![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ইসতেকার আহমেদ সাকিব।আমি একজন খহুদে লেখক এবং আমি আমার সবরকমের মতামত দিতে এসেছি তাি আমার বলগ পড়থে হলে এখানে ছওখ রাকুন।
img|https://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/Isthekar/Isthekar-1625215520-9c33268_xlarge.jpg]
আয়াশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলো তুতুল বটতলার নিচে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। তার হাতে একটা কাগজের টুকরো।
গতকাল শান্তা গম্ভীরমুখে এসে তুতুলের হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। কোনো ভালো মন্দ কিছু বলেনি। তুতুল যখনই কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান্তা চুপচাপ চলে যায়। চিঠি খোলার পর থেকেই তুতুল তার স্থিরতা হারিয়ে ফেলে। চিঠির মানে সে বুঝতে পারছে না। কাল সারারাত এর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। অগত্যা উপায় না পেয়ে আজ সকাল হতেই আয়াশকে ডেকে পাঠিয়েছে। তুতুলের অস্থিরতা দেখে আয়াশের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। হঠাৎ ই কৌতূহলী হলো তার মন। তুতুলের কাছে গিয়ে আয়াশ আস্তে করে ডাক দিলো,
'তুতুল ভাই।'
আয়াশের গলা শুনে তুতুল যেন একটু স্বস্তি পেলো। দ্রুত আয়াশের হাত ধরে তাকে বসিয়ে বলল, 'এসেছিস তুই! কতক্ষণ ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করছি।'
'কিছু কি হয়েছে? এতো জরুরি ভাবে ডেকে পাঠালে যে!'
তুতুল আর কোন কথা বাড়ালো না। তার হাতের চিঠিটি আয়াশের হাতে দিয়ে বলল,
'এটা মনোযোগ দিয়ে পড়। পড়ে আমাকে বলবি এর অর্থ কি?'
আয়াশ সাদা কাগজের চিঠির ভাঁজ আলতো করে খুললো। দেখলো তাতে কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা,
'আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন আপনার মধ্যে ছিল অংশুমালীর ন্যায় প্রখরতা। আমার অনন্বয় উচ্চহাস্যই যে ছিল তার হেতু সে ব্যাপৃতে আমি অবগত। আপনার আননে একরাশ অম্ভোদ দেখে পরক্ষণেই তা ছেয়ে গিয়েছিল আমার মর্মদেশে। কিন্তু তখনো আমার অন্তঃকরণেরর স্পর্শানুভূতিকে আপনার ন্যায় অনুধ্যায় করে দেখিনি। আপনার মুখে সেদিন ঐ কথা শুনে আমি যারপরনাই চমকপ্রদ হয়েছিলাম। আপনার মুখ নিঃসৃত বোলের স্পর্শেন্দ্রিতে উর্ণনাভের জালের মতো আমিও আষ্ঠেপৃষ্ঠে হয়েছি আবদ্ধ। সময় বহিতেই টের পেলাম এই স্পর্শেন্দ্রি অম্বুর মতোই স্বচ্ছ, মাতঙ্গের ন্যায় দৃঢ়, সহস্যদল সদৃশ শুভ্র। তবুও যদি আরও বিশদ বিবৃতি দিতে হয় তাহলে আপনার সত্তয়ালে আমার প্রত্যুত্তর ইতিবাচক।'
ইতি
শান্তা
চিঠি থেকে মুখ না তুলেই আয়াশ মৃদু হেসে বলল,
'মেয়েটা কি বাংলা ডিপার্টমেন্টের তুতুল ভাই?'
তুতুল চঞ্চল চিত্তে বলল,'হ্যাঁ। এইসব কি লিখছে?
ইংরেজি পড়তে গেলেও তো এমন দাঁত ভাঙ্গে না। এই লেখার মাথামুন্ডু তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এইসব লেখার অর্থ কি আমাকে একটু বল।'
আয়াশ মুখের সামনে হাত নিয়ে খুক করে কাশি দিয়ে শুরু করলো,
'দেখো প্রথম থেকে বলি অংশুমালী অর্থ সূর্য। সূর্যের প্রখরতা বুঝিয়েছে। অনন্বয় উচ্চহাস্য মানে অসংলগ্ন জোরে হাসি। অম্ভোদ অর্থ মেঘ। আননে বলতে মুখ মানে চেহারা বুঝিয়েছে। মর্মদেশ অর্থাৎ মন। অন্তঃকরণ অর্থ হৃদয়। স্পর্শানুভূতি অনুধ্যায় মানে হলো অনূভূতি নিয়ে ভেবে দেখা। মুখ নিঃসৃত বোল মানে হলো কথা। উর্ণনাভ অর্থ মাকরসা....'
তুতুল বিস্ফোরিত চোখে বলল, 'কি...আমাকে মাকরসা বলেছে?'
'আরে না, মাকরসার জাল প্রতীকী শব্দে বুঝিয়েছে। আচ্ছা এবার শুনো, স্পর্শেন্দ্রি অর্থ অনুভূতি। অম্বু অর্থ পানি। মাতঙ্গ অর্থ হাতি, সহস্যদল সদৃশ শুভ্র মানে পদ্ম ফুলের মতো পবিত্র। আর সত্তয়াল মানে প্রশ্ন......
