নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুধু দেখি আর লিখি, কী আছে আর জীবনে!

জেডিপি

লিখতে ভালোবাসি, প্রকৃতি ও প্রাণীপ্রেমী।

জেডিপি › বিস্তারিত পোস্টঃ

চা

০৩ রা আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:০৪

শুক্রবার সকাল, খুব শীত পড়েছে।
মজিদ ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে জাম্পারটা গায়ে দিয়ে নিল হাই তুলতে তুলতে। ঘড়ি দেখলো, সাতটা বাজে। স্যার ঠিক আটটায় ঘুম থেকে উঠবেন। এর আগে চা পাতা আর চিনি এনে রাখতে হবে।
মজিদ চোখ কচলে রান্নাঘরের পেছনের উঠানের কলের পাড়ে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে নিল।
সূর্যের দেখা নেই এখনও, সবকিছু শীতল আর মন খারাপ করা হয়ে আছে।
কলের পাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল আম গাছটা শীতে জবুথবু হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আজ পাখিরাও যেন নড়ছে না, কোন সাড়াশব্দ নেই।
শীত পছন্দ করে এমন লোকদের কথা ভেবে মেজাজটা বিগড়ে গেল মজিদের, চোখমুখ কুঁচকে কুলি করতে করতে বিড়বিড় করে আজ সকালের বৈরি আবহাওয়ার জন্য শীত প্রেমী লোকদের দায়ী করে এক গাদা গালি দিল।
গামছা দিয়ে মুখ মুছে যেন একটু ধাতস্থ হল মজিদ। দেয়ালে টাঙ্গানো রশিতে গামছাটি মেলে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গ্লাসে করে এক চুমুক পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো। এরপর নিজের রুমে ঢুকে চৌকির পাশের ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে নিয়ে লুঙ্গির কুঁচকিতে ভরে রান্নাঘরে এসে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বের হল।

বাজারে গিয়ে সবচেয়ে প্রথমে ফখরুদ্দিন মিয়ার চায়ের দোকানে বসে দিনের প্রথম বিড়ি ধরানো মজিদের অনেক পুরনো রুটিন। বিড়ি শেষ হওয়া পর্যন্ত দোকানে ঐ মূহুর্তে বসে থাকা পাড়ার কোন লোকের সাথে ‘দেশের অবস্থা ভাল না’ কিংবা ‘জিনিসপত্রের দাম কীভাবে বাড়তেছে’ এসব নিয়ে আলোচনা করে মজিদ। আজ অবশ্য কথা বলার মত লোক খুঁজে পেল না। দোকানে ভাপাপিঠা বানানো হচ্ছে। মজিদের মুখোমুখি বেঞ্চে বসে মুখভর্তি সাদা দাঁড়ি নিয়ে চাদর দিয়ে ঘোমটা দেয়া খনখনে এক বুড়ো চিন্তিত মুখে ভাপা পিঠার চুলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার কপালে ভাঁজ, হাতে এক কাপ লাল চা, আরেক হাতে সিগারেট। ভাপা পিঠা বানানো দেখে এত চিন্তিত হওয়ার কী আছে তা ভেবে পেল না মজিদ।

‘ঐ মিয়া কী দেখেন এইভাবে?’ মজিদ ঝাড়ি দিয়ে উঠলো লোকটাকে উদ্দেশ্য করে।
লোকটা মনযোগ ভেঙে কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে বলল, ‘শীত করে।’
‘শীত করলে ভাপা পিঠা খান।’ কথাগুলো বলে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে নাড়তে মজিদ ঠোঁটে ধরানো বিড়িতে আগুন দিল। এমনিতেই সকাল সকাল মজিদের মেজাজ খারাপ থাকে, শীতের সকালে আরও বেশি মেজাজ খারাপ থাকে, কারণ সে শীত সহ্য করতে পারে না।

ফখরুদ্দিন মিয়াকে আজ রোবটের মত লাগছে। সে চুপচাপ একই ভঙ্গীতে ভাপা পিঠা বানিয়েই যাচ্ছে, পাশে রাখা প্লেটে পিঠার স্তুপ বাড়ছে, কিন্তু খাওয়ার লোক দেখা যাচ্ছে না। এই শীতের সকালে বাজারে লোকজন কম। মজিদ চুপচাপ বিড়ি শেষ করে একটা ভাপা পিঠা আর চায়ের অর্ডার দিল। ফখরুদ্দিন মিয়ার মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না, সে মেশিনের মত ভাপা পিঠা বানানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলো। তার সদ্য কৈশোরে পা দেয়া ছেলেটি ব্যস্ত ভঙ্গীতে মজিদের জন্য চা বানাতে শুরু করল। ভাপাপিঠা আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মজিদও ফখরুদ্দিন মিয়ার ভাপাপিঠা বানানোর প্রক্রিয়া দেখতে লাগলো, এক পর্যায়ে সেও ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ফখরুদ্দিন মিয়ার ছেলেটি তাকে ডাক দিয়ে চা ধরিয়ে দিলে তার ঘোর ভাঙল। মজিদ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো খনখনে বুড়োটি চলে গেছে।

