![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা আমাদের অবগত করেছেন বহু বছর আগে। ভাষাকে কেন্দ্র করে অসা¤প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে ১৯৪৮-এ সূচিত ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে মূর্ত হয়েছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে।
১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নতুন প্রজাতন্ত্রের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতালাভের চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে বাংলাদেশের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতি ও সমাজের যে ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে তার চূড়ান্তরূপ ছিল ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে জামায়াতে ইসলামীর রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক হওয়া যে দলটি ’৭১-এ ইসলামের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন সহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছিল।
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশে ‘হরকতুল জেহাদ’ ও ‘জামাতুল মুজাহিদীন’ সহ কয়েক ডজন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের অস্তিত্বের কথা দেশবাসীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ও জেনেছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত এতদসংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এসব জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। জঙ্গী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র যুবকদের ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সমচরিত্রের মৌলবাদী সংগঠনগুলো কয়েক হাজার বাংলাদেশী যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আফগানিস্তান, কাশ্মীর, বসনিয়া, চেচনিয়া, প্যালেস্টাইন ও বার্মায় জেহাদে অংশগ্রহণের জন্য পাঠিয়েছে। এদের অনেকেই সেই সব দেশে জেহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে। অনেকে দেশে ফিরে বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি করেছে।
গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর আমেরিকা একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েতপন্থী নজিবুল্লাহ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদের জন্য পাকিস্তান, সৌদি আরব ও আমেরিকার সম্মিলিত উদ্যোগের ফসল হচ্ছে তালেবান, যারা পরবর্তীকালে আমেরিকার জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সহযোগিতায় তালেবান ও আলকায়দা বিশ্বব্যাপী যে জেহাদী নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছে বাংলাদেশের কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমল থেকে বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদের উত্থান সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য যেমন মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে একইভাবে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ২০০৫ সালের ১৫ আগস্ট জামাতুল মুজাহিদীনের জঙ্গীরা মাত্র আধঘন্টার ব্যবধানে ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী যেভাবে তালিকা প্রস্তুত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করেছে, একই ভাবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গী মৌলবাদীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, বিচারক, আইনজীবী ও সংস্কৃতি কর্মী সহ বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় স¤প্রদায় সহ সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের উপর। এই সব হত্যা ও নির্যাতনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে সেক্যুলার মানবিকতার বোধ নিশ্চিহ্ন করে এ দেশটিকে মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেমনটি তালেবানরা করেছিল আফগানিস্তানে।
২০০৫ সালের বোমা হামলা এবং বহুমাত্রিক সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানত পশ্চিমের চাপে খালেদা জিয়ার সরকার জেএমবির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী নেতাকে গ্রেফতার করেছিল, যদিও সরকার প্রথমে এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করছিল। গ্রেফতারকৃত শীর্ষ জঙ্গীরা গোয়েন্দা বিভাগের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বলেছে, জোট সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা। তারা বলেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন ইসলামী এনজিও থেকে কীভাবে তারা অর্থসাহায্য পায় এবং প্রতিবেশী দেশসমূহে তাদের নেটওয়ার্ক কতদূর বিস্তৃত। জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য সহ অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী-লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় জঙ্গী মৌলবাদীরা গ্রেনেড-বোমার হামলা চালিয়ে ২২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল যাদের ভেতর ছিলেন কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সহ এই হামলায় দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা এই হামলা ও হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ২০০৬-এর জানুয়ারিতে দিল্লীতে বাংