নিয়ে যাই। ভয়ে ভয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, মা কি খুব রাগ করবে? রাগ করলে আবার পিটুনি না দেয়।
চলতো দেখি। যখনকারটা তখন বুঝা যাবে।
তালগাছের কাছটাতে গিয়ে গর্তের দিকে তাকাতেই বাপ-বেটা আশ্চর্য হয়ে দেখে সেখানে একটা মাছও নেই। শুধু খানিকটা পানি দেখা যাচ্ছে।
বাবা মাছগুলি কি ভূতে নিয়ে গেছে?
যুতসই কোন উত্তর না পেয়ে রহমত আলী চুপ করে থাকেন। তিনি বললেন, মনে হয় গর্তটা অনেক বড়, অনেক নীচে চলে গেছে। মাছগুলিও হয়তো গর্তের নীচে ঢুঁকে গেছে। কথাগুলি ছেলেকে স্বান্তনা দেবার জন্য বললেও নিজে কতটুকু বিশ্বাস করলেন নিজেই বুঝতে পারছেন না। রফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ছেলেটা এতক্ষণ ধরে কত শখ করে মাছ ধরল!
সাধু বাবু, এই যে সাধু বাবু।
আপনার মাছগুলি বিক্রি করবেন।
নাগো বাবা, আজ এগুলি দিয়েই রান্না হবে।
অর্ধেক মাছ বিক্রি করনা?
সাধু বাবু মাথা নেড়ে নাসূচক জবাব দিয়ে মাছের ঝুড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। একরাশ হতাশা নিয়ে রহমত আলী বললেন, চল বাজারে যাই। গিয়ে দেখি কিছু মাছ পাওয়া যায় কিনা।
তোমার কাছে টাকা আছে?
এবার আরও বেশি হতাশা নিয়ে মুখ অন্ধকার করে রহমত আলী মাথা নাড়লেন- তার কাছে টাকা নেই।
বাড়িতে ঢুকতেই সুফিয়া বেগম একদৃষ্টিতে কাঁদা মাখা রফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রহমত আলী শঙ্কিত বোধ করলেও সুফিয়া বেগম তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেও কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। ছেলেকে টেনে হেঁচড়ে কল পাড় নিয়ে গেলেন। বালতিতে গরম পানি মিশিয়ে ধুন্দল গাছের ছোবায় সাবান মেখে ডলে ডলে গোসল করাতে লাগলেন। রফিকের কাছে আজ ছোবার ডলাটা একটু জোরে জোরে হচ্ছে বলে মনে হলো। গা জ্বলছে, ফর্সা গা জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে আছে।
একসময় গোসল শেষ হয়। সুফিয়া বেগম ছেলের সারা শরীর মুছে দিয়ে সরিষার তেল মেখে দেন। সুফিয়া বেগমের চোখ, মুখ এখনও শক্ত হয়ে আছে। রফিক কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। টানা বারান্দায় জলচৌকির উপর রহমত আলী বসে আছেন। তার চেহারাটাও ভাবলেশহীন। যেন তিনি এই পৃথিবীতে নেই। অন্য কোন জগতে অবস্থান করছেন তিনি।
কেউ কি দয়া করে রফিককে জামাকাপড় পড়িয়ে দেবে? কথাটা রহমত আলীর দিকে তাকিয়ে না বললেও যে কেউ বুঝে নেবে কথাটা তাকেই বলা হয়েছে।
রহমত আলী চুপ করে থাকেন। চোখের দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দেন কাজটাতে তার কোন আপত্তি নেই। সুফিয়া বেগম ছেলেকে ঘরের দিকে ফেরত পাঠিয়ে নিজে রান্নাঘরে ঢুকলেন। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকা ছেলেকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বারান্দা থেকে ঘরের দিকে রওনা হলেন রহমত আলী। নিজের শরীরের উত্তাপ দিয়ে ছেলেকে উষ্ণ করার প্রাণপণ চেষ্টা। ছোট একটা আলনা, সেখান থেকে ছেলের শার্ট, প্যান্ট আর সোয়েটার নামিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে শরীরের উপর ভারী একটা কাঁথা দিয়ে বললেন, তুই একটু শুয়ে থাক আমি গোসল করে আসি। ঘুমিয়ে যাসনে আবার। রফিক হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে কাঁথার ওমে আয়েশি ভঙ্গীতে শুয়ে থাকে। ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে বাইরে এসে দেখেন বালতি ভরা। পানিতে হাত দিতেই বুঝলেন সেখানে পরিমান মতো গরম পানি মেশানো। চুলায় রান্না বসানো সুফিয়া বেগমের পিঠটা দেখা যাচ্ছে। রাগ, দুঃখের সময়েও স্বামীর জন্য প্রয়োজনীয় কাজটি করে গেছে সে। রহমত আলী মগ দিয়ে বালতি থেকে পানি তুলে গায়ে, মাথায় ঢালতে লাগলেন। আরামদায়ক পানি ঢালার আনন্দে শরীরটা কেমন করে উঠলো। অন্যরকম এক অনুভূতি- অপার্থিব অনুভূতিতে সমস্ত শরীর, মন জুড়িয়ে যায়।
বিকেল বেলা বুড়িগঙ্গার পারে পাকা সিঁড়ির দুই পাশের উঁচু দেয়ালের একটিতে পা বিছিয়ে বাপ, ছেলে বসে আছে। ওদের সামনে দিয়ে গুণ টেনে যাচ্ছে তিনজন লোক। দূরে রংচঙে পাল তুলে হাল ধরে বসে আছে মাঝি।
বাবা, এই লোকগুলি কি নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, ওরা ঐ যে বড় নৌকাটা দেখছিস ওটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকগুলি খালি পায়ে, গুণ টানতে ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না বাবা।
হ্যাঁ বাবা, ওগুলি টানতে খুব কষ্ট।
বাবা, বাবা দেখ।
কি?
লোকগুলি খালি পা। ভাঙ্গা ইটের উপর দিয়ে যাচ্ছে কিভাবে? যদি কোথাও কাঁটা বিঁধে। ওরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেরে বেটা। ওদের সয়ে গেছে।
ওদের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হবারই কথা। সেই কতদূর থেকে নৌকা টেনে নিয়ে আসছে। কতদূর যেতে হবে! একটা অদ্ভুত ভাবাবেগে ডুবে যান রহমত আলী।
হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে ওঠে রফিক। বাবা ঐ যে বাঁশের ভেলা। কত লম্বা! এগুলি কোথায় যাবে? তা জানি না। তবে এসেছে অনেক দূর থেকে, যাবে অনেকদূর। রফিক দেয়ালে দাঁড়িয়ে কপালে হাট রেখে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটাকে আড়াল করে ভালভাবে বাঁশের লম্বা ভেলাটাকে ভালমত দেখতে চায়।
রফিক, সাবধান। নিচে কোন পানি নেই, সোজা মাটিতে গিয়ে পড়তে হবে- ছেলেকে সাবধান করে তিনি তাকিয়ে থাকেন হেঁটে যাওয়া গুণটানা মানুষগুলির দিকে। আহারে! সত্যিই কি অমানুষিক কষ্ট করতে হয় এদের। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে মনটা উদাস হয়ে যায়। বাবা, তুমি কি কাঁদছ? নারে বেটা, কাঁদব কেন? এসব দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে।
বাবা, দেখ দেখ, ভটভট করে একটা নৌকা যাচ্ছে। গুণটানা নৌকাকে পিছনে ফেলে এগুচ্ছে। ওগুলি কি বাবা?
ওগুলি ইঞ্জিনের নৌকা। একদিন গুণটানা নৌকার চল উঠে যাবে। তখন সবাই ইঞ্জিনের নৌকা চালাবে।
কত জোরে শব্দ করে নৌকাগুলি। মাছেরা ভয় পায় না।
অবশ্যই ভয় পায়। যখন সব নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো হবে তখন হয়তো মাছদের আর দেখা যাবে না।
মাছের ভবিষ্যৎ চিন্তায় বাপ, ছেলে দুজনেই মগ্ন হয়ে আছে। পশ্চিম আকাশের সূর্যটা একসময় ডুবে যায়। রহমত আলী আর তার ছেলে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেন। দুজন চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
নিজের মতো ছেলেটাকেও বাউন্ডুলে বানিয়ে ফেলবে নাকি? যখন তখন ছেলেকে নিয়ে কোন চুলায় যায়- মন্তব্যের কঠিন সুরে কথাগুলি বললেন সুফিয়া বেগম।
হ্যাঁ, এই জীবনই ভাল। মমতাময়ী স্ত্রী, দুইটি মিষ্টি ছেলেমেয়ে, খাওয়া পড়ার তেমন কোন চিন্তা নেই। এক জীবনে ভাল থাকার জন্য আর কিছু লাগে নাকি? রফিক তোর মাকে বলে দে আমরা কোথায় ছিলাম, কোন চুলায় গিয়েছিলাম।
থাক আর বলতে হবে না। যে সংসার আমার, তা নিয়ে আবার এতো বাহাদুরি! ঘরে যে তরকারি নেই সেটা কি কারো জানা আছে। সেই সকাল বেলাতেই বলে দিয়েছিলাম বাজার করতে, রাতে খাবে টা কি? আমার মাথা দিয়ে?
রহমত আলী মাথা নিচু করেন। সত্যিই মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তিনি তাড়াতাড়ি গায়ে শার্ট চড়ালেন।
এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় যাচ্ছ? সন্ধ্যায় বাজারে যাবার দরকার নেই। কাল সকালে গেলেও হবে। কথায় মমতার একটা টান আছে, টের পান রহমত আলী।
সকালে আবার কোন ভেজাল লাগে। এখন গেলে কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। বল, কি কি আনতে হবে।
সুফিয়া বেগম ছোটখাটো একটা লিস্ট ধরিয়ে দেন। লিস্টের দিকে তাকিয়ে রহমত আলী বলেন, এতো সদাইপাতি! এখন গেলে সবকিছু পাওয়া যাবে না। অনেক দোকানই সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে যায়। এজন্যই তো বলেছিলাম, সকালে গেলেও হবে।
তাহলে রাতের খাবার কি? ডিম ভাজা আর মুগডাল আছে। ডিমভাজা রফিকের প্রিয় খাবার। সে পড়ার টেবিল থেকে চেঁচিয়ে বলল, মা রাতে ডিমভাজা আর ডাল দিয়ে ভাত খাব।
রহমত আলী কাঁধ ঝাঁকালেন। বললেন, তাহলে তাই হোক। বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি।
সুফিয়া বেগম জোর গলায় বললেন, এখন তুমি কোথাও বেরুবে না। এই আমার সাফ কথা। এখন গিয়ে রাজ্যের বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেবেন। ফিরবেন ঘুমানোর সময়। আচ্ছা, ছেলেমেয়েদের সাথে খেতে কি তোমার ভাল লাগে না? তুমি বস, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। বাজারে যেতে হবে না।
রহমত আলী হতাশ ভঙ্গিতে খাটের একপাশে বসে পড়েন। হাতে থাকা শার্টটা খুলে আলনায় রাখেন।
রাতে খুমোবার সময় সুফিয়া বেগম বলে, বাড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছে। রুনার বিয়ের পাকা কথাবার্তা হবে। আমি ক’দিনের জন্য বাবার বাসায় যাব। কয়দিন মানে?
সপ্তাখানেকের জন্য যাব। এতদিন থাকবে! আমি এখানে একা একা কিভাবে থাকবো। তুমিও সাথে চল।
শ্বশুরবাড়িতে এতদিন থাকা সম্ভব না। ওখানে ঠিক স্বস্তি পাই না। তাহলে আমাদের দিয়ে আস। আবার এক সপ্তাহ পর গিয়ে নিয়ে আসলেই হবে। আমি রহিমা বুবুকে বলে দেব, তিনি তোমার খাবার রেঁধে দেবেন।
রহমত আলী মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, একেবারে এক সপ্তাহ থাকতে হবে। ঘর অন্ধকার থাকায় রহমত আলী সুফিয়া খাতুনের হাসিটা দেখতে পেলেন না। সুফিয়া বেগম জানেন, তিনি না থাকলে রহমত আলী কিরকম ছটফট করেন। একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় সুফিয়া খাতুনের সমস্ত অন্তরাত্মা জুড়ে। ঘুমন্ত রফিককে একপাশে সরিয়ে স্বামীর কাছাকাছি যান। পরম মমতায় স্বামীর বুকে হাত রাখেন। বুকের উপর রাখা হাতের উপর রহমত আলী একটা হাত রাখেন।
সকালে রওনা দিয়ে সুফিয়া খাতুনের বাবার বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সুফিয়া বেগম আগেই তাদের আসার কথা ও বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা সে বাড়িতে যেতে না যেতেই যেন আনন্দ উৎসবে পুরো বাড়িটা ঝলমল করে উঠে। কতদিন পর ওরা এ বাড়িতে আসলো! রহমত আলীর শ্বশুর সকালেই পুকুর থেকে মাছ উঠিয়েছেন। অনেকদিন পর বিশাল এক শোল মাছ উঠেছে। খাবার সময় মুরগী, মাছ আরও কতো যে পদ দিয়ে পরিবেশন করেছেন দেখেই রফিকের আনন্দ চিৎকার ভেসে আসে- এতো খাবার! রফিককে ওর নানা পাশে বসিয়েছেন। তিনি জবাব দিলেন খা শালা, দেখি কতো খেতে পারিস।
তুমি আমাকে শালা বললে কেন?
