![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশ সংকটে যুদ্ধ আসন্ন মনে হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালের এপ্রিলে চটজলদি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর হামলা চালানোর জন্য সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে চাপ দিতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে তড়িঘড়ি সামরিক অভিযান চালানোর ব্যাপারে জনসংঘের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। মানেকশ দৃঢ়তার সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেন এবং জানিয়ে দেন যে, যুদ্ধের জন্য তাদের বর্ষাকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, শীতকালে হিমালয়ের গিরিপথগুলো বরফে আচ্ছাদিত হওয়া নাগাদ আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে নয়তো চীন সামরিক হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। এ যুক্তি দেয়ায় কয়েকজন উ্বর্ধতন রাজনৈতিক নেতা মানেকশকে বরখাস্ত করে অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে জেনারেল মানেকশ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের ইচ্ছামতো দ্রুত যুদ্ধ শুরু করতে চাইলে দেশের সম্মান খোয়া যেতে পারে এবং সৈন্য, কামান ও সাজসরঞ্জাম মৌসুমি বৃষ্টিতে আটকা পড়বে। তাতে যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটবে। তিনি তার বক্তব্য শেষ করে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেন। ইন্দিরা মানেকশর পদত্যাগের প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং তার পরামর্শ গ্রহণ করেন।
বয়রা যু্দ্ধ
২১ নভেম্বর ভারত সীমান্তের কাছে যশোর শহর থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে বয়রায় প্রথম ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী ৬ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে চৌগাছা দখল করে নেয়। তবে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। কয়েকটি ভারতীয় ট্যাংক জলাভূমিতে আটকা পড়ে। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রথম বিমান বাহিনীর সহায়তা কামনা করে। তাদের মধ্যে ট্যাংক যুদ্ধও হয় এখানেই প্রথম। পিটি-৭৬ ট্যাংক সজ্জিত ভারতের ৪৫তম ক্যাভালরি গরীবপুর দখলে এগিয়ে এলে উভয়পক্ষের তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় হামলা মোকাবিলায় পাকিস্তানের ১০৭তম পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় এম-২৪ শ্যাফি ট্যাংক সজ্জিত তৃতীয় সাঁজোয়া স্কোয়াড্রন এগিয়ে আসে। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় পাকিস্তানিরা ভারতীয় হামলা গুঁড়িয়ে দিতে পারতো। কিন্তু পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। ভারতীয়রা পদাতিক বাহিনী ও রিকয়েললেস রাইফেলকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রেখে ট্যাংকগুলোকে সামনে পাঠায়। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ধরে ভারতীয় ট্যাংক থেকে পাকিস্তানি অবস্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু ঘন কুয়াশা থাকায় পাকিস্তানিরা ভারতীয় ট্যাংকের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। পিছু না হটে পাকিস্তানি ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী ভারতীয় অবস্থানের দিকে ধেয়ে যায়। ভারতীয়রা এ হামলা ব্যর্থ করে দেয়। পাকিস্তানি পক্ষে ব্যাপক হতাহত হয়। দু্পুরের মধ্যে তাদের ১১টি ট্যাংক অকেজো এবং ৩টি সচল অবস্থায় ধরা পড়ে। অন্যদিকে ভারতের ধ্বংস হয় ৬টি ট্যাংক। পাকিস্তানের ১০৭তম ব্রিগেড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় ৪০ জন। ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি কমান্ডার বিমান বাহিনীর সহায়তা চান। ভারতীয় রাডারে তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেটের উড্ডয়ন ধরা পড়লে চারটি ভারতীয় ন্যাট কলকাতার দমদম বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে। ভারতীয় বিমান তেড়ে আসার আভাস পেয়ে স্যাবরগুলো নিজেদের ভূখন্ডে ফিরে আসে। দ্বিতীয়বার ভারতীয় রাডারে ধরা না পড়ায় স্যাবারগুলো অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ পান। বিকেলে ভারতীয় স্থলবাহিনীর উপর তৃতীয় দফা বিমান হামলা হয়। জঙ্গিবিমানগুলো রাডারে ধরা পড়ার তিন মিনিটের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রায় এন্ড্রু মাসির নেতৃত্বে চারটি ন্যাট উড়ে আসে। অন্য তিনটি ভারতীয় বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এমএ গণপতি, ফ্লাইং অফিসার কেবি বাগচি ও ফ্লাইং অফিসার ডন লাজারাস। ন্যাটগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে হামলায় অংশ নেয়। ভারতীয় ন্যাটের গুলিতে দু’টি স্যাবর ঘায়েল হয়। উইং কমোডর চৌধুরীর বিমান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকলেও তিনি তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ভারতের নওগাঁর কাছে একটি গ্রামে দু’টি পাকিস্তানি স্যাবর ভূপাতিত হয়। জ্বলন্ত বিমান থেকে প্যারাশূট দিয়ে নামতে গিয়ে পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহেদী কোরেশী ও ফ্লাইং অফিসার খলিল আহমদ ভারতীয় সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। ভারত পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে লড়াই হওয়ার সত্যতা অস্বীকার করে দাবি করে যে, পাকিস্তানি জেটবিমান ভারতীয় আকাশসীমা লংঘন করেছিল এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানি বিমানগুলোকে গুলি করে নামিয়েছে। বয়রার আকাশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চার ভারতীয় বৈমানিক রায় মাসি, এমএ গণপতি ও ডন লাজারাস ‘বীর চক্র’ এবং কেবি বাগচি ‘বায়ু সেনা’ খেতাবে ভূষিত হন। লাজারাস ভারতীয় বাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে হন ফ্লাইট কমান্ডার। ভারতের হাতে বন্দি পাইলট পারভেজ মেহেদী কোরেশী ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে নিযুক্তি পেলে প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়নি। একটি দুর্বল বিশ্বাস নিয়ে ফ্লাইট কমান্ডার লাজারাস তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৯৭১ সালে আকাশ যুদ্ধে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। হয়তো সে স্মৃতি এতদিনে তিনি ভুলে গেছেন। ফ্লাইট কমান্ডার লাজারাস উত্তর পাওয়ার আশা করতে পারেননি। একদিন বিস্মিত হয়ে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পারভেজ মেহেদী কোরেশীর স্বাক্ষর দেয়া একটি চিঠি পান। চিঠিতে কোরেশী ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে লাজারাসের অফুরন্ত মঙ্গল কামনা করেন। লাজারাস এ চিঠি অত্যন্ত যত্ম করে নিজের কাছে রেখে দেন।
পাকিস্তানের প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা
অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ২৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। জন্মলগ্ন থেকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত থাকায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল, ÔThe defense of East lies on the West.’ ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর।’ এ প্রতিরক্ষা নীতির আওতায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব রণাঙ্গনের উপর ভারতীয় হামলার চাপ কমাতে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে যতটুকু সম্ভব ততটুকু ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায়ে যুদ্ধের পথ বেছে নেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টায় ভারতে হামলা চালানোর চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। ১০ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রথম বহর আকাশে উড্ডয়ন করে এবং লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। সরকারি চ্যানেলে ঘোষণা করা হয় যে, পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানি রেঞ্জারদের চৌকিতে বিমান বাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সৈন্যদের হামলার জবাবে এ বিমান হামলা চালানো হয়। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৫টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তান বিমান বাহিনী পশ্চিম ভারতের ৮টি বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে। সীমান্ত থেকে ৩ শো মাইল অভ্যন্তরে আগ্রায়ও বোমাবর্ষণ করা হয়। পাকিস্তানের এ অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান।’ ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলের ‘অপারেশন ফোকাস’-এর আদলে ভারতে এ হামলা চালানো হয়। তবে ‘৭৩ সালে ৬ দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জঙ্গিবিমান নিয়ে ইসরাইল আরব দেশগুলোর বিমান ঘাঁটিতে যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, সেই তুলনায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর তৎপরতা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। ভারতে বোমাবর্ষণে পিএএফ ৫০টির বেশি জঙ্গিবিমান ব্যবহার করতে পারেনি। পাকিস্তানি বিমান হামলায় ভারতীয় ঘাঁটিগুলোর রানওয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য অকেজো ছিল। তবে ভারতীয়রা পশ্চিম রণাঙ্গনে এ ধরনের হামলা চালানোর সত্যতা অস্বীকার করে। ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা রাডার পাকিস্তানি বিমান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বিমানগুলোর গর্জন শুনে ভারতীয়রা পাকিস্তানি বিমান হামলা আঁচ করতে সক্ষম হয়। দিল্লিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর সাংবাদিকদের নিয়মিত ব্রিফিং দেয়া হতো। এ সময় দিল্লিতে সাইরেন বেজে উঠলে সাংবাদিকরা বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
ভারতের অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটি ও রাডার স্থাপনায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে একাত্তর সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে তিন দফা ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়। যেসব বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করা হয় সেগুলো ছিল অমৃতসর, আম্বালা, আগ্রা, অবন্তিপুর, বিকানার, হালবারা, যোধপুর, জয়সালমার, পাঠানকোট, শ্রীনগর, উত্তরলাই ও ফরিদকোট। ভারতীয় হামলার পরিকল্পনার কথা জানাতে পেরে পাকিস্তান বিমান বাহিনী আগেভাগে হামলা চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ যুদ্ধ শুরু করার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ৪ ডিসেম্বর। এ তারিখ সেনা কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল মোজাফফর হাসানের কাছে যুদ্ধ শুরু করার ভারতীয় সংকেত ধরে পড়ে। ৪ লাকি সংখ্যা হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরকে ডি-ডে হিসাবে বেছে নেয়া হয়। ডে-ডে’র বিষয়ে সমঝোতা হওয়ায় জেনারেল মানেকশ ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল সরদারী এম নন্দ ও সেনা কমান্ডারদের তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিমানের গর্জন শুনে ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের অনেকেরই ধারণা করেছিলেন যে, ডি-ডে’র সময় ও তারিখ এগিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি হামলার জবাব দানের সিদ্ধান্ত নেন। সৈন্যদের লুটপাট ও ধর্ষণে লিপ্ত না হওয়ার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেন। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে রেডিও ঘোষণায় তিনি বলেন,‘When you see a Begum, keep your hands in your pockets and think of Sam. ‘কোনো মহিলাকে দেখতে পেলে হাত পকেটে গুজে রাখবে এবং স্যামের কথা স্মরণ রাখবে।’
৩০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান খানের মধ্যে এক বৈঠকে ঘোষণা ছাড়া ভারতে বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভারতে বিমান হামলা চালানোর পেছনে পাকিস্তানের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল:
(১) ভারতীয় সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে বাধা দান। অসংখ্য নদীনালা ও খাল বিল থাকায় বাংলাদেশের গভীর অভ্যন্তরে সৈন্য চলাচল করা সহজতর ছিল না। সৈন্য, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের পক্ষে বিশাল বিশাল নদী পাড়ি দেয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন।
(২) অপ্রত্যাশিতভাবে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে তাক লাগিয়ে দেয়া।
(৩) পশ্চিম রণাঙ্গনের আকাশে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের এসব বিমান ঘাঁটিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া।
(৪) ভারতের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে বিমান শক্তিতে ভারতের সংখ্যাধিক্যের বিপরীতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর কন্ট্রোল সেন্টারগুলোতে কাজের পালা পরিবর্তনকালে আকস্মিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনের অভিজ্ঞতার আলোকে রাতের অন্ধকারে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে প্রথমে দু’টি তরঙ্গে এবং পরে রাতব্যাপী আরো কয়েক দফা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভূগর্ভস্থ বাংকারে (পেন) ভারতীয়রা তাদের বিমান লুকিয়ে রাখবে বলে আন্দাজ করা হয়েছিল। জ্বালানি ট্যাংকার, গোলাবারুদের মজুদ ও কমান্ড সেন্টারের মতো আচ্ছাদিত লক্ষ্যবস্তুগুলোতে নির্ভুল বোমাবর্ষণের জটিলতাও বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল।
ইয়াহিয়া খানের অফিসে কর্মরত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা আগেই জানতে পেরেছিল যে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতে হামলা চালাবে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিরা স্বপক্ষত্যাগ করায় ভারতে হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় বলে কেউ কেউ অনুমান করেছেন। এছাড়া ভারতীয় বিমানঘাঁটিগুলোর রানওয়ে অকেজো করে দেয়ার মতো গোলার ঘাটতিও ছিল। গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী এ ধরনের একটি হামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভারতীয় বিমান বাহিনীতে রেড এলার্ট জারি করা হয় এবং পহেলা ও ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটিগুলো থেকে জঙ্গিবিমান প্রত্যাহার করা হয়। ভারতীয়রা গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ধারণা করেছিল যে, পহেলা ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমান হামলা হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদানীন্তন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাউয়ের পীড়াপীড়িতে ৩ ডিসেম্বরও বিমান বাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়। সেদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী সতর্ক থাকায় পাকিস্তান বাহিনী তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার পাল্টা পদক্ষেপ
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে ছিলেন। কংগ্রেসের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগদানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি এ মহানগরী সফরে ছিলেন। কলকাতায় প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় তিনি একটি বিশেষ বিমানে রাজধানী নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা হন। তাকে বহনকারী বিমানটি লক্ষ্ণৌর অদূরে পূর্ব আকাশে থাকা অবস্থায় দিল্লি থেকে পাঠানো একটি জরুরি বার্তার জবাব দেয়ার জন্য পাইলট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ককপিটে আসার জন্য অনুরোধ করেন। ডিপি ধর ৩/৪ মিনিট ককপিটে অবস্থান করেন এবং ফিরে এসে ইন্দিরাকে নয়াদিল্লি থেকে প্রেরিত বার্তা অবহিত করেন। ইন্দিরার সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি পেছনে তার নিজের আসনে ফিরে আসেন এবং সামনের আসনে উপবিষ্টদের লক্ষ্য করে বলেন,‘The fool has done exactly what one had expected’ ‘সবাই যা প্রত্যাশা করছিল এই বোকা লোকটি (ইয়াহিয়া খান) ঠিক সে কাজটি করেছেন।’