চা আর ভাপা পিঠা খেয়ে বাজার করে ফেরার সময় মজিদের উষ্ণ মেজাজ অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে এল, এই শীতের সকালের মত। বাড়িতে ঢুকে মজিদ দেখলো স্যার ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বসে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মজিদ চুপচাপ রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রেখে স্যারের রুমে প্রবেশ করল একটু গলা খাঁকারি দিয়ে। স্যার অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, ‘মজিদ, আজকেও চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না। দেখো তো কোথাও চোখে পড়ে কীনা।’

মজিদ কোন কথা না বলে বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখা আধপড়া এক বইয়ের ভেতর থেকে চশমাটা বের করে দিল তার স্যারের হাতে। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গীতে রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের সরঞ্জাম সাজাতে লাগলো।

ষাটোর্ধ মহসিন তালুকদার প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একই কাজ করেন।
হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানান, নিজের জন্য আর মজিদের জন্য। তিনি চা বানানোর সময় তার দীর্ঘদিনের চাকর মজিদ বারান্দার বেতের চেয়ারটি মুছে রাখে। চেয়ারের পাশে ছোট টেবিলে আজকের পত্রিকাটি এনে রাখে। কখনও তার বিছানার পাশে গত রাতের আধপড়া কোন বই থাকলে সেটাও এনে রাখে। এ যেন এক অঘোষিত রীতি। চা নিয়ে বারান্দায় যাওয়ার সময় তিনি মজিদকে বলে যান, ‘তোমার জন্য চা রেখেছি চুলার পাশে।’
সত্যিকার অর্থে, স্যারের বানানো চা মজিদের খুব বেশি ভাল লাগে না। সে অনেক বেশি চিনি দিয়ে চা খেতে পছন্দ করে। এরপরও সে স্যারকে মানা করতে পারে না, প্রতিদিন একবার ফখরুদ্দিন মিয়ার দোকানে ডাবল চিনি দিয়ে চা খেয়ে এসে চোখমুখ কুঁচকে মজিদ তার স্যারের বানানো চা গলধঃকরণ করে। মাঝে মাঝে চাটুকু ফেলে দিতে মন চায়, কিন্তু ‘স্যার না দেখলেও আল্লাহ দেখবেন’ এই কথা ভেবে আর ফেলা হয় না।

ছোট্ট রান্নাঘরে একটি চা কর্নার আছে। চুলার বাম পাশে, দেয়াল ঘেঁষে। সুন্দর কয়েকটি কাপ দেয়ালের শেলফে ঝোলানো থাকে। নিচের তাকে সারিবদ্ধভাবে সাজানো চা পাতা, গুঁড়ো দুধ আর চিনির কৌটা। চা বানানোর হাঁড়ি, চায়ের ছাকনি সবকিছুই যত্ন করে কেনা, দেখলে বুঝা যায়। মহসিন সাহেব বিভিন্ন দেশ ঘুরে এইসব জিনিস খুঁজে খুঁজে কিনে এনেছেন। এখনও তার বিছানার নিচের ট্রাংকে জমা আছে অনেক চায়ের সরঞ্জাম। অবসরে যাওয়ার পর আর ঘর থেকে খুব একটা বের হন না তিনি।

