![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভোরের কাগজ : Click This Link
আঞ্চলিক দুই শক্তি সুন্নিপন্থি সৌদি আরব এবং শিয়াপন্থি ইরানের মধ্যকার বিরোধ যখন চরমে তখন সারা পৃথিবীর বাদবাকি দেশের মুসলমানরা শঙ্কিত। এই দুই দেশের দুইটি ভিন্ন কিন্তু আকিদাগতভাবে সমগোত্রীয়দের পারস্পরিক যুদ্ধ প্রকারান্তে পুরো ইসলাম ও এর সামগ্রিকতাকে প্রশ্নবিদ্দ করছে। এ ঘটনার পরম্পরায় সারা বিশ্বের মুসলমানরা মূলত দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। যার একদিকে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হজব্যবসায়ী, তেলবণিক সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতারসহ আফ্রিকার কিছু দেশ। যারা আবার ইসরাইল ও পশ্চিমাগোষ্ঠীর যোগ্যসহচর, পরমবন্ধু। আর অন্যদিকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ শিয়া অধ্যূষিত ইরান, সিরিয়াসহ অন্য কিছু আরব দেশ। এরা আবার আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের চক্ষুশূল, চিরশত্রু। তবে ইরানপন্থি জোটের সামরিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে বুঝা যায়, এরা ঠিকই তাদের আদিম শত্রু পশ্চিমা চক্রটিকে চিনতে পেরেছে। আর সেটা মোকাবেলায় নিজেদেরকে পশ্চিমা আদলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান-চিকিৎসা আর পরমাণুতে সম্মৃদ্ধও করেছে। কিন্তু সৌদি জোট সে তুলনায় থেকে গেছে অনেক পশ্চাতে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাদের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত নেই একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী, কিংবা চিকিৎসায় নেই একজন ভালো গাইনি বিশেষজ্ঞ। পাশ্চাত্যের সব ধার করা সাময়িক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক জ্ঞান নিয়ে খনি থেকে তেল আর সোনা তুলে বিকিকিনি করে এ দেশটি নিজেদের রিজার্ভ বাড়িয়েছে কেবল। আর ওই টাকায় দেশটির শাসকশ্রেণি সমুদ্র ও লেকের ধারে বিলাসবহুল বাড়ি করে দিনে দিনে পত্নী-উপপত্নীর সংখ্যা বাড়িয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেসব তেলকুবের ধনাঢ্যরা আরবের নীল জলে পানীয়বোঝাই প্রমোদ তরীতে উৎসবে মজেছে পশ্চিমের কুশীলবদের সঙ্গে।
বিপরীতে তেল সম্মৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতিতে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর সেখানে সুন্নিদের তুলনায় সংখ্যালুঘু শিয়ারা হয়েছে পদে পদে নিগৃহীত ও অবহেলিত। সৌদি পরিবার ও দেশটির শেখদের বিরুদ্ধে যেমন এইরুপ অপচয়, ভাগাড়ম্ভরতা আর রাজতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ পাওয়া যায়, তেমনি ভাবে বিভিন্ন সময় ইরানের দেশকর্তাদের বিরুদ্ধেও অনেক উচ্চাভিলাষ, নিপীড়ন, স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। সেখানে আবার শিয়াদের হস্তক্ষেপে সুন্নি সহ বাকি মুসলিমগোষ্ঠীগুলো সামাজিক ও নাগরিক বিভিন্ন সুবিধা থেকে সবসময়েই বঞ্চিত হয়ে আসছে। তবে এতকিছুর পরও সুন্নি অধ্যূষিত সৌদিয়ানদের চেয়ে শিয়াপন্থি ইরানি জনগণের দেশপ্রেম ও বিশ্বায়নের প্রশংসা করতে হয়। রাজা-খলিফা শাসিত মরু অঞ্চলের দেশ সৌদি আরবের মাটির তলায় যদি এত অঢেল সম্পত্তি না থাকতো এ জাতিটিকে এখন নিশ্চয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হতে হতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইরানীরা নিজেদের একক চেষ্টা ও ক্ষমতায়- প্রযুক্তি, প্রাত্যহিক জীবনমান, পরমাণু বিজ্ঞান আর চিকিৎসায় ব্যাপক উন্নয়ন আনতে সক্ষম হয়েছে।
তবে মূলত এ দুটি দেশ নিজ দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যসব দেশ ও মুসলমানদের ধর্মীয় রাজনীতির খোলসে বিবেচনা করে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি সংকটের শিকড় আজ এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশ পর্যন্ত এতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাই দেখা যায়, যুদ্ধের ময়দানেও জাতভাই শিয়া মুসলমান নিধনে ন্যাটো জোটের পক্ষ নিয়ে সিরিয়া ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আজ অবধি স্থল ও আকাশ পথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সুন্নি মতালম্বি সৌদি আরব। যেখানে ঐতিহাসিক শত্রু ইরানকে পেয়েছে জাদরেল প্রতিপক্ষ হিসেবে। সৌদি-ইরান পরিস্থিতি এমন যে- আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরানের চোখে যেসমস্ত দেশ ও বিশ্বনেতারা শত্রু বলে বিবেচিত হবে। সেই ইঙ্গো-মার্কিন জোটকে যেকরেই হোক বন্ধু বানাবে প্রিন্স-বাদশা শাসিত সৌদি সরকার। এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ইরানের আকাশে যদি কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেখানে বিষাদের কালো মেঘ ছড়িয়ে দিবে সৌদি আরব। আরব বলয়কেন্দ্রিক মুসলিম বিশ্বে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পাকাপোক্ত করতে অনেক সময় এ দুই পক্ষ আবার কোনো না কোনো ভাবে সাম্রাজ্যবাদি ইইউ-মার্কিন শক্তি ও সমাজতান্ত্রিক রাশান বলয়ের লেজেও ভর করে। হিসেবটা এমন যে, বর্তমানে মুসলিম দেশ সিরিয়ায় আইএস দমনে আমেরিকার হয়ে সৌদি আরব বিমান হামলা করছে, আর রাশিয়ার হয়ে তা প্রতিরোধ করছে ইরান। অনেক সময় এ দুটি শ্রেণির ভেতর উগ্রবাদি মহলগুলো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে প্রায়ই নিজেরাও রক্তাক্ত হয়। আর সে সুযোগটাই নিয়ে থাকে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুরা। ইসলামের বিরোধীতাকারি চক্রগুলো মুসলমানদের শিয়া-সুন্নি টাইটেলের জাত্যভিমান ও ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে সমস্যা জিইয়ে রাখে। পরে সেসব দেশে অত্যন্ত সুকৌশলে বসিয়ে দেয় তাদের আজ্ঞাবহ কূটব্যবসাবান্ধব পুতুল সরকার, যারা নাকি শুধু পাশ্চাত্য স্বার্থ দেখবে। এখনকার ইরাক, আফগানিস্তান, মিশর, তিউনেসিয়া, লিবিয়া, ও ইয়েমেনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এ আকাট্য সত্যের প্রমাণ মেলে। ইসলামের বিরোধীরা কইয়ের তেলে কই ভাজে। এরা ষড়যন্ত্র করে সুন্নি মুসলিমদের অস্ত্র তার জাতভাই শিয়ার দিকে ঠেকানোর পাঁয়তারায় লিপ্ত থাকে।
ইরান ও সৌদি সম্পর্কের এমন ঘাত-প্রতিঘাত আঞ্চলিক কারণেই কয়েক দশক ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। প্রথম বারের মতো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবে পশ্চিমা-সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি উৎখাত হওয়ার পর তেহরান-রিয়াদ সম্পর্কে বিশেষ টানাপোড়েন শুরু হয়। তবে ১৯৮৭ সালে খোমেনির একটি বিরূপ মন্তব্যের পর সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যায়, পরে তা ১৯৯১ সালে পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারকে সমর্থন করে আসছে ইরান। ওই লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের হয়ে মাঠে রয়েছে সৌদি আরব। এদিকে দরিদ্র দেশ ইয়েমেনে বসবাসরত শিয়াপন্থি হুতিদের উত্থানে সমর্থন দিচ্ছে ইরান অন্যদিকে হুতি বিদ্রোহীদের দমনে যুদ্ধ করছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বাহিনী। এদিকে ২০১৪ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি হয়- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ মোট ছয় জাতির। কিন্তু ওই চুক্তির ঘোর বিরোধীতা করে সৌদি প্রশাসন। পশ্চিমা গতিতে আধুনিক ইরানের লোকেদের এগিয়ে চলা সৌদি রাজপরিবার যেমন পছন্দ করে না। তেমনি সৌদি জনগণের আরববিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নে- ইরান সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আসছে। আর দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে এমন দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে পতনের খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন উভয় দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে একে অপরের প্রতিপক্ষ রুপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দুই দেশের সরকার সেসব দেশের সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। এদিকে আবার অনেক দরিদ্র দেশ অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে কিংবা অনেকটা বাধ্য হয়েই শিয়া-সুন্নি বলয়ের দেশগুলোর কথিত জোটে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার দেশ সুদানের কথা। তেল সম্মৃদ্ধ অথচ দরিদ্রপীড়িত এ দেশটি অনেকটা অবিবেচনা প্রসূত হয়েই সৌদি আরবের সুরে সুরে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা করেছে। একই পথে হেঁটেছে আরব আমিরাত ও বাহরাইনও। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিকট অতীতে আইএস দমনে সৌদি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে আইএস সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠনেও দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে, ইরানপন্থি কোনো দেশ ওই জোটে নাম লিখায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ আগেও ওই জোটের ব্যাপারে সৌদি আরবকে অণুসরন করে তাদের অণু সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এবারও ইরান নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি বলয়ের সঙ্গে রয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে।
