![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংক্ষিপ্ত রায়ের পূর্ণ বিবরণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ (আইসিটি)
১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনের ৬(১) ধারার অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল পুরনো হাইকোর্ট ভবন ঢাকা বাংলাদেশ
আইসিটি-বাংলাদেশ কেস নং ০২/২০১২
[অভিযোগ : ১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ) ধারায় বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন এবং অপরাধসমূহ সংঘটনে সহায়তা করা ও জড়িত থাকা]
প্রধান প্রসিকিউটর
বনাম
আবদুল কাদের মোল্লা
উপস্থিত বিচারকগণ :
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, চেয়ারম্যান
বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া, সদস্য
বিচারক মোঃ শাহিনূর ইসলাম, সদস্য
রাষ্ট্রপক্ষে :
জনাব গোলাম আরিফ টিপু, প্রধান প্রসিকিউটর
জনাব মোহাম্মদ আলী, প্রসিকিউটর
আসামি পক্ষে :
জনাব আবদুর রাজ্জাক, সিনিয়র এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
জনাব একরামুল হক, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
জনাব আবদুস সোবহান তরফদার, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
জনাব তাজুল ইসলাম,্ এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
জনাব ফরিদ উদ্দিন খান, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
জনাব সাজ্জাদ আলী চৌধুরী, এ্যাডভোকেট
রায় ঘোষণার তারিখ : ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
রায়ের পূর্ণ বিবরণের সংক্ষিপ্ত সার
[১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনের ২০(১) ধারার অধীনে]
১। প্রারম্ভিক বক্তব্য
১। এ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-২), বৈধভাবে গঠিত অন্যতম অভ্যন্তরীণ বিচারবিভাগীয় ফোরাম কথিত অপরাধগুলোর দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিচার অনুষ্ঠানের পর এক মামলায় এর সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর আগে ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধসমূহ অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের ভূখ-ে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রসিকিউশন বিবেচনা করে বিচারকাজ সম্পন্ন করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ আইসিআই কর্তৃক এ মামলায় রায় প্রদান বাস্তবিক পক্ষেই এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর কার্যধারার সব পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ বিকশিত আইনবিজ্ঞান থেকে উদ্ধৃতিদানসহ একাডেমিক ও আইনগত দিকগুলো সম্পর্কে তাদের মূল্যবান যুক্ত তুলে ধরে প্রশংসনীয় কঠোর প্রচেষ্টা চালান। এটি মামলার তথ্যগত দিকগুলোর পাশাপাশি এতে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আইনগত ইস্যুগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে স্বভাবতই আমাদের উৎসাহিত করেছে। আমরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার প্রশংসা করার এ সুযোগ গ্রহণ করছি।
রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আমরা আসামির শাস্তিযোগ্যতা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ও প্রাসঙ্গিক পটভূমিকা, অপরাধগুলোর বৈশিষ্ট্য, কার্যধারার সূচনা, সমগ্র কার্যধারার প্রতিফলন ঘটায় এমন পদ্ধতিগত ইতিহাস, সংক্ষেপে গঠন করা অভিযোগসমূহ এবং মামলাটিতে প্রযোজ্য আইনগুলো ছাড়াও কোন কোন ইস্যু তুলে ধরা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছি। পরে তথ্যগত দিকগুলোর পাশাপাশি আমরা প্রাসঙ্গিক আইনগত ইস্যুগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করেছি এবং এরপর অভিযোগগুলো সম্পর্কে উপস্থাপিত সাক্ষ্য স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা ও মূল্যায়ন করেছি।
এক্ষণে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন) ১০(১) (জে) ধারা, ২০(১) ধারা ও ২০(২) ধারা অনুসারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ (আইসিট-২) এতদ্দ¦ারা নিম্নলিখিত সর্বসম্মত রায় প্রদান ও ঘোষণা করছে।
২। কার্যধারার সূচনা
১। ২০১১-এর ১৮ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আসামি আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের ৯(১) ধারার বিধানমত পিটিশনের আকারে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে। আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজনীয় সুযোগ দানের পর ট্রাইব্যুনাল কার্যপ্রণালী বিধিমালার অতঃপর ‘আরওপি’ বলে অভিহিত) ২৯(১) বিধির অধীনে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২)(এ)(বি)(জি) (এইচ) ধারায় বর্ণিত অভিযোগগুলোকে আমলে নেয়।
২। উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনা এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র, দলিলপত্র ও সাক্ষীদের বিবৃতি পাঠ করার পর ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২)(্এ) ধারায় বর্ণিত ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ সংঘটন বা বিকল্প হিসেবে ঐ আইনের ৩ (২)(এ) (জি) (এইচ) ধারায় বর্ণিত এরূপ অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অপরাধ সংঘটন সম্পর্কিত ছয়টি অভিযোগ গঠন করে। এরূপে গঠিত অভিযোগগুলো আসামি আবদুল কাদের মোল্লাকে প্রকাশ্য আদালতে পড়ে শোনানো এবং ব্যাখ্যা করা হয়।
৩। পরিচিতিমূলক বক্তব্য
৩। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন (১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইন) (অতঃপর ১৯৭৩ সালের আইন বলে অভিহিত ১৯৭৩ সালে বিধিবদ্ধ ঘটনাপরবর্তী অভ্যন্তরীণ আইন। ১৯৭৩ সালের আইসিটিএকে ২০০৯ সালে সংশোধনের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণভাবে হালনাগাদ করার পর বর্তমান সরকার ২০১০-এর ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল (১নং ট্রাইব্যুনাল) গঠন করে। ২নং ট্রাইব্যুনাল ২০১২-এর ২২ মার্চ গঠন করা হয়। মূল আইনটিতে এবং এর ২২ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ট্রাইব্যুনালগুলোর প্রণীত কার্যপ্রণালী বিধিমালায় (আরওপিতে) যে নিরপেক্ষতার ধারণা করা হয়, জাতীয় প্রয়োজনের নিরিখে সেই নিরপেক্ষতার মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এমন ব্যক্তিদের প্রতি এবং সমগ্র জাতির প্রতি দীর্ঘদিন যে ন্যায়বিচার করা হয়নি, তা জাতীয় প্রয়োজনের পর্যায়ে পড়ে।
৪। বাংলাদেশ সরকার আইসিসিপিআর (ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট ফর সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস) এবং এর অপশনাল প্রটোকল স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে। একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৭৩ সালের আইসিটি-এর (আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩) বিধানাবলী এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা আইসিসিপিআর-এর ১৪ অনুচ্ছেদের আওতায় আসামিকে প্রদত্ত অধিকারসমূহের সঙ্গে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে এমন সব সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত রক্ষা কবচের মান নিশ্চিত করার গুণ ও পদ্ধতি বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে রয়েছে।
৪। ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার
৫। ১৯৭৩ সালের আইনের উদ্দেশ্য ছিল কেবল সশস্ত্র বাহিনীকেই নয়, সহায়ক বাহিনীর সদস্য ছিল এমন অপরাধীদের বা যারা কোন ব্যক্তি বা কোন দল হিসেবে অপরাধ সংঘটন করেছিল এমন ব্যক্তিদের অভিযুক্ত বিচার ও শাস্তি দান করা। আইনটির কোথাও বলা হয়নি যে, সশস্ত্র বাহিনীকে (পাকিস্তানী) অভিযুক্ত না করে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ (১) ধারায় বর্ণিত অন্য শ্রেণীর ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণকে অভিযুক্ত করা যাবে না। এরূপে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণরূপেই অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ ভূখ-ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সংঘটিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধগুলোর বিচার করা। ট্রাইব্যুনাল শব্দটির সামনে ‘আন্তর্জাতিক’ কথাটি লেখা রয়েছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তি বিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধগুলোর ওপর ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার রয়েছেÑ কেবল এ কারণে ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই ‘এক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল হিসেবে অবশ্যই গণ্য করতে হবে বলে ধরে নেয়া ভুল হবে।
৫। সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমিকা
৬। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে নৃশংস ও ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধের ফলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। বাঙালী জাতির ৯ মাসের যুদ্ধ ও সংগ্রামকালে প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়, প্রায় ৫ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং এক কোটিরও বেশি লোক দেশে পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এসব অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার করা হয়নি। এবং এটি দেশের রাজনৈতিক চেতনা ও সমগ্র জাতির মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়।
৭। অবিতর্কিত ইতিহাসে দেখা যায় যে, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সরকার এই বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি সম্মান দেখায়নি। ফলে পাকিস্তানের এ অংশের ভূখ-ে আন্দোলন শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো না হলে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করার আহ্বান জানান। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট হামলা শুরু করার পর ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
৮। যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আহ্বান সর্বান্তকরণে সমর্থন করে ও এতে অংশ নেয়। কিন্তু ক্ষুদ্র সংখ্যক বাঙালী, বিহারী, অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী এবং কিছুসংখ্যক বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষত, জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ (আইসিএস), মুসলীম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব হিংসাত্মক পথে প্রতিহত করতে পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় এবং/অথবা সহযোগিতা করে এবং তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে নৃশংস অপরাধ সংঘটন করে অথবা সংঘটনে সহযোগিতা করে। ‘ইসলামী ছাত্রসংঘের খাঁটি কর্মীদের আলবদর, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলামী ইত্যাদির সাধারণ দেশপ্রেমিক লোকজনকে আলশামস এবং বিহারী নামে সাধারণভাবে পরিচিত উর্দুভাষীদের আল মুজাহিদ বলা হতো।’
উৎস : ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী লিখিত ‘সানসেট এট মিডডে’ (প্রদর্শনী-২), কিরতাস পাবলিকেশন্স, করাচী, পাকিস্তান, ১৯৯৮)
৯। জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালী বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসব আধা-সামরিক বাহিনী (সহায়ক বাহিনী) গঠনে উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করেছিল।
ফক্স বাটারফিল্ড ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলেন যে, আলবদর গত মার্চে পাকিস্তানী দমন অভিযান শুরুর পর জামায়াতে ইসলামীর সুসংগঠিত যুদ্ধবাহিনী ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। [উৎস : বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ভলিউম-২, পৃষ্ঠা ৫৭৭, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দিল্লী]। নিঃসন্দেহে বাঙালী জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণের পথ ছিল শ্রমসাধ্য, রক্তাক্ত, সংগ্রামবহুল ও আত্মত্যাগপূর্ণ। বাঙালী জাতি এর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য যে চরম ত্যাগ স্বীকার করেছিল বর্তমান যুগের বিশ্ব ইতিহাসে কোন জাতি তা সম্ভবত করেনি।
১০। ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের লড়াইয়ের পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ইসলামপন্থী দলের সমর্থন লাভ করেছিল। সেগুলোর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, যার এমন একটি ছাত্র সংগঠন ছিল, সেটি আলবদর নামে অভিহিত এক সেনাবাহিনীপন্থী, আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করেছিল। [উৎস : ইকোনেমিস্ট : ১ জুলাই, ২০১০]।
১১। জেইআই ও অন্য পাকিস্তানপন্থী রাজনৈকি দলগুলোর বৈরী ও নৃশংস ভূমিকা সম্পর্কে উপরোক্ত ঐতিহাসিক সত্য সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(১) ধারায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূখ-ে সংঘটিত নৃশংস ঘটনায় কোন সংগঠনের দায় সম্পর্কে নীরব রয়েছে।
৪। আসামির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