মিসেস গান্ধীর বিমান নয়াদিল্লীর পরিবর্তে লক্ষ্ণৌতে অবতরণ করে। ১০টায় বিমানটি পুনরায় আকাশে উড্ডয়ন করে। ১০টা ৫৫ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে বহনকারী বিমানটি দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ইন্দিরাকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। মিসেস গান্ধী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সরাসরি অপারেশন রুমে প্রবেশ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ইন্দিরা গান্ধীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সেখানে ছুটে আসেন। তিনি পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করার জন্য তার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাকে তৎক্ষণাৎ অনুমতি দেয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী অপারেশন রুমে একটি টেবিলের উপর স্কচ হুইস্কির একটি বোতল এবং কয়েকটি গ্লাস দেখতে পান। মদের বোতল দেখতে পেয়ে তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করেন এবং বিষয়টি তদন্ত করার জন্য মানেকশকে নির্দেশ দেন। মানেকশ তাকে জানান যে, এ ব্রান্ডের নাম ‘ব্লাক ডগ’। এ মদ খেয়ে ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণে এ মদ পান করাবেন এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করবেন। মানেকশ তাকে বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। সাউথ ব্লকের পশ্চিম অংশে মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা সেখানে এগিয়ে যান। একইদিন রাতে জাতির উদ্দেশে রেডিও ভাষণে তিনি তার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিমান হামলাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। রাতে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে মিসেস গান্ধী যুদ্ধের কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। (১) বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্ত করা (২) আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণাংশ ভারতের সঙ্গে একীভূত করা এবং (৩) পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া যাতে ভবিষ্যতে দেশটি আর কখনো ভারতের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে না পারে। যুদ্ধের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য শিয়ালকোটের মধ্য দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত এগিয়ে যেতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নির্দেশ দেন। সিআইএ তৎক্ষণাৎ ভারতের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ওয়াশিংটনকে অবহিত করে। ভারতীয় মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে সিআইএ’র সোর্স ছিল। এ সোর্সই সিআইএ’র কাছে ভারতীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দেয়।
ভারতের পাল্টা বিমান হামলা
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নির্দেশে ৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রাথমিক জবাব দেয় এবং পরদিন ভোরে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক বোমাবর্ষণ করে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্থাপনাগুলোতে হামলা অব্যাহত রাখে। পরদিন ভোরে দু’টি দেশ তাদের মধ্যে ‘যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করার’ সত্যতা স্বীকার করে। তবে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৩ ডিসেম্বর উভয় দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ এবং স্থলবাহিনীকে ছত্রছায়া প্রদান করলেও আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান গোটা সেক্টরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডকে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে আধিপত্য কায়েমের নির্দেশ দেয়া হয়। তারা সাফল্যের সঙ্গে তাদের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করে। ৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতের ক্যানবেরা বোমারু বিমানগুলো তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপর্যুপরি আঘাত হানে। পাকিস্তানের ১৪তম স্কোয়াড্রনে স্যাবর জেট ছাড়া আর কোনো বিমান ছিল না। এসব বিমানের নৈশকালীন লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করার সামর্থ্য না থাকায় ভারতীয় বিমানগুলোকে পাকিস্তানি বিমানবিধ্বংসী কামান ছাড়া আর কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭ নম্বর, ১৪ নম্বর, ১৭ নম্বর ও ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টার, ২২১ নম্বর স্কোয়াড্রনের এসইউ-৭ এবং ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১-কে তেজগাঁয়ে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টার পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম দিনের বেলায় আক্রমণ চালায়। ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ এসব বিমানকে ছত্রছায়া দেয়। একটি স্যাবর বোমাবর্ষণের আগে হান্টারকে ধাওয়া করার চেষ্টা করে। এসময় হান্টারের গুলিতে পাকিস্তানি স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। ভারতের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রন কুর্মিটোলায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঘাঁটিতে আঘাত হানে। হ্যাঙ্গার ও বিমান স্থাপনা লক্ষ্য করে ভারতীয় বিমানগুলো রকেট নিক্ষেপ করে। বিকেলের মধ্যে ভারতীয় হান্টার নারায়ণগঞ্জে জ্বালানি ডিপোতে আঘাত হানে। ৪ ডিসেম্বর ভোরে ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে বোমাবর্ষণ করে। একইদিন বিকেলে তেজগাঁয়ে ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগের বোমাবর্ষণে একটি টুইন অটার বিধ্বস্ত হয়। ভারতীয় জঙ্গিবিমানকে ধাওয়া করতে ঢাকায় ডগফাইটে তিনটি স্যাবর জেট খোয়া যায়। দু’টি খোয়া যায় কুর্মিটোলায় হান্টারের আঘাতে। উইং কমান্ডার এসএম আহমেদ চারটি ভারতীয় হান্টারকে ধাওয়া করতে একটি স্যাবর জেট নিয়ে আকাশে উড্ডয়ন করেন। হান্টারের সঙ্গে আরো কয়েকটি মিগ ও এসইউ-৭ যোগ দেয়। হান্টারের গুলিতে এফ-৮৬ স্যাবর ভূপাতিত হলে এসএম আহমেদ কুর্মিটোলার ৫ মাইল অদূরে অবতরণ করেন। রশিদী একটি বিমান নিয়ে কয়েকটি ভারতীয় বিমানের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হন। তার একটুখানি দূরে স্কোয়াড্রন লীডার আফজাল ও ফ্লাইট লে. সাঈদ দু’টি এফ-৮৬ নিয়ে ৩টি হান্টারের সঙ্গে ডগফাইটে লিপ্ত হন। আফজাল ও সাঈদের বিরুদ্ধে আরেকটি হান্টার এগিয়ে আসে। এ হান্টারের গুলিতে আফজাল ভূপাতিত হন। কয়েক মিনিট পর আফজাল একটি মিগ-২১ ভূপাতিত করেন। ফ্লাইট লে. সাঈদ নিরাপদে অবতরণে সক্ষম হন। উদ্ধারকারী দল এসএম আহমদ ও সাঈদকে খুঁজে না পাওয়ায় যুদ্ধের সময় তাদের ‘নিখোঁজ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে খবর পাওয়া যায় যে, স্থানীয় জনতার হাতে এ দু’জন পাইলট নিহত হয়েছেন।
৪ ডিসেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জে ভারতের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টারের সঙ্গে লড়াইয়ে একটি স্যাবর জেট ভূপাতিত হলে ফ্লাইট অফিসার সাজিদ নূর প্যারাশূটের সাহায্যে জিনজিরায় অবতরণ করেন। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। এসব মিশনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের ৬ টি হান্টার ও একটি এসইউ-৭ বিধ্বস্ত হয়। লালমনিরহাটে গোলাবারুদ বোঝাই একটি ট্রেনে বোমাবর্ষণ করতে গিয়ে ফ্লাইট লে. এ আর ডি কোস্টা নিহত এবং দু’টি হান্টার ঘায়েল হয়। বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলাবর্ষণে এ দু’টি ভারতীয় বিমান ঘায়েল হয় এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত একটি বিমানের পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার এস কে গুপ্ত নিরাপদে বাগডোগরায় অবতরণ করেন। একইদিন বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রন আরো দু’টি হান্টার হারায়। তবে দু’জন পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার কে ডি মেহরা ও ফ্লাইট লে. কে সি ত্রিমেনহিয়ার নিরাপদে বিমান থেকে বেরিয়ে আসেন। ত্রিমেনহিয়ারকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। তবে কে ডি মেহরা আটক হওয়া থেকে রক্ষা পান এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরে যান। ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়। এ স্কোয়াড্রনের দু’জন পাইলট নিহত হন। তারা হলেন স্কোয়াড্রন লীডার এস বি সামন্ত ও ফ্লাইট অফিসার এস জি খোন্দে। ২২১ নম্বর স্কোয়াড্রনের একটি এসইউ-৭ গুলিতে ভূপাতিত হলে পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার ভি ভুটানিকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ক্যানবেরা বিমানগুলো চট্টগ্রাম বিমান বন্দর, জ্বালানি ট্যাংকার ও তেল শোধনাগারে হামলা চালায়। সেদিন পাকিস্তান বিমান বাহিনী মোট ২৪ বার উড্ডয়ন করে এবং ভারতীয় বিমানকে লক্ষ্য করে ৩০ হাজার রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে ভূমি থেকে আকাশে ভারতীয় বিমান লক্ষ্য করে ৭০ হাজার রাউন্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ইতিহাসে একদিনে আর কখনো এত গোলাবর্ষণ করা হয়নি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, তারা ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১০ থেকে ১২টি বিমান ধ্বংস করে এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনায় গোলাগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যুদ্ধের শেষদিন নাগাদ পাকিস্তান বিমান বাহিনী কার্যক্ষম ছিল।
৪ ও ৫ ডিসেম্বর ঢাকাবাসী অতি নিচুতে বিমানের রোমাঞ্চকর ডগফাইট প্রত্যক্ষ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী বিমান ঘাঁটিতে মোতায়েন পাকিস্তানি বিমানে হামলা চালানোর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। তবে চরম মূল্য দিয়েও তারা পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী স্থলবাহিনীকে ছত্রছায়া প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উপর চাপ হ্রাস পায়। এ ফাঁকে পাক বিমান বাহিনী কুমিল্লা ও আরো কয়েকটি জায়গায় স্থল অভিযানে সহায়তা দানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দু’দিনে স্যাবর জেট মোট ২০ দফা উড্ডয়ন করে এবং ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর মোকাবিলায় এক হাজার দুই শো রাউন্ড গোলাবর্ষণ করে। ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ ভারতীয় বিমান বাহিনী কৌশল পরিবর্তনের কথা উপলদ্ধি করে। পাক বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট ৫ ও ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ ভারতীয় বিমান হামলা থেকে নিজেদের বিমানঘাঁটি রক্ষা করতে সফল হয়। ৬ ডিসেম্বর ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ গৌহাটি থেকে উড়ে এসে তেজগাঁও বিমান বন্দরের রানওয়েতে এক হাজার পাউন্ড ওজনের কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে। বোমাবর্ষণ করায় বিমান বন্দর অপারেশনের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ভারতীয় বিমান হামলার সময় তেজগাঁও বিমান বন্দরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বাধা দেয়ার সময় পায়নি। স্থলবাহিনীকে সহায়তা দিয়ে একটি পাকিস্তানি জেট বিমান অবতরণ করা মাত্র ভারতীয় বিমান হামলা শুরু হয়। ১০ মিটার গভীর ও ২০ মিটার প্রশস্ত দু’টি গর্ত হয়। একটি গর্ত থেকে আরেকটি গর্তের দূরত্ব ছিল এক হাজার ২ শো মিটার। তবে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি ৭ ডিসেম্বর সকাল নাগাদ কার্যক্ষম ছিল। সেদিন সকালে ভারতের ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১ আবার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে। ৬ ডিসেম্বর ভারতের ৭ নম্বর স্কোয়াড্রনকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সেনাবাহিনীকে সহায়তাদানে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ১৪ ও ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১ এবং হান্টারগুলো বিরতি না দিয়ে আঘাত হানতে থাকায় কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির রানওয়েতে বড় বড় গর্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান হামলায় পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পরিত্যক্ত কুমিল্লা, লালমনিরহাট ও শমসেরনগর বিমানবন্দরে আঘাত হানে। যশোর বিমানঘাঁটিতে মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ বিমান বন্দর রক্ষা পায়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ রানওয়েগুলো মেরামতে উপর্যুপরি প্রচেষ্টা চালায়। বেসামরিক শ্রমিকদের সহায়তায় বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীগণ ৬ ও ৭ ডিসেম্বর বিরামহীনভাবে কাজ করে। তেজগাঁও বিমান বন্দরকে পুরোপুরি কার্যক্ষম করে তুলতে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু মেরামত কাজ শেষ হতে না হতেই ৭ ডিসেম্বর বিকেল ৪ টা ৫০ মিনিটে আবার ভারতীয় বিমান হামলা হয়। তখন হিসাব করা হয় যে, রানওয়ে মেরামতের জন্য আরো ৩৬ ঘন্টার প্রয়োজন। ভারতীয় বিমান বাহিনী তেজগাঁও বিমান বন্দর পুনরায় মেরামতের মতো সুযোগ না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। প্রতিপক্ষের বিমান হামলা অব্যাহত থাকায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সেকেন্ড ক্যাপিটালের রাজপথকে রানওয়ে হিসাবে ব্যবহার করার চিন্তা করতে থাকে। তবে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকায় এ সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়ায় পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনী চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
রানওয়ে মেরামতের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ৩৬ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় এবং ভারতীয় বিমান হামলা প্রতিরোধে বিমানবিধ্বংসী ইউনিটগুলোর অক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে উঠায় ৮ ও ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলটদের বার্মার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুরে মোতায়েন পাকিস্তানের ৩৯তম এডহক ডিভিশন নদীপথে পিছু হটার অনুরোধ জানায়। এসব সৈন্য ঢাকা প্রত্যাহারে কয়েকটি লঞ্চের সমন্বয়ে একটি বহর গঠন করা হয়। একটি গানবোটের প্রহরায় ১০ ডিসেম্বর ভোরে এ বহর যাত্রা করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী বহরটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং বোমাবর্ষণ করে। বোমাবর্ষণে নিমজ্জ্বিত কিংবা আটকা পড়ায় লঞ্চগুলো ঢাকা পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। নৈশকালে নৌযান দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে এবং হেলিকপ্টারে করে তাদের উদ্ধার করা হয়।
১১ ডিসেম্বর ৪৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের তিনটি এএন-১২এস জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে বোমাবর্ষণ করে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের বার্তা ধরে ফেলে। এ বার্তা ধরা পড়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকায় হামলা চালানো হয়। নগরীর পর্যটন গাইডের মানচিত্র সঙ্গে নিয়ে ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ আকাশে উড্ডয়ন করে। বৈঠক শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিমানের কানফাটা গর্জন ধ্বনিত হয়। মিগ থেকে গভর্নর হাউস লক্ষ্য করে প্রথমে ৫৭ মিলিমিটার রকেট নিক্ষেপ করা হয়। বোমাবর্র্ষণ করে গভর্নর হাউসের মূল হলরুমের ছাদ ফুটো করে ফেলা হয়। ভবনটি একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ভারতীয় বিমান হামলায় আতংকিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ঢাকায় রেডক্রস সেন্টারে আশ্রয় নেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে এমএ মালিক জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোতে সৈন্য ও গোলাবারুদ বহনে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান বিমান বাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার অব্যাহত রাখে। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে লে. কর্নেল লিয়াকত বুখারীর নেতৃত্বে আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন ৩৯তম এডহক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রহিম খানের মতো বাছাইকৃত অফিসারদের নিয়ে বার্মার মধ্য দিয়ে পালিয়ে যায়।
