![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ (আইসিটি-২)
[১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনের ৬(১) ধারার অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল]
পুরনো হাইকোর্ট ভবন, ঢাকা বাংলাদেশ আইসিটি বাংলাদেশ কেস নং ০৫/২০১২
[অভিযোগ : ১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনের ৩(২) (এ) ও ৩(২) (সি) (আই) ধারায়
বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার]
প্রধান প্রসিকিউটর
বনাম
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু (পলাতক)
উপস্থিত বিচারকগণ : বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া, সদস্য বিচারক মোঃ শাহিনূর ইসলাম, সদস্য
রাষ্ট্রপক্ষে :
জনাব গোলাম আরিফ টিপু, প্রধান প্রসিকিউটর জনাব সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর জনাব শাহিদুর রহমান, প্রসিকিউটর আসামি (পলাতক) পক্ষে : জনাব আবদুস শুকুর খান, আসামির পক্ষে রাষ্ট্র-নিযুক্ত কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোট।
রায় ঘোষণার তারিখ : ২১ জানুয়ারি ২০১৩।
সংক্ষিপ্ত রায়
১. প্রারম্ভিক বক্তব্য
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি বস্তুত এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত যে বৈধভাবে গঠিত অন্যতম অভ্যন্তরীণ বিচারবিভাগীয় ফোরাম এ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-২) এর প্রথম রায় আজ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর আগে ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধসমূহ অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের ভূখন্ডে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার প্রসিকিউশন বিবেচনা করে বিচার কাজ স¤পন্ন করে। এর কার্যধারার সব পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ বিকশিত আইন বিজ্ঞান থেকে উদ্ধৃতি দানসহ একাডেমীর ও আইনগত দিকগুলো স¤পর্কে তাদের মূল্যবান যুক্তি তুলে ধরে প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা চালান। এটি অপরিহার্যভাবেই মামলার তথ্যগত দিকগুলোর পাশাপাশি আইনগত ইস্যুগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে আমাদের উৎসাহিত করেছে। আমরা তাদের তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টার প্রশংসা করার এ সুযোগ গ্রহণ করছি।
রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আমরা আসামির শাস্তিযোগ্যতা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ও প্রাসঙ্গিক পটভূমিকা, অপরাধগুলোর বর্ণনা দান, কার্যধারার সূচনা, সমগ্র কার্যধারার প্রতিফলন ঘটায় এমন পদ্ধতিগত ইতিহাস, সংক্ষেপে গঠন করা অভিযোগসমূহ এবং মামলাটিতে প্রযোজ্য আইনগুলো ছাড়াও কোন কোন ইস্যু তুলে ধরা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছি। পরে তথ্যগত দিকগুলোর পাশাপাশি আমরা প্রাসঙ্গিক আইনগত ইস্যুগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে এবং এরপর অভিযোগগুলো স¤পর্কে উপস্থাপিত সাক্ষ্য স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করেছি ও শেষ পর্যন্ত আসামির শাস্তিযোগ্যতা স¤পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেছি।
এখানে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন, অতঃপর ১৯৭৩ সালের আইন নামে অভিহিত) ১০(১) (জে) ধারা, ২০(১) ধারা এবং ২০ (২) ধারা অনুসারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ (আইসিটি-২) নামে অভিহিত এ ট্রাইব্যুনাল এতদ্বারা নিম্নলিখিত রায় প্রদান ও ঘোষণা করছে।
২। কার্যধারার সূচনা
১। প্রধান প্রসিকিউটর তদন্ত সংস্থার তদন্ত শেষ করার পর পেশ করা রিপোর্ট ও তদসঙ্গে সংযুক্ত দলিলপত্রের ভিত্তিতে ঐ ট্রাইব্যুনালের সমক্ষে ১৯৭৩ সালের আইনের ৯(১) ধারার অধীন ০২.৯.২০১২ তারিখে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল পদ্ধতি-বিধির (রুলস অব প্রসিডির-আরওপি) ২৯(১) বিধির আওতায় ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) (এ) (বি) (জি) (এইচ) ধারায় উল্লিখিত অপরাধগুলো আমলে নেয় এবং আরপির ৩০ বিধির চাহিদামতো আসামির হাজিরা নিশ্চিত করতে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু আসামি পলাতক থাকায় গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর করা যায়নি। এরপর পলাতক আসামির পক্ষ সমর্থনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কৌঁসুলি নিয়োগ করে তার অনুপস্থিতিতে তার বিচার করার আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে ট্রাইব্যুনাল
অভিযোগ গঠন বিষয়ে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এর ৪ নবেম্বর ২০১২ তারিখের আদেশবলে আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ গঠন করে।
৩। ঐতিহাসিক পটভূমিকা
২। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে নৃশংস ও ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধের ফলেই এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। বাঙালী জাতির নয় মাসের যুদ্ধ ও সংগ্রামকালে প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়, প্রায় ৫ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং এক কোটিরও বেশি লোক দেশে পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এসব অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার করা যায়নি এবং এটি দেশের রাজনৈতিক মানসিকতা ও সমগ্র জাতির মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। তারা বিচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ অবরুদ্ধ হয়, জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে এবং জাতির সংবিধান ধ্বংস হয়।
৩। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে অভিহিত ‘পগ্রম’ দিয়ে গণহত্যার শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী পুলিশ, সৈন্য ও সামরিক অফিসারদের নিরস্ত্র ও হত্যা করা, জাতীয়তাবাদী বাঙালী রাজনীতিক, সৈন্য ও সামরিক অফিসারদের গ্রেফতার ও হত্যা করা এবং পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের গ্রেফতার, হত্যা ও আটক করা।
৪। এক সংগঠন হিসাবে জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালী বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আধা-সামরিক বাহিনী (সহযোগী বাহিনী) গঠনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দান করে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার পথ ছিল কষ্টসাধ্যকর ও বন্ধুর এবং তা ছিল রক্তাক্ত, শ্রমসাধ্য ও আত্মত্যাগময়। সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত কোন জাতিই তাদের মুক্তির জন্য বাঙালীদের মতো এত চড়া মূল্য দেয়নি।