সৌদি রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে প্রভাবশালী শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ইরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের সঙ্গে সবধরনের কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্কে ইতি টানার অফিসিয়াল ঘোষণা আসে সৌদির পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। আর এ দুটি ঘটনা গোটা অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি বৈরিতাকেও উসকে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সৌদি আরব ও ইরানকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন যেন আরো ঘোলাটে হয়ে উঠছে। নিমরের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে তেহরানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে রিয়াদ। এখন ইরানি নেতৃত্ব হাতে তলোয়ার তুলে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করতেও বাধ্য। সৌদি, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শিয়ারা এখন ইরানের সামরিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তাই তেহরান এ ঘটনাকে পুঁজি করে সৌদি আরবকে কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলার পাশাপাশি শিয়াদের উসকে দিয়ে এসব দেশে অস্থিতিশীলতাও ও পুন:কর্তৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে ইসলামের শুরু থেকেই শিয়া-সুন্নির সম্প্রদায়ের ভেতর জটিল কিছু মতভেদ থাকায় এ দুটি দল কালক্রমে কাউকে শত্রুতে পরিণত করেছে কিংবা আবার কারো বন্ধু হয়েছে। কখনো কখনো এদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এদের ভেতরই (মুসলমান-মুসলমান) যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফায়দা লুটেছে পশ্চিমের সাম্রজ্যবাদিরা। তবে মনে রাখা জরুরি যদিও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু আকিদাগত ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শিয়া-সুন্নি উভয়ই একই বিধাতা, কোরআন আর হাদিসের অনুসারী।
আঞ্চলিক দুই শক্তি সুন্নিপন্থি সৌদি আরব এবং শিয়াপন্থি ইরানের মধ্যকার বিরোধ যখন চরমে তখন সারা পৃথিবীর বাদবাকি দেশের মুসলমানরা শঙ্কিত। এই দুই দেশের দুইটি ভিন্ন কিন্তু আকিদাগতভাবে সমগোত্রীয়দের পারস্পরিক যুদ্ধ প্রকারান্তে পুরো ইসলাম ও এর সামগ্রিকতাকে প্রশ্নবিদ্দ করছে। এ ঘটনার পরম্পরায় সারা বিশ্বের মুসলমানরা মূলত দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। যার একদিকে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হজব্যবসায়ী, তেলবণিক সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতারসহ আফ্রিকার কিছু দেশ। যারা আবার ইসরাইল ও পশ্চিমাগোষ্ঠীর যোগ্যসহচর, পরমবন্ধু। আর অন্যদিকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ শিয়া অধ্যূষিত ইরান, সিরিয়াসহ অন্য কিছু আরব দেশ। এরা আবার আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের চক্ষুশূল, চিরশত্রু। তবে ইরানপন্থি জোটের সামরিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে বুঝা যায়, এরা ঠিকই তাদের আদিম শত্রু পশ্চিমা চক্রটিকে চিনতে পেরেছে। আর সেটা মোকাবেলায় নিজেদেরকে পশ্চিমা আদলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান-চিকিৎসা আর পরমাণুতে সম্মৃদ্ধও করেছে। কিন্তু সৌদি জোট সে তুলনায় থেকে গেছে অনেক পশ্চাতে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাদের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত নেই একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী, কিংবা চিকিৎসায় নেই একজন ভালো গাইনি বিশেষজ্ঞ। পাশ্চাত্যের সব ধার করা সাময়িক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক জ্ঞান নিয়ে খনি থেকে তেল আর সোনা তুলে বিকিকিনি করে এ দেশটি নিজেদের রিজার্ভ বাড়িয়েছে কেবল। আর ওই টাকায় দেশটির শাসকশ্রেণি সমুদ্র ও লেকের ধারে বিলাসবহুল বাড়ি করে দিনে দিনে পত্নী-উপপত্নীর সংখ্যা বাড়িয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেসব তেলকুবের ধনাঢ্যরা আরবের নীল জলে পানীয়বোঝাই প্রমোদ তরীতে উৎসবে মজেছে পশ্চিমের কুশীলবদের সঙ্গে।