তিনি রফিকের নানীর দিকে ইশারা করে বললেন, এই যে, উনি তোর বোন না। তোর বোনকে বিয়ে করেছি তাই আমি তোর দুলাভাই আর তুই শালা।
উনি তো আমার নানী হন। নানী তো বোনের মতো।
যাহ্, তুমি যা বলনা নানাজান! তোমাকে দুলাভাই ডাকতে পারবো না। তুমি নানা- তোমাকে নানা ডাকবো সেটাই ঠিক- কথাটা বলেই মেয়ের জামাইয়ের পাতে খাবার তুলে দিতে থাকা নানীর দিকে তাকায়। নানী নাতির কথায় পূর্ণ সমর্থন জানায়। তুই ঠিক বলেছিস ভাই। লোকটা বেশি কথা বলে- বলেই মুখের হাসি লুকাতে আঁচলের কোণা দিয়ে মুখ ঢাকেন।
দেখেছিস শালা, তোর নানী তোকে ভাই বলেছে- তাহলে কি হল, তুই আমার শালা, হা হা হা। উচ্চগ্রামের হাসিতে খেতে থাকা সবাই ওদের দিকে মুখ তুলে তাকায়। হেরে গিয়ে রফিকের মনটা অবশ্য একটু খারাপ। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। রফিকের নানা বললেন, থাক গোমড়া মুখে বসে থাকতে হবে না, তুই আমার শালা না, তুই আমার দুলাভাই আর আমি তোর শালা।
আমিতো এখনো বিয়ে করিনি, তাহলে আমি তোমার দুলাভাই হলাম কিভাবে? কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে নাতির দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন তর্কে বিশাল ঠক খেয়েছেন। ঠিক আছে, তর্ক বন্ধ, এখন খা। রফিক খুশি খুশি ভাব নিয়ে খেতে বসে।
রহমত আলীর দিয়ে তাকিয়ে রফিকের নানা বলেন, বাবা এতদিন পর এসেছ এবার কিন্তু কয়েকটা দিন থেকে যেতে হবে।
না আব্বা, ওখানে অনেক কাজ আজই ফিরে যেতে হবে।
সুফিয়া খাতুনের মা আঁতকে ওঠার মতো করে বলেন, এটা কেমন কথা বাবা, অন্তত আজকের রাতটা থেকে যাও। সুফিয়া বেগম রহমত আলীর চলে যাবার বিষয়টা তার মাকে কোন এক ফাঁকে জানিয়ে রেখেছিল বলেই তিনি সময়টা সংক্ষেপ করে দিলেন। রহমত আলী একই বাক্য পুনরায় বললেন, না আম্মা আমাকে আজই যেতে হবে।
বিষণ্ণ কণ্ঠে রফিকের নানি বললেন, আমাদের উপর তোমার কোন রাগ আছে বাবা?
না আম্মা, এসব কি বলছেন। সত্যিই আজকে ফিরে না গেলে সমস্যা হয়ে যাবে।
এবার সুফিয়া বেগম বলে উঠেন, মা, ওর আসলেই অনেক জরুরী কাজ আছে। আমাদের নিতে যাবার সময় দুদিন থেকে যাবে।
তোরা যা বলবি তাইতো হবে। বুড়ো মানুষদের কথার কোন দাম আছে নাকি। ওনার গলার স্বরটা একটু আদ্র।
সুফিয়া বেগম অনুনয়ের দৃষ্টিতে রহমত আলীর দিকে তাকায়। রহমত আলী চোখ সরিয়ে খাবার খাওয়ায় মন দেন।
নানাবাড়ির পরিবেশটা দারুন। এখানে কোন শাসন নেই- যতক্ষণ মন চায় যা খুশি করা যায়। দিনভর সমবয়সী মামাতো ভাইদের নিয়ে খেলাধুলা হৈচৈ। মা অবশ্য মাঝে মাঝে বকাঝকা দেয়। কিন্তু নানীর আড়ালে আশ্রয় নিলেই সব ঠিকঠাক- এতোটুকু ছেলে, এখন তো আর লেখাপড়া নেই, এই বয়সে খেলাধুলা করবে না তো কবে করবে। তোর নানার মতো বুড়ো হলে করবে? সুফিয়া বেগম এ কথার পর আর কোন কথা বলেন না। শুধু একবার ছেলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরে পড়েন।
নানাবাড়ির তৃতীয় দিনের বিকেল। বাড়ির সব মহিলা একজোট হয়ে উঠোনে বসে আছে। নানা গল্পে চারিদিকে কেমন উৎসব উৎসব ভাব। বাড়ির বাইরে থেকে ভরাট কণ্ঠে উচ্চস্বরে সালামের আওয়াজ আসলো। মহিলারা মাথায় কাপড় তুলে দিলো। নানী বললেন, রফিক দেখত বাইরে কে এসেছে?
রফিক বাইরে বেরিয়ে দেখে শুশ্রুমণ্ডিত, লম্বাচুলের একজন সূঠাম দেহের লোক। চেহারায় কেমন অপার্থিব এক আভা ফুটে আছে। বেশ অমায়িক ভঙ্গিতে তার কণ্ঠ গমগম করে ওঠে- খোকা তোমার নাম কি? রফিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এতো চেনা লাগছে লোকটাকে, সেই কণ্ঠ! কোথায় দেখা হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই মনের অজান্তে উত্তর দেয়- আমার নাম রফিক।
স্মিত হেসে লোকটি বললেন, শুধ রফিক?
না, আমার পুরো নাম রফিকুল ইসলাম রফিক। আপনি কে?
তিনি উত্তরে শুধু হাসলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তুমি নানু বাড়িতে এসেছ?
হুম।
বাড়ির কথা মনে পড়ে? বাড়িতে যেতে মন চায়?
খুব মনে পড়ে।
বাড়িতে গিয়ে বল একজন ভিক্ষুক এসেছে। একটু পানি পান করবো। রফিক দৌড়ে গিয়ে সবাইকে বলে, ভিক্ষুক এসেছে, পানি খাবে।
সুফিয়া বেগম বলেন, মা, ঘরে মুড়ি আর গুড় আছে, ওনাকে ভিতরে এনে বসিয়ে কিছু গুড়, মুড়ি দেই? সুফিয়া খাতুনের মা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রফিককে বললেন, যা ওনাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে আয়।
সদর গেইট দিয়ে শুশ্রুমণ্ডিত, লম্বাচুলের সূঠাম দেহের লোকটি উঠোনে এসে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুত জ্যোতির্ময় চেহারা। মহিলারা সবাই একপাশে একটু আড়ালে গিয়ে লোকটিকে দেখতে লাগলো। সুফিয়া বেগম একটা জলচৌকি রফিকের হাতে দিয়ে বললেন, যা ওনাকে বসতে বল। তিনি ঘরের ভিতর চলে গেলেন। একটা বাটিতে কিছু চিড়া, গুড় আর একগ্লাস পানি এনে রফিককে ডাকলেন। রফিক কি এতো কথা বলছে লোকটার সাথে!
রফিক এদিকে আয়।
আসছি মা, বলেই একদৌড়ে মায়ের কাছে এসে বাটি আর পানির গ্লাস নিয়ে ফিরতি দৌড়ে লোকটির কাছে যায়।
লোকটি বাটিতে হাত রেখে রফিককে বললেন, আমার সাথে তুমিও খাও।
আপনার কি একা একা খেতে খারাপ লাগে?
একথা বলছ কেন?
না, আমাকে খেতে বলছেন তো তাই মনে হল একা একা খেতে আপনার খারাপ লাগে। তোমার তো অনেক বুদ্ধি বলেই লোকটা জোরে হেসে ওঠেন। তার হাসিতে কি যেন একটা আছে। চারিদিক কেমন গমগম করছে। মহিলারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অবাক চোখে লোকটিকে দেখতে লাগলো।
আচ্ছা আপনার বাড়ি কোথায়?
সবখানেই আমার বাড়ি।
সব বাড়ি আপনার! চারিদিকে যত বাড়ি আছে সব আপনার?
আরে না, আসলে সবার বাড়িকেই আপন ভাবি। সত্যি কথা বলতে কি এই দুনিয়ায় কারো কিছু নেই। সব একজনার মালিকানায়- যিনি তোমাকে, আমাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর।
তিনি কে?
তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা- আল্লাহ্।
আপনার কথা কিছুই বুঝি না।
না বুঝলে থাক। বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবে।
তিনি চুপচাপ খেতে লাগলেন। খাবারের শেষ অংশটুকু খেয়ে ধীরে ধীরে পানি খেলেন। রফিক ওনার গম্ভীর মুখ দেখে নিজেও একেবারে চুপ হয়ে রইলো। পানি খাওয়া শেষ করে তিনি বললেন, এই বাড়ির লোকজন খুব ভালো।
আমিতো এই বাড়ির ছেলে না, তাহলে কি আমি খারাপ? কে বলল তুমি খারাপ। তুমি অনেক ভালো। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো দেখবে?
কি দেখাবেন। ঝোলার ভিতর কি সাপ আছে? ওটা দেখাবেন?
লোকটি আবারো গমগমে কণ্ঠে হেসে উঠলেন। রফিক ভাবছে, এতো সময় কেউ একনাগাড়ে হাসতে পারে?
তোমার ডান হাতটা দাও তো খোকা।
রফিক ভয়ে ভয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। লোকটা রফিকের বুড়ো আঙ্গুলটা ধরে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলেন। একসময় চোখ খুললেন। তুমি একচোখ বন্ধ করে যা দেখতে চাইবে তাই দেখতে পাবে।
রফিক বাম হাত দিয়ে ওর বাম চোখ ঢেকে ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখের দিকে তাকায়। আশ্চর্য! টাইগার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠোনে শুয়ে আছে। বাবা আধো অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন। একবার উঠে বসে আবার শুয়ে পরলেন। মনে হয় খুব অস্থির হয়ে আছেন। একজনকে দরজায় খুব জোরে জোরে কড়া নাড়তে দেখা যায়। রহমত আলী দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দেন- বলেন- ভিতরে আসেন। লোকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে, ভিতরে গিয়ে কি হবে, আমার টাকাটা দেন। গত সপ্তাহে টাকা দেবার কথা ছিল, বাজারের লোকজনদের সামনে কথা দিয়েছেন।
দেখেন, ব্যবসায় এতবড় একটা লোকসান গেলো, আপনিতো সবই জানেন, এই মুহূর্তে টাকা দেয়া সম্ভব নয়। আমাকে আর মাসখানেক সময় দেন- আপনার টাকা কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দেব।
অতসত বুঝি না, আজকেই আমাকে টাকা দেবেন, এক্ষুনি। আপনাকে ভালোমানুষ মনে করেছিলাম, এখন তো দেখছি আপনি একটা ঠগ, বাটপার।
রহমত আলী কথার কোন জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না, অপমানে তার সারামুখ লাল হয়ে গেছে। তিনি মাথা নিচু করে আছেন। লোকটা আগের চেয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, আগামী সপ্তায় টাকা না পেলে সবাইকে আপনার আসল রূপ দেখিয়ে দেব, কান ধরে সারা বাজার ঘুরাব। কি, মাথা নিচু করে আছেন কেন? কথাটা মনে রাখবেন, সবার সামনে কান ধরে ঘুরাব। রহমত আলী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, চোখে জল জমতে শুরু করেছে। তিনি আবারো মাথা নিচু করে আছেন। লোকটা আজেবাজে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, শুনা যাচ্ছে- রফিকের ভিতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। সে ডানহাতটা নামিয়ে নেয়।
হাত নামালে কেন?
আর দেখতে ভালো লাগছে না।
লোকটা স্মিত হেসে বললেন, আচ্ছা আর কিছু দেখতে হবে না। আমি যাই।
আপনি আর আসবেন না?
কি জানি, হয়তো আবারো কোন একদিন তোমার সাথে দেখা হবে। লোকটা ধীরলয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিলেন।
রফিক পিছু পিছু যাচ্ছে।
আমাকে কিছু বলতে চাও?
আচ্ছা, আমি কি দেখেছি আপনি তা জানেন?
হুম, জানি।
বাবার মনে খুব কষ্ট, তাইনা?