৪। আসামির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
৫। আসামি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু, পিতা- আবদুস সালাম মিয়া ও মাতা মৃত সাগফুরা খাতুন, গ্রাম-বড়ঘারদিয়া ( চোইআনি), থানা-সালতা, জেলা-ফরিদপুর। বর্তমান ঠিকানা-সেক্টর নং ০৭, রোড নং-৩৩, বাড়ি নং-০৬, থানা উত্তরা, ডিএমপি, ঢাকা এবং আজাদ ভিলা। ২৭৯/৬ চাঁনপাড়া, উত্তরখান, ঢাকা। ০৫.০৩.১৯৪৭ তারিখে বড় ঘারদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (আইসিএস) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। রাজাকার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু ফরিদপুরে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্য হিসেবে কথিত অপরাধমূলক তৎপরতা সংঘটনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছিলেন।
৫। পরিচিতিমুলক বক্তব্য
৬। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন) ১৯৭৩ সালে বিধিবদ্ধ ঘটনাপরবর্তী অভ্যন্তরীণ আইন। ১৯৭৩ সালের আইসিটিএকে ২০০৯ সালে সংশোধনের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণভাবে হালনাগাদ করার পর বর্তমান সরকার ট্রাইব্যুনালটি (১নং ট্রাইব্যুনাল) গঠন করে। ২নং ট্রাইব্যুনালটি ২০১২-এর ২২ মার্চ গঠন করা হয়। মূল আইনটিতে এবং এর ২২ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ট্রাইব্যুনালের প্রণীত আরওপিতে যে নিরপেক্ষতার ধারণা করা হয়, জাতীয় প্রয়োজনের নিরিখে সেই নিরপেক্ষতার মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংস নির্যাতনের শিকার এমন ব্যক্তিদের প্রতি এবং সমগ্র জাতির প্রতি দীর্ঘদিন যে ন্যায়বিচার করা হয়নি, তা জাতীয় প্রয়োজনের পর্যায়ে পড়ে।
৬। ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার
৭। ১৯৭৩ সালের আইনের লক্ষ্য হলো কেবল সশস্ত্র বাহিনী নয় সহযোগী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল এমন অপরাধীদের বা কোন ‘ব্যক্তি’ বা ‘দল’ হিসাবে অপরাধ সংঘটন করেছিল এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারি অভিযোগ আনা ও বিচার করা। আইনের কোথাও বলা হয়নি যে, সশস্ত্র বাহিনীর (পাকিস্তানী) বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ না এনে আইনটির ৩(১) ধারায় উল্লেখিত অন্য যে কোন শ্রেণীর ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা যাবে না। বরং ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(১) ধারা থেকে এটি ¯পষ্ট যে, এমন যে কাউকে (ব্যক্তি বা দল) ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে বিচারে সোপর্দ করা যেতে পারে, যদি তিনি অপরাধ বা অপরাধগুলোর জন্য অপরাধ সদৃশ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে দেখা যায়। এরূপে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালগুলো স¤পূর্ণভাবেই অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল, কিন্তু প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সংঘটিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধগুলোর বিচার করা সেগুলো গঠনের লক্ষ্য।
৭। পদ্ধতিগত ইতিহাস
৮। প্রাক-বিচার পর্যায়ে ১৯৭৩ সালের আইনের ৮(১) ধারার অধীনে গঠিত তদন্তকারী সংস্থা কার্যকর ও যথোচিত তদন্তের জন্য প্রধান প্রসিকিউটরের মাধ্যমে ২৫ মার্চ ২০১২ তারিখে এক আবেদন পেশ করে অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুকে গ্রেফতার করার নির্দেশ চায়। [আরওপির এ (১) ধারা] ট্রাইব্যুনাল আবেদনের শুনানি ও নিস্পত্তির জন্য ৩ এপ্রিল ২০১২ তারিখ ধার্য করে। আবেদন শুনানির পর আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি এটি কার্যকর করতে পারেনি, কারণ আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে বলে বুঝতে পেরে পলায়ন করেন। তবে প্রধান প্রসিকিউটর ১৯৭৩ সালের আইনের ৯(১) ধারার অধীনে এ ট্রাইব্যুনাল স¤পর্কে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেশ করার পর ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) (এ) (বি) (জি) (এইচ) ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলো আমলে নেয়া হয় এবং আরওপির ৩০ বিধি মোতাবেক আসামিকে হাজির হতে বাধ্য করার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১০. ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া চূড়ান্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পূর্বেই সে দেশ ত্যাগ করেছে বলে জানা গেছে। এ প্রেক্ষিতে আরওপির ৩১ বিধি অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে দুটি দৈনিক পত্রিকায় (একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজী) এই মর্মে একটি নোটিস প্রকাশের জন্য আবেদন প্রদান করেন যে, এ নোটিস যে দিন প্রকাশিত হবে সে দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে অভিযুক্তকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হবে। কিন্তু উক্ত নোটিস প্রকাশের পরও অভিযুক্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়নি।
১১. গত ৭ অক্টোরর ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে যে, এটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক অথবা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। সুতরাং তাকে গ্রেফতার কিংবা ট্রাইব্যুনালে হাজির করা যায়নি এবং তাকে শীঘ্র গ্রেফতারের সম্ভাবনাও নেই। এ প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আদেশ প্রদান করে যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতেই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ (সর্বশেষ সংশোধিত) এর ১০-এ(১) ধারা অনুযায়ী এবং একই সঙ্গে আরওপির ৩২ বিধি অনুযায়ী ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর সে মোতাবেক পলাতক অভিযুক্তের পক্ষে লড়তে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী আব্দুস শুকুর খানকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ১১ অক্টোবর সরকার নিয়োজিত এই কৌঁসুলি ট্রাইব্যুনালকে অবগত করেন যে, তিনি নিবন্ধকের অফিস থেকে আনুষ্ঠানিক চার্জের কপি পেয়েছেন যাতে সাক্ষীদের জবানবন্দী ও ডকুমেন্টস রয়েছে। এরপর ট্রাইব্যুনাল উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ২০১২ সালের ৪ নবেম্বর অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যাসহ আটটি ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগ গঠন করে।
৮. প্রযোজ্য আইন