১২। আসামি আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানায় আমিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের বিএসসির (ব্যাচেলর অব সায়েন্স) ছাত্র থাকাকালে জামায়াতে ইসলামীর (জেইআই) ইসলামী ছাত্র সংগঠন নামে অভিহিত ছাত্র সংগঠনে যোগ দেন এবং সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সলিমুল্লাহ হল শাখার প্রেসিডেন্ট হন। প্রসিকিউশনের মতে, ১৯৭১ সালে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য ছাত্রদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন। অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভূখ-ে ভয়াবহ নৃশংসতা সংঘটনে সক্রিয়ভাবে সহায়তা ও উল্লেখযোগ্যভাবে মদদদান করেছিলেন এবং নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ যুগিয়েছিলেন।
৭। কার্য প্রণালীগত ইতিহাস
১৩। প্রাক-বিচার পর্যায়ে প্রধান প্রসিকিউটর কার্যকর ও উপযুক্ত তদন্তের স্বার্থে আসামি আবদুল কাদের মোল্লার গ্রেফতার চেয়ে কার্যপ্রণালী বিধিমালায় ৯(১) বিধির অধীনে সিআইটি ১ বরাবরে এক আবেদন পেশ করেন। শুনানির সময় আসামি অন্য কোন মামলায় এরই মধ্যে হেফাজতে রয়েছেন বলে জানা যায়। এরপর ট্রাইব্যুনাল (ট্রাইব্যুনাল-১) কর্তৃক জারি করা হাজিরা পরোয়ানা মোতাবেক কারা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আসামিকে ট্রাইব্যুনালের (ট্রাইব্যুনাল-১) সামনে হাজির করা হয় এবং তারপর তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে গ্রেফতার করানো হয়েছে বলে দেখানো হয়। সেই অনুযায়ী ০২-১০-২০১০ থেকে আসামি আবদুল কাদের মোল্লা হেফাজতে রয়েছেন।
১৪। অবশেষে, প্রধান প্রসিকিউটর আইনের ৯(১) ধারার অধীনে ১৮-১২-২০১১ তারিখে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ট্রাইব্যুনাল (ট্রাইব্যুনাল-১) প্রসিকিউশনের পেশ করা অভিযোগপত্রের সঙ্গে দাখিল করা দলিলপত্র বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে দোষ প্রমাণিত হয়েছে বলে দেখতে পেয়ে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আমলে নেয়।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল-১ প্রধান প্রসিকিউটরের দাখিল করা আবেদনের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের আইনের ১১এ(১) ধারার অধীনে এ ট্রাইব্যুনাল-২-এর কাছে কেস রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
ঠওওও. প্রযোজ্য আইন
১৬. ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ট্রাইব্যুনাল গঠিত কার্যপ্রণালী বিধি ২০১২ অনুযায়ী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের আইনের ২৩ ধারা অনুযায়ী এটি ১৮৯৮ এবং ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্টের ফোজদারি কার্যবিধি প্রয়োগে বাধাগ্রস্ত হবে না। সাধারণ বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী যা বোধগম্য তা ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণের প্রয়োজন নেই (আইনের ১৯(৪) ধারা অনুযায়ী) আনুষ্ঠানিক প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ট্রাইব্যুনাল শ্রুতি সাক্ষ্যকেও বিবেচনায় নিতে পারে (৫৬(২) বিধি)। আসামি পক্ষের কৌঁসুলি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে জেরা করার অধিকার রয়েছে এবং সাক্ষ্যর বিরোধিতা করতে পারেন।
১৭. ম্যাজিস্ট্রেট অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তার গ্রহণ করা সাক্ষীর বিবৃতিতে ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করতে পারবে, তবে এ ক্ষেত্রে সাক্ষী মারা গেলে অথবা উপস্থিত হতে অসমর্থ হলে। ট্রাইব্যুনালের হাতে সাক্ষীর বিবৃতি পৌঁছালে আসামি পক্ষের কৌঁসুলি সাক্ষীর বক্তব্য যাচাই করতে পারবেন।
১৯৭৩ সালের আইনে অভিযুক্তর সর্বজনীন অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
১৮. নিরপেক্ষতা সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এটি যথার্থ নাও হতে পারে, তবে এটাই উত্তম ও শ্রেয়। এর জন্য প্রয়োজন সকলের অধিকার নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে
১৯৭৩ সালের (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইনের ও কার্যপ্রণালী বিধির আওতায় আইসিসিপিআর এর আওতায় ১৪নং আর্টিকেলের মাধ্যমে অভিযুক্তর অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। দেশের প্রচলিত আইন শুধু দেশের মানের দিক থেকেই নয় এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এটি বিশ্বের আইন শাস্ত্রের অনুমোদিত।
