নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার দেশ

রুবেল১৯৮৭

আমি বিশ্বস করি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ কিন্তু ধর্মহীনতায় নয়।

রুবেল১৯৮৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ হোক

২২ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৮:০৫



ছোটবেলায় গুরুজনেরা অনেক নৈতিক শিক্ষা দিতেনÑ মিথ্যে কথা বলবে না, অন্যের জিনিসের দিকে হাত বাড়াবে না, রাস্তায় টাকা-পয়সা পড়ে থাকতে দেখলেও তুলবে না, কারও বিপদ দেখলে সাহায্যে এগিয়ে যাবেÑ এমন আরও অনেক।

আগুন নিয়ে খেলা করতে নেইÑ এটাও একটা বড় শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। আক্ষরিক অর্থেই শুধু নয়, এ শিক্ষার অনেক গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

পরিবার বা সমাজে নৈতিক শিক্ষার চর্চা এখন কতোটা হয়, নৈতিক শিক্ষার প্রভাব সর্বস্তরে কতটুকুÑ এসব প্রশ্ন নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। তবে নিজের দুঃখজনক পর্যবেক্ষণ হলোÑ সমাজে সকল স্তরে হরদম মিথ্যা বলছেন লোকে। নির্দ্বিধায় কেড়ে নিচ্ছে অন্যের জিনিস। এজন্য কাউকে জখম করতেও কুন্ঠাবোধ করছেনা। কেউ ভাল কিছু করলে দুষ্ট লোকেরা পেছনে লেগে পড়ছে তার ক্ষতি করতে। ভাল মানুষের ভড়ং ধরেও নষ্টরা কলুষিত করছে সমাজকে। বহুকাল ধরেই সমাজের কোথাও নীতি নৈতিকতার শক্তিশালী অস্তিত্ব অনুভব করা যায় না। ছোট ছোট অপরাধ যেন পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্য বিষয়ে। বড় অপরাধও নির্বিকারভাবে সহ্য করে নিচ্ছে বা নিতে হচ্ছে মানুষকে। অন্যের বিপদ দেখেও মানুষ সাহায্যে এগিয়ে না এসে সরে যায়; শংকাÑ পাছে নিজে না বিপদে পড়ে। রাতারাতি নয়, যুগের পর যুগ ধরে নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধের ধারাবাহিক পতন লক্ষণীয়। পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটিও নাজুক হয়ে গেছে। আর আগুন নিয়ে নানান খেলাতো চলছেই। যার নিকৃষ্ট একটি চেহারা আমরা দেখলাম কক্সবাজারের রামুতে।



রামু। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২। শনিবার।

শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ভাঙিয়ে একদল উগ্র, ধর্মান্ধ উন্মাদ আচমকাই শনি হয়ে আসলো রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য। জ¦ালিয়ে ছাই করলো ১২টা বৌদ্ধ বিহার। ভাংচুর করলো আরও ৬টি। বৌদ্ধদের ৫০টি বাড়ি-ঘরে আগুন দিল। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এক বৌদ্ধ যুবকের নামে জালিয়াতি করে বানানো ফেসবুক সদৃশ্য পেজ-এ মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন শরিফের অবমাননাকর ছবি দেখিয়ে ছড়ানো শুরু হয় ধর্মীয় উত্তেজনা। বেছে নেয়া হয় দক্ষিণ-দক্ষিণাঞ্চলের সবচে বড় আদি বিপণন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত রামুর ফকিরা বাজারকে। সেদিন শনিবার ছিল হাটবার। সন্ধ্যায় জমজমাট ভিড়। সেই ভিড়ের ভেতরের একটি ছোট্ট মোবাইল ফোন সাড়ানোর দোকান থেকেই পরিকল্পিত ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর শুরু।