তুতুল আয়াশকে মাঝপথে থামিয়ে বলল,
'কি বলতাছোস? আগামাথা কিচ্ছু বুঝতাছি না। একটা কাজ কর তোর সব শব্দের অর্থ বলা লাগবে না। তুই সহজ ভাষায় বল চিঠিতে কি বুঝিয়েছে।'
'তুমি কি মেয়েটাকে কোনো প্রশ্ন করেছিলে তুতুল ভাই?'
তুতুল কিছুক্ষণ ভেবে শান্তার সাথে শেষ কথোপকথোনের কথা মনে করে বলল,
'হ্যাঁ করেছিলাম। তো!'
আয়াশ মুচকি হেসে বলল,
'মেয়েটা তোমার প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলেছে।'
তুতুল অন্যমনষ্ক ভাবে বলল,
'ও...তারপর।'
হঠাৎ হুঁশ হলো তুতুলের। বুকের মধ্যে একধরনের শিরশিরে অনুভূতি বইতে লাগলো। আবারো জিজ্ঞাসা করলো, 'হ্যাঁ বলেছে?'
'হুম।'
'সত্যি?'
'আরে হ্যাঁ, সত্যিই।'
মনের আন্দোলিত মৃদু সুরেলা দোলা তুতুলের চেহারায় তার প্রতিবিম্ব তুলে ধরলো। আয়াশ তুতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
'তুতুল ভাই, তুমি তো দেখি লজ্জা পাচ্ছো!'
তুতুল অস্বীকার করে বলল,
'কই!'
হাতের সাদা কাগজে লেখা চিঠিটি আরেকটু নিজের সাথে চেঁপে ধরে আয়াশের থেকে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল তুতুল। আড়ালে মুখ নিয়ে ঠোঁট চেঁপে হাসতে লাগলো। ছোটো ভাইয়ের সামনে তার সত্যিই খুব লজ্জা লাগছে। সাথে আছে এক অপ্রকাশিত ভালো লাগা অনুভূতিও।
__________________________________________
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে শান্তা একবার ভ্রু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকালো। নীল প্রশস্ত আকাশের আনাচে কানাচে এখন কৃষ্ণকায় মেঘের আধিপত্য। থেমে থেমে একধরনের শীতল হাওয়া বইছে। রাস্তার ধুলোগুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে একটু আধটু উড়ে বেড়াচ্ছে। আনমনে হেসে উঠে শান্তা ভাবলো, আজ বৃষ্টি হলে কোনো অসুবিধা নেই। বাসা থেকে সে ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে। বেশিরভাগই সে যখন ছাতা নিয়ে বের হয় সেদিন বৃষ্টি আসে না। আর যেদিন ছাতা আনবে না সেদিনই ঝুম বৃষ্টি। আজ হয়তো এতোদিনের হিসেবের বিপরীত হতে চলেছে।
ঠোঁট চেঁপে ব্যাগে ছাতার উপস্থিত দেখার জন্য শান্তা একবার ব্যাগের চেইন খুললো।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবত শান্তার গতিবিধি পরখ করছে তুতুল। ক্যান্টিনের সামনের এক প্রকান্ড গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে। শান্তার উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেঁপে রাখার দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে অস্বাভাবিক ঢিপ ঢিপ শব্দ হতে লাগলো তুতুলের। কি সুন্দর করেই না মেয়েটা কিউট চেহারা করে ব্যাগের মধ্যে কি যেন খুঁজে যাচ্ছে। বেপরোয়া বাতাসও দেখো কেমন করে এলোমেলো করার নেশায় মত্ত হয়ে বিনা অনুমতিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার কালো ঘন চুল। তার মোলায়েম সরু হাত বারবার এপাশ ওপাশ করে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সেই নগন্য ব্যাগটিকে। তুতুলের মনে হলো এই মুহুর্তে সে সার্থক হতো, যদি সে হতে পারতো শান্তার কাঁধের সেই তুচ্ছ ব্যাগ অথবা প্রকৃতির অদম্য সেই বেপরোয়া হাওয়া।
হুট করেই শান্তার কাঁধ থেকে ফসকে মাটিতে পড়ে গেল ব্যাগটি। ব্যাগ থেকে সব জিনিস ছিটকে পড়লো রাস্তার মাঝে। তুতুল মুখ দিয়ে একটা আফসোসের শব্দ করে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলো সেখানে। হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ে শান্তার সাথে ব্যাগে সব কিছু পুনরায় ঢুকানোর জন্য হাত লাগালো। একটি পুরুষালী পারফিউমের গন্ধ হঠাৎ এসে ধাক্কা খেলো শান্তার নাকে। একবার আড়চোখে সামনের মানুষটিকে দেখে শান্তা থমকে গেলো। মুহুর্তের মধ্যেই যেন অসাড় হয়ে পড়লো হাত পা। কি করে শ্বাস নিতে হয় তা যেন হঠাৎ করেই ভুলে গেছে সে। হৃদপিন্ড যেন গুলিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম। কি মুশকিল! যে মানুষটিকে দেখার জন্য এতক্ষণ ধরে ছটফট করছিলো। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে যাচ্ছিল তাকে। এখন হঠাৎ করেই সে সামনে আসতে এতোটা অস্থির লাগছে কেন? তুতুল একটা একটা করে বই,খাতা, কলম আরো অন্যান্য জিনিস ব্যাগে তুলে দিতে লাগলো। শান্তাও চুপচাপ তাই করছে। ব্যাগের জিনিস তুলে দেওয়ার সময় তুতুল একবারো শান্তার দিকে তাকালো না। মাথা নিচু করে দায়িত্ব সহাকারে শুধু কাজেই মনোনিবেশ করলো। ব্যাগে সব ভরা হয়ে গেলে শান্তা উঠে দাঁড়ালো। আড়চোখে একবার তুতুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো তুতুল একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শান্তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কোথা থেকে যেনো একরাশ আড়ষ্টতা এসে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কানে অবাধ্য চুলগুলোকে গুঁজে দিয়ে আরেকবার খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে পাশে তুতুলকে দেখে শান্তা। ছেলেটা এখনও কেমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে পড়ে। শান্তা দ্রুত তার ছাতা খুলে মাথা আড়াল করে নেয় আকাশের অদম্য বর্ষণ হতে। ইশ! বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটা এখনো তাকিয়ে আছে। কি এমন দেখছে বেহায়ার মতো! বৃষ্টি নেমেছে সেদিকে কি তার খেয়াল আছে! শান্তা ভেবে পায় না। ব্যাগে সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। বৃষ্টি এসে পড়েছে। ছাতা খোলাও হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই শান্তার পা বাড়িয়ে চলে যাওয়া উচিত। মাঝ রাস্তায় শুধু শুধু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার নিশ্চয়ই কোনো মানে হয় না। কিন্তু এই বেমানান কাজটিই শান্তা করছে৷ কেন? শান্তার অবচেতন মন কি চায় যে পাশের মানুষটি শুধু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে না থেকে আরো কিছু বলুক। অন্তত নাম ধরেই বা ডাকুক। আরো কিছুক্ষণ উসখুস করে শান্তা কোনো সাড়া না পেয়ে মুখ ফুলিয়ে সামনে পা বাড়ায়। তুতুল খপ করে শান্তার হাত ধরে বসে। একধরণের শীতল শিরশিরে শিহরণ মুহুর্তের মধ্যে বয়ে যায় শান্তার শরীরে। শ্বাসপ্রশ্বাস যেন থমকে যায় গলায়। তুতুলের কোনো হুঁশ নেই। সে থমকে আছে সামনের মানুষটির রচিত মায়ায়। এতক্ষণে দেখতে থাকা মায়াপরীকে অবলোকনে হঠাৎ বাঁধা পড়লো বলেই সে অজান্তেই ধরে বসে শান্তার হাত। হঠাৎ করেই সে সম্বিত ফিরে পায়। নিজের কৃতকর্ম চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই দ্রুত ছেড়ে দেয় শান্তার হাত। তুতুলের হাত থেকে ছাড়া পেতেই শান্তা দ্রুত চলে যায়। হাত দিয়ে মাথার ভেজা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে ওঠে তুতুল। না জানি শান্তা কি ভাবছে! নিশ্চয়ই খুব খারাপ ছেলে মনে করছে তাকে। মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে তুতুল। কাঁচুমাচু করে সামনে তাকিয়ে হঠাৎ দেখে শান্তা তার কয়েক কদম এগিয়েই থেমে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখলো থমকে দাঁড়িয়ে থেকেই শান্তা তার ছাতা মাথার উপর থেকে সরিয়ে একটু সাইডে নিয়ে রাখলো। ইশারায় আরেকজনের জায়গা করে দিলো নিজের পাশে। তুতুল হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসে দ্রুত দৌঁড়ে যায় শান্তার খালি করে দেওয়া জায়গা দখল করতে। শান্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে শান্তার দিকে তাকিয়ে একটা ফিচেল হাসি দেয় তুতুল। অজস্য বারিধারাকে কেন্দ্র করে এই অবাধ্য ছেলের বেহায়া দৃষ্টি থেকে একইসঙ্গে বাঁচতে আর থাকতে শান্তা তার মাথা নত করে মনের লাজুক হাসিটি লুকায়।
__________________________________________
রাত নিঝুম। ঘড়ির কাটা এক এর সংখ্যা এই ছুঁলো বলে! হোস্টেলের প্রত্যেকটা মেয়ে এখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে মুখ থেকে চাদর সরিয়ে উঠে বসে। ঘুম আজ কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না তাকে। রাত গভীর, চোখে ঘুম নেই অথচ ঘুমের জন্য শুয়ে থাকার মতো অসহ্যকর ব্যাপার হয়তো পৃথিবীতে আর দুটো নেই। না! আর চেষ্টা করে লাভ নেই৷ ঘুম মনে হয় না আর আসবে। এই গভীর রাতে এখন আর কিই বা করবে প্রত্যাশা। শুধু শুধু বসে থাকতেও তো ভালো লাগে না। প্রত্যাশা একবার করুণ মুখে তার দু পাশের দুটো বিছানার দিকে তাকায়। কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে স্বর্ণা আর মৌরি। বান্ধবীদের ঘুম দেখে প্রত্যাশার হিংসে হয়। ও নিজে নির্ঘুম হয়ে জেগে থাকবে আর বদমাইশ বন্ধুগুলা নাক ডেকে ঘুমাবে! প্রশ্নই উঠে না। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টিয়ে স্বর্ণার বিছানায় গিয়ে ডাকে, 'দোস্ত উঠ। আর ঘুমায় না। এতো ঘুমিয়ে কি করবি, স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে।' স্বর্ণা কিছুক্ষণ আড়মোড়া দিয়ে হুম হুম করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এবার প্রত্যাশা যায় মৌরির কাছে। একইভাবে ডাকতে থাকে তাকে।
'মৌরি, আমার লক্ষ্মী বান্ধুপি! উঠ না একটু। আমার একটুও ঘুম আসছে না। তুই না আমার ভালো বন্ধু। এক বন্ধুকে রেখে আরেক বন্ধু কি ঘুমাতে পারে!'