মহসিন তালুকদারের হাতে বানানো চা বিশেষভাবে খ্যাত। শীত হোক কিংবা বর্ষা, প্রতি বিকেলে পাড়ার লোকেরা চা খেতে আসে তার বাড়িতে। ঠিক যখন সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়তে থাকে, কমে আসে উত্তাপ, মহসিন তালুকদারের এক তলা বাড়ির পুরনো ড্রয়িংরুমে বাড়তে থাকে পাড়ার লোকের আনাগোনা। রাজনীতি, দেশের অবস্থা কিংবা এই বছর কতখানি গরম পড়েছে তা নিয়ে আড্ডা চলতে চলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। আড্ডার এক পর্যায়ে মহসিন সাহেব ‘আপনারা গল্প করুন, আমি চা নিয়ে আসছি।’ বলে উঠে চলে যান চা বানাতে। চা বানিয়ে এনে সবাইকে পরিবেশন করতে করতে মহসিন সাহেব একটি গল্প শোনান, ‘বুঝলেন তমুক সাহেব, তখন আমি ছাত্র। একবার আমার এক বড়ভাইয়ের সাথে অমুকগঞ্জ গিয়েছিলাম বেড়াতে, বড়ভাইয়ের হোমটাউন। আমার আবার রেগুলার চা খাওয়া লাগে তখন থেকেই। ভাইয়ের বাড়িতে কেউ চা খায় না। এদিকে দুদিন হয়ে গেল, ভাল এক কাপ চা না খেয়ে আমার তো অবস্থা বেগতিক! তখন বড়ভাই বললেন, চল তোমাকে আমি একটা ভাল দোকানের চা খাওয়াবো, পুরো এলাকার সেরা চা। বেশি দূরে না, এই তো কাছেই। আমরা দুপুরে ভাত খেয়ে বের হলাম, হাঁটতে হাঁটতে কত মাইল পাড়ি দিলাম হিসাব নেই, সন্ধ্যা হয়ে গেল। অবশেষে দেখলাম সেই চায়ের দোকান। গ্রাম এলাকা, বাজারের মধ্যে দোকান। দোকানের সামনে সেই ভিড়! লোকজন উপচে পড়ছে চা খাওয়ার জন্য। অনেক কষ্টে আমরাও পেলাম দুকাপ। কিন্তু বিশ্বাস করবেন না তমুক সাহেব, চায়ে চুমুক দিয়ে আমার যে কেমন লাগলো! এই চা খাওয়ার জন্য আমি এত কষ্ট করে এসেছি! চা তো না, এ যেন চিনির শরবত! এরপর থেকে আমি চায়ের ব্যাপারে কারও কথা বিশ্বাস করি না। নিজের চা নিজেই বানাই।’

এরপর কিছুক্ষণ মহসিন সাহেবের চায়ের প্রশংসা চলে। অনেকে তার কাছে চা বানানোর রেসিপিও চান, মহসিন সাহেবকে তখন হাসিমুখে আরও একবার চা বানানোর উছিলা দিয়ে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করতে দেখা যায়। চায়ের কাপে ঝড় তোলা এই আড্ডার দিনগুলোতে ড্রয়িংরুমে ফুলতোলা কুশনগুলোর পেছনের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা ফ্রেমে নির্বিকার ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকেন মহসিন সাহেবের প্রয়াত স্ত্রী।

ড্রয়িংরুম আর রান্নাঘরের মাঝের করিডরের মেঝেতে চুপচাপ বসে ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে সবকিছু দেখে মহসিন তালুকদারের দীর্ঘদিনের চাকর মজিদ। কখনও সে তাদের আড্ডা শুনে, কখনও দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে হাঁ করে ঘুমিয়ে যায়। শেষ বিকেলের এই সময়টায় নিজের বিছানায় নয়, বরং আড্ডার গল্প শুনতে শুনতে দেয়ালে মাথা দিয়ে হাঁ করে ঘুমাতেই ভাল লাগে মজিদের। কেন সে জানে না, কখনও জানার চেষ্টাও অবশ্য করা হয়নি। মাস শেষে বেতনের সাথে মজিদ বাড়তি বোনাস পাঠায় বাড়িতে, বাজার করার জন্য যে টাকা দেয়া হয় সেই টাকা থেকে নিজের খরচ রেখে কিছুটা বোনাস হিসেবে বাড়িতে পাঠানো তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। মজিদের স্ত্রী সেদিন ফোনে জানিয়েছে, এই বোনাসের টাকা জমিয়ে তার বড় ছেলেটিকে সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছে। ছেলে এখন সাইকেলে করে কলেজে যায়। মজিদ মনে করে, তার স্ত্রী ভাগ্য অনেক ভাল। বাজারের পয়সার সাথে মহসিন সাহেব মাঝে মাঝে মজিদকে বিড়ি খাওয়ার জন্য বাড়তি টাকা দেন। তখন মজিদের মনে হয়, শুধু স্ত্রী ভাগ্য নয়, তার পুরো ভাগ্যটাই অনেক ভাল।

এভাবেই চলছে আজ বছরখানেক হল।
৪০ বছর ধরে এই বাড়িতে বসবাস করছেন মহসিন তালুকদার।
একতলা বাড়িটা এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে খুব কম দামে কিনেছিলেন, লোকটা স্বপরিবারে বিদেশ যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। মহসিন সাহেবের ছেলে অয়ন তখন স্কুলে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছে। অয়নকে দেখেশুনে রাখার জন্য কিশোর বয়সী মজিদকে তার স্ত্রী দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন, সম্পর্কে মজিদ তার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের ভাই হত। অয়ন বড় হল, পড়াশুনা করতে বিদেশ চলে গেল, ওখানেই থিতু হয়ে গেল। স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ল, স্ত্রী চলে গেলেন।