তেজগাঁও বিমান বন্দর লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত ৭৫০ পাউন্ড ওজনের তিনটি বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে রহমত-ই-আলম ইসলামী মিশন নামে একটি এতিমখানায় পতিত হলে ৩ শো শিশু নিহত হয়। এ এতিমখানায় ৪ শো শিশু ঘুমন্ত ছিল। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে একটি পাটকলের কাছে বস্তিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দু’টি বোমা পতিত হলে ২৭৫ জন লোক নিহত হয়। রহমত-ই-আলম ইসলামী মিশনে বোমাবর্ষণ করেছিল পিস্টল ইঞ্জিন চালিত একটি জঙ্গিবিমান। স্থানীয় ও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা দাবি করছিলেন যে, বিমানটি পাকিস্তানি। পরে জানা যায় যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পিস্টন ইঞ্জিন চালিত কোনো বিমান ছিল না। বিমানটি ছিল মিত্রবাহিনীর।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, ৪ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের ২২ থেকে ২৪ টি বিমান খোয়া যায়। ৭ টি বিমান বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তানি বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে এবং বাদবাকিগুলো বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায়। তবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯ টি বিমান খোয়া যাবার সত্যতা স্বীকার করা হয়। আইএএফ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের তিনটি বিমান প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিমান যুদ্ধে, দুর্ঘটনাক্রমে ৬ টি এবং অবশিষ্টগুলো বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় বিধ্বস্ত হয়। ভারতীয় বিমানের গুলিতে ৫টি স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১৩টি বিমানের কাঠামো উদ্ধার করে। দু’টি টি-৩৩ ট্রেইনার ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। ৮টি স্যাবর জেট সচল করা হয়। ১৯৭২ সালে ৫ টি স্যাবর জেট বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানি হাইকমান্ড বিমানগুলো উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ জারি করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পিএএফ’র প্রধান এয়ার কমোডর ইনাম এ নির্দেশ পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেন, বিমানগুলোর প্রজ্জ্বলিত হওয়ার দৃশ্য ঢাকার প্রতিরক্ষায় মোতায়েন সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে। তার যুক্তি মেনে নেয়া হলে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্যরা গোলাবারুদের মজুদ ধ্বংস করে এবং বিমানগুলোর ইলেক্ট্রিক ও হাইড্রোলিক সিস্টেম অকেজো করে দেয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিনা বাধায় মোট ৪ হাজার বার পাকিস্তানি অবস্থানে হানা দেয়।
পাকিস্তানি বিমান হামলা ব্যর্থ হওয়ার কারণ
পাকিস্তান ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ’ বা হুঁশিয়ারি ছাড়া বিমান হামলা চালালেও তাদের হামলা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অফিসে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ডেপুটি পরিচালক শংকর নায়ারের একজন অনুচর ১৯৭১ সালে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাকে জানায় যে, পহেলা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে হুঁশিয়ারি ছাড়া বিমান হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নায়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানান এবং ‘র’ প্রধান আর. এন. কাউ তা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করেন। নায়ারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় বিমান বাহিনী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু পহেলা ও ২ ডিসেম্বর কিছুই ঘটেনি। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদরদপ্তর নায়ারকে জানায় যে, তারা আর বেশি সময় পাইটলদের সতর্কাবস্থায় রাখতে পারছে না। নায়ার এ সতর্কাবস্থা আরো ২৪ ঘণ্টা বাজায় রেখে কোনো কিছু না ঘটলে ৪ ডিসেম্বর সকালের দিকে সতর্কতার মাত্রা নিচে নামিয়ে ফেলার অনুরোধ করেন। তিনি ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদরদপ্তরকে আশ্বস্ত করেন যে, তার সোর্স অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং তার বিবেচনায় প্রাপ্ত তথ্য সঠিক। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ’ হামলা চালায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকায় তাদের বিমান হামলা ব্যর্থ হয়। কিন্তু যথাসময়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনী হামলা না করায় নায়ারের কপালে ভাঁজ পড়ে। তিনি ভাবতে থাকেন সোর্স নির্ভরযোগ্য হলে তার দেয়া সময় হেরফের হয় কিভাবে? তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পান যে, ‘র’-এর সদরদপ্তর পাকিস্তানি অনুচরের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভুল করে। সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে ‘র’ ৩ ডিসেম্বরকে পহেলা ডিসেম্বর হিসাবে ধরে নেয়।
ভারতীয় বিমানবাহী রণতরীর তৎপরতা
যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে এ দু’টি অঞ্চলের উপকূলবর্তী সাগর অবরোধ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। পূর্ব পাকিস্তান অবরোধে পাঠানো হয় ভারতের একমাত্র বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিক্রম’। ‘বিক্রম’ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ব্রিটেনে তৈরি একটি রণতরী। ১৯৭১ সালের আগে আর কখনো এ বিমানবাহী রণতরী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। করাচি বন্দর অবরোধে বিক্রমের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু বিক্রমের একটি মূল বয়লার অকার্যকর হওয়ায় এবং বিমান হামলার ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ সমুদ্র পথ পাড়ি দেয়ার মতো গতি না থাকায় করাচি বন্দর অবরোধের পরিবর্তে এ বিমানবাহী জাহাজকে পূর্বাঞ্চলে পাঠানো হয়। যুদ্ধ ঘোষণার দিন বিক্রম আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সর্ব উত্তরের প্রান্ত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিক্রমকে বাধাদানে পাকিস্তান ‘গাজী’ নামে তাদের একটি সাবমেরিন পাঠায়। গাজী ছিল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি পুরনো সাবমেরিন। এ সাবমেরিন ভারতের বিশাখাপট্টম পোতাশ্রয়ের আশপাশে মাইন স্থাপন করে। মাইন পুঁততে গিয়ে ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার ‘আইএনএস রাজপুত’ থেকে নিক্ষিপ্ত ডেপথ চার্জের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে পহেলা অথবা ২ ডিসেম্বর গাজী নিমজ্জ্বিত হয়। একজন মৎস্যজীবী বিশাখাপট্টম বন্দরের প্রবেশমুখে সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়। পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিশিয়াল ভাষ্যে বলা হয়, ৪ ডিসেম্বর ইস্টার্ন ফ্লীটের যুদ্ধজাহাজ ‘গাজী’কে ডুবিয়ে দিয়েছে। গাজী নিমজ্জ্বিত হলে বিক্রম নির্বিঘ্নে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছায়।
৪ ডিসেম্বর প্রথম বিক্রমের ডেক থেকে জঙ্গিবিমান উড্ডয়ন করে এবং কঙবাজার ও চিড়িঙ্গায় আঘাত হানে। প্রথম মিশনে ৮টি সী হক বিমান অংশগ্রহণ করে। একইদিন বিকেলে দ্বিতীয় মিশনে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে বোমাবর্ষণ করা হয়। সেদিন রাতে বিক্রম মংলা ও খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করে। মংলা, খুলনা ও বরিশালে মিশন শেষ করে এ ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী ফের চট্টগ্রামে ফিরে আসে। দ্বিতীয় যাত্রায় বিক্রম থেকে উড্ডয়নকারী বিমানগুলো চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়, বিমান বন্দর ও চট্টগ্রামের সংযোগ সড়কগুলোতে বোমাবর্ষণ করে। বোমাবর্ষণ করায় চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলো হয়তো উল্টে যায় নয়তো অর্ধ নিমজ্জ্বিত হয়। ফেনীতেও বোমাবর্ষণ করা হয়। ১২ ডিসেম্বর ভারতের অনুমতি নিয়ে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের তিনটি এবং জাতিসংঘের একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান কুর্মিটোলা বিমান বন্দরের অক্ষত রানওয়েতে অবতরণ করে এবং ব্রিটিশ ও আমেরিকান নাগরিকদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়। ব্রিটিশ বিমানের ক্রু জানায় যে, বিক্রম থেকে উড়ে গিয়ে ভারতীয় বিমান তাদের উপর বোমাবর্ষণ করে। সৌভাগ্যক্রমে বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি. সি. লাল তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাই ইয়ার্স উইথ দ্য আইএএফ’-এ তিনি ব্রিটিশ যাত্রীবাহী বিমানে বোমাবর্ষণের সত্যতা স্বীকার করেন। বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতি ছিল একতরফা। পাকিস্তানের আধুনিক তিনটি সাবমেরিন আরব সাগরে নিয়োজিত থাকায় ভারতীয় নৌবাহিনী পূর্বাঞ্চলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান বেশি জোর দিয়েছিল স্থলযুুদ্ধের উপর । উভচর ও নৌশক্তির সমাবেশ ঘটাতে দেশটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
স্থলযুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন কেকটাস লিলি।’ মানেকশর পরামর্শ অনুযায়ী ঘোষণা দেয়া ছাড়া ২১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়। দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। ধারণা করা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যরা ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত থাকবে। তাই দিনটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করার দিন হিসাবে বেছে নেয়া হয়। সেদিন হেলিকপ্টারের সহায়তা নিয়ে একটি ভারতীয় ব্রিগেড পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকি তছনছ করে দিয়ে ১০ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়ে। একইদিন ভারতের ২৩তম ডিভিশনের আরেকটি ব্রিগেড নোয়াখালী জেলার বিলোনিয়ায় হামলা চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডের ৮ মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভারতের ৫৭তম ডিভিশনের একটি ব্যাটালিয়ন তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার মুকন্দপুর ও সালদান্দিতে দু’টি পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালায়। ভারতের কাছে এ দু’টি সীমান্ত চৌকির পতন ঘটে। সিলেট জেলার তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমায় দু’টি ভারতীয় ব্যাটালিয়ন ধলাই, আথিরাম ও জকিগঞ্জে সীমান্ত চৌকি দখল করে নেয়। এ দু’টি ব্যাটলিয়নে দু’টি গুর্খা কোম্পানি ছিল। রংপুরের ভুরঙ্গামারিতে একটি ভারতীয় ব্রিগেড হামলা চালিয়ে ১৫ মাইল ভেতরে নাগেশ্বরী পর্যন্ত এগিয়ে আসে। সাঁজোয়া ও বিমান বাহিনীর সহায়তা নিয়ে ভারতের নবম ডিভিশনের একটি ব্রিগেড যশোর জেলায় বড় ধরনের একটি হামলা চালায়। চৌগাছার বিপরীতে এ হামলা চালানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করে ফেলার লক্ষ্যে সকল ফ্রন্টে আক্রমণ পরিচালনার পর যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করা হয়।
পুরনো মডেলের বিশেষ করে এম-২৪ এবং পিটি-৭৬ ট্যাংকের অধিকাংশ মোতায়েন করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতের কাছ থেকে এসব ট্যাংক দখল করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছিল চারটি ডিভিশন। এসব ডিভিশনে ছিল ৪০ ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য। পূর্ব পাকিস্তানের চারটি ডিভিশনকে সহায়তা দিতো দু’টি হাল্কা সাঁজোয়া ইউনিট। এ অঞ্চলে মোতায়েন নবম ডিভিশন ভারতের দ্বিতীয় কোরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। পদ্মা ও যমুনা নদীর মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেছিল পাকিস্তানের ষোড়শ ডিভিশন। এ ডিভিশনের বিপরীতে ছিল ভারতের ৩৩তম কোর। ভারতের চতুর্থ কোরের বিপরীতে ছিল পাকিস্তানের ৩৬তম ডিভিশন। উত্তরাঞ্চলে ভারতের ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের বিপরীতে পাকিস্তানের ছিল ষোড়শ পদাতিক ডিভিশন।
উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে হিলি-বগুড়া এলাকায় ভারতের ৩৩তম কোরের সহায়তায় একটি টি-৫৫ ট্যাংক রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়। পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দ্বিতীয় কোরকে সহায়তা করছিল পিটি-৭৬ এর একটি রেজিমেন্ট। পূর্বদিক থেকে হামলায় চতুর্থ কোরকে সহায়তা করছিল তিনটি স্বতন্ত্র সাঁজোয়া স্কোয়াড্রন। একটি ছিল পিটি-৭৬, আরেকটি এএমএঙ-১৩ এবং অন্যটি ফেরেট সাঁজোয়া স্কোয়াড্রন। পক্ষান্তরে বগুড়া এলাকায় ভারতের টি-৫৫ ট্যাংক বহরের বিপরীতে পাকিস্তানের ছিল একটি এম-২৪ শ্যাফি সাঁজোয়া রেজিমেন্ট। পশ্চিমাঞ্চল এবং ঢাকা সেক্টরকে সহায়তা দিচ্ছিল দু’স্কোয়াড্রন শ্যাফি ট্যাংক। সর্বাত্মক লড়াই শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাকিস্তানের অর্ধেক ট্যাংক হয়তো ধ্বংস হয়ে যায় নয়তো ভারতীয়দের হাতে আটক হয়। ততক্ষণে ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। অবশিষ্ট ট্যাংকগুলো আত্মসমর্পণের শর্ত অনুযায়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কমপক্ষে ৩০টি ভারতীয় পিটি-৭৬ ট্যাংক ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাইন বিস্ফোরণে চারটি টি-৫৫ ট্যাংকের চাকা উড়ে যায়। তবে যুদ্ধের পর ১১ টি ছাড়া সব ক’টি ট্যাংক মেরামত করা হয়। এএমএঙ-১৩ ট্যাংককে তেমন একটা যুদ্ধে জড়িত হতে হয়নি। কোনো ফেরেট ট্যাংক ধ্বংস হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যে, ভারতের সপ্তম লাইট ক্যাভালরি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে খোয়া যাওয়া তাদের একটি ট্যাংক পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। চারদিক থেকে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ৬ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার হায়াতের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ১০৭তম ব্রিগেডকে যশোর থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ব্রিগেড দৌলতপুর, খুলনা ও মধুমতি নদীর পূর্ব তীরে পুনরায় অবস্থান গ্রহণ করে। খালি পেয়ে ভারতের নবম ডিভিশন ৭ ডিসেম্বর বিকেলে যশোরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। যুদ্ধে প্রথম যশোর মুক্ত হয়।
ডিসেম্বরের শুরুতে মেজর মইনের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট আখাউড়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর কয়েকটি মারাত্মক আঘাত হানলে ভারতীয় সৈন্যদের ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে যাবার পথ প্রশস্ত হয়। মেজর মইন আজমপুর দখল করে আশুগঞ্জ অভিমুখী রাস্তা মুক্ত করলে ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে আসার সুযোগ পায় এবং তারা আশুগঞ্জের কাছে পাকিস্তান সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ব্রিগেডিয়ার মিশ্র মেজর মইনকে নরসিংদীতে অবস্থান করার এবং ভারতীয় সৈন্যদের ঢাকা এগিয়ে যাবার সময় তাদের পেছন দিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। মেজর মইন ব্রিগেডিয়ার মিশ্রর নির্দেশ অমান্য করে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হন।
মেঘনা নদী অতিক্রমের সাংকেতিক নাম ছিল ‘মেঘনা হেলি ব্রিজ।’ ৯ ডিসেম্বর এ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ভারতের চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎ সিং উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ভৈরব সেতু অতিক্রম করতে পারলে ঢাকা পর্যন্ত তার সামনে উল্লেখযোগ্য কোনো বাধা থাকবে না। আকাশ থেকে গৃহীত চিত্রে তিনি দেখতে পান, ভৈরব সেতু উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তখন হিসাব করা হয় যে, বিশাল মেঘনা বক্ষে একটি নয়া সেতু নির্মাণে আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের প্রয়োজন হবে এবং শক্তিপ্রয়োগের চেষ্টা করা হলে বিপুল প্রাণহানি ঘটবে। এ পরিস্থিতিতে জেনারেল সগৎ ও ভারতের ৫৭তম মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল বিএফ গঞ্জালভেস হেলিকপ্টার যোগে সৈন্য পারাপারের সিদ্ধান্ত নেন। মেঘনা নদী অতিক্রমের সময় ভারতীয় সৈন্যদের গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া বাহিনীর সহায়তা ছিল না। ৯ ডিসেম্বর ভারতীয়রা আশুগঞ্জের দক্ষিণে রায়পুরায় অবতরণ করতে থাকে। রায়পুরায় নিজেদের অবস্থান সংহত হলে ভারতীয় সৈন্যদের নরসিংদীতে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দ্র সিং নদী পারাপারে নেতৃত্ব দেন। তিনি এমআই-৪ হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। ৯ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী পুরো ৩১১ ব্রিগেডকে নদীর পশ্চিম পাড়ে বহন করে নিয়ে যায়। পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টায় ১১০ বার কপ্টার উড্ডয়ন করে। একটি এমআই-৪ সাধারণত ১৪ জন করে সৈন্য বহন করতে পারতো। কিন্তু সেদিন সৈন্য বহন করা হয় ২৩ জন করে। একইসময়ে ভারতের ৭৩তম ব্রিগেড নৌকা ও নৌযানে করে মেঘনা নদী পাড়ি দেয়। নরসিংদীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় সৈন্যরা ১৪ ডিসেম্বর দাউদকান্দি এবং ১৫ ডিসেম্বর বৈদ্যেরবাজার মুক্ত করে। এ পর্যায়ে ভারতীয় সৈন্যদের সামনে ঢাকা অভিমুখী মহাসড়ক উন্মুক্ত হয়ে যায়। হুমকি দেখা দেয়া না সত্ত্বেও ভৈরব সেতু উড়িয়ে দেয়ায় ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানি ব্রিগেড আশুগঞ্জে কার্যকরভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মৌলভীবাজারে মোতায়েন পাকিস্তানের ৩১১তম পদাতিক ব্রিগেড ঢাকার প্রতিরক্ষায় এগিয়ে না এসে সিলেটে পিছু হটে। ৩১১তম ব্রিগেড ছিল পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের অংশ। এ ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ। তাকে ঢাকায় পিছু হটার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ভারতীয়রা রেলপথ দখল করে নেয়ায় সৈন্য পারাপারে তাকে ৬টি ফেরিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি নির্দেশ অমান্য করেন। ভারতীয় সৈন্যরা মেঘনা নদী অতিক্রম করার সময় তার সৈন্যরা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। মেঘনা নদী উন্মুক্ত হয়ে গেলে ঢাকার প্রতি মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। জেনারেল নিয়াজি নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদকে কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে যায়। এ ধাক্কা সামলানো সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করায় জেনারেল নিয়াজি অন্য কাউকে মেজর জেনারেল মজিদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেননি। তাই তিনি তার ডিভিশনকে ৩৬ এডহক ডিভিশনের আওতায় ন্যস্ত করেন।
