![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিবর্তনের জন্য দেশপ্রেমিক সুস্থ রাজনীতি প্রয়োজন।
ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা
বিভিন্ন ধরনের এসব অর্থনৈতিক সহায়তা ইসরাইলের জন্য আগের মতো এখনো গুরুত্বপূর্ণ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ সহায়তা এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যেই পরিচালিত। ইসরাইল শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক অস্ত্রই পায় না (এফ-১৫ এবং এফ-১৬ বিমান, ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার, ক্লাস্টার মিউনিটিয়নস, স্মার্ট বোমা ইত্যাদি), এর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ হয় বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিক চুক্তি ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের মতে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য ইসরাইলের সশস্ত্রবাহিনীকে বিশ্বের প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যাধুনিক একটা সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হয়েছে।’ এ ছাড়া ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতে, ইসরাইল ‘ব্যতিক্রমভাবে (সামরিক সহায়তা) তহবিল খরচের ব্যাপক সুবিধা ভোগ করে।’ ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি প্রায় সব কেনাকাটা দেখাশোনা এবং অন্য সব সামরিক সহায়তা লাভকারী দেশগুলোর জন্য মার্কিন সহায়তা পর্যবেক্ষণ করে। তবে ইসরাইল আসলে তার সব কেনা কাটার ক্ষেত্রে সরাসরি সামরিক ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সহায়তার হিসাব থেকে ওই অর্থ তুলে নেয়। ইসরাইল হলো একমাত্র দেশ যেখানে ৫ লাখ মার্কিন ডলারের কম চুক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে পূর্ব-পর্যালোচনার প্রয়োজন হয় না। উল্লেখিত আর্থিক ও সামরিক সহায়তা ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। এ অর্থ দেওয়া হয় বিভিন্ন অস্ত্র, যেমন লাভি বিমান, মারকেভা ট্যাঙ্ক ও অ্যারো ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়নের জন্য। এসব প্রকল্পে অর্থ দেওয়া হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের মাধ্যমে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই দেখানো হয় যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার জন্য ওই অর্থ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব অস্ত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই এবং নিজের ব্যবহারের জন্য তা কিনবে এমন কোনো উদ্দেশ্যও নেই। লাভি প্রকল্প পরে বাতিল করা হয় খরচের কথা বিবেচনা করে (প্রকল্প বাতিলের অধিকাংশ খরচও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহন করে)। কিন্তু অন্যান্য অস্ত্র ইসরাইলের অস্ত্রভান্ডারে জমা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৪ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে অ্যারো ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য ১৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের অনুরোধ অন্তর্ভুক্ত করা হয় – যেমন ৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয় ওই পদ্ধতির আরো উন্নয়নের জন্য এবং ৭ কোটি মার্কিন ডলারের অনুমোদন দেওয়া হয় অতিরিক্ত ইউনিট উৎপাদনের জন্য। এভাবে ওয়াশিংটন ইসরাইলের প্রতিরক্ষাশিল্পের উন্নয়ন বা এ ধরনের যৌথ অস্ত্র প্রকল্পে উৎপাদনের জন্য যে আর্থিক সহায়তা দেয় তা বাস্তবে অন্য এক ধরনের ভর্তুকি। ইসরাইলের ফার্মগুলো যে প্রযুক্তির উন্নয়ন করে তা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মাঝে উপকৃত হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত শিল্পে ওই অর্থ দেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি উপকৃত হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক আশির দশকে উন্নত করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েতবিরোধী ‘কৌশলগত ঐক্য’ গড়ে তুলতে রিগ্যান প্রশাসন ওই উদ্যোগ গ্রহণ করে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার ওয়েনবার্গার এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন ১৯৮১ সালে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তিতে ‘তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অব্যাহতভাবে আলোচনা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির কাঠামো’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ওই চুক্তির ফলে জয়েন্ট সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স প্ল্যানিং গ্রুপ এবং জয়েন্ট পলিটিক্যাল মিলিটারি গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। ইসরাইলের সহায়তার অনুরোধ পর্যালোচনা এবং সামরিক পরিকল্পনার সমন্বয়, যৌথ মহড়া ও সৈন্য চলাচলব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ওই দুটি গ্রুপ নিয়মিতভাবে বৈঠক করে। ইসরাইলি নেতারা যদিও আশা করেছিলেন, একটা আনুষ্ঠানিক মৈত্রীচুক্তি হবে কিন্তু তা শুধু কাঠামোগত চুক্তি হওয়ায় তারা আশাহত হন। তবু গোল্ডামেয়ার সম্পর্কে ১৯৬২ সালে কেনেডি ব্যক্তিগতভাবে যে মন্তব্য করেন তা মার্কিন অঙ্গীকার সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের বিবৃতির চেয়ে অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক ছিল।সৌদি আরবে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি, ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লির ওপর বোমাবর্ষণ, ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইল কর্তৃক গোলান উপত্যকা দখল, ১৯৮২ সালে ইসরাইলের লেবানন আক্রমণ এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরে ইসরাইল কর্তৃক শান্তির জন্য রিগ্যান পরিকল্পনা হঠাৎ করে প্রত্যাখ্যান – এসব একাধিক বিষয়ে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা ধীরে ধীরে রিগ্যান প্রশাসন আমলে আরো বৃদ্ধি পায়। যৌথ সামরিক মহড়া শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, আর ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিরক্ষা উদ্যোগে (স্টার যুদ্ধ) যে তিনটি বিদেশী দেশকে আহবান করা হয় তার মধ্যে ইসরাইল ছিল একটি। অবশেষে ১৯৮৮ সালে একটা সমঝোতা চুক্তিতে পুনরায় ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব’ নিশ্চিত করা হয় এবং অস্ট্রেলিয়া, মিসর, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ইসরাইলকে গণ্য করা হয় ‘প্রধান অ-ন্যাটো মিত্র’ হিসেবে। যেসব রাষ্ট্র এই মর্যাদা ভোগ করে তারা কম দামে বিভিন্ন ধরনের মার্কিন অস্ত্র কিনতে পারে, যুদ্ধোদ্বৃত্ত সামগ্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লাভ করতে পারে এবং যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগে অংশ নিতে পারে। এসব রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ফার্মগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষাচুক্তির সময় অগ্রাধিকার পায়। ১৯৮০-এর দশক থেকে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা যোগাযোগ আরো ব্যাপক হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে পূর্বপ্রস্ত্ততিমূলক সামরিক সরঞ্জাম মজুদ শুরু করে ১৯৮৯ সাল থেকে, আর কংগ্রেস মোটামুটি ১০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের মজুদ বৃদ্ধি করার পক্ষে ২০০৬ সালে ভোট দেয়। আঞ্চলিক সংকটের সময় দ্রুত সক্রিয় হওয়ার জন্য পেন্টাগনের সামর্থ্য বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ওই নীতির যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু তবু ইসরাইলে পূর্বপ্রস্ত্ততিমূলক অস্ত্র সরবরাহ আসলে একটা দুর্বল পদক্ষেপ ছিল এবং পেন্টাগন এই নীতি সম্পর্কে কখনো উৎসাহ দেখায়নি। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যাফে ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের সাবেক প্রধান শাই ফেল্ডম্যানের মতে, বর্তমানে যে ব্যবস্থা আছে তা শুধু সরঞ্জাম মজুদ রাখার, যা জরুরিকালে ইসরাইলি বাহিনীও ব্যবহার করতে পারে। পেন্টাগন পরিকল্পনাকারীদের মতে, এর অর্থ হলো এই যে, ইসরাইলে মজুদ করা অস্ত্রশস্ত্র সংকটকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তা ছাড়া এই ‘দ্বিবিধ ব্যবহার’ ব্যবস্থার অর্থ হলো, পূর্বপ্রস্ত্ততিমূলক মার্কিন ইউনিটের মজুদ অস্ত্র ও গোলাবারুদের পরিবর্তে সংকটকালে সাধারণ মজুদ থেকে অস্ত্র বিতরণ করতে হবে এবং অতঃপর তা বিভিন্ন যুদ্ধ ইউনিটের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে এর ফলে নিয়মিত সরবরাহব্যবস্থায় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হবে যা দুঃস্বপ্নের মতো। অস্ত্র মজুদ কর্মসূচির আসল উদ্দেশ্য হলো ইসরাইলের অস্ত্র মজুদ বৃদ্ধি। এটা কোনো বিস্ময়কর বিষয় নয় যে, ইসরাইলি সংবাদপত্র ইদিওথ আহরোনোথের সঙ্গে সংযুক্ত ওয়েবনিউজ সার্ভিস ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে রিপোর্ট করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশস্ত্রের একটা বিরাট অংশ ইসরাইলে মজুদ করা আছে… তা (২০০৬ সালের) গ্রীষ্মকালে লেবানন যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়।