৪০ বছরে এই পাড়ার অনেকেই বাড়ি বিক্রি করে চলে গেলেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ইভটিজিং করা ছোকরাগুলো বছর খানেক যাওয়ার পর ফর্মাল শার্ট পরে চাকরির জন্য ছুটতে থাকলো, ছুটতে ছুটতে তাদের গালে মাংস লাগলো, পেটে চর্বি জমল, চুলে পাক ধরল। তাদের সন্তানেরা স্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল, ছুটির দিনে সেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে শুরু করল। বছরখানেক পর আবার সেই ফর্মাল শার্ট, গালে মাংস, পেটে চর্বি, চুলে পাক ধরা!
মহসিন সাহেব প্রতিদিন সকালে চা বানিয়ে নিয়ে বেতের চেয়ারে বসলেন, পত্রিকার পড়তে পড়তে ছোকরাদের জীবনচক্র প্রত্যক্ষ করলেন, চা খেয়ে অফিসে গেলেন। এভাবে বছরের পর বছর পার করলেন। এরপর অবসর নিলেন। বেতের চেয়ার ক্ষয় হয়ে গেলে নতুন বেতের চেয়ার কিনে আনলেন।

প্রতিদিন, নানা কারণে, নানা অজুহাতে বিকালবেলা মহসিন সাহেবের বাড়িতে লোকের পা পড়ে। উদ্দেশ্য একটাই, এক কাপ চা।
সবাই জানে, মহসিন তালুকদার তার বাড়িতে গেলে অবশ্যই বলবেন, ‘চা করি একটু?’।
তুচ্ছ ছুতায় ড্রয়িং রুমে বসে হাত কচলাতে কচলাতে আগন্তুক বলবেন, ‘না থাক কষ্ট করবেন না।’
মহসিন সাহেব মাথা নেড়ে ব্যস্ত ভঙ্গীতে উঠে যাবেন চা বানাতে। ফুটন্ত পানিতে পরিমাণমত চায়ের পাতা যখনই পড়বে, ভারী হয়ে উঠবে মহল্লার বাতাস। চায়ের সুঘ্রাণ চাঙ্গা করে তুলবে দুপুরের শেষ প্রহরে ঝিমিয়ে পড়া পাড়ার লোকদের। চা পরিবেশন করতে করতে মহসিন সাহেব আরও একবার তার চায়ের গল্প শোনাবেন, ‘বুঝলেন অমুক সাহেব, আমি একবার তমুকগঞ্জ গেছি বেড়াতে………’
একই গল্প অসংখ্যবার শুনলেও সেই অমুক কিংবা তমুক সাহেব চা খাওয়ার লোভে এমনভাবে মাথা নাড়বেন যেন এই প্রথম শুনছেন। মহসিন সাহেব নিজেও জানেন তিনি গল্পটি অসংখ্যবার বলে ফেলেছেন, কিন্তু এরপরও তার বলতে ভাল লাগে, তাই তিনি বলে যাবেন। কিছুক্ষণ পর সেই অমুক কিংবা তমুক সাহেব ‘আপনার চা এত ভাল হয় কি করে? রেসিপিটা দিন প্লিজ’ বলবেন, মহসিন তালুকদার হাসিমুখে মাথা নেড়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবেন।
পাড়ার লোকেরা বলে, মহসিন সাহেব চা বানালে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে বাজার অব্দি। বাজারের গোড়ায় ফখরুদ্দিন মিয়ার দোকানে বসে থাকা যেনতেন মানুষগুলো, যারা মহসিন সাহেবের বাড়িতে প্রবেশের জন্য কোন নেহাত অজুহাত খুঁজে পায় না, তারা ঐ সময় বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়, আর চুমুক দেয় ফখরুদ্দিন মিয়ার বানানো চায়ে। যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। ফখরুদ্দিন মিয়ার অবশ্য এতে আপত্তি নেই। সকাল আর বিকাল এই সময়গুলোতে বিক্রি ভাল হয় বলে তিনি খুশি।

মহসিন সাহেবের চা বানানো শেষ, রোজকার রুটিন অনুযায়ী চায়ের মগ হাতে তিনি বারান্দায় বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পত্রিকা পড়া হবে সকাল নটা পর্যন্ত। এরপর খানিকটা মুড়ি আর গুড় দিয়ে নাশতা মহসিন সাহেব নাস্তা সারবেন। নাস্তা শেষে সামনের উঠানের বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করবেন। এবছর শীতে গাঁদাফুল হয়েছে অনেক, সকাল সকাল রোদ পড়লে সারাঘর গাঁদা ফুলের গন্ধে ভরে যায়।

রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দূর থেকে বাড়ির সামনের বাগানটা দেখা যায়। পেঁয়াজ কাটতে কাটতে মজিদ দেখলো, তার স্যার চিন্তিত ভঙ্গীতে হিজল গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক মাস বয়সী গাছটার কচি পাতা সব খেয়ে সাফ করে ফেলেছে শুঁয়াপোকা। মজিদ বাজার থেকে কীটনাশক এনে রেখেছিল, কিন্তু স্যার শুঁয়াপোকা মারতে দিচ্ছেন না বলে কীটনাশক ছিটানো যাচ্ছে না। শুঁয়াপোকা থেকে নাকি প্রজাপতি হবে। প্রজাপতি গাছে গাছে উড়ে বেড়াবে। মজিদ ভেবে পায় না, গাছ না থাকলে প্রজাপতি কিসের মধ্যে উড়ে বেড়াবে? স্যারের জন্য মজিদের মায়া হয়। অনেক মায়া হয়।

বাগানের কাজ শেষ করে মহসিন সাহেব যখন হাঁটতে বের হলেন তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে ফুলকপি দিয়ে মাছ রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, কাছেই কোথাও মগ দিয়ে পানি ঢালার শব্দ, একটু পর পাওয়া গেল সাবানের গন্ধ। দ্বিপ্রহর। এখনও সূর্যের দেখা নেই। গলির মুখে আস্তাকুঁড়ের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে পোড়া পাতার ছাইয়ের মাঝে শুয়ে উষ্ণতা খুঁজছিল পাড়ার কুকুর জুলি। কুকুরটার নাম কে বা কারা জুলি রেখেছে কেউ জানে না। সবাই জানে ওর নাম জুলি। ফখরুদ্দিন মিয়ার চায়ের দোকান আর গলির মাথায় ফেলা আস্তাকুঁড়ের ময়লা জুলির দখলে থাকে সবসময়। খাওয়াদাওয়া শেষে এখানেই ঘুমায় সদ্য যৌবনে পা দেয়া জুলি। আজকাল জুলির আশেপাশে অনেক কুকুর ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, তবে ময়লার ভাগাড় পর্যন্ত আসতে পারে না একজনও।

রাস্তায় মানুষজনের আনাগোণা আগের থেকে বেড়েছে। মহসিন সাহেব হাঁটতে হাঁটতে মুদি দোকানের বজলু, কুমিল্লা ফার্মেসির পল্লী ডাক্তার দেলোয়ার হোসেন আর সবজি বিক্রেতা বৃদ্ধা আয়েশা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করে ফিরছিলেন। মুদি দোকানের বজলুর সঙ্গে কথা বলার সময় বজলুর জোরাজুরিতে তাকে একটি পাউরুটি কিনতে হল। পল্লী ডাক্তার দেলোয়ার হোসেন তাকে রোজকার মত ডায়বেটিস আর প্রেশার মেপে দিলেন। সবজি বিক্রেতা বৃদ্ধা আয়েশা বেগম সদ্য আনা তাজা লাউশাকের লোভ দেখালেও মহসিন তালুকদার হাসিমুখে বিদায় নিয়ে হাঁটা দিলেন।

মহসিন তালুকদার বাড়ি ফিরে শিমের বিচি আর কইমাছের ঝোল (উপরে তাজা ধনেপাতা কুচি ছড়ানো) দিয়ে ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নিতে গেলেন। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল আসি আসি করছে, মজিদ চুলায় চায়ের জন্য গরম পানি চড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই কলিংবেল শোনা গেল। দরজা খুলে মজিদ যাকে দেখলো সে এই পাড়ার কেউ নয়, অপরিচিত। ফর্মাল শার্ট, হাতকাটা সোয়েটার পরা, চোখে চশমা আর হাতে চামড়ার ফাইলওলা লোকটার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে লোকটা মজিদকে বলল, সে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। মজিদ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে লোকটিকে ভেতরে বসতে দিল।

মহসিন তালুকদার সাধারণত দুপুরে ঘুমান না, শুয়ে শুয়ে বই পড়েন। আজ অলস শীতের দুপুরে খানিকটা গড়িয়ে নিতে গিয়ে কখন যেন তার চোখটা লেগে গিয়েছিল। মজিদ মহসিন সাহেবকে ডেকে তুলল। তিনি উঠে আবার চশমা খুঁজতে লাগলেন, মজিদ বরাবরের মত চশমা এগিয়ে দিল। কালো পুরু ফ্রেমের চশমাটা চোখে নিয়ে, ধবধবে সাদা চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে, মহসিন তালুকদার ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবীটা আলনা থেকে তুলে পরে নিলেন। ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা হলেন আরেকটি বিকেলের উদ্দেশ্যে।

