![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাষা দক্ষতাঃ পদ্ধতি ও কৌশল
সূচনাঃ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বাংলা চালু আছে। ফলে বাংলা শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে শোনা, বলা, পড়া ও লেখা খুবই দরকার। মানুষ চিন্তা করতে শেখে ভাষার মাধ্যমে। শিশু তার মাতৃভাষা অর্জন করে সহজাতভাবে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে তা পরিপুষ্ট হয়। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় নিরবচ্ছিন্নভাবে।
শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য তাই মূলত মাতৃভাষাকেই আশ্রয় করতে হয়। তবে মুখে কথা বলা আর কাগজপত্রে লেখা দুটোই শিখতে হয়, নিয়মিত অনুশীলনের দ্বারা রপ্ত করতে হয়। শুনে শুনে অভ্যস্ত হওয়া, পড়তে শেখা এবং লিখে লিখে অভ্যাস করা তাই একান্ত প্রয়োজন। এই অনুশীলন ছাড়া ভাষা ঠিকমতো বলতে পারা এবং লিখতে শেখা সম্ভব হয় না।
ভাষা দক্ষতা অর্জনের পদ্ধতি ও কৌশলঃ
শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া হিসেবে আমাদের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা, স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলভাবে পড়া, সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে লেখায় সাহায্য করা এবং শব্দসম্ভার সমৃদ্ধ করা, বাক্যগঠনে দক্ষ হওয়া এ সবই ভাষা দক্ষতায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। শিক্ষাক্রমভিত্তিক ভাষা দক্ষতা আমাদের ভালোভাবে আত্মপ্রকাশে সহায়তা করে এবং জীবন ও পরিবেশ উপলব্ধিতে সহায়ক হয়।
আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয় শেখার মাধ্যমও বাংলা। তাই বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন তার ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যবহারিক ও কারিগরি বিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের অনুকূল ভিত্তি প্রস্তুত করে দেয়। একই সঙ্গে ভাষিক দক্ষতা শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যৎ জীবন-গঠনে এবং স্বদেশ ও বিশ্ব, সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্প ইত্যাদি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। ভাষা আয়ত্ত করার পদ্ধতি অর্থাৎ ভাষা দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা হলো যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। তাই আমাদের সঠিকভাবে যোগাযোগের জন্য ভাষা শেখাটা জরুরি। প্রশ্ন হলো, ভাষা আমরা কীভাবে আয়ত্ব করবো ? অর্থাৎ ভাষার দক্ষতাগুলো কীভাবে শেখা যাবে ?
আমাদের মাতৃভাষা যেহেতু বাংলা, তাই আমরা জন্মের পর থেকেই চারপাশে বাংলা ভাষায় কথা শুনতে পারি, একটু বড় হয়ে এই ভাষায় বলতে পারি, পড়ালেখা করার সুবাদে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারি। কিন্তু বিদেশি ভাষা রপ্ত করার ক্ষেত্র অবশ্য ভিন্ন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শেখা ও বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আর এ কারণে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বাংলা ও ইংরেজি দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে শিক্ষাক্রমে স্থান করে নিয়েছে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করানো। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আমরা জানতে পারি—
আমাদের শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষা শুদ্ধ ও ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা। আর এই কাজটি করার জন্য বিষয় হিসেবে প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলা পড়ানো হয়ে থাকে। প্রাথমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রসঙ্গ কথায় আমরা দেখতে পাই, বাংলা পাঠ্যপুস্তকটি রচনার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে— বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাও বাংলা। ফলে শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
বাংলা কেবল একটি বিষয় নয়, এটি সকল বিষয় শেখার মাধ্যম। এদিক থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষায় শোনা, বলা, পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। তাই বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যেন শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা আনন্দময় পরিবেশে আয়ত্ত করতে পারে ।
আমাদের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ভাষার চারটি দক্ষতাকে অর্জন করানোর জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে। পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, প্রতিটি পাঠের শুরুতেই দেওয়া আছে পাঠে কী করতে হবে, এর ফলে কোন দক্ষতাটা অর্জন হবে অর্থাৎ শিক্ষকের জন্য একটি নির্দেশনা দেওয়া থাকে পাঠটি কীভাবে পড়াতে হবে। কোন পাঠটি শোনাতে হবে, কোন পাঠটি বলাতে হবে, কোনটি পড়াতে হবে ও কোনটি লেখাতে হবে তাও নির্ধারণ করা আছে।
একজন শিক্ষক যদি নির্দেশনাটি যথাযথ অনুসরণ করেন, তাহলে একজন শিক্ষার্থী ভাষার চারটি দক্ষতাই সমানভাবে অর্জন করতে পারবে। এই কাজটি কতটুকু নিষ্ঠার সাথে করা হয় তা অবশ্য গবেষণার বিষয়। প্রতিটি শিক্ষাস্তরের মাঝে ও শেষে ওই স্তরের শিক্ষা কতটুকু অর্জন করা হলো, তা যাচাই ও ফলাবর্তন প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে।