আশির দশকে সৃষ্ট বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ১৯৯৬ সালে যৌথ সন্ত্রাসবাদবিরোধী ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত করে। ওই সময় তারা পেন্টাগন ও ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ইলেকট্রিক হটলাইন গঠন করে। ওই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার যোগাযোগ আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর ইসরাইলকে ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটভিত্তিক মিসাইল সতর্কীকরণব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। অতঃপর ২০০১ সালে উভয় রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলো আলোচনার জন্য বার্ষিক আন্তঃএজেন্সি কৌশলগত আলোচনা প্রতিষ্ঠিত করে। চীনের কাছে ইসরাইল আমেরিকান সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করার পর সৃষ্ট বিবাদের সময় আন্তঃএজেন্সি কৌশলগত আলোচনা ফোরাম সাময়িকভাবে অকার্যকর থাকে। তবে ২০০৫ সালে তা কার্যকর করা হয়। কেউ হয়তো আশা করতে পারেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার নিরাপত্তা সহযোগিতা গোয়েন্দা কার্যক্রমেও বিস্তৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে গোয়েন্দা সহযোগিতার কার্যক্রম শুরু হয় পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে। ১৯৮৫ সালে এ দুটি দেশ প্রায় দুই ডজন গোয়েন্দা সহযোগিতাব্যবস্থা সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষর করে বলে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইল দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং সোভিয়েত ব্লক থেকে আগত অভিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্ট দেখার সুযোগ করে দেয়। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে সংঘটিত যুদ্ধ এবং ১৯৭৬ সালের আগে অ্যান্টবি জিম্মি উদ্ধার কার্যক্রমের স্যাটেলাইট ছবি ইসরাইলকে দেখানোর সুযোগ করে দেয়। এ ছাড়া আফ্রিকায় একাধিক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে আর্থিক সহায়তা দেয়। আশির দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে এমন কিছু গোয়েন্দা তৎপরতা কার্যক্রম দেখায় যা সে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ন্যাটোকে দেখাতেও অস্বীকার করে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, ইসরাইল অত্যাধুনিক কেএইচ-১১ সামরিক অভিযান স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সীমাহীন সুযোগ পায় (ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা প্রধানের মতে, শুধু তথ্য নয় চিত্রও)। অথচ ওই তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশদের সুযোগ খুবই সীমিত। ১৯৮১ সালে ইরাকের অসিরাক রিঅ্যাক্টরে আক্রমণ চালানোর পর ইসরাইলের জন্য ওই তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তবে প্রেসিডেন্ট (প্রথম) বুশ ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের স্কাড আক্রমণ সম্পর্কিত স্যাটেলাইট তথ্য ইসরাইলকে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের বিস্তারে বিরোধিতা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের বিভিন্ন গোপনীয় গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র কর্মসূচির মাধ্যমে আঞ্চলিক পর্যায়ে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়াসে নীরব থাকে – এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল দুশর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়ার প্রয়াস। মার্কিন সরকার ১৯৬৮ সালে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য বহু রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মার্কিন নেতৃবৃন্দ ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রায় কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। ষাটের দশকে কেনেডি প্রশাসন স্পষ্টভাবে ইসরাইলের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। ইসরাইল পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই দেশের ডিমোনায় অবস্থিত পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র পরিদর্শনে মার্কিন বিজ্ঞানীদের সুযোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে ইসরাইল অবশেষে রাজি হয়েছিল। ইসরাইল সরকার তার কোনো অস্ত্র কর্মসূচি নেই বলে পরিকল্পিত পরিদর্শন কর্মসূচি পিছিয়ে দেয়। পরিশেষে ওই পরিদর্শন কর্মসূচি যখন কার্যকর তখন ইসরাইল এককভাবে ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনের ওপর নানা বাধানিষেধ আরোপ করে। এভাবে প্রথম মার্কিন পরিদর্শন সংঘটিত হয় ১৯৬১ সালের ১৮ মে। এই পরিদর্শনে মাত্র দুজন মার্কিন বিজ্ঞানী যান, তাও মাত্র চার দিনের জন্য। এর মধ্যে একজন মাত্র ডিমোনা এলাকায় যাওয়ার সুযোগ পান। ওয়ারেন বাসের মতে, ‘ইসরাইলের কৌশল ছিল পরিদর্শনের জন্য অনুমতি দেওয়া … কিন্তু এটা নিশ্চিত করা যে, ইন্সপেক্টররা যেন কিছু দেখতে না পান।’ এক বছর পর ফিরতি পরিদর্শনের জন্য চাপ দেওয়া হলে ইসরাইল অপ্রত্যাশিতভাবে মার্কিন আণবিক শক্তি কমিশন কম©©কর্তাদের আহবান করে এবং অনির্ধারিতভাবে ডিমোনা পরিদর্শনসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনের সুযোগ দেয়। বাস উল্লেখ করেন, এই পরিদর্শনকে পরিদর্শন নামে অভিহিত করা যায় না। তবে কেনেডি প্রশাসন এ নিয়ে বিরোধে জড়াতে চায়নি বলে মনে হয়।পরবর্তী বছরে কেনেডি ওই চাপ আরো বাড়ান। তেনি বেনগুরিয়ন এবং তার উত্তরসূরি লেভি এশকল উভয়ের কাছে একাধিক চিঠি পাঠান। ওইসব চিঠিতে বছরে দুবার পরিদর্শনের তিনি দাবি করেন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এবং সতর্ক করে দেওয়া হয়, ইসরাইলের পারমাণবিক উচ্চাশা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বেগ নিরসনে ব্যর্থ হলে ইসরাইলকে সমর্থন করার জন্য এ সরকারের অঙ্গীকার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। কেনেডির ওই হুমকিতে ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ অতিরিক্ত সফরের অনুমতি দেয়। তবে ওই সুবিধা দেওয়ার অর্থ তাদের কথা মেনে নেওয়া ছিল না। ১৯৬৩ সালের জুলাইয়ে কেনেডির রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সংবাদ পেয়ে এশকল তার সহকর্মীকে বলেন, আমি কীসের জন্য ভীত হচ্ছি? তার লোকটা আসবে এবং তাকে এলে বলা হবে যে, তিনি (ডিমোনা এলাকা) পরিদর্শন করতে এবং যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন কোনো স্থানে দরজা খোলার কথা বলবেন তখন (ডিমোনা নির্মাণকাজের প্রধান) [ইমানুয়েল] প্রাট তাকে বলবেন, ‘ওটা নয়।’ অন্যান্য স্থান পরিদর্শনকালে ইন্সপেক্টরদের বাইরে থেকে যন্ত্রপাতি ভেতরে নিয়ে যেতে বা ভেতর থেকে কোনো নমুনা বাইরে নিয়ে আসতে দেওয়া হয়নি। ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গোপনে অস্ত্র বিস্তারকারীদের সবার নির্ধারিত মানদন্ডের কৌশল হলো অস্পষ্টতার অংশবিশেষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জেরুসালেমের পারমাণবিক পরিকল্পনা সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। কিন্তু ইসরাইলের প্রতারণা কার্যকর হয়। কারণ কেনেডি বা তার উত্তরসূরি লিন্ডন বি. জনসন ইসরাইল নমনীয় না হলেও মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহারে সম্মত ছিলেন না। এর ফলে অভনার কোহেন তার ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তারিত ইতিহাসে লেখেন, ইসরাইলিরা (মার্কিনিদের) সফরের নিয়মনীতি নির্ধারণে সক্ষম ছিল এবং জনসন প্রশাসন এ বিষয়ে ইসরাইলের মুখোমুখি হতে চায়নি। কারণ তাদের ভয় ছিল, ইসরাইল সব ব্যবস্থার সমাপ্তি টেনে দেবে… বেনগুরিয়ন ও (লেভি) এশকল উভয়কে কেনেডি হুমকি দিয়েছিলেন যে… মানা না হলে তা ইসরাইলের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য মার্কিন অঙ্গীকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে মার্কিন ইসরাইল সম্পর্কের সংকটের ঝুঁকি নিতে জনসন ইচ্ছুক ছিলেন না। বাস লেখেন, ছয় মাস পর পর পরিদর্শনের পরিবর্তে বাস্তবে জনসন বছরে একবার বা এমনইভাবে দ্রুত পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেমস ১৯৬৮ সালে জনসনকে জানানোর জন্য হোয়াইট হাউসে আসেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, ইসরাইল আসলে পারমাণবিক সামর্থ্য অর্জন করেছে। জনসন তাকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডিন রাস্ক এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারাসহ আর কেউ তাকে এ কথা বলেননি বা কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। সাংবাদিক সিমুর হার্শের মতে, হেমস ও তার গোয়েন্দাদের বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়ার কারণ স্পষ্ট। তিনি সিআইএ’র কথা শুনতে চাচ্ছিলেন না। কারণ ওই বক্তব্য গ্রহণ করা হলে সেই অনুযায়ী তাকে কাজ করতে হবে। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের পারমাণবিক বোমা উদ্যোগ বন্ধ করার জন্য কোনো কিছু করার ইচ্ছা প্রেসিডেন্টের ছিল না।পারমাণবিক অস্ত্রাগার ছাড়াও ইসরাইল কার্যকর রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচি অব্যাহত রাখে এবং তখনো তারা রাসায়নিক বা জীবা্রু১ণু অস্ত্র চুক্তি অনুমোদন করেনি। মারাত্মক এ বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরে চাপ দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণে অস্বীকৃতির জন্য এমন অনেক রাষ্ট্রের ওপর অবরোধ আরোপ করে যারা কোনোভাবে পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করে, গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র পাওয়া থেকে ইরাককে বিরত রাখার জন্য ২০০৩ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং একই কারণে ইরান ও উত্তর কোরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তবু ওয়াশিংটন তার মিত্রকে দীর্ঘদিন ধরে ছাড় দিয়ে আসছে যার গোপন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র কার্যাবলি সবার কাছেই বিদিত ছিল। শুধু তাই নয়, তার ওই মিত্রের পারমাণবিক অস্ত্রাগার প্রতিবেশী অনেক দেশকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র জোগাড়ে দৃঢ়ভাবে উৎসাহিত করে।কিউবার জন্য সোভিয়েত সমর্থনের আংশিক ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টান্তের কথা চিন্তাও করা যায় না যেখানে একটা দেশ অন্য দেশকে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে একই ধরনের বস্ত্তগত সহায়তা দিয়েছে। ইসরাইলকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন আগ্রহ নিশ্চিতভাবে বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন নেতারা ইসরাইলের অস্তিত্বের অনুকূলে ছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারা একটা শত্রুভাবাপন্ন পরিস্থিতির হুমকির মোকাবিলা করছে। মার্কিন নেতারা আরো বুঝতে পারেন, ইসরাইলকে সহায়তা করার অর্থ ব্যাপক ধরনের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের পরিমাণ সত্যি উল্লেখযোগ্য। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, মার্কিন সামরিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইসরাইল তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে শক্তিশালী ছিল। ইসরাইল বর্তমানে একটা সমৃদ্ধ দেশ। ইসরাইলের জন্য মার্কিন সহায়তার প্রয়োজন ছিল নিঃসন্দেহে তবে তা তার অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল না।ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একক বৈশিষ্ট্য হলো ক্রমাগতভাবে এর শর্তমুক্তবৈশিষ্ট্য। প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার সুয়েজ যুদ্ধের পর বিশ্বাসযোগ্যভাবে সাহায্য বন্ধের হুমকি দিতে পারতেন (এ কাজ করার সময় তাকে অবশ্য কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হয়), কিন্তু সেসব অতীতের কথা। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইসরাইল উদারভাবে সহায়তা পেতে থাকে যদিও তার কার্যকলাপের প্রতি মার্কিন নেতাদের চিন্তা বিবেচনাপ্রসূত ছিল না ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীত ছিল। পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি এবং এর বিভিন্ন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র কর্মসূচি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল সহায়তা পেতে থাকে। অধিকৃত অঞ্চলে বসতি নির্মাণ করার সময় সে সাহায্য পায় (এ জন্য তার ঋণ নিশ্চয়তার সামান্য অর্থ হ্রাস পায়) মার্কিন সরকার অবশ্য এই নীতির বিরোধিতা করেছিল। দখলকৃত এলাকা নিজেদের সীমানাভুক্ত করার সময়ও (একইভাবে সে এ কাজ করেছিল গোলান উপত্যকা ও জেরুসালেমে) সে সাহায্য পায়। চীনের মতো সম্ভাব্য শত্রুর কাছে মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা অথবা মার্কিন আইন লঙ্ঘিত হয় এমনভাবে মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার করার সময়ও (যেমন লেবাননে অসামরিক এলাকায় গুচ্ছ যুদ্ধোপকরণ ব্যবহার) সে সাহায্য লাভ করে। শান্তির জন্য যখন সে ছাড় দেয় তখন সে অতিরিক্ত সহায়তা পায়। কিন্তু তার কাজে শান্তি যখন অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন সে মার্কিন সমর্থন পেতে প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কাছে ইসরাইলি নেতাদের প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করলেও তারা সাহায্য পায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে মেনাহেম বেগিন প্রতিজ্ঞা করেন, ১৯৮১ সালে সৌদি আরবের কাছে প্রস্তাবিত এডব্লিউএসিএস বিমান বিক্রি করার সময় তিনি এর বিরুদ্ধে লবি করবেন না। কিন্তু এরপর বেগিন ক্যাপিটাল হিল পর্যন্ত যান এবং সিনেট প্যানেলকে বলেন, তিনি ওই চুক্তির বিরোধিতা করেন। কেউ হয়তো চিন্তা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারতা ইসরাইলের আচরণের চেয়ে ওয়াশিংটনকে বিশেষ সুবিধা দেবে এটা আসল ঘটনা নয়। আসলে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা সাধারণত সহযোগিতা চান শুধু অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া কথা বলে হুমকি বা সহায়তা বন্ধ করার কথা বলে নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ইসরাইলি মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ প্রস্তাব ২৩২ প্রকাশ্যে সমর্থন করে। ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাস। ওই প্রস্তাবে ছয় দিনের যুদ্ধে অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানানো হয়। ইসরাইল ওই প্রস্তাব অনুমোদন করে সে অতিরিক্ত মার্কিন বিমান পাবে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর। এছাড়া মিসরের সঙ্গে তথাকথিত আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধসম্পর্কিত সন্ধি চুক্তি ইসরাইল গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে বিমান সরবরাহ ত্বরান্বিত, মিসরে সোভিয়েত কর্তৃক সরবরাহকৃত বিমান বিধ্বংসী মিসাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উন্নত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রদান এবং ‘ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা’ করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গীকারের পর। শিমন পেরেজের মতে, (ওই সময় কার্যভার ছাড়া মন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন) ‘আমাদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসূচি গ্রহণের চাপ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে, তারা অতিরিক্ত সহায়তা দিয়ে আমাদের রাজি করায়, সহায়তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে নয়। কোনো ঘটনাতেই অবরোধের কথা বলে তারা আমাদের কখনো হুমকি দেয়নি।’