‘সালাম। আমি মাহবুব হোসেন। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এসেছি। আপনি কি মহসিন তালুকদার?’
মহসিন সাহেবের সামনে সোফায় বসা এক ত্রিশোর্ধ যুবক, পরিপাটি করে পোশাক পরা।
‘জ্বি।’ মহসিন সাহেব মাথা নেড়ে চশমার কোণটা ঠিকমত বসিয়ে নিলেন।
কয়েক সেকেন্ড অস্বস্তিকর নীরবতা। মহসিন তালুকদার লোকটার মুখোমুখি সোফায় গিয়ে বসলেন।
এরপর বললেন, ‘কি করতে পারি আপনার জন্য?’
লোকটা তার কথার উত্তর না দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘মহসিন সাহেব, আপনি এই বাড়িতে কতদিন ধরে আছেন?’
মহসিন সাহেব একটু ইতস্তত করে তারপর বললেন, ‘প্রায় ৪০ বছর হবে। কর্মজীবনের শুরুর দিকে কিনেছিলাম একজনের কাছ থেকে।’
ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টাঙানো মহসিন তালুকাদের প্রয়াত স্ত্রীর পোর্টেটের দিকে তাকিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি ছেলেমেয়ে আছে?’
‘জ্বি, এক ছেলে। বিদেশে সেটেলড। কেন বলুন তো?’
‘আপনার এই জমিটা সরকার একুয়ার করতে চাচ্ছে, মেট্রোরেলের অমুক টু তমুক রুটের পাথওয়ের উপর দিয়ে এই জায়গাটা গেছে। তাই এখানে বাড়ি রাখা যাবে না। বাড়িটা ভেঙে ফেলা লাগবে। সরকার থেকে আপনি ভাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবেন। আপনি তো অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, তাই আপনার জন্য বিশেষ বোনাসের ব্যবস্থাও আছে।’ নির্বিকার ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে গেলেন ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আসা মাহবুব হোসেন।
মহসিন সাহেব তার কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে রইলেন।
এরপর বললেন, ‘আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।’
লোকটা কিছু বলার আগেই মহসিন সাহেব যন্ত্রের মত উঠে রান্নাঘরে গেলেন।

মজিদ রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমের করিডরের পাশে তার চিরাচরিত স্থানে বসে ভুরু কুঁচকে পুরো বিষয়টি দেখলো। আজ তার ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে ইচ্ছা হল না, ঘুমও এল না। সকালবেলার শীতপ্রেমী লোকদের মত ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আসা এই ব্যক্তিটির উপর প্রচন্ড রাগ হল মজিদের।

মহসিন তালুকদার স্বাভাবিক ভঙ্গীতে চা পরিবেশন করতে করতে তার চায়ের গল্প বলতে লাগলেন, ‘বুঝলেন মাহবুব সাহেব, আমার আবার চায়ের শখ। যেকোন জায়গার চা খেতে পারি না। তো একবার হয়েছে কী, অনেক বছর আগের কথা, তখন আমি ছাত্র……অমুকগঞ্জ গিয়েছি এক বড়ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে…………।’

ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আসা ত্রিশোর্ধ যুবক মাহবুব হোসেন অধৈর্য ভঙ্গীতে মহসিন সাহেবের গল্প শুনতে শুনতে চা খেয়ে শেষ করলেন। চায়ের প্রশংসা করলেন, তবে রেসিপি চাইলেন না।

‘মহসিন সাহেব, এখনও অনেক সময় বাকি আছে। আগামী বছরের আগে মেট্রোরেলের এইদিককার কাজ শুরু হবে না। আপনি এর মধ্যে আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলুন, নিজের থাকার ব্যবস্থাটা করে ফেলতে পারবেন। সরকার যা টাকা পয়সা দিবে তাতে আপনার বাকি জীবন আর কোন চিন্তাই থাকবে না। বুঝলেন? উঠি তাহলে আজকে, থ্যাংকস ফর দ্য টি। আমি কয়েকদিনের মধ্যে লিখিত আকারে আপনাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো মাহবুব হোসেন।

মহসিন তালুকদার হাসিমুখে মাথা নাড়লেন, তাকে বিদায় দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যার আড্ডায় মহসিন তালুকদারের ড্রয়িংরুমে দেশের অবস্থা নিয়ে যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল তাতে মহসিন তালুকদারকে অংশ নিতে দেখা গেল না। রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ নিয়ে আড্ডার সদস্যরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় কেউ মহসিন তালুকদারের অন্যমনস্ক আচরণ খেয়াল করল না।


