![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
“হাঁচির গতি বেশি? না মাছির গতি বেশি?”
প্রশ্নটা যে করেছে তার নাম রাহাতকে বলা হয়নি। টাক মাথার এক ছোটখাটো ভদ্রলোক। টাকের দিকে একবার তাকিয়ে যে কেউ বলে দেবে এই ভদ্রলোক নিয়মিত টাক পালিশ করেন। টাকের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে নিজেও, কপাল থেকে সাবধানে চুল সরাল রাহাত।
“মাছিদের প্রকারভেদ আছে। একবাক্যের প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু এই প্রশ্নের এক বাক্যের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।”
কৌতুক নেচে উঠল ভদ্রলোকের চোখে, “তাই? মাছিদের প্রকারভেদের পর কি কিছু মাছি হাঁচির চেয়ে জোরে ছুটতে পারে?”
“ন-না।” নিজেকে গালি দিল রাহাত। ইন্টারভিউয়ের প্রথম প্রশ্নেই বেশি কথা বলতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে।
“তাহলে তোমার ফাইনাল অ্যানসার কি?”
“হাঁচির গতি বেশি।”
“কত সেটা?” ভ্রু নাচালেন টেকো ভদ্রলোক।
“তিনশ' ষাট কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। অ্যাপ্রক্সিমেটলি।” চটপট উত্তর দিল রাহাত।
“মাছির ক্ষেত্রে-”
“মাছিদের মা-বাপ নেই স্যার। একেক মাছির গতি একেকরকম। হর্সফ্লাইদের পুরুষজাতিটা বেশি খাচ্চর। মেয়ে পেলেই একশ' পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টাতে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
“ভালই পড়াশোনা করেছ দেখছি।”
এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বোলাল রাহাত। চমৎকার একটি ডেস্ক আর তারচেয়ে কিছুটা কম চমৎকার একটি মোড়া। অদ্ভুত সংমিশ্রণ। দুর্দান্ত একটি ডেস্কের ওপর সাজানো আছে ছোট কিন্তু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। যে কোন অফিস ওয়ার্কারের স্বপ্নের একটা ডেস্ক হতে পারে এটা!
তার সামনে মোড়া নিয়ে বসে আছেন টেকো।
পুরো ঘরটায় আর কিছুই নেই। এমনকী রাহাতের বসে থাকার মতও কোন মোড়া নেই। চেয়ার দূরে থাকুক!
“বসবে নাকি?” মিচমিচে হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন টেকো ভদ্রলোক।
“না না! ঠিক আছে।” এছাড়া আর কি-ই বা বলার আছে? এসেছে চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার জন্য। খুঁতখুঁতে স্বভাব দেখানোর মত ডিপার্টমেন্ট তাদের না।
চুপচাপ হয়ে গেছে ঘরটা। মনে হচ্ছে কোন তাড়াহুড়োই নেই ভদ্রলোকের। ইন্টারভিউ দিতে না, নাক চুলকাতে এসেছেন এ ঘরে। এই মুহূর্তে শক্ত হাতে নাসিকা-বিদ্রোহ দমন করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নাক না কুঁচকে পারল না রাহাত।
“ইমরানের রেফারেন্সেই এখানে এসেছ তাহলে?” অবশেষে জানতে চাইলেন তিনি। এখন পর্যন্ত লোকটার নাম জানা হল না।
“বলা যায়।” অস্বস্তির সাথে বলল রাহাত। ইমরান তার জন্য প্রিয় কোন বিষয় না।
বায়োডাটাতে একবার চোখ বোলালেন টেকো, “ইম্প্রেসিভ। এখানে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল লক খুলতেও তুমি বিশেষ পারদর্শী। কার্নিশওয়ারের ওপর বার্গলারি ডিগ্রী আছে। ফ্রড অ্যান্ড ইমপিউডেন্সের গ্রেড খারাপ এল কেন?”
একটু মাথা চুলকাল রাহাত, “আসলে, একবার ফ্রড কেস খেয়ে গেছিলাম।”
আছড়ে ডেস্কের ওপর ফাইলটা ফেলে দিলেন টেকো, “যথেষ্ট যোগ্যতা নাই মনে হচ্ছে তোমার।”
কাঁচুমাচু হয়ে গেছে এখন রাহাত, “স্যার, এক্সট্রা কারিকুলামে আমার অ্যাকটিভিটি কিন্তু ভাল ছিল।”
“পড়েছি। 'ইলিউশন এক্সপার্ট' লেখা ছিল ওখানে। ঠিক কি মীন করা হয়েছে বুঝিনি।”
সামান্য হাসল রাহাত। প্রথমবারের মত প্রশ্ন করল, “এই পৃথিবীটা কিসের ওপর ভিত্তি করে চলে, স্যার?”
কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি, “টাকা। টাকা আনার জন্য অনেক পদ্ধতি আছে। তবে সেসবের ওপর ভিত্তি করে তো আর দুনিয়া চলে না।”
মুচকি হাসিটা বর্ধিত হয়ে ঝলমলে হয়ে উঠেছে, “ভুল বললেন স্যার। পৃথিবীটা চলে ইলিউশনের ওপর ভিত্তি করে। টাকার কথা বলছেন তো? ওটা তো সবচেয়ে বড় ইলিউশন। মানুষ কাগজের টুকরোগুলোকে যে হারে দাম দেয়! টাকার মত দেখতে কাগজ পেলেই তারা খুশিমনে ওটা গ্রহণ করে।”
“হুঁ। জালনোটও। টাকা অবশ্যই ইলিউশন।” কিছুটা বুঝতে পারলেন টেকো, “তবে পুরো পৃথিবী কি শুধু ইলিউশনের ওপর বেজ করেই চলে?”
ঘাড় বাঁকাল রাহাত, “অবশ্যই। ফ্রড কেস খেয়ে যাওয়ার পর সেটা আবার তুলে দিয়েছিলাম আমি। ইলিউশন স্যার। ইলিউশন এক্সপার্ট হলে আপনার জন্য আর কিছু দরকার নেই। দরকার নেই টাকারও। পৃথিবীর যে কোন ক্রাইম আপনি করতে পারবেন আনটাচেবল থেকে।”
এবার আক্ষরিক অর্থেই জিভ বের করে তাকে ভেঙচে দিলেন টেকো মানুষটা, “এতই ওভার কোয়ালিফাইড মনে করছ নিজেকে? তাহলে তোমাকে একটা কাজ দিতে পারি।”
স্থির থেকেই একরকম নেচে উঠল রাহাত। চাকরিটা তাহলে হয়েই যাচ্ছে এবার!
“থ্যাংকিউ স্যার!” দ্রুত বলল সে।
এক হাত তুলে তার উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিলেন টেকো, “আরে আগে এক পিস হয়ে ফিরে এসো তো! তারপর দেখা যাচ্ছে কত ধন্যবাদ দেওয়ার মত অবস্থান থাকে তোমার।”
ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি এখনও ঝুলছে রাহাতের, “কাজটা কি বলুন শুধু, স্যার।”
“ইজি। কিডন্যাপ করতে হবে তোমাকে।”
ধীরে ধীরে হাসিটুকু মুছে গেল রাহাতের মুখ থেকে।
“মুরগির পাছার মত মুখ করে ফেললে কেন? কিডন্যাপের চেয়ে ভাল কোন কাজ হবে না তোমাকে টেস্ট করার জন্য। বার্গলারী, স্টেলথ, উইপন কন্ট্রোল, হোস্টেজ কন্ট্রোল – চাইকি তোমার ইলিউশন এক্সপার্টাইজমও দেখাতে পারবে। আগে কিডন্যাপিংয়ের অভিজ্ঞতা নেই তোমার?”
দুই হাত নাড়াল রাহাত, যেন এতে করেই বছরের পর বছর কিডন্যাপ করার অভিজ্ঞতা এসে জমা হয়ে যাবে, “তা নেই। কিন্তু ম্যানেজ করে ফেলব।”
“গ্রেট! তাহলে বের হয়ে আমার পিএর কাছ থেকে মিশন ডিটেইলস নিয়ে নাও। তারপর আমার সামনে থেকে দূর কর তোমার মুরগির পা-”
“জ্বি জ্বি, শিওর।” তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দ্রুত বলল রাহাত। চেহারার এমন কাব্যিক বর্ণনা একবারের জন্যই যথেষ্ট। বার বার শুনতে ভাল লাগার কথা না কারও।
দরজার কাছে গিয়ে একবার ঘুরে তাকাল অবশ্য, “একটা প্রশ্ন ছিল, স্যার।”
“ইয়েস?”
“আপনিই কি এজেন্ট ফোর্টিসেভেন?”
“হোয়াট দ্য হেল ইজ দ্যাট?”
হাসি চেপে একবার মাথা নাড়ল রাহাত, “কিছু না, স্যার। কাজ শেষ করে খবর দেব আপনাকে।”
২.
“উইটনেস প্রটেকশনের ভেতর থেকে একজন উইটনেসকে কিডন্যাপ করতে হবে আমাকে।”
ইমরানের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। রাহাতের অবস্থা অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কথাটা এমনভাবে বলল যেন তার সাথে উইটনেসের গলফ খেলার কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেছে। মুখে হাসিও ঝুলে আছে, বোঝাই যাচ্ছে খুব পছন্দ হয়েছে কাজটা।
“মাফিয়াদের গডফাদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছে এক মেয়ে। মার্ডারের উইটনেস। মেয়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে উইটনেস প্রটেকশনে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার কাজ-”
“মেয়েকে গায়েবই করে দেওয়া।” এটুকু বুঝতে ইমরানের কষ্ট হল না মোটেও, “কাম অন। উইটনেস প্রটেকশনের ভেতর থেকে কাওকে কিডন্যাপ করা একরকম অসম্ভব একটা কাজ। খুন? তা করা যেতে পারে। লোকেশন জানার পর এটা খুব একটা কঠিন কাজ না। কিন্তু কিডন্যাপ? আমি বলব তোর উচিত এখানে না ঢোকা।”
পাত্তাই দিল না রাহাত, “আমার কয়েকটা জিনিস দরকার। অথেনটিক হতে হবে, মানে দুই-তিন ঘণ্টার জন্য হলেও যেন তাদের অমনই মনে হয়।”
“তারমানে ঢুকবিই, তাই তো?”
এক মুহূর্তও দেরী না করে উত্তর দিল রাহাত, “সবার তো আর আপনার মত মুরগির কলিজা না।”
ইমরানের মুখ কালো হয়ে গেছে। ইমরানের কলিজা যে মুরগির কলিজার থেকে মোটেও বড় নয়, সেটা দেশের প্রায় সবারই জানা আছে। নতুন করে এটা রাহাতের মুখ থেকে শুনে মুখ উজ্জ্বল করার মত কিছু নেই।
“কি কি লাগবে তোর?” আমশি মুখে জানতে চাইল ইমরান।
“কয়েকধরণের কাগজপত্র। দুটো আইডি কার্ড। একটা বিজনেস, আরেকটা -” ইতস্তত করল রাহাত এবার।
“আরে, অর্ধেক কথা মুখের ভেতর চিবিয়ে রাখার কোন দরকার নাই। কলিজা আমার যতটুকুই হোক, যে কোন ধরণের ফরজারি আমি অনায়াসে করতে পারি এটা তো জানিস? আরেকটা কার্ড কিসের লাগবে?”
মিষ্টি করে হাসল রাহাত এবার, “অফিসারস কার্ড। মিনিস্ট্রি অফ হোম অ্যাফেয়ারস।”
ইমরানের চেহারা আরেকবারের মত দেখার মত হয়ে গেছে। দুই চোখ আগের চেয়েও বড় বড় হয়ে গেছে তার। ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেছে। চোয়াল ঝুলে পড়বে যে কোন সময়।
“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের ক্রেডেনশিয়াল-”
“ঠিক ওই জিনিসই দরকার আমার।” নাক সিঁটকে নিশ্চিত করল রাহাত।
৩.
ঢাকা শহরে ছিমছাম দেখতে বাড়ির অভাব নেই কোন। তেমন একটা বাড়ির সামনে দিয়েই একটু আগে ড্রাইভ করে গেছে রাহাত। একই এলাকার একটা চায়ের দোকানের সামনে এনে থামিয়েছে গাড়ি।
যে পাঁচ সেকেন্ড দেখতে পেয়েছে, তাতেই বাড়িটি সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেছে তার। তিনতলা, আগের ডিজাইন। চেহারা দেখে মনে হয়েছে দুইহাজার পাঁচ সালের এদিক ওদিক নির্মিত হয়েছে ওটা। ভাল একটা খবর, জানালাগুলোর কার্নিশ আছে। ইদানিং যে বাড়িগুলো বানানো হচ্ছে তাদের জানালার ওপর সানশেড রাখা হয় না। নাগরিক জীবনে দুটো বিল্ডিং খুব কাছাকাছি বানানো যাচ্ছে এখন। আলাদা ক্লিয়ারেন্স রাখতে হচ্ছে না। সব দিক থেকেই ভাল। রাহাতের মত ইনফিল্ট্রেটরদের জন্য খারাপ।
বাড়িটি নয় ফিট উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। তবে ওটা সমস্যার কিছু নয়। আজকে রাহাত পাচিল ডিঙাবে না। প্রধান ফটক সাদামাটা, তবে স্টিলের। তারপর ছোট্ট একটি পোর্চের পর শুরু হয়েছে বাড়ির বেলকনি। একটা মাত্র প্রবেশ পথ। ওয়ান ওয়ে ইন, ওয়ান ওয়ে আউট।
চায়ের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনল রাহাত। একমনে ধোঁয়া ছাড়ছে। ইমরানের জন্য অপেক্ষা। আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসবে সে। তারপর রাহাতের গাড়িটি নিয়ে কেটে পড়বে। ইমরানের গাড়ি নিয়ে আবারও সে বাড়ির দিকে যাবে রাহাত। তবে এবার গাড়ির সামনে চমৎকারভাবে “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়” লিখা থাকবে।
এই কাজটা একটু আগে ফার্স্ট রেকি করার সময় করতে পারত না রাহাত। উইটনেস প্রটেকশনের জন্য যদি একদল মাথামোটাকে দায়িত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া প্রতিটা গাড়িকে নজরে রাখে তারা। একই গাড়ি নিয়ে দুইবার ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার অর্থ কাভার উড়িয়ে দেওয়া।
আর একই গাড়ি দ্বিতীয়বার এনে নেমে নিজেকে মিনিস্ট্রি অফ হোম অ্যাফেয়ার্সের ডব্লিউপি অফিসার হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অর্থ সমকামীর সামনে দাঁড়িয়ে পেছন দিকটা পেতে দেওয়া। রাহাত নিজের পেছন দিকটা পেতে দিতে রাজ্যের অনীহা পোষণ করে।
কাঁধের কাছে হাল্কা টোকা পড়তে ঘুরে তাকাল ও। ইমরান চলে এসেছে।
“চকচকে স্যুটে তোকে একদম কাকতাড়ুয়ার মত লাগছে।”
সাদা শার্ট, লাল টাই আর কালো স্যুট পরে থাকা রাহাত ইমরানের কথাটা গায়েই মাখল না। শুধু বলল, “চাবিটা?”
চাবি হস্তগত করে সিগারেটের বাকি অংশ ইমরানের হাতে ধরিয়ে দিল ও।
উজ্জ্বল কালো রঙের গাড়িটাতে উঠে বসতেই নিজেকে হোমড়া চোমড়া কেউ বলে মনে হতে শুরু করল রাহাতের। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ছুটে চলল রাস্তা ধরে।
উইটনেস প্রটেকশন ইউনিটকে ইলিউশন দেওয়ার সময় হয়েছে!
৪.
স্টিলের ভারী দরজার সামনে এনে গাড়ি থামাল রাহাত। ড্রাইভারের পাশের গ্লাস নামিয়ে দিয়েছে। একবার আলতো করে হর্ন বাজাল এবার।
দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেল না। পকেট গেট খুলে বের হয়ে এল একজন মানুষ। স্যুট পরে আছে এই লোকটাও। পিস্তলের অবস্থান পরিষ্কার বুঝতে পারল রাহাতের অভিজ্ঞ চোখ। নার্ভাস ভঙ্গিতে একবার নিজের হোলস্টারটি স্পর্শ করল ও।
“স্যার?” আমন্ত্রণ দূরে থাকুক। কার্ড পর্যন্ত দেখতে চাইল না উইটনেস প্রটেকশন ইউনিটের সদস্য। প্রশ্নটা অতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে বাতাসে ঝুলিয়ে দিল।
“মেজর ইকবাল। সিক্সথ ড্রাগনফ্লাই। উইটনেসের একটা ইন্টারভিউ নিতে আমাকে পাঠানো হয়েছে।”
প্রভাবিত মনে হল না একে। কোন রকম বাড়তি আগ্রহ না দেখিয়েই বলল, “আইডি, প্লিজ।”
বিরক্ত মুখে আইডি কার্ড বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিল রাহাত। চমৎকার অভিনয় করছে। কড়া চোখে একবার তাকালও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। যেন অধস্থন ব্যক্তিত্বের কাছে চ্যালেঞ্জড হয়ে যারপরনাই ক্ষেপে গেছে সে।
বিভ্রান্ত দেখাল মানুষটাকে, “কিন্তু স্যার, ট্রায়ালের আগে তাঁর সাথে আলাদা করে আর কোন কথা বলার তো কথা নয়।”
“এসব নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।” কড়া কণ্ঠে বলল রাহাত, “স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয় পাঠিয়েছেন আমাকে।”
কথাটা বলেই থেমে গেল না সে। কিছু কাগজপত্র বের করে ধরিয়ে দিয়েছে লোকটার হাতে।
স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়ের সাক্ষর আছে ওখানে। যুক্তিতে যতই খটকা থাকুক, খটাস করে স্যালুট না করে পারল না লোকটা। দরজা খুলে দেওয়ার আদেশ দিল ভেতরের কাওকে।
এতেই ওরা সন্তুষ্ট থাকবে না, জানা আছে রাহাতের। ফোন করে হাঁড়ির খবর জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে এসব কিছুর মাঝে পাঁচ মিনিট মত সময় পাবে ও। এর মধ্যেই কাজ সেরে দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ে ফোন না দিলেও মাউথপীসে বিড়বিড় করে উইটনেসকে রাহাতের আগমনী সংবাদ পৌঁছে দিল এদের একজন।
দোতলায় রাহাতকে এসকর্ট করে নিয়ে এল দ্বিতীয় আরেকজন স্যুটধারী। ঝকঝকে চকচকে একেকটা ঘর। দেখে মনে হয় বুয়া এসে রোজ দুইবেলা ঝাড়ু দিয়ে যায়। বড় বড় জানালাগুলো সবই লাগিয়ে রাখা। পর্দাও সরানো হয়নি কোনটার। স্নাইপারকে সুযোগ দিতে নারাজ এরা। সোফাগুলো দেখে একটার ওপর শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে রাহাতের। খাসা জিনিস।
“এদিকে আসুন।” ডানদিকের একটি করিডোর ধরে বলল উইটনেস গার্ড।
পাথরের মত মুখ করে রেখেছে রাহাত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করা একজন মেজরের যেমনটা হওয়া উচিত।
শেষ প্রান্তের দরজাটা খুলে দিল গার্ড। শান্ত পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল রাহাত।
উইটনেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই ঘরের ভেতরেও আছে একজন গার্ড। থমকে দাঁড়িয়েছে রাহাত।
ঘরের মাঝখানে বসে আছে একটি মেয়ে। কালো চুলগুলো অবসন্নের মত পড়ে আছে তার কপালে। তবে চোখের তারা দুটো অসম্ভব প্রাণবন্ত। তামাটে গাল চকচক করছে। ঠোঁটদুটো অতিরিক্ত লাল, অথচ কোনরকম প্রসাধনী ব্যবহার করেনি সে।
রাহাতের উইটনেস ভিক্টিম অসম্ভব সুন্দরী!
তবে রাহাতের দাঁড়িয়ে পড়ার পেছনে এটা কোন কারণ নয়।
অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েটি বসে আছে হুইলচেয়ারে।
হাঁটুর নিচ থেকে দুটো পা-ই কাটা তার।
৫.