এই প্রক্রিয়া চলে পুরো সত্তর দশক ধরে। নিক্সন, ফোর্ড ও কার্টার এই তিন প্রেসিডেন্টই মিশরের সঙ্গে সংঘাত বিচ্ছিন্নকরণ আলোচনার সময় (যার ফলে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং ১৯৭৯ সালের মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়) বেশি পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্দিষ্টভাবে ইসরাইলে মার্কিন সাহায্য বৃদ্ধি পায় ১৯৭৫ সালের ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ১৯৭৬ সালে ৬২৯ কোটি মার্কিন ডলারে (দ্বিতীয় সিনাই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর) এবং ১৯৭৮ সালের ৪৪০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ১৯৭৯ সালে ১০৯০ কোটি মার্কিন ডলারে (মিশরের সঙ্গে চূড়ান্ত শান্তি চুক্তির পর)। এছাড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি করাবার জন্য মার্কি যুক্তরাষ্ট্রের আরো একাধিক সাহায্যের অঙ্গীকার করে। একইভাবে ক্লিনটন প্রশাসন ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে শান্তি চুক্তির সময় ইসরাইলকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান করে। ক্লিনটন উদ্যোগ গ্রহণ করেন অসলো শান্তি প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এজন্য তিনি ইসরাইলকে অতিরিক্ত ১২০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেন এ জন্য যে, ইসরাইল যেন ১৯৯৮ সালের উই-ই (Wye) চুক্তি গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু উই-ই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই তা বাতিল করে দেন, দুই জন ইসরাইলি নাগরিক ও ফিলিস্তিনি জনতার মধ্যে এক প্রচন্ড সংঘর্ষ সংঘটিত হওয়ার পর। মার্কিন মধ্যস্থতাকারী ডেনিস রাসের মতে, ‘এ সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাওয়া কষ্টকর যে, বিবি (নেতানিয়াহু)… এ ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন এড়িয়ে যান। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, ফিলিস্তিনিরা উই-ই চুক্তির অধীন সব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অত্যন্ত আগ্রহী ছিল, নির্দিষ্টভাবে যেসব এলাকায় গ্রেফতার ও যুদ্ধের ভীতি ছিল।’ এতদসত্ত্বেও ইসরাইলি পন্ডিত আবরাহাম বেন জবি বলেন, ‘নেতানিয়াহুর কার্যধারায় ক্লিনটন প্রশাসন হতাশ হলেও তা এমন কোনো নীতিতে পরিণত হয়নি যা আমেরিকান-ইসরাইল বিশেষ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’বস্ত্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সুযোগের ব্যবহার প্রায় কখনো উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হয়নি, এমনকি ইসরাইলের কাজে মার্কিন কর্মকর্তারা হতাশ হওয়া সত্ত্বেও। প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৫ সালে মিশরের সঙ্গে বিরোধমুক্তের আলোচনার সময় ইসরাইলের অনমনীয় মনোভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ওই সময় তারা ইসরাইলকে সাহায্য প্রদান হ্রাস এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দীর্ঘমেয়াদীভাবে পুনর্মূল্যায়নের হুমকি দেন। কিন্তু তাদের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায় যখন আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির উদ্যোগে ৭৬ জন সিনেটর এক চিঠিতে স্বাক্ষর করেন এই দাবি করে যে, ফোর্ড যেন ইসরাইলের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনের বিষয়ে ‘দায়িত্বশীল’ থাকেন। মার্কিন সহায়তা হ্রাসের জন্য তাদের প্রয়াস বন্ধ হয়ে যায়। ফোর্ড ও কিসিঞ্জারের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারা ‘দ্বারে দ্বারে’ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করেন এবং অতিরিক্ত সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে তাদের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করেন।প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও একইভাবে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পুরো মেয়াদ বাস্তবায়নে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিনের ব্যর্থতার জন্য হতাশ হন (ওই চুক্তি ছিল মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে পরবর্তী সব চুক্তির কাঠামো সৃষ্টির প্রাথমিক প্রয়াস)। কিন্তু তিনি ইসরাইলকে প্রদত্ত সহায়তার সঙ্গে তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা মেনে নেওয়ার চেষ্টা কখনো করেননি। ক্লিনটন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও বারাক অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষরিত সব অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না করায় একইভাবে হতাশ হন। জেরুজালেমের তিনটি গ্রাম ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার অঙ্গীকার পালন না করায় বারাকের ওপর ক্লিনটন খুবই ‘ক্ষুব্ধ’ হন বলে জানা যায়। তিনি বলেন, অন্য এক বিদেশী নেতা ইয়াসির আরাফাতের কাছে বারাক তাকে ‘মিথ্যা অবতার’ বানিয়েছিল। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি থেকে ২০০০ সালে সরে আসার চেষ্টা করার জন্য বারাকের ওপর ক্লিনটন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘চুক্তি কাটছাঁট অবস্থায় আমি আরাফাতের সঙ্গে দেখা করতে পারি না। আপনি এটা করতে পারেন, আমি এটা করতে পারি না কোনোভাবেই। এটা ঠিক নয়, এটা মোটেও হালকা বিষয় নয়।’ তবু ক্লিনটন সহায়তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। এটা ঠিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মাঝে সাময়িকভাবে সাহায্য বন্ধ করেছে। কিন্তু তা ছিল সাধারণত প্রতীকী এবং অল্প কিছুদিনের জন্য। এ ধরনের কার্য ব্যবস্থায় ইসরাইলের আচরণের ওপর স্থায়ী প্রভাব পড়েনি। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৭ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে হস্তক্ষেপ করার জন্য মার্কিন সৈন্য বহনকারী সাঁজোয়া গাড়ি ব্যবহার এবং পরে তা অস্বীকার করেছিল (এর সঙ্গে অস্ত্র রফতানি নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘিত হয় এ কারণে, ওই আইন অনুযায়ী মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে শুধু ‘বৈধ আত্মরক্ষার্থে’। এছাড়া ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রথমে আলোচনা ছাড়া লেবাননে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিন তার ওই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন)। অত্যাধুনিক গোয়েন্দা তথ্যে ইসরাইলের ওই প্রতারণা ধরা পড়ে। কার্টার প্রশাসন তখন ভবিষ্যতে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ বাতিলের হুমকি দেয়। বেগিন অবশ্য নিয়োজিত সরঞ্জাম প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। একই ধরনের অন্য একটি দৃষ্টান্ত হলো- রিগান প্রশাসনের ১৯৮১ সালের কৌশলগত সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক সাময়িকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইসরাইল কর্তৃক অন্যায়ভাবে গোলান উপত্যকা অধিকার করার পর। কিন্তু পরে রিগান ওই চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন করলেও ইসরাইল ওই দখল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেনি। ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমণের সময় আগের সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে গুচ্ছ যুদ্ধোপকরণ ব্যবহার করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই যুদ্ধোপকরণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালে তা আবার সরবরাহ করতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে আক্রমণ করার পর পিএলও’র যেসব সৈন্য বৈরুতে আশ্রয় নেয় তাদের ওপর পুরোপুরি আক্রমণ না চালাবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ওই ধরনের আক্রমণ চালাতে ইসরাইলি নেতারাও অনিচ্ছুক ছিল এবং এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হয়নি।প্রথম বুশ প্রশাসন ১৯৯৯ সালে শামির সরকারকে ইহুদি বসতি স্থাপনের নির্মাণ কাজ বন্ধ এবং পরিকল্পিত শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চাপ দেয়। এজন্য তারা ১০০০ কোটি ডলারের ঋণ গ্যারান্টি বন্ধ রাখে। কিন্তু ওই সাময়িক বন্ধ মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয় এবং ওই গ্যারান্টি শামিরের পর আইজ্যাক রবিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর পুনরায় অনুমোদন করা হয়। ইসরাইল নতুন বসতি এলাকায় নির্মাণ কাজ বন্ধে সম্মত হয়। কিন্তু বর্তমান ব্লক বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রাখে। অধিকৃত এলাকায় বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১৯৯১ সালে ৮ হাজার (শতকরা ১৪.৭ ভাগ), ১৯৯৩ সালে ৬ হাজার ৯শ’ (শতকরা ১০.৩ ভাগ), ১৯৯৪ সালে ৬ হাজার ৯শ’ (শতকরা ৯.৭ ভাগ) এবং ১৯৯৬ সালে ৭ হাজার ৩শ’ (শতকরা ৯.১ ভাগ)। ওই সময়ে বসতি স্থাপনের ওই হার ইসরাইলের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি।একই ধরনের ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালে। ওই সময় দ্বিতীয় বুশ প্রশাসন পশ্চিম তীরে ইসরাইলের ‘নিরাপত্তা দেওয়ালের’ বিরুদ্ধে আপত্তি জানায় এবং ইসরাইলে মার্কিন ঋণ গ্যারান্টি কিছুটা হ্রাস করে। পুরো গ্যারান্টি বন্ধ বা সরাসরি বিদেশী সহায়তা হ্রাস করা হলে তার একটা ফল পাওয়া যেত। কিন্তু বুশ শুধু ঋণ গ্যারান্টির একটা অংশ বন্ধ রাখে। ওই দেওয়ালের যে অংশবিশেষ প্যালেস্টাইন ভূমিতে প্রবেশ করেছে তার সমপরিমাণ ছিল ওই ঋণ গ্যারান্টি। ইসরাইলকে তার ঋণের একটা সামান্য অংশের ওপর বেশি হারে সুদ দিতে হয়, এই দন্ডের পরিমাণ ছিল কয়েক লাখ ডলার। ইসরাইলের পাওয়া কোটি কোটি ডলার মার্কিন সাহায্যের (এবং ভবিষ্যতে আরো পাওয়ার আশা আছে) তুলনায় ওই দন্ড ছিল খুবই সামান্য। এটা ইসরাইলের আচরণে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে আসেনি।
কূটনৈতিকভাবে রক্ষা ও যুদ্ধের সময় সমর্থন
অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার দৃশ্যমান দিক ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। ১৯৭২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৪২টি প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে। ওই প্রস্তাবগুলো ছিল ইসরাইলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সমবেতভাবে যে ভেটো প্রদান করে তার চেয়ে ওই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং মোট আমেরিকান ভেটোর অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি। এছাড়া ইসরাইলকে লক্ষ্য করে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমেরিকান ভেটোর হুমকিতে নিরাপত্তা পরিষদে কখনো ভোটাভুটির পর্যায়ে আসেনি। জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জন নেগরোপন্টে ২০০২ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক গোপন বৈঠকে বলেন বলে বলা হয়, এখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে নিন্দা করে যে কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করবে যদি একই সঙ্গে সাধারণভাবে সন্ত্রাসবাদ ও নির্দিষ্টভাবে ইসলামিক জিহাদ, হামাস এবং আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের নাম উল্লেখ করা না হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকবার ইসরাইলকে নিন্দা করার জন্য ভোট দিয়েছে নির্দিষ্টভাবে ইসরাইলের কোনো নিন্দনীয় কাজের জন্য, যখন ইসরাইলকে মৃদু সমালোচনা করা হয়েছে অথবা ইসরাইলের আপস বিরোধী মনোভাবের জন্য ওয়াশিংটন তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে চেয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অনেক প্রস্তাবের মধ্যে একটা প্রস্তাব গ্রহণ এবং ইসরাইলের আচরণের নিন্দা অথবা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানায়। তখন প্রস্তাব বাধ্যতামূলক না হলেও এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতীকী হলেও ওয়াশিংটনের মনোভাব তার অধিকাংশ মিত্র এবং অন্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দেয়। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৫৯/১২৪ নম্বর প্রস্তাব ছিল ‘ইসরাইলি কার্যধারা যা প্যালেস্টাইন জনগণের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করে’-এর ওপর। ওই প্রস্তাব ১৪৯-৭ ভোটে পাস হয় (২২ জন ভোটদানে বিরত থাকে এবং ১৩ জনের ভোটাধিকার ছিল না) ২০০৪ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই প্রস্তাব সমর্থনকারীদের মধ্যে ছিল জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, চীন এবং গ্রেট ব্রিটেন। ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ৬টি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই দেশগুলো হলো ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, মার্শাল আইল্যান্ডস, মাইক্রোনেসিয়া, নাউরু এবং পালাউ।
একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির আওতায় ইসরাইলের অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার নিয়ে আরব দেশগুলো প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করলে ওয়াশিংটন ওই সংস্থাকে তার এজেন্ডায় এ বিষয়টি তালিকাভুক্ত করতে প্রতিহত করে। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জোনাথন পেলেড ২০০৩ সালে ইহুদি সংবাদপত্র ফরোয়ার্ডকে বলেন, আরবরা এটা প্রতিবছর করে। কিন্তু ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য হয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হলে আপনার প্রয়োজন হবে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির বোর্ড অব গভর্নেন্সের সম্মতি। কিন্তু আপনি এটা পাবেন না, কারণ বোর্ডের ওপর ওয়াশিংটনের প্রভাব আছে। কূটনীতি ও যুদ্ধের সময় ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করার জন্য আমেরিকার আগ্রহ সময়ের বিবর্তনে আরো উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আইসেনহাওয়ার প্রশাসন সুয়েজ যুদ্ধে দখলকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। প্রধান পানিসম্পদকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এককভাবে ইসরাইলি প্রচেষ্টাকেও ওই প্রশাসন থামিয়ে দিতে সফল হয়েছিল। যা হোক, ষাটের দশকের প্রথম দিকে প্রধান প্রধান যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। জেরুজালেম যা চেয়েছে তা ওয়াশিংটন দেয়নি, কিন্তু তাদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হয়ে আছে সম্মতিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরাইল ও সিরিয়ার মধ্যে ১৯৬৬-৬৭ সালে একের পর এক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের সিনাই এলাকায় সৈন্য ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। ইসরাইলি নেতাদের সম্পর্কে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, তারা ব্যাপক আকারে যুদ্ধের বিস্তার ঘটাবে। এ অবস্থায় জনসন প্রশাসন অনুধাবন করে, আরব প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ইসরাইল সামরিক দিক থেকে অধিক শক্তিশালী এবং আরব আক্রমণের বিষয়টা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল আর্লে হুইলার জনসনকে জানান, ‘আমাদের সর্বোত্তম হিসাব হলো, যুদ্ধ হলে পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যে ইসরাইল জিতে যাবে।’ আর জনসন নিজে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবা এবানকে বলেন, মিসর আক্রমণ করলে ‘তোমরা তাদেরকে ঝেটিয়ে দেবে’। ইসরাইলের প্রধান প্রধান নেতা ব্যক্তিগতভাবে এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হন। তবে তারা ওয়াশিংটনের কাছে উদ্বেগজনক রিপোর্ট পাঠাতে থাকে সহানুভূতি ও সমর্থন পাওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত প্রচারণার অংশ হিসেবে।
নিজের মূল্যায়ন অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল সরকারকে শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত রাখা এবং কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে যুদ্ধের বিস্তার রোধে চেষ্টা করে। প্রেসিডেন্ট জনসন তিরাল প্রণালীতে ইসরাইলের জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণায় মিশরের সিদ্ধান্তকে ‘অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত এবং ইসরাইলের উদ্বেগের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তবে তিনি সৈন্য সাহায্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো মার্কিনসংশ্লিষ্টতার মতো অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে চাননি এবং ইসরাইলের সহায়তার জন্য খোলাখুলি কিছু বলেননি। ইসরাইলকে বিরত রাখার তার প্রয়াস ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ে এবং জুনের প্রথম সপ্তাহে জনসন ও তার একাধিক উপদেষ্টা ইসরাইলি কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত দেন, ইসরাইল আক্রমণ করলে তাদের কোনো আপত্তি নেই তবে ইসরাইলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, পরিস্থিতি খারাপ হলে তারা যেন মার্কিন সাহায্যের আশা না করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডীন রাস্ক একজন সাংবাদিককে বলেন, ‘কাউকে নিবৃত্ত করা আমাদের কাজ বলে আমি মনে করি না।’ অপরদিকে মাইকেল ব্রেচার উল্লেখ করেন, ৩ জুনের মধ্যে ‘(ইসরাইলের) ধারণা হয়, ইসরাইল উদ্যোগ গ্রহণ করলে… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবন্ধুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে না।’ আসলে ইসরাইলকে জনসন আক্রমণের জন্য এমন ইঙ্গিত দেন যা একজন বিশেষজ্ঞ ‘হলুদ সংকেত’ বলে উল্লেখ করেন। জনসনের মতের ওই পরিবর্তন অস্পষ্ট থেকে যায়। অবশ্য ইসরাইল সমর্থক বন্ধু ও উপদেষ্টাদের চাপ ছিল, ইসরাইলি দূতাবাস চিঠি লেখার প্রচার আন্দোলন শুরু করে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়, ইসরাইল যে আক্রমণ করতে যাচ্ছে তাতে সবার একটি ভূমিকা থাকতে পারে।