সন্ধ্যা তখন। সিংহভাগ অশিক্ষিত-অসচেতন স্থানীয় অধিবাসী, বাদবাকীদের অধিকাংশই অর্ধশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত। যা’ও সামান্য শিক্ষিত সমাজ তারাও কম্পিউটার, কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে জমিয়ে রাখা ছবি, ইন্টারনেট, ওয়েব পেজ, অনলাইন, ফেসবুক, ইমেজ, ফটোসপ- এসব ব্যাপারে অতিসামান্যই ধারণা রাখে। তার ওপর শুধু রামু নয় গোটা কক্সবাজার জেলায় সহজাত সরল ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্ম ভীরুতার বাইরে ইসলাম ধর্ম নিয়ে গোড়ামি ও ধর্মান্ধতা অনেক বেশী। গত কয়েক যুগ ধরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার করে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরির চাষ হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এ অঞ্চলে দারিদ্র্য, অসচ্ছলতা দৃশ্যমান। কিন্তু অদৃশ্য টাকার সরবরাহে কক্সবাজার জেলার যত্রতত্র মাদ্রাসা নির্মাণ হয়েছে, হচ্ছে। কোত্থেকে টাকা আসছে, কে টাকা আনছে, কিভাবে জমি মিলছেÑ এমন অনেক প্রশ্নের পাহাড় জমছে; কিন্তু উত্তর নেই। স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয় বলে প্রশ্ন তুলবার সাহস দেখাতে চায়না কেউ, আবার একই অজুহাতে জবাবদিহিতার জায়গাটিকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন এইসব আয়োজনের প্রকাশ্য ও নেপথ্যের কুশীলবরা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে রামুর অধিবাসীদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অসচেতনতা, ধর্মীয় গোড়ামি আর ধর্মান্ধতাটাই পুঁজি হয়ে গেল দুষ্টবুদ্ধি বা কূটবুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের। জালিয়াতি করা ছবি দেখিয়ে সাজানো পরিকল্পনা অনুসারে ধর্মের উত্তেজনা ছড়ানো শুরু করলো। তারপর আরও উস্কানি, আরও.......আরও....... চললো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, শুরু হলো সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা/৭টার দিকে। তারপর ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবারের রাত হয়ে গেল বৌদ্ধদের জন্য কালো রাত। রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় বড় উৎসব মধু পূর্ণিমা পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেই রাতে। কিন্তু সেই মধুর রাতে তাদের ওপর নেমে আসে জীবনের তিক্ততম অন্ধকারের অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যার উত্তেজনা, তারপর ধারাবাহিক দৃশ্যমান ও অদৃশ্য উস্কানিতে উন্মত্ততা রূপ নিল উন্মাদনায়। ৬/৭ ঘণ্টাব্যাপী উন্মাদনার শেষ হলো ধর্মীয় তাণ্ডব দিয়ে। ধর্মীয় উন্মাদরা আগুন নিয়ে খেললো। ছাই করলো মন্দির, চুরমার করলো বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলো, লুটপাটও করলো। এসব ধর্মীয় উন্মাদনা আর তান্ডবের কোনো কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিলনা, সেগুলোও ছিল ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করে পরিকল্পিতভাবে আয়োজন করা তাণ্ডব। তাইতো যেসব সমতল ও পাহাড়ী প্রত্যন্ত এলাকার অধিবাসীরা রাত ৮/৯ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পরে, সেইসব এলাকা থেকে রাত ১১টা, ১২টা, ১টা, ২টার সময়ও গাড়ী ভাড়া করে লোক আনা হয়েছে হামলার জন্য। তারা গান পাউডার নিয়ে এসেছিল কয়েক শতবর্ষীয় মন্দিরগুলোকে মুহূর্তের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করতে।



কিন্তু কেন?

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা এই প্রথম আমাদের দেশে। তা’ও আবার রামুতে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য যে এলাকার মানুষ গর্ববোধ করে আসছিল শত শত বছর ধরে। এই কেন’র অনেক উত্তর হতে পারে। অনেক স্বার্থের সম্মিলন ঘটে থাকতে পারে এখানে। তাই হয়তো চেনা-অচেনা স্থানীয় ধর্মীয় উন্মাদদের বিচিত্র সমাবেশ দেখা গেছে উস্কানি দেয়ার পর্ব থেকে শুরু করে তাণ্ডব শেষ হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে।

ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত সাম্প্রদায়িক দল জামায়াত-শিবির ছিল;

ছিল সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতনে সিদ্ধহস্ত হিসেবে পরিচিত বিএনপি;

উগ্রবাদী ধর্মীয় উন্মাদ হিসেবে পরিচিত ইসলামী ঐক্যজোট পরিচালিত কাওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা

ছিল;

ছিল প্রতিবেশি দেশ বার্মা থেকে অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গারা;

এদের ভীড়ে যাদের মুখ সবাইকে অবাক করেছে তারা হলো অসাম্প্রদায়িক নীতির দল হিসেবে পরিচিত

আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ, ওলামা লীগের কিছু স্থানীয় নেতা-কর্মী, উস্কানিমূলক মিছিলে তাদের অংশগ্রহণ;

আরও অবাক করা অংশগ্রহণ ছিল স্থানীয় কিছু সাংবাদিকের;

যারা সমাজের রক্ষক সেই পুলিশ ছিল নির্লিপ্ততায়, উস্কানিতে ছিল সহযোগীর ভূমিকায়;

গোয়েন্দারা ছিলো একদম নিশ্চুপ, যেন অস্তিত্বহীন।

এদের সবার স্বার্থ যেন এক জায়গায় মিলেছে। নিশ্চিত মিলেছে। নইলে এমন সম্মিলিত, সুপরিকল্পিত হামলা হয় কী করে?

