![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কনফুসিয়াসের মূল্যবোধ, দর্শন ও একটি পর্যালোচনা
ভূমিকাঃ
কনফুসিয়াসের জীবনীঃ
কনফুসিয়াস হলেন প্রাচীন চীনের একজন মহান দার্শনিক। তার প্রকৃত নাম খুন ছিউ। কনফুসিয়াস হলো তাঁর সম্মানসূচক নাম। বর্তমানে তিনি এই সম্মানসূচক নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে কনফুসিয়াস জন্মগ্রহণ করেন। কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা মারা যান। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্তমান চীনের সাং তুং প্রদেশে। মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। এবং মা কে হারান চব্বিশ বছর বয়সে। উনিশ বছর বয়সে কিগুয়ান নামে এক নারীকে তিনি বিয়ে করেন । বিয়ের একবছর পর তাদের ছেলে কঙ লি এর জন্ম হয়।
কনফুসিয়াসকে একজন ধর্মগুরু বলে গন্য করা হলেও আসলে তিনি একজন প্রকৃত দার্শনিক। কনফুসিয়াস ছিলেন মুলত মানবতাবাদী দার্শনিক। মানব জাতির ইতিহাসে তিনিই সবথেকে বেশী প্রভাব বিস্তারকারী দার্শনিক। তিনি চীনের ঐতিহ্যগত দার্শনিক চিন্তাধারাগুলিকে সমৃদ্ধ করেন। তার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়,
“লুন ইয়ু নামক একটি বইয়ে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার- আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে । এই বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । প্রাচীন চীনে এই বই পাশ্চাত্য দেশের বাইবেলের মতো পবিত্র ছিল । একজন সাধারণ অধিবাসীকে এই বইয়ে লেখা আচার আচরণ অনুসারে জীবনযাপন করতে হয় । একজন সরকারী অফিসারের পক্ষে এই বই পড়া আরো প্রয়োজনীয়। এই বই ভালো করে পড়েই শুধু যোগ্য সরকারী কর্মকর্তা হতে পারতেন অন্যথায় চাকুরি লাভে ব্যর্থ হতো” (প্রাচীন চীনা দর্শন লাওসি ও কনফুসিয়াস,হেলাল উদ্দিন আহমেদ )
৫০১ খ্রি.পূ. এ ছোট্ট একটি শহরের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে কনফুসিয়াসের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তখন তার বয়স ছিল প্রায় পঞ্চাশ । কিন্তু তার জ্ঞান এবং শিক্ষার খ্যাতি এর আগে থেকেই ছড়াচ্ছিল চারিদিকে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনীতির দুনিয়াতে আরোহণ শুরু হয়েছিল। রাজনীতিতে খুব দ্রতই তার মেধার পরিচয় রেখেছিলেন। তার যোগ্যতার জন্য রাজ্যের বিচারমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্রাটকে কয়েকবার রক্ষা করেছেন। আবার তার এই দ্রুত উত্থান সমকালীন অনেক ক্ষমতাসীনদের চোখের পীড়ার কারণ হয়েছিল। এজন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শুরু হয়েছিল। সম্রাট থেকে তাকে দূরে সড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোন কমতি ছিলোনা।
৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বে কনফুসিয়াস কুফু নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। নগরীর উত্তর দিকে সি নদীর তীরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিক্ষেত্র তখন থেকেই এক মহাতীর্থের মর্যাদা লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বের চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামের এক বিরাট জনগোষ্ঠি কনফুসিয়াসবাদের প্রভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তবে আশ্চর্য্য বিষয় হলো তাদের কাছে কনফুসিয়াস একজন ধর্মীয় নেতার মতই। আর এর তাঁকে তারা পুজাও পর্যন্ত করতো।
কনফুসিয়াসের কর্মজীবনঃ
পারিবারিক অভাবের জন্য অল্প বয়সেই তিনি জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পরেন। তার সমগ্র জীবনে নানা কাজ করেছেন তিনি। একসময় “রু” নামের পদে চাকরী নেন। “রু” হলো জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে সংক্রান্ত সামাজিক অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজ। সেকালে “রু” কে গন্যকরা হতো মর্যাদাহীন কাজ রুপে।