হ্যাঁ, খুব কষ্ট। তুমি কিন্তু তোমার বাবাকে কখনো কষ্ট দিওনা। তোমার বাবার কোন দোষ নেই। আচ্ছা আমি এখন উঠি।
আপনি কোথায় যাবেন?
কথার উত্তর না দিয়ে রফিকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হাঁটা ধরলেন। পড়ন্ত বিকেলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখার কথা। কিন্তু রফিক আশ্চর্য হয়ে দেখল, কিছুদূর যাবার পরই লোকটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলো। রফিক মনে মনে ভাবছে, অদ্ভুত তো!
রফিকের মা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন, কিরে এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? এমনি- বলেই গেইট দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। সুফিয়া বেগম ছেলের পিছু পিছু শোবার ঘরে ঢুঁকে ছেলেকে হাত, পা গুঁটিয়ে অসহায়ের মতো শুয়ে থাকতে দেখতে পান।
কিরে, কিছু হয়েছে?
না।
তাহলে এভাবে অবেলায় শুয়ে আছিস কেন?
ভালো লাগছে না মা।
সুফিয়া বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? বাবাকে মনে পরেছে?
রফিক উঠে বসে মায়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মা, আমার কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে।
ছেলের পিঠে হাত রেখে সুফিয়া বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে খুব সন্তর্পণে চোখ মুছেন। ছেলেকে বুকে চেপে ধরে বসে থাকেন। কতক্ষণ পেরিয়েছে মা, ছেলে কেউ হিসেব করে বলতে পারবে না। একসময়য় রফিক মায়ের বুকে নেতিয়ে পরে, ও ঘুমিয়ে গেছে। সুফিয়া বেগম আলতো করে ওর মাথাটা বালিশে রেখে পাশে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকেন।
খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গে রফিকের। পাশের রান্নাঘর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সন্তর্পণে উঠে রান্নাঘরে ঢুঁকে মা আর নানীকে ভাপা পিঠা বানাতে দেখে- ওর প্রিয় পিঠা। রফিককে দেখে নানী একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিয়ে বলেন, এখানে বস। বসে বসে পিঠে খা। একটা পিঠা প্লেটে নামিয়ে রফিকের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। কি সুন্দর! পিঠা থেকে কেমন ধোঁয়া উঠছে। কি মিষ্টি গন্ধ। হাত দিয়ে পিঠা ভাঙ্গতে গিয়ে বাবার মুখটা ভেসে উঠে। মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। লোকটা কি সত্যি বাবার কান ধরে বাজারে ঘুরাবে? যদি এমন হয়, তাহলে বাবা কি করবেন? রফিক বিড়বিড় করে বলতে থাকে, এমন কখনো হবে না, কখনো না। একবার মনে হয়েছিল মাকে সব বলবে। কিন্তু সে নিজেও জানে না, কেন মাকে এসব বলতে পারছে না। মাথা নিচু করে পিঠা ভেঙ্গে খেতে লাগলো।
রহমত আলী খবর পাঠিয়েছেন। সুফিয়া বেগম, মিতা আর রফিক যেন আরও কয়েকটা দিন ঐ বাসাতেই থাকেন। তিনি জরুরী কাজে আটকা পরেছেন। সময় হলে তিনি নিজেই ওদের নিয়ে আসবেন। সুফিয়া বেগম অদ্ভুত এক দিশেহারা ভঙ্গিতে খবর আনা লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। রফিক কিছুটা আন্দাজ করতে পারে, বাবা তাঁর ঝামেলার মাঝে ওদেরকে জড়াতে চান না। কিন্তু কতদিন আর এখানে থাকতে ভালো লাগে। বাবার অসহায় ভঙ্গিটা ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সুফিয়া বেগম খবর আনা লোকটাকে বললেন, ভাইজান, রফিকের বাবার ওখানে কোন সমস্যা হয়েছে?
না ভাবী, কি যে বলেন। ওনার আবার সমস্যা কি? এমন ভালো মানুষের প্রতি আল্লাহ্’র রহমত আছে। এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। মনে হয় ব্যবসা সংক্রান্ত কোন বিষয়। নতুন কোন ব্যবসা হয়তো চালু করছেন।
নতুন ব্যবসা!
মনে হয় তো তাই।
সুফিয়া বেগম তার স্বামীর সবকিছু জানেন। নতুন ব্যবসা চালু করবেন আর তাকে জানাবেন না- কেমন বেখাপ্পা লাগছে। তবু কথার কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন- কি ব্যবসা, আপনি কিছু জানেন?
না ভাবী। ভাই কিছু বলেন নি। শুধু আপনাদেরকে কয়েকটা দিন এখানে থাকতে বলেছেন। ওখানে সবকিছু গোছগাছ করে আপনাদের নিয়ে যাবেন। এরপর চুপচাপ নাস্তা খেয়ে লোকটা উঠে দাঁড়ায়। যাই ভাবী, ভালো থাকবেন। ভাইকে কিছু বলতে হলে বলে দেন। আমি খবর পৌঁছে দেব। না, ওনাকে কিছু বলতে হবে না। আমরা ভালো আছি।
মোলায়েম সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে থাকা রফিকের চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। শ্মশ্রুমণ্ডিত লোকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। খোকনের অতীত দেখার প্রতিটি ক্ষণ তিনি নিজেও দেখতে পারছেন। অনুভব করতে পারছেন ওর ছোটবেলায় দেখা বাবার অপমান। ঘুমের মধ্যেই খোকন কেমন যেন অস্থির হয়ে পরেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় চেহারাটা কুঁকড়ে যাচ্ছে।
রহমত আলী অতি সাবধানে চাবি দিয়ে আলমিরার নিচের পাল্লা খুললেন। ওখানে রাখা ড্রয়ারে হাত দিয়ে তিনটা বাক্স বের করলেন। খাটের উপর বাক্সগুলি রেখে খুললেন, একটাতে ভারী গলার হার, অপরটায় একজোড়া ভারী হাতের রুলি আর শেষ বাক্সটায় অনেকগুলি টাকা। ঐ বাক্সে নিয়মিত ব্যবহারের জন্য একটা পাতলা চেইন আর একজোড়া কানের দুল ছিল। বাবার বাড়ি যাবার সময় ওগুলো পড়ে গিয়েছেন। অন্য জায়গায় রাখা টাকাগুলি একসাথ করে খালি বাক্সে রেখে গেছেন। রহমত আলী গুণতে শুরু করলেন- দশ হাজার পাঁচশ পঞ্চাশ টাকা। মনে মনে দ্রুত হিসাব করলেন, টাকাগুলির সাথে গয়নাগুলি বেঁচে মাজেদ মিয়ার টাকাটা শোধ হয়ে যাবে। লোকটা বদের বদ। সত্যি সত্যিই বাজারের লোকজনকে একাট্টা করে অপমানের চূড়ান্ত করে ছাড়বে। যাক বিরাট এক অপমানের হাত থেকে বাঁচা গেল। এর পরপরই আরেক দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সুফিয়া জানতে পারলে কি করবে? ও যেমন সহজ, আবার এমন কঠিন যে, একবার গোঁ ধরলে কোনকিছুকে তোয়াক্কা করবে না। রাগ উঠলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা। তার নিজেরই কি কম খারাপ লাগছে। স্ত্রীর বাবার বাড়ির গয়না আর তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে এগুলি কিনেছে। ঠাট্টা করে রহমত আলী একদিন বলেছিলেন, তোমাকে তো এগুলি কখনো পড়তে দেখি না। দাও এগুলি বেঁচে কিছু জমি কিনে ফেলি। শুধু শুধু ফেলে রেখে লাভ কি?
সুফিয়া বেগমের সেদিনের দৃষ্টিটা আজও রহমত আলীর মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কোন চিৎকার, চেঁচামেচি নয়- শুধু হিমশীতল দৃষ্টিটা রহমত আলীর চোখে স্থির রেখে বলেছিলেন- আমি মরে গেলেও এগুলি বিক্রি করবো না। এগুলি রফিকের বউয়ের জন্য। দৃষ্টিটা এমন যে, রহমত আলীর গলা শুকিয়ে যায়। তিনি অতিদ্রুত ঘরে গিয়ে এক চুমুকে পানি ভরা গ্লাসটি শেষ করে মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ভেবেছিলেন, ভয়টা কাটবে। কিন্তু সুফিয়া বেগমের কঠিন দৃষ্টিটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলো। তিনি দ্রুতপায়ে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলেন।
রহমত আলী এক দৃষ্টিতে টাকা আর গয়নাগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখ দুটি অসম্ভব জ্বালা করছে। তিনি দ্রুত টাকাগুলি পকেটে নিলেন আর গয়নাগুলি একটা ছোট ব্যাগে ভরে সদরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পকেটে রাখা টাকা আর গয়না বিক্রি করে সাকুল্যে ষাট হাজার ছয়শ টাকা হলো। মনের মাঝে খোঁচাতে থাকা কাঁটাটা মোটেই দূর করতে পারছেন না। এটা কি সুফিয়া বেগমের রাগ আন্দাজ করে, না নিজের অসম্ভব খারাপ লাগা থেকে উত্থিত; কোন কারন নিজেও বুঝতে পারছেন না। তিনি টাকাগুলি গুণে একটা চায়ের দোকানে বসলেন। বিয়ের একমাস পর সুফিয়া বেগমের কথায় সিগারেট খাওয়া ছেড়ে ছিলেন। আজ একটা সিগারেট নিলেন। অনেকক্ষণ ধরে সিগারেটের দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা ধরিয়ে টান দিলেন। টান দিয়ে খুক খুক করে বেশ কিছুক্ষন কাশলেন। চা এবং সিগারেট একই সাথে শেষ করে সিগারেটের দোকান থেকে আস্ত এক প্যাকেট সিগারেট কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যদিও বাড়ি যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এতোগুলি টাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাঘুরিটা মোটেই কাজের কাজ নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
বাড়ি ফিরে চাচাতো ভাই করিমকে ডেকে পাঠালেন। করিম, আজ সন্ধ্যায় নিজাম মহাজনকে আসতে বলে দিবি। সন্ধ্যায় তুইও থাকবি।
মিয়া ভাই, ঐ বজ্জাতের সাথে তোমার বিষয়টা কি? হারামজাদা এলাকায় বসে বসে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে- এমন লোকের সাথে তোমার কি দরকার? দাদা, খবর্দার, ঐ লোকের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা ধার নেবে না।
রহমত আলী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন, তুই খবর দিয়ে আয়, আর সন্ধ্যায় তুইও থাকিস।
মিয়া ভাই, আমাকে খোলাসা করে বল, কোন সমস্যা? না কোন সমস্যা নেই। যা বললাম তা করিস। ভুল যেন না হয়। করিম বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক আছে আমি ঐ শয়তানের বাচ্চাকে খবর দেব, আর সন্ধ্যায় কি তামাশা হয় সেটাও দেখবো। দেখি তোমার রহস্যটা কি? রহমত আলী একথার কোন জবাব দিলেন না। চুপচাপ মাথা নিচু করে খাটের উপর বসে রইলেন।
মাগরিবের নামাজের পর নিজাম মহাজনকে নিয়ে রহমত আলীর ঘরে পৌঁছায় করিম। বাইশ বছরের তরতাজা তরুণের ভাবগতি বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না রহমত আলীর কাছে। একবার ওকে চলে যেতে বলবেন বলে ভাবলেন। কি মনে করে চুপ হয়ে রইলেন।
আমার টাকা জোগাড় করেছেন- রহমত আলীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে নিজাম মহাজন।
ঐ মিয়া এত খ্যাঁকখ্যাঁক করেন কেন। ভালভাবে কথা বলতে পারেন না।
দেখ করিম, আমি তোর সাথে কথা বলছি না। রহমত আলীর সাথে কথা বলছি। তোর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা আমার সাথে বলবি না। সেই দেখা হবার পর থেকেই এটাসেটা বলতে বলতে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।
মাথা ধরেছে? চা খাবেন, চা এনে দেব? আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বললে কি করবেন? সুদ খেতে খেতে তো পেটটাকে ঢোল বানিয়ে ফেলেছেন।
দেখ করিম সাবধানে কথা বল। এজন্যই কোন দেনাদারের বাসায় আসতে নেই। গদিতে বসে নিরিবিলি হিসাব শেষ করতে হয়।
হ, গদিতে বসে আরামসে জায়গামত চেপে ধরে বেশী আদায় করা যায়। রহমত আলী দুজনের বিতণ্ডায় বাঁধা দিলেন- তা, মহাজন সাহেব আপনার খাতা খোলেন। দেখেন কত টাকা হয়েছে।
এই মাসের সুদ সহ মোট উনপঞ্চাশ হাজার সাতশ টাকা।
এই মাসের সুদ মানে? আজকে মাত্র এক তারিখ!