কড়া গলাতে আদেশ দেওয়ার পরও ঘরের ভেতরের গার্ডটি গড়িমসি করে বের হল। রাহাত জানে এই লোক বেশিদূর যাবে না। দরজার বাইরেই অপেক্ষা করবে। কোনরকম সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে নারাজ তারা। এদিকে রাহাতের মাথাতে ঝড়ের বেগে চিন্তা শুরু হয়েছে।
এতক্ষণ পর্যন্ত ও ভেবেছিল এটা হবে “ইজি ইন, টাফ আউট” জাতীয় গেম। ঢোকার পর যতক্ষণ পারা যায় সন্দেহ না তুলেই বাইরের দিকে উইটনেস সহ এগিয়ে যাওয়া, তারপর লড়াই করে বাকি পথটুকু করে নেওয়া। এখন দেখা যাচ্ছে তার ধারণাতে ভুল ছিল। এটা হতে যাচ্ছে “ইজি ইন, টাফেস্ট আউট” ধরণের গেম।
এই মেয়েকে নিয়ে ছোটা যাবে না। দ্রুত মুভই নেওয়া যাবে না! আর সেক্ষেত্রে কচ্ছপের সাথে পাল্লা দিয়ে রেস হতে যাচ্ছে একটা। অথচ যখন বুলেট ছোঁড়া হবে তখন কচ্ছপের গতিতে কাজ হবে না। মাছির গতিতেও না, হাঁচির গতিতে ছুটতে হবে ওদের।
“স্টেটমেন্টে কোন চেঞ্জ এসেছে?” মেয়েটিই নৈঃশব্দ ভাঙল।
কিছুটা চমকে উঠল রাহাত, “তোমার কি ধারণা?”
“আর মাত্র আট দিন পর ট্রায়াল। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসার অর্থ একটাই। স্টেটমেন্টে পরিবর্তন এসেছে।”
“ম্যান!” বিড়বিড় করে বলল রাহাত। ঘটনা বুঝতে ওর সময় লাগেনি। কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল দ্রুত, “মানে, ম্যাম! আমার এখানে আসার কারণ ভিন্ন।”
মেয়েটার চোখ থেকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি পাল্টে গিয়ে সেখানে সন্দেহের ছায়া স্থান করে নিতে শুরু করেছে। সেই ছায়া চোখদুটোকে পুরোপুরি গ্রাস করে নেওয়ার আগেই মুখ খুলল রাহাত, “আপনার সিকিউরিটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
“সেজন্যই আমি উইটনেস প্রটেকশনে আছি।” বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলল মেয়েটি। এর নামটাও জানানো হয়নি রাহাতকে। ব্ল্যাংক ইন্টেল নিয়ে মিশনে নামানো হয়েছে তাকে।
“আপনার প্রটেকশন ডিটেইলের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে আছে বলে মনে করছি আমরা।” গলা নামিয়ে বলল রাহাত।
“আমাকে খুন করতে চাইছে কেউ? কে চাইবে খুন করতে?” যথেষ্ট বিস্মিত মনে হল মেয়েটিকে।
“যাদের জন্য আপনি উইটনেস প্রটেকশনে আছেন।” গলা আরও নামিয়ে বলল রাহাত।
মেয়েটিকে এখন সত্যিই অবাক মনে হচ্ছে। বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার জীবনের ওপর কোন হুমকি নেই। উইটনেস প্রটেকশনে আমাকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। আমাকে কেউ মারতে আসবে না। ডিটেইলের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক থাকার সম্ভাবনা তো একেবারেই নেই।”
চোখ কুঁচকে ফেলল রাহাত, “আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছে ডন রাবেকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। আর আপনাকে কেউ মারতে আসবে না? আপনি সম্ভবতঃ জানেন না এই শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটির নামই ডন রাবেক?”
“বাদ দিন।” আচমকা সতর্ক হয়ে গেল মেয়েটা, “আপনি কতভাগ নিশ্চিত?”
বাইরে থেকে কড়কড় শব্দে গর্জে উঠল মেশিনগান। বেশ দূরে।
বিল্ডিংয়ের চারপাশে কাচ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা যেতে থাকে।
তারপর আচমকা বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ল এই ঘরের কাচগুলোও।
ঝড়ের বেগে উঠে দাঁড়িয়েছে রাহাত। হাতে বের হয়ে এসেছে পিস্তল।
“শতভাগ!” মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখে উত্তর দিল ও।
৬.
দমকা হাওয়ার মত ঘরে এসে ঢুকেছে একটু আগেই বের হয়ে যাওয়ার গার্ড। তার সাথে আরও দুইজন। ছুটে গেল তারা মেয়েটির দিকে।
ফলাফল হল দেখার মত। প্রথমবার গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথেই মেয়েটির চেহারা হয়ে গেছিল ফ্যাকাসে একটা কাগজের মত। এখন একসাথে তিন প্রটেকশন ডিটেইলের সদস্য এগিয়ে আসার সাথে সাথে সভয়ে পিছু হটল সে।
“ম্যা'ম? আমরা ম্যা'ম। আপনাকে নিরাপদে নামিয়ে রাখব নিচতলাতে। প্লিজ আমাদের সহযোগিতা করুন।”
“স্টে অ্যাওয়ে!” চিল চিৎকার ছাড়ল মেয়েটা, “স্টে-অ্যাওয়ে!”
“নিজেদের থেকে সাবধান, সোলজার।” চট করে বলে ফেলল রাহাত। ডিটেইল হেডের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে এক্স-আর্মি। প্রেজেন্ট আর্মিও হতে পারে। পরের বাক্যেই দুশ্চিন্তাটি ঢুকিয়ে দিল সুন্দর করে, “তোমাদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক আছে।”
এক পা সরে গেছে রাহাত। ওদের তিনজন আর মেয়েটার মাঝে চলে এসেছে। খোলা হাতে সার্ভিস পিস্তল।
ডিটেইল হেড জায়গাতেই দাঁড়িয়ে গেছে। মাথা চুলকানোর মত একটা সমস্যা দেওয়া হয়েছে তাকে। বাইরে থেকে গুলির শব্দ এখন শোনা যাচ্ছে না, তবে ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে। বাইরের গুলির প্রতিবাদে এরা ভেতর থেকে গুলি চালাচ্ছে বাইরের দিকে।
বাইরের দিকেই চালাচ্ছে না সহকর্মীর বুকে?
দোতলার এই ঘরে দাঁড়িয়ে সেটা বোঝার উপায় নেই।
ডিটেইল হেডের ঘাবড়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
“ম্যাডামকে বের করে নিয়ে যেতে হবে।” দুই সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাল সে, “সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুইজনকে নিয়ে বের হয়ে যাব আমরা। উই উইল বি অন দ্যা মুভ টিল উই ফাইন্ড অ্যানাদার সেইফ হাউজ।”
“নাইস প্ল্যান।” একমত হল রাহাত।
মেয়েটির নাম এখনও জানা হল না। হুইলচেয়ারের পেছন দিকটা ধরল ও। সামনের তিনজনকে বলল, “কাভার ফায়ার করবে তোমরা। আমি ওকে নিয়ে আসছি। দরকার হলে আমিও টুকটাক হেল্প করতে পারব।” একহাত তুলে পিস্তলটা দেখিয়ে দিল রাহাত।
সবচেয়ে ভাল সিনারিও হতে পারে এমনভাবে এগুলেই। এটা না বোঝার মত বোকা তারা নয়। আগে আগে করিডোরে বের হল তারা। পেছনে রাহাত। যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে নয়- উল্টোদিকে নিয়ে গেল ওরা। বিল্ডিংয়ের এক কোণে লিফটটা দেখা গেল। রাহাতকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এসেছে প্রটেকশন ডিটেইল। তবে উইটনেসের পায়ের অভাব পূরণ করতে কাজে আসছে এই লিফট।
সুড়সুড় করে হুইলচেয়ার সমেত লিফটে ঢুকে পড়ল ও। তারপর ঢুকল তিন গার্ড। নিচতলার দিকে নেমে যেতে শুরু করল লিফট।
ঘামে চকচক করছে ডিটেইল হেডের মুখ। টেনশনের চোটেই মুরগির পাছার মত মুখ করে ফেলেছে। টেকো ভদ্রলোককে মনে পড়তে মনে মনে একচোট হাসল ও। নচ্ছার ব্যাটা জানত লুলা উইটনেসের সামনে পড়বে সে। ইচ্ছে করেই তথ্যটা দেয়নি রাহাতকে।
লিফটের দরজা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে গ্রেনেডের পর গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। ছিটকে বের হয়ে আসল ওরা। পোর্চের দিকে ছুটছে প্রাণপনে। প্রটেকশন ডিটেইলের কাওকে কাছে আসতে দিল না ডিটেইল হেড। সোজাসুজি পোর্চে বের হয়ে এল ওরা।
এখানেও দুইজন গার্ড। ডন রাবেকের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আসা মানুষটাকে নয়জন গার্ড মিলে রক্ষা করছে? বিষয়টা খেয়াল করতে রাহাতের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হল।
পোর্চে এসেই শরীর-বর্ম গঠন করে আমাদের সামনে চলে গেছে তিন গার্ড। শত্রুপক্ষের কাওকে অবশ্য দেখা গেল না। ডিফেন্স করতে থাকা দুই গার্ড জানাল, শত্রু সংখ্যা নিশ্চিত করার উপায় নেই। তীব্রবেগে গাড়ি ছুটিয়ে আসছে তারা, গতি একটুও না কমিয়ে গুলি ছুঁড়ে চলে যাচ্ছে। একবার এভাবে গ্রেনেডও মেরেছে। সম্ভবতঃ কিছুটা ক্ষতি করার পর তারা নেমে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে।
ডিটেইল হেড এদের একজনকে সাথে নিয়ে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হুইলচেয়ার সহ ফলো করল রাহাত। একই সাথে বক বক করছে লিডারের কানের পাশে, “দ্রুত আরেকটা সেফ হাউজ ম্যানেজ করছি আমি। তোমরা ওকে নিয়ে মুভমেন্টের ওপর থাকবে প্ল্যানওয়াইজ। থামবে না কোথাও। পারলে ঢাকার বাইরে নিয়ে চলে যাও। সবচেয়ে ভাল হত -”
“ফাক!” চিৎকার করে উঠেছে লিডার গার্ড।
“কি হল?” কুঁকড়ে উঠে জানতে চাইল মেয়েটি।
“ইঞ্জিন স্টার্ট পর্যন্ত নিচ্ছে না।” ড্রাইভিং সীট থেকে বলল সে। দড়াম করে ঘুষি হাঁকড়েছে ড্যাশবোর্ডে। হতাশা।
দ্রুত অন্য দুই গাড়ির ভেতরে ঢুকে চেষ্টা করল বাকি দুই গার্ড।
মাথা নেড়ে বের হয়ে এল দুইজনই।
“গতকাল রাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে স্যাবোটাজ করে রেখেছে ওরা খুব সম্ভব!” তীব্র হতাশাতে বিড়বিড় করে বলল গার্ডদের একজন।
মনে মনে মুচকি হাসল রাহাত। বালটা করেছে 'ওরা'। অথচ তারা ভাবছে সেটাই।
নিজের গাড়িতে করে ইএমপি চার্জ করেছে রাহাত। সেটা বুঝবে কি করে অন্যরা?