“চাকরী কালীন সময়েই তিনি ছয় কলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই ছয় কলা হলো- সদাচারণ , সংগীত, ধনুর্বিদ্যা, শকট চালানো, লেখালেখি আর গনিত শাস্ত্র” (কনফুসিয়াসের কথোপকথন ,হেলাল উদ্দিন আহমেদ )
কিন্তু কিছুদিন পর কনফুসিয়াস চাকরী ছেড়ে দেন এবং পরবর্তী ষোল বছর নানা জায়গায় ঘুরে মানব জীবনের নানা জ্ঞান আহরণ করেন। এরপর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। সেকালের চীনে সমাজের নীচু স্তরের মানুষের সন্তানেরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। তিনি এই অব্যবস্থা দূর করতে ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসেন। কনফুসিয়াস চীনের বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রদূত ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি নৈতিকতা আর শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের ওপর জোর দেন। তিনি নিজে কাব্য চর্চা করতেন তার ছাত্রদেরও কাব্য চর্চায় উৎসাহ দিতেন। কবিতা,সংগীত আর চিত্রকলার প্রতি অনুরাগ ছিল খুবই বেশি। তিনি বলতেন শিল্পকলা মানুষের মনের কলুষতা দূর করতে সাহায্য করে। পরবর্তীতে দেখা যায় তার ছাত্রদের কেউ কেউ পরে লু প্রদেশের উচু পদেও অধিষ্ঠিত হয়। কনফুসিয়াস এক সময়ে কিছুদিন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
কিন্তু চার বছর পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যহতি নেন এবং শিষ্যদের নিয়ে চীন সাম্রাজ্য ভ্রমনে বেড়িয়ে পড়েন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তাঁর ছাত্ররা অনেক চেষ্টা করেন। মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে তিনি পুনরায় স্বদেশে ফিরেন। জীবনের বাকী দিন গুলিতে তিনি এখানেই শিক্ষাদান ও গ্রন্থ রচনার কাজে ব্যয় করেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি লু রাজ্যের বছর ওয়ারী ইতিহাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন।
“কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর তার ছাত্ররা তাঁর বাণী আর শিক্ষাপ্রণালীকে সংকলিত ও গ্রন্থভূক্ত করেন। আজ আমরা কনফুসিয়াস এনালেকটস (Confusias's Enalects) নামে যে গ্রন্থগুলি পাই তার কোনটি যে তার নিজের সংকলিত, সেই প্রমাণ নেই। বর্তমানে প্রচলিত তার বিশটি গ্রন্থ মোট ৪৯৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। তবে পন্ডিতমহলে অনুমোদিত কনফুসিয়াসবাদের” মোট তেরটি প্রামান্য গ্রন্থ আছে । (কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান । বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ)
সাধারণ মানুষ ছাড়া তৎকালীন রাজ পরিবারগুলোও তাঁকে সম্মান করতো। কারণ তাঁর চিন্তাভাবনা সাধারণ মানুষকে রাজদ্রোহী আচরণকে সংযমিত করতে সহায়তা করতো। কনফুসিয়াস মনে করতেন, নিচু স্তরের কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মান্য করবে, যেমনটা পুত্র তার পিতার কথা মান্য করে। আর এটা না করাটা হবে গুরুতর অপরাধ। তাঁর মতে, রাজাকে ভালো করে দেশ শাসন করতে হবে এবং সাধারণ অধিবাসীরাও রাজাকে মান্য করবে। বিভিন্ন অবস্থায় সামাজিক শ্রেণী ও পারিবারিক অবস্থান অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এইভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার প্রজাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের রীতিকে ঠিক মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সময় চীন যখন একটি একত্রীভূত হয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত হলো। তখন শাসকরা কনফুসিয়াসের মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে অনুকুল বলে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে চীনের রাজা তাঁর চিন্তাধারাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