১২. ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ট্রাইব্যুনাল গঠিত রুলস অব প্রসিডিউর ২০১২ অনুযায়ী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের আইনের ২৩ ধারা অনুযায়ী এটি ১৮৯৮ এবং ১৮৭২ সালের এভিডেন্টস এ্যাক্টের ফৌজদারি কার্যবিধি প্রয়োগে বাধাগ্রস্ত হবে না। সাধারণ বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী যেগুলো বোঝা যায় তা ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণের প্রয়োজন নেই (আইনের ১৯ (৪) ধারা অনুযায়ী)। আনুষ্ঠানিক প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ট্রাইব্যুনাল শ্র“তি সাক্ষ্যকেও বিবেচনায় নিতে পারে (৫৬(২) বিধি)। আসামিপক্ষের রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে জেরা করার অধিকার রয়েছে এবং তার দেয়া সাক্ষ্যের বিরোধিতা করতে পারেন।
১৩. প্রণীত আইন এবং আরওপি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনগত প্রক্রিয়া স¤পাদনের পর আসামিপক্ষের অনুপস্থিতিতে তার বিচারের শুনানি করার বিধান রয়েছে। এ আইন এবং আরওপি উভয় ক্ষেত্রেই বিবাদীর জন্য সর্বজনীন স্বীকৃত অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজে আন্তর্জাতিক কোন রেফারেন্স কিংবা প্রাসঙ্গিক রায় থেকে গাইডলাইন নিতে কোন বাধা নেই। জটিল কোন বিষয়ের মীমাংসা করতে ট্রাইব্যুনাল তার থেকে উদাহরণ টানতে পারে।
৯. উভয়পক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষীরা
১৪. শুনানিতে ২২ সাক্ষীর সবাইকে উপস্থাপন এবং তাদের সাক্ষ্য পরীক্ষা করা হয় যাতে সিজার উইটনেস হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষের ২১নং সাক্ষী এবং তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষের ২২নং সাক্ষী রয়েছেন। ১৩ কর্মদিবসে এই ২২ সাক্ষীর সাক্ষ্য পরীক্ষা ও জেরা স¤পন্ন করা হয়। আর এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালকে আবারও অবগত করেন যে, তিনি আসামির পক্ষে কোন সাক্ষীপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। কেন না আইনের ৯(৫) ধারা অনুযায়ী তিনি কোন সাক্ষীর নাম বা তালিকা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জমা দিতে পারেননি, অভিযুক্তের স্বজনরা সহযোগিতা না করায়।
এরপর ১৯৭৩ সালের আইনের ১০(১০) (১) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল শুনানির সারসংক্ষেপ উপস্থাপনের একটি তারিখ নির্ধারণ করে। তখন পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞ কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী এবং শহীদুর রহমান সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। এরপর বিবাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী কয়েকটি জটিল আইনগত বিষয়সহ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
১০. অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়া
১৫. সংশ্লিষ্ট এ মামলার সমর্থনে কৌঁসুলিরা যেসব প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন তা প্রধানত সাক্ষ্যভিত্তিক। ট্রাইব্যুনাল মনে করে রাষ্ট্রপক্ষের অধিকাংশ সাক্ষী যেসব ভয়ঙ্কর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তা তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং তাঁদের সাক্ষ্যে তার প্রভাব পড়তে পারে। তবে এ বাস্তবতা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাঙালী হিন্দু স¤প্রদায়ের ওপর যে ভয়ঙ্কর ও নৃশংসতা ঘটেছিল তার সত্যানুসন্ধানে ট্রাইব্যুনালের কাছে তাদের সাক্ষ্য অত্যন্ত মূল্যবান।
১৬. এদিকে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য যাদের অধিকাংশই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, আমাদের নির্ভর করতে হবে ১) সাধারণ বিচার বিবেচনা, ২) নিরস্ত্র হিন্দুদের ওপর হামলার পটভূমি, ৩) ডকুমেন্টার এভিডেন্স (যদি থাকে), ৪) প্রাসঙ্গিক ঘটনা, ৫) পারিপার্শি¦ক প্রমাণাদি ৬) ঘটনার সময়ে অভিযুক্তের রাজনৈতিক অবস্থান ৭) স্থানীয় পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে অভিযুক্তের যোগসাজশ এবং ৮) এই বিষয়ে বিকশিত আইন যদি তা অতীত প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১১। অভিযোগ প্রমাণের দায়
১৭। যে সব অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তার আলোকে রাষ্ট্রপক্ষের যে বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ১) অভিযোগে যে সব অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, ২) অভিযুক্ত কিভাবে অপরাধে জড়িত হয়েছে, ৩) ঘটনার সময়ে অভিযুক্তের অবস্থান ও ভূমিকা এবং পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করেছে, ৪) বেসামরিক নাগরিক এবং জনসংখ্যা একটি বিশেষ গ্র“পের ওপর নৃশংস হামলার পটভূমি।
১২। পটভূমি ও প্রসঙ্গ
১৮। বাঙালী জাতি ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৭১ সালে বর্বর নৃশংস ঘটনা ঘটে, যা বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীনতা লাভের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পর এবং তা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে, যখন পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তাদের অধিকাংশ পরে ফিরে আসে।
১৯. এই মামলা অনুসারে দেখা যায়, বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মে থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মধ্যে। ১৯৭১ সালের এই স্বাধীনতাযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, শান্তি কমিটি গঠন করা হয় পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে, যারা নৈতিক সমর্থন, সহায়তা এবং বস্তুগত সমর্থন দিয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের ওপর ভয়ঙ্কর নৃশংস হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছে।
২০. সাধারণ বিচারবুদ্ধি থেকেই এটা স্পষ্ট যে, সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে আক্রমণ পরিচালনার অংশ হিসেবে দেশজুড়ে হাজার হাজার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। আক্রমণের টার্গেট ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালী বেসামরিক জনতা, হিন্দু স¤প্রদায়, স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক গ্র“প, মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবীরা। অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু এগুলোর কোন কোনটির ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, যার মধ্যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা রয়েছে।
১৩. বিবেচ্য বিষয়সমূহ