আমার হিসাব মাসের ত্রিশ তারিখ পর্যন্ত। একদিন দেরি হলে পুরা মাসের সুদ দিতে হবে।
কথাটা কিন্তু টাকা দেবার সময় বলেন নাই মহাজন।
মহাজন গলা চড়িয়ে বললেন, যেটা সবাই জানে সেটা জনে জনে নতুন করে বলার কি আছে?
এই মাসের সুদ সহ উনপঞ্চাশ হাজার সাতশ টাকা দেন। করিম আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে- ঐ মিয়া লেখাপড়া কিছু শিখছেন? সব মাস কি ত্রিশ দিনে হয়? ফেব্রুয়ারি মাস হলে কি করেন?
দেখ করিম, তোকে আবারো বলছি, লেনদেন তোর সাথে না। রহমত আলীর সাথে লেনদেন, কথাবার্তা তার সাথেই হবে। তুই আলগা মাদবরি করস ক্যান?
ওরে আমার সোনার চান। দাদারে ভোদাই পাইছেন, যা মন চায় তেমন করে টাকা নিয়ে যাবেন? আপনাকে এক টাকাও সুদ দেয়া হবে না। দাদা, তুমি কত টাকা নিয়েছিলে এই চামারের কাছ থেকে? আমি তো জানি, মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েছিলে। এই বেটার কাছ থেকেই আসার সময় শুনলাম।
হ্যাঁ, পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। এখন তুই চুপ কর। তোকে এখানে স্বাক্ষী হিসাবে রাখা হয়েছে। আর মহাজনের কথামতো টাকাটা গুণে ওনার হাতে দে বলেই পঞ্চাশ হাজার টাকার তোড়াটা করিমের দিকে এগিয়ে দেন। কথাটা বেশ রাগান্বিত ভঙ্গিতেই বললেন রহমত আলী।
মুখের তেজী ভাবটা না কমলেও করিম চুপ করে টাকা গুণতে থাকে। পাঁচশ টাকার নোটের তোড়া মহাজনের দিকে দিয়ে বলে, তিনশ টাকা ফেরত দেন।
আমার কাছে ভাংতি ষাট টাকা আছে। বাকি টাকা পরে দেব। এবার রহমত আলীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে- মহাজন সাহেব- আপনার হিসাব অনুযায়ী টাকা দিলাম। একপয়সাও কম দেয়া হচ্ছে না। আপনি পুরা তিনশ টাকা ফেরত দেন। মহাজন রহমত আলীর দিকে তাকিয়ে দেখেন তার চোখ দুটি টকটকে লাল হয়ে আছে। পাঞ্জাবির এ পকেট ও পকেট হাতড়ে তিনশ টাকা বের করে দিলেন।
এখন আপনি এই কাগজে লিখে দিয়ে যান যে, আপনার সাথে আমার আর কোন লেনদেন নেই।
এইটা আবার কি কথা শুনাইলা রহমত মিয়া। আমার ব্যবসায় কোন ফাঁকিঝুঁকি নাই। টাকা ফেরত দিছ, কারবার শেষ।
ঠিক আছে লিখে দিতে হবে না, কিন্তু যে খাতায় আমার নামে টাকা তোলা আছে সেটা কাটেন। কোন ভণিতা না, এক্ষুনি কাটেন।
নিজাম মহাজন অনেক সময় নিয়ে রহমত আলীর হিসাবের পাতাটা আবার বের করে। নিজ হাতে কেটে স্বাক্ষর করে দেখিয়ে দেয়- এই যে, দেখ সব কাটাকাটি শেষ। এইবার খুশি তো?
করিমের মন চাইছে শালাকে লাথি মেরে ওর একটা বিচি ফাটিয়ে দেয়। আড়চোখে একবার লুঙ্গির উপরের দিকটাতে তাকায়। ওর জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝল, মহাজন দ্রুত কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়।
দাদা, একটা কথা বলবো? রহমত আলীর নীরব সমর্থন পেয়ে করিম বলে, হঠাৎ কি এমন হয়েছিল যে ঐ সুদখোরের কাছ থেকে টাকা নিতে হল?
আমার বন্ধু, সুজন ওর বিদেশে যাবার সময় কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। ঘরে টাকা ছিল না, তাই ওকে মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে দিয়েছি। তুমিও দাদা মানুষ একটা! সুদে টাকা নিয়ে বন্ধুর উপকার করো। তা তোমার বন্ধু বিদেশ যাবার পর কোন যোগাযোগ করেছে? না, কোন যোগাযোগ হয়নি।
সুজন ভাইয়ের বাড়িতে যাওনি, ওনাদের জানাওনি? জানিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা বলেছে সুজন নাকি ওনাদের কিছু জানায়নি। যেখানে টাকার কথা জানায়নি, সেখানে ওনাদের চাপ দিয়ে লাভ কি বল।
আমি যাব ঐ বাড়িতে। দেখি কি বলে।
কোন দরকার নেই। আমার যা শিক্ষা হবার হয়েছে। এসব করে শুধু শুধু একটা ঝগড়াঝাঁটি তৈরি হবে। শেষে তোর ভাবীর কান পর্যন্ত যাবে। ওকে তো চিনিস। ও জানলে কুরুক্ষেত্র ঘটিয়ে দেবে।
টাকা জোগাড় করলে কি করে? এই কথার উত্তরে বিমর্ষ চোখে করিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন রহমত আলী। নিচু স্বরে স্ত্রীর গয়না বেচার কথা বলে যেতে লাগলেন। করিম সবটা না শুনেই গজরাতে গজরাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রহমত আলী চিৎ হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন। এই নিরিবিলি, নিঃশব্দ পরিবেশে লোক দেখানো শক্ত আবরণটা খসে পড়েছে। একেকবার মনে হচ্ছে ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে উঠেন। গলায় যেন কিছু আঁটকে আছে। তিনি চিৎকার করতে পারছেন না। উপুড় হয়ে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, একসময় ক্লান্ত হয়ে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন।
খুব ভোরে রহমত আলীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছুটা পথ মাটির। রাতের কুয়াশায় ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে। এসময় একটু সতর্ক হয়ে চলতে হয়। কয়েক জায়গায় এমন অবস্থা পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। দীর্ঘ ঘুমের পর ক্ষুধার্ত ক্লান্ত শরীরটা দুর্বল হয়ে আছে। বাজারে গিয়ে নাস্তা সারতে হবে। গত সন্ধ্যার ঘটনাবলী, সুফিয়া বেগম জানতে পারলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে এসব ভাবতে ভাবতে বেশ জোর কদমে কাঁচা রাস্তায় চলতে লাগলেন। হঠাৎ পা পিছলে হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ে গেলেন। তিনি প্রাণপণে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। পিচ্ছিল মাটিতে বসে পড়লেন। ডান পায়ের গোড়ালিটা মনে হয় মচকে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথাটা তাকে কাবু করে ফেলেছে। দূরে একজনকে পাঞ্জাবি আর টুপি মাথায় এদিকেই আসতে দেখলেন। মনে হয় ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন কেউ। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। দৃষ্টিটা স্থির রাখতে পারছেন না। কে আসছে বুঝা যায় না।
রহমত আলী, তুমি এই মাটির মধ্যে বসে আছ কেন? করিমের বাবা আজমত মিয়ার কণ্ঠ না?
কোনমতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, চাচা মনে হয় পা মচকে গেছে, উঠতে পারছি না।
তুমি আমার কাঁধে হাত রেখে উঠে দাঁড়াও। চল বাড়ি যাই। তোমার চাচী হলুদ বাটা না কি দিয়ে যেন পট্টি লাগিয়ে দেন। ওকে পাঠিয়ে দেব। রহমত আলী কোন জবাব না দিয়ে আজমত মিয়ার কাঁধে হাত রেখে এক পায়ে কোনমতে উঠে দাঁড়ায়। রহমত আলী খুব সতর্ক হয়ে হাঁটছে, যাতে বুড়ো মানুষটার উপর গায়ের সমস্ত ভর চেপে না বসে।
খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি রহমত?
দাঁতে দাঁত চেপে কণ্ঠটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে রহমত আলী জবাব দেয়- না চাচা, এই একটুখানি পা মচকেছে। খুব বেশী কষ্ট হচ্ছে না।
আজমত মিয়া বেশ বিরক্ত নিয়েই বললেন, ভাব দেখে তো তাই মনে হচ্ছে, খুব বেশী ব্যথা পাওনি।
রহমত আলী সামান্য বিব্রত বোধ করেন। আজমত চাচা নিশ্চয়ই তার মিথ্যা কথাটা ধরে ফেলেছেন।
রহমত মিয়ার পায়ে করিমের মা হলুদ বাঁটা আর কি কি সব তেল মিশিয়ে পুরো পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত লেপটে দিলেন। তার কঠোর নির্দেশ কোনভাবেই যেন বিছানা থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি না করে। আজমত মিয়া করিমকে বললেন, তুই আজই গিয়ে বৌমাকে নিয়ে আয়। এই সময় রহমতের সাথে বৌমার থাকাটা জরুরী। রহমত আলী হাহাকার করে উঠলেন- ওকে এখন আনার দরকার নেই। ওর ছোট বোনের বিয়ের কথাবার্তায় ও না থাকলে কিভাবে হবে। করিম আমার সাথে একটু সময় দিলেই হবে। রহমত মিয়া লক্ষ্য করলেন, করিম তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একসময় চাচা-চাচী উঠে বাড়িতে গেলেন। করিম রহমতের সাথে থেকে যায়।
দাদা, তুমি ভাবীকে আনতে না করলে কেন? রুনার বিয়ের কথাবার্তা তো ঠিক হয়ে গেছে, আগামী মাসের ২৫ তারিখে বিয়ে। এখন তাকে আনলে সমস্যা কি?
রহমত আলী চুপ করে থাকেন। যেন পাথরের একটা মূর্তিকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। একসময় মূর্তি মুখ খোলে। শোন, তোর ভাবী আরও সপ্তাহখানেক ওর বাবার বাড়িতে থাকুক। এর মধ্যে টাকা জোগাড় করে গয়নাগুলি ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করবো।
তুমি তো ওগুলো বিক্রি করে দিয়েছ, তাই না, বন্ধক তো রাখনি। তা, সেগুলি আনবে কিভাবে?
ওদের সাথে কথা হয়েছে। দিন দশেকের মধ্যে গেলে ওরা গয়নাগুলি ফেরত দেবে। নিশ্চয়ই বিনা লাভে দেবে না। তা কতো টাকা বেশী দিতে হবে?
দশ হাজার বেশী দিলেই গয়নাগুলি ফেরত দেবে।
এই পাঁচ দিনের মধ্যে তুমি টাকা পাবে কোথায়?
উত্তর বিলের পাশে দশ শতাংশ জমি আছে। ওটা বিক্রি করে দেব।
করিম তোতলাতে থাকে- দাদা, তুমি আসলেই একটা ইয়ে।
রহমত আলী মৃদু হাসেন, বলেন- আসলেই আমি একটা অপদার্থ। কি করবো বল। ব্যবসায় এত বড় একটা ধরা খেয়ে ফেঁসে গেছি।
টিটকিরি মারতে ছাড়ে না করিম- তারপর আবার মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে বন্ধুকে ধার দেয়া। কত বড় ছোয়াবের কাজ যে করেছ দাদা!
এবার রহমত আলী আর কথা বললেন না। চুপচাপ চিত হয়ে শুয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর হালকা নাক ডাকার শব্দে করিম বুঝতে পারলো রহমত আলী ঘুমিয়ে পড়েছেন। রহমত আলীর ক্লান্ত, স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে করিমের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠে। এত ভাল একজন মানুষ, তার সাথে মানুষেরা এমন অন্যায় কিভাবে করে!