যুদ্ধে জয়লাভ না করা পর্যন্ত ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি এবং যুদ্ধের পর ইসরাইলের আক্রমণের সমালোচনা করেনি। বস্ত্তত, ইসরাইল কর্তৃক গোলান উপত্যকা দখলের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করার হুমকি দিলে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের মোকাবিলা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ষষ্ঠ নৌবহরকে ইসরাইলের কাছাকাছি যাওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ যুদ্ধের বিপরীতে জনসন প্রশাসন এটা স্পষ্ট করে দেন, ব্যাপকভিত্তিক শান্তিচুক্তি ছাড়া ইসরাইলকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো চাপ সৃষ্টি করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিদর্শনকারী যুদ্ধজাহাজ লিবার্টির ওপর দুঃখজনক আক্রমণের বিষয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো কৈফিয়ত চাইবে না – ওই আক্রমণ চালায় ইসরাইলের নৌ ও বিমানবাহিনী। ঘটনাটি এখনো বিতর্কিত হয়ে আছে। সংকট শুরুর সময় সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা চাইলেও আমেরিকা ইসরাইলকে তা না দিলেও আমেরিকার যে সহানুভূতি ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৬৯-৭০ সালে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ প্রয়াসে শত্রুর শক্তি ক্ষয় করার সময় আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। যুদ্ধের সময় ইসরাইলকে সাহায্য দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। নিক্সন ও কিসিঞ্জারের ধারণার সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, ইসরাইলকে দ্রুত সহাযতা দেওয়া হলে সোভিয়েত সহায়তার নগণ্যতা প্রকাশ পাবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আরব ক্লায়েন্টরা আমেরিকার প্রতি ঝুঁকে পড়তে উৎসাহিত হবে। ইসরাইলের চাহিদা অনুযায়ী নিক্সন প্রশাসন অবশ্য সব অস্ত্র প্রদান করেনি। এ বিষয়টা নিয়ে উভয় সরকারের মধ্যে মাঝে মাঝে কড়া কথাবার্তা হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। কিন্তু ওই সময়ের বিভিন্ন শান্তি আলোচনায় কিছুটা ছাড় দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুপাতিক হারে ইসরাইলকে উৎসাহিত করেনি। কিন্তু যখন আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং বৃহৎ শক্তির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাব্য ভীতি দেখা দেয়, তখন ওয়াশিংটন সাময়িক যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেয় এবং বাড়তি সহায়তার অঙ্গীকার করে তা মেনে নেওয়ার জন্য ইসরাইলকে অনুরোধ করে। ১৯৭২ সালের সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদীভিত্তিতে বিমান ও ট্যাংক সরবরাহের অঙ্গীকার করে। নতুন কোনো শান্তিপ্রস্তাব দেওয়ার আগে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনা করারও অঙ্গীকার করে নিক্সন এবং কিসিঞ্জার। একাজ করে পৃথিবীর দুটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটা দেশ পরবর্তী কূটনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র একটা দেশকে আসলে আধা ভেটো ক্ষমতা প্রদান করে। উইলিয়াম কোয়ানদত সত্তর দশকের প্রথম দিকে লেখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি হলো ইসরাইলকে খোলাখুলি সমর্থনের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। পরে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবা এবান এই যুগকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল আরো নাটকীয়। নিক্সন ও কিসিঞ্জার প্রথম দিকে আশাবাদী ছিলেন, ইসরাইল খুব বাড়াবাড়ি বিজয় লাভ করবে। তারা বিশ্বাস করেন, প্রকাশ্যে বিশেষ কিছু না করলে এবং চূড়ান্তভাবে বিজয়ী না হলে ইসরাইলকে যুদ্ধের পর আমেরিকা ব্যাপক সহায়তা দেবে। কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘ইসরাইল যদি ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে, যা আমরা প্রথমে আশা করেছিলাম, তাহলে আমাদেরকে আরবদের সব অসন্তুষ্টির মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসতে হবে। আরবদের রক্ষাকারী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান যেন না ঘটে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে… অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে এবং ইসরাইল বিপদে পড়লে আমাদের এমন কিছু করতে হবে যা তাদের রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয়।’ এ প্রত্যাশা ও কৌশলগত উদ্দেশ্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রথম দিককার সাহায্যের অনুরোধে সাড়া দেয় খুব ধীরগতিতে। ইসরাইল যখন অপ্রত্যাশিত বিপদের মোকাবিলা করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরবরাহ কমে আসতে থাকে তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামরিক যন্ত্রপাতি জরুরিভিত্তিতে বিমানে করে সরবরাহের নির্দেশ দেন এবং অতিরিক্ত সামরিক সহাযতার জন্য ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদান করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পৌঁছার আগেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলেও ওই সহায়তা ইসরাইলের মনোবল বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বিজয় নিশ্চিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুঃখজনক বিষয় এই, আমেরিকার পুনরায় অস্ত্র সরবরাহের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে আরবরা জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এর ফলে সারাবিশ্বে জ্বালানির মূল্য হঠাৎ বেড়ে যায়। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অনেক খরচ কাটছাঁট করতে হয়।
যুদ্ধের সময সীমিত আকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি ইসরাইলের অনুকূলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্দানের রাজা হোসেনকে চুপ থাকতে রাজি করায়। কিসিঞ্জার যুদ্ধবিরতি আলোচনা পরিচালনা করেন। (উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২১ অক্টোবর মস্কোতে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনা)। তার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সোভিয়েত জেনারেল সেক্রেটারি লিয়োনিদ ব্রেজনেভকে একথা বলার জন্য নিক্সন কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভিত্তিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই যুদ্ধকে ব্যবহার করতে চায়’। কিন্তু মস্কোতে কিসিঞ্জার সফলভাবে একটা সাধারণ যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করেন। এতে ইসরাইলের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয় এবং পরবর্তী সব শান্তি প্রক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাইরে রাখা সম্ভব হয়। ঐতিহাসিক কেনেথ স্টেইনের মতে, ‘ব্রেজনেভের সঙ্গে কিসিঞ্জারের তিনটি বৈঠকের আলোচ্য বিষয় আমেরিকা সংকলন করে। তা থেকে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, তিনি সঠিকভাবে এবং বারবার মস্কোর কাছে ইসরাইলের স্বার্থ তুলে ধরেন যা ছিল নিক্সনের অগ্রাধিকারের প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত।’ যুদ্ধবিরতির জন্য আমেরিকান-সোভিয়েত বিরোধের বিষয়গুলো ইসরাইলি নেতারা তুলে ধরেন। তবে স্টেইন উল্লেখ করেন, ‘কিসিঞ্জার ক্রেমলিনের কাছে ইসরাইলের প্রতিনিধিত্ব না করলেও তিনি নিশ্চিতভাবে ইসরাইলের উদ্বেগের প্রতিনিধিত্ব করেন।’
নিরাপত্তা পরিষদ ২২ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করে, সব পক্ষকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবন্ধের আহবান জানানো হয়। কিসিঞ্জার ইসরাইলকে সামরিক অবস্থান সুদৃঢ় না করা পর্যন্ত ওই আহবান না মানার অনুমতি দেন। তিনি আগেই ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত সিমচা ফিনিৎজকে বলেন, মস্কো সফরের সময় ইসরাইলের জন্য ‘সদুপদেশ’ হলো তার সামরিক প্রভাবকে সম্পূর্ণ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অশ্রেণীভুক্ত দূত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা গ্রুপ ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের মতে, ‘যুদ্ধবিরতির আসন্ন শেষ সময় সত্ত্বেও ইসরাইলের সামরিক অগ্রাভিযানের জন্য সময়ক্ষেপণ করতে কিসিঞ্জার গোপনে ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করার সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন।’ যুদ্ধবিরতি যখন একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী যখন মিসরের তৃতীয় বাহিনীকে একেবারে ঘিরে ফেলে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজের বাহিনী নিয়ে হস্তক্ষেপ করার স্পষ্ট হুমকি দেয়। ওই সময় নিক্সন ও কিসিঞ্জার বিশ্বব্যাপী সামরিক সতর্কতার নির্দেশ দেন এবং মস্কোকে দূরে থাকার জন্য সতর্কতামূলক ঘোষণা দেন ও ইসরাইলকে বলেন, এখন যুদ্ধ বন্ধের সময় এসেছে।