ইলিউশন নাম্বার থ্রি!
৭.
“আমার গাড়িতে উঠে পড় তোমরা। মাত্রই গাড়িটা এখানে এনেছি, এর মধ্যে কারও পক্ষে স্যাবোটাজ করা সম্ভব হয়নি নিশ্চয়?”
রাহাতের তাৎক্ষণিক সমাধানে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডিটেইল হেডের চোখ। ছুটে ওদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল তারা। রিমোটে একবার চাপ দিয়ে সবগুলো দরজা খুলে দিল রাহাত। সামনের রাস্তা ধরে গাড়ির ছুটে আসার কর্কশ শব্দ শোনা গেল একই সাথে।
“মাই গড, আবার আসছে ওরা।” হাহাকার করে উঠল একজন গার্ড, “অ্যাকনলেজ! লেডি-হক ইজ ওপেন অ্যান্ড ডাইম।”
লেডি-হক অবশ্য ততক্ষণে ডিটেইল হেডের সহযোগীতায় হুইল চেয়ার থেকে গাড়িতে উঠে পড়েছে। মেয়েটির কোডনেম। মোটেও চকচকে ডাইমের মত গড়াগড়ি করছে না খোলা আকাশের নিচে। পেছনের সীটে তাকে তুলে দিয়ে নিজেও দ্বিতীয় সীটটা দখল করল ডিটেইল হেড। অন্যজন ছুটে যাচ্ছিল ড্রাইভারের পাশের প্যাসেঞ্জার সীটের দিকে। তবে সময়ে কুলালো না। ঝড়ের বেগে মেইন গেট অতিক্রম করছে আক্রমণকারীদের গাড়ি। গর্জে উঠেছে সাবমেশিনগান।
প্রথম বুলেটটা পিঠের ঠিক মাঝখান দিয়ে ঢুকেছে, দ্বিতীয় বুলেট পড়ন্ত শরীরের ডান কাঁধের নিচের অংশটা একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। দড়াম করে আছড়ে পড়ল কালো স্যুট। প্যাসেঞ্জার সীটটি সম্ভবতঃ খালিই যেতে চলেছে- চকিতে ভাবল রাহাত। ড্রাইভিং সীট থেকেই ড্রাইভ বাই করতে থাকা ইমরান তার দিকে আলতো করে চোখ টিপে দিতে ভোলেনি।
নিজের নামের পেছন থেকে মুরগির কলিজা টাইটল সরিয়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে তাকে।
“ড্যাম ইট!” কৃত্রিম হলেও আক্ষেপের সুরটা নিখুঁত ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারল রাহাত।
“গেট ইন! গেট ইন! গেট ইন!!” হুঙ্কার ছাড়ল ডিটেইল লিডার।
আর কিছুর দরকার আছে? প্রকাণ্ড এক লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সীটে পশ্চাদ্দেশ ঠেসে দিল রাহাত।
বন বন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বের হয়ে এল বাড়ির চৌহদ্দি থেকে। আশেপাশে কোথাও আক্রমণকারী গাড়ির চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। উদ্যত পিস্তল নিয়ে শত্রুর মোকাবেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে প্রটেকশন ডিটেইলের প্রধান। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা দোলাল রাহাত।
“আমাকে কারা মারতে চাইছে?” রীতিমত ককিয়ে উঠল এবার উইটনেস।
“আমার মনে হয় না আপনাকে কেউ মারতে চাইছে।” গম্ভীর গলাতে বলল রাহাত, “সেক্ষেত্রে বাইরের রাস্তাতে গাড়ি নিয়ে শো-অফ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকত না তারা। ইনফিলট্রেট করত, নতুবা চলে যেত সম্মুখ সমরে।”
“তাহলে ঘটছেটা কি এখানে?” মেঘের মত গুড়গুড় করে উঠল লিডারের গলা।
“সম্ভবতঃ এটা কারও কিডন্যাপ প্ল্যান।” চটপট তার জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করল রাহাত, “কিডন্যাপাররা চাইছে লেডি-হককে বের করে নিয়ে আসতে। এবং তারা সফলও হয়েছে এ পর্যন্ত।”
“ফাক! এই সম্ভাবনাটার কথা মাথাতেই আসেনি আমার!” আচমকা ব্যাপারটা ধরতে পারল সে।
চুপচাপ আরও দুটো মোড় নিল রাহাত। পেছনের মাথামোটাটিকে ভাবার জন্য সামান্য সময় দিচ্ছে।
“আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়া উচিতই হয়নি।” ধীরে ধীরে বলল লোকটা, “আপনি চাপ না দিলে-”
নিজের মুখ থেকে বের হয়ে আসা কথাটার মর্ম বুঝতে বুঝতে একটা দীর্ঘ সেকেন্ড লেগে গেল তার। সুযোগটা ছেড়ে দিল না রাহাত। চট করে ঘুরেই টেনে দিল ট্রিগার।
বদ্ধ গাড়ির ভেতরে বিকট শব্দ হল গুলির।
৮.
কান ফাটানো শব্দে চেঁচাচ্ছে পেছনের মেয়েটা। হিস্ট্রিয়াগ্রস্থদের মত অনেকটা। সামনের ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা রাহাতের কোন বিকার নেই। মৃদু শিস বাজাতে বাজাতে ড্রাইভ করে চলেছে সে। গতিবেগ এখনও মাত্রাতিরিক্ত বেশি। প্রটেকশন ডিটেইলের চোখের সামনে 'লিগালি' বের হয়ে এলেও এসব ব্যাপার বেশিক্ষণ চাপা থাকবে না। তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে খুব বেশি হলে পনের মিনিট লাগবে। এর মধ্যেই গাড়ি পরিবর্তন করতে হবে।
মেয়েটার চিৎকার এখনও থামছে না। রিয়ার ভিউ মিররে একনজর দেখল রাহাত। একপাশের চুল আর ঠোঁটের সামান্য অংশ জুড়ে প্রটেকশন ডিটেইলের লিডাররের রক্ত লেগে মাখামাখি হয়ে আছে। আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চটচট করছে জায়গাটা।
মিনিট পাঁচেক এভাবে চেঁচিয়ে গেল মেয়ে। রাহাত জানে, আর কেউ হলে পেছন থেকে তার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। তবে এই মেয়ের দিক থেকে ওসবের ভয় নেই। পা থাকলে একটা কথা থাকত। যতই সুন্দরী হোক, এই মেয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করার ক্ষমতা রাখে না।
“কুত্তী কোথাকার।” আচমকা গর্জে উঠল রাহাত।
ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছে এবার। আচমকা থেমে গেছে চিৎকার। যেন কেউ সুইচ অফ করে লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
একেবারে চুপ হয়ে গেছে বলাটা ঠিক হবে না। পেছন থেকে ফোঁত ফোঁত করে শব্দ হচ্ছে।
সাদা রঙের বাড়িটার গেটের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দেওয়ার সময়ও চুপ করে থাকল নতুন আপদটি। গ্যারেজের ভেতরে যত্ন করে গাড়ি পার্ক করল রাহাত। পরিষ্কার দেখিয়ে দিল পিস্তল।
দারোয়ান হারামজাদাকে ইমরান কিনে নিয়েছে। তবে বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ফ্ল্যাটেই কেউ না কেউ থাকে। তাদের রাত-দিন এক করে দেওয়ার জন্য ইসরাফিলের শিঙা তুল্য চিৎকার যথেষ্ট হবে। এই ঝুঁকি নিতে পারে না রাহাত। পিস্তল দেখাতেই হল।
মেয়েটাকে মনে হয় পিস্তল না দেখালেও চলত। মাথার অর্ধেক নাই হয়ে যাওয়া একটি লাশের পাশে বসে আছে সে। এমনিতেও বোবাতে ধরেছে। শকে চলে গেছে মানুষটা। এমনভাবে রক্ত দেখে অভ্যস্ত না সে। তার ওপর খেয়েছে গালি।
ইমরানকে গ্যারেজেই পাওয়া গেল। আরেকটা গাড়ি এখানে। কয়েক মিনিট আগে যে গাড়ি দিয়ে তাণ্ডব করা হচ্ছিল সেটাও আছে এই গ্যারেজেই। পুরো মিশনটাই ছিল তিন-গাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঠিক সেভাবেই শেষ হতে যাচ্ছে এটা। উইটনেস প্রটেকশনের মত শক্ত ধাঁচের মানুষগুলোকে ইলিউশন দিয়ে বিভ্রান্ত করার জন্য রাহাতের গাড়ির দরকার ছিল মাত্র তিনটা।
বোতল থেকে পানি এনে মেয়েটার মুখের রক্ত মুছে দিল রাহাত। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে অন্য গাড়িটিতে তুলল ও। সাদা রঙের টয়োটা অ্যালিয়ন। টাকা হলেই লোকজন কেনে এই মডেলের গাড়ি। ওদের খুঁজে বের করাটা হতে যাচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
কারণ, পরিকল্পনার শেষ অংশ হিসেবে রাহাতের দরকার খোলা রাস্তাতে আর ত্রিশ মিনিটের ড্রাইভ মাত্র।
এই সংক্ষিপ্ত ড্রাইভের মধ্যে কথা হল খুব সামান্য।
রাহাত জানতে চেয়েছিল, “তোমার নাম কি, মেয়ে?”