১৯. প্রাক বিচার ও বিচারের সময় পদ্ধতিমত সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইসিটি-২। ১৯৭৩ সালের আইন ও কার্যপ্রণালী বিধির সঙ্গে এটি সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। যা সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ বিচার ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ১৯৭৩ সালের আইনটি আইনশাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আইনের প্রক্রিয়া প্রকৃতভাবে অনুসরণ করেই ১৯৭৩ সালের আইনটি হয়েছে। যার ফলে এই আইনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত সম্ভব। একই সঙ্গে আইনীভাবে এটি বৈধ।
২০. ট্রাইব্যুনাল-২ এ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেককে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রত্যেক অভিযুক্তকে তার অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি।
ী. সর্বজনীন স্বীকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার
২১. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাদের ওপর বর্বরতম হামলা ও নির্যাতন হয়েছিল তারা প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ন্যায় বিচার পাওয়ার যোগ্য। যুদ্ধাপরাধে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে বাংলাদেশ বিবেচনা করে। মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করতে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বজনীন মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার কনভেন্টের অনুচ্ছেদ ২(৩) অনুমোদন করে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কার্যকর বিচার নিশ্চিত করে।
ঢ১.অভিযোগের বিচার করার প্রক্রিয়া
২২. ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় অপরাধ করার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর্যন্ত অভিযোগগুলো নিবিরভাবে পরীক্ষা করা হয়। অভিযুক্ত অপরাধী নয় এমনটি মাথায় রেখেই তা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-২) শুরু করে ১৯৭৩ সালের আইনটির ধারা ৬ (২এ)টির। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক ফ্রানফুটার ডেনিস বনাম যুক্তরাষ্ট্র মামলার (৩৪১ যুক্তরাষ্ট্র ৪৯৪-৫৯২) প্যারা ৫২৫ পৃষ্ঠা ২০৮ চূড়ান্ত যুক্তি তর্কে বলা হয় :
আদালত কোন সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না। আদালত গণতান্ত্রিণ সমাজের প্রতিফলন ঘটায় না। সব কিছু অবগত হয়েই বিচার করা হয়।
সে কারণেই স্বল্পসীমার মধ্যে এই বিচার হয়ে থাকে নির্ভরযোগ্য। তাদের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। বিচারকের স্বাধীনতার মধ্যেই তা নিহিত। ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক চাপ বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করলে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নস্যাত হয়।
২৩. সে কারণে এ ধরনের অপরাধ ঘটেছে কিনা তার সমাধান করা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো বিচার করে দেখা, তারা প্রকৃত অপরাধী কিনা তা বিবেচনা করা। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব হচ্ছে প্রমাণ করা (র) তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো (রর) অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্য। এই অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে তার উৎসাহ ও নৈতিক সমর্থনের বিষয়টি। (ররর) কিভাবে অভিযুক্ত অপরাধ সংগঠিত করেছে। (রা) মানবতা বিরোধী অপরাধের উপাদানগুলো।
২৪. অভিযুক্ত প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অপরাধ সংগঠিত করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আইন শাস্ত্রে চিহ্নিত অপরাধকে আমলে নিতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য নয়।
আইনী বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি নিবষদ্ধ
২৫. বিচার অভিযোগের ব্যাপারে আলোচনায় প্রবেশ করার আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে উভয়পক্ষের মামলার আইনগত বিষয় নিষ্পত্তির বিষয়টি।
(১) অব্যাখ্যাত বিলম্ব কি মামলার বিচার কার্যক্রমকে দুর্বল করে।
২৬. আসামি পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বিচার কার্যের আইনী বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, ফোজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বাধাধরা কোন সময়সীমা নেই। তবে এ ধরনের ব্যতিক্রমী মামলার ৪০ বছর বিলম্বের ঘটনা অবশ্যই ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