বিপরীতে তেল সম্মৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতিতে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর সেখানে সুন্নিদের তুলনায় সংখ্যালুঘু শিয়ারা হয়েছে পদে পদে নিগৃহীত ও অবহেলিত। সৌদি পরিবার ও দেশটির শেখদের বিরুদ্ধে যেমন এইরুপ অপচয়, ভাগাড়ম্ভরতা আর রাজতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ পাওয়া যায়, তেমনি ভাবে বিভিন্ন সময় ইরানের দেশকর্তাদের বিরুদ্ধেও অনেক উচ্চাভিলাষ, নিপীড়ন, স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। সেখানে আবার শিয়াদের হস্তক্ষেপে সুন্নি সহ বাকি মুসলিমগোষ্ঠীগুলো সামাজিক ও নাগরিক বিভিন্ন সুবিধা থেকে সবসময়েই বঞ্চিত হয়ে আসছে। তবে এতকিছুর পরও সুন্নি অধ্যূষিত সৌদিয়ানদের চেয়ে শিয়াপন্থি ইরানি জনগণের দেশপ্রেম ও বিশ্বায়নের প্রশংসা করতে হয়। রাজা-খলিফা শাসিত মরু অঞ্চলের দেশ সৌদি আরবের মাটির তলায় যদি এত অঢেল সম্পত্তি না থাকতো এ জাতিটিকে এখন নিশ্চয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হতে হতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইরানীরা নিজেদের একক চেষ্টা ও ক্ষমতায়- প্রযুক্তি, প্রাত্যহিক জীবনমান, পরমাণু বিজ্ঞান আর চিকিৎসায় ব্যাপক উন্নয়ন আনতে সক্ষম হয়েছে।
তবে মূলত এ দুটি দেশ নিজ দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যসব দেশ ও মুসলমানদের ধর্মীয় রাজনীতির খোলসে বিবেচনা করে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি সংকটের শিকড় আজ এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশ পর্যন্ত এতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাই দেখা যায়, যুদ্ধের ময়দানেও জাতভাই শিয়া মুসলমান নিধনে ন্যাটো জোটের পক্ষ নিয়ে সিরিয়া ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আজ অবধি স্থল ও আকাশ পথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সুন্নি মতালম্বি সৌদি আরব। যেখানে ঐতিহাসিক শত্রু ইরানকে পেয়েছে জাদরেল প্রতিপক্ষ হিসেবে। সৌদি-ইরান পরিস্থিতি এমন যে- আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরানের চোখে যেসমস্ত দেশ ও বিশ্বনেতারা শত্রু বলে বিবেচিত হবে। সেই ইঙ্গো-মার্কিন জোটকে যেকরেই হোক বন্ধু বানাবে প্রিন্স-বাদশা শাসিত সৌদি সরকার। এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ইরানের আকাশে যদি কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেখানে বিষাদের কালো মেঘ ছড়িয়ে দিবে সৌদি আরব। আরব বলয়কেন্দ্রিক মুসলিম বিশ্বে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পাকাপোক্ত করতে অনেক সময় এ দুই পক্ষ আবার কোনো না কোনো ভাবে সাম্রাজ্যবাদি ইইউ-মার্কিন শক্তি ও সমাজতান্ত্রিক রাশান বলয়ের লেজেও ভর করে। হিসেবটা এমন যে, বর্তমানে মুসলিম দেশ সিরিয়ায় আইএস দমনে আমেরিকার হয়ে সৌদি আরব বিমান হামলা করছে, আর রাশিয়ার হয়ে তা প্রতিরোধ করছে ইরান। অনেক সময় এ দুটি শ্রেণির ভেতর উগ্রবাদি মহলগুলো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে প্রায়ই নিজেরাও রক্তাক্ত হয়। আর সে সুযোগটাই নিয়ে থাকে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুরা। ইসলামের বিরোধীতাকারি চক্রগুলো মুসলমানদের শিয়া-সুন্নি টাইটেলের জাত্যভিমান ও ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে সমস্যা জিইয়ে রাখে। পরে সেসব দেশে অত্যন্ত সুকৌশলে বসিয়ে দেয় তাদের আজ্ঞাবহ কূটব্যবসাবান্ধব পুতুল সরকার, যারা নাকি শুধু পাশ্চাত্য স্বার্থ দেখবে। এখনকার ইরাক, আফগানিস্তান, মিশর, তিউনেসিয়া, লিবিয়া, ও ইয়েমেনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এ আকাট্য সত্যের প্রমাণ মেলে। ইসলামের বিরোধীরা কইয়ের তেলে কই ভাজে। এরা ষড়যন্ত্র করে সুন্নি মুসলিমদের অস্ত্র তার জাতভাই শিয়ার দিকে ঠেকানোর পাঁয়তারায় লিপ্ত থাকে।
ইরান ও সৌদি সম্পর্কের এমন ঘাত-প্রতিঘাত আঞ্চলিক কারণেই কয়েক দশক ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। প্রথম বারের মতো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবে পশ্চিমা-সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি উৎখাত হওয়ার পর তেহরান-রিয়াদ সম্পর্কে বিশেষ টানাপোড়েন শুরু হয়। তবে ১৯৮৭ সালে খোমেনির একটি বিরূপ মন্তব্যের পর সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যায়, পরে তা ১৯৯১ সালে পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারকে সমর্থন করে আসছে ইরান। ওই লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের হয়ে মাঠে রয়েছে সৌদি আরব। এদিকে দরিদ্র দেশ ইয়েমেনে বসবাসরত শিয়াপন্থি হুতিদের উত্থানে সমর্থন দিচ্ছে ইরান অন্যদিকে হুতি বিদ্রোহীদের দমনে যুদ্ধ করছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বাহিনী। এদিকে ২০১৪ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি হয়- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ মোট ছয় জাতির। কিন্তু ওই চুক্তির ঘোর বিরোধীতা করে সৌদি প্রশাসন। পশ্চিমা গতিতে আধুনিক ইরানের লোকেদের এগিয়ে চলা সৌদি রাজপরিবার যেমন পছন্দ করে না। তেমনি সৌদি জনগণের আরববিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নে- ইরান সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আসছে। আর দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে এমন দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে পতনের খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন উভয় দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে একে অপরের প্রতিপক্ষ রুপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দুই দেশের সরকার সেসব দেশের সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। এদিকে আবার অনেক দরিদ্র দেশ অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে কিংবা অনেকটা বাধ্য হয়েই শিয়া-সুন্নি বলয়ের দেশগুলোর কথিত জোটে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার দেশ সুদানের কথা। তেল সম্মৃদ্ধ অথচ দরিদ্রপীড়িত এ দেশটি অনেকটা অবিবেচনা প্রসূত হয়েই সৌদি আরবের সুরে সুরে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা করেছে। একই পথে হেঁটেছে আরব আমিরাত ও বাহরাইনও। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিকট অতীতে আইএস দমনে সৌদি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে আইএস সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠনেও দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে, ইরানপন্থি কোনো দেশ ওই জোটে নাম লিখায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ আগেও ওই জোটের ব্যাপারে সৌদি আরবকে অণুসরন করে তাদের অণু সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এবারও ইরান নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি বলয়ের সঙ্গে রয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে।
সৌদি রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে প্রভাবশালী শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ইরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের সঙ্গে সবধরনের কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্কে ইতি টানার অফিসিয়াল ঘোষণা আসে সৌদির পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। আর এ দুটি ঘটনা গোটা অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি বৈরিতাকেও উসকে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সৌদি আরব ও ইরানকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন যেন আরো ঘোলাটে হয়ে উঠছে। নিমরের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে তেহরানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে রিয়াদ। এখন ইরানি নেতৃত্ব হাতে তলোয়ার তুলে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করতেও বাধ্য। সৌদি, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শিয়ারা এখন ইরানের সামরিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তাই তেহরান এ ঘটনাকে পুঁজি করে সৌদি আরবকে কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলার পাশাপাশি শিয়াদের উসকে দিয়ে এসব দেশে অস্থিতিশীলতাও ও পুন:কর্তৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে ইসলামের শুরু থেকেই শিয়া-সুন্নির সম্প্রদায়ের ভেতর জটিল কিছু মতভেদ থাকায় এ দুটি দল কালক্রমে কাউকে শত্রুতে পরিণত করেছে কিংবা আবার কারো বন্ধু হয়েছে। কখনো কখনো এদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এদের ভেতরই (মুসলমান-মুসলমান) যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফায়দা লুটেছে পশ্চিমের সাম্রজ্যবাদিরা। তবে মনে রাখা জরুরি যদিও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু আকিদাগত ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শিয়া-সুন্নি উভয়ই একই বিধাতা, কোরআন আর হাদিসের অনুসারী।
©somewhere in net ltd.