অনেকের বিশ্বাস, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বার্মার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গারা বার্মায় তাদের জনগোষ্ঠীর ওপর বৌদ্ধদের নির্যাতনের প্রতিশোধ নিয়েছে । রোহিঙ্গাদের রাগÑক্ষোভ বাংলাদেশ সরকারের ওপরও। কেননা সরকার ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধদের সাথে সহিংসতার সময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেছে। আমেরিকাসহ অনেক প্রভাবশালী বিদেশী শক্তির ক্রমাগত চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ, কেননা নিজেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দিশেহারা। বিএনপি-জামায়াত হামলা নির্যাতন করে অনেক হিন্দু ধর্মের অনুসারী নাগরিকদের তাড়িয়েছে দেশ থেকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অতীত রেকর্ড রয়েছে তাদের। ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করে, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে ইসলামী ঐক্যজোট ও কাওমী মাদ্রাসাগুলোও তাদের রাজনৈতিক পূঁজি, মূলধন তৈরি করার জন্য পরিচিত। সাম্প্রদায়িক ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াত, বিএনপি পরীক্ষিত রাজনৈতিক বন্ধু। অসাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, ওলামা লীগের কিছু কর্মীর কিছু উস্কানিমূলক সভা-মিছিলে অংশগ্রহণ অবাক করলেও একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই অসাম্প্রদায়িক আদর্শের দলেও সাম্প্রদায়িক ও অশুভ চিন্তা-চেতনার মানুষ রয়েছেন, ঢুকেছেন। আর শুধু সাংবাদিক নয়Ñ যে কোনো পেশায়, সমাজের যে কোনো স্তরে সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় মৌলবাদী, উগ্রবাদী, উন্মাদনায় উজ্জীবিত মানুষ পাওয়া যায়। পুলিশ, প্রশাসন, গোয়েন্দা বিভাগগুলোও তো এমন ধরনের মানুষ বর্জিত নয়। আর নেহায়েত টাকার বিনিময়ে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অনেক অনাকাংখিত, অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে দেখি ধনী-গরিব, প্রভাবশালী-অপ্রভাবশালী সর্বস্তরের বহু মানুষকে। তাই কক্সবাজার, বান্দরবানের নাইক্ষংছড়িসহ রামুর আশেপাশের এলাকার এমন ভাড়াটে সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ দেখা যায় এই পরিকল্পিত হামলায়।

হামলার জন্য যে সময়টি বেছে নেয়া হয়েছে সেটিও লক্ষণীয়। বার্মায় মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর হামলা-নির্যাতন; বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো, নানান সন্দেহের কারণে তিনটি বিদেশী এনজিওকে কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে নিষেধ করা; বাংলাদেশের এমন ভূমিকায় পরাশক্তি আমেরিকার বেজায় নাখোশ হওয়া, মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-কে অবমাননা করে আমেরিকার এক নাগরিকের বানানো ভিডিও চিত্র প্রচার এবং ফ্রান্সে কার্টুন প্রকাশÑ এসব ঘটনা শুধু জঙ্গী, উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীকে যেমন উছিলা তৈরি করে দেয় তাণ্ডব করার, তেমনি বাংলদেশসহ মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বহু মানুষের মধ্যে। এমন সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষ করে বৌদ্ধ বিহার, উপাসনালয়গুলোতে হামলা করা হলো। এই অঞ্চলের মানুষের সরল ধর্মীয় অনুভূতি-বিশ্বাস যখন আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে আছে, যখন ধর্মান্ধ, উগ্রবাদীরা সুযোগের অপেক্ষায় আছে, যখন গোটা বাংলদেশের সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয় ব্যথিত, ভারাক্রান্ত তখন বর্বর ধর্মীয় উন্মাদনায় পুড়ানো হলো বৌদ্ধদের হৃদয়। এমন একটি দুর্বল-জটিল সময়কে ব্যবহার করা হয়েছে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য।

কী লাভ হলো প্রকাশ্য ও নেপথ্যে থাকা হামলাকারীদের, কী উদ্দেশ্য সাধিত হলো তাদের এই হামলার মধ্য দিয়ে? নিছক মনের আক্রোশ মেটাতে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এই হামলা? নেহায়েত ধর্মীয় উন্মাদ গোষ্ঠীর দানবীয় রূপ/তাণ্ডব দেখাতে? নাকি আরও কিছু?

হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেকে গত ৪১ বছরের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। মোট জনসংখ্যায় ধর্মীয় অনুপাতিক হারের বিবেচনায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। বাধ্য হয়েছে তারা দেশ ছাড়তে। আর নিরাপদ ভাবতে পারেনি তাদের দেশ, সমাজকে। অনেকে সম্পদ, সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে পালিয়েছে, অনেকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে গেছে। নির্যাতন করে তাড়ালেই সম্পদ দখল করা যায়, সম্পদের মালিকানা পাওয়া যায়Ñ এটাও অনেক উদ্দেশ্যের একটা হিসেবে কাজ করে থাকে হামলা নির্যাতনের ক্ষেত্রে।

রামু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য যেমন প্রসিদ্ধ তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও। পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা। পুড়ে ছাই করা বৌদ্ধ মন্দিরের অনেকগুলোই কয়েক’শ বছরের পুরোনো স্থাপত্য, ইতিহাস, সভ্যতার ধারক-বাহক ছিল। অনেক মহামূল্যবান পৌরাণিক ও প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল এসব মন্দির। সারা বছর কৌতূহলী দেশি-বিদেশী পর্যটকদের কম-বেশি পদচারণা ছিল রামুতে। বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে। পর্যটনের জন্য যতই পরিচিত হয়েছে, ততই পর্যটক বেড়েছে কক্সবাজারে, রামুতে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পসার বৃদ্ধির সাথে সাথে কক্সবাজার, রামুর জমির দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, নানা পেশার প্রভাবশালী মানুষের। টাকার অভাব নেই তাদের, তাই তাদের অনেকেই জমি চায়, ব্যবসা করতে চায়, নিজের চিত্ত বিনোদন, অবসরের অবকাশ যাপনের জন্য স্থায়ী জায়গা চায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত রামুতে। এমন অনেক চাওয়ার স্বাক্ষর ছেয়ে আছে কক্সবাজারে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, আর বাণিজ্যিক স্থাপনায় কক্সবাজারের চেহারা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে? রামুর জমিকে ঘিরেও অনেকেই স্বপ্নের প্রকল্পের জাল বুনছেন অনেকদিন ধরে, ভূমিদস্যু, শত-হাজার কোটি টাকাওয়ালা জমি দখলকারীদের চোখ পড়েছে রামুর ওপর অনেক আগে থেকেই, স্থানীয়দের সাথে কথা বললেই তা জানা যায়।

কিন্তু চাইলেই তো জমি মিলছে না, মিললেই মন মতো জায়গায় নয়, মন মতো মিললেও আকাংখা অনুযায়ী বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায় না। তবে উপায়? অনেক টাকার প্রলোভন; তাতে কাজ না হলে জবরদস্তি আর নানা কৌশলের বুদ্ধিতো খাটাতেই হবে। কূটচালের কি অভাব আছেÑ মানুষ তাড়াবার জন্য। এসব হাঙ্গামা করার সিদ্ধহস্ত মানুষও আছে। কিন্তু তার সাথে লাগে পুলিশ, প্রশাসনের সমর্থন, সহযোগিতা। এসবও পাওয়া যায়। টাকায় কি-না হয় এই দেশে। টাকায় কেউ চুপ হয়, টাকায় কেউ চিৎকার করে গলা ফাটায়। টাকায় কেউ চোখ বুজে থাকে। কেউ মুখ ঘুরিয়ে রাখে। কেউ দেখেও না দেখার কথা বলে, কেউ না দেখেও দেখার দাবি করে। টাকায় চেনাকে অচেনা করে, জানাকে অজানা করে। টাকা সত্যকে মিথ্যা করে, মিথ্যাকে সত্য। টাকায় আগুন নেভায়, টাকায় আগুন জ¦ালায়। টাকায় বিবেক কেনা-বেচা হয়।