পরবর্তী পর্যায়ে ‘ধাপে ধাপে’ কূটনৈতিক আলোচার সময় অনেক জটিল দর কষাকষি চলে এবং অতঃপর সম্পাদিত হয় ১৯৭৫ সালের সিনাই-২ অনাক্রমণ চুক্তি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে থাকে। অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা দেওয়া ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে ‘ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ’ করার অঙ্গীকার করে পরবর্তী শান্তি সম্মেলনের প্রস্ত্ততির সময়। ভবিষ্যতে পিএলওকে কোনো শান্তি আলোচনায় বিরত রাখার জন্য অবৈধভাবে আমেরিকা ইসরাইলকে ভেটো ক্ষমতা প্রদান করে। বস্ত্তত কিসিঞ্জার অঙ্গীকার করেন, ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকার স্বীকার অথবা জাতিসংঘের ২৪২ এবং ৩৩৮ প্রস্তাব গ্রহণ না করা পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিএলওকে ‘স্বীকার’ করবে না বা তার সঙ্গে ‘আলোচনা’ করবে না (যে দুই প্রস্তাবে যথাক্রমে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহবানসহ এর সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার স্বীকৃতির কথা বলা হয়)। ওই অঙ্গীকারের বিষয় কংগ্রেস আইনে পরিণত করে ১৯৮৪ সালে। ইসরাইলি ঐতিহাসিক আভি স্লেইম বলেন, ‘(ইসরাইলি প্রধামন্ত্রী) রবিন কিসিঞ্জারকে স্পষ্টভাবে বলেন, একই সঙ্গে আমেরিকান-ইসরাইল চুক্তি না হলে মন্ত্রিসভা সিনাই-২ (অনাক্রমণ) চুক্তি অনুমোদন করবে না।’ স্লেইম পরবর্তী সব ব্যবস্থাকে ‘আমেরিকার সঙ্গে শুধু নামেই মৈত্রী’ বলে গণ্য করেন।
ইসরাইল ১৯৮২ সালে লেবাননে অসৎ উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো একবার তার (ইসরাইলের) সহায়তায় এগিয়ে আসে। দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইল ও পিএলও বাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমেরিকার অনুমোদন চান। ওই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল লেবানন থেকে পিএলওকে বিতাড়িত করা, সিরিয়ার প্রভাবকে নির্মূল করা এবং লেবাননের খৃস্টানদের নেতা বশির জামায়েলকে ক্ষমতায় বসানো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার হেগ ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় ওই পরিকল্পায় শর্তযুক্ত অনুমোদন দেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইসরাইলের সাড়া দ্রুত হতে হবে ‘ঠিক জীবনীশক্তি হরণ করার মতো’। তিনি সম্ভবত ইসরাইলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পুরোটা জানতেন না। সে কারণে তিনি সতর্ক করে দেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্ররোচনা’র ক্ষেত্রেই কেবল ইসরাইল অনুরূপ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অবশেষে ইসরাইল ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমণ করে (হেগের শর্ত না মানা সত্ত্বেও)। কিন্তু লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পুনরায় শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জটিল আকার ধারণ করে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দ্রুততার সঙ্গে পিএলও এবং সিরিয়ার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করলেও পিএলও বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যরা বৈরুতে আশ্রয় নেয়। লেবাননের অসামরিক লোকদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন না করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত ফিলিপ হাবিব ওই অবরোধ সমাপ্তির জন্য একটা আলোচনা চুক্তি করেন। এর ফলে পিএলওকে স্থান ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয় এবং শেষে কয়েক হাজার মার্কিন নৌসেনা বহুজাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে লেবাননে প্রেরণ করা হয়।
লেবাননে ইসরাইল সমর্থক সরকার গঠনে ইসরাইলের আশা চূর্ণ হয়ে যায় সেপ্টেম্বরে জামায়েলের হত্যার পর। ওই সময় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী খ্রিস্টান মিলিশিয়াকে সাবরা ও শাতিলা উদ্বাস্ত্ত শিবিরে প্রবেশের অনুমতি দেয়। সেখানে তারা যায় ব্যাপকসংখ্যক ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ অসামরিক লোকদের হত্যা করার জন্য। সাধারণভাবে উদ্বাস্ত্ত শিবিরে মৃতের সংখ্যা সাতশ’ থেকে দুই হাজারের বেশি বলে বলা হয়। লেবাননের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও বিদেশী দখল সমাপ্তির একাধিক প্রয়াস ব্যর্থ হয়। লেবাননে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ধ্বংসের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের নিয়ে আসা হয়। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে মার্কিন দূতাবাসে এক আত্মঘাতী বোমায় ৬৩ জন লোক নিহত হয়। অক্টোবর মাসে নৌবাহিনীর ব্যারাকে ট্রাকভর্তি বোমা দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়। এতে ২৪১ জন নৌসেনা নিহত হয়। এর পরের বছর লেবানন থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।
যুদ্ধের সময় ইসরাইলের আচরণে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হলেও তারা ইসরাইলের কাজের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো চেষ্টাই করেনি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের কাছে রিগ্যান ৯ জুন একটা কড়া চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি সিরিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার আহবান জানান কিন্তু সিরিয়ার বিষয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর লক্ষ্য ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ায় ওই প্রস্তাবে সম্মত হতে ইসরাইলের বড় ধরনের কোনো ছাড় দিতে হয়নি। ঐতিহাসিক ও কূটনীতিক ইটামার রবিনোভিচ বলেন, ‘মৌখিক প্রতিবাদ, অন্যান্য অঙ্গভঙ্গি এবং মাঝে মাঝে সত্যিকার বিরক্তি প্রকাশ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে রাজনৈতিক সমর্থন দেয় এবং এর ফলে তারা যুদ্ধকে অসাধারণভাবে দীর্ঘায়িত করতে অক্ষম হয়।’
প্রতিবেশী দেশ আক্রমণের জন্য অবরোধ আরোপের পরিবর্তে ইসরাইলকে বস্ত্তত কংগ্রেস ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা প্রদানের পক্ষে ভোট দেয়। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ও তার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জজ পি শুলজ ওই প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করা সত্ত্বেও কংগ্রেস ভোট দেয়। পরে শুলজ বলেন, ‘ডিসেম্বরের (১৯৮২) প্রথম দিকে… আমি জানতে পারি, কংগ্রেসের এক ঢিলেঢালা অধিবেশনে ইসরাইলকে অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হচ্ছে। আর এটা এমন সময় করা হচ্ছে যখন ইসরাইল লেবানন আক্রমণ করে, সে গুচ্ছবোমা ব্যবহার করে এবং সাবরা ও শাতিলায় উদ্বাস্ত্তদের হত্যা করার কাজে সহায়তা করে। আমরা ওই অতিরিক্ত সাহায্যের বিরুদ্ধে সচেষ্ট হই। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ও আমি একই ধরনের চিন্তা পোষণ করি এবং অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানকে টেলিফোন করি। ডিসেম্বরের ৯ তারিখে আমি আমার বিরোধিতার কথা বলে একটা আনুষ্ঠানিক চিঠি দেই। ওই চিঠিতে আমি বলি, অতিরিক্ত ওই সহায়তা ‘ইসরাইলের নীতিকে অনুমোদন ও পুরস্কার দেওয়া’ বলে মনে হয়। (ইসরাইলের) পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামির প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের বিরোধিতাকে ‘অবন্ধুসুলভ কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা শান্তি প্রয়াসকে ব্যাহত করবে।’ অতিরিক্ত ওই সহায়তার বিষয়টা ঠিকমতো আলোচিত হয় এবং আমরা তা অনুমোদন দেই, যদিও প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ও আমি সেখানে ছিলাম না। আমি অবাক হই এবং হতাশ হয়ে পড়ি। এর ফলে আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, কংগ্রেসে ইসরাইলের সুবিধাপ্রাপ্তির কতটা প্রভাব আছে। আমি বুঝতে পারি, ইসরাইলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন কাজে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে অগ্রগতির জন্য কংগ্রেসের সমর্থন পাওয়ার জন্য কংগ্রেসের বিষয় পরিচালনার সময় ইসরাইলের সঙ্গে কাজ করতে আমাকে কতটা সতর্ক থাকতে হবে।