২১. অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা প্রকৃত পক্ষে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কিনা তা বিচারের জন্য আমরা এসব বিষয় বিবেচনা করব যথা - (ক) অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই সময়ে রাজাকার (স্বেচ্ছাসেবী) বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন কিনা (খ) অপরাধ সংঘঠনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহায়তাকারী ছিলেন কিনা (গ) যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে যেমন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আওতায় পড়ে কিনা।
১৪. আলোচনা
আইনগত ইস্যুসমূহ
২২. অপরাধ বিচার স¤পর্কিত আমাদের আলোচনা শুরুর আগে আইনগত ইস্যুগুলো নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে যেসব বিষয় নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করার জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করি।
(ক) বিচারে দীর্ঘসূত্রতা
২৩. বিচার শুরুতে বিলম্ব করার অভিযোগ বাস্তবতা এবং আইনের নিরিখেও যুক্তিসঙ্গত নয়। ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এবং ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের কোন সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ স¤পর্কিত কনভেশনের অনুচ্ছেদ ১ এ স¤পর্কিত কোন সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ২৩৯১(২৩) নম্বর প্রস্তাবে কনভেনশনটি অনুমোদিত হয়। অতএব বিচার শুরুতে বিলম্ব করার অভিযোগটি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
২৪. উল্লেখিত মীমাংসাকৃত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিত এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনী সীমাবদ্ধতা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু বিচার শুরু করতে বিলম্ব হওয়াটা বিচার শুরু না করার কোন কারণ হতে পারে না। এ কারণে আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধীদের বিচার না করার পক্ষে কারণ হিসেবে দেখান যায় না। নিঃসন্দেহে, একটি দ্রুত ও অবিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়া ঘটনার শিকার ব্যক্তিবর্গের দুঃসহ স্মৃতি ও যন্ত্রণা পুরোপুরি না হলেও আংশিক উপশম করতে পারে। এর প্রয়োজন ছিল সরকারের যে ধরনের সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা তা অতীতে অনেক সময়ই পরিলক্ষিত হয়নি। যে কারণে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর করার ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটেছে।
২৫. দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভেঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধীদের আইনগত প্রক্রিয়ায় বিচার করা একটি বড় সাহসের কাজ। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মতে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়াকে এখন আর কোন রাষ্ট্রের অজুহাত হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গুরুতর অপরাধসমূহ কখনই পুরনো হয় না এবং এর সংঘটকদের অবশ্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আমাদের কখনই ঘটনার শিকার ব্যক্তিবর্গের দুঃসহ স্মৃতি ও যন্ত্রণা বিস্মৃত হওয়া উচিত হবে না। সুতরাং বিচার বিলম্বিত হলেই সবসময় বিচার অস্বীকৃত হয় না।
(খ) অনুপস্থিতিতে বিচারের বৈধতা
২৬. পলাতক থাকার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সশরীরে হাজির করা সম্ভব না হলে ১৯৭৩ সালের আইনে অনুপস্থিতিতে বিচারের সুযোগ রাখা হয়েছে, [ধারা ১০ক (১)]। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর উদাহরণ রয়েছে। নুরেমবার্গের ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে (আইএমটি) প্রথম এ ধরনের অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা হয়েছিল। আইএমটি চার্টারের ১২ অনুচ্ছেদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপীয় অক্ষ শক্তির অধীন যুদ্ধাপরাধীদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা হয়েছিল।
২৭. ২০০৬ সালে ¯েপশাল ট্রাইবুনাল ফর লেবাননের (এসটিএল বা লেবানন ট্রাইবুনাল) বিষয়ে জাতিসংঘ অনুপস্থিতিতে বিচারের নীতিটি প্রয়োগ করে। ওই আইনে অনুপস্থিত অভিযুক্তদের বিচার করা হয়েছিল।
২৮. প্রফেসর উইলিয়াম শাবাসের মতে, এসটিএলের ২২(১)(খ) অনুচ্ছেদ অনুপস্থিতিতে বিচারকে বৈধতা দিয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে হাজির না হলে বা তাঁকে হাজির করানো সম্ভব না হলে, বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর অভিযুক্ত উপস্থিত না হলে এবং কোনভাবেই উপস্থিত করা সম্ভব না হলে অভিযুক্তকে অনুপস্থিতিতে বিচার করা যায়।
২৯. অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর নামে প্রথমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি হাজিরা না দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন এবং পলাতক থাকেন। এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে তিনি বিচারের মুখোমুখি হওয়া এড়াতেই এটি করেছেন। এর ফলে আদালতে সশরীরে হাজির হলে তিনি যে আইনগত সুবিধাগুলো পেতেন তা বিসর্জন দিয়েছেন।
(খ) সংশোধনীর দ্বারা ‘ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিসংঘ’ কথাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা
৩০. এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনের ভূতাপেক্ষ সংশোধনীর প্রতি দৃষ্টি দিতে। এর মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
৩১. মূল আইনটি প্রণয়নের অভিপ্রায় এবং ধারা ৩(১)-এর মর্মার্থ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭(৩)-এ ১৯৭৩ সালের আইনকে যে সুরক্ষা দেয়া হয়েছিল তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়াও চলবে না। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল।
৩২. ২০০৯ সালে আইনের সংস্কার করা হয় যাতে ট্রাইব্যুনাল ব্যক্তিগত বা গ্র“পের সদস্য হিসেবে কোন অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারে। খুব যুক্তিসঙ্গতভাবে আইন সংস্কারের কারণও অনুধাবনযোগ্য। সংস্কারের উদ্দেশ্যই হচ্ছে জঘন্যতম এই অপরাধের সঙ্গে জরিতরা যাতে শাস্তি থেকে রেহাই না পায়। আইন সংস্কারের এটাই ছিল মূল চেতনা।
৪. ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর দায়মুক্তি
৩৩. ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(১) ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি অথবা সহযোগী বাহিনীর কোন সদস্যের সে বিচার সম্ভব ছিল না। একই কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে সে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায়। ত্রিপক্ষীয় ঐ চুক্তিটি ছিল ‘নির্বাহী আদেশ’ এবং কোন ‘সহযোগী বাহিনী’ অথবা কোন ‘ব্যক্তি’ অথবা কোন গ্র“পের ‘সদস্যর’ বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। পাকিস্তানী ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি বলে ক্ষমা করা হলেও ১৯৭৩ সালের আইনের প্রয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