হোস্টেজে পরিণত হওয়া উইটনেস জবাব দিয়েছিল, “সুমি।”
৯.
নিচতলায় আগোরার শপিং মল। ওপরের চৌদ্দতলা আবাসিক। ওরা আছে বারোতলাতে।
হুইলচেয়ার ছিল না, এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতই ছিল না রাহাত। গ্যারেজ থেকে রুম পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা সুমিকে কোলে করে তুলে আনতে হয়েছে। অসময়ে এসেছে ওরা, গ্যারেজ বা লিফটে কারও সাথে দেখা হল না। ওপরে ফ্ল্যাতে এনে বন্দিনীকে তার বেডরুমে বসিয়ে দিল রাহাত।
কিছুটা বিভ্রান্ত সে। প্রথম কিডন্যাপ কেসটা চমৎকারভাবে সামলেছে ঠিক, তবে হোস্টেজের হাতে হাতকড়া লাগাবে কি না বুঝতে পারছে না। পা-কাটা মেয়ে কিডন্যাপ করতে হতে পারে - একথা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। কেমন যেন ঠেকছে বিবেকে আজ। বিবেক জিনিসটা যে আছে এখনও, এটাই ভুলতে বসেছিল রাহাত!
“একটু পানি খেতাম।” মিন মিন করে বলল সুমি।
তার দিকে এগিয়ে গেল রাহাত। সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে। আসলেই পিপাসার্ত লাগছে তরুণীকে। বয়েস বেশি হবে না মেয়ের। চব্বিশ থেকে সাতাশের মধ্যেই হওয়ার কথা।
“ক্লিক” জাতীয় শব্দের সাথে সাথে তার ডানহাতে হাতকড়া আটকে ফেলল রাহাত। অন্য মাথা লাগিয়ে দিল খাটের এক কোণে। অসহায় একটা অভিব্যক্তি ছেয়ে গেল সুমির মুখে। ভ্রুক্ষেপ না করে বের হয়ে গেল রাহাত।
পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
পঙ্গু একটি মেয়ে তার বন্দীনি বলে বাড়তি সুযোগ সুবিধে দেওয়ার ভুল করতে সে পারে না। ডন রাবেকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছিল মেয়েটা কয়েকদিন পর। অর্থাৎ গডফাদার অথবা তার সহচরদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। এরকম মেয়েদের পা থাকুক আর না থাকুক, বিপদজনক হয়ে থাকে। সাপেরও পা থাকে না। তাই বলে ঘরের মধ্যে সাপ এনে খোলা ছেড়ে রাখবে না কেউ।
পানির বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এল রাহাত। মুখ খুলে বাড়িয়ে দিল ওটা।
ঢক ঢক করে পানি খেল মেয়েটা। এত ব্যস্ত হয়ে কোনদিনও কাওকে পানি খেতে দেখেনি রাহাত … একজন বাদে।
পেটে গুলি খেয়ে পড়ে ছিল মিথিলা। এক বছর হয়ে গেল। পেটে গুলি খেলে নাকি পানির পিপাসা লাগে খুব। রাহাত সেদিনও তাকে পানি এনে দিয়েছিল। ঢক ঢক করে গিলে খাচ্ছিল মেয়েটা। এমন করেই।
পার্থক্যটা সামান্য। মিথিলা পানি খেয়ে হজম করতে পারছিল না। পানি খেয়েই বমি করে ফেলে দিচ্ছিল পুরোটা। তারপর আবারও চাইছিল পানি।
কখনও এই পানি আনতে ছুটছিল রাহাত, কখনও ইমরান।
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আর কারও কথা ভাবছেন।” খালি বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল মেয়েটা।
কিছুটা চমকাল রাহাত, “আর পানি লাগবে?”
“না। থ্যাংকস।” খালি বোতলটা ফিরিয়ে দিল মেয়েটি।
পিস্তল বের করে চেম্বারে একটা রাউন্ড ভরল রাহাত। একটা মাত্র গুলি করে আস্ত একটা দুই-পা কাটা মেয়েকে উইটনেস প্রটেকশন ডিটেইল থেকে উদ্ধার করে বের করে নিয়ে এসেছে ও, কেউ বিশ্বাস করবে? তাকিয়ে দেখল, পিস্তল হাতে উঠে আসার পর সুমির মুখের ভাবে এসেছে পরিবর্তন।
তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল রাহাত। হোস্টেজের সাথে হাসি-তামাশার সম্পর্ক কিডন্যাপারের থাকে না। তবে কিছু প্রশ্ন জানার আছে তার। সুমির মুখ খোলাতে হবে।
খাটের কোণে গিয়ে বসল ও। লালচে ঠোঁট কামড়ে বসে আছে এখন সুমি। ছোটাছুটির পর রক্ত মুছে দেওয়া মুখে কিছু ভেজা চুল এসে পড়ে আছে। অন্যরকম আবেদনময়ী লাগছে তাকে এখন। অথবা, কিডন্যাপারকে সিডিউস করার জন্য এই ভঙ ধরেছে মেয়ে। রাহাত এসব নিয়ে মাথা ঘামাল না।
“তোমার জন্য আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা প্রপোজাল আছে।” ষড়যন্ত্রকারীদের গলাতে বলল সে।
সুমির মুখ থেকে লাবণ্যের ছাপ মুছে অর্ধেক হয়ে গেল, “আমাকে নিয়ে কি করবেন?”
“তোমার কপালে কি আছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ক্যারিয়ার শুরু করছি আমি। নতুন চাকরি করতে যাচ্ছি ব্যানডিটের হয়ে। এটাই আমার প্রথম প্রজেক্ট। তোমার কোন ধারণা আছে ব্যানডিট সম্পর্কে?”
দুইপাশে মাথা নাড়ল সুমি। কিডন্যাপার খোশগল্পে মেতে উঠবে তা সম্ভবতঃ ভাবেনি সে-ও। কিছুটা হতভম্ভ দেখাচ্ছে তাকে।
“ওয়েল দেন। এই ঘরে আমরা নিজেদের স্টোরি শেয়ার করব। ব্যানডিট নিয়ে তোমাকে বলব আমি। বলব মরুভূমির মত শুষে পানি খাওয়ার দৃশ্য কেন ওভাবে দেখছিলাম। তবে তোমার দিকের গল্পও বলতে হবে তোমাকে। উইটনেস প্রটেকশন? ফাক অল দ্যাট। এর মধ্যে আর কিছু আছে।”
অস্বীকার না করলেও স্বীকার করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না মেয়ের মধ্যে।
আবারও বলতেই হল রাহাতকে, “দেখ, তোমাকে নিয়ে কি করবে ওরা তা আমার জানা নেই। ভাল কিছু না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আমার আসলেই মাথাব্যথা নেই তোমার কপালে যা আছে তা নিয়ে। কিন্তু যদি তোমার গল্প দিয়ে আমাকে কনভিন্স করতে পারো, আমি পার্সোনালি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। স্কাউট'স অনার।”
১০.
“ব্যানডিট হল অর্গানাইজড ক্রাইমের নতুন পদ্ধতি। জনৈক ব্যানডিট এই অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা। দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে আসতে হয় এখানে সবাইকে। একটা জেনারেল ইউনিভার্সিটি। আরেকটা ব্যানডিট ইউনিভার্সিটি। আন্ডার গ্রাজুয়েট কাওকে এখানে নেওয়া হয় না। এই অর্গানাইজেশনের প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষিত। পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট প্রত্যেকে। অ্যাকাডেমিকভাবে ব্রাইট রেজাল্ট করা প্রতিটি ক্রিমিনাল। এটাই আমাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র।”
“আপনি কোন ইউভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলেন?” আগ্রহ দানা বেঁধে উঠছে সুমির মুখে।
“বুয়েট। ইলেক্ট্রিক্যালে ছিলাম আমি। সিজিপিএ 3.90। ব্যানডিট ইউনিভার্সিটির বার্গলারী ছিল আমার মেজর। তবে স্টুডেন্ট ছিলাম ইনডোর ক্রাইমস, টেকনিক্যাল বাগশট অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক প্যানারোমা ডিপার্টমেন্টের। সিজিপিএ খুব একটা ভাল ছিল না ওখানে। ফ্রড অ্যান্ড ইম্পিউডেন্সে ছিল সি গ্রেড। একটা কেস খেয়ে গেছিলাম। তবে নতুন কিছু নিয়ে থিসিস করছিলাম দেখে ওভারঅল আমার রেজাল্ট খারাপ বলা যাবে না। ইলিউশন এক্সপার্টাইজের ওপর আমার কিছু জার্নাল ছিল।”
“তারমানে এখন ক্রাইম আপনারা যথেষ্ট পড়াশোনা করেই করছেন?” কিছুটা অবাকই দেখাচ্ছে সুমিকে।
“অবশ্যই। নাহলে পারব কেন বাকিদের সাথে? আমাদের কেউ জেলে যায় না কোনদিনও।” সবগুলো দাঁত দেখিয়ে দিল রাহাত।
“ভাল রেজাল্ট ছিল আপনার। দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছিলেন। চাকরী বাকরি করে বিয়ে-থা করবেন। তা না করে রাস্তাঘাটে পাছায় গুলি খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘুরছেন কেন তাই বুঝলাম না।”
হতাশায় মাথা দুইপাশে নাড়ল রাহাত, “পয়েন্টটা ধরতেই পারেননি। ব্যানডিটের প্রত্যেকেই যথেষ্ট কোয়ালিগফাইড। আমি অন্তত একজনকে চিনি যে গুগলে জব করে। তুখোড় প্রোগ্রামার। তার নাইট ওয়াচ অবশ্য আইনী কিছু না। আমরা এসব টাকার জন্য করি না। থ্রিলের জন্য করি। আমাদের একেকজন কোয়ালিফাইড ইন্টেলেকচুয়ালস, মিস সুমি। খেয়ে পড়ে বাচার জন্য আমাদের একশ একটা বৈধ পথ আছে। আমরা ক্রাইম করি, কারণ আমরা ক্রাইম করতে ভালবাসি।”
“মাই গড।” বিড়বিড় করে বলল সুমি।
“ব্যানডিট ইউনিভার্সিটির অস্তিত্ব আছে এটা অবশ্যই সরকার দূরে থাকুক, সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জানে না। সাবান কোম্পানির কাভারে বেজমেন্টে ক্লাস হয়। বিলিভ করবে না, ওখানে একটা শুটিং রেঞ্জও আছে। সাইট অ্যাডজাস্ট অ্যান্ড পারফেক্ট শুটিং কোর্সে এ প্লাসের কম পেলে কাওকে সার্টিফিকেটই দেওয়া হয় না। আমাদের ট্রেইনিং পুলিশ বা আর্মির চেয়ে কয়েকগুণ উন্নত। এক্স-কমান্ডোরা আমাদের ট্রেনিং দিত। ওখানেই মিথিলার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার।”
সুমি এবার আর কিছু বলল না।
বলে যাচ্ছে রাহাত, “মিথিলা পড়ত ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তার বড় ভাই ইন্টার্নি করছে তখন। দুটোই ছিল ব্যানডিট ইউনিভার্সিটিতে। তবে ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে এসে মিথিলার ভাই ইমরানের সাথে অন্য ডিপার্টমেন্টের কিছু ছেলের মধ্যে ঝামেলা হয়ে গেল। ইমরানের হাতে গুলি করে তাকে 'শিক্ষা' দিতে চেয়েছিল তাদের একজন। কিন্তু ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তুলতে দেখে নিজেকে তার সামনে ছুঁড়ে দিয়েছিল মিথিলা।”
মাথা নিচু হয়ে গেছে রাহাতের। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল সে।
“মিথিলাকে ভালবাসতেন আপনি?”