২৭. নৈতিক ও সুষ্ঠু আইন মোতাবেক মামলা দায়ের করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে বিলম্ব কোন বাধা নয়। ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন বা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে কোথাও যুদ্ধাপরাধীর বা মানবতার বিরুদ্ধে অপবাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা বেঁধে দেয়া নেই। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৬৮ সালের ২৬ নবেম্বর ২৩৯১ (ীী১১১) নম্বর প্রস্তাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ইত্যাদি বিচারের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়ার কথা উল্লেখ নেই।
২৮. এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ১৯৭৩ সালে চিলির বিপ্লবের সময়কালে গণহত্যার এবং ১৯৭০-এর দশকে কম্বোডিয়ার পল পট রিজিমের বিচার এখনও চলছে।
মরিস পাপন ১৯৮১ সালে ৯৬ বছর বয়সে মারা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসী ইহুদীদের বহিষ্কারের ব্যাপারে তার ভূমিকা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে ১৯৯৭ সালে অভিযোগ আনা হয়।
১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তার কর্মকা-ের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাকে দশ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। পাপন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ২২৩ শিশুসহ ১৬৯০ ইহুদীকে বরফক্স অঞ্চল থেকে জার্মানির নাৎসি শিবিরে পাঠানোর জন্য গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়ায় তাকে এই সাজা দেয়া হয়।
২৯. এসবের কোন কিছুই জানা যেতনা যদি তরুণ ফরাসী ঐতিহাসিক মিশেল এ বিষয়ে গবেষণা না করতেন। তিনি এভিডেন্স সংক্রান্ত যে সব কাগজপত্র খুঁজে পান তা ১৯৪২ থেকে ‘৪৪ সালের মধ্যে যেখানে ইহুদীদের জোরপূর্বক বোরদ্যু থেকে প্যারিসের কাছে ড্র্যান্সি ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল।
সূত্র : ডগলাস জনসন : দ্য গার্ডিয়ান, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭।
৩০. সন্দেহাতীতভাবে, একটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং তর্কাতীত বিচার প্রক্রিয়া কেবলমাত্র ভিকটিমদের বেদনাবহ স্মৃতি এবং আকাক্সক্ষা দিয়ে পরিচালিত হতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন অনুকূল ও স্থিতিশীল রাজিৈনতক পরিস্থিতিসহ শক্তিশালী জনমত এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ আইন প্রবর্তিত হয়েছে ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায় এবং এমনকি ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালের দালাল আইন বাতিল করা হয়। আর ১৯৭১ সালে যে সব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ন্যক্কারজনক ও বর্বর কাজ করেছিল তাদের রাষ্ট্রের সর্বত্র পুনর্বাসিত এবং স্বীকৃতি দেয়া হয়। এমনকি সে সময় প্রভাবশালী ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মকা-ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হতে সুযোগ করে দেয়া হয়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্র স্থগিত ছিল এবং কোন সুষ্ঠু বা অনুকূল পরিস্থিতি, শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। ১৯৭৩ সালর আইনের অধীনে অপরাধীদের বিচার করার ব্যাপারে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কোন ঐকমত্যও গড়ে ওঠেনি। সুতরাং এসব কারণে এই বিচার কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে এবং অভিযুক্ত এ ক্ষেত্রে বলতে পারবেন না যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের আইনে তাদের বিচার করা হচ্ছে ।
৩১. এখানে বিচার বিলম্বিত হওয়ার অর্থ বিচার অস্বীকার করা নয়, বিশেষত যখন অপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তাছাড়া এরকম কোন স্বীকৃত আইন নেই যে, নির্দিষ্ট কয়েক বছরের মধ্যে ওইসব অপরাধ সংঘটিত না হয়ে থাকলে তার বিচার করা যাবে না। সুতরাং, বিলম্বে কাজ শুরু বিচার কাজের এবং সংশ্লিষ্টকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে না এবং ১৯৭১ সালে সংঘটিত বর্বর কর্মকা-কে অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই।
(রর) ১৯৭৩ সালের আইন প্রণয়নের আইনগত উদ্দেশ্য এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালের সংশোধনীতে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীর সংযুক্তি
৩২. এখানে আরও একটি বিষয় এই যে, ১৯৭৩ সালের আইন এবং সংবিধানের প্রথম সংশোধনী থেকে এটি দেখা যায় যে, ওই আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত ১শ’৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা, বেসামরিক কোন নাগরিকের নয়।
৩৩. ১৯৭৩ সালের আইন ২০০৯ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল এবং এর অধীনে কোন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অনুযায়ী পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত ১শ’৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে রেহাই দেয়া হয় যা স্বাভাবিক বিচার পরিপন্থী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া জাতির দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের আইনে সংশোধনী আনা হয় ট্রাইব্যুনালের বিচারিক ক্ষমতার আওতা বৃদ্ধি করা হয় অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনতে ।
৩৪. আমাদের মূল বিধির সঙ্গে আইনের ৩(১) ধারা সংযোজনের উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করতে হবে। পাশাপাশি আমরা ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী সংবিধানের ৪৭(৩) ধারায় যে সুরক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে তা থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারি না । এই আইনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে যারা বর্বর কর্মকা- করেছে তাদের বিচার ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
৩৫. এ অবস্থায় আমরা দেখি যে, আসামি পক্ষ যে যুক্তি উপস্থাপন করেছে তার কোন তাৎপর্য নেই এবং বিশেষত সংবিধানের ৪৭(৩) এবং ৪৭এ(২) ধারার আলোকে আসামিপক্ষের আপত্তি ধোপে টেকে না।
(ররর) ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা এবং ১শ’ ৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে অব্যাহতি
৩৬. ১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অনুযায়ী পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর ১শ’৯৫ তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়ার বিষয়টি বিবাদী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী উত্থাপন করেছেন। ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী ওই অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়টি উক্ত সমঝোতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। তবে স্থানীয় অপরাধী যাদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে বর্বর কাজে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিচারে সরকার ১৯৭২ সালে দালাল আইন করেছে। স্থানীয় অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের এই দালাল আইনই একমাত্র বৈধ উপায়।
৩৭. উপরোক্ত উপস্থাপনা এবং ১৯৭৩ সালের আইন এবং ১৯৭২ সালের দালাল আইন সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণের পর আমরা একথা বলতে পারি না যে, একই ধরনের অপরাধে যেখানে ১৯৭৪ সালের সমঝোতা অনুযায়ী ১শ’ ৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করা হয়েছিল সেখানে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(১) ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কিংবা সহায়ক বাহিনীর সদস্যকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না।
৩৮. এ ধরনের সমঝোতা ছিল একটি ‘নির্বাহী আইন’ এবং এটি সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা কোন ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিগোষ্ঠীর সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না।
৩৯. এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘জাস কোগেনস’ (সর্বজনগ্রাহ্য) নীতিমালা হচ্ছে সেসব নীতিমালা বা নিয়মকানুন যা অমান্য করা যায় না এবং তা অবমাননারও কোন সুযোগ নেই এবং তা কেবল কোন চুক্তি বা সমঝোতার ক্ষেত্রে ওই টুকুই প্রযোজ্য হবে যা এ ধরনের নীতিমালা বা নিয়মকানুনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি যে, ইউডিএইচআর (মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা) এবং ১৯৭৩ সালের আইন যা রাষ্ট্র মেনে চলতে বাধ্য এবং যা অপরিহার্য ও অপরিহারযোগ্য এবং সে কারণেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি নিছক একটি ‘নির্বাহী কর্ম’ এবং নৃশংস অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনা থেকে রাষ্ট্র বিরত থাকতে পারে না।
৪০. তালিকাভুক্ত ১শ’ ৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন আন্তর্জাতিক আইনের অবশ্য পালনীয় নিয়মকানুনের পরিপন্থী। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এই নীতিমালার পরিপন্থী যে কোন সমঝোতা ও চুক্তি ইন্টারন্যাশনাল ট্রিটি ল কনভেনশন (ভিয়েনা কনভেনশনের ৫৩ অনুচ্ছেদ)- এর বিধান অনুযায়ী অচল ।