কনফুসিয়াসের মূল্যবোধঃ
তৎকালীন প্রাচীন চীনে পড়াশুনার সুযোগ পেতো শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা। স্বশিক্ষিত কনফুসিয়াস এই প্রথা ভেঙে দেন। তিনি সমাজের সকল শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন। এক্ষেত্রে যে কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য দ্রব্য জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন। কনফুসিয়াস নিজের ছাত্রদের ভিতরে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক চিন্তাধারা প্রচার করেন। এবং তিনি এত গভীর নিষ্ঠার সাথে শিক্ষা দান করতেন যে, তিনি প্রায় তিন হাজার উল্লেখযোগ্য জ্ঞানী ব্যক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
“কনফুসিয়াস একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তাঁর জীবদ্দশায় চীনের একীভূত রাজ্যগুলো ভেঙ্গে অনেক ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভাঙনের ফলে তিনি তখনকার ‘লু’ রাজ্যের নাগরিক ছিলেন। উল্লেখ্য সেই আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে সমৃদ্ধতর ছিল। কনফুসিয়াস লু রাজ্যের সে ঐতিহ্যকে একটি উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন” (ইন্টারনেট)
কনফুসিয়াস ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ, নীতিবাদী ও মানবতাবাদী দার্শনিক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাস্ট্রের কল্যাণ সাধনই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। তিনি তার পূর্ববর্তীদের নীতিশাস্ত্র অধ্যায়ন করে সেগুলির ভিত্তিতে নিজস্ব দর্শন প্রচার করে গেছেন। প্রাচীন কালে যখন মানুষ নানারকম দেব-দেবীর মহাত্ম্য আলোচনায় মুখর থাকত, অতিপ্রাকৃত নানা শক্তির বন্দনায় আনন্দ পেত, তখন তিনি মানুষের মহত্ব প্রচার করেন।
সব ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কনফুসিয়াস পরিবারকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন পরিবারই নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক কেন্দ্র। পরিবারই সমাজ তথা রাষ্ট্রের মধ্যে সেতুবন্ধন। সকলেই যদি তাদের নিজস্ব দায়িত্ব আর অপরের প্রতি করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করে তবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুখশান্তি নিশ্চিত হতে পারে।
কনফুসিয়াস মতবাদে অসহিষ্ণুতার কোন স্থান নেই। এতে অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদকে আক্রমণ করা হয়নি। তার রাষ্ট্রীয় দর্শন অতি উদার। তার মতে রাষ্ট্র হলো একটি বিরাট পরিবার মাত্র। রাজাকে হতে হবে নীতিবান। তিনি কোন ক্রমেই ইশ্বরের প্রতিনিধি নন বরং তিনি জনগনের প্রতিনিধি। কনফুসিয়াস সেনাবাহিনীকে কম গুরুত্ব দিতেন। তার মতে, সেনাবাহিনী থাকবে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে। নারী-পুরুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন রক্ষনশীল মনোভাবের। তার মতে, পুরুষরা কাজ করবে বাইরে আর স্ত্রীর দায়িত্ব গৃহে।
কনফুসিয়াস পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন না। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের চাইতে ইহজগতের ভাল-মন্দই ছিল তার বিচার্যা। মানুষের ভাগ্য কেন ইশ্বর গড়ে দিবেন এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। মানুষকে তার নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়তে হবে-এটাই ছিল তার মতাদর্শ।