ছোট্ট এক শিশুর মত মাথা দোলাল রাহাত, “তা বাসতাম। তবে পাঞ্চ লাইন এটা না। ইমরানকে গুলি করতে আসা ছেলেটা এ ডাবল প্লাস পাওয়া শুটার ছিল। গুলিটা সে ইমরানের হাতেই করেছিল। বোকা মেয়েটা নিজেকে অযথা সামনে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেদিন। হলোপয়েন্ট বুলেট পেটে এসে লাগলে কি হয় তা আশা করি জানো। বাঁচার উপায় ছিল না ওর। ঢক ঢক করে পানি খেতে খেতে মারা গেল মিথিলা।”
আলতো করে মাথা দোলাল সুমি। কিডন্যাপারের প্রতি সামান্য সহানুভূতির ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার মুখে।
“ফেয়ার এনাফ। আপনার স্টোরি আপনি শুনিয়েছেন। যথেষ্ট সত্য মনে হয়েছে কথাগুলো। আমি আমার সাইডের স্টোরি শোনাতে পারি। তবে আপনাকে ট্রাস্ট করব কিভাবে? কিভাবে বুঝব আপনি ডন রাবেকের লোক নন? আমাকে মেরে ফেলার জন্য তুলে আনেননি? হয়ত স্টোরি শোনার নাম করে আমার অবস্থানটা নিশ্চিত হয়ে নেবেন। তারপর গুলি করবেন আমার মুখে?”
ঘর কাঁপিয়ে হাসল রাহাত, “ডন রাবেকের লোকজনকে আমি চিনি, ম্যাম। কারও মুখে গুলি করার জন্য তাদের কোন নিশ্চয়তা লাগে না। এত এথিকস মেনে কাজ করে না তারা। তুমিই ভেবে দেখো, তোমার আর কোন চয়েজ আছে আমাকে ট্রাস্ট করা ছাড়া? একবার বলেছি, তোমার পুরো গল্পটা শোনালে আমি তোমার সিকিউরিটির ব্যাপারটা দেখব।”
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চিন্তা করল সুমি। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমার গল্পটা ছোট। ডন রাবেকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এসেছিলাম আমি। কিন্তু আমাকে পাঠিয়েইছিল ডন রাবেক স্বয়ং।”
১১.
“অর্থাৎ, যাকে আমরা সবাই ডন রাবেক বলে জানি, সে মোটেও ডন রাবেক নয়।” ইশারাই কাফি ছিল রাহাতের জন্য। নিমেষে ধরে ফেলল সে ব্যাপারটা।
“অবশ্যই না। পেপারে পত্রিকাতে ডন রাবেকের ছবি অসংখ্যাবার এসেছে। সেই চেহারার মানুষটার নামেই করা হয়েছে রাজ্যের কেস। কোন উইটনেস পাওয়া যায়নি বলে ট্রায়াল শুরু করা হয়নি। তবে এবার আমি এবং আমার মত উইটনেস রাখা হয়েছে আরও সাতজন। আমাদের সাক্ষ্য নিয়ে ডন রাবেকের বিরুদ্ধে আদালত অনায়াসে ফাঁসির রায় ঘোষণা করতে পারবেন।”
“ডন রাবেক তাহলে এবার 'অফলাইনে' থেকে কাজ করতে চাইছে। চমৎকার।” মৃদু হাসি ফুটল রাহাতের মুখে।
“অফলাইন?”
হাত নাড়ল রাহাত, “ক্রিমিনাল টার্ম। ব্যানডিট ইউনিভার্সিটি। যখন কেউ নিজেকে মৃত হিসেবে রটিয়ে দিয়ে পুরোনো ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায়, তখন সেটাকে আমরা অফলাইন বলি।”
“যাকগে। ব্যাপার আসলে এতটুকুই। আমাকে ডন রাবেক নিজে উইটনেস প্রটেকশনের জন্য আবেদন করতে বলেছিলেন। তিনিই পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। মাঝে আরামেই ছিলাম। শুয়ে বসে বই পড়ে সময় কাটছিল। আমার জীবনের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা কারও করার কথা ছিল না। আমাকে খুন করবে কে? সাক্ষ্য দিচ্ছিলাম ডন রাবেকের বিরুদ্ধে। সাক্ষ্য দেওয়াচ্ছেন ডন রাবেক নিজেই!”
“তাহলে, এখানে একজনের পক্ষে অন্তত তোমাকে খুন করার যৌক্তিকতা আছে। নকল ডন রাবেকের। ফাঁসির পর্যায়ে বিষয়টা এলে তো সে-ই ঝুলবে। তাই না?”
হাসল সুমি, “বেস্ট পার্ট তো এটাই। সে ছিল আমাদের সুইসাইড স্কোয়াডের মেম্বার। ফাঁসির দড়িতে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আত্মাহুতি দিতে চলেছিল সে। কোনভাবেই আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার কথা ছিল না।”
“কিন্তু হয়েছে। আমাকে এখানে পাঠানোর উদ্দেশ্য, ব্যানডিটকে কেউ ভাড়া করেছে।” গাল চুলকালো রাহাত।
লালচে হয়ে গেছে সুমি।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল রাহাত, “কি হল?”
কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল সে, “উইটনেস প্রটেকশনের ওখানে আমার সাথে তাও একজন আয়া ছিল।”
“ছিল নাকি? যুদ্ধের ফাঁক ফোকড়ে তার সাথে আমার দেখা হয়নি। সরি।” হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারটা বুঝেনি রাহাত।
“বাথরুমে যেতাম। এত পানি খাওয়া ঠিক হয়নি মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে নিশ্চয় আমার জন্য আয়ার ব্যবস্থা রাখেননি আপনি?”
চুপচাপ খাটের সাথে লাগানো হাতকড়ার অংশটা খুলে সুমির বাম হাতে লাগাল রাহাত। দুই হাত আটকে দেওয়ার সাথে সাথে আবারও অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার মুখে। পাত্তা না দিয়ে আবারও পাঁজাকোলা করে তুলে নিল তাকে রাহাত।
“দরজার বাইরে অপেক্ষা করব আমি।”
কমোডের ওপর মেয়েটাকে বসিয়ে দিয়ে হাতকড়া দুই হাত থেকেই খুলে দিয়ে বলল রাহাত।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথাতে চিন্তা করার সুযোগ পেল রাহাত। ঘটনা যেদিকে এগিয়েছে তাতে খুশি হওয়ার উপায় নেই কারও। না রাহাতের, না সুমির। সুমি যদি অর্ধেক কথাও সত্য বলে থাকে তাহলে ডন রাবেকের লোকেরা তাকে উদ্ধার করে উইটনেস প্রটেকশনে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে।
“অথবা … এরই মধ্যেই চেষ্টা করা শুরু করে দিয়েছে তারা।” বিড়বিড় করে নিজেকে বলল রাহাত। ঝুলন্ত বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিল রাহাত। অন্যপাশ থেকে গাঢ় একটা ছায়াকে দেখা যাচ্ছে দরজার কাঁচের অন্যপাশ থেকে সাবধানে হাতল স্পর্শ করতে।
বিল্ডিংয়ের বারো তলাতে কিভাবে উঠে এল হারামজাদা? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের করতে হবে রাহাতকেই। অযথা ব্যানডিট ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী ধরে রাখার মাঝে কি আর কৃতিত্ব থাকছে তাহলে?
সাইলেন্সার একটা ছিল বটে, গাড়িতে রেখে এসেছে ওটা। এই ফ্ল্যাটকে সেইফ ভাবার মত ভুল রাহাত কিভাবে করল? নিজেকে মনে মনে কষে দুটো লাথি দিল সে।
বর্জ্র্যপাতের মত শব্দ করে প্রথম বুলেটটা বের হয়ে গেল। দরজার কাচে একটা মাত্র ফুটো হয়েছে। পরমুহূর্তে ওপাশ থেকে রক্তের একটা ধারা ছিটকে পড়ল দরজার ওপর। গুলি কোথায় লাগিয়েছে তা খুব ভাল করেই জানে রাহাত।
সুপিরিয়র ভেনা কেভাতে।
সুন্দর বারান্দাটা রক্ত পড়ে নষ্ট হল।
ঝড়ের বেগে বাথরুমে ফিরে এল রাহাত। তখনও প্যান্ট পরে সারতে পারেনি সুমি।
“শত্রুপক্ষ। এখান থেকে বের হতে হবে আমাদের।” দুই বাক্যে ব্যাখ্যা দিল রাহাত। সুমির মতামতের কোনরকম তোয়াক্কা না করে এক হাতে কোলে তুলে নিল তাকে। অনেকটা ছোট বাচ্চাদের যেভাবে ধরা হয়।
“বাঁচতে চাইলে আমার গলা জড়াও।”
১২.