৪১. ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা বলে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর যে ১শ’ ৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে রেহাই দেয়া হলো ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(১) ধারা মোতাবেক বাংলাদেশ ভূখ-ে সংঘটিত বর্বর নির্যাতনের বিচার ও শাস্তি দেয়ার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনকারীরা মানবজাতির শত্রু। সুতরাং আমরা একমত যে, ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে স্থানীয় বেসামরিক অপরাধীদের বিচারে ‘ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা’ কোন বাধাই নয়।
(রা) অভিযুক্তকে দালাল আইন ১৯৭২ অনুযায়ী বিচার করা যেত এবং ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে বিচার করা যায় না
৪২. বিবাদী পক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলি বলার চেষ্টা করেন যে, ১৮৭২ সালের দালাল আইনের অধীনেই বিচার করে শাস্তি দেয়া যেত।
৪৩. দালাল আইন ১৯৭২ একটি পৃথক আইন যার লক্ষ্য নির্দিষ্ট অপরাধসমূহের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা। পেনাল কোডে শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ ১৯৭২ সালের দালাল আইনে উল্লেখ রয়েছে বলে প্রতীয়মান। কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনকারী অন্যান্য অপরাধের বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছে। সুতরাং ১৯৭২ সালের দালাল আইন অনুযায়ী অপরাধসমূহ ১৯৭৩ সালের আইনে বর্ণিত অপরাধসমূহ একইরকম এটি বলার সুযোগ নেই। অতএব এই যুক্তি গ্রহণ করতে পারছি না যে, ১৯৭২ সালের দালাল আইনে বিচার করা হয়নি বলেই এখন তাকে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী বিচার করা যাবে না।
৪৪. এই যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে হত্যার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং ১৯৭২ সালের দালাল আইনের অধীনেই তার বিচার করা যেত।
৫২. আইনের ৩ (২) (ক) ধারা অনুসারে আমরা বিষয়টি আইনগতভাবে বিবেচনা করে দেখব, ধারাটি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের’ বিষয়টি সমসাময়িক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব এ সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। অনুচ্ছেদ ৫এ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের’ যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে এই অপরাধ সংঘটনের জন্য কাউকে দায়ী করতে ‘ব্যাপকভিত্তিক ও পরিকল্পিত আক্রমণ’ কিংবা এ বিষয়টি ‘অবহিত’ থাকা এগুলোর কোনটিকেই শর্ত করা হয়নি। যুগোসøাভিয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটিওয়াই) এবং রুয়ান্ডা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটিআর) বিধির সঙ্গেও রোম স্ট্যাচুটের সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে।
৫৩. ১৯৭৩ সালের আইনের ধারা ৩ (২)এ উল্লেখিত ‘বেসামরিক জনতার সংঘটিত অপরাধ’ শব্দাবলী আইসিটিওয়াইর ১৯৯৩ সালে প্রণীত আইনের ধারা ৫ থেকে সংগৃহীত।
৫৪. রোম স্ট্যাচুটে উল্লেখিত সংজ্ঞার সঙ্গে আইসিটিওয়াই এবং আইসিটিআর স্ট্যাচুটে উল্লেখিত সংজ্ঞার পার্থক্য রয়েছে। রোম স্ট্যাচুটের অনুচ্ছেদ ১০-এ উল্লেখিত ‘স্ট্যাচুটের উদ্দেশে’ শব্দাবলী প্রমাণ করে যে আইনটির খসড়া প্রণেতারা এ ব্যাপারে শুধু অবগতই ছিলেন না বরং সচেতনও ছিলেন যে, এগুলো কোন চূড়ান্ত সংজ্ঞা নয় এবং কোন ব্যাখ্যাও চূড়ান্ত কোনকিছু নির্দেশ করে না। এ কারণে আমাদের ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যা আমাদের পার্লামেন্টে পাস হওয়া একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এটি রোম স্ট্যাচুটের অধীন কোন প্রতিষ্ঠান নয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য রোম স্ট্যাচুট নির্ধারণ করেছে তা এই আদালতের জন্য আনীত মামলার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য হবে না।
** রায়টি সম্পূর্ণ অনুবাদ করতে পারিনি।
** রায় ইংরেজি ভাষায় দেয়া হয়েছে।
***** কেউ পারলে ৫৫ থেকে ১১১ ধারা অনুবাদ করুন।
উৎস : -
জনকন্ঠে (৫ফেব্রুয়ারী ২০১৩) রায়ের এই বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১০
খুব সাধারন একজন বলেছেন: কে বিচারক, কে সরকার, কে খালা কে হাসি?
আমরা জানি কারা রাজাকার, দিবই ওদের ফাঁসি।