নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বো-লোগার

ইফতেখার রাজু

বো-লোগার

ইফতেখার রাজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

কওমি মাদ্রাসা, জঙ্গিপনা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:২০

( আমার লেখাটি ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে Click This Link )
আমাদের এ অঞ্চলে এক সময় মুঘল শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে আলেমরা। তাদের সে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছিল সাদা চামড়ার ইংরেজরা। তখন থেকেই ইংরেজি শিক্ষা আর আরবি শিক্ষার একটি বিরোধ চলে আসছে। বিরোধটা হলো একসঙ্গে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, সবচেয়ে কম আয়ের গ্রামের দিনমজুর বা শহরের রিকশাওয়ালার সন্তান পড়ছে কওমি মাদ্রাসায়। এর চেয়ে একটু ভালো রোজগার করেন গ্রামের প্রান্তিক কৃষক বা শহরের ছোট ব্যবসায়ী এদের সন্তান পড়ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার চেয়েও বেশি স্বাবলম্বী গ্রামের যেসব পরিবারের কর্তা ব্যক্তি বিদেশে থাকেন আর শহরের নামকরা ধনী-আমলাদের সন্তানরা পড়ছে কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে, পর্যায়ক্রমে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই যে রাষ্ট্রে চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও তার ফলশ্রুতিতে মনোজগত তৈরির শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে বিশাল ফারাক রযেছে, সেটাই আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন জীবনে একটি কঠিন সাংস্কৃতিক বিরোধ তৈরি করে দিচ্ছে।

তবে খুব বেশি সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব রয়েছে কওমি শিক্ষাব্যবস্থায়, তাই সংক্ষেপে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যায়। সম্প্রতি মিরপুরে জঙ্গি আস্তানা থেকে পাবলিক প্লেসে বোমা ছুঁড়ে মারা, এর আগে জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ড, পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে হামলা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা, তারও আগে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জঙ্গি আক্রমণ ও একযোগে ৬৪ জেলায় বোমা হামলার প্রত্যেকটি ঘটনা একটি নির্দিষ্ট সূত্রে গাঁথা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটককৃত ওইসব হামলার মূল ক্রীড়ানকদের চরিত্র নিরীক্ষণে দেখা গেছে, সবগুলো সন্ত্রাসীযজ্ঞের পেছনে জড়িতরা একটি বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী ও একটি বিশেষ বিদ্যায়তন থেকে বিদ্যাপ্রাপ্ত। আর বিশেষ ওই শিক্ষায়তনগুলো হচ্ছে আমাদের দেশে প্রত্যন্ত গ্রাম ও নগওে ছড়িয়ে থাকা কওমি মাদ্রাসা। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, হামলাকারিদের অধিকাংশই কওমি ব্যবস্থার মাদ্রাসা থেকে আগত। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো কৃতকর্মের জন্য ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে হামলায় অংশ নেয়া ব্যক্তিরা যতোটা না দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী এ দেশের সরকার ও তার শিক্ষাপদ্ধতির অমনোযোগীতা-এমনটিই মনে করছেন শিক্ষা গবেষকরা।