বুকে সেঁটে আছে সুমি। গোড়ালির নিচ থেকে কাটা পড়া দুই পা দিয়ে শক্ত করে আটকেছে রাহাতকে। ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে গলা। রাহাতের বাম হাত এখন সুমির কোমরে। পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে মেয়েটাকে। ডানহাতে পিস্তল।
লিফটটা থাকে কমন একটা গ্রাউন্ডে। প্রতি ফ্লোরে চৌদ্দটা করে ফ্ল্যাট। করিডোর ধরে সেই কমন গ্রাউন্ডের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। করিডোরের অন্য প্রান্ত থেকে ছিটকে বের হয়ে আসা দুই সাবমেশিনগানধারীর পরিকল্পনা আর যাই হোক, তাদের সাহায্য করা ছিল না।
বিদ্যুতবেগে হাত উঠতে শুরু করেছে রাহাতের, মাপা বৃত্তচাপ কেটে উঠল হাত। সবচেয়ে কম অ্যাঙ্গেলের পার্থক্য রেখে দুইবার ফায়ার করেছে সে। দুটো বুলেটই আঘাত করেছে শত্রুদের উইন্ডপাইপে। গরু জবাইয়ের মত রক্তের ফোয়ারা বের হয়ে এল তাদের গলা থেকে।
ইচ্ছে করেই কাজটা করছে রাহাত। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া শত্রু যখন কোন ক্রাইম অর্গানাইজেশনের সদস্য, তখন তাদের নিজের লেভেলটা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার আছে। জবাই হয়ে থাকা লাশগুলো দেখে ডন রাবেক যেন বোঝে কার সাথে লাগতে এসেছিল সে।
“তোমার পেছনে!” রাহাতকে খামচে ধরে বলল সুমি।
তার আগেই রিঅ্যাক্ট করেছে অবশ্য ও। লিফটের দরজার সামনে চলে এসেছে এখন। ত্রিশ ফিট দূর থেকে চকচকে দরজায় অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে পেছনের। দশ ফিট পেছনে দরজা খুলে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে একজন এলোমেলো চুলের তরুণ বের হয়ে এসেছে, তা টের পেতে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল।
ঘুরেও তাকাল না রাহাত। এক সেকেন্ডের মত যে কারও মনে হতে পারে সুমিকে পিস্তলধরা ডানহাত দিয়েও জড়িয়ে ধরছে সে। আসলে নিজের পেছনের দিকে পিস্তল তাক করতে এটা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
খুব কাছ থেকে গুলির শব্দ হয়েছে, সুমি কেঁপে উঠল একবার।
“কোথায় লেগেছে হারামজাদার?” নিছক কৌতুহলের বশেই জানতে চাইল রাহাত। টার্গেটকে না দেখে গুলি করেনি ও ফিল্ডে। ভার্সিটির ল্যাবে প্রচুর করতে হয়ে এ কাজ। এ প্লাস পাওয়া এত সহজ কিছু নয় ওখানে।
“গ-গলাতে।” কোনমতে বলল সুমি।
“এজন্যই লিফট বরাবর ফ্ল্যাট নিতে আমার এত আগ্রহ।” খুশিতে গদ গদ হয়ে গেল যেন রাহাত। লিফটকেও যথেষ্ট খুশি হতে দেখা গেল এবার। টং জাতীয় শব্দ করে খুলে গেছে দরজা।
হাত ওপরেই তোলা ছিল খুনীর। কিন্তু ট্রিগার টানার সময় দেওয়া হল না তাকে। অসামান্য রিফ্লেক্সে কোমরের কাছ থেকেই গুলি করেছে রাহাত। হাত তোলার চেষ্টাও করেনি।
ডান চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেছে বুলেট। লিফটের পেছনে গিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল লোকটা। সেদিকে একবারও না তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে রওনা দিল রাহাত।
“আমরা লিফটে করে নামছি না?” অবাক হল সুমি।
“গুলি খেতে? নো থ্যাংকস।”
“আমাকে কোলে করে বারো তলা নামবে তুমি?”
“ 'তুমি' করে ডাকতে শুরু করেছ যখন, আমার তো মনে হয় তোমার খুব একটা আপত্তি নেই।” মিটিমিট হাসল রাহাত।
“তোমার কথা ভাবছিলাম আমি।”
“তাহলে মনোযোগ দিয়ে আমার পেছনদিকটা কাভার দাও। যেমনটা বলা হয়ে থাকে- ওয়াচ মাই ব্যাক।”
সাত তলা পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই নেমে এল ওরা। এতক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণকারী দল হয়ত আশা করেছিল লিফট ধরেই নেমে আসবে তারা। হতাশ হতে হয়েছে তাদের। তবে বেশিক্ষণের জন্য না। সিঁড়ি বেয়ে প্রথম দলটাকে উঠে আসতে দেখা গেল ছয়তলার ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে।
ওদের দুইজনকে রেইলিংয়ের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়ে হুল্লোড় করে উঠল তারা। ক্লিয়ার ভিউ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজনই মনে করল না রাহাত। ছুটন্ত অবস্থাতে নেমে আসছে এখনও, তার মধ্যেই রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তিনটা বুলেট পাঠিয়ে দিয়েছে। বুক পেতে বুলেট নেওয়া দেখে বাকিরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল জায়গাতে।
সামনের সঙ্গীদের আহত কিংবা মৃত দেহ সিঁড়ির পেছনের ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের গায়ে পড়লে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়।
পেছনের ওদের সামনে থেকে সামনের আহতদের বাঁধা পুরোপুরি মেঝেতে শুয়ে পড়ার আগেই তাদের মুখোমুখী হল রাহাত। সঙ্গীদের পড়ন্ত দেহে গুলি লাগার আশঙ্কাতে মূল্যবান একটা মুহূর্ত দ্বিধা করে ফেলেছে তারা।
রাহাতের মধ্যে দ্বিধার ছিঁটেফোটাও নেই এখন। সুমি বলতে পারবে না ঠিক কয়টা গুলি করেছে সে, তবে ক্লিক শব্দের সাথে সাথে ম্যাগাজিন খালি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারল পরিষ্কার।
রক্তে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে সিঁড়ি। একটা ধাপে সুমিকে কিছুক্ষণ বসিয়ে মেঝে থেকে দুটো সাবমেশিনগান তুলে নিল রাহাত। পড়ে থাকা শত্রুদের কোমর হাতিয়ে তুলে নিল এক্সট্রা ম্যাগাজিন। একটা ধরিয়ে দিল সুমির হাতে।
“আমার পেছনে কোন কিছুকে নড়তে দেখলেই গুলি করবে। সামনের দিকটা আমি দেখছি। অলরাইট?”
দ্রুত মাথা দোলাচ্ছে মেয়েটা, এগিয়ে এসে তাকে আবারও বুকে তুলে নিল ও।
অজান্তেই রাহাতকে খামচে ধরল সুমি।
অচেনা একটা মানুষের বুকে বুক মিশিয়ে থাকতে এখন আর খারাপ লাগছে না তো!
১৩.
প্রচণ্ড এক লাথিতে ভাঙ্গা হল দরজা। ডেস্ক থেকে লাফিয়ে উঠল একমাত্র মানুষটা। টেবিলের নিচের দিকের লাল একটা বোতাম চেপে দিয়েছে সাথে সাথে। ইমার্জেন্সী ড্রিল।
ঘরের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে রাহাত। এখনও ওকে জড়িয়ে আছে সুমি। তবে হাতে সাবমেশিনগানটি নেই। গাড়িতে ওঠার আগে গ্যারেজের শেষ লড়াইয়ে ম্যাগাজিন শেষ করে ফেলেছিল মেয়েটি। ওখানেই ফেলে এসেছে অস্ত্রটা। গাড়িতে ঢোকার পর পিস্তলের এক্সট্রা ম্যাগাজিন পেয়েছিল রাহাতও। নিজের অস্ত্র হাতে ফিরে পেতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল যথেষ্ট।
“না না, ব্যস্ত হবেন না প্লিজ।” ব্যাঙ্গের ছোঁয়া রাহাতের গলাতে, “মোড়াতে বসে পড়ুন প্লিজ। বসতে আজ্ঞা হোক।”
ধীরে ধীরে মোড়ার ওপর বসে পড়ল টেকো।
“কংগ্রাচুলেশনস, রাহাত। দারুণভাবে প্রথম মিশন সফল করেছ তুমি। ইউ আর ইন দ্য ফ্যামিলি।”
“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, সুমি, শুনছো?” একগাল হেসে মেয়েটাকে বলল রাহাত। তারপর সাবধানে মেঝেতে বসিয়ে দিল তাকে। “আপনার সাথে তো আর সুমিকে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই মনে হয়।”
সতর্ক হয়ে গেল টেকোর দৃষ্টি। একবার রাহাতের দিকে, একবার সুমির দিকে তাকাচ্ছে এখন। টাক মাথার দিকে তাকিয়ে আরেকবার নিজের চুল ঠিক করল রাহাত। সুমির দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটাও অবাক হয়ে গেছে।
“ক্ষেপে আছো তুমি, ছেলে। তোমার একটা ইন্টারভিউ নেব আমরা। এটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জানো তুমি। কোম্পানির হয়ে কাজ করার সুযোগ সবাই পায় না। যারা চাকরি পায় না তারা ফ্রি লান্স কাজ করতেই পারে। আমাদের তরফ থেকে কোন সমস্যা নেই। তবে চাকরি পাওয়ার জন্য একটা ইন্টারভিউ সবাইকে দিতে হবে। এটাই এখানকার নিয়ম।”
“তারমানে, সেদিন এই ঘরে আমার যে ইন্টারভিউ আপনি নিতে শুরু করেছিলেন, তার শেষ হয়েছে এখন। এই মুহূর্তে? সুমিকে কিডন্যাপ করে ফিরে আসার পর?”