মৌরিরও স্বর্ণার মতো একই অবস্থা। ঘুমের চোখে সে থেমে থেমে বলে,
'আরেকটু ঘুমাই। সকাল হলেই উঠবো। তুই ঘুমিয়ে পড়.....ঘুমিয়ে প...
প্রত্যাশা এবার একটু থামে। পরক্ষণে জোরে চিৎকার দেয়। বলে, 'স্বর্ণা মৌরি, ঐ দেখ একটা হ্যান্ডসাম ছেলে এসেছে।'
স্বর্ণা আর মৌরি ধড়ফড়িয়ে উঠে। দুজনে একসাথে দ্রুত প্রত্যাশার কাছে এসে সমস্বরে জিজ্ঞাসা করে, 'হ্যান্ডসাম ছেলে! কই? কই?'
প্রত্যাশা সরু চোখে দুজনের দিকে তাকায়। দুজনের গায়ে সাদা লং নাইট গাউন। মুখে নাইট ক্রিমের পুরু স্তর। চুলগুলো এলোমেলো উসকোখুসকো হয়ে আছে।
'ফ্রেন্ডের কথা শুনে উঠলি না। হ্যান্ডসাম ছেলের কথা শুনতেই বান্দরের মতো লাফিয়ে উঠে পড়লি! বান্দরনিরা!'
স্বর্ণা আর মৌরি হাই তুলে একবার আশেপাশে দেখে। আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে, 'হ্যান্তসাম ছেলে আসে নাই! ধুর! কি ঘুম আসছিলো।'
স্বর্ণা আর মৌরি পুনরায় ঘুমিয়ে পরার আগেই প্রত্যাশ দুজনের হাত টেনে উঠিয়ে বসায়। দুজনকে দুটো ঝাঁকি দিয়ে বলে,
'প্রথমেই ফ্রেন্ড আর হ্যান্ডসাম ছেলের কম্প্যারিসনে হ্যান্ডসাম ছেলের পাল্লা ভারি করছোস। এখন আবার ফ্রেন্ডকে রেখে ঘুমাতে যাস! তোদের দুজনের সাথে কিন্তু আমি ব্রেকআপ করবো। শালী হারামি!'
মৌরি আবারো হাই তুলে গাল হাত রেখে বলে,
'আচ্ছা যা! ঘুমাবো না। এখন কি করবি? গল্প শুনবি? আমার লাস্ট ক্রাশ খাওয়ার গল্পটা কি বলবো?'
স্বর্ণা চোখ বন্ধ করে ঘুম ঘুম চোখে বলে,
'তোর লাস্ট ক্রাশ খাওয়ার গল্প তো আর বলবি না। লাস্ট তো একটা শার্ট প্যান্ট পড়া বুইড়া ব্যাটারে পেছন থেকে দেখে ক্রাশ খাইছিলি। পড়ে সামনে গিয়ে দেখছোস আসল ঘটনা। কি মনে করছোস আমি জানি না। এখন বল, বলবি ঐটা? ঐটা তো আর বলবি না। ঐটা তো ঠিকই সুযোগমতো স্কিপ কইরা দিছোস।'
মৌরি রাগান্বিত হয়ে বলে, 'এখন তোর লাস্ট ব্রেকআপের ঘটনা বলি? তুই যে অনলাইনে তিন মাস প্রেম কইরা জানতে পারছোস একটা তিন ছেলেমেয়ে আলা বিবাহিত ছেলের সাথে এতদিন প্রেম করছোস৷ তাও আবার বরিশাইল্লা রিকশা আলা। ফেক আইডির কথা জানতে পাইরা যে ব্রেকআপ কইরা দিছো ঐটার গল্প আমি বলবো?'
স্বর্ণা ক্ষেপে উঠে বলে, 'তুই আমার পেছনে খবরদারি করোস?'
'আর তুই যে করোস! তার বেলা!'
প্রত্যাশা চেঁচিয়ে উঠে বলে, 'আহ! তোরা থামবি। তোদের দুজনকে কি ঝগড়া করে আমার মাথা ধরাবার জন্য ঘুম থেকে উঠিয়েছি।'
মৌরি বলল, 'সরি দোস্ত। বল এই মাঝরাতে এখন কি করবো?'
স্বর্ণা আবারো একটা হাই তুলে বলে, 'তাই তো। আয়াশকে তো আর এখন দেখতে পারবি না, ওদের বাসায় না যাওয়া ছাড়া।'
স্বর্ণা এমনিই কথার কথা বলেছিলো। কিন্তু
প্রত্যাশা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
'গুড আইডিয়া!'
স্বর্ণা মৌরি একসাথে চমকে উঠে বলল,
'কি?'
প্রত্যাশা বলল, 'আমরা এখন আয়াশের বাসায় যাবো।'
কথাটা বলে প্রত্যাশা বিছানার উপর দাঁড়িয়ে আনন্দিত হয়ে লাফাতে লাগলো। স্বর্ণা আর মৌরি একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের মুখেই করুণ দৃষ্টি।
আয়াশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলো তুতুল বটতলার নিচে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। তার হাতে একটা কাগজের টুকরো।
গতকাল শান্তা গম্ভীরমুখে এসে তুতুলের হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। কোনো ভালো মন্দ কিছু বলেনি। তুতুল যখনই কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান্তা চুপচাপ চলে যায়। চিঠি খোলার পর থেকেই তুতুল তার স্থিরতা হারিয়ে ফেলে। চিঠির মানে সে বুঝতে পারছে না। কাল সারারাত এর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। অগত্যা উপায় না পেয়ে আজ সকাল হতেই আয়াশকে ডেকে পাঠিয়েছে। তুতুলের অস্থিরতা দেখে আয়াশের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। হঠাৎ ই কৌতূহলী হলো তার মন। তুতুলের কাছে গিয়ে আয়াশ আস্তে করে ডাক দিলো,
'তুতুল ভাই।'
আয়াশের গলা শুনে তুতুল যেন একটু স্বস্তি পেলো। দ্রুত আয়াশের হাত ধরে তাকে বসিয়ে বলল, 'এসেছিস তুই! কতক্ষণ ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করছি।'
'কিছু কি হয়েছে? এতো জরুরি ভাবে ডেকে পাঠালে যে!'
তুতুল আর কোন কথা বাড়ালো না। তার হাতের চিঠিটি আয়াশের হাতে দিয়ে বলল,
'এটা মনোযোগ দিয়ে পড়। পড়ে আমাকে বলবি এর অর্থ কি?'
আয়াশ সাদা কাগজের চিঠির ভাঁজ আলতো করে খুললো। দেখলো তাতে কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা,
'আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন আপনার মধ্যে ছিল অংশুমালীর ন্যায় প্রখরতা। আমার অনন্বয় উচ্চহাস্যই যে ছিল তার হেতু সে ব্যাপৃতে আমি অবগত। আপনার আননে একরাশ অম্ভোদ দেখে পরক্ষণেই তা ছেয়ে গিয়েছিল আমার মর্মদেশে। কিন্তু তখনো আমার অন্তঃকরণেরর স্পর্শানুভূতিকে আপনার ন্যায় অনুধ্যায় করে দেখিনি। আপনার মুখে সেদিন ঐ কথা শুনে আমি যারপরনাই চমকপ্রদ হয়েছিলাম। আপনার মুখ নিঃসৃত বোলের স্পর্শেন্দ্রিতে উর্ণনাভের জালের মতো আমিও আষ্ঠেপৃষ্ঠে হয়েছি আবদ্ধ। সময় বহিতেই টের পেলাম এই স্পর্শেন্দ্রি অম্বুর মতোই স্বচ্ছ, মাতঙ্গের ন্যায় দৃঢ়, সহস্যদল সদৃশ শুভ্র। তবুও যদি আরও বিশদ বিবৃতি দিতে হয় তাহলে আপনার সত্তয়ালে আমার প্রত্যুত্তর ইতিবাচক।'
ইতি
শান্তা
চিঠি থেকে মুখ না তুলেই আয়াশ মৃদু হেসে বলল,
'মেয়েটা কি বাংলা ডিপার্টমেন্টের তুতুল ভাই?'
তুতুল চঞ্চল চিত্তে বলল,'হ্যাঁ। এইসব কি লিখছে?
ইংরেজি পড়তে গেলেও তো এমন দাঁত ভাঙ্গে না। এই লেখার মাথামুন্ডু তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এইসব লেখার অর্থ কি আমাকে একটু বল।'
আয়াশ মুখের সামনে হাত নিয়ে খুক করে কাশি দিয়ে শুরু করলো,
'দেখো প্রথম থেকে বলি অংশুমালী অর্থ সূর্য। সূর্যের প্রখরতা বুঝিয়েছে। অনন্বয় উচ্চহাস্য মানে অসংলগ্ন জোরে হাসি। অম্ভোদ অর্থ মেঘ। আননে বলতে মুখ মানে চেহারা বুঝিয়েছে। মর্মদেশ অর্থাৎ মন। অন্তঃকরণ অর্থ হৃদয়। স্পর্শানুভূতি অনুধ্যায় মানে হলো অনূভূতি নিয়ে ভেবে দেখা। মুখ নিঃসৃত বোল মানে হলো কথা। উর্ণনাভ অর্থ মাকরসা....'
তুতুল বিস্ফোরিত চোখে বলল, 'কি...আমাকে মাকরসা বলেছে?'
'আরে না, মাকরসার জাল প্রতীকী শব্দে বুঝিয়েছে। আচ্ছা এবার শুনো, স্পর্শেন্দ্রি অর্থ অনুভূতি। অম্বু অর্থ পানি। মাতঙ্গ অর্থ হাতি, সহস্যদল সদৃশ শুভ্র মানে পদ্ম ফুলের মতো পবিত্র। আর সত্তয়াল মানে প্রশ্ন......
তুতুল আয়াশকে মাঝপথে থামিয়ে বলল,
'কি বলতাছোস? আগামাথা কিচ্ছু বুঝতাছি না। একটা কাজ কর তোর সব শব্দের অর্থ বলা লাগবে না। তুই সহজ ভাষায় বল চিঠিতে কি বুঝিয়েছে।'
'তুমি কি মেয়েটাকে কোনো প্রশ্ন করেছিলে তুতুল ভাই?'