প্রচলিত অর্থে কনফুসিয়াস কোন ধর্ম প্রচারক ছিলেন না। তিনি সে দাবীও কখনওকরেননি। প্রচলিত কনফুসিয়াসবাদ তাই একটি দর্শন মাত্র। কনফুসিয়াসবাদের দর্শন আছে, শিক্ষাগ্রন্থ আছে, তবে কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। তবে তার শিক্ষাতেও প্রার্থনার ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে তিনি বর্জন করেন নি। অমরত্বের যেই ধারণা কনফুসিয়াসবাদে প্রচলিত, তাও একধরনের মানবতাবাদ- “মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত মানুষের সদগুণ আর সতকর্মই টিকে থাকে।”
চীনে পরবর্তীকালে তাওবাদ, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রসারে কনফুসিয়াস মতবাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কারন কনফুসিয়াসের শিক্ষার মাধ্যমে মতবাদগুলিতে প্রচারিত বিষয়ের সাথে চীনের মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ছিল ।
কনফুসিয়াস দর্শনে চৈনিক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রথাগত বিভিন্ন আয়োজনের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল ধর্মের বিশেষ প্রভাব। সেসব অনুষ্ঠানে মানুষ সামাজিক রীতিনীতি পালনের মাধ্যমেই তাদের উর্ধ্বতনের প্রতি একধরনের আনুগত্য প্রকাশ করতো এবং একই সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবদান প্রকাশ করতো তাদের অধস্তনের প্রতি।
কিন্তু কনফুসিয়াসের নৈতিক দর্শনের কোনোকিছুই ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত না হলেও তার লেখাগুলোর অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন আদব-কায়দা এবং শিষ্টাচারের উপদেশে পরিপূর্ণ। তিনি সর্বদা মানুষকে এ সকল সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। কারণ তিনি দেখতেন একমাত্র এসব আচার-অনুষ্ঠানে মানুষ প্রকৃতপক্ষেই সততা এবং নিষ্ঠার সাথে যার যার দায়িত্ব পালন করাকে। তৎকালীন চীনে অপরাধের শাস্তি দেয়া হতো ধর্মীয় বিধান অনুসারে। কিন্তু কনফুসিয়াস এ ব্যাপারে আরও উদার চিন্তা-ভাবনা করতেন। তিনি বলেন, “যা তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো না, তা তুমি অন্যের সাথে করো না”।
তিনি মনে করতেন আইনের শাসন দিয়ে মানুষকে শৃঙ্খলিত করা যায় না। কারণ আইন যত কঠোর, মানুষের তা ভঙ্গ করবার ইচ্ছা আরও বেশি প্রবল। অনেক ক্ষেত্রে হয়ত মানুষ আইনের দ্বারা ভীত হয়ে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে, কিন্তু এতে করে তার আত্মার উন্নয়ন ঘটবে না। কিন্তু মানুষ যখন ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরে আত্মার উন্নয়ন ঘটাবে, তখন মানুষ নিজে থেকেই অপরাধের পথ ছেড়ে দিয়ে নৈতিক জীবনযাপন করতে শুরু করবে।
কনফুসিয়াস জীবিত অবস্থায় চীনের অধিকাংশ রাজ্য তার রাজনৈতিক দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেননা এতে সে সময়কার চৈনিক অভিজাত পরিবারগুলো তাদের ক্ষমতা রক্ষা নিয়ে ব্যাপক শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল কনফুসিয়াসের নৈতিক দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে তাদের শোষণের সুযোগ কমে যাবে।
কনফুসিয়াসের স্মরণীয় ১০ টি উক্তিঃ
১। ভুল করায় লজ্জিত হয়ে তাকে অপরাধে রূপান্তরিত করো না।
২। প্ৰতিশোধের পথে যাওয়ার আগে দুটি কবর খুঁড়ে রেখে - একটি নিজের জন্য, অপরটি শত্রুর জন্য।
৩। আমি শুনি এবং ভুলে যাই, আমি দেখি এবং স্মরণ করি, আমি করি এবং বুঝি।
৪। নিজেকে শ্রদ্ধা কর, তাহলে অন্যেরাও তোমাকে শ্রদ্ধা করবে।
৫। যে কোনো পরিস্থিতিতে পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের চর্চা করলে নিখুঁত সদগুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এগুলো হলো- গাম্ভীর্য, আত্মার উদারতা, আন্তরিকতা, ঐকান্তিকতা ও দয়া।
৬। যা সঠিক তা দেখেও কিছু না করা হলো সাহস বা নীতির অভাব।
৭। আঘাতকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রতিদান দাও, আর দয়ার প্রতিদান দাও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে ।
৮। গুণী মানুষের প্রথম অগ্ৰাধিকার হলো বাধা আসলে তা অতিক্রম করা; সাফল্যের বিবেচনা পরে,