নোংরা বুদ্ধি, টাকা, লোভ, নানান স্বার্থের সম্মিলনÑ এসবের সাথে যদি আরও কোনো বড় শক্তির সহায়তা, সমর্থন যোগ করা যায় তাহলে আর ঠেকায় কে! দেশের ভেতরের মানুষ যেমন ষড়যন্ত্র করে, দেশের ভেতরের মানুষ বাইরের ষড়যন্ত্রের গুটি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র বাইরেরও সাহায্য নেয়। অতীতের ইতিহাস বলে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ায় অনেক বিদেশী শক্তি, দেশ দারুণ নাখোশ বাংলাদেশের ওপর। তার ওপর বৃটিশ মুসলিম এইড ও ফ্রান্সের ২টি এনজিওকে কক্সবাজারে অনিবন্ধিত বা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ভেতর অবৈধভাবে পরিচালিত কাজ করতে বাংলাদেশ নিষেধ করেছে। এজন্য সমালোচনা ও চাপ এসেছে । সেই চাপও উপেক্ষিত হয়েছে। এমন নিষেধাজ্ঞা আর উপেক্ষার গ্লানি কোনো প্রভাবশালী শক্তি খুব সহজে হজম করে নেয়না। তেমনটি দেখাও যায় না, কোনো না কোনো কৌশলে, কূটচালে সেই প্রত্যাখ্যানের গ্লানি মুছে ফেলে তারা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশী-বিদেশী যারাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিলো, যারা হেরে গিয়েছিল যুদ্ধে, আজও তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অতীতের বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ নানা কিছু অনুমান করে, অনেক সন্দেহ জাগে তাদের মনে।

রোহিঙ্গারা যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক-ধর্মীয় নির্যাতনের মুখে পড়ে ১৯৭৮ ও ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে এসেছে তা নয়। তারা ১৯৭৮ সাল থেকে দারিদ্র্র্য, অর্থনৈতিক সংকট, কাজের অভাবÑএ ধরনের নানা কারণে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক মাসেই বার্মার রাখাইন রাজ্য থেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। তাই নির্যাতনের কারণে ১৯৯১-৯২ সালে এসে এখনও ফিরে না যাওয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা যেখানে কক্সবাজারের ২টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩০ হাজার, সেখানে অর্থনৈতিক কারণে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা (যারা ‘ইকনমিক মাইগ্র্যান্ট’ হিসেবে পরিচিত) কক্সবাজার ও আশেপাশের এলাকায় এখন পাঁচ লাখ পর্যন্ত অনুমান করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ঘিরে বাংলাদেশের ভেতরেও স্থানীয় বেসরকারী সংস্থা, ব্যবসায়ী, ধর্মকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করে পরিচালনা করা অনেক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় জড়িয়েছে গত কয়েক দশক ধরে।

রোহিঙ্গারা বিশ্বব্যাপী ‘স্টেটলেস পিপল’ হিসেবে পরিচিত। বার্মা তাদেরকে নিজেদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনা, তাই তাদের পরিচয় হয়েছে রাষ্ট্র বিহীন জনগোষ্ঠী । ফলে তাদের জন্য রাষ্ট্র চাই। রাষ্ট্র চাইলেই কি হবে? রাষ্ট্র বানাতে জমি চাই, ভূখন্ড চাই। সেই ভূখন্ড কোথায় পাওয়া যাবে, কোত্থেকে আসবে? অনেক প্রতিবেশি দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী ভূখন্ডের মালিকানা, দখল নিয়ে লড়াই চলেছে যুগ যুগান্তরে, এখনও চলছে। যেমন কাশ্মীর নিয়ে চলছে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই, প্যালেস্টাইন-ইসরাইল ধারাবাহিক যুদ্ধে লিপ্ত। এসব লড়াই থেকে কতভাবে অন্যেরা নিজেদের ফায়দা লুটে নেয় তা সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে থেকে যায়। তেমন কিছু একটা শুরুর অসৎ প্রচেষ্টাই যে নেই তা’ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বার্মা এলাকায় স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র করতে চায়। রোহিঙ্গাদের অনেক সংগঠন এ লক্ষ্যে সক্রিয় রয়েছে, তৎপরতা চালাচ্ছে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন ইসলামী বিশ্বের দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি, সমর্থন, সহযোগিতা পাবার জন্য আমেরিকাতেও চলছে নানা কার্যক্রম, তদ্বির, প্রচারণা, প্রপাগান্ডা। বাংলাদেশের মানুষও রোহিঙ্গাদের ওপর বার্মায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে। শুধু মুসলমান হিসেবে নয় মানবিক কারণেও রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলদেশের মানুষ সহানুভূতিশীল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সংগঠনগুলো তাদের নানা স্বার্থ ও এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা ও প্রপাগান্ডায় বাংলাদেশকেও প্রতিপক্ষ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের জঙ্গিদের কয়েকজনকে পাওয়া গেছে কক্সবাজারে যারা বার্মা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ ভূখন্ডে একটি ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ করতে চায়। রোহিঙ্গাদের সাথে, রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সাথে বাংলাদেশের জঙ্গিদের আদর্শিক, আর্থিক, সামরিক, অনেক মেলবন্ধন রয়েছে অনেক আগে থেকেই। সেই গোপন সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার অনেক কিছুই আজও অজানা।

বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, এই এলাকা দিয়ে বার্মা হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত এশিয়ান হাইওয়ে’র সাথে সংযোগের সম্ভাবনাসহ নানান দিক থেকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নজর রয়েছে এদিকে। বার্মাও এখন গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আছে। চিন বার্মার পুরোনো বন্ধু। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর অঙ্গীকারে বার্মার নতুন বন্ধু হিসেবে ঘনিষ্ঠ হতে এগিয়ে এসেছে আমেরিকা। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, বাণিজ্যের সম্ভাবনা আছে বার্মায়, যা নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরাক্রমশালী অনেক দেশের বিপুল আগ্রহ। অস্ট্রেলিয়ানরাও পিছিয়ে নেই বার্মাকে নিয়ে তাদের বিশেষ আগ্রহের জায়গাটিকে শাণিত করতে। আমেরিকা, চিন, ভারতের মধ্যে আছে নানামুখী প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এমন নানান আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক রাজনীতির মেরুকরণে এবং বিদেশী শক্তিধর দেশগুলোর ভবিষ্যত রাজনৈতিক, সামরিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের নানা কৌশলও থাকে অনেক এলাকাকে ঘিরে। সেসবের অনেক কিছুই থেকে যায় সাধারণের জানার বাইরে, দৃষ্টির অন্তরালে। তাই অনেক ঘটনা আশ্চর্যজনক হয়ে ওঠে, হাজারো প্রশ্ন তৈরি করে মনে। কিন্তু তাৎক্ষণিক উত্তর মেলে না, হয়তো কখনই মেলে না। শুধু বহু পরে, বহু.... বহু..... পরে হয়তো তার ফল দেখা যায়, তখন অতীতের অনেক কিছু বিস্মৃত হয় মানুষ। কখনোই অংক মেলানোর ধাপগুলো দেখা যায় না, শুধুই ফল দেখা যায় দূর ভবিষ্যতে।

দৃশ্যত ধর্মান্ধ উন্মাদদের দেয়া রামুর আগুন সবকিছু ছাই করে নিভে গেছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। কিন্তু এই আগুন শুধু মন্দির নয় পুড়িয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হৃদয়কে। নতুন বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। সেটাকে নেভাতে না পারলে অশুভ শক্তিগুলোর সেই আগুনে এ সমাজ ক্রমাগত পুড়তেই থাকবে। সম্মিলিতভাবে হামলাকারীদের মধ্যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যার যা’ই হোক না কেন, সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে এ আগুন দেয়া হয়েছে। এই আগুন ছিল বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর আগুন। এ আগুন সমাজের শুভ বুদ্ধি, শুভ শক্তির ওপর অশুভ বুদ্ধি, অশুভ শক্তির আগুন।

এ আগুন বৌদ্ধদের কাছে চিরচেনা বিশ্বাসী সমাজকে রাতারাতি অচেনা করেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রামুর অধিবাসীদের মধ্যে যে আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তাতে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভাঙন আর দূরত্ব তৈরি করেছে।

হামলার পর মন ভেঙে যাওয়া বৌদ্ধদের অনেকেই আমাকে বলেছেন, “আমাদেরকে আপনারা যেহেতু বাংলাদেশে চান না, অন্য দেশে পাঠিয়ে দিন।”

লজ্জায় হেট হয়ে গেছে মাথা।

এ এক দারুণ লজ্জা আমাদের জন্য; বাংলাদেশের শুভ বুদ্ধির মানুষের জন্য।

আগুন নিয়ে এমন অনেক খেলায় আমরা পুড়েছি বারবার।

পুড়েছে বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যত।

জটিল আর কুটিল হয়েছে আমাদের সমাজ।

সব ধরনের কুৎসিত নোংরা খেলা বন্ধ হোক।

বন্ধ হোক আগুন নিয়ে খেলা ।



উৎস :

ডেইিল স্টার থেকে।





মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:৩১

হাসান কালবৈশাখী বলেছেন: Click This Link

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.