রহমত আলীর বাঁধা স্বত্বেও পরেরদিন বিকেলে করিম সুফিয়া বেগমকে বাসায় নিয়ে এল। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেই দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেলেন। রহমত আলী চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছেন। আজ দুপুরে চেষ্টা করেছিলেন নিজ পায়ে কিছুদূর হাঁটতে। হেঁটে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত গিয়েছেন। কোনমতে ডান পা মাটিতে ছোঁয়াতেই ও মাগো বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তারপরেও থেমে থাকেন নি। মচকানো পা মাটিতে ফেলেছেন। বেশ কয়েক কদম হেঁটেছেন। ব্যথায় মা গো বলে আর চিৎকার করেন নি। দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগিয়েছেন। যন্ত্রণাগুলি নোনা জল হয়ে দুচোখ বেয়ে নেমে আসছিল। একসময় তাকে থামতে হয়। বিছানায় ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে টেনে নিয়ে বালিশে মাথা রাখেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। সুফিয়া বেগম স্বামীর মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় বিলি করে দেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে এলোমেলো হয়ে থাকা ঘরের সমস্ত কিছু গোছগাছ করতে থাকেন। কি অবস্থা ঘরের! সিগারেটের টুকরা ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আলমিরার অগোছালো জামাকাপড়। করিম- রফিক আর মিতাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। কিছুক্ষণ একমনে কাজ করতে পারলে সবকিছু গোছগাছ হয়ে যাবে। রাতের খাবার রাঁধতে হবে। তিনি শোবার ঘর গুছিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। যেটা যেমন রেখেছিলেন, সেগুলি ঠিক তেমনি আছে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। তিনি বাইরে এসে উঠোন ঝাড়ু দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। রহমত আলী এখনো ঘুমিয়ে আছেন। একবার ঘরে উঁকি দিয়ে ঘুমন্ত রহমত আলীর দিকে তাকালেন। ঘুমের মধ্যেও লোকটার মুখে কি যেন এক যন্ত্রণা, কি এক বিষাদ ছেয়ে আছে।
ঘরের সমস্ত আগোছালো কাজ গুছিয়ে রাতের জন্য রান্না বসালেন। বাজার সদাই কিছু নেই। ভাত, আলুভর্তা আর ডাল। রান্নার পাশাপাশি মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে দেখে আসেন রহমত আলী উঠেছে কিনা। না, এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। সুফিয়া বেগম একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এত ঘুমায় কিভাবে মানুষটা! ভাত ঠিকা দেবার সময় উফ জাতীয় একটা শব্দ শুনে কোনমতে ঠিকা বসিয়ে দৌড়ে ঘরে গেলেন। রহমত আলী জেগে উঠেছেন। হারিকেনের স্বল্প আলোতে বিস্ময় নিয়ে সুফিয়া বেগমকে দেখতে লাগলেন। ও কখন এসেছে? করিমকে বারবার বলা সত্ত্বেও সুফিয়া বেগমকে আনার কাজটা মোটেই ঠিক করেনি সে। পায়ের ব্যথা ভুলে একরাশ অস্বস্তি আর মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
সুফিয়া বেগম স্বামীর মাথার পাশে বসে বললেন, এখন কেমন লাগছে?
ভালো। তুমি হঠাৎ করে এভাবে চলে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি।
তুমি এভাবে ঠ্যাং ভেঙ্গে শুয়ে থাকবে, আর আমি বাপের বাড়িতে পায়ের উপর পা তুলে খাবো- তুমি আমাকে কি ভাব?
রুনার বিয়ের দিন, তারিখ তো গত পরশু দিন হয়ে গেছে। তুমি থাকলে ভাল হতো না? আসলে আমি একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।
তুমি আমার কাছে কিছু লুকাও না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এবার কিছু একটা লুকাচ্ছ।
সুফিয়া, এসব আলাপ করতে ভালো লাগছে না। ক্ষুধা লেগেছে। পার যদি কিছু খাবার দাও।
তুমি দশটা মিনিট অপেক্ষা করো। ভাত নামানো হয়ে গেছে। আমি তোমাকে জগে করে পানি দিয়ে যাচ্ছি। হাত, মুখ ধুয়ে নাও।
কোন ফাঁকে সুফিয়া বেগম জগভরতি পানি দিয়ে গেছে রহমত আলী টের পেলেন না। দুশ্চিন্তাগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সুফিয়া বেগম যদি গয়নাগুলির কথা জানতে পারে, কি করবে সে ভাবতেই ভয়ে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
সুফিয়া বেগম ঘরের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে রফিক আর মিতাকে পাঁশে নিয়ে বসেছেন। রহমত আলী বিছানা থেকে নেমে পা গুটিয়ে বসতেই আহ করে চিৎকার করে উঠলেন। পা মুড়ে বসতে অসুবিধা হচ্ছে। মচকে যাওয়া পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছেন। সুফিয়া বেগম, দ্রুত উঠে স্বামীর পাঁশে আসলেন।
তোমাকে নীচে বসে খেতে হবে না। তুমি খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বস, আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। রহমত আলী সুফিয়া বেগমের কাঁধে হাত রেখে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসলেন। সুফিয়া বেগম ভাত আর আলু ভর্তা মাখতে মাখতে স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। রফিক আর মিতাও বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখ খোল। রহমত আলীর কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। তিনি বললেন, ওদের আগে খাইয়ে নিলে হতো না? রফিক বাবার একটা হাত ধরে বলল, বাবা তুমি আগে খাও। কথাটা শুনে রহমত আলী কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। তিনি মুখ হা করলেন। ভাতের মলাটা রহমত আলীর মুখে তুলে দিয়ে সুফিয়া বললেন, লবন লাগবে। রহমত আলীর মুখ বন্ধ। তিনি ভাত চিবুতে চিবুতে ভাবছেন, এমন স্বাদের খাবার কতদিন পর খেলেন। সেই যে, ছোটবেলায় মা মুখে তুলে খাওয়াতেন, তখনো কি এমন স্বাদ লাগতো? তিনি সেই স্মৃতি মনে করতে পারলেন না। তিনি ঢোঁক গিলে বললেন, সব ঠিক আছে। আচ্ছা এক কাজ করা যায় না- এই প্লেটেই সবাই মিলে খাই। সুফিয়া বেগম লজ্জা পেলেন। কপট রাগে চেঁচিয়ে বললেন, সবাইকে খেতে হবে না। তুমি আগে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, তারপর আমরা খাব। রফিকও মায়ের কথায় সায় দেয়। তুমি আগে খাও বাবা। আমরা পরে খাব। রহমত আলী আড়চোখে খেয়াল করলেন রফিক তার মচকে যাওয়া পায়ের কাছে বসে পরেছে। হলুদ লাগানো স্থানে হালকাভাবে হাত বুলাচ্ছে। তিনি মাথাটা একটু নিচু করলেন। নিজেকে কেমন যেন অপাংক্তেয় মনে হচ্ছে।
এই মাথা নিচু করে আছ কেন? তাড়াতাড়ি খাবারটা শেষ করো। রহমত আলী আবারো হা করলেন। একসময় রহমত আলীর খাবার শেষ হয়। পানি খাইয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে স্বামীকে বললেন, এখন শুয়ে পড়। আমি ওদেরকে নিয়ে খেয়ে থালা, বাসন ধুয়ে আসছি।
রহমত আলী আলতো করে মচকানো পা’টা তুলে বিছানায় উঠলেন। খোকন বাবাকে সাহায্য করার জন্য হাঁটুর কাছাকাছি যায়গা ধরে পা’টা উঠাতে সাহায্য করে। রহমত আলী রফিককে কাছে ডাকলেন। হালকা করে ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলেন। রহমত আলীর বুকের ভিতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো।
পাশাপাশি দুইটি শোবার ঘরের একটিতে রফিকের শোবার ব্যবস্থা করা হল। প্রথম রাতে একটু ভয় ভয় করলেও আজ তেমন একটা ভয় লাগছে না। ভারী একটা কাঁথার পাশাপাশি পাতলা একটা কাঁথা পায়ের কাছে বিছিয়ে রাখেন। রফিকের ঘুম গাঢ় না হওয়া পর্যন্ত সুফিয়া বেগম ছেলের পাশে শুয়ে রইলেন। রফিক একহাতে মায়ের কোমর পেঁচিয়ে ধরে কেমন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।
অনেক রাত হয়েছে। সুফিয়া বেগম উঠে পাশের ঘরে গেলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, ছোট মেয়েটা হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। রহমত আলী বিছানায় নেই। এমন চোট নিয়ে এত রাতে কোথায় গেল লোকটা? দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেটা সামান্য ফাঁকা হয়ে আছে। দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলেন। আজ পূর্ণিমা নাকি, চারিদিকে নীলাভ জ্যোৎস্না চুইয়ে চুইয়ে পরছে। অপার্থিব আলোতে কেমন অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠেছে গাছের পাতাগুলি। মৃদু ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস। অসম্ভব সুন্দরের মাঝে কেমন একটা উদাস ভাব। এমন সময়ে মন ছুটে যায় অন্য ভুবনে। উঠোনের মাঝখানে রহমত আলী একটা মোড়া নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আছে। সুফিয়া বেগম ঘর থেকে আরেকটা মোড়া নিয়ে নিঃশব্দে স্বামীর পাশে গিয়ে বসলেন। রহমত আলী একবার ফিরেও তাকালেন না। তার অনড় মূর্তি দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেখানে বসে আছেন সেখানে শুধু তার শরীরটা আছে। তার মন অন্য কোনখানে, অন্য কোথাও। এই পৃথিবীর সাথে তার কোন সংযোগ নেই, অসীমতার মাঝে ডুবে আছেন। যেন ধ্যানমগ্ন কোন সাধু। সুফিয়া বেগম অনেকক্ষণ বসে রইলেন। একসময় ডান হাত বাড়িয়ে স্বামীর পিঠে রাখলেন। রহমত আলী চমকে পাশ ফিরলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কখন এসেছ?
অনেকক্ষণ হয় এসেছি। তোমার কি হয়েছে? কোন সমস্যা। আমাকে বল। পায়ের ব্যথা নিয়ে ঘর থেকে এতদূর হেঁটে এলে কেন?
রহমত আলী আবারো মাথা নিচু করলেন।
সুফিয়া?
বল।
আজ কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে। দেখ জ্যোৎস্নায় চারিদিক কেমন আলোকিত হয়ে আছে। রহমত আলী সুফিয়া বেগমের একটা হাত নিজের দিকে টেনে নিলেন। হাতটা চোখের উপর রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সুফিয়া বেগম মোড়া নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি বসলেন। কি হয়েছে তোমার? আমাকে খুলে বল। রহমত আলী চুপ করে রইলেন। বিয়ে হবার পর থেকে শত ঝড়ঝাপটাতেও স্বামীকে এমন ভেঙ্গে পরতে দেখেননি। সুফিয়া বেগম দাঁড়িয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন। তোমার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
রহমত আলী কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু কান্নার অদম্য আবেগে শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। সুফিয়া বেগম আরও জোরে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমি, আমি একটা অপরাধ করেছি ............ হঠাৎ ছোট বাচ্চা মিতার তীব্র চিৎকারে থেমে যান রহমত আলী। খুব ধীরে সুফিয়া বেগমের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বলেন- মেয়েটা হয়তো ভয় পাচ্ছে। তুমি যাও।
তুমি যাবে না?
চোখ মুছে রহমত আলী বলেন, আমি আরেকটু বসি।
পায়ের ব্যথাটা অনেকখানি কমেছে। এখন দুপায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন রহমত আলী। বাজারে যাওয়া দরকার। ঘরে চাল, ডাল কিছুই নেই বললেই চলে। বাঁশের খুঁটির তারকাটায় ঝুলানো ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই সুফিয়া বেগম হায় হায় করে ছুটে আসলেন। এই সকালে ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
বাজার করে নিয়ে আসি। ঘরে তো বলতে গেলে কিছুই নেই।
এই পা নিয়ে বাজারে যেতে হবে না। আর দুটা দিন পা’টাকে একটু বিশ্রাম দাও। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
আরে না। পা এখন ঠিক আছে বলেই ঘরের এ কোণ থেকে ঐ কোণে নির্বিঘ্ন হেঁটে গেলেন। দেখেছ, শোন কোন সমস্যা হবে না। আমি যাই বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুফিয়া বেগম বাঁধা দিলেন না।
একটু পরেই বাজারের স্বর্ণকারের হাঁকডাক শোনা গেল। রহমত আলী, ও রহমত আলী বাসায় আছ নাকি?
মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সুফিয়া বেগম। কি হয়েছে চাচা?
রহমত আলীর সাথে একটু কথা ছিল।
উনি বাজারে গেছেন। আমাকে বলে যান। আমি ওনাকে বলে দেব।
বউ মা, রহমত আলী গয়না ছাড়ানোর জন্য দশদিন সময় চেয়েছিল। তিনদিন হয়ে গেল। আমি বুঝে পাই না, ও দশ দিনের ভিতর কিভাবে টাকা জোগাড় করবে। এদিকে খাঁ বাড়ির গিন্নী এসে গয়নাগুলি পছন্দ করে গেছেন। দামও ভালো দেবেন। রহমত আলী যদি বলে তাহলে খাঁ বাড়ির গিন্নীর কাছে গয়নাগুলি আজই বিক্রি করে দেব। আমি মা এসব করেই খাই। রহমত আলীকে কথা দিয়েছিলাম বলে ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।
কতো টাকা নিয়েছিল?