তুতুল কিছুক্ষণ ভেবে শান্তার সাথে শেষ কথোপকথোনের কথা মনে করে বলল,
'হ্যাঁ করেছিলাম। তো!'
আয়াশ মুচকি হেসে বলল,
'মেয়েটা তোমার প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলেছে।'
তুতুল অন্যমনষ্ক ভাবে বলল,
'ও...তারপর।'
হঠাৎ হুঁশ হলো তুতুলের। বুকের মধ্যে একধরনের শিরশিরে অনুভূতি বইতে লাগলো। আবারো জিজ্ঞাসা করলো, 'হ্যাঁ বলেছে?'
'হুম।'
'সত্যি?'
'আরে হ্যাঁ, সত্যিই।'
মনের আন্দোলিত মৃদু সুরেলা দোলা তুতুলের চেহারায় তার প্রতিবিম্ব তুলে ধরলো। আয়াশ তুতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
'তুতুল ভাই, তুমি তো দেখি লজ্জা পাচ্ছো!'
তুতুল অস্বীকার করে বলল,
'কই!'
হাতের সাদা কাগজে লেখা চিঠিটি আরেকটু নিজের সাথে চেঁপে ধরে আয়াশের থেকে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল তুতুল। আড়ালে মুখ নিয়ে ঠোঁট চেঁপে হাসতে লাগলো। ছোটো ভাইয়ের সামনে তার সত্যিই খুব লজ্জা লাগছে। সাথে আছে এক অপ্রকাশিত ভালো লাগা অনুভূতিও।
__________________________________________
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে শান্তা একবার ভ্রু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকালো। নীল প্রশস্ত আকাশের আনাচে কানাচে এখন কৃষ্ণকায় মেঘের আধিপত্য। থেমে থেমে একধরনের শীতল হাওয়া বইছে। রাস্তার ধুলোগুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে একটু আধটু উড়ে বেড়াচ্ছে। আনমনে হেসে উঠে শান্তা ভাবলো, আজ বৃষ্টি হলে কোনো অসুবিধা নেই। বাসা থেকে সে ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে। বেশিরভাগই সে যখন ছাতা নিয়ে বের হয় সেদিন বৃষ্টি আসে না। আর যেদিন ছাতা আনবে না সেদিনই ঝুম বৃষ্টি। আজ হয়তো এতোদিনের হিসেবের বিপরীত হতে চলেছে।
ঠোঁট চেঁপে ব্যাগে ছাতার উপস্থিত দেখার জন্য শান্তা একবার ব্যাগের চেইন খুললো।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবত শান্তার গতিবিধি পরখ করছে তুতুল। ক্যান্টিনের সামনের এক প্রকান্ড গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে। শান্তার উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেঁপে রাখার দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে অস্বাভাবিক ঢিপ ঢিপ শব্দ হতে লাগলো তুতুলের। কি সুন্দর করেই না মেয়েটা কিউট চেহারা করে ব্যাগের মধ্যে কি যেন খুঁজে যাচ্ছে। বেপরোয়া বাতাসও দেখো কেমন করে এলোমেলো করার নেশায় মত্ত হয়ে বিনা অনুমতিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার কালো ঘন চুল। তার মোলায়েম সরু হাত বারবার এপাশ ওপাশ করে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সেই নগন্য ব্যাগটিকে। তুতুলের মনে হলো এই মুহুর্তে সে সার্থক হতো, যদি সে হতে পারতো শান্তার কাঁধের সেই তুচ্ছ ব্যাগ অথবা প্রকৃতির অদম্য সেই বেপরোয়া হাওয়া।
হুট করেই শান্তার কাঁধ থেকে ফসকে মাটিতে পড়ে গেল ব্যাগটি। ব্যাগ থেকে সব জিনিস ছিটকে পড়লো রাস্তার মাঝে। তুতুল মুখ দিয়ে একটা আফসোসের শব্দ করে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলো সেখানে। হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ে শান্তার সাথে ব্যাগে সব কিছু পুনরায় ঢুকানোর জন্য হাত লাগালো। একটি পুরুষালী পারফিউমের গন্ধ হঠাৎ এসে ধাক্কা খেলো শান্তার নাকে। একবার আড়চোখে সামনের মানুষটিকে দেখে শান্তা থমকে গেলো। মুহুর্তের মধ্যেই যেন অসাড় হয়ে পড়লো হাত পা। কি করে শ্বাস নিতে হয় তা যেন হঠাৎ করেই ভুলে গেছে সে। হৃদপিন্ড যেন গুলিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম। কি মুশকিল! যে মানুষটিকে দেখার জন্য এতক্ষণ ধরে ছটফট করছিলো। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে যাচ্ছিল তাকে। এখন হঠাৎ করেই সে সামনে আসতে এতোটা অস্থির লাগছে কেন? তুতুল একটা একটা করে বই,খাতা, কলম আরো অন্যান্য জিনিস ব্যাগে তুলে দিতে লাগলো। শান্তাও চুপচাপ তাই করছে। ব্যাগের জিনিস তুলে দেওয়ার সময় তুতুল একবারো শান্তার দিকে তাকালো না। মাথা নিচু করে দায়িত্ব সহাকারে শুধু কাজেই মনোনিবেশ করলো। ব্যাগে সব ভরা হয়ে গেলে শান্তা উঠে দাঁড়ালো। আড়চোখে একবার তুতুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো তুতুল একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শান্তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কোথা থেকে যেনো একরাশ আড়ষ্টতা