মেঘনা নদী অতিক্রম সম্পন্ন হলে ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে ভারতের ছত্রীসেনা অবতরণ করে। টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনাদের অবতরণের লক্ষ্য ছিল যমুনার পুঙ্গলি সেতু দখল করে উত্তরাঞ্চল থেকে পশ্চাদপসরণকারী ৯৩তম পাকিস্তানি ব্রিগেডের ঢাকার প্রতিরক্ষায় ছুটে আসা রোধ করা। ভারতের সেকেন্ড প্যারাশূট ব্যাটালিয়নকে ঢাকা অভিমুখে মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সঙ্গে সংযোগ সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয়। ছত্রীসেনা অবতরণে নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল কুলবন্ত সিং। টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণে একাদশ ও ৪৮তম স্কোয়াড্রনের এএন-১২, সি-১১৯, ক্যারিবু ও ডাকোটা বিমান অংশগ্রহণ করে। সর্বমোট এক হাজার সৈন্য বিমান থেকে প্যারাশূটের সাহায্যে অবতরণ করে। সৈন্য অবতরণে ২২ নম্বর স্কোয়াড্রনের ন্যাট ছত্রছায়া প্রদান করে। ভারতের সেকেন্ড প্যারাশূট ব্যাটালিয়নের সঙ্গে একটি আর্টিলারি ব্যাটারি, একটি প্রকৌশল ডিটাচমেন্ট, একটি এডিএস, একটি সার্জিক্যাল টীম এবং ৫০তম স্বতন্ত্র প্যারাশূট ব্রিগেডের অন্যান্য সৈন্য যোগ দেয়। ১১ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টায় ভারতের ছত্রীসেনারা ভূমিতে প্রথম অবতরণ করে। ভূমিতে অবতরণ করে ছত্রীসেনারা একটি বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ৩ শো পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় ছত্রী সেনাদের চীনা সৈন্য ভেবে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে বন্দি হয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি সিগনাল নম্বর জি-১২৫৫-তে বিমানে করে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। তার অনুরোধের কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় টাঙ্গাইলে মোতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যরা এ ভুল করে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ভারতীয় সৈন্যরা ৯৩তম পাকিস্তানি ব্রিগেডের ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে আসা রোধ করে। মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি টাঙ্গাইল সড়কে ধরে এগিয়ে আসে এবং পুঙ্গলি সেতুতে পৌঁছে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা সেতুটি পুনর্দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনাদের অবতরণ ছিল পাকিস্তানের ৯৩ ব্রিগেডের পশ্চাদপসরণ রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভারতীয় ছত্রীসেনারা অবতরণ করায় টঙ্গী-ঢাকা ও মানিকগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়ক উন্মুক্ত হয়ে যায়। ঢাকার উপকন্ঠে মিরপুর সড়ক অরক্ষিত হয়ে পড়লে পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুত পরাজিত হওয়ার পথে ধাবিত হয়।
জেনারেল নিয়াজির রণকৌশল ছিল ক্রটিপূর্ণ। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার জন্য সীমান্তের ৩৯০টি পয়েন্টে শক্তিশালী ঘাঁটিতে সৈন্য ও ভারি সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করে রেখেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে তার মোকাবিলা হবে। এ ধারণা থেকে তিনি দেশের ভেতরে সৈন্য মোতায়েন রেখেছিলেন খুব সামান্য। ভারতীয়রা তার এ ক্রটিপূর্ণ কৌশলের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে সোজা রাজধানী ঢাকার দিকে ধেয়ে আসে। ভারতীয়দের এ চাল ছিল দাবা খেলায় রাজা খেয়ে ফেলার মতো। স্থল যুদ্ধে পাকিস্তানিরা ৪১ টি ট্যাংক, ৫০টি কামান/ ভারি মর্টার ও ১০৪টি রিকয়েললেস গান হারায়। অন্যদিকে ভারতের ধ্বংস হয় ২৪টি ট্যাংক এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৩টি।
হিলির স্মরণীয় লড়াই
১৯৭১ সালে হিলিতে সর্বোত্তম যু্্দ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এই একটি মাত্র জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বিপুলসংখ্যক শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এক পক্ষ অকপটে অন্যপক্ষের বীরত্বের প্রশংসা করেছে। একটি পাকিস্তানি ব্রিগেড লড়াই করেছে একটি পুরো ভারতীয় ডিভিশনের বিরুদ্ধে। এখানকার যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৩০৫তম ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার তোজাম্মল হোসেন মালিক এবং ভারতীয় পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ২০তম মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল লক্ষ্ণণ সিং। ২০৫তম ব্রিগেড ছিল পাকিস্তানের ষোড়শ ডিভিশনের আওতায়। ভারতের ৩৩তম কোরের অংশ ২০তম মাউন্টেন ডিভিশনে ছিল ৬৬তম, ১৬৫তম, ২০২তম এবং ৩০৪তম ব্রিগেড। এ ডিভিশনকে সহায়তা করছিল তৃতীয় সাঁজোয়া ব্রিগেড, ৪৭১তম প্রকৌশল ব্রিগেড ও আরো দু’টি আর্টিলারি ব্রিগেড।
সাঁজোয়া ও আর্টিলারির মুহূর্মুহূ গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও ভারতীয়রা হিলিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের টলাতে পারেনি। পতন ঘটাতে না পেরে ভারতীয় সৈন্যরা এ দুর্গ এড়িয়ে গিয়ে পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে পাক-ভারত যু্দ্ধ শুরু হওয়ার আগে ২১ নভেম্বর হিলিতে লড়াই শুরু হয়। দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। ২২ মারাঠা রেজিমেন্টে দু’টি মুসলিম কোম্পানি থাকায় ঈদ উদযাপনে ভারতীয় সৈন্যরা প্রচুর বীয়ার পান করে। এসময় একজন ভারতীয় অফিসার পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে মিষ্টি পাঠানোর প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব অনুযায়ী হাতে লেখা শুভেচ্ছা বাণী ও ৬টি মিষ্টির প্যাকেট মর্টারের গোলায় ভরে ছুঁড়ে মারা হয়। পাকিস্তানি অবস্থানের পাঁচ শো গজের ভেতর এসব মিষ্টির প্যাকেট গিয়ে পতিত হয়। কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সৈন্যরাও একইভাবে ৬টি মিষ্টির প্যাকেট ছুঁড়ে মারে। পাকিস্তানিদের ছুঁড়ে মারা মিষ্টির প্যাকেটগুলো কী করা হবে এ নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। কেউ কেউ আশংকা করছিল যে, মিষ্টিতে বিষ মেশানো থাকতে পারে। মারাঠা আর্টিলারির মেজর শেখ সন্দেহ না করে সবাইকে মিষ্টি খেতে বলেন। তার কথামতো সবাই একটু একটু করে মিষ্টি খায়। তাদের কাছে এ মিষ্টি খুব সুস্বাদু বলে মনে হলো।
পাকিস্তানের ২০৫তম ব্রিগেডে ছিল চতুর্থ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (৪এফএফ)। এ ফোর্স ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশর নিজস্ব রেজিমেন্ট। ব্রিটিশ ভারতে তিনি ছিলেন এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭১ সালে হিলিতে মানেকশর পুরনো রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তারই বাহিনীকে। গড়ে ভারতীয় সৈন্যরা ১৮ কেজি ওজন বহন করছিল। হাতাহাতি লড়াইয়ে তারা গুর্খাদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র খুকরি ব্যবহার করে। হাজার হাজার অস্ত্রের গোলাবর্ষণে আকাশ আলোকিত হয়ে উঠে। মনে হচ্ছিল হিন্দুদের দেয়ালি উৎসব। ভারতীয় সৈন্যরা ‘বল বজরং বলি কি জয়, জয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ কি জয়,’ প্রভৃতি রণধ্বনি দিয়ে কাঁটা তারের বেষ্টনী এবং মাইন ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিপরীত দিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘আল্লাহু আকবর।’ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে মা কালিকে স্মরণ করতে গিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের মুখ থেকে উচ্চারিত হতো, ‘আয় মা।’ ভারতের অষ্টম গার্ডস প্রথমে হামলা চালায়। অষ্টম গার্ডস ভেবেছিল তারা হতাহত হওয়া ছাড়াই কাঁটা তারের প্রতিবন্ধক, মাইন ক্ষেত্র ও পরিখা অতিক্রম করতে পারবে। কিন্তু তাদের আশা দুরাশায় পরিণত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের মর্টার ও রকেট নিক্ষেপ এবং গোপনস্থানে প্রোথিত মেশিনগানের গুলিতে অগ্রসরমান ভারতীয় সৈন্যদের অনেকেই ধরাশায়ী হয়।
ষোড়শ রাজপুত রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর ভিডি গুপ্ত রণাঙ্গনে একজন সুবেদারের সাক্ষাৎ পান। এ সুবেদার লড়াইয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তার অস্বীকৃতির কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রথম দিন তিনি অরুণাচলে বন্দি হন। চীনারা তাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে। একইভাবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রথম দিন কাশ্মীরের তিথওয়ালে তিনি বন্দি হন। পাকিস্তানিরা তার উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। তাই তার আশংকা হিলিতে যুদ্ধের প্রথমদিন তাকে বন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে। মেজর গুপ্ত এ আবেগপ্রবণ সুবেদারকে বুঝিয়ে সুজিয়ে যুদ্ধে যোগদানে রাজি করান।
উভয়পক্ষে ৪৮০ জন সৈন্য হতাহত হয়। প্রথম রাতে ভারতের অষ্টম গার্ডস প্রায় ৫০শতংশ সৈন্য হারায়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন অষ্টম গার্ডসের ডি কোম্পানির কমান্ডার মেজর কে কে রাও এবং বি কোম্পানির কমান্ডার মেজর মাঞ্জরেকার। মেজর এইচডি মাঞ্জরেকারের শরীরে ৩৪টি গুলি লেগেছিল। মৃত্যুকালে তার এক হাতে ছিল হাল্কা মেশিনগান এবং তার থলিতে ছিল একটি হ্যান্ড গ্রেনেড। এ যুদ্ধে মোট চারজন ভারতীয় অফিসার, দু’জন নন কমিশন্ড অফিসার ও ৬১ জন সৈন্য নিহত এবং ৮৫ জন আহত হয়।
১১ ডিসেম্বর ষোড়শ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ বগুড়ার প্রতিরক্ষায় এগিয়ে যেতে হিলিতে অবস্থানকারী সৈন্যদের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ পেয়ে ব্রিগেডিয়ার মালিক তার সৈন্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে হিলি থেকে নওগাঁয় পিছু হটার নির্দেশ দেন। নওগাঁয় তখনো তার একটি ব্যাটালিয়ন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। সৈন্যদের লড়াইয়ে উৎসাহিত করতে ব্রিগেডিয়ার মালিক পতাকা শোভিত ফ্লাগ কার নিয়ে বগুড়ার রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়াতেন। অবরোধ ভেঙ্গে নওগাঁয় পিছু হটার পথে তিনি আক্রান্ত হন। গুলিতে তার আর্দালী নিহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তার দু’টি হাত ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মাথা থেতলে দেয়া হয়। তাকে প্রায় অচেতন অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ভারতীয়রা ব্রিগেডিয়ার মালিকের লড়াইয়ে এত মুগ্ধ হয় যে, কেন শেষদিন পর্যন্ত তার ব্যূহ ভেদ করা সম্ভব হয়নি তার কারণ খুঁজে বের করতে যু্দ্ধ থেমে যাবার পর হিলিতে একটি ভারতীয় বিশেষজ্ঞ টীম পাঠানো হয়। ব্রিগেডিয়ার মালিক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে হিলির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি নোয়াপাড়া রেললাইন, বাসুদপুরা চেকপোস্ট ও রেলওয়ে স্টেশনে পর্যবেক্ষণ চৌকি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পরিখার সঙ্গে আরেকটি পরিখার আন্তঃসংযোগ গড়ে তোলা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখী সকল রুট রক্ষায় অভ্যন্তরেও কয়েকটি সুরক্ষিত অবস্থান গড়ে তোলা হয়। ৪ ও ১৩ এফএফ’র জওয়ানরা এসব অবস্থান কার্যকরভাবে রক্ষা করেছিল। মালিকের ব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয়রা হিলি এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। এখানে ১৯ দিন লড়াই হয়। লড়াই শুরু হয়েছিল ২০/২১ নভেম্বর রাতে এবং শেষ হয় ১১/১২ ডিসেম্বর। হিলির পতন ঘটিয়ে বগুড়ায় এগিয়ে যাওয়া ছিল ভারতীয়দের লক্ষ্য। বগুড়ার রাস্তা ছিল হিলির মাঝ দিয়ে। ভারতীয়রা চাইছিল এ ব্রিগেডকে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাদবাকি পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে ৩৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেড মেজর হোসেন ৫০ জন জওয়ান নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। ১৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণে ভারতীয়রা মেজর জেনারেল নজর হোসেনকে হেলিকপ্টারে করে বগুড়া থেকে ৪০ মাইল দূরে নাটোরে বহন করে নিয়ে যায়।
উভয়পক্ষ অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করায় হিলির লড়াই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উভয়পক্ষের কয়েকজন সৈন্য নিজ নিজ দেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম গার্ডসের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল শমসের সিং ও চতুর্দশ গার্ডসের ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা ‘পরম বীর চক্র’, মেজর জেবিএসওয়াই যাদব ও মেজর অভিজিত মামিক ‘বীর চক্র’ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল তারিক আনিস মালিক ‘সিতারা-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হন। লে. কর্নেল তারিক পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কে পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। হিলি লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ভারতের ২০তম মাউন্টেন ব্রিগেডের ৫/১১ গুর্খা রাইফেলসের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল এফটি ডায়াস ও ক্যাপ্টেন বিকে বোপানা এবং চতুর্দশ জিওসি ডিভিশনের ট্যাংক রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর এসপিএম ত্রিপাঠী পরবর্তীকালে লে. জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। কর্নেল শমসের সিং মেজর জেনারেল ও মেজর অভিজিত মামিক ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ভারতের হাতে ৩২ জন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বন্দি হয়েছিলেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার মালিক ছাড়া আর কেউ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হতে পারেননি।
হিলি লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এসপিএম ত্রিপাঠী ২০১০ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা সফরে এসে তার বিরল অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লড়াইয়ের সময় তার ট্যাংক একটি ধানক্ষেতে আটকা পড়ে। রাত পার হয়ে যায়। পরদিন অনেক চেষ্টা করেও তিনি তার ট্যাংক এক চুলও নড়াতে পারেননি। পাকিস্তানি সৈন্যরা তার ট্যাংক আটকা পড়ার সংবাদ পেয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এসময় মারাঠা আর্টিলারির তিন মুসলিম জওয়ান তার কাছে তাদের রাইফেল তুলে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলার আগে অন্য জায়গা থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ছুটে আসে তাকে উদ্ধার করে।
মেজর জেনারেল লক্ষ্ণণ সিং তার ‘ইন্ডিয়ান সোর্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ নামে বইয়ের দু’টি অধ্যায়ে হিলির লড়াই নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, , ÔBrigadier Tajammal was the only exception in my sector who showed fanatical will to fight even at the cost of his life.Õ ’ ‘আমার সেক্টরে ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মল ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে লড়াই করার জন্য ধর্মান্ধ অভিপ্রায় প্রদর্শন করেছিলেন।’ মে. জেনারেল সুখবন্ত সিং তার ‘লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ নামে পুস্তকে লিখেছেন, ÔDid Thapan (Indian 33 Corps Commander) capture territory? At the time of ceasefire, had capture all territory east of Atrai river and north of Balurghat bulge as well as a sustained area of waistline, but all important towns like Dinajpur, Saidpur, Rangpur, Rajshahi and Natore were still holding out and had capability of sustained resistance (ভারতীয় ৩৩তম কোর কমান্ডার) কি কোনো ভূখণ্ড দখল করেছিলেন? যু্দ্ধবিরতিকালে তিনি আত্রাই নদীর পূর্ব দিকের সকল ভূখণ্ড, বালুরঘাটের উত্তরাংশ এবং কটিদেশের এক উল্লেখযোগ্য ভূমি দখল করেছেন। কিন্তু দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী ও নাটোরের মতো সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর তখনো প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এসব শহরের অব্যাহত প্রতিরোধ চালিয়ে যাবার সামর্থ্য ছিল।’