৩৪. আইনের মূল চেতনাই হচ্ছে তার ভেতরকার উদ্দীপনা রক্ষা করা। সে কারণে কোন চুক্তির ফলে আইনের মূল চেতনা বা কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে না। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং ১৯৭৩ সালে আইন অবিচ্ছেদ্য এবং কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি নিছকই ‘নির্বাহী আদেশ’। এই নির্দেশের ফলে গোটা রাষ্ট্রের নৃশংস কর্মকান্ড সংগঠনকারীকেও বিচারের আওতা থেকে দায়মুক্তি দিতে পারে না। এই নির্বাহী আদেশ সংগঠিত অপরাধকারীদের বিচারের আওতা থেকে নিষ্কৃত্তি দেয় না।
৩৫. সে কারণে যে কোন চুক্তি যদি আইনের মূল চেতনার পরিপন্থী মনে হয় তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রের দায়ের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
৩৬. ১৯৭৩ সালের আইনের অর্থ হচ্ছে শুধুমাত্র ‘সেনা সদস্যদের’ বিচার ও শাস্তি দেয়া নয়। এই আইনের আওতায় এদের সহযোগী ‘এবং’ সহযোগী বাহিনীর সদস্যরাও বিচারযোগ্য। এই আইনের কোথাও লেখা নেই পাকিস্তানী সেনা বাহিনী ছাড়া আর কারও বিচার এই আইনে করা যাবে না। ধারা ৩(১) এর আওতায় সেনাবাহিনী বহির্ভূত কাউকে বিচার করা যাবে না এমন কথা উল্লেখ নেই।
৫. অভিযুক্তদের দালাল আইন ১৯৭২-এর আওতায় বিচার করা যেত। বর্তমান অভিযুক্তদের আগেই বিচার করা হলে তা হতো আইনবহি র্ভূত।
৩৭. অভিযুক্তদের আগেই ১৯৭২ সালের দালাল আইনে বিচার হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। এটাও সঠিক নয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যি অপরাধ করে থাকলে তার ১৯৭৩ সালের আইনেই বিচার হতো। অভিযুক্ত ব্যক্তির যদি ১৯৭২ সালের দালাল আইনে বিচার হতো এবং বর্তমানে ১৯৭৩ সালের আইনে বিচার হতো সেটি হতো ডকট্রিন অব ডবল জিওপার্ডি। যার অর্থ হচ্ছে- একই ব্যক্তির একই অভিযোগে দুইবার বিচার হতে পারেনা।
৩৮. ভয়াবহ অপরাধকারীদের সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ১৯৭২ সালের দালাল আইনের সূচনা হয়। অপরদিকে ১৯৭৩ সালের আইন করা হয়েছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও অন্যান্য পরিকল্পিত অপরাধের মাধ্যমে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিচার করার উদ্দেশ্যে এ আইনে ভিন্ন দুটি আইন মিলিয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই।
৩৯. ১৯৭২ সালের দালাল আইনের আওতায় অভিযুক্তর বিচার হয়নি বিধায় তার বিচার ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় বিচার করা চলবে না এমন যুক্তি মানা যায় না।
৬. অপরাধের সহযোগীদের ছাড়া অভিযুক্তকে বিচারে সোপর্দ করা যায় কিনাÑ
৪০. অভিযোগ অনুযায়ী জানা গেছে সশস্ত্র রাজাকার ও অন্য সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে অপরাধ সংঘটিত করেন। তবে তার অন্য সঙ্গীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি এটা সত্য। কিন্তু অর্থ এই নয় যে, হিন্দু স¤প্রদায়ের ওপর চালানো নির্যাতন মিথ্যা ছিল। তাদের ওপর চালানো মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা হয়নি? বা এর জন্য অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে কখনই দায়মুক্তি দেয়া হয়নি। অভিযুক্ত যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় এবং অপরাধকর্ম চালিয়েছে এমনটি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলে তার সহযোগীদেরও দায় নিতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ১৯৭৩ সালের ৪(১) ধারার কথা স্মরণ করিতে পারি।
৭. অপরাধের সংজ্ঞা ও উপাদান
৪১. আইসিটিএ ১৯৭৩ সালের ৩(২) ধারার স¤পর্কে বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলির ব্যাখ্যা নিয়ে আমরা একমত নই। আইসিটিএ ১৯৭৩ সালের ৩(২) ধারা অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এর আওতায় সম্ভব নয়।
৪২. আইনের ৩(২)(এ) ধারা স্বয়ংস¤পূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে স¤পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
৪৩. ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের’ সংজ্ঞা আইসিটিওয়াই ১৯৯৩ সালের ৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে।
৪৪. ১৯৭৩ সালের ৩(২)(এ) ধারায় বর্ণিত যে কোন বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত
অপরাধÑ বক্তব্যটি নির্দিষ্ট করে দেয় এই হামলার প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিল বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
৪৫. এক্ষেত্রে আমাদের ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যা কিনা অভ্যন্তরীণ বিচারিক সংস্থা যা পার্লামেন্টের বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় গঠন করা হয়েছিল এবং সেকারণে রোম স্টেটিউট মেনে চলতে বাধ্য নয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করতে গিয়ে কোন রোম স্টেটিউট মেনে চলতে আমরা বাধ্য নই।
৪৬. ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অধীনে সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এসব অপরাধ অবশ্যই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংগঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশীদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালানোর যে অভিযোগসমূহ বর্ণিত রয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
৪৭. বেসামরিক নাগরিকদের ওপর একটি হামলা মানেই হচ্ছে ৩(২) নম্বর ধারার (এ) নম্বর উপ-ধারায় অপরাধমূলক কার্যক্রম সংগঠিত করা। এ ধরনের হামলার অর্থই হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সরাসরি অপরাধ সংগঠিত করা। এগুলো পরিকল্পিত ও সংগঠিত হামলার বৈশিষ্ট্য বহন করছে।
৪৮. সুতরাং ১৯৭১ সালের এ্যাক্ট অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় আন্তর্জাতিক মান বজায় না থাকার যে অভিযোগ রয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই।
১৫. অভিযোগের বিচার
৪৯. সাত নম্বর অভিযোগটি হচ্ছে গণহত্যা যা এ্যাক্টের ৩(২)(সি)(আই) তে বর্ণিত আছে। ৭-এর বাকিগুলোও মানবতাবিরোধ অপরাধের অধীনে ক্রিমিনাল অপরাধ যা ৩(২)(এ) তে বর্ণিত রয়েছে।