মাঘের শেষ।
সূর্যের আলোর ধরণ পাল্টে গেছে, সকাল থেকে হলদে রোদ আর ঝিরিঝিরি বাতাসে ভরে থাকে চারিদিক।
মহসিন তালুকদারের বাড়ির পেছনের আমগাছটায় মুকুলে ছেয়ে গেছে। সন্ধ্যা হলে ঘরভরা এখন আমের মুকুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে যায়। মজিদ তার স্যারের সঙ্গে মিলে বাগানের বড়ই গাছ থেকে বড়ই পাড়ছে। গত বছর সে গাছটা লাগিয়েছিল, এক বছরে গাছটা বড় হয়ে এত মিষ্টি বড়ই হয়েছে দেখে মজিদের খুব বেশি আনন্দ হচ্ছে। কিছু বড়ই বাড়ি পাঠানো গেলে ভাল হত মজিদ ভাবছিল।
বড়ই পাড়ার পর যথারীতি বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করে মহসিন তালুকদার হাঁটতে বের হলেন।
গলির কুকুর জুলির সন্তান হয়েছে আজ মাসখানেক হল, তবে ছানাগুলোকে এখনও কেউ দেখতে পায়নি। পাড়ার লোকদের ধারণা, ছানাগুলো একটিও বাঁচেনি। জুলিকে আজকাল আস্তাকুঁড়ের পাশে কম দেখা যায়। ঝুলন্ত আটটি স্তন নিয়ে জুলি করুণ স্বরে কান্না করে যায়, দিন রাত যখন তখন। জুলির কান্না শুনে ফখরুদ্দিনের ছেলে সকাল সকাল ওকে ভাপাপিঠা খেতে দেয়, কিন্তু সন্তান হারা মায়ের কান্না কেউ থামাতে পারে না।
দ্বিপ্রহরের প্রথম পক্ষে ছাতা নিয়ে যখন মহসিন তালুকদার হাঁটতে বের হলেন, তখনও জুলি করুণ স্বরে কাঁদছিল। বজলুর মুদি দোকান থেকে বিস্কিট কিনে জুলিকে খাওয়ালেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে গলি পার হয়ে সামনে হারিয়ে গেলেন। মজিদ টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার স্যারের চলে যাওয়া দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর গেট বন্ধ করে রান্না করতে গেল।
কয়েক মিনিট পর টিনের গেটের বাইরের কলিংবেলটা বেজে উঠল।
মজিদ হাত ধুয়ে দরজা খুলে দেখল ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আসা মাহবুব হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন।
‘স্যার বাইত নাই। পরে আসেন।’ মজিদ ইচ্ছা করেই বিরক্তি প্রকাশ করল।
‘কখন আসবেন আপনার স্যার?’
‘জানি না, কিছু কয় নাই।’
মাহবুব হোসেন মাথা নিচু তার চামড়ার ফাইল থেকে একটা খয়েরী খাম বের করে মজিদের হাতে দিল।
‘এটা আপনার স্যারকে দিবেন।’
‘আইচ্ছা দিমু। আর কিছু কইবেন?’
‘নাহ।’ মাহবুব হোসেনের চেহারায় অপমানবোধ ফুটে উঠলো।
তিনি চলে গেলে মজিদ দরজা আটকে দিল।

সেদিন দুপুরে মহসিন সাহেব বাড়ি এসে ড্রয়িংরুমে বসে চুপচাপ চিঠিটা পড়লেন। মন্ত্রণালয়ের চিঠি। ঠিক ছয়মাসের মধ্যে ঘর খালি করতে হবে। চিঠিটা পড়ার পর তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন। মজিদকে ডাক দিলেন।
‘মজিদ।’
‘জ্বি স্যার।’
‘তোমার গাছের বড়ইগুলো ভালই মিষ্টি হয়েছে দেখি।’
‘জ্বি স্যার। বড় মিঠা হইছে। আলহামদুল্লিহাহ।’
‘এতগুলো বড়ই খাওয়ার তো লোক নেই। তুমি এক কাজ কর, দুদিনের জন্য বাড়ি ঘুরে এসো। ছেলেমেয়েদের জন্য বড়ইগুলো নিয়ে যাও।’
‘আপনার বড় মেহেরবানি স্যার। আপনার জন্য রান্না কইরে রাইখে যাবো। এই দুইদিন কি খাইবেন স্যার? ইলিশ মাছের পাতুড়ি কইরে রাখবো?’
‘তোমার যা ভাল লাগে করো, মজিদ। আমার কোন সমস্যা নেই।’
‘শুকরিয়া স্যার। আমি দুইদিনের মধ্যেই চইলে আসবো।’
‘ঠিক আছে। কাল রাতের গাড়িতে যাও। কিছু টাকা নিয়ে যেও আমার কাছ থেকে।’
‘আপনার অশেষ মেহেরবানি স্যার।’


পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মজিদকে একটা কাগজে কিছু জিনিসের নাম লিখে বাজারে পাঠালেন মহসিন তালুকদারঃ