এসে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কানে অবাধ্য চুলগুলোকে গুঁজে দিয়ে আরেকবার খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে পাশে তুতুলকে দেখে শান্তা। ছেলেটা এখনও কেমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে পড়ে। শান্তা দ্রুত তার ছাতা খুলে মাথা আড়াল করে নেয় আকাশের অদম্য বর্ষণ হতে। ইশ! বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটা এখনো তাকিয়ে আছে। কি এমন দেখছে বেহায়ার মতো! বৃষ্টি নেমেছে সেদিকে কি তার খেয়াল আছে! শান্তা ভেবে পায় না। ব্যাগে সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। বৃষ্টি এসে পড়েছে। ছাতা খোলাও হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই শান্তার পা বাড়িয়ে চলে যাওয়া উচিত। মাঝ রাস্তায় শুধু শুধু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার নিশ্চয়ই কোনো মানে হয় না। কিন্তু এই বেমানান কাজটিই শান্তা করছে৷ কেন? শান্তার অবচেতন মন কি চায় যে পাশের মানুষটি শুধু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে না থেকে আরো কিছু বলুক। অন্তত নাম ধরেই বা ডাকুক। আরো কিছুক্ষণ উসখুস করে শান্তা কোনো সাড়া না পেয়ে মুখ ফুলিয়ে সামনে পা বাড়ায়। তুতুল খপ করে শান্তার হাত ধরে বসে। একধরণের শীতল শিরশিরে শিহরণ মুহুর্তের মধ্যে বয়ে যায় শান্তার শরীরে। শ্বাসপ্রশ্বাস যেন থমকে যায় গলায়। তুতুলের কোনো হুঁশ নেই। সে থমকে আছে সামনের মানুষটির রচিত মায়ায়। এতক্ষণে দেখতে থাকা মায়াপরীকে অবলোকনে হঠাৎ বাঁধা পড়লো বলেই সে অজান্তেই ধরে বসে শান্তার হাত। হঠাৎ করেই সে সম্বিত ফিরে পায়। নিজের কৃতকর্ম চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই দ্রুত ছেড়ে দেয় শান্তার হাত। তুতুলের হাত থেকে ছাড়া পেতেই শান্তা দ্রুত চলে যায়। হাত দিয়ে মাথার ভেজা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে ভীষণ অপ্রতিভ হয়ে ওঠে তুতুল। না জানি শান্তা কি ভাবছে! নিশ্চয়ই খুব খারাপ ছেলে মনে করছে তাকে। মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে তুতুল। কাঁচুমাচু করে সামনে তাকিয়ে হঠাৎ দেখে শান্তা তার কয়েক কদম এগিয়েই থেমে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখলো থমকে দাঁড়িয়ে থেকেই শান্তা তার ছাতা মাথার উপর থেকে সরিয়ে একটু সাইডে নিয়ে রাখলো। ইশারায় আরেকজনের জায়গা করে দিলো নিজের পাশে। তুতুল হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসে দ্রুত দৌঁড়ে যায় শান্তার খালি করে দেওয়া জায়গা দখল করতে। শান্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে শান্তার দিকে তাকিয়ে একটা ফিচেল হাসি দেয় তুতুল। অজস্য বারিধারাকে কেন্দ্র করে এই অবাধ্য ছেলের বেহায়া দৃষ্টি থেকে একইসঙ্গে বাঁচতে আর থাকতে শান্তা তার মাথা নত করে মনের লাজুক হাসিটি লুকায়।
__________________________________________
রাত নিঝুম। ঘড়ির কাটা এক এর সংখ্যা এই ছুঁলো বলে! হোস্টেলের প্রত্যেকটা মেয়ে এখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে মুখ থেকে চাদর সরিয়ে উঠে বসে। ঘুম আজ কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না তাকে। রাত গভীর, চোখে ঘুম নেই অথচ ঘুমের জন্য শুয়ে থাকার মতো অসহ্যকর ব্যাপার হয়তো পৃথিবীতে আর দুটো নেই। না! আর চেষ্টা করে লাভ নেই৷ ঘুম মনে হয় না আর আসবে। এই গভীর রাতে এখন আর কিই বা করবে প্রত্যাশা। শুধু শুধু বসে থাকতেও তো ভালো লাগে না। প্রত্যাশা একবার করুণ মুখে তার দু পাশের দুটো বিছানার দিকে তাকায়। কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে স্বর্ণা আর মৌরি। বান্ধবীদের ঘুম দেখে প্রত্যাশার হিংসে হয়। ও নিজে নির্ঘুম হয়ে জেগে থাকবে আর বদমাইশ বন্ধুগুলা নাক ডেকে ঘুমাবে! প্রশ্নই উঠে না। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টিয়ে স্বর্ণার বিছানায় গিয়ে ডাকে, 'দোস্ত উঠ। আর ঘুমায় না। এতো ঘুমিয়ে কি করবি, স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে।' স্বর্ণা কিছুক্ষণ আড়মোড়া দিয়ে হুম হুম করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এবার প্রত্যাশা যায় মৌরির কাছে। একইভাবে ডাকতে থাকে তাকে।
'মৌরি, আমার লক্ষ্মী বান্ধুপি! উঠ না একটু। আমার একটুও ঘুম আসছে না। তুই না আমার ভালো বন্ধু। এক বন্ধুকে রেখে আরেক বন্ধু কি ঘুমাতে পারে!'