৫০. সাক্ষীদের সাক্ষ্যে দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ে পি. ডব্লিউ ১৯-এর পিতাসহ হিন্দু গ্র“পকে টার্গেট করে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করাসহ যে জঘন্য অপরাধ সংগঠিত করা হয়েছে তা প্রমাণিত হয়েছে। একই সময়ে পি. ডব্লিউ ১৯ নম্বর সাক্ষ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, এসব জঘন্য অপরাধ সংগঠিত করা জন্য অভিযুক্তের একটি বাহিনী ছিল। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানোর জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি কিভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তাও জানতে পেরেছি। ১৯ নম্বর সাক্ষীর জেরা করার সময়ও এ সবকিছুই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি, মামলার বাদী পি. ডব্লিউ ১৬, সরকারী সাক্ষী ১৭, পি. ডব্লিউ ১৯ পি. ডব্লিউ ১৯ এবং পি.ডব্লিউ ১৯ ও পি. ডব্লিউ ২০ এর সাক্ষ্যের মাধ্যমে আসামির অপরাধের বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ১৬ ও ১৯ নম্বর সাক্ষী।
৫১. যে গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয় সেই গ্রামের হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করার এই কর্মকান্ডকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার গ্র“পের নীতিমালায় সমর্থনযোগ্য নয়। হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা, তাদের ওপর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড, লুটপাট, মানসিক নির্যাতন চালানোর মতো ঘটনাবলীসহ সবমিলিয়ে এই চিত্রই ফুটে উঠছে সংশ্লিষ্ট গ্রামের হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকদের ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিত বা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করা হয়েছে এবং এটা ইচ্ছাকৃত গণহত্যা, এতে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।
৫২. সাক্ষ্য-প্রমাণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সহযোগীরা ইচ্ছাকৃতভাবে স্থানীয় হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। হিন্দু স¤প্রদায়ের ১০ ব্যক্তিকে হত্যা করাসহ তাদের ওপর নির্যাতন চালানোসহ, কয়েক ব্যক্তিকে হত্যার ধরন দেখে দ্বিধাহীনভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে এটি ইচ্ছাকৃত গণহত্যা। গ্রামের যে এলাকায় হিন্দু স¤প্রদায়ের লোক বেশি বাস করত সেই এলাকাকেই হামলার জন্য বেছে নেয়া হয়।
৫৩. এটা অনুমেয় যে, নৃশংস হত্যাকান্ডের সময় অভিযুক্তের সরাসরি অংশগ্রহণ, হত্যাকান্ডে তার সহযোগিতা, উৎসাহ দেয়া ও গণহত্যায় সহযোগীদের নৈতিক সমর্থন দেয়ার কারণেই হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকদের ওপর গণহত্যা চালানোর মতো ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এসব অপরাধ ১৯৭১ সালের এ্যাক্টের ৩ (২)(সি)(আই) ধারায় সুনির্দিষ্ট গণহত্যামূলক অপরাধ।
৫৪. সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, ছিলেন রাজাকার বাহিনীর সদস্য। পাঁচ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুযায়ী তিনি এসব অপকর্মে সক্রিয়ই ছিলেন তা নয় তিনি নিজে পাঁচ নম্বর সাক্ষী রঞ্জিত নাথের ওপর নির্যাতন চালানো, বন্দী করে রাখা, অমানবিক সব কর্মকান্ড চালিয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে তিনি কেন পাঁচ নম্বর সাক্ষীকে টার্গেট করলেন। এর জবাবও সহজ, পাঁচ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুযায়ী ফরিদপুর সার্কিট হাউসে আর্মি ক্যাম্পে তিনি মুজাহিদকে (গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা) দেখতে পান। তাকে দেখেই মুজাহিদ তাকে বলে ওঠেন, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সে হিন্দু এবং পরে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু তাকে আটক করে।
৫৫. অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু অপহরণ, আটকে রাখা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের ৩(২)(এ) ধারার অধীনে অপরাধ সংগঠিত করেছে। এ ছাড়া তার এই অপরাধ ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের ২০(২) ও ৩(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া আবুল কালাম আজাদ যে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে সেটা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের ৪(১)ধারায়ও অপরাধ।
৫৬. ১৮ নম্বর সরকারী সাক্ষীকে অপহরণ করার ঘটনায় আবুল কালাম আজাদের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। ক্যাম্পে তার যাতায়াত এবং অন্যদের ওপর নির্যাতন চালানোর মতো ঘটনা এটা প্রমাণ করে না যে ১৮ নম্বর সাক্ষীর ওপর নির্যাতন চালানোর ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
৫৭. সেনাক্যাম্পে ১৮ নম্বর সাক্ষীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটেছে এটা প্রমাণিত। তবে মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে অভিযুক্ত আবুল কালাম ওরফে বাচ্চুই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ফলে সে ৪(১) ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হতে পারে না।
৫৮. এক নম্বর সাক্ষী ও তিন নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে, আবুল কালাম আজাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল এবং তার ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ ছিল। তিনি ওই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতি অনুসরণ করে হামলা চালানোর লক্ষ্য নিয়ে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে এক নম্বর ও তিন নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যকে নস্যাত করার মতো কোন যৌক্তিক কারণ আমরা দেখি না।
৫৯. আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু ১৯৭১ সালে সুধাংশু মোহন রায়কে হত্যা করে ক্রিমিনাল কাজ করেছেন যা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের ৪(১) ধারায় অপরাধযোগ্য। এছাড়া তিনি ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের ৩(২) ধারায়ও তার অপরাধ সুনির্দিষ্ট এবং এ্যাক্টের ৩(১) ধারায়ও তার অপরাধ শাস্তিÍযোগ্য।
৬০. ছয়, আট ও ১০ নম্বর সাক্ষী যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার মধ্যে মাধব চন্দ্র বিশ্বাস ও গ্যানেন্দ্র মন্ডলকে হত্যা করার যথেষ্ট আলামত রয়েছে এবং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। অপরাধ সংগঠনের সময়, ধরন ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে দেখা যায় যে, এসব অপরাধ আবুল কালাম আজাদ ও তার সহযোগীরা ঘটিয়েছে। বাচ্চুর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের সমর্থক মাধব চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। মাধব চন্দ্রকে টেনেহেঁচড়ে ১০ নম্বর সাক্ষীর পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে বাচ্চুই তাকে গুলি করে হত্যা করে। এর পরে বাচ্চু গ্যানেন্দ্র মন্ডলকে একই স্থানে গুলি করে হত্যা করে। হিন্দু গ্রামকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হত্যা করা হয়।