৯। তিনিই একজন পরিপূর্ণ মানুষ যিনি লাভের ক্ষেত্রে ন্যায্যতার কথা বিবেচনা করেন, বিপদে নিজের জীবন
বিসর্জন দিতে প্ৰস্তুত থাকেন এবং যতো পুরোনোই হোক অতীত সমঝোতার কথা ভুলে যান না।
১০। উত্তম মানবকে ক্ষুদ্র বিষয় দিয়ে বিচার করা যাবে না, কিন্তু বড় বিষয়ের দায়িত্ব দিয়ে তার উপর নির্ভর করা
যাবে। ক্ষুদ্র মানবকে বড় বিষয়ের দায়িত্ব দিয়ে বিশ্বাস করা যাবে না, কিন্তু ক্ষুদ্র বিষয়ের মাধ্যমে তাকে চেনা যাবে।
আমার নিজস্ব আত্মপোলদ্ধি ও পর্যালোচনাঃ
শিক্ষা বিষয়ে তাঁর ভাবনাগুলোও আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। জানা যায়, সমাজের সকল শ্রেণি থেকে তিনি শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন। এক্ষেত্রে যে কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য দ্রব্য জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন। কনফুসিয়াস নিজের ছাত্রদের ভিতরে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক চিন্তাধারা প্রচার করেন। এবং তিনি এত গভীর নিষ্ঠার সাথে শিক্ষা দান করতেন যে, তিনি প্রায় তিন হাজার উল্লেখযোগ্য জ্ঞানী ব্যক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় চীনের একীভূত রাজ্যগুলো ভেঙ্গে অনেক ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
এই ভাঙনের ফলে তিনি তখনকার লু রাজ্যের নাগরিক ছিলেন। উল্লেখ্য সেই আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে সমৃদ্ধতর ছিল। কনফুসিয়াস লু রাজ্যের সে ঐতিহ্যকে একটি উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা মারা যান। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্তমান চীনের সাংতুং প্রদেশে। মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। প্রাচীন চীনে পড়াশুনার সুযোগ পেতো শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা। স্বশিক্ষিত কনফুসিয়াস এই প্রথা ভেঙে দেন।
কনফুসিয়াস রাজ দরবারে অনেক সম্মানিত আসন থেকে বের হয়ে তিনি নেমে পড়েন রাস্তায়। প্রাসাদ থেকে একেবারে গাছতলায়। তার সঙ্গ নিয়েছিল তার একদল প্রিয় শিষ্য। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেই প্রিয় শিষ্যরা ছিলেন পাশে।
আজকের বাংলাদেশে যখন সবজায়গাতেই শিক্ষকদের নিয়ে জঘন্য সব কথা শুনি তখন বিশ্বের একজন সেরা শিক্ষক কনফুসিয়াস আমাদের জন্য অনেক প্রাসাঙ্গিক। আজকে আমরা দেখি কিভাবে একজন শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন দিক দিয়ে শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্রেফ অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট কেনার মহরা হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। ভালো শিক্ষক আছেন কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই কম যে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করার মতো জটিল কাজ সেটা।
আবার শিক্ষকদের উপর অবমাননার চিত্র প্রতিনিয়ত দেখা যায়। কয়েকমাস আগে শিক্ষকদের মান উপরে নয় কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে বেশ খোশ মেজাজে আছে দেশের কর্তাব্যক্তিরা। নারায়ণগঞ্জের একজন প্রধান শিক্ষককে কানে ধরে উঠবস করিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে দিলেন এমপি সাহেব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ক্যাডার ছাত্রদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