তবু রিগ্যান ও শুলজ শিগগিরই কংগ্রেসের মত মেনে নেন। ১৯৮১ সালের কৌশলগত সহযোগিতার সমঝোতা চুক্তি (ইসরাইল কর্তৃক গোলান উপত্যকা দখলের পর সাময়িকভাবে স্থগিত) ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে পুনর্বহাল করা হয়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, ইসরাইলের আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তারের একমাত্র উপায় হলো ইসরাইলের সঙ্গে গভীর সহযোগিতা। শান্তি আলোচনার সময়ও আমেরিকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ইসরাইলের পক্ষ সমর্থনের মধ্যে। ছয়দিন যুদ্ধের পর ব্যর্থ শান্তি প্রয়াস ও ১৯৭০ সালে আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ প্রচেষ্টা সমাপ্তির বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান ভূমিকা পালন করে। ১৯৭২ সালে আরো শান্তি উদ্যোগ শুরু করার আগে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মত হয়। অক্টোবর যুদ্ধের আগে ‘ধাপে ধাপে’ কূটনৈতিক প্রয়াস পরিচালনার সময় কিসিঞ্জার কখনো ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি। অলোচনার একপর্যায়ে কিসিঞ্জার অভিযোগ করেন, আমি রবিনকে ছাড় দেওয়ার কথা বলি, কিন্তু তিনি বলেন, তিনি তা করতে পারেন না। কারণ ইসরাইল দুর্বল। সে জন্য আমি তাকে অনেক অস্ত্র দেই। এরপর তিনি বলেন, ছাড় দেওয়ার তার কোনো প্রয়োজন নেই কারণ ইসরাইল শক্তিশালী। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি প্রাথমিকভাবে কার্যকর হয় অতিরিক্ত মার্কিন সহায়তা এবং সিনাইয়ে অসামরিক মনিটর স্টেশন স্থাপনের অঙ্গীকারের মাধ্যমে।
ক্লিনটন প্রশাসনের আলোচনা পরিচালনার ক্ষেত্রেও একই রকমের পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা যায়। এর ফলে সম্পাদিত হয় ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে চূড়ান্ত চুক্তির মর্যাদায় উপনীত হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস। মাঝে মাঝে ক্লিনটন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ইসরাইলের প্রতিপক্ষকের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তার অবস্থান ঘনিষ্ঠ করেছে এবং ইসরাইলের কৌশল সম্পর্কে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের মারাত্মক আপত্তি সত্ত্বেও শান্তি প্রচেষ্টায় ইসরাইলকে সমর্থন করেছে। ইসরাইলি মধ্যস্থতাকারী রন পনডাক ছিলেন অসলো চুক্তি আলোচনার মুখ্য প্রতিনিধি এবং ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা চূড়ান্ত অবস্থার চুক্তির কাঠামো নির্ধারণের প্রধান স্থপতি। তিনি বলেন, ‘(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) পররাষ্ট্র দফতরের প্রথাগত অবস্থান ছিল… ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান গ্রহণ করা। নেতানিয়াহুর সরকারের সময় এটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ সময় মাঝে মাঝে মনে হতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কাজ করছে। কারণ ওই সময় ইসরাইলি প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের রাজি করাতে (এবং চাপ দিতে) চেষ্টা করত। বারাকের সময়ও মার্কিনীদের এই প্রবণতা দৃশ্যমান।’
শান্তি প্রক্রিয়ার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণকারীরাও একই ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করেছে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের আরব-ইসরাইলি বিষয়ক বিশেষ সহকারী এবং ক্যাম্প ডেভিড আলোচনায় একজন প্রধান অংশগ্রহণকারী রবার্ট ম্যালের মতে, ‘ক্যাম্প ডেভিডে (ইসরাইলি) ধ্যানধারণা কখনো লিখিতভাবে উপস্থাপন করা হয়নি… ওইসব ধারণা সাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা হিসেবে, ইসরাইলের ধ্যান-ধারণা হিসেবে নয়।’ সম্ভাব্য নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কার্যধারায় কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলকে সহায়তা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা ‘বিস্ময়কর বিধান নয়’-এর কারণে আটকে পড়ে – এ অবস্থাকে ম্যালে বর্ণনা করেন, ‘‘স্পষ্ট করে না হলেও আমেরিকার অঙ্গীকার, কমপক্ষে ইসরাইলের সঙ্গে তার প্রতিটি ধ্যান-ধারণা অগ্রিমভাবে ভাগাভাগি করা। কারণ বারাকের কৌশল কারো কাছে (প্রেসিডেন্টসহ) প্রকাশ হওয়ার আগেই নিম্নস্তরের লোকদের কাছে জানাজানি হয়ে যায়। ফলে তিনি ‘বিস্ময়কর বিধান নয়’ কামনা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তব প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যা তার কাছে অনেক বেশি বলে মনে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের আলোচনার অবস্থানের সমাপ্তি টেনে দেয় (অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে) এবং ইসরাইলকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যেখান থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না।’’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ও আরব-ইসরাইল বিষয়ক ছয়টি বিভিন্ন সচিবালয়ের উপদেষ্টা এবং ক্লিনটন প্রশাসনের শান্তি প্রয়াসের একজন প্রধান কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার ব্যর্থ সব আলোচনার বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ের এক বিশ্লেষণে ২০০৫ সালে বলেন, ‘প্রায় ক্ষেত্রেই আমরা ব্যাপকভাবে কাজ করেছি… ইসরাইলের আইনবিদ হিসেবে।’
আমেরিকার সহযোগিতায় কৃতজ্ঞ ইসরাইল
‘আমরা আপনাদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।’ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ছিলেন অস্বাভাবিকভাবে আবেগাপ্লুত। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুলাই কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে তাকে দেখা যায়। সে সময় তিনি তার মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন ‘আমেরিকার চমৎকার লোকদের প্রতি।’ গুরুত্বের সঙ্গে রবিন বলেন, ‘আমাদের কৃতজ্ঞতার কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না… আপনাদের উদার সমর্থন, উপলব্ধি এবং সহযোগিতা আধুনিক ইতিহাসে তুলনাহীন।’ রবিনের দুঃখজনক হত্যাকান্ডের দুই বছর পর তার উত্তরসূরি বেনজামিন নেতানিয়াহু একই স্থানে দাঁড়িয়ে একই রকম প্রশংসাসূচক কথা বলেন। ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে যা দিয়েছে তা আমি এ সংঘকে কীভাবে বলব? রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে দিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ও বিশাল সহায়তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরাইল একটা শক্তিশালী আধুনিক রাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে।’ তিনি তার শ্রোতাদের বলেন, ‘আমি জানি, আমি আজ আপনাদের সামনে কথা বলছি প্রত্যেক ইসরাইলি ও সারা বিশ্বের ইহুদিদের পক্ষ থেকে। আমেরিকার জনগণ, আপনাদের ধন্যবাদ।’ বিদেশী সফররত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে সাধারণভাবে যেমন কথা শোনা যায় এ ধরনের বা অনুরূপ অন্য বক্তব্য তেমন শুধু প্রশংসনীয় অলঙ্কারবহুল ছিল না। রবিন ও নেতানিয়াহুর কথায় ছিল ইহুদি রাষ্ট্রকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিয়ে আসছিল তার সঠিক বিবরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের অর্থ ইসরাইলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয় এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় তা একে উদ্ধার করে। যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ইসরাইলকে শক্তিশালী এবং মধ্যপ্রাচ্যে এর সামরিক প্রাধান্যকে নিশ্চিত করে। যুদ্ধ ও শান্তির সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ব্যাপক কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং ইসরাইলের নিজের কিছু কিছু কাজের ক্ষতিকর প্রভাবকে পৃথক্ভাবে দেখার কাজে সহায়তা করেছে। আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়িত প্রয়াসে মার্কিন সহায়তা একটা বড় বিষয়। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি বা মিসর ও জর্দানের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে ক্রমবর্ধমান মার্কিন সহায়তার স্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশের চেয়ে ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো এক মহান দাতা।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:০৫
প্রভাষ প্রদৌত বলেছেন: তথ্যবহুল পোস্ট । পোস্টে প্লাস ।