৬১. ৪নং অভিযোগে বর্ণনা করা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সরাসরি অপরাধ বা হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছেন। আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী এটা ব্যক্তিগত অপরাধের মধ্যে পড়ে। অভিযোগ নং ৪ অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। এটা আইনের ৩(১) ধারায় পঠিত এবং ২০(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।
৫নং অভিযোগের বিচার: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (দেবী রানী ও শোভা রানীকে ধর্ষণ)
৬২. ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে সশস্ত্র হামলাকারীদের সঙ্গে অংশীদার হওয়া ও তাদের শোভা রাণীর ঘরে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনাই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ। এটা মনে রাখতে হবে যে, ওই পরিস্থিতিতে ধর্ষণের মতো একটা ঘটনা ঘটাই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
৬৩. এই অবস্থা বা প্রেক্ষিত বলে দেয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র হামলাকারীদের সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের পরিকল্পনা ও নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ কাজ করা হয়েছে। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানপন্থী সংগঠনের প্রধান সহযোগী সংগঠন এ কাজ করেছে। তাদের আক্রমণ ও কাজের ধরন এটাই নির্দেশ করে যে, দুর্বৃত্ত চক্র সংখ্যালঘু হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়িঘর ও বেসামরিক লোকজনের একটি অংশকে লক্ষ্য করে হামলা পরিচালনা করেছিল। অপরাধ সংঘটনের সময় ওই স্থানে আসামি ও তার সহযোগী ছাড়া অন্য কোন পুরুষ লোক ছিল না। এটাই এলাকার মহিলাদের বিপদের কারণ হয়ে দাড়ায়। একপর্যায়ে আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে শোভা রানীর ঘরে ঢুকে পড়েন। এ ঘরেই আটকে রাখা হয়েছিল কয়েকজন মহিলাকে। বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী ঘরের মধ্যে অবস্থানকালে তাঁর কয়েকজন সহযোগী ঘরের বাইরে অবস্থান করে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে। এ থেকে আমরা নির্দ্বিধায় বিবেচনা এবং লিপিবদ্ধ করতে পারি যে, ওই সময় ক্ষতিগ্রস্তরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ষণ সংঘটনের মতো অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। আর এ ধরনের কাজ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, বিশেষ করে আইনের ৩(২)(এ) ধারার পরিপন্থী।
৬৪. ৪নং অভিযোগে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ধর্ষণের অপরাধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী তিনি ব্যক্তিগতভাবে অপরাধের জন্য দায়ী। অভিযোগ নং-৫-এ বলা হয়েছে, অপরাধ সংঘটনের জন্য বাচ্চু রাজাকার দায়ী। এটা আইনের ৩(১) ধারায় পঠিত এবং ২০(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।
৫নং অভিযোগের বিচার: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (চিত্র রঞ্চন দাসকে হত্যা)
৬৫. প্রসিকিউশনের ২নং, ৪নং ও ৯নং সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্য থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকার দল ফুলবাড়িয়া গ্রামে হামলা ও বর্বর কর্মকান্ড পরিচালনা করে। আর ওই তারিখে তাদের পরিচালিত বর্বরতার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বেসামরিক লোকদের ওপর পরিচালিত ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে তাদের কর্মকান্ডের ইচ্ছা সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়। এটা প্রতিষ্ঠিত যে তাদের ধ্বংসাত্মক ও বর্বর কর্মকান্ডের কারণে চিত্র রঞ্জন এবং বাদল দেবনাথ নিহত হয়েছেন। তারা ঘরবাড়ি লুট করেছেন। প্রসিকিউশনের ২নং সাক্ষীসহ ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্ভোগে পড়া ব্যক্তিরা বাড়িঘর ও সম্পদ রেখে দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমরা এটাও বুঝতে পেরেছি সশস্ত্র রাজাকার গ্রুপের নেতা হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি সরাসরি অপরাধ সংঘটিত করেছেন। ঘটনাটি ভয়াবহ এবং মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশনের মারাত্মক লঙ্ঘন।
৬৬. এটা প্রমাণিত যে, অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার সরাসরি সশস্ত্র সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত করেছেন।
হিন্দু স¤প্রদায়ের বেসামরিক লোকদের ওপর হামলার অংশ হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির নেতৃত্বে সহযোগীরা অপরাধ সংঘটিত করে। আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ব্যক্তিগতভাবে দায় এড়াতে পারেন না। তিনি হত্যার মতো অপরাধ সংঘটনের জন্য দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। তাঁর কর্মকান্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিশেষ করে আইনের পরিপন্থী। আইনের ৩(১) ধারায় পঠিত ২০(২) ধারা অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য।
৮নং অভিযোগের বিচারঃ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (অঞ্জলী দাসকে অপহরণ ও নির্যাতন)
প্রসিকিউশনের ১১নং ও ১২নং সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে, ঘটনার তারিখে অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার সশস্ত্র সহযোগীদের নিয়ে অঞ্জলী দাসের বাড়িতে আক্রমণ করে এবং মৌখিক বাধা উপেক্ষা করে জোরপূর্বক অঞ্জলী দাসকে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনা বলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সরাসরি এই অপহরণের কাজে অংশ নেন।
৬৮. এ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, অঞ্জলী দাসকে আটকে রাখার কাজে অভিযুক্ত বাচ্চু রাজাকার স্বজ্ঞানে সহযোগিতা করেছেন।
৬৯. একই সময় এ বিষয়টিও বৈধভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাকে এভাবে ৭-৮ দিন আটকে রাখা কোনভাবেই আইনের মধ্যে পড়ে না। প্রসিকিউশনের ১২নং সাক্ষীর মতে, ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাকে যৌন নিপীড়নসহ মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। আর এজন্যই তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
৭০. পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নীতি ও পরিকল্পনা মতে অভিযুক্ত ব্যক্তি হিন্দু স¤প্রদায়ের ওপর ও বেসামরিক নাগরিকদের একটি অংশের ওপর হামলা চালান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে এ অপরাধ সংঘটিত হয়। এ কারণে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার আইনের ৪(১) ধারায় ব্যক্তিগত অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। আইনের ৩ (২) ধারা অনুযায়ী তিনি অপহরণ,আটক, নির্যাতনের দায়ে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। আইনের ৩(১) ধারায় পঠিত ২০(২) ধারা মতে এটা শাস্তিযোগ্য।