“অবশ্যই। ইন্টারভিউটা নিশ্চয় হাঁচি আর মাছির গতির পার্থক্য জানতে চাওয়া ছিল না। নাকি তুমি তেমনটাই ভেবেছিলে?”
দুইপাশে মাথা নাড়ল রাহাত, “আপনার ইন্টারভিউ চমৎকার হয়েছিল। সেটা নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছি না আমি।”
“দরজা না ভেঙ্গে, একটা নক করে ভেতরে ঢোকাটা মনে হয় আপত্তি জানানোর লক্ষণ বলে বিবেচিত হত? সেকারণেই দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হয়েছে তোমাকে, নাকি?”
“আমার আপত্তি অন্যখানে, মি. রহমান।”
এবার অবাক হওয়ার চিহ্ন লুকাতে পারলেন না টেকো ভদ্রলোক, “আপনি কিভাবে-”
“আপনার নাম জানি? আরে আপনার বায়ো আমার মুখস্থ। আপনার মেয়ে সামান্থা রহমান যে উনিশ বছর বয়েসে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে দুই পা হারিয়েছে গোরালির কাছ থেকে তাও আমার জানা ছিল আগে থেকেই। তবে মেয়েকে যে এ পথে নিয়ে এসেছেন তা অবশ্য জানতাম না।”
বসে থেকেই লাফিয়ে উঠল সুমি।
“ব্যানডিট একটা ক্রাইম অর্গানাইজেশন, মি. রহমান। আমরা অন্য ক্রাইম অর্গানাইজেশনদের থেকে অন্যরকম। এবং আমরা কখনই তাদের হয়ে কাজ করি না। এক্সিকিউটিভ ব্যানডিট হিসেবে আপনার এসব জানা থাকার কথা।”
এক্সিকিউটিভ ব্যানডিট মি. রহমানের মুখ এবার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
“ডন রাবেকের কাছ থেকে কত টাকা নিচ্ছেন? ব্যানডিটের বেতন যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না আপনার? তাই তো? মানথলি আট লাখ। এটা আর তেমন কি? তাই না?”
মি. রহমানকে যেন চাবুকের মত আঘাত হানল কথাগুলো।
“ডন রাবেকের সাথে আমার কোন-”
“প্লিজ, সাফাই গাইবেন না নিজের পক্ষে। ডন রাবেক এখন ফেইক ডন রাবেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অফলাইনে যেতে চাইছে, এই খবর খুব বেশি মানুষ না জানলেও, আপনি জানতেন। আপনাকে জানানো হয়েছিল। ডন রাবেক নিশ্চয় পার্সোনালি এসে আপনাকে হায়ার করেছিল। একজন মানুষের বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রস্তুত, উইটনেস প্রটেকশনে রাখা হল সেই সাক্ষীদের। তাদের কেউ যদি কিডন্যাপড বা খুন হয়ে যায়, ডিটেইলসের ভেতর থেকেই? ফেইক ডন রাবেকের বিরুদ্ধে আরও জোরদার হবে মামলা। তাই না?”
চুপ হয়ে গেছেন মি. রহমান। এখন আর আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করছেন না তিনি।
“সুমিকে একটা প্লাস দেব।” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল রাহত, “ইচ্ছে করলেই আমাকে মিথ্যে কোন কাহিনী শুনিয়ে উল্টোপথে পরিচালনা করতে পারত সে। কিন্তু করেনি। কেন, তা আমি জানি না। তবে জানি, আমাকে ওপাড়ে পাঠাতে লোক আপনিই পাঠিয়েছিলেন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে। মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিশ্চয়?” একটা ভ্রু উঁচু করল রাহাত।
এবারও চুপ করে থাকলেন টেকো।
“দরজা ভাঙ্গার কারণ এবার কিছুটা হলেও মাথায় ঢুকছে নিশ্চয় আপনার? মাথা ভাঙ্গার জন্য কিছু কারণ আপনি এরই মধ্যে জন্ম দিয়েছেন। পাপ স্বীকার করুন, নতুবা আরও কিছু কারণ যুক্ত হবে বলে আমার বিশ্বাস।”
গলা খাকারি দিলেন মি. রহমান, “স্বীকার করছি সবকিছু। ডন রাবেকের দরকার ছিল যোগ্য লোক। আর যো্গ্য লোক ছিল আমাদের কাছে। দুই কোটি টাকা বাড়তি কামানোর সুযোগ আপনি হাতছাড়া করবেন না নিশ্চয়? সুমির জন্য কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল আমার। কৃত্রিম পায়ের ওই প্রযুক্তিটা নতুন। যেখান থেকে সুযোগ পাচ্ছিলাম কাজে হাত দিচ্ছিলাম। টাকাটার দরকার ছিল আমার। আপনার ছেলেমেয়ে আছে, মি. রাহাত?”
দুইপাশে মাথা নাড়ল রাহাত।
“সেক্ষেত্রে আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন না। আমি অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করছি না কোন। তবে আপনার হাতে সুমি ঠিকমত কিডন্যাপড হবে সেটা আমার জানা ছিল। জানা ছিল না এরপর আপনি কি করবেন তাকে নিয়ে। সুমির নিরাপত্তা দেখার জন্যই কিছু লোক পাঠিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে নিজেরাই নিজেদের কোন্দলে এসে কিছু অ্যাসেট হারিয়েছি আমরা।”
“আপনার ছাগলামির জন্য।” সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল রাহাত। “বালছাল লোকজন দিয়ে এই পোস্ট চলবে না। আপনার মত নীতির তোয়াক্কা না করা লোকজন যাদের রিক্রুট করবেন তারাও কোন অংশে আপনার চেয়ে কম যাবে বলে মনে হয় না। আপনি মনে করেছিলেন এটা একটা ইন্টারভিউ ছিল। রাইট ইউ আর, মি. রহমান। তবে ইন্টারভিউটা আপনার নেওয়া হয়েছে। ইন্টারভিউ বলব না ইন্সপেকশন বলব সেটাই বুঝতে পারছি না আরকি। শেষ লাইনটা অবশ্য একই থাকছে, ইউ আর ফায়ারড।”
আমশি হয়ে গেছে মি. রহমানের মুখ। সেদিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসল রাহাত, “মুরগির পাছার মত মুখ করে ফেললেন কেন? আপনার পোস্টটা পাচ্ছে সামান্থা রহমান। আপনি যাচ্ছেন অবসরে। আর মেয়েকে নিয়ে ভাবতে হবে না, ওর পায়ের চিকিৎসার খরচ আমি দেব। শী ইজ ফ্যামিলি নাউ। ইউ আর নট। পেনশন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন আপনি। এরপর এই অফিসের একশ ফুটের মধ্যে আপনার মুরগির পা-”
“না না, আমাকে আর দেখতে পাবেন না এখানে। অসংখ্য ধন্যবাদ!” মৃত্যুদণ্ড আশা করেছিল মানুষটা। এত অল্পে ছাড়া পেয়ে যাবে ভাবেনি। রীতিমত গদ গদ হয়ে গেছে এখন তার চেহারা। “অসংখ্য ধন্যবাদ, মি. ব্যানডিট।”
ঘর কাঁপিয়ে হাসল রাহাত, “আপনার ধারণা হয়েছে আমিই ব্যানডিট? নো, স্যার! ভুলে যাচ্ছেন কেন? সেরের ওপর যেমন সোয়া সের থাকে, সোয়া সেরের ওপর দেড় সেরও থাকে। এটুকু মনে থাকলে আপনাকে তো আর কষ্ট করে ডেস্কের তলের ওই লাল বোতামটা চাপ দিতে হত না।”
পরিশিষ্টঃ
শেষবারের মত সুমিকে কোলে নিয়েছে রাহাত। গ্যারেজে চলেছে ওরা। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট পাচ্ছে সুমি। এক্সিকিউটিভ ব্যানডিটের কোয়ার্টার। সেখানে তাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে রাহাত। বাকি সবকিছু ব্যানডিটের লোকজনই দিয়ে যাবে ও বাড়িতে।
এবার রাহাতকে দুই হাতে জড়িয়েছে সুমি। এক হাত দিয়ে কোমলভাবে এলোমেলোও করে দিচ্ছে রাহাতের চুল। টের পেলেও ভালমন্দ কিছু বলছে না অবশ্য বাহক।
“শী ইজ ফ্যামিলি নাউ?” ফিসফিস করে বলল সে।
“ওই অর্থে বলিনি কথাটা। অর্গানাইজেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পোস্টে আছ এখন তুমি।”
“সেজন্যই কি কোন হুইল চেয়ার আসার অপেক্ষা না করে আমাকে কোলে করে নামিয়েছ তুমি? আমার জানামতে তোমার জন্য এটা একটা ফোনকলের কাজ।”
মুখ বাঁকাল রাহাত, “তোমার ঘোড়া না আমি। এটাই শেষবার।”
গাড়ির কাছে চলে এসেছে ওরা। দুই হাতে রাহাতের গাল ধরল সুমি। তারপর কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে দেখল তাকে।
কোনরকম আগাম সঙ্কেত না দিয়ে গভীরভাবে চুমু খেল তাকে এবার।
“থ্যাংকস ফর এভরিথিং, রাহাত।”
অসহায় দেখাচ্ছে এখন রাহাতকে। অসমসাহসী যোদ্ধার চেহারার এই হাল দেখে মজা পাচ্ছে সুমি।
“ওয়েল, ফিরিয়ে নিলাম আমার কথা। এটাই শেষবার না।”
দুইজোড়া ঠোঁট আরও একবার এক হল।
নিকট ভবিষ্যতে তারা আলাদা হবে বলে মনে হয় না!
--- ০ ---
[লেখাটি প্রথম প্রকাশিত আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। সারাজীবনই ব্লগের পরোয়া করিনি। ফেসবুকেই লেখা থাকে আমার। সেখানে পড়ে আসা কারও মনে যেন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় তাই সেই লিংকটাও দিলামঃ Click This Link ]
©somewhere in net ltd.