ষাট হাজার ছয়শ টাকা। কার কাছ থেকে নাকি সুদে টাকা নিয়েছিল। সেই টাকা শোধ করতে আমার কাছে গয়নাগুলি বিক্রি করে। বলেছে দশ হাজার টাকা বেশী দিয়ে দশদিনের মধ্যে গয়নাগুলি ছাড়িয়ে নেবে।
রহিমা বেগম শীতল গলায় বলল, চাচা, ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। খাঁ বাড়ির গিন্নী আসলে ওনার কাছে গয়নাগুলি বিক্রি করে দিবেন। স্বর্ণকার বিভূতি বাবু বলল, তুমি আমাকে বাঁচালে মা। খাঁ বাড়ির মানুষদের তো চেন। তুমি অনুমতি না দিলে কি কেলেঙ্কারি যে ঘটাত। ওরা আবার জোর করে দশ হাজার টাকা বায়না দিয়ে গেছ। কি মুছিবত বল দেখি মা।
চাচা, আর কিছু বলতে হবে না। আপনি ওগুলো বিক্রি করে দেন।
বিভূতি বাবু বাড়ি থেকে বের হবার সাথে সাথে চাবি নিয়ে আলমিরা খুলে গয়না রাখার স্থানটি খালি দেখতে পান। এক কোণে একটা নাকফুল পড়ে আছে শুধু। সুফিয়া বেগমের থমথমে মুখের দিকে তাকালে যে কেউ চমকে উঠবে। কোনমতে আলমিরার দরজায় তালা লাগিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। রফিকের স্কুল বন্ধ। রফিক আর মিতা মোটা কাঁথার ভিতর ঘুমিয়ে আছে।
রহমত আলী বাজার করে ফিরেছেন। আজ বাজারে গরু জবাই হয়েছে। রহমত আলী দুই সের মাংস কিনেছেন। পোলাও এর চালের সাথে অন্যান্য তরিতরকারি। রহমত আলী উৎফুল্ল কণ্ঠে স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন- কি গো, এই যে তোমার বাজার। আজ সবাই মিলে একত্রে খাব। কতদিন একসাথে খাওয়া হয় না। রফিক আর মিতা কোথায়?
ওরা ঘুমিয়ে আছে। সুফিয়া বেগমের হিমশীতল কণ্ঠ শুনে রহমত আলী চমকে উঠলেন। তিনি সুফিয়া বেগমের দিকে তাকালেন। সুফিয়া বেগম উল্টা দিকে বসে একমনে রুটি বেলছেন। রহমত আলীর হতভম্ব ভাবটা দূর হচ্ছে না। তিনি আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। ঘরে গিয়ে রফিক আর মিতার পাশে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। কাঁথা গায়ে দেবার কথাটাও মনে রইল না। সুফিয়া বেগমের একটা কথাতেই মনের ভিতর নানা রকমের চিন্তা মাথায় খেলতে লাগলো। তিনি শোয়া থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে রওনা হতে গিয়েও আবার শুয়ে পড়লেন। কতক্ষণ কাটল তিনি টের পেলেন না। সেই হিমশীতল কণ্ঠ- রফিক, মিতা উঠ। সকাল হয়ে গেছে। নাস্তা খাবি আয়। রফিক ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে, মা, আর দশ মিনিট। দশ মিনিট না, এক্ষুনি উঠে হাত, মুখ ধুয়ে আয়। রহমত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও খেতে আস।
সেই শুরু, আরও দুইটি বছর কেটে গেছে। সুফিয়া বেগমের কণ্ঠের শীতলতা একটুও কমেনি। রহমত আলীও ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। দুজনের মধ্যে কথাবার্তায় শুধু সংসারের অতি প্রয়োজনীয় দু’চারটা বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করায় শেষ হয়। এটাকে অবশ্য আলোচনা বলা যায় না। সুফিয়া বেগম শুধু এটা লাগবে, ওটা লাগবে- অত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিসের কথা বলে যান, আর রহমত আলী মাথা নিচু করে শুনে যান। সাংসারিক একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দিতে গিয়েও রহমত আলীর বেশ বেগ পেতে হয়। চাল ভাঙ্গার কলের চাকুরীটাও দুইমাস যাবত নেই। চাল ভাঙ্গা কল নাকি বিক্রি হয়ে যাবে। তখন নতুন মালিক চাইলে হয়তো চাকরিটা পেতে পারেন। কথাটা সুফিয়াকে বলা হয়ে উঠেনি। কিন্তু রহমত আলীর মনে হচ্ছে বিষয়টা সুফিয়া বেগম জেনে গেছেন। তাই সংসারের প্রয়োজনের কথাগুলিও এখন কালেভদ্রে দু’একবার হয়। তাও যোগান দিতে হবে সেজন্য বলা নয়, শুধু জানানো। রহমত আলী সেগুলিও যোগান দিতে পারেন না। বর্গা দেয়া ক্ষেত থেকে ছয় মাসের চালের সংস্থান হয়ে যায়। বাকি ছয়মাস কিভাবে চলে আল্লাহ্ জানেন আর জানে সুফিয়া বেগম।
একদিন রহমত আলী সুফিয়া বেগমের সামনে রফিককে বললেন, রফিক তোর সুবল কাকার আজ শ্রাদ্ধ। দুপুরে যেতে বলেছে, যাবি? রফিক সুবল নামের কোন কাকা কে চেনে না। তবুও বলল আমি যাব বাবা। সুফিয়া বেগম কোন মন্তব্য করলেন না। চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।
এই দুই বছরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিশাল একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সুফিয়া বেগম মিতাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঘুমান। আর রহমত আলী রফিককে নিয়ে আরেক ঘরে। মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে মাঝরাতে সুফিয়া বেগমের ঘরে যান, গায়ে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ডাকেন। কিন্তু সুফিয়া বেগমের কঠিন দৃষ্টির সামনে তিনি মিইয়ে যান। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে এ ঘরে চলে আসেন। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘর-সংসার ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যান। কিন্তু সেই মনের জোর তার দু’বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। নিজেকে কেমন যেন মেরুদণ্ডহীন মনে হয়।
সুবল বাবুরা জাতে ময়রা। চার পুরুষের ব্যবসা। স্কুলে পড়ার সময় থেকে রহমত আলীর সাথে সুবল বাবুর বন্ধুত্ব। বাবার শ্রাদ্ধে বিশাল আয়োজন করেছেন তিনি। একেকটা কাঁসার থালায় পরাটা, ভাজি আর ডাউস সাইজের দুইটা মিষ্টি- একটা রসগোল্লা আরেকটা চমচম। একেকটা এক পোয়ার নিচে না। রফিক আস্তে করে বলে বাবা, আমি তো একটাও পুরো খেতে পারবো না। মিতা আর মায়ের জন্য এগুলি নিয়ে যাই। সবাই মিলে একসাথে খাব। রহমত সাহেব দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন সেটা সম্ভব না। রফিক মন খারাপ করে ধীরে ধীরে খেতে থাকে। রহমত আলী আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। তার মনটাও আদ্র হয়ে ওঠে।
শ্মশ্রুমণ্ডিত লোকটা যুবক রফিকের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি খেয়াল করলেন, ঘুমের মধ্যেই সে ছটফট করছে। তিনি জানেন রফিক কি দেখতে পাচ্ছে- বাড়িতে আজ চাল নেই। তিনটা আলু ছিল, সেগুলি সিদ্ধ করে মা আর মিতা খাচ্ছে। অন্যদিকে রফিক মনখারাপ ভাব দূর করে মিষ্টি দিয়ে পরাটা খাচ্ছে। মিষ্টিগুলি খুব ভালো হয়েছে। প্রথমে খেতে পারবে না বলে মনে হলেও দেখা গেল দুটি মিষ্টিই খেয়ে ফেলেছে সে। বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বিজয়ীর হাসি হাসল। রফিকের হাসির জবাবে রহমত আলীও হাসলেন।
একদিন দুপুর বেলা রহমত আলী খেয়াল করলেন, সুফিয়া বেগমের চোখ-মুখ ফুলে আছে। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। খাওয়া দাওয়ার প্রতি তেমন একটা মন নেই। সবসময়ই কেমন বমি বমি ভাব থাকে। এরপর বমি হতে থাকে। মাঝে মাঝে তার শ্বাসকষ্ট হয়। একদিন সুফিয়া বেগম মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় রহমত আলী রামু ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। তিনি সুফিয়া বেগমের হাতের নাড়ি দেখে চমকে উঠলেন। সুফিয়া বেগমের ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে খানিকটা ভড়কে গেলেন মনে হয়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে কি একটা ট্যাবলেট বের করে সুফিয়া বেগমের জিহবার নিচে দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ রোগীর পাশে বসে রইলেন। সুফিয়া বেগম এখন স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিচ্ছেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। রামু ডাক্তার রহমত আলীকে ঘরের বাইরে এনে সুফিয়া বেগমের শারীরিক সমস্যার আদ্যোপান্ত জানিয়ে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। মনে হয় ঢাকাতেও নিতে হতে পারে। লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। টাকা পয়সাও যতটা পারেন হাতে রাখবেন।
সুফিয়া বেগম শুয়ে থেকেও রহমত আলী আর ডাক্তার সাহেবের সব কথা শুনতে পেলেন। রহমত আলী ঘরে ঢুকতেই কণ্ঠে যতটুকু পারা যায় জোর দিয়ে বললেন, আমার চিকিৎসার জন্য কেউ যেন উতলা না হয়। আমি যেভাবে আছি, সেভাবেই যেন থাকতে দেয়া হয়। রহমত আলী নানাভাবে সুফিয়া বেগমকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। মাফ চাইবার জন্য সুফিয়া বেগমের হাত ধরলেন। সুফিয়া বেগম এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলেন। খাটের কোণায় বসা রহমত আলী নিচে পড়ে গেলেন। কি এক আদিম উন্মাদনায় তিনি দরজার পাশে রাখা ডাঁশা নিয়ে একে একে ঘরের সমস্ত কিছুর উপর হামলে পড়লেন রহমত আলী। প্রচণ্ড শব্দে পাশের ঘর থেকে রফিক এসে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর সারা শরীর ভয়ে কাঁপতে থাকে। বাবার এমন আচরণ, এমন রক্তচক্ষু জীবনে দেখেনি। মিতা ঘুম থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে।
একসময় রহমত আলী মাথায় হাত রেখে মাটিতে বসে পড়েন। সুফিয়া বেগমের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। রহমত আলী খোকনের দিকে তাকালেন- এই জানোয়ারের বাচ্চা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ঘরে যা। রফিক ওর ঘরে না গিয়ে মায়ের খাটে উঠে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ফোঁপাতে থাকে। রহমত আলী একসময় শান্ত হন। একেবারে শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। মাটিতে পড়ে থাকা একটা শার্ট তুলে নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। একবারের জন্যও রফিক, মিতা আর সুফিয়া বেগমের দিকে ফিরে তাকালেন না।
এরই মধ্যে ছয়মাস পেরিয়ে গেছে। রহমত আলী সেই যে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, আজও ফিরেন নি। কোথায় আছে, কেমন আছে লোকটা- ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। ঘরে জমানো কিছু টাকা, কোথায় রেখেছেন তা শুধুমাত্র তিনিই জানতেন সেগুলিও একসময় শেষ হয়ে গেল। তিনি অসুস্থ অবস্থায় বাবার বাড়িতে গিয়ে নিজের প্রাপ্য অংশটুকু বুঝে নিয়ে এলেন। এমন দুরাবস্থায় কেউ তেমন কোন বাঁধা দিলো না। একবার সুফিয়া বেগমের মা বললেন, তুই এখানেই থেকে যা, চিকিৎসা করা। সুফিয়া বেগমের কণ্ঠের ঝাঁঝে ওনাকে থেমে যেতে হয়েছে- ওখানেই আছি, মরলে ওখানেই মরব। দিনে দিনে সুফিয়া বেগম চলাফেরার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু অসম্ভব মনের জোরে তিনি এখনো চারিদিকে খেয়াল রাখছেন। শুধু রাত হলে মিতা যখন ঘুমিয়ে যায়, তিনি কান পেতে থাকেন, এই বুঝি রহমত আলী ঘরের দরজায় টোকা দিলো। সে আশাও পূর্ণ হয় না। এই ভাঙ্গা শরীরেও তিনি নিজেই সবকিছু করতে চান। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারেন না। একদিন করিমের মা এসে বললেন, শোন বৌ, রতনের মাকে ওর বাবা তালাক দিয়েছে। ওদের সংসারের অবস্থা তো জানই। যদি ভালো মনে করো, ওকে তোমার এখানে এনে রাখ। সব কাজ করে দেবে। শুধু তিনবেলা মা, ছেলেকে খাইয়ে দিও। আর জেদ বাদ দিয়ে চিকিৎসা করাও। সুফিয়া বেগম উত্তরে বলেন, রতনের মা’কে পাঠিয়ে দিবেন।