তবে প্রাথমিক স্তরে আমরা সাধারণত সাময়িক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষাকেই গুরুত্বসহকারে দেখে থাকি। এছাড়াও আছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। সব পরীক্ষাতেই বাংলা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে অর্থাৎ বাংলা পাঠ্যবইটি কতটা আয়ত্ব করতে পারল তার পরীক্ষা নেওয়া হয়।
আমরা আগেই দেখেছি ভাষার দক্ষতা চারটি কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষাগুলোতে শুধু শিক্ষার্থীর একটি দক্ষতা অর্থাৎ লেখার দক্ষতাই পরিমাপ করা হয়। ব্যতিক্রম শুধু প্রথম শ্রেণির পরীক্ষা। এখানে শিক্ষার্থীর বলার দক্ষতাও পরিমাপ করা হয়। কিন্তু আর সব শ্রেণিতে শুধু পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারলেই পরবর্তী স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে।
বাংলা ভাষার চারটি দক্ষতার মূল্যায়ন করা যায়, তার ধারণা আমি প্রথম পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। সেখানে প্রথম বর্ষে সকল শিক্ষার্থীকে বাংলা ভাষা বিষয়টি পাঠ করতে হয়। আর এই কোর্সের শেষে একটি ব্যবহারিক পরীক্ষাও দিতে হয়। আর এই ব্যবহারিকে শোনা, বলা ও পড়ার দক্ষতা কতটা অর্জন করা হয়েছে তার বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। এজন্য যা করানো হয় তা হলো—
১। শোনার জন্য: সবাইকে একটি সাউন্ডপ্রুফ রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সবাই তৈরি থাকে। তাদেরকে একটি অডিও শোনানো হয় আর এই অডিও শুনে তার থেকে উত্তর খুঁজে লিখতে হয়।
২। বলা ও পড়ার জন্য: শিক্ষক একজন একজন করে শিক্ষার্থীকে রুমে নিয়ে যান, সেখানে একটি অডিও রেকর্ডারের সামনে কোনো বই থেকে পাঠ করতে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীকে সেই অংশটুকু জোরে জোরে পড়তে হয়। শিক্ষক পরবর্তীতে অডিও চালিয়ে দেখতে পারেন উচ্চারণসহ অন্যান্য বিষয় শিক্ষার্থী বলতে পারছে কিনা ও পাঠ্যবিষয়টি যথানিয়মে পাঠ করতে পারছে কিনা।
এভাবে এখানে বাংলা ভাষার চারটি দক্ষতার কোনটি কতটুকু অর্জন করা হয়েছে তা যাচাই করা যায়।
আমরা চাইলেই এই কাজগুলো আমাদের প্রাথমিক স্তরে চালু করতে পারি। অর্থাৎ একটি ব্যবহারিক পরীক্ষার আয়োজন করতে পারি। তবে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিসর ও অন্যান্য বিষয়ে কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য হয়ত এত জাঁকজমকপূর্ণভাবে শুরু করা যাবে না, তবে নিজস্ব পরিসরেও কাজটি করা যাবে।
যেমন— আমরা যদি প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার সাথে সাথে ব্যবহারিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখি তবে দক্ষতার কতটা অর্জন করানো গেল তা পরিমাপ করা যাবে। যেমন—
১। শোনার জন্য: ক্লাশ শিক্ষক সামনে দাড়িয়ে কিছু বলবেন আর শিক্ষার্থীরা একে একে তার উত্তর দিবে। এভাবে শিক্ষক সহজেই শোনার দক্ষতার মূল্যায়ন করতে পারবেন।
২। বলার জন্য: শিক্ষক একে একে সবাইকে দিয়ে কিছু না কিছু বলাবেন, হতে পারে এটা কোনো কবিতা বা নিজের কোনো গল্প। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বলার দক্ষতার পরিমাপ করা যাবে।
৩। পড়ার জন্য: শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবইয়ের নির্বাচিত অংশ পড়তে দিয়ে পড়ার দক্ষতার পরিমাপ করা যাবে। এছাড়া আমরা প্রচলিতভাবে লেখার পরীক্ষা নিয়েই থাকি।
তাই দেখা যায়, এসব কাজের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ভাষার চারটি দক্ষতার কোনটি কতটুকু অর্জন করতে পারল, তা সহজেই পরিমাপ করা যাবে। এর মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী ভাষা ব্যবহারে স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে। অর্জিত হবে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য।
উপসংহারঃ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভাষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আর গুরুত্ব বেশি বলেই তা সুষ্ঠু ভাবে শিখতে ও প্রয়োগ করতে না পারলে জীবনে হাজার রকমের সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে প্রাথমিক স্তরে চারটি মৌলিক ভাষিক দক্ষতার (শোনা, বলা, পড়া ও লেখা) সমন্বিত ও সুষ্ঠু প্রয়োগের সামর্থ্য অর্জন শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষা শেখার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করার সঙ্গে ঐ চারটি দক্ষতাও অর্জন করতে পারবে এমন প্রত্যাশাই স্বাভাবিক । অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যদি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করতে পারে, তাহলে ভাষাজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার যেটুকু জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জিত হবে, তা দিয়ে সে সমাজ-পরিবেশে বাস্তব জীবনে বাংলাভাষা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
দৈনন্দিন জীবনে চিঠিপত্র লেখা, দরখাস্ত করা, দলিল দস্তাবেজ পড়া, সরকারি বিজ্ঞপ্তি পড়ে বুঝতে পারা, ফরম পূরণ করা ইত্যাদি তার পক্ষে তখন কঠিন হবে না।
এছাড়া আনন্দ ও জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজনীয় বই ও পত্র-পত্রিকার পঠন-পাঠনও তার পক্ষে সম্ভব হবে। এভাবে অর্জিত ভাষাজ্ঞান তার আত্মপ্রত্যয় ও কর্মদক্ষতা অর্জনের পক্ষে সহায়ক হবে। শিশুর কল্পনা, আত্মপ্রকাশ ও সৃজনশীলতা বিকাশের প্রধান মাধ্যম হল তার মাতৃভাষা বাংলা।
©somewhere in net ltd.