১। চিঠি লেখার খাতা
২। ঝর্ণা কলম
৩। নীল রঙের খাম
৪। স্ট্যাম্প
৫। সীল মোহরের আঠা

অনেক খুঁজে খুঁজে জিনিসগুলো কিনে আনলো মজিদ।
মহসিন তালুকদার সেদিন আর হাঁটতে বের হলেন না।
দুপুরবেলা তার বিছানার পাশের ডেস্কের সামনে মজিদের কিনে আনা জিনিসগুলো সাজিয়ে রেখে চুপচাপ বসে থাকলেন।
সন্ধ্যার আড্ডায় আবারও চায়ের গল্প হল।
মজিদ করিডরের সামনে বসে ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাল, আড্ডার গল্প শুনতে শুনতে হাঁ করে ঘুমিয়ে নিল। আজ রাতে জার্নি করবে, ঘুম টুম তো হবেই না।

মজিদ চলে গেলে সেদিন সারাদিন খাটের নিচ থেকে একটার পর একটা পুরনো ট্রাঙ্ক বের করে জিনিসপত্র খুলে খুলে দেখলেন মহসিন তালুকদার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বাড়ির পেছনের আমগাছে বসে কোকিল ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল, মহসিন তালুকদার খেয়াল করলেন না। ছাত্রজীবনের কয়েকটি পুরনো এ্যালবাম দেখতে দেখতে একটি লালচে হয়ে যাওয়া ছবি চোখে পড়ল তার। ছবিতে যুবক বয়সী মহসিন তালুকদার, পরনে বেলবটম প্যান্ট, মাথার ঝাপড়া চুল আর বিশাল গোঁফের ফাঁকে এক টুকরো হাসি দেখা যাচ্ছে। তার পাশে চেয়ারে বসা লম্বা দুই বেণী করা এক নারীর হাস্যোজ্জল মুখ, দুজনের হাতে চায়ের কাপ উঁচু করে ধরা।
ছবির পেছনে লেখাঃ ‘রুপু, তোমার চায়ের সবচেয়ে বড় ভক্ত কিন্তু আমি। চায়ের রেসিপির অপেক্ষায় রইলাম। সারাজীবন অপেক্ষায় রেখো না যেন। ইতি, চারুলতা বন্দোপাধ্যায়। বরিশাল, ১৯৭৬’।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের র‍্যাগ ডে। চারুর জন্মদিনও ছিল সেদিন। চারুর বাসায় তোলা ছবি। নিজের হাতে বানানো চা নিয়ে খুব গর্ব করতো চারু। ওর সঙ্গে বাজি ধরে চা বানাতে গিয়েছিলেন মহসিন সাহেব। ছবিটা জামিল তুলেছিল। মহসিন তালুকদার তার জন্মদিনে ছবিটা উপহার পেয়েছিলেন চারুর কাছ থেকে।
চারুকে আর চায়ের রেসিপি দেয়া হয়নি, অনেকটা অভিমান করেই দেননি বলা যায়।
কলেজ থেকে বেরিয়ে চারুরা চলে যায় অন্যখানে, পুরো পরিবার নিয়ে। মেয়েটা একবার যোগাযোগও করেনি। পরে মহসিন সাহেব তার বন্ধু জামিলের কাছে জানতে পারেন, চারুর বিয়ে হয়েছে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। চারু নাকি ইচ্ছা করেই যোগাযোগ করেনি, যদি তার মন ছুটে যায়!

এমনই এক বসন্তের সকালে যখন বাড়ির পেছনের আমগাছটায় বসে কোকিল সবেমাত্র গানের আসর শুরু করেছিল, তখন মহসিন তালুকদার ঘুম থেকে উঠলেন। হাতমুখ ধুয়ে আজ তিনি সোজা রান্নাঘরে গেলেন না। চিঠি লিখতে বসলেন। লেখা হলে চিঠিটা খামে ভরলেন। স্ট্যাম্প লাগালেন। সীলগালা করলেন। বাড়িতে কেউ নেই। মজিদ আজ ফিরবে। কখন ফিরবে বলে যায়নি।
চিঠি লেখা হলে তিনি চা বানাতে গেলেন।
চা নিয়ে বারান্দার বেতের চেয়ারের পাশের টেবিলে রাখলেন।
শোবার ঘর থেকে চিঠিটা নিয়ে এলেন।
চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে চুপচাপ চা খেলেন।
কিছুক্ষণ পর তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল।


শেষ কথা
মজিদ এসে তার স্যারকে মৃত অবস্থায় পায়।
ধারণা করা হয়, চায়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন মহসিন তালুকদার।
তার শবদেহের পাশে একটি চিঠি পাওয়া গেছে।
চিঠিটার খামের উপর লেখা, ‘চারুর জন্য আমার চায়ের রেসিপি’।











মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.