![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগনের কল্যাণে কাজ করা। সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাম্য বজায় রাখা। স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। এই লক্ষে ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৮ থেকে ১১ এবং ১৩ থেকে ২৫ তম অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিগুলো বর্ণিত হয়েছে। মূলনীতিগুলো রাষ্ট্র পরিচালনায় সব ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। প্রতিটি নাগরিককে এগুলো মেনে চলতে হয়। সংবিধান হল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল। প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি সমূহঃ
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি সমূহ নিম্মে আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি চারটি। যথাঃ-
জাতীয়তাবাদ,
সমাজতন্ত্র,
গণতন্ত্র ও
ধর্মনিরপেক্ষতা
১। জাতীয়তাবাদঃ
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি সমূহের মধ্যে জাতীয়তাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশি। হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি এক ও অভিন্ন সত্তা হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্য লালন করে আসছে। ভাষাগত ও সংস্কৃতগত একক সত্তা বিশিষ্ট এই বাঙালি জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতিসত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একই ধরনের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঙালি জাতির মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি করেছে।
সংবিধানে বলা হয়েছে,
“অনুচ্ছেদ ২৩ : রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলা বিকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন”
অর্থাৎ, একই ভাষা ও সংস্কৃতিতে আবদ্ধ বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, সেই ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।
২। সমাজতন্ত্রঃ
রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো সমাজতন্ত্র। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা আনার মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই সমাজতন্ত্র। শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম অঙ্গীকার ছিল শোষণ মুক্ত ন্যায়ানুগ সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক কোন প্রকার সামাজিক বৈষম্য করা হবেনা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের জন্য সমান অধিকারের ভিত্তিতে সমসুযোগ প্রদান করা হবে। বাংলাদেশ সংবিধানে সমাজতন্ত্র মূলনীতিটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবিধানে বলা হয়েছে-
“অনুচ্ছেদ: ১৩ রাষ্টীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তিমালিকানার মাধ্যমে উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন ব্যবস্থার মালিক বা নিয়ন্ত্রক হবেন জনগণ”।
“অনুচ্ছেদ: ১৬ নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন সাধন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন”।
“অনুচ্ছেদ: ১৯ রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করবেন এবং সারাদেশে সমভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন”।
৩। গণতন্ত্রঃ
বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতির অন্যতম হল গণতন্ত্র । রাষ্ট্রের সব কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হলো গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রে জনগণ তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। আবার জনগণ ইচ্ছা করলে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। যেমন, যে কোনো পরিবারে একজন কর্তা বা একজন প্রধান থাকেন। তার প্রতি পরিবারের সব আনুগত্য থাকা উচিত। তদুপরি পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পরিবারের সবার মতামত নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করতে পারি।
গণতন্ত্র হলো যেখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকে। মানুষের মর্যাদার প্রতি গণতন্ত্রে শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের সব কাজে নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জাতি, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ কোনো প্রকার ভেদাভেদ ছাড়াই রাষ্ট্রের সর্বস্থরের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা নিরসনে অবদান রাখতে পারে।
আমাদের সংবিধানে গনতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“অনুচ্ছেদ: ৯ রাষ্ট্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করবেন এবং এ সকল প্রতিষ্ঠানে কৃষক, শ্রমিক এবং মহিলাদের যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেয়া হবে”।
“অনুচ্ছেদ: ১০ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে”।
“অনুচ্ছেদ: ১১ (১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী এবং ১৯৯১ সালের সংশোধনী মোতাবেক) প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে”
“অনুচ্ছেদ: ১৪ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষ তথা কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি দান করা।
অনুচ্ছেদ: ১৫ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে জনগণের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবসরের অধিকার, এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা”।
“অনুচ্ছেদ: ১৭ রাষ্ট্র সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব নিরক্ষরতা দূর করবেন”
“অনুচ্ছেদ : ১৮ জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় ও স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার এবং গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন”।
“অনুচ্ছেদ: ২০ কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং প্রত্যেকে তার কর্মের জন্য যথাযথ পারিশ্রমিক লাভ করবেন রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক বা কায়িক যে কোন ধরনের শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার অভিব্যক্তিতে পরিণত হবে”।
“অনুচ্ছেদ: ২১ সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য, এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক কর্মচারী বা কর্মকর্তার কর্তব্য সকল সময়ে জনগণের সেবা করা”।
“অনুচ্ছেদ: ২৫ জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন, অপর দেশের আভ্যন্তরিণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন”।
অর্থাৎ, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। জনগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলকে মূল্যবান ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারে। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফল ঘটাতে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করে। পৃথিবীর দেশে দেশে বর্তমানে এ ব্যবস্থায়ই সরকার গঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক দেশ, সুতারং জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।
৪। ধর্মনিরপেক্ষতাঃ
বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম আরেকটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা নয়, বরং সকলের ধর্মীয় বিশ্বাস সংরক্ষণ করাই হলো ধর্মনিরপেক্ষতা।
কোন ধর্মকে একক প্রাধান্য না দিয়ে সকল ধর্মকে সমান দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতিটি মানুষ যেন স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ নীতি অনুসারে কেউ অন্য ধর্মের লোকদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঈদের সময় আমরা আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করি। এতে কেউ বাধা দেয় না। তেমনি অন্য ধর্মের লোকজন যাতে নিরাপদে তাদের ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ যেন নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে এবং কেউ কারও ধর্ম পালনে বাধা না দিতে পারে, সে জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্টীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
উপসংহারঃ
একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মূলনীতি অপরিহার্য। রাষ্ট্রের মূলনীতি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা খুবই কঠিন। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবাধিকার তথা কোনো দেশের নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের কোনো বিকল্প নেই।
আর তাই ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অনুসরণ করা প্রত্যেক নাগরিকেরই উচিত।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। প্রতিটি নাগরিকেই এগুলো মেনে চলা উচিত। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে।
গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপকভাবে অনুসরণ করা উচিত। কারণ এ বিষয় দুটি আমাদের জীবনকে সরাসরি এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
©somewhere in net ltd.