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড আত্মসমপর্ণ করা সত্ত্বেও ব্রিগেডিয়ার মালিকের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। স্টাফ অফিসার তাকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিলেও তিনি তার প্রস্তাব উপেক্ষা করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে সবাই পরিত্যাগ করলেও আমার হাতে যদি কেবল একটি পিস্তল থাকে তবু আমি আত্মসমর্পণ করবো না।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম সৈন্য কখনো আত্মসমর্পণ করতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ। যুদ্ধের শেষদিকে প্রতিদিন ৩০-৪০ জন করে পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হতো। সে সময় মেডিকেল গ্রাউন্ড দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসাররা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে বসে ব্রিগেডিয়ার মালিক এসব রিপোর্ট দেখতেন। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি মারাত্মক দেখে তিনি জেনারেল নিয়াজির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখেন। ব্রিগেডিয়ার বাকির ছিলেন তার বন্ধু। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমরা কি পূর্ব পাকিস্তানকে স্পেন হতে দিতে পারি?’ এ মন্তব্য করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং চান। তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। হিলিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিনদিন আগে ১৯ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং নিয়ে এসেছিলেন। এখানে এসেই তিনি অগ্রবর্তী অবস্থানে লড়াই করতে ছুটে যান। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি তার কঠিন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘স্টোরি অব মাই স্ট্রাগল’ নামে একটি আলোচিত বই লিখেছেন। তিনি একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অনেক তথ্য ফাঁস করেছেন। জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণকে তিনি রহস্যময় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য তাদের কাছে আরো ৬ মাসের অস্ত্রশস্ত্র মজুদ ছিল।
কামালপুর যুদ্ধ
হিলির মতো জামালপুরের কামালপুরেও পাকিস্তানিরা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে। এ সেক্টর ছিল পাকিস্তানের ৩৬তম এডহক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদের কমান্ডে। এ ডিভিশনের ৯৩ ব্রিগেডের অধীন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক অনুপম বীরত্বের পরিচয় দেন। তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে শত্রু ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ তার কাছে ব্যক্তিগত অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। নিয়মিত বাহিনীর ৭৫ জন এবং আধাসামরিক বাহিনীর আরো ৭৫ জন সৈন্য নিয়ে তিনি নির্ভয়ে লড়াই করেছেন। ক্যাপ্টেন মালিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তার কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের মেজর আইউব তার কাছে সরবরাহ পাঠানোর চেষ্টা চালাতে গিয়ে একইভাবে ব্যর্থ হন। ৪ ডিসেম্বর অনুরূপ চেষ্টা চালাতে গিয়ে গুলিতে তিনি নিহত হন। তাকে ভারতীয়রা সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করে। ব্রিগেডিয়ার ক্লার মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি ও ১২০মিলিমিটারের চারটি কামান নিয়ে মালিকের অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে তিনি তার অবস্থান ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ঘেরাও হয়েও মালিক আত্মসমর্পণ না করায় তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করতে আসার পথে ভারতের ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবঙ সিং গিল মাইন বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন। ব্রিগেডিয়ার ক্লারও তার সঙ্গে ছিলেন। তবে তার আঘাত তত গুরুতর ছিল না। জেনারেল গুরবঙ সিং আহত হলে মেজর জেনারেল নাগরা কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন আহসান আত্মসমর্পণ করার পর দেখা গিয়েছিল যে, তার কোম্পানির গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। তাদের কাছে ছিল মাত্র কয়েকটি গ্রেনেড এবং প্রত্যেকের কাছে ছিল কয়েকটি করে বুলেট। গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসায় তারা ছোরা ও বেয়নেট নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়ার পর্যায়ে ছিল। গুটিকয়েক সৈন্য এমন এক মুহূর্তে প্রাণ বিসর্জন দিতে যাচ্ছিল যে সময় বাংলাদেশের জন্ম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধবন্দিত্ব শেষে দেশে ফেরার পর ক্যাপ্টেন আহসান মালিককে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে এমন বহু ঘটনার নজির খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহসে চমৎকৃত হয়েছে ভারতীয়রা। আবার পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের বীরত্বের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে একথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, বীরের কোনো শত্রু নেই। ৩১ বালুচের কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ছিলেন সেই পর্যায়ের একজন বীর। জেনারেল সুখবন্ত সিং ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’-এ সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘৪ ডিসেম্বর প্রত্যুষে কামালপুর পোস্টে পাকিস্তানি কমান্ডার ও তার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের মধ্যে ওয়ারলেসে বার্তা বিনিময় হয় এবং এ বার্তা ভারতীয়দের গোচরীভূত হয়। পোস্ট কমান্ডার সৈন্য প্রত্যাহারে অনুমতি চাইছিলেন। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবঙ সিং এ পোস্টে মনস্তাত্ত্বিক রণকৌশল প্রয়োগ করেন। পাকিস্তানি পোস্টের কাছাকাছি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মিগ-২১ সাতবার এ পোস্টে রকেট নিক্ষেপ করে। একইদিন আরো দু’বার বিমান হামলা চালানো হয়। প্রথম বিমান হামলার পর গুরবঙ সিং মুক্তিবাহিনীর একজন বার্তা বাহকের মাধ্যমে পোস্ট কমান্ডারের কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এতে তিনি বলেন, ‘আপনি বিগত কয়েকদিন ধরে সরবরাহ ও গোলাবারুদ আনতে প্রাণপন চেষ্টা করেছেন এবং আপনি তাতে সফল হননি। এসব সরবরাহ আমাদের হাতে পড়েছে। আপনার পোস্টের সময় ফুরিয়ে গেছে এবং আপনি যে সিদ্ধান্তই নিন, আমরা কামালপুর চৌকি দখলে বদ্ধপরিকর। অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি এড়াতে আপনার কাছে এ বার্তা পাঠানো হচ্ছে। গতকাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আশা করি আপনি অবগত আছেন যে, এ মুহূর্তে আমাদের সৈন্যরা আপনার দক্ষিণে কয়েক মাইল দূরে তৎপরতা চালাচ্ছে।’ পোস্ট কমান্ডার আহসান মালিক কোনো জবাব দেননি। মেশিনগান চালিয়ে তিনি যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। জেনারেল গুরবঙ সিং দ্বিতীয়বার বিমান হামলার নির্দেশ দেন। আবার দ্বিপ্রহরে এ পোস্টে বিমান হামলা হয়। গুরবঙ সিং এবার দ্বিতীয় একটি বার্তা পাঠান। এ বার্তায় তিনি বলেন, ‘আপনি প্রথম বার্তার কোনো জবাব দেননি। একটু আগে আপনি আমাদের ওষুধের স্বাদ গ্রহণ করেছেন (পোস্টের উপর বিমান হামলার প্রতি লক্ষ্য করে একথা বলা হয়)। আপনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে আমি আপনাকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, একজন সাহসী শত্রুর প্রাপ্য সম্মান আপনাকে দেয়া হবে।’ দ্বিতীয় বার্তারও কোনো জবাব দেয়া হয়নি। শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সংকেত হিসাবে বাংকার থেকে মেশিনগান গর্জে উঠে। এরপর পোস্ট কমান্ডার ও তার কমান্ডিং অফিসারের মধ্যে ওয়ারলেসে আবার কথা হয়। কমান্ডিং অফিসার অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর এবং প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা চালানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি। জেনারেল গুরবঙ সিং অধৈর্য হয়ে উঠেন। তিনি বিকালে আবার এ পোস্টের উপর বিমান হামলার নির্দেশ দেন। অবশেষে তিনি চূড়ান্ত বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি বলেন,‘আপনি আত্মসমর্পণ করবেন কিনা তা অবশ্যই বিকাল ৪ টার মধ্যে জানাতে হবে। আমি আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না। আপনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য একজন বার্তা বাহক নিয়ে এলে খুবই ভালো হয়। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’ পোস্ট কমান্ডার এ বার্তারও কোনো জবাব দেননি। তিনি পোস্টে মোতায়েন সকল অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। এতে গুরবঙ সিং আরো হতাশ হন। তিনি নৈশকালীন হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় পোস্ট কমান্ডার আহসান রাত ৭টায় একটি সাদা পতাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং তার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। তবে তিনি বলেন, তার (গুরবঙ সিং) চরমপত্রে সাড়া দিয়ে নয় বরং তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি আত্মসমর্পণ করছেন। ক্যাপ্টেন আহসান অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছেন এবং ৭৫ জন সৈন্য ও মুজাহিদ নিয়ে ২১ দিন পোস্ট অবরোধকারী একটি ভারতীয় ব্রিগেডকে মোকাবিলা করার পর আত্মসমর্পণ করেন। ভারতের অব্যাহত গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা সত্ত্বেও এ পোস্টে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল খুবই কম। প্রতিপক্ষ এ বালুচ ক্যাপ্টেনের বীরত্বের প্রশংসা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ তার অনমনীয় ভূমিকার প্রশংসা করে ক্যাপ্টেন আহসানের কাছে ব্যক্তিগত অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কামালপুর যুদ্ধবন্দিদের সাহসী সৈনিক হিসাবে প্রাপ্য যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে তিনি ফরমেশন কমান্ডারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পতন
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পতন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতের ৬১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কৈলাশ প্রসাদ পান্ডে। তিনি ‘টম পান্ডে’ নামেও পরিচিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ছিলেন ভারতের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সতীর্থ। এছাড়া তিনি ছিলেন আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিসার। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফও ছিলেন একই রেজিমেন্টের অফিসার। ৯ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় সৈন্যরা স্থানীয় নৌকায় গোমতী নদী পার হয়। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ছিলেন তার জীপে। অন্ধকারে ভারতীয় সৈন্যরা চিনতে না পেরে শত্রু মনে করে তার জীপে গুলি চালায়। জীপে কয়েকটি গুলি লাগলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। তবে তার পায়ে গুলি লেগেছিল। গুলি লাগায় তাকে অন্তত এক সপ্তাহ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হয়। তিনি বাংলাদেশে ১৮টি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তার ব্রিগেড ১৯৭১ সালের মে থেকে ১৯৭২ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের মতে, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ হয়েছিল ১৩ দিন। কিন্তু এ যুদ্ধের বিস্তৃতি ছিল ১৩ মাস। ৬১তম মাউন্টেন ব্রিগেড ৭২ ঘণ্টায় ৪০মাইল পথ অতিক্রম করে। এ ব্রিগেড ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে। অবশেষে ৯ ডিসেম্বর রাতে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হয়। দিনে রাজপুত রাইফেলস ময়নামতির একটি পাহাড়ের চূড়া দখল করে নেয়। একটি পাকিস্তানি ট্যাংক ভারতীয় সৈন্যদের উপর গোলাবর্ষণ করায় তাদের অগ্রযাত্রা বিলম্বিত হয়। ভারতীয়দের হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় মিগ থেকে বোমাবর্ষণ করায় তাদের উপর চাপ হ্রাস পায়। মিগের প্রথম বোমাবর্ষণ ব্যর্থ হয়। তবে দ্বিতীয় হামলা সফল হয়। ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডের কাছে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পতাকা হস্তান্তর করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর হোসেন আতিফের নেতৃত্বে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে দুই ব্রিগেড পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করছিল। ৫ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সৈন্য ও ৫০ জন অফিসার পান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৪১জন যুদ্ধবন্দিকে তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। মুক্তিবাহিনী এসব যুদ্ধবন্দিকে গুলি করে হত্যা করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে মালে গণিমত হিসাবে ব্রিগেডিয়ার আতিফের সিতারা-ই-পাকিস্তান পদক হস্তগত করেন। এ পদক তিনি তার বেডরুমে সাজিয়ে রাখতেন। ময়নামতি লড়াইয়ে ৯৫ এবং ধলাই লড়াইয়ে ৪৫জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। এসব ভারতীয় সৈন্যের স্মরণসভায় তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতো। বাংলাদেশ যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়ায় তাকে ‘মহা বীর চক্র’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
সিলেট দখলের লড়াই
সিলেট দখল করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ২০/২১ নভেম্বর সিলেটের আটগ্রামে ৩১ পাঞ্জাবের বি কোম্পানিকে নিশ্চিহ্ন এবং ৪/৫ ডিসেম্বর গাজীপুরে ২২ বালুচের আরেকটি কোম্পানিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এ দু’টি নিষ্পত্তিকারী লড়াইয়ে গুর্খারা তাদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র খুকরি ব্যবহার করেছিল। এ হামলায় ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের ৭ জন অফিসার, তিন জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য র্যাঙ্কের আরো ৯২ জন সৈন্য হতাহত হয়। ৫ ডিসেম্বর বিকালের মধ্যে এ ব্যাটালিয়ন কুলাউড়া এবং সিলেট অভিমুখী রেল ও সড়ক পথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সিলেট ছিল একটি যোগাযোগ কেন্দ্র। এখান থেকে চারটি রাস্তা ভারতে প্রবেশ করায় অঞ্চলটির সামরিক গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। এ জেলার সম্ভাব্য পতন ছিল পাকিস্তানিদের জন্য একটি মারাত্মক বিপর্যয়। ভারতীয়রা প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যে দেখতে পায় যে, ডিসেম্বরের শুরুতে গ্যারিসন ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নেয়ায় সিলেটে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা দুর্বল। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিলেটকে ভারতের অষ্টম মাউন্টেন ডিভিশনের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নেয়া হয়। সিলেট সেনানিবাসে পাকিস্তানের ২০২তম ব্রিগেড অবস্থান করছিল। এ ব্রিগেডের সদরদপ্তর ছিল সিলেট শহরে। সদরদপ্তরে ছিল দু’টি ব্যাটালিয়ন (৩১পাঞ্জাব ও ৯১ মুজাহিদ), দুই কোম্পানি ইপকাফ এবং ফ্রন্টিয়ার কোর উইংয়ের অর্ধেক সৈন্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় ছিল ১০৫ মিলিমিটার গানের একটি রেজিমেন্ট এবং ১২০ মিলিমিটারের আরেকটি মর্টার ব্যাটারি। ৭/৮ ডিসেম্বর ৩১৩ পাকিস্তানি পদাতিক ব্রিগেড এ ব্রিগেডের শক্তিবৃদ্ধি করে। প্রাথমিকভাবে ২০২তম ব্রিগেড শমসেরনগর ও মৌলভীবাজার অক্ষ প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। সকল গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ প্রতিরক্ষায় এ দু’টি ব্রিগেড মোতায়েন করা হয় এবং সিলেটকে একটি দুর্গে পরিণত করা হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার এসএ হাসানকে সিলেটে পাঠানো হয় এবং তিনি দু’টি ব্রিগেডের প্রতিরক্ষায় সমন্বয় সাধন করছিলেন।
৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভারতের চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎ সিং সিলেট দখলে ব্রিগেডিয়ার সিএ কায়িনের নেতৃত্বাধীন ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেডের একটি ব্যাটালিয়নকে হেলিকপ্টারে অবতরণের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এ পরিকল্পনা সম্পর্কে অষ্টম মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল (পরবর্তীতে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান ও জেনারেল) কে ভি কৃষ্ণ রাওকে অবহিত করা হয়। ৭ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কায়িন কুলাউড়ায় ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট পরিদর্শন করেন এবং ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থলবাহিনীর সঙ্গে সংযোগ সাধনে গুর্খা রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) এবি হারোলিকারকে একইদিন বিকালে তার ব্যাটালিয়নকে সিলেটে হেলিকপ্টারে অবতরণ করানোর পরিকল্পনা অবহিত করেন। সিলেটে পাকিস্তানিদের অবস্থান শক্তিশালী হওয়ায় ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থলবাহিনীর সঙ্গে সংযোগ সাধনের পরিকল্পনাকে কমান্ডিং অফিসার দুরূহ বলে বিবেচনা করছিলেন। ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ব্রিগেডিয়ার কায়িন, কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল হারোলিকার ও হেলিকপ্টার ইউনিটের প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে এয়ার মার্শাল) চন্দন সিং কপ্টারে করে সিলেটে উড়ে যান এবং রেলওয়ে ব্রিজ থেকে ২ কিলোমিটার পূর্বদিকে সুরমা নদীর উত্তর তীরে মিরপাড়ার কাছে হেলিকপ্টার অবতরণের একটি জায়গা বাছাই করেন। সেখানে তাদের চোখে কোনো সামরিক তৎপরতা ধরা পড়েনি। তাতে তারা ধারণা করছিলেন, ২০২তম পাকিস্তানি পদাতিক ব্রিগেডকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ চালানোর পর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল হারোলিকার বুঝতে পারছিলেন, তাদের ধারণা অমূলকও হতে পারে। কমান্ডিং অফিসার ফিরে এলে হেলিকপ্টারে করে সৈন্য অবতরণ করানোর পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। পরিকল্পনায় বলা হয়, হেলিকপ্টার অবতরণের স্থান হবে মিরপাড়া, এমআই-৪ হেলিকপ্টারে সৈন্য পরিবহন করা হবে, ২৫ থেকে ৩০মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করবে এবং প্রতিবার ৫০ জন করে সৈন্য বহন করা হবে। প্রথমে উড্ডয়ন করবে কমান্ডিং অফিসারের গ্রুপসহ মেজর মালিকের নেতৃত্বাধীন চার্লি কোম্পানি এবং পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন শর্মার নেতৃত্বাধীন ব্র্যাভো, মেজর দীনেশ রানার নেতৃত্বাধীন আলফা ও ক্যাপ্টেন শালগোত্রার নেতৃত্বাধীন ডেল্টা তাকে অনুসরণ করবে। প্রথম হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করবে ১৪০০ থেকে ১৪৩০ টার মধ্যে এবং সূর্যের রশ্মি মিলিয়ে যাবার আগে অবতরণ সম্পন্ন হবে। ১৫০০ টার মধ্যে প্রথমে চার্লি কোম্পানির বেশির ভাগ সৈন্য অবতরণ করে।
বিকাল ৪টায় ৩১ পাঞ্জাবের সি কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মোমতাজ ভারতীয় সৈন্যদের অবতরণ করার সংবাদ পান। এ সংবাদ পেয়ে তিনি একটি বেসামরিক পিকআপ নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের অবতরণস্থলে ছুটে যান। চরখাই থেকে একমাত্র কামানটি তার অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। এ কামান থেকে গানার মেজর গফুর শত্রু সৈন্যদের লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। চার্লি কোম্পানির গুর্খা সৈন্যরা ‘আয়ো গোর্খালি’ রণধ্বনি দিয়ে লক্ষ্যস্থলে আক্রমণ চালায়। ৪০/৪৫ মিনিট পর দ্বিতীয় তরঙ্গে কমান্ডিং অফিসারের দল এবং সি কোম্পানির বাদবাকি এবং বি কোম্পানির একটি অংশ অবতরণ করে। এ পর্যায়ে ভারতের ছত্রী সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ থেকে ১০০ জন। তাদের সঙ্গে ছিল ১৫টি হাল্কা এবং চারটি মাঝারি মেশিনগান। পরবর্তী ১২ ঘণ্টায় কোনো সৈন্য অবতরণ না করায় অবতরণকারী সৈন্যদের সারারাত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। তারা সিলেটের এ অংশে মোতায়েন পাকিস্তানি ৩১পাঞ্জাবের মেজর মোমতাজ হোসেনকে নিশ্চল করে রাখে এবং ৩১ পাঞ্জাব ও ৩১৩তম ব্রিগেডকে সিলেট যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা দিয়ে যেতে থাকে। মেজর মোমতাজ তার সদরদপ্তরে ৪ থেকে ৫ শো ভারতীয় সৈন্য অবতরণ করার সংবাদ দেন। ৮ ডিসেম্বর ভোরে গোলন্দাজ গোলাবর্ষণের মাঝে আলফা ও ডেল্টা কোম্পানি অবতরণ করে। পাকিস্তানিরা অতিরিক্ত ভারতীয় সৈন্য অবতরণকে ব্রিগেডের অবশিষ্টাংশের অবতরণ বলে ধারণা করেছিল। ৮ডিসেম্বর গোধূলি লগ্নে হেলিকপ্টারে করে দু’টি মাউন্টেন গান এবং বি কোম্পানি নবম গার্ডকে বহন করে নিয়ে আসা হয়। এ সময় পাকিস্তানিদের সুরক্ষিত অবস্থানে এগিয়ে যেতে হবে নাকি বৃহত্তর আক্রমণ চালানো হবে সে ব্যাপারে উভয় সংকট দেখা দেয়। কমান্ডিং অফিসার কর্নেল হারোলিকার শেষোক্ত বিকল্প বেছে নেন। তিনি অবতরণস্থলের আশপাশের আক্রমণাত্মক অবস্থানগুলো দখল করে নেন, অ্যাম্বুশ স্থাপন করেন এবং সড়ক প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের হয়রানি করতে থাকেন। ৮ ডিসেম্বর রাতে আলফা ও ডেল্টা কোম্পানির উপর পাকিস্তানিদের পাল্টা হামলা প্রতিহত করা হয়। ৯ ডিসেম্বর মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আয়ান কর্ডোজো সিলেটে এসে পৌছান এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই ফ্লাইটে মেজর রাতন কাউলও (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) সিলেটে এসে পৌছান এবং সরাসরি তিনি ডেল্টা কোম্পানির কমান্ড গ্রহণ করেন। সেদিন মেজর মালিকের নেতৃত্বে একটি মিশ্র ভারতীয় বাহিনী সিলেট-খাদিমনগর সড়কে পাকিস্তানি বহরের উপর হামলা চালায়। আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি বহরের চালকরা যানবাহন ফেলে পালিয়ে যায়। এসময় মেজর কাউল পাকিস্তানিদের বেতার বার্তা ইন্টারসেপ্ট করে স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে, ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ৩১৩তম ব্রিগেড সিলেটে এসে পৌঁছেছে এবং পাঁচটি কোম্পানি নিয়ে ২০২তম ব্রিগেডের সঙ্গে মিলিতভাবে মেজর দীনেশ রানার আলফা এবং কাউলের ডেল্টা কোম্পানির উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তার আধাঘণ্টা পর আর্টিলারির সহায়তায় পাকিস্তানিরা পাল্টা হামলা চালায়। এ হামলা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর ভোরে তিনটি ভারতীয় হান্টার আলফা ও ডেল্টা কোম্পানির সামনে পাকিস্তানি অবস্থানে বোমাবর্ষণ করে। স্থলবাহিনীর সঙ্গে সংযোগ না হওয়ায় ভারতীয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাকিস্তানিরা আলফা ও ডেল্টা কোম্পানির উপর ফের পাল্টা চালায়। হামলায় ডি কোম্পানির কমান্ডার মেজর কাউল গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পর ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থানে পুনর্বিন্যাস ঘটানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পর ষষ্ঠ রাজপুত রেজিমেন্টের একটি দুর্বল অংশ ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নের কাছে পৌঁছে।
১৫ ডিসেম্বর সকালে দু’জন অফিসারের নেতৃত্বে এক থেকে দেড় হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সাদা পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে এসে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে একটি চিরকুট হস্তান্তর করে। চিরকুটে বলা হয়, ৩১৩তম ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এসএ হাসান তার গোটা ব্রিগেড নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চান। পাকিস্তানি সৈন্যদের জানানো হয়, এ ব্যাপারে খুঁটিনাটি নিয়ে তাদের ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৫ ডিসেম্বর বিকাল তিনটায় ব্রিগেডিয়ার হাসান ভারতীয় ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কায়িনের সঙ্গে রেলওয়ে ব্রিজে সাক্ষাৎ করেন এবং আত্মসমর্পণের বিস্তারিত নিয়ে আলোচনা করেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ২৪ ঘণ্টা আগে সিলেটে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পরদিন সকালে যথাযথভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে।
অন্যদিকে ২০২তম ব্রিগেডের ৩১পাঞ্জাবের সি কোম্পানির কমান্ডার মেজর মোমতাজ তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ব্রিগেড সদরদপ্তরে গিয়ে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। মানচিত্রে ঢাকার প্রতি ভারতীয় হুমকিগুলোকে লাল চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করা হয়। পাকিস্তানি অবস্থান নির্দেশক সবুজ চিহ্ন সংকুচিত ও নিশ্চিহ্ন। মেজর মোমতাজ রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ খুব একটা শুনতেন না। বিবিসি ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবাদ তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ১৬ ডিসেম্বর রাতে অন্য দিনের চেয়ে আগে বাংকারে প্রবেশ করেন। সারারাত তার ঘুম হয়নি। ফিল্ড ফোনের শব্দে সকাল সাড়ে ৬ টায় তার ঘুম ভাঙ্গে। অগ্রবর্তী চৌকির কমান্ডার নায়েব সুবেদার সরদার আলী প্রথামাফিক শুভেচ্ছা বা সালাম না দিয়ে তাকে বললেন, ‘স্যার একজন ভারতীয় অফিসার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ বিস্মিত ও উত্তেজিত হয়ে মেজর মোমতাজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভারতীয় অফিসার! ভারতীয় অফিসার তোমার এখানে কেন। ভারতীয়দের কাছে তোমার চৌকির কি পতন ঘটেছে?’ জবাবে সুবেদার আলী বললেন, ‘না, স্যার। আমার চৌকির পতন ঘটেনি। গতকাল ঢাকা আত্মসমর্পণ করেছে।’ ১৭ ডিসেম্বর ভোরের এ দুঃসংবাদে মেজর মোমতাজের বুক ভেঙ্গে যায়। সিলেটে পাকিস্তানি গ্যারিসনে ছিল তিনজন ব্রিগেডিয়ার, একজন কর্নেল, ১০৭ জন অফিসার, ২১৯ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, ৬ হাজার ১৯০ জন সৈন্য এবং ৩৯ জন বেসামরিক লোক। ৭ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিলেট যুদ্ধে এডজুট্যান্ট মেজর করন পুরী, দু’জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য র্যাঙ্কের ১১ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। এছাড়া মেজর কর্ডোজো, মেজর কাউল ও মেজর মালিক এবং আরো ৩৬ জন সৈন্য আহত হয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ
৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর ষোড়শ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং ৯ ডিসেম্বর ৩৯তম এডহক ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খান আক্রান্ত হন। অলৌকিকভবে জেনারেল নজর রক্ষা পান। মিত্রবাহিনী নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে ফেললে জেনারেল রহিম তার সদরদপ্তর নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পিছু হটার সময় তার কয়েকটি ফেরি চরায় আটকা পড়ে। তার পশ্চাদপসরণ বিলম্বিত হয়। নারায়ণগঞ্জের দিকে পিছু হটার সময় তার উপর ভারতীয় বিমান হামলা হয়। জেনারেল রহিমের সদরদপ্তর সম্বলিত নৌযান নিমজ্জিত হয়। ভারতীয় বিমান হামলায় কয়েক শো পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার নিহত হয়। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অভিযানে অংশগ্রহণকারী মেজর বিলাল এখানেই প্রাণ হারান। জেনারেল রহিমও আহত হন। ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয়। আমেরিকানরা যুদ্ধবিরতি এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। তবে রুশরা ভারতকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর কোনো ভেটো প্রয়োগ করবে না। রাশিয়ার এ ইঙ্গিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভারতীয়দের হাতে সময় ছিল খুব সামান্য। ভারতীয় হাইকমান্ডের পরিকল্পনা ছিল প্রথমে খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যে ভারতীয় সেনাসদর দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর দখলের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের জন্য বেতারযোগে চরমপত্র দেন। তবে তিনি এ চরমপত্র দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে লক্ষ্য করে। বিবিসির একটি ভুল সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এ ভুল করেন। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছিল যে, জেনারেল নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন এবং ফরমান আলী দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি তার উদ্দেশ্যে প্রেরিত বেতার বার্তায় বলেন, ‘রাও ফরমান আলী কা পয়গাম হে। হাতিয়ার ঢাল দো।’ ঢাকার আকাশে বিমান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার জন্য লাখ লাখ প্রচারপত্র নিক্ষেপ করা হয়। জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি ছিলেন না। ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্মতিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের শর্তে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে জেনারেল নিয়াজির কাছে একটি বার্তা পাঠান।
১৪ ডিসেম্বর ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যরা টঙ্গী এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে সাভারে এসে পৌঁছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা মিরপুর ব্রীজে এসে পৌঁছে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে তার কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এ চিরকুট পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৬তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদ তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজি ও নাগরা উভয়ে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একই ব্যাচের অফিসার। পাকিস্তান বাহিনীতে নিয়াজি লে. জেনারেল র্যাঙ্কে উন্নীত হলেও নাগরা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল র্যাঙ্কের অফিসার। নিয়াজির সদরদপ্তরে উভয়ে পাশাপাশি বসেন। নিয়াজি তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি উর্দু কবিতা বুঝেন কিনা। জবাবে নাগরা জানান, তিনি লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ফার্সীতে এমএ পাস করেছেন। নাগরা নিয়াজির চেয়ে বেশি শিক্ষিত হওয়ায় তিনি তার সঙ্গে পাঞ্জাবী ভাষায় রসিকতা করতে শুরু করেন। জেনারেল নাগরা নিয়াজির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগেই বেলা ১টায় জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকায় আসেন। কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান জেনারেল নিয়াজির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী। বাকির সিদ্দিকীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়। আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে তার সঙ্গে ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। নিয়াজি প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে তার অফিসে আত্মসমর্পণের আয়োজন করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। জেনারেল জ্যাকব তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নিয়াজি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছিলেন। জ্যাকব তাও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়াজিকে ভেবে দেখার জন্য ৩০ মিনিট সময় দিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। ফিরে এসে তিনি তার টেবিলে আত্মসমর্পণের দলিলটি পেশ করেন। তিন মিনিট কোনো জবাব না দেয়ায় জ্যাকব তার হাত থেকে দলিলটি নিয়ে বলেন, আমি ভারতীয় হাইকমান্ডকে বলবো, আপনি দলিলটি পাঠ করেছেন এবং তাতে স্বাক্ষর দানে সম্মতি দিয়েছেন। জ্যাকবের চাপে নিয়াজি তার শর্তেই আত্মসমর্পণে রাজি হন।
পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে সফল বোমাবর্ষণের সংবাদ পেয়ে ৪ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তানি সৈন্যরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবছিল অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে তাদের পরিত্রাণ ঘটবে। কিন্তু সেদিন খুব সৈন্যই ভাবতে পেরেছিল যে, তাদের সামনে চরম দুঃসময় অপেক্ষা করছে। তাদেরকে জানানো হয়েছিল, পশ্চিম রণাঙ্গনে চাম্ব ও অমৃতসর দখল করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু একসময় তাদের কাছে এ নিষ্ঠুর পরিহাস ধরা পড়ে। ৭ ডিসেম্বর যশোরের পতন ঘটলে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ পেয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে।
আত্মসমর্পণের দলিল
আত্মসমর্পণ দলিলে বল হয়,
`The Pakistan Eastern Command agrees to surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Sing Aurora, General Officer Commanding-in-Chief of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all Pakistan land, air and naval forces as also para-military forces and civil armed forces. The forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.
The Pakistan Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora as soon as the Instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General Jagjit Sing Aurora will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms.
Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the provision of Geneva Convention and guarantees safety and well-being of all Pakistan military and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of West Pakistan origin by the forces under the Command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.'