ইদানিং গোসল করাও বন্ধ করে দিয়েছেন সুফিয়া বেগম। প্রায় সারাক্ষণই শুয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে বিছানা থেকে নামেন। কিন্তু পায়ে তেমন একটা জোর পাননা বলেই ধপাস করে বিছানায় বসে পড়েন। গোসল না করার কারনেই হয়তো মাথার চুলে জট বেঁধেছে। রতনের মা কোন কোন সময় শরীর মুছিয়ে দিয়ে যায়। মাথায় একটু পানি পড়লেই সুফিয়া বেগম চিৎকার করে উঠেন। ধীরে ধীরে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে থাকেন। বেশিরভাগ সময় ঘোরের মধ্যে কাটে। মাঝে মাঝে চোখ খুলে এদিক ওদিক কি যেন খুঁজে বেড়ান। চোখের কোণায় পানি জমে, কিন্তু যা দেখতে চান তা হয়তো দেখা হয় না বলেই ভাঙ্গা গাল বেয়ে জমে ওঠা পানি নেমে আসে। নখগুলি অনেক লম্বা হয়ে গেছে। রতনের মা অনেকবার চেষ্টা করেও নখ কাঁটার কাজটি করে উঠতে পারেনি। হাত ধরলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে যান সুফিয়া বেগম। কোন সময় কি ঘটে যায় ভেবে রতনের মা সুফিয়া বেগমের হাত, পায়ের নখ কাঁটার চিন্তা বাদ দিয়েছে। একদিন রফিক মায়ের মাথার পাশে বসে বলে, মা, আমি তোমার নখ কেটে দেই। দেখ কতো বড় হয়ে গেছে। নখের ভিতর কত ময়লা। সুফিয়া বেগম ঘোর লাগা চোখে রফিকের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসেন। বুঝা যায় না এমনভাবে রফিকের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দেন। রফিক দৌড়ে দোকান থেকে ব্লেড নিয়ে এসে দেখে মা কেমন যেন ছটফট করছে। হয়তো শারীরিক কোন প্রচণ্ড কষ্ট তাকে কাবু করে ফেলেছে। রফিক মায়ের হাত ধরে। সুফিয়া বেগম স্থির হয়ে থাকেন। মনে পড়ে ছেলে তার হাত, পায়ের নখ কেটে দেবে। প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তি দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখেন। রফিক খুব সতর্কতার সাথে মায়ের হাতের আঙ্গুলের নখ কাটতে থাকে। শান্ত থাকতে চাইলেও প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে নড়ে উঠেন। কোন অঘটন না ঘটে যায়, সে কারনে বার বার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে অস্বাভাবিক ধৈর্য নিয়ে মায়ের একহাতের নখ কেটে দেয়। মায়ের ওপাশে গিয়ে অন্য হাতটি ধরতেই সুফিয়া বেগম ছটফট করতে থাকেন। জটা চুলের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে যায় রফিক। একসময় সুফিয়া বেগম শান্ত হন। রফিক মায়ের আরেক হাতের নখ কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে রফিক বুঝতে পারে না। একসময় নখ কাটার কাজ শেষ হয়। রফিক মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমের মধ্যেই চেহারায় কষ্টের ভাবটা স্পষ্ট ফুটে আছে। রতনের মা ভাত খাবার জন্য ডাকলে রফিকের ঘোর কাটে। খুব সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে আসে, যাতে মায়ের ঘুম না ভাঙ্গে।
হঠাৎ করেই একদিন সকালে রহমত আলী ফিরে এলেন। খোকন, মিতার জন্য খেলনা, সুফিয়া বেগমের জন্য নতুন শাড়ি আরও কতকিছু। উচ্ছসিত মুখটা হঠাৎ করেই নিভে যায় রহমত আলীর। এ কে? সুফিয়া বেগমকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। শরীর একেবারে ভেঙ্গে পরেছে। মাথার প্রায় পুরোটা জুড়েই জটা। রহমত আলীর গলার আওয়াজ পেয়ে কি করে যেন বিছানা থেকে উঠে এসেছেন। দরজার একপাশ ধরে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন- তুমি এসেছ? সুফিয়া বেগম হাসতে চেষ্টা করছেন। আজ তার খুব আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে সবাইকে বলেন- রফিকের বাবা এসেছে, রফিকের বাবা এসেছে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মুহূর্তে রহমত আলী দৌড়ে এসে সুফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। পাঁজা কোলে করে তাকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেন। মাথার পাশে বসে জিজ্ঞেস করেন?
খুব খারাপ লাগছে সুফিয়া?
সুফিয়া বেগম অতিকষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন। মৃদুস্বরে কি যেন বললেন, রহমত আলীর কান পর্যন্ত তা পৌঁছে না। জটা ভরা মাথায় খুব হালকা করে হাত বুলাতে বুলাতে রফিককে ডাক দেন। রফিক ঘরে এসে পৌঁছে বাবার সামনে দাঁড়াতেই রহমত আলী বললেন, রফিক, দেখত গোসলখানায় সাবান আছে কি না? ঘুমন্ত সুফিয়া বেগমের দিকে একপলক তাকিয়ে আলমিরাতে নারিকেল তেল খুঁজতে লাগলেন। একটা সাদা বোতলে খুব সামান্য পরিমাণ তেল আছে। এর মধ্যে রফিক এসে বলে, বাবা গোসলখানায় অল্প একটু সাবান আছে। রহমত আলী পকেট থেকে টাকা বের করে বললেন, এই বোতলে করে একপোয়া নারিকেল তেল আর তিনটা গায়ে মাখা সাবান নিয়ে আসবি। তোরা কিছু খেয়েছিস?
খালা এলে রুটি বানিয়ে দেবে, তারপর খাব। রহমত আলী আরও কিছু টাকা রফিকের হাতে দিয়ে বললেন, বাজার থেকে নাস্তাও নিয়ে আসবি। মিতা কি ঘুমুচ্ছে?
হ্যাঁ বাবা।
যা, তাড়াতাড়ি পারিস ফিরে আসবি কিন্তু। যা যা বলেছি সব মনে আছে তো?
মনে আছে বাবা।
রতনের মা এসেছে। রহমত আলী তাকে সুফিয়া বেগমের কথা জিজ্ঞেস করলেন- ওর এমন অবস্থা হল কিভাবে?
আপনি চলে যাবার পর আপা কিছুই খেতে চাইত না। খেলেই বমি করে দিতেন। মাঝে মাঝে কোমরের পিছনে খুব ব্যাথা হত। ব্যাথার চোটে তিনি পাগলের মত বিছানায় গড়াগড়ি করতেন।
ওর মাথায় এত জটা বাধল কিভাবে?
আপা গোসল করতে চাইত না। গোসল করতে গেলেই নাকি তার ভয় লাগত। মাঝে মাঝে আমি ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতাম। মাথায় পানি দিলেই চিৎকার করে উঠতেন। আর ওনার সাথে কাউকে শুতে দিতেন না। রফিক আর মিতা একসাথে ঘুমাত। আমি মাঝে মাঝে পাটি বিছিয়ে নিচে ঘুমাতাম। আপা সারারাত ছটফট করতেন। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বলতেন- রফিকের বাবা এসেছে। এই বলেই উঠে বসে কেমন করে যেন চারিদিকে তাকাতেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও। আজ নাস্তা বানাতে হবে না। রফিক বাজার থেকে নাস্তা আনতে গিয়েছে। তুমি মিতাকে উঠিয়ে মুখ, হাত ধোয়াও। আর তোমার ছেলে কোথায়? রতন ওর বাবার সাথে চলে গেছে ভাইজান।
ও, আচ্ছা বলেই রহমত আলী চুপ করে গেলেন। রতনের মা মিতাকে ঘুম থেকে উঠাতে যাবার সময় রহমত আলী বললেন, আজ সুফিয়াকে গোসল করাব। তুমি একটু সাহায্য কর। ঠিক আছে ভাইজান।
সকালের নাস্তা শেষ করে নারিকেলের তেলের বোতল নিয়ে সুফিয়া বেগমের ঘুমন্ত মুখের দিকে চাইলেন। মুখটা বড় ক্লান্ত, কিন্তু কি যেন এক সুখানুভূতিতে ঝলমল করছে।
রহমত আলী তেলের বোতল থেকে তেল নিয়ে চুলের জটায় মাখছেন আর খুব ধীরে ধীরে একটা একটা করে চুল আলাদা করছেন। রতনের মা কিছু একটা বলতে গিয়ে রহমত আলীর ইশারায় থেমে গেল। রতনের মাকে ইশারায় দুপুরের খাবার রাঁধবার জন্য বললেন। প্রায় দুপুর হয়ে এল। রহমত আলী তেল দিয়ে চুলের জটা ছাড়িয়ে ফেলেছেন প্রায়। তেল মাখা হাতটা মুছে পাশ ফিরে শোয়া সুফিয়া বেগমের বাহুতে হাত রেখে খুব আস্তে করে ডাকলেন, সুফিয়া?
এই এক ডাকেই সুফিয়া বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুরে রহমত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন।
সুফিয়া শোন, তুমি আজ গোসল করবে, ঠিক আছে? রতনের মা রান্না শেষ করে এলে দুজনে মিলে তোমাকে গোসল করাব। সুফিয়া বেগম কেমন ভীত দৃষ্টিতে তাকালেন। রহমত আলী বললেন, ভয় পাচ্ছ কেন, আমি সাথে থাকব।
সুফিয়া বেগম ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললেন, তুমি একা গোসল করিয়ে দিতে পারবে না? বলেই কেমন লাজুক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, খুব পারব। এখন যাবে?
তুমি একটু বস। রতনের মাকে ডেকে দাও। আমি একটু পরে যাব। রতনের মাকে নিয়ে সুফিয়া বেগম বাথরুমে গেলেন।
রহমত আলী একটা আস্ত সাবান সুফিয়া বেগমের মাথায় ঘষলেন। সুফিয়া বেগমকে সত্যিই আনন্দিত মনে হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। রহমত আলী জিজ্ঞেস করলেন- হাসছ কেন?
সুফিয়া বেগম টেনে টেনে বলতে লাগলেন, বিয়ের পরপরই আমার লম্বা চুল নিয়ে ঠাট্টা করেছিলে মনে আছে?
রহমত আলী শব্দ করে হেসে উঠেন। ঐ যে একদিন তুমি বললে চুলায় দেবার জন্য লাকড়ি জোগাড় করতে। আমি হেসে ঠাট্টা করে বলেছিলাম- তোমার যে লম্বা চুল, অর্ধেক চুল চুলায় দিলেই একদিনের রান্নাবান্না হয়ে যাবে। তুমি আমার দিকে এই বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খোঁপা খুলে চুলের মাথা চুলার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলে। মাগো, সেদিন যদি আমি না থাকতাম তুমি পুড়েই শেষ হয়ে যেতে।
তুমি আমার মাথায় পুরো এক কলসি পানি ঢেলে দিয়েছিলে। ঐদিনের রান্নাটা তোমাকেই করতে হয়েছিল। শব্দ করে হাসির শক্তি পাচ্ছেন না সুফিয়া বেগম। কথাগুলি বলেই কেমন যেন হাঁপাতে লাগলেন। কিন্তু সারামুখ জুড়ে প্রশান্তির ছায়া ভেসে আছে। রহমত আলী একনজর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে আল্লাহ’র কাছে কতকিছু চাইলেন। আল্লাহ্ চাইলে কি না করতে পারেন। সুফিয়া বেগমকে এই মুহূর্তে একেবারে সুস্থ করে দিতে পারেন। এমন আশ্চর্য কাণ্ড হবে কি? তিনি কায়মনবাক্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালা’র কাছে স্ত্রীর সুস্থতার জন্য দোয়া করতে লাগলেন।
রহমত আলী রতনের মাকে বলে রাতে ভালো কিছু রান্না করার কথা বলেন। সুফিয়া বেগম কোন কথা বলল না। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর সুফিয়া বেগম রফিককে বললেন, তুই আর মিতা পাশের ঘরে থাকবি। আজ তোদের বাবা আমার সাথে থাকবে।
ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
আমাকে একটু পানি খাওয়াবে?
রহমত আলী উঠে গিয়ে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। পিঠের নিচে হাত দিয়ে বসালেন। এক ঢোঁক পানি খাবার পর সুফিয়া বেগম বললেন, আর খাব না। তিতা লাগছে।
রহমত আলী গ্লাস রেখে বিছানায় এসে সুফিয়া বেগমের পাশে শুলেন। সুফিয়া বেগম অতিকষ্টে স্বামীর দিকে পাশ ফিরলেন।
এই, আমার হাতটা একটু ধরতো।
কি, কোন অসুবিধা হচ্ছে?
না, তুমি আমার হাতটা শুধু ধরে থাক।
কিছু বলবে?