দেশে বর্তমানে ৯ হাজার কওমি মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী সাড়ে ৩ লাখের মতো। বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ পড়াশোনার যাবতীয় খরচ লাগে না বলে সমাজের নিম্নবিত্ত, এতিম, আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা এখানে ভর্তি হয়। মূলত ইসলাম হিতৈষী দেশিয় দানবীর এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অনুদানের টাকায় চলে এসব প্রতিষ্ঠান। আর প্রায় ২শ বছরের পুরনো সিলেবাসে সেখানে চলে পাঠদান। দারুল উলুম দেওবন্দের (ভারত) শিক্ষা পদ্ধতি ও মদীনা (সৌদি আরব) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ক্যারিকুলাম নামে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা এখানকার মাদ্রাসাগুলোতে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু ওই দুই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার মাদ্রাসাগুলোতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি মৌলিক বিষয় পড়ানো হয় না। তাই দেশের মূল শিক্ষা কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হিতাহিত কোনো জ্ঞান ছাড়াই মাদ্রাসা পড়ুয়াদের ১৬ বছরের দীর্ঘ শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরপর এরা করছেটা কী? প্রচলিত শিক্ষাবোর্ড় কর্তৃক স্বীকৃত কোনো সনদ নেই সুতরাং সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেই চাকরির সুযোগ। এদিকে বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো যথেষ্ট পুঁজিও থাকে না তাদের। তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন-মসজিদ, মক্তব ও মাদ্রাসাই এদের একমাত্র কর্মক্ষেত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়। যদিও কেউ কেউ মোবাইল সার্ভিসিং, কম্পিউটার মেরামত, অনুবাদ ও কম্পোজের কাজ করেন, কিন্তু তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেহেতু এ সম্প্রদায়ভুক্তদের কর্মজীবন সুখকর নয় এবং অর্থনৈতিকভাবে এরা স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাই এ জনগোষ্ঠীকে সহজেই সাংস্কৃতিকভাবে কনভার্ট করে ফেলা যায়। অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে এদেরকে সমাজ-রাষ্ট্র ও বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি স্বরুপ যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সহজেই জড়িয়ে ফেলা যায়। তাই দেখা যায়, একসময় এরা জামায়াত, হেফাজত, আইএস, ওলামা লীগ আর আনসারউল্লাহর পাঁতানো জালে আটকা পড়ে। আর দেশে বর্তমানে জঙ্গী উত্থানের পেছনে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থলগ্নি করার কথা সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে জঙ্গিরা ধর্মের মর্মবাণী ও সহিষ্ণুতার কথা ভুলে গিয়ে সম্প্রদায়গত জাত্যভিমান আর অন্ধকারের বিষবাণী প্রতিষ্ঠিত করতে নিদারুণ হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। অনেক সময় এরা নিজেকে হত্যা করে, অন্যের চাপিয়ে দেয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে যায়। সম্প্রতি রাজশাহীর বাঘমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে জঙ্গিপনার ঘটনায় এমন প্রমাণ মিলেছে। সেখানে হামলাকারি বোমা নিজের শরীরে বেঁধে রেখেছিলো। পরে সেই বোমার বিস্ফোরণে তিনি নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান। গাজীপুরের জঙ্গি আস্তানায় একই রকম ঘটনায় জঙ্গিদের আত্মঘাতী স্কোয়াড়ের আরো দুইজন নিহত হন । কিন্তু পরিস্থিতি যখন এমন উদ্বেগজনক তখন সময় হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষাপদ্ধতি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবার। মনে রাখা জরুরি, কওমির ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রান্তিক ঘরের। আর শুরু থেকেই খেটে খাওয়া, দিনমুজুরদের সেসব সন্তানরা প্রবঞ্চনার শিকার হয়। এ বলয় থেকে এদেরকে বের করতে হলে অবশ্যই তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত করতে হবে। আর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সেখানে আরবীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি প্রদানে সরকার ও মাদ্রসা পরিচালনায় জড়িত আলেম ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তবে স্বীকৃতিদানের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষা সিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই সরকারে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছে।

এ বিষয়ে সরকার যতোটা আন্তরিক ও উদারতার পরিচয় দিয়েছে, ঠিক ততোটাই পশ্চাতে চলেছে আমাদের আলেম সমাজ। বেশির ভাগ মাদ্রাসা প্রধানরা দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এদের রাজনৈতিক দল ভিন্ন হওয়ার দরুণ মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে ওই সমস্ত আলেমরাই একমত ও এক পথে দাঁড়াতে পারেননি। বিশেষ করে ২০১৩ সালে কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পর মাদ্রসা ইস্যুটি পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই সংগঠনটি মূলত সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিচালিত হয়েছিল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সে সুযোগও নিয়েছিল। ওই সংগঠনে অনেক ধর্মভিত্তিক দলের প্রধানরা যোগও দিয়েছিলেন। তাই স্বীকৃতি দেয়া না দেয়ার বিষয়টি একদিকে যেমন রাজনৈতিক বিষয়। অন্যদিকে, কওমি কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামীও এজন্য দায়ী। কিন্তু এর ফলে যে দিকটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ তা হলো বাংলাদেশ তার উদার অসাম্প্রদায়িক দেশের চেতনার তকমাটা হারাতে বসেছে। পরম্পরায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার ফলে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে সব সম্প্রদায়ের মাঝে যে সুন্দর সহাবস্থান স্বাধীনতার পর থেকে বিরাজমান ছিলো, তাতে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কখেনো ভাবেনি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে জঙ্গিপনার শিকার হয়ে তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে, কিন্তু এখন পরিস্থিতি সেই দিকেই গড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গোটা সমাজ ও তার অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মেরুদন্ডের। তাই আমাদের মনে রাখা দরকার, সমাজের বৃহত্তর একটা অংশকে আলোতো না এনে অনুৎপাদনশীল রেখে রাষ্ট্রযন্ত্র এগুতে পারে না।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.