মৌরিরও স্বর্ণার মতো একই অবস্থা। ঘুমের চোখে সে থেমে থেমে বলে,
'আরেকটু ঘুমাই। সকাল হলেই উঠবো। তুই ঘুমিয়ে পড়.....ঘুমিয়ে প...
প্রত্যাশা এবার একটু থামে। পরক্ষণে জোরে চিৎকার দেয়। বলে, 'স্বর্ণা মৌরি, ঐ দেখ একটা হ্যান্ডসাম ছেলে এসেছে।'
স্বর্ণা আর মৌরি ধড়ফড়িয়ে উঠে। দুজনে একসাথে দ্রুত প্রত্যাশার কাছে এসে সমস্বরে জিজ্ঞাসা করে, 'হ্যান্ডসাম ছেলে! কই? কই?'
প্রত্যাশা সরু চোখে দুজনের দিকে তাকায়। দুজনের গায়ে সাদা লং নাইট গাউন। মুখে নাইট ক্রিমের পুরু স্তর। চুলগুলো এলোমেলো উসকোখুসকো হয়ে আছে।
'ফ্রেন্ডের কথা শুনে উঠলি না। হ্যান্ডসাম ছেলের কথা শুনতেই বান্দরের মতো লাফিয়ে উঠে পড়লি! বান্দরনিরা!'
স্বর্ণা আর মৌরি হাই তুলে একবার আশেপাশে দেখে। আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে, 'হ্যান্তসাম ছেলে আসে নাই! ধুর! কি ঘুম আসছিলো।'
স্বর্ণা আর মৌরি পুনরায় ঘুমিয়ে পরার আগেই প্রত্যাশ দুজনের হাত টেনে উঠিয়ে বসায়। দুজনকে দুটো ঝাঁকি দিয়ে বলে,
'প্রথমেই ফ্রেন্ড আর হ্যান্ডসাম ছেলের কম্প্যারিসনে হ্যান্ডসাম ছেলের পাল্লা ভারি করছোস। এখন আবার ফ্রেন্ডকে রেখে ঘুমাতে যাস! তোদের দুজনের সাথে কিন্তু আমি ব্রেকআপ করবো। শালী হারামি!'
মৌরি আবারো হাই তুলে গাল হাত রেখে বলে,
'আচ্ছা যা! ঘুমাবো না। এখন কি করবি? গল্প শুনবি? আমার লাস্ট ক্রাশ খাওয়ার গল্পটা কি বলবো?'
স্বর্ণা চোখ বন্ধ করে ঘুম ঘুম চোখে বলে,
'তোর লাস্ট ক্রাশ খাওয়ার গল্প তো আর বলবি না। লাস্ট তো একটা শার্ট প্যান্ট পড়া বুইড়া ব্যাটারে পেছন থেকে দেখে ক্রাশ খাইছিলি। পড়ে সামনে গিয়ে দেখছোস আসল ঘটনা। কি মনে করছোস আমি জানি না। এখন বল, বলবি ঐটা? ঐটা তো আর বলবি না। ঐটা তো ঠিকই সুযোগমতো স্কিপ কইরা দিছোস।'
মৌরি রাগান্বিত হয়ে বলে, 'এখন তোর লাস্ট ব্রেকআপের ঘটনা বলি? তুই যে অনলাইনে তিন মাস প্রেম কইরা জানতে পারছোস একটা তিন ছেলেমেয়ে আলা বিবাহিত ছেলের সাথে এতদিন প্রেম করছোস৷ তাও আবার বরিশাইল্লা রিকশা আলা। ফেক আইডির কথা জানতে পাইরা যে ব্রেকআপ কইরা দিছো ঐটার গল্প আমি বলবো?'
স্বর্ণা ক্ষেপে উঠে বলে, 'তুই আমার পেছনে খবরদারি করোস?'
'আর তুই যে করোস! তার বেলা!'
প্রত্যাশা চেঁচিয়ে উঠে বলে, 'আহ! তোরা থামবি। তোদের দুজনকে কি ঝগড়া করে আমার মাথা ধরাবার জন্য ঘুম থেকে উঠিয়েছি।'
মৌরি বলল, 'সরি দোস্ত। বল এই মাঝরাতে এখন কি করবো?'
স্বর্ণা আবারো একটা হাই তুলে বলে, 'তাই তো। আয়াশকে তো আর এখন দেখতে পারবি না, ওদের বাসায় না যাওয়া ছাড়া।'
স্বর্ণা এমনিই কথার কথা বলেছিলো। কিন্তু
প্রত্যাশা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
'গুড আইডিয়া!'
স্বর্ণা মৌরি একসাথে চমকে উঠে বলল,
'কি?'
প্রত্যাশা বলল, 'আমরা এখন আয়াশের বাসায় যাবো।'
কথাটা বলে প্রত্যাশা বিছানার উপর দাঁড়িয়ে আনন্দিত হয়ে লাফাতে লাগলো। স্বর্ণা আর মৌরি একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের মুখেই করুণ দৃষ্টি। [
©somewhere in net ltd.