হ্যাঁ, আমার ভুল হয়ে গেছে, অনেক বড় ভুল করেছি। তোমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রেখেছি। এটুকু বলেই হাঁপাতে লাগলেন। রহমত আলী চুপ করে সুফিয়া বেগমের হাত ধরে বসে আছেন। বললেন, এসব কথা এখন থাক। তুমি একটু ঘুমাও।
সুফিয়া বেগম যেন বহুদূর থেকে কথা বলছেন। কোথায় টাকা পয়সা রাখা আছে, ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার বিষয়ে অনেক কথা বললেন। দুহাত দিয়ে স্বামীর হাত ধরে বললেন, তুমি আসার পর থেকে আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। এভাবে সারাজীবন তোমার হাত ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে। তোমার বুকে মাথা রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। রহমত আলী বললেন, অবশ্যই তুমি, আমি, রফিক, মিতা সবাই মিলেমিশে থাকবো।
সুফিয়া বেগম শ্বাস টেনে টেনে বলতে লাগলেন, সময় যে শেষ গো। আমি আর বাঁচব না। তুমি আমাকে বাঁচাবে?
অবশ্যই। সকালেই আমরা ঢাকা যাব। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুমি অবশ্যই সুস্থ্য হয়ে উঠবে। সুফিয়া বেগম রহমত আলীর কথা শুনতে পেলেন না। শুধু বললেন, আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে থাক। ফজরের আজান দেবার সাথে সাথে সুফিয়া বেগমের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আজান দেয়া শেষ হওয়া মাত্র সুফিয়া বেগম তার বাঁচার আশাকে সাথে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ফজর নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত রহমত আলী সুফিয়া বেগমের মাথা কোলে নিয়ে বসে রইলেন- যেন এক পাথরের মূর্তি-স্থির, নিষ্কম্প।
শুশ্রুমণ্ডিত, লম্বা চুলের সূঠাম দেহের লোকটি রফিকের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা যন্ত্রণায় কেমন যেন হয়ে গেছে। ডান চোখের কোণ গড়িয়ে অঝোরে জল গড়াতে লাগলো। ওকে দেখে লোকটাও কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। একবার মনে হল রফিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। একটু স্পর্শেই হয়তো রফিকের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে, আবার নাও হতে পারে। রফিকের আরও কিছু দেখার আছে। তিনি নিশ্চুপ হয়ে রফিকের পাশে বসে রইলেন। স্পর্শ না করেও তিনি বুঝতে পারছেন, ঘুমের মধ্যেও আপনজন হারানোর তীব্র অনুভূতিটা রফিককে কেমন কষ্ট দিচ্ছে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর রহমত আলীকে আত্মীয়, স্বজনেরা অনেক পিড়াপীড়ি করেছে আরেকটা বিয়ে করতে। কিন্তু রহমত আলী কোন কথায় কান দেন নি। কিছু জায়গা জমি বিক্রি করে সে টাকায় নিজেকে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে নিলেন। ব্যবসায় আশাতিত লাভ হতে লাগলো। একের পর এক জায়গা, সম্পত্তি কিনতে লাগলেন। দান, খয়রাতেও উদারহস্ত। যৌক্তিক কারনে যে কেউ সাহায্যের জন্য আসলে তিনি ফিরিয়ে দেন না। সাহায্যপ্রার্থীর চাওয়ার আশা ছাপিয়ে এত বেশি দেন যে, সাহায্যপ্রার্থীও মাঝে মাঝে বিব্রত হয়ে পড়ে। একান্ত অবসরের সময়টুকু সুফিয়া বেগমের বাঁধান ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। চোখের কোণে জল জমতেই মুখ ফিরিয়ে দাম্পত্য জীবনের অসাধারণ স্মৃতিগুলি হাতড়াতে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সুফিয়া বেগম রান্নাঘরে আছেন। খাবার খেতে ডাকতে আসবেন। নিজের অজান্তেই অপেক্ষা করতে থাকেন। একসময় ঘোর ভাঙ্গে। খেতে ডাকবার জন্য সুফিয়া বেগম আর নেই। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে চান। চিৎকারের আওয়াজটা মনের ভিতরে ছটফট করতে থাকে বেরিয়ে আসার জন্য।
ছেলে-মেয়েদের প্রচুর সময় দেন। সুফিয়া বেগমের অনুপস্থিতিটা ওদেরকে তিনি পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মিতা এখন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী। শরীরটা কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। আজকে ঘর থেকে বের হননি। রফিক কলেজে, মিতা স্কুলে গেছে। শুয়ে বসে কতক্ষণ থাকা যায়। তিনি মিতার ঘরে ঢুকলেন। পড়ার টেবিলে সুন্দর করে বইপত্র সাজানো। একবছর আগের কেনা বই, এখনো নতুনের মতো। মেয়ে তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। যেখানে যেটা থাকার দরকার, সেখানেই সেটা থাকবে। তিনি প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে মেয়ের পড়ার চেয়ারে বসে বইগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। বাচ্চাদের মতো একবার সব এলোমেলো করে রাখার কথা মনে হল। হাস্যকর চিন্তা- দেখা যাক মেয়ে কি করে। তিনি একে একে বইগুলি এলোমেলো করতে লাগলেন। তার মুখে হাসি। একটা একটা বই এদিক ওদিক রাখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। মোটা একটা বই সরাতে গিয়ে বেশ কয়েকটা কাগজ মাটিতে পড়ে যায়। তিনি বইটি টেবিলের উপর রেখে কাগজগুলি তুলতে লাগলেন। একটা কাগজের ভাঁজ খুললেন। তিনি পড়তে শুরু করলেন। পড়তে পড়তে তার দু’চোখ জ্বলতে লাগলো। চিঠির নিচে সুজনের ছেলের নাম লেখা- সেই সুজন, যার জন্য তার পুরো সংসার এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তিনি আরেকটা কাগজের ভাঁজ খুলে পড়লেন। একটা একটা করে সবগুলি কাগজ পড়া শেষ করলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে। তিনি কাগজগুলি ভাঁজ করে সব আগের মতো করে সাজিয়ে নিজের ঘরে গেলেন।
রহমত আলী একটা কাগজ হাতে নিয়ে শোবার ঘরে খাটের উপর বসে আছেন। মনের ভিতর তোলপাড়- চরম উত্তেজনায় ছটফট করছেন। তিনি মনের ভাবনাকে অন্যদিকে সরাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিছানার পাশে ছোট টেবিলে রাখা হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন। সকাল দশটা। মিতার ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। রফিকের আসার ঠিক নেই। কলেজে কি যেন আন্দোলন হচ্ছে। ক্লাশ হচ্ছে না। রহমত আলীর কড়া নির্দেশ, কোন আন্দোলন ফান্দোলনে রফিক যাতে জড়িয়ে না পরে। তাই কলেজে গেলেও বাবার নির্দেশ মান্য করে প্রায়ই কলেজে গিয়েও সকাল সকাল ফিরে আসে।
রহমত আলীকে অবাক করে দিয়ে বাইরে ভাই-বোনের হাসাহাসির শব্দ শুনতে পেলেন। অন্যদিন হলে খুশিতে তার মনটা ভরে উঠত। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। মিতা ঘরে ঢুঁকেই বলতে লাগলো, জান বাবা, আমাদের সোহরাব স্যার আজ ভোরে মারা গেছে। তাই স্কুল ছুটি। রাস্তায় ভাইয়ার সাথে দেখা ......... কথাগুলি শেষ করার আগেই রহমত আলী মিতার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ফর্সা গালে আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে। মিতা একদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করছে। যে কোন মুহূর্তেই গাল বেয়ে নেমে আসতে পারে। মিতার স্থির হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকায় রহমত আলী আরও উত্তেজিত হয়ে গেলেন। একটার পর একটা চড় মেরেই চলছেন। রফিক বাবার অগ্নিমূর্তি দেখে প্রথমে হকচকিয়ে যায়। একটু পরেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বাবাকে সরিয়ে দেবার জন্য হালকা ধাক্কা দেয়। উত্তেজিত রহমত আলীর কাঁপতে থাকা শরীর মাটিতে পরে যায়। রফিক অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাকে টেনে তুলবার কথাটাও ভুলে যায়। রহমত আলী অনেকক্ষণ বসে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। রফিকের দিকে একনজর তাকিয়ে বিছানায় উঠে বসেন। ইতিমধ্যে মিতা ওর রুমে চলে গেছে। রফিক বাবার সামনে এগুতেই হাত ইশারায় কাছে আসতে বারণ করলেন রহমত আলী। বললেন, এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। এক মুহূর্তও এই বাড়িতে তোকে দেখতে চাই না। রফিক আবারো বাবার কাছে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু রহমত আলীর চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস হারিয়ে ফেলে। কাউকে, এমনকি মিতাকেও কিছু না জানিয়ে রফিক মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে। জানার সুযোগ হয়নি, মিতা এমন কি অপরাধ করেছে যে, বাবা ওকে এভাবে মারল। মিতা যদি কিছু করেই থাকে তাহলে আগে জিজ্ঞেস করে নিত। যাকে জীবনে একটা ধমক দেয়নি বাবা, সে মেয়েটাকে এভাবে মারল ! বাবার প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে কলেজের দিকে রওনা দিল। মিছিলে যোগ দিল। অভুক্ত পেটে জামিন হিসাবে তিন কাপ চা আর দুইটা নোনতা বিস্কুট খেয়েছে।
রহমত আলী ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত একটা বাজে। সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড অস্থিরতায় সময় কাটছে। রতনের মা একবার রহমত আলী আর মিতাকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করতে এল। রহমত আলীর প্রচণ্ড ধমক খেয়ে রতনের মা চলে গেল। মিতাকে ডাকতে গিয়েও দেখে সে শুয়ে আছে। বাবার মত প্রচণ্ড ধমক না দিলেও কঠিন দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, রতনের মা ঘ্যানঘ্যান না করে চলে গেলেই ভাল হয়। রহমত আলী এক গ্লাস পানি খেয়ে খুব সন্তর্পণে মিতার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন ও শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা, কে জানে। একবার মনে হয়েছিল মেয়েকে ডেকে রফিকের বিষয়ে আলাপ করে। কিন্তু একরোখা মনটাকে জেদের আবরণে ঢেকে রাখলেন। নিজের খাটে এসে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম আসেনা। তিনি বিছানার এপাশ ওপাশ করতে থাকেন। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে ছেলেটা কোথায় আছে? কোথায় খুঁজতে যাবেন এই মধ্য রাতে। কিছুক্ষণ এমন এলোমেলো ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ছাতা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। একটু এগুনোর পর ঝটকা বাতাসে ছাতাটা উড়ে গেল। ছাতা কুড়িয়ে আনার জন্য তিনি থামলেন না। জোর কদমে হাঁটতে লাগলেন। এরই মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছেন। এখন মাথায় বৃষ্টি ভেজা শরীরের চিন্তা নেই। কোন একটা নির্দিষ্ট লক্ষে তাকে পৌঁছাতে হবে। তার মন বলছে তিনি যা ভাবছেন সেটাই হবে।
মিতা দরজায় দাঁড়িয়ে বাবাকে বাইরে বেরুতে দেখে। ঘরের ছিটকিনি তুলে বাবার পিছু পিছু সেও রওনা দেয়। বাবা এমন পাগলের মত হাঁটছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বাবার হাঁটার সাথে তাল মেলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাঁপটায় শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে বাবাকে অনুসরণ করে দৌড়াচ্ছে। রাস্তার বাঁকটা ঘুরতেই মিতা বুঝতে পারলো বাবা কোথায় যাচ্ছে।
কত সময় পেরিয়েছে কেউ ওরা বলতে পারবে না। রহমত আলী সুফিয়া বেগমের কবরের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রফিক একহাতে মায়ের কবর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তিনি রফিকের শরীরে আলতো করে হাত রাখলেন- একেবারে বরফের মত ঠাণ্ডা। তার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। রফিকের কিছু হয়ে যায়নি তো! ও যেভাবে নিশ্চল হয়ে আছে! আল্লাহ্ মাফ কর- এসব কি ভাবছেন তিনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মানুষ যেভাবে অস্ফুট কান্নায় কেঁপে উঠে রফিকও সেভাবে কেঁপে উঠলো। রহমত আলীর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় কান্নার জল ঝরছে। এই বয়সেও এমন বাড়বাড়ন্ত ছেলেকে কাঁধে উঠিয়ে নিলেন। রফিককে কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। একটু পিছলে পড়লে রফিক পরে যাবে। ওর খুব ব্যথা লাগবে। তারপরেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রফিককে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।
কবরের নিচু দেয়ালের বাইরে মিতা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চোখে পরে ধবধবে সাদা পোষাকে শ্মশ্রুমণ্ডিত; পোষাকের মতোই ফর্সা লম্বা সুগঠিত কে একজন বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:০৬
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: সে একজন