(Signatories)
1. Jagjit Singh Aurora
Lieutenant General
General Officer Commanding in-Chief
Indian and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre
2. Amir Abdullah Khan Niazi
Lieutenant General
Martial Law Administrator
Zone `B' and Commander Eastern Command (Pakistan)
‘বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হচ্ছে। পাকিস্তানের সকল স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনী এবং সকল আধাসামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের আওতায় পড়বে। বর্তমানে এ বাহিনীর যে যেখানে অবস্থান করছে সেখানে তারা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ডের আওতায় নিকটবর্তী নিয়মিত সৈন্যদের কাছে তাদের অস্ত্র সমর্পণ এবং আত্মসমর্পণ করবে। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশের আওতায় চলে আসবে। নির্দেশ অমান্যকে আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং অনুমোদিত আইন ও যুদ্ধের রীতিনীতি অনুযায়ী কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলী ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে জেনেভা কনভেনশনের ধারা অনুযায়ী সৈন্য হিসাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান এবং পাকিস্তান সশস্ত্র ও আধাসামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণকারী সকল সদস্যের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নিশ্চয়তা প্রদানের দৃঢ় আশ্বাস দিচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার অধীন সৈন্যরা বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও পশ্চিম পাকিস্তান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’
(স্বাক্ষরকারীদ্বয়)
১. জগজিৎ সিং অরোরা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক
২. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক
জোন ‘বি’ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার (পাকিস্তান)
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করেই সময় ৬ ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কোথায়, কিভাবে এবং কখন আত্মসমর্পণ করবে সে পরিকল্পনা জ্যাকবই করেছিলেন। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে জেনারেল নিয়াজি অনুস্বাক্ষর করলে আত্মসমর্পণ দলিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয় বিকাল ৪ টা ৩০মিনিটে। ব্রিগেডিয়ার সাহবেগ সিং ও তার সাতজন সহযোগী আত্মসমর্পণের মঞ্চ প্রস্তুত করেন। জ্যাকবের সঙ্গে ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। অরোরার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ভান্তি কাউর। বিমান বন্দরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্যরা অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। একটি সামরিক জীপ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ও তার সহযোগীদের নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে থামে। সামরিক জীপ দেখে জেনারেল অরোরা ও তার লোকজন উড়ে দাঁড়ান। চোস্ত সামরিক কায়দায় দু’জেনারেল একে অন্যকে স্যালুট করেন। বিশাল বটগাছের নিচে একটি টেবিলের পাশে দু’টি চেয়ার পাতা। একটিতে বসেন অরোরা এবং অন্যটিতে নিয়াজি। একজন ভারতীয় সেনা অফিসার টেবিলের উপর আত্মসমর্পণের দলিল পেশ করেন। তাতে প্রথমে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি এবং পরে অরোরা। সময় ছিল তখন বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট। এরপর হোলস্টার থেকে নিয়াজি তার পিস্তল বের করে টেবিলের উপর রাখেন। তিনি আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসাবে অরোরার কাছে ৩৮ নম্বর খচিত পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের নিজের পিস্তল তুলে দেন এবং ব্যাজ ও বেল্ট খুলে ফেলেন। দু’জেনারেল করমর্দন করেন এবং একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। এসময় তাদের উভয়ের চোখ ছিল অশ্রুসজল। উভয় জেনারেল আবার উড়ে দাঁড়ান এবং একে অন্যকে স্যালুট করেন।
আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ থেমে যায় এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে অরোরা ছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল এন. কৃষ্ণ, অষ্টম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কে. ভি. কৃষ্ণ রাও (পরবর্তীতে ভারতের সেনাপ্রধান), পূর্বাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধান এইচসি দেওয়ান, চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎ সিং, ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এবং ১০১তম কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা। বাংলাদেশ পক্ষে উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার, ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী প্রমুখ। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করায় হাজার হাজার মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সৈন্যরা অরোরাকে কাঁধে তুলে নেয়। জনতার ভয়ে নিয়াজি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানিকে বন্দি করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।
ঢাকার বাইরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যরা নিকটবর্তী ভারতীয় সেনা কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঝিনাইদহে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএইচ আনসারী আত্মসমপর্ণ করেন ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এমএস ব্রার কাছে, নাটোরে ষোড়শ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ আত্মসমর্পণ করেন ২০তম মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লক্ষ্ণণ সিংয়ের কাছে এবং চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ ভারতের ৫৭তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল বিএস গঞ্জালভেসের কাছে পিস্তল হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করেন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যরা নিয়াজির নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দু’জন ব্রিগেডিয়ার, ৪/৫ জন মেজর ও প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিরপুরের সশস্ত্র অবাঙালি মিলিশিয়ারাও অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তাদেরকে নিরস্ত্র করতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মেজর মইনুল হোসেনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টকে মিরপুরে পাঠানো হয়। বিদ্রোহী বিহারীদের সঙ্গে ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের ভয়াবহ লড়াইয়ে ৩৯ জন সৈন্য নিহত হয়। কোনো একক লড়াইয়ে আর কখনো বাংলাদেশকে এত সৈন্য হারাতে হয়নি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার লে. হেলাল মোর্শেদ খান আহত হন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি তার সহোদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজে বের করতে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যের সঙ্গে জহির রায়হানের লাশ পাওয়া যায়। মতাদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট। কলকাতায় অবস্থানকালে জহির রায়হান আওয়ামী লীগ নেতাদের কর্মকান্ডের বেশ কিছু বিতর্কিত ছবি তুলেছিলেন। এসব ছবি নিয়ে তিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। এ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৬ ডিসেম্বরের পরবর্তী দু’দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজ নিজ অস্ত্র বহন করার সুযোগ পেয়েছিল। ভারতীয়রা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিল। তবে ধীরে ধীরে তাদের আচরণ রুক্ষ হতে থাকে।
বাংলাদেশী ও ভারতীয় সূত্রের হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগীসহ ৯৩ হাজার লোক ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বন্দিদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৬৭৬ জন ছিল ইউনিফর্মধারী। ইউনির্ফমধারীদের মধ্যে ৫৫ হাজার ৬৯২ জন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য, ১৬ হাজার ৩৫৪ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, ৫ হাজার ২৯৬ জন ছিল পুলিশ বাহিনীর সদস্য, এক হাজার ছিল নৌসেনা এবং ৮ শো ছিল বিমান বাহিনীর সদস্য। বাদবাকি বন্দিরা ছিল হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিবারের সদস্য নয়তো সহযোগী। হামুদুর রহমান কমিশনের তালিকা অনুযায়ী বন্দিদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ:
শাখাবন্দির সংখ্যা
সেনাবাহিনী ৫৪ হাজার ১৫৪
নৌবাহিনী ১ হাজার ৩৮১
বিমান বাহিনী ৮৩৩
পুলিশসহ আধাসামরিক বাহিনী ২২ হাজার
বেসামরিক লোক ১২ হাজার
পূর্ব রণাঙ্গনে ৮ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি হিসাবে ১১৫ জন অফিসার, ৪০ জন জেসিও এবং অন্যান্য র্যাঙ্কের ১ হাজার ১৮২ জন সৈন্য নিহত হয়। ভারতের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং আরো চার হাজার সৈন্য আহত হয়। ভারতের পক্ষে নিহত হয় ১ হাজার ৪২১ জন, আহত হয় ৪ হাজার ৫৮ জন এবং নিখোঁজ হয় ১৫৬ জন। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নিহত হয় ২ হাজার ৮৪৩ জন। ২০ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি ও তার উর্ধ্বতন কমান্ডারদের বিমানে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা অনির্বাণ প্রজ্জ্বলন করা হয়। ভারতে দিবসটিকে ইস্টার্ন কমান্ড দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
ঢাকায় ভারতীয় সৈন্য
১৬ ডিসেম্বরের পর রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র ছিল শুধু ভারতীয় সৈন্য। বাংলাদেশ ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে কিনা এমন কথা বলাবলি শুরু হয়। প্রথমেই মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে এক ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। তারপর ভারতের ৫৭তম মাউন্টেন ব্রিগেড অবস্থান গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টোদিকে মনিপুরী পাড়ায়। এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ভারতীয় সৈন্যে ছেয়ে যায়।। বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তির আওতায় ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।
মিত্রবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতীয় সৈন্যরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অবস্থানকালে অবাধে লুণ্ঠন চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত সকল সমরাস্ত্র তারা সীমান্তের বাইরে পাচার করে। নিঃসন্দেহে এসব অস্ত্র ছিল বাংলাদেশের প্রাপ্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্পিত অস্ত্র ভারতে পাচারের বিরুদ্ধে মেজর জলিল ছাড়া আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা রুখে দাঁড়াননি। কেউ প্রতিবাদ করেননি। ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া সমরাস্ত্র ফেরত দেয়ার জন্য ভারতের কাছে দাবি করেনি। ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রতীক জেনারেল নিয়াজির সামান্য বেল্ট, ব্যাজ, পিস্তল ও মার্সিডিজ গাড়ি তুলে নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। আত্মসমর্পণ করার সময় শুধুমাত্র ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অক্ষত ট্যাংক ছিল ৫০টি এবং কামান ছিল ৭ শো। এসব ভারি অস্ত্রের কোনোটাই ভারতীয়রা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি। সর্বাত্মক যুদ্ধকালে বাংলাদেশের সীমান্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সুযোগে টয়লেট সামগ্রী থেকে শুরু করে সবই লুণ্ঠন করে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। ভারতে বিদেশী সামগ্রী আমদানির সুযোগ সীমিত থাকায় ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সামগ্রী নিজ দেশে নিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ হয়। কী পরিমাণ সম্পদ তারা লুণ্ঠন করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। অটল জীপ ও শক্তিমান ট্রাকে করে লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পাচার করা হয়। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল বাধা দেয়ায় তাকে গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠনের ব্যাপারে ‘বাংলাদেশ পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট’ পুস্তকে সালাহউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ÔAfter the war was over, India was criticised for overstaying in the Chittagong Hill Tracts. It was also alleged that the Indian army removed by convey of trucks large amounts of arms, ammunitions and machinery from Bangladesh. As a result, tension and suspicion grew up against India’s policy towards Bangladesh, apprehending that India wanted to turn Bangladesh into a client state and not a self-respecting independent state.’‘যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ভারতীয় সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিক সময় অবস্থান করতে থাকায় ভারত সমালোচিত হতে থাকে। অভিযোগ উঠে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রাক বহরে করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশালী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারত একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এমন একটি আশংকা দেখা দেয়। তাতে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও সংশয় সৃষ্টি হয়।’
মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক জনাব জয়নাল আবেদীনের ‘র’ এন্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি বইয়েও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বইটিতে তিনি লিখেছেন,, ÔThe real Indian face lay bare after the surrender of Pakistani forces, when I saw the large scale loot and plunder by the Indian Army personnel. The soldiers swooped on everything they found and carried them away to India. Curfew was imposed on our towns, industrial bases, ports, cantonments, commercial centres and even residential areas to make the looting easier.They lifted everything from ceiling fans to military equipment, utensils to water taps. Thousands of Army vehicles were used to carry looted goods to India.’ ‘পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক লুটতরাজ দেখতে পেয়ে ভারতের প্রকৃত চেহারা আমার কাছে নগ্নভাবে ফুটে উঠে। ভারতীয় সৈন্যরা যা কিছু দেখতে পেতো তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো এবং সেগুলো ভারতে বহন করে নিয়ে যেতো। লুটতরাজ সহজতর করার জন্য তারা আমাদের শহর, শিল্প স্থাপনা, বন্দর, সেনানিবাস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এমনকি আবাসিক এলাকায় কারফিউ জারি করে। তারা সিলিং ফ্যান থেকে শুরু করে সামরিক সাজসরঞ্জাম, তৈজষপত্র ও পানির টেপ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায়। লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়।’ বইটির আরেকটি অংশে তিনি লিখেছেনÔThrough the independence war of Bangladesh India was immensely benefited economically, militarily, strategically and internationally. So India involved in our war of liberation for its own interest, not for us.’ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমপৃক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়।’
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে সম্পদ পাচার সম্পর্কে আট নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে অংশগ্রহণকারী মেজর জেনারেল খোন্দকার মো: নূরন্নবী (অব তার ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে সেক্টর আট নামে বইয়ের ১৬৪/১৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সীমান্ত খোলা পেয়ে ভারতীয় মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং স্থানীয় বাজার ও দোকানপাট থেকে সব বিদেশী মালামাল বিশেষ করে রেডিও, টেলিভিশন, খুচরা যন্ত্রাংশ, বিদেশী ওষুধপত্র অর্থাৎ যা কিছু বিদেশী সব কিনে নিচ্ছিল। এমনকি পাকিস্তানি ধাতবমুদ্রাও। এটা আমাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এসময় সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ মঞ্জুর আমাদের এলাকায় এলেন। আমরা তাকে এ বিষয়ে অবহিত করলাম। তিনি জানালেন যশোরেও একই অবস্থা। সেক্টর কমান্ডার মাড়োয়ারীদের এ ব্যবসার ব্যাপারে ভারতের চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ব্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জেনারেল ব্রার সেক্টর কমান্ডারকে জানান যে, এদের নিয়ে সবাই অতিষ্ঠ।’
বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের লুন্ঠনের ব্যাপারে কানাডা প্রবাসী আজিজুল করিম ‘হোয়াই সাচ এন্টি-ইন্ডিয়ান ফিলিংস এমং বাংলাদেশী?’ শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ‘অনিক’-এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য ছিল প্রায় ১ শো কোটি মার্কিন ডলার।’ বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী ড. কামাল সিদ্দিকী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে তিনি খুলনার ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারের কাছে লিখিত পত্রে বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা তার জেলা থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও সাজসরঞ্জাম স্থানান্তর করে ফেলেছে। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিযোগ করেছিলেন, ভারতীয় সৈন্য ও চোরাচালানীরা বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার কোটি রুপি মূল্যের সামগ্রী ভারতে পাচার করেছে। অরোরার পদোন্নতি না ঘটা হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈনদের লুণ্ঠনের আরেকটি বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। যে যুক্তিতে মানেকশর পদোন্নতি ঘটেছিল একই যুক্তিতে অরোরারও পদোন্নতি ঘটার কথা ছিল। পদোন্নতি ঘটলে মানেকশর পরে তিনি হতেন ভারতের পরবর্তী সেনাপ্রধান। কিন্তু তার কপালে পদোন্নতি ঘটেনি। মানেকশ অবসরে যাবার পর লে. জেনারেল জি. জি. বেবুর ভারতের সেনাপ্রধান হিসাবে নিযুক্তি পান। বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক অরোরাকে লে. জেনারেল র্যাঙ্ক থেকেই বিদায় নিতে হয়। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তার পদোন্নতি ঘটেনি। অরোরার প্রতি অবিচার করার সত্যতা মানেকশ নিজেও স্বীকার করেছেন। একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ÔJaggi did the work, but I got the baton ‘বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার কাজটি করেছেন জগি বা জগজিৎ। কিন্তু ফিল্ড মার্শালের ব্যাটন পেলাম আমি।’
ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা ও তার সহযোগী মেজর জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশর কথাবার্তায়ও বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া যায়। এব্যাপারে জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনূদিত গ্রন্থের ১২৮ পৃষ্ঠা) লিখেছেন, ‘আমি মানেকশ বললাম, আমাদের সৈন্যরা যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ ইতিমধ্যে তাদের কার্যকলাপ নিয়ে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। তার কয়েকদিন পর সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ আমাকে টেলিফোনে প্রশ্ন করেন, আপনি কি পাকিস্তানি সৈন্যদের রসদ লুট হওয়ার গুজব শুনতে পেয়েছেন? আমি বললাম, এটা গুজব। আর কিছু নয়। তিনি জানতে চাইলেন, তাহলে আমি কী শুনেছি? আমি বললাম, আমি গুজব ছড়াই না। তারপর তিনি অরোরার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন জেনারেল মানেকশ লুটপাটের গুজব তদন্ত করতে আমাকে ঢাকা যাবার নির্দেশ দেন। সেদিনই আমি ঢাকা গিয়ে কমান্ডার ও স্টাফ সদস্যদের সঙ্গে কলকাতা ও দিল্লিতে লুটপাটের যে গুজব পৌঁছেছে সে সম্পর্কে জানতে চাই। তবে এসব অভিযোগ তারা অস্বীকার করেন।’
মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে যোগদান করার সুযোগ না দিয়ে ভারতীয়রা মুক্তিযুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। আত্মসমর্পণ দলিলে একদিকে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি এবং অন্যদিকে স্বাক্ষর করেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। বাংলাদেশ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দেশটি এ দলিলের স্বাক্ষরদাতা নয়। বাংলাদেশকে এ ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর দানের সুযোগ না দিয়ে ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করার অশুভ প্রয়াস চালিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা বি রমনের বইয়ের একটি উক্তি তার প্রমাণ। সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী ও একরামুল্লাহিল কাফির যৌথ উদ্যোগে ‘র’ এর কাওবয়েরা’ নামে তার বইয়ের বাংলা অনুবাদের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ফিল্ড মার্শাল এসএইচএফজে মানেকশর নেতৃত্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং পরলোকগত কে. এফ. রুস্তমজীর নেতৃত্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র প্রকাশ্য এবং ‘র’ ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর গোপন কর্মকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা না হলে এ প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হতো না।’
ভারত সরকার নিজেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করে এবং যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য গৌরবান্বিত বোধ করে। এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের সংরক্ষিত সরকারি দলিলের ভূমিকায় ড. এস এন প্রসাদ লিখেছেন,ÔIndia won a glorious victory against Pakistan in 1971 war. It was the first decisive victory in a major war in centuries. And it was won singlehandedly in the face of opposition and threats from a majority of the UN member states, including a super power. Every Indian felt proud of this glittering chapter in the nation’s history.’ ‘ভারত ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জন করে। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এটা ছিল প্রথম চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী বিজয়। একটি পরাশক্তিসহ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশের বিরোধিতা ও হুমকির মুখে এককভাবে এ বিজয় অর্জিত হয়। জাতির ইতিহাসের এ উজ্জ্বল অধ্যায়ের জন্য প্রতিটি ভারতীয় গৌরব বোধ করে।’ ভারতীয় লেখক ড. সুভাষ কাপিলা তার ‘দ্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ÔIn India’s post-independence political and military history, December 16, 1971 was India’s finest hour.’ ‘স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতের উজ্জ্বলতম মুহূর্ত।’ লে. জেনারেল জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’-এ (বাংলা অনুবাদ ১৩৪ পৃষ্ঠা) মন্তব্য করেছেন,‘ ইন্দিরা গান্ধী জাতিকে এক মহান সামরিক বিজয় এনে দিয়েছেন যা আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করে এবং ভারতকে আঞ্চলিক পরাশক্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইন্দিরা গান্ধীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।’
মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি ভারতীয়রা অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় মুক্তিযোদ্ধারাও ব্যথিত। এ ব্যাপারে ৩ নম্বর সেক্টরে এস ফোর্সের সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীকের একটি উক্তি উল্লেখ করার দাবি রাখে। তিনি প্রোবনিউজে ৩৯তম বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ÔThere is no mention of the Mukti Bahini in the surrender document and there is only little or marginalized mention of the contribution of Mukti Bahini in the dozens of books written by Indian authors, It is a pity.’ ‘আত্মসমর্পণ দলিলে মুক্তিবাহিনীর অবদানের কোনো উল্লেখ নেই এবং ভারতীয় লেখকদের ডজন ডজন বইয়ে মুক্তিবাহিনীর অবদান স্থান পেয়েছে খুব সামান্য। নয়তো নামমাত্র। তা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুপস্থিতি
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। কেন সেদিন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী অথবা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কিংবা মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না সে ব্যাপারে খুব কম তথ্যই প্রকাশ পেয়েছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি জনাব এমএ মোহাইমেনের একটি সাক্ষ্য বিবেচনার দাবি রােেখ। তিনি তার ‘ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর’ পুস্তকের ১৬০-১৬১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর ভোরে আমি জানতে পারি যে, সেদিন বিকালে ঢাকায় রমনার রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি তার সকল সৈন্যসহ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। এ খবর পেয়ে আমি তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছুটে যাই। আমি শুনতে পেয়েছিলাম তিনি ততক্ষণে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন অথবা রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু আমি সেখানে পৌঁছে তাজউদ্দিন সাহেবকে স্বাভাবিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় উপবিষ্ট দেখতে পেলাম। ঢাকার উদ্দেশে তার রওনা হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন তিনি ঢাকা যাচ্ছেন না। আমি তার জবাব শুনে বিস্মিত হই। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আমাদের দেশ মু্ক্ত হতে যাচ্ছে এবং শত্রু সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকবেন না। আমি বিষয়টি মোটেও বুঝতে পারিনি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি শেখ মনি ও মুজিব বাহিনীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত আছেন। সেনাবাহিনীতে আমার হিতাকাঙ্খীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, এ মুহূর্তে ঢাকায় চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। তাই এসময় ঢাকায় প্রকাশ্য সমাবেশে উপস্থিত হওয়া আমার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। ওসমানী সাহেব ঢাকা যাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওসমানীও ঢাকা যাচ্ছেন না। আমি বুঝতে পারলাম তাজউদ্দিন যে কারণে ঢাকা যাচ্ছেন না, ওসমানীও ঠিক একই কারণে যাচ্ছেন না। ওসমানীর সঙ্গেও মুজিব বাহিনীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমি জানতে চাইলাম তাহলে আমাদের মধ্য থেকে কে ঢাকা যাচ্ছেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তার জবাব আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হলো। আত্মসমর্পণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কেউ প্রতিনিধিত্ব করবেন না। আমি বুঝতে পারলাম যে, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমাদের অনুপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অবদান ও অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করবে। এখন লোকজন সবকিছুর জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কৃতিত্ব দেবে। আর ভাববে আমরা কেউ নই।’
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একান্ত সচিব ড. ফারুক আজিজ খানের একটি বিবরণও উল্লেখ করার দাবি রাখে। সেদিন তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে কে যোগদান করছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে তা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি তখন জানতে চান কর্নেল ওসমানী কোথায়। তাজউদ্দিন তাকে জানান, ‘কর্নেল ওসমানী ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জল গুপ্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ লে. কর্নেল আবদুর রবকে নিয়ে কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। আমরা তার ব্যাপারে আর কিছুই জানি না।’ তাজউদ্দিন তাকে আরো বললেন, ‘কত হতভাগ্য তিনি! আজকের মতো দিনে তিনি এখানে নেই। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকারকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জেনারেল অরোরার সঙ্গে যেতে বলুন।’
পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ’র পাকিস্তানি সাংবাদিক হুসেন হাক্কানি তার ‘পাকিস্তান :বিটুয়িন মস্ক এন্ড মিলিটারি’ নামে বইয়ে লিখেছেন,ÔMoreover, the army had failed to fulfill its promises of fighting to the last man. The eastern command had laid down arms after losing only 13,00 men in battle.’ দসেনাবাহিনী শেষ সৈন্যটি জীবিত থাকা পর্যন্ত লড়াই করার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধে মাত্র ১৩ শো সৈন্য নিহত হওয়ার পর ইস্টার্ন কমান্ড অস্ত্রসমর্পণ করে।’ ১৬ ডিসেম্বর ছিল ভাওয়ালনগর থেকে ভারতের অভ্যন্তরে জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শেষসম্বল দ্বিতীয় সাঁজোয়া কোরের আক্রমণ শুরু করার দিন। সবকিছু ঠিকঠাক। আক্রমণ শুরু করার পূর্ব মুহূর্তে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান টিক্কা খানকে থেমে যাবার নির্দেশ দেন। যে যেখানে ছিল সে সেখানে থমকে যায়। ফিল্ড কমান্ডাররা কিছু বুঝতে পারছিল না। বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত রহস্যময়। তিনি শুরুতেই পাকিস্তানি বিমানগুলো লুকিয়ে ফেলেন। একদিকে তিনি বলছিলেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো বিমান তার কাছে নেই। অন্যদিকে তিনি বলছিলেন, পরবর্তী দু’মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য তিনি বিমান মজুদ করে রেখেছেন। কোনো এক অফিসার পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন, ‘স্যার, কায়েদে আজম কা পাকিস্তান টুট গিয়া।’ অপ্সরী সুন্দরী গায়িকা পরলোকগত নূরজাহানকে নিয়ে ফূর্তি করার সময় মাতাল ইয়াহিয়া জবাব দেন, ‘টুটনে দে। পহেলে নূরজাহান কা গানা শোনেনে দে।’ অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আনন্দের আতিশয্যে মন্তব্য করেন, ‘হাম হাজার সালো কা বদলা লি লিয়ে।’ আমরা হাজার বছরের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। নিয়াজি আত্মসমর্পণ করায় ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। যুুদ্ধবিরতির ঘোষণায় সৈন্যরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পশ্চিম রণাঙ্গনের সব ক’টি ফ্রন্টে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যু্্দ্ধ শুরু হতে না হতেই যুদ্ধবিরতি। জুনিয়র অফিসাররা মারমুখি হয়ে উঠে। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে তারা যুদ্ধ করার সুযোগই পায়নি। তারা ভারতীয়দের সঙ্গে লড়াই করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিল। লড়াই না করে তারা পরাজয় মেনে নিতে চায়নি। পাকিস্তানের বেশিরভাগ সৈন্য তখনো ছিল অক্ষত। জনগণ ও ফিল্ড কমান্ডারদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি তাদের আবেগ অনুধাবন করতে পারেননি। জয়-পরাজয় যাই হোক, পাকিস্তানের জনগণ ও সাধারণ সৈন্যরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষপাতি ছিল। উত্তেজিত জনতা রাস্তায় নেমে আসে। তারা ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। ‘সরাবী ইয়াহিয়া, গাদ্দার ইয়াহিয়া। আমাদের হাতিয়ার দাও। আমরা লড়াই করবো। আমরা কোরবান হবো।’ জেনারেলদের ফ্লাগ কারে জনতা অগ্নিসংযোগ করে। পেশোয়ারে ইয়াহিয়া খানের বাসবভন ‘ইয়াহিয়া হাউস’-এ আগুন দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খান এক ক্যান্টনমেন্ট থেকে আরেক ক্যান্টনমেন্টে পালাতে থাকেন। মহিলারা তার প্রতি জুতা নিক্ষেপ করে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করলে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এ ঘটনা ছিল পাকিস্তানিদের কাছে লজ্জা ও অসম্মানের। তারা ভাবতে পারেনি যে, তাদের সৈন্যরা এক পক্ষকালের মধ্যে পরাজিত হবে। ইয়াহিয়া খানের পতন ঘটে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ জেনারেল নিয়াজিকে ভারতে যুদ্ধবন্দি হিসাবে তিন বছর কাটাতে হয়। ১৯৭৩ সালে দেশে ফেরার পর তাকে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখা হতে থাকে। বিশ্বাসঘাতক হিসাবেও তিনি চিহ্নিত হন। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় পাকিস্তানের অনুসৃত প্রতিরক্ষা নীতির ক্রটি ধরা পড়ে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের উপর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে। কিন্তু পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিপর্যয়ে এ সামরিক মতবাদ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বিপুলসংখ্যক সৈন্যের আত্মসমর্পণ করার আর কোনো নজির ছিল না। এ বিপর্যয় খতিয়ে দেখতে ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ নামে পরিচিত।
ভুট্টো তদন্ত রিপোর্ট চেপে রাখার চেষ্টা করেন। তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত না হলেও ২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল ৭ শো পৃষ্ঠার এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হলে পাকিস্তানের কৌশলগত ও টেকটিক্যাল পর্যায়ের ঘাটতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। হামুদুর রহমান কমিশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব লে. জেনারেল পীরজাদা ও মেজর জেনারেল মিঠঠা খানসহ ১৩ জন উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্য সামরিক আদালতে বিচারের সুপারিশ করে। কিন্তু কারো বিচার করা হয়নি। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ্য সামরিক আদালতে বিচার করার সুপারিশ করা হলেও অবসর নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আবদুল হামিদ, জেনারেল পীরজাদা ও জেনারেল মিঠঠা পেনশন সুবিধা ভোগ করেন। পেনশন থেকে বঞ্চিত হন একমাত্র লে. জেনারেল নিয়াজি ও তার চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী। রিপোর্টে সুস্পষ্টরূপে স্বীকার করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ঘিরে গড়ে উঠা অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ জেনারেলদের একটি কোটারি ১৯৭১ সালের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। পাকিস্তান ধ্বংসের সময় ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীরা মদ্যপ অবস্থায় নারী নিয়ে ফূর্তি করছিলেন। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো হয়। তবে ভুট্টোর উচ্চাকাঙ্খা এ সামরিক অভিযানে ইন্ধন যোগায়। নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে তিনি রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান বোকার মতো ভুট্টোর ফাঁদে পা ফেলেন। তবে তারও খায়েস ছিল। প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে রাখতে তিনি আওয়ামী লীগ ও পিপিপিকে নিয়ে খেলছিলেন। ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে এই মর্মে একটি সমঝোতা হয় যে, মুজিবকে বাদ দিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা হবে। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে বহাল থাকবেন। আর প্রধানমন্ত্রী হবেন ভুট্টো। কিন্তু সামরিক অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় তাদের সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ইয়াহিয়ার পতন ঘটে এবং পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়।
ভারতীয়দের সঙ্গে পাকিস্তানিদের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ভারতীয় ও পাকিস্তানি সামরিক অফিসার বিশেষ করে কমান্ডিং জেনারেল ছিলেন একে অন্যের সহপাঠী। ভারত অবিভক্ত থাকার সময় তারা বিলাতের স্যান্ডহার্স্ট ও ভারতের দেরাদুন সামরিক একাডেমিতে একসঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্লাসমেট। এছাড়া ইয়াহিয়া খান ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশর অধঃস্তন। মানেকশ ছিলেন দ্বাদশ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কমান্ডার। তিনি ১৯৪৭ সালে একজন ব্রিটিশ অফিসারের কাছ থেকে এক হাজার ৬ শো রুপির বিনিময়ে একটি জেমস মোটর কার কিনেছিলেন। উপমহাদেশ বিভক্তির মাত্র দু’দিন আগে তার অধস্তন মেজর ইয়াহিয়া খান গাড়িটি তার কাছে বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। ‘তুমি গাড়ি দিয়ে কি করবে?’ জানতে চান লে. কর্নেল মানেকশ। জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, ‘স্যার ভারতে আপনি সবই পাবেন। পাকিস্তানে আমরা কিছুই পাবো না।’ মানেকশ এক হাজার রুপির বিনিময়ে তার কাছে গাড়ি বিক্রিতে সম্মত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ইয়াহিয়া, তুমি গাড়ি নিয়ে যাও।’ ইয়াহিয়া তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার এ মুহূর্তে আমার কাছে এক হাজার রুপি নেই। আমি আপনার কাছে গাড়ির মূল্য পাঠিয়ে দেবো।’ ইয়াহিয়া গাড়ি বিক্রির প্রতিশ্রুত অর্থ না দেয়ায় মানেকশ মন্তব্য করেছিলেন, , ÔYahya made up for it by giving me whole of East Pakistan.’ ‘ইয়াহিয়া গোটা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিয়ে আমার গাড়ির মূল্য পরিশোধ করেছেন।’
যুদ্ধের নামকরণ নিয়ে দ্বিমত
১৯৭১ সালে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়েছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের নামকরণ নিয়ে দ্বিমত দেখা যায়। পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ বাঙালিদের জন্য নিরংকুশভাবে মুক্তিযু্দ্ধ হলেও ভারতের জন্য নয়। একই সময়ে দু’টি রণাঙ্গনে ভারত যুদ্ধ করেছে অভিন্ন কমান্ডের আওতায়। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েও বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক এবং ভারতের সরকারি সূত্র ১৯৭১ সালে পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত এবং ৭ ডিসেম্বর ভুটান স্বীকৃতি দান করায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য হওয়া সত্ত্বেও বাইরের কোনো কোনো সূত্র এ যুদ্ধকে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ হিসাবে মেনে নিতে নারাজ। তাদের মতে, এ যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ। এব্যাপারে এনসাইক্লোপিডিয়ার একটি মন্তব্য উল্লেখ করার দাবি রাখে। তাতে বলা হয়, ÔPakistan civil war is mainly used by current day Pakistan Army and by some certain unofficial Indian sources. The name describes either the period of March 26, 1971 to December 16, 1971 or the period of March 26, 1971 to December 3, 1971. The main issues arises from the validity of the declaration of independence on 26 March. This is entirely a matter of political technically. There are certain logic used by the proponents of this nomenclature. According to them, no country accepted Bangladesh’s independence declaration and hence the region contempleted continued to be East Pakistan. So the war was a civil war in effect. The proponents of this terminology also question the validity of declaration of Independence of Bangladesh since there was no foreigngovernment that acknowledged the independence. So, according to them, the war was effectively between Indian Army and Pakistan Army.’ দ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং কয়েকটি বেসরকারি ভারতীয় সূত্র গৃহযুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত উভয় সময়ের যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধতা থেকে মূলত এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতা ঘোষণা হচ্ছে টেকনিক্যালি পুরোপুরিভাবে একটি রাজনৈতিক বিষয়। গৃহযুদ্ধ হিসাবে নামকরণের সমর্থকদের কয়েকটি নির্দিষ্ট যুক্তি আছে। তাদের মতে, এসময় কোনো দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। অতএব ভূখন্ড হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান অব্যাহত ছিল। তাই এ যুদ্ধ কার্যত গৃহযুদ্ধ। কোনো বিদেশী সরকার স্বীকৃতি না দেয়ায় গৃহযুদ্ধ নামকরণের সমর্থকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সুতরাং তাদের মতে, এ যুদ্ধ ছিল কার্যকরভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যকার একটি যুদ্ধ।’
হামুদুর রহমান কমিশনের দৃষ্টিতে পরাজয়ের কারণ
১৪ দিনের যুদ্ধে পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সৈন্যরা পরাজিত হবে এমন কথা ভারতীয়রাও ভাবতে পারেনি। এব্যাপারে অরোরার সহযোগী মেজর জেনারেল (পরবর্তীতে লে. জেনারেল ও ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার) জ্যাকবের একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়। জেনারেল জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’ (বাংলা অনুবাদ ১৩৮ পৃষ্ঠা)-এ লিখেছেন, ‘চীফ অব স্টাফ ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর প্রধানরা ভাবতে পারেননি যে, পাকিস্তানিদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত এবং ঢাকার পতন ঘটানো সম্ভব হবে। তার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র ভূখন্ড মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।’ বিমান বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও পাকিস্তানের স্থল বাহিনীর বিরাট অংশ ছিল অক্ষত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেননি। তারপরও পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। হামুদুর রহমান কমিশন পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের জন্য কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করে। (১) ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার রাত এবং পরদিন ২৬ মার্চ অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ এবং সমরাস্ত্র ব্যবহার (২) বাছ বিচার না করে অবাধে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ (৩) শুধু অপারেশনের শুরুতে নয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধের শেষদিনগুলোতে ডাক্তার, প্রকৌশলী ও শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা এবং গণকবরে তাদের মাটি চাপা দেয়া (৪) বিদ্রোহ দমন এবং নিরস্ত্র করার সময় ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের হত্যা (৫) পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লোক, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হত্যা এবং বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাদের উধাও করে দেয়া (৬) প্রতিশোধ গ্রহণ এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বিপুলসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি মহিলাকে ধর্ষণ (৭) সংখ্যালঘু হিন্দুদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা। এসব কারণে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি জনসমর্থন নিঃশেষ হয়ে যায় এবং মনোবল ভেঙ্গে গেলে তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
পরিকল্পিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ
লে. জেনারেল নিয়াজি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’-এ বারবার উল্লেখ করেছেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আল ভুট্টো পরিকল্পিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ করেছেন। দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেয়ার চক্রান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তান ভাঙ্গার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয় লারকানায় জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে এক বৈঠকে। এ পরিকল্পনা ‘এমএম আহমদ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এ পরিকল্পনার মূল কথা ছিল সরকারবিহীন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ যুদ্ধে হেরে যাওয়া। সুতরাং ইয়াহিয়া জান্তা ও ভুট্টোর সকল কর্মকান্ড যুদ্ধে হেরে যাবার লক্ষ্যে ধাবিত হয়। তারা রাজনৈতিক নিষ্পত্তি অথবা যুদ্ধবিরতি কোনোটাই চাননি। পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হবে পশ্চিম পাকিস্তানে-এমন একটি পরিকল্পনা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া ও ভুট্টো এ পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগ করো’-এ নীতিতে কাজ করতে থাকেন।’
চমকে উঠার মতো হলেও সত্যি যে, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগে ছিলেন ব্যাকুল। বেলুচিস্তানের ন্যাপ নেতা গাউস বঙ বেজেঞ্জো ১৯৭০ সালে বেলুচিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে পূর্ব পাকিস্তান নিয়েও তাদের মধ্যে কথা হয়। এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বললেন, ‘আজ হোক, কাল হোক, পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কেন তাদের আরো দুই তিন বছর আমাদের রক্ত শোষণের সুযোগ দেবো?’
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনতে পেয়ে বেজেঞ্জো লা-জওয়াব হয়ে যান। তিনি মনে মনে শুধু বললেন, ‘কে কার রক্ত শোষণ করছে তা সারা বিশ্ব জানে।’ জনাব বেজেঞ্জো তার ‘ইন সার্চ অব সলিউশন’ নামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এ উপাখ্যান বর্ণনা করছেন।
©somewhere in net ltd.