ব্যাপারগুলো এক পাক্ষিক নয়। বর্তমানে শিক্ষার এই দুরবস্থার জন্য শিক্ষক সমাজ বড় দায়ী। আবার শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের অমনোযোগও সমভাবে দায়ী। এই দ্বিমুখী দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বেশ হুমকিজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। এখন পাশের হার, জিপিএ ফাইভের হার যে গতিতে বাড়ছে অশিক্ষিতের হার বা অপশিক্ষিতের হার একই গতিতে বাড়ছে। সার্টিফিকেট অর্জন জীবনের চরম মুখ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে, সুশিক্ষা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র, মা-বাবা, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী সবাই মিলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী খেলায় মগ্ন।
শিক্ষার এই নিত্য নিম্নমুখী যাত্রার প্রাক্কালে দাড়িয়ে অতীতে ফিরে দেখতে চাচ্ছিলাম এমন শিক্ষক কি ছিলেন যাদেরকে ছাত্ররা মন থেকে সম্মান করতো, যাদের জ্ঞান সমকাল থেকে শুরু করে এখনো মানুষকে দিশা দিচ্ছে? মানবজাতির ইতিহাসে সেরা কয়েকজন শিক্ষকের তালিকাতে বেশ সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় কনফুসিয়াসের নাম।
কনফুসিয়াসের সাথে তার শিষ্যদের কেমন সম্পর্ক ছিল, কিভাবে তারা অনুসরণ করেছে ভালো-মন্দ সব সময়ে, কিভাবে একেবারে চরম দুঃসময়েও তার শিষ্যরা তাকে ছেড়ে যায়নি। বর্তমান বাংলাদেশে নানা দুরবস্থার জন্য অনেকে অনেক কিছুর দরকার বলে দাবি করেন। আমার কাছে মনে হয় এখন সমাজে সুশিক্ষার সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। চতুর্দিকে অপশিক্ষা, অশিক্ষা আর কুশিক্ষারই ছড়াছড়ি দেখি। এটা একেবারে রাষ্ট্রের ছোট্ট প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে শুরু করে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই ছড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় দেশ ও জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন শুরু করার জন্য একদল শিক্ষকের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। কনফুসিয়াসদের মতো শিক্ষকরা হতে পারে আমাদের আদর্শ।
কনফুসিয়াসের শিক্ষার একটা বড় দিক ছিল এটা একেবারে পরিবার থেকে শুরু। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসংহত ও সুন্দর সম্পর্ক থাকলে সবচেয়ে বড় পরিবার যে রাষ্ট্র সেখানেও সে বৃহৎ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের সাথে মিলে মিশে থাকতে পারবে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিবারের শিক্ষা বৃহৎ পরিবারে অনেক কাজে লাগে।
এজন্য একটা শিশু প্রথম বড় শিক্ষাটা পায় তার পরিবার থেকে। সেখানে বাবা-মার আচার আচরণ শিশুর জীবনে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখে। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর মন-মগজ-মনন ও চরিত্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকদেরকে অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা। এজন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে খুব সতর্কভাবে নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। কনফুসিয়াস বলেন ‘পচা কাঠে নকশাঁ করা যায় না’। এজন্য নষ্ট শিক্ষক, নষ্ট শিক্ষা কাঠামো থেকে বড় মানুষ, ভালো মানুষ বের হওয়া অনেক কঠিন।
নিজ জন্মভূমি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ফিরে খুঁজছিলেন সেই দার্শনিক সম্রাটকে। এ যেন প্লাতোর ‘ফিলসফার কিং’ খোঁজার প্রচেষ্টার সাথে তুল্য, বা চানক্যর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে অখন্ড ভারতের অধিপতি পাওয়ার আকাঙ্খার সাথে।
রেফারেন্সঃ
একশ মনিষীর জীবনী, মাইকেল এইচ. হার্ট
কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান । বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ
প্রাচীন চীনা দর্শন লাওসি ও কনফুসিয়াস,হেলাল উদ্দিন আহমেদ
কনফুসিয়াসের কথোপকথন ,হেলাল উদ্দিন আহমেদ
THE POLITICS BOOK; CAPTER – ANCIENT POLITICAL THOUGHT (PAGE 22 – 27)
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী; কনফুসিয়াস
সমাপ্ত
©somewhere in net ltd.