১৬. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বিরাজমান প্রেক্ষিত
৭১. বস্তুত এটাই ইতিহাস যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার সহযোগী বাহিনী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ ভূখন্ডে বর্বর কর্মকান্ড পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্যগুলো নিম্নরূপ:
* তাদের লক্ষ্য ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে বিশ্বাসী বেসামরিক বাংলাদেশী
* উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক, সামরিক কর্তৃপক্ষ, সামরিক সম্পদ
* লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সহকারী বাহিনী গঠন।
* প্রতিদিন ও অব্যাহতভাবে বেসামরিক লোকদের ওপর ভয়াবহ ধরনের অত্যাচার চালানো
৭২. উপরে উল্লেখিত তাদের লক্ষ্যগুলো ব্যাপকভাবে শুধু সকলের জানাই নয়; এটা নিয়ে কোন বিতর্কও নেই। উপরে বর্ণিত তাদের লক্ষ্যই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যাপ্ত প্রমাণ। এটা ১৯৭৩ সালের ৩(২)(এ) ধারায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সরাসরি পরিকল্পিত আক্রমণের অপরিহার্য পরিণতির বিষয়টিরও বর্ণিত আছে। ব্লাসকিক (আই টিওয়াই) ট্রাইল চেম্বারের রায়েও এ বিষয়টির সমর্থন মেলে।
৭৩. আইনগতভাবে এটি ধরে নেয়া যায় যে ১৯৭৩ সালের আইনে উল্লিখিত, ‘যে কোন বেসামরিক মানুষ লক্ষ্য করে’ শব্দগুচ্ছ প্রমাণ করে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত বহু ‘ধারাবাহিক’ অপরাধ ছিল বেসামারিক লোকজনের বিরুদ্ধে।
৭৪. ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমসে প্রকাশিত এ্যান্টোনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হচ্ছে না,’ পূর্ববাংলা সম্পর্কিত সরকারের নীতি সম্পর্কে আমার মনে হচ্ছে এর তিনটি উপাদান রয়েছে
(১) বাঙালীরা নিজেদের ‘অনির্ভরযোগ্য’ প্রমাণ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবশ্যই তাদের শাসন করা উচিত।
(২) বাঙালীদের অবশ্যই ইসলামী পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া উচিত । এই পরিভাষাটি পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত।
(৩) হিন্দুদের নির্মূল করার তাদের সম্পত্তি মুসলমানরা দখল করে নিতে পারবে।
১৭. উপসংহার
৭৫. সাক্ষীদের প্রমাণিত হয়েছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সশস্ত্র রাজাকার সদস্য হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে অপরাধ সংঘটন করেছেন। ১৯৭৩ সালের আইনের ধারা ৩(১) অনুযায়ী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু ধারা ৩(২) এ উল্লিখিত অপরাধ সংঘটন করেছেন।
৭৬. ১৯৭৩ সালের আইনের ধারা ৪(১) অনুযায়ী এসব অপরাধ সরাসরিভাবে সংঘটনের জন্য যে কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী। চাই সে অপরাধ এককভাবে করুক অথবা যৌথভাবে।
৭৭. অভিযুক্তকে কেবলমাত্র অনুপস্থিত হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তিনি একজন পলাতক অভিযুক্ত। যেসব অভিযোগের দায় তার বিচার হচ্ছে তা থেকে সজ্ঞানে পালিয়ে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে আইন তাকে যেসব সুবিধা দিত সেগুলো তিনি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেছেন। এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পৃথকভাবে তিনি আরেকটি অপরাধ করেছেন।
৭৮. অতএব পলাতক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলো।
১৮. অভিযোগের দন্ড
৭৯. আদালতের কাছে উপস্থাপিত যুক্তি এবং সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
অভিযোগ ১ : দোষী : অপহরণ করা, বন্দী করা ও নির্যাতন করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা ৩(২)(ক) অনুসারে তিনি অভিযুক্ত এবং ধারা ২০(২) অনুসারে দন্ডপ্রাপ্ত।
অভিযোগ ২ : নির্দোষ : অপহরণ করা, বন্দী করা ও নির্যাতন করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তাকে এ অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়া হলো।
অভিযোগ ৩ : দোষী : আইনের ধারা ৩(২)(ক) অনুসারে তিনি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং ধারা ২০(২) অনুসারে দন্ডপ্রাপ্ত।
অভিযোগ ৪ : দোষী : আইনের ধারা ৩(২)(ক) অনুসারে তিনি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং ধারা ২০(২) অনুসারে দন্ডপ্রাপ্ত।
অভিযোগ ৫ : দোষী : আইনের ধারা ৩(২)(ক) অনুসারে তিনি ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত এবং ধারা ২০(২) অনুসারে দন্ডপ্রাপ্ত।
৬নং অভিযোগ : আইনের ৩(২)(এ) ধারায় বর্ণিত ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং তিনি আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী দন্ড ভোগ করবেন।
৭নং অভিযোগ : আইনের ৩(২)(সি)(১) ধারা অনুযায়ী হিন্দু স¤প্রদায়ের সদস্যদের হত্যার জন্য গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী দণ্ড ভোগ করবেন।
৮নং অভিযোগ : অপহরণ, আটক ও নির্যাতন যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যা আইনের ৩(২)(এ) ধারায় বর্ণিত হয়েছে। আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী তিনি দোষী সাব্যস্ত এবং দন্ডিত হবেন।
১৯. দন্ডাদেশ
৮০. গণহত্যা, খুনের অপরাধকে আমরা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে, যা বিশেষভাবে মানবজাতির বিবেককে আঘাত করেছে। আমরা এ বিষযে একমত হলে, ১৯৭৩ সালের আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর বিরুদ্ধে যদি একটি মৃত্যুদন্ডের রায়ও দেয়া হয় তাহলে তাতে ন্যায়বিচার হবে।
৮১. আমরা আরও অভিমত পোষণ করি যে, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর অপরাধের যে ব্যাপকতা তাতে তাকে যদি কারাদন্ড দেয়া হয় তা হলে তার অপরাধের তুলনায় তা হবে লঘু শাস্তি।
অতএব এই আদেশ দেয়া হলো যে, অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু পিতা মৃত আব্দুল সালাম মিয়া ও মাতা মৃত মাওফুরা খাতুন, গ্রাম বড়খারদিয়া (চইআনি), থানা-সালথা, জেলাÑফরিদপুর, বর্তমান সেক্টর নং-০৭ সড়ক নং-৩৩, বাড়ি নং-০৬, থানা উত্তরা, ডিএমপি, ঢাকা এবং আজাদ ভিলা, ২৭৯/৬ চনপাড়া, উত্তরখান, ঢাকা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন (৩, ৪ ও ৬নং অভিযোগ) এবং গণহত্যার অপরাধে (৭ নং অভিযোগ) দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দেয়া হলো।*
রায় ইংরেজি ভাষায় দেয়া হয়েছে।
উৎস : -
জনকন্ঠে (২২ জানুয়ারি ২০১৩) রায়ের এই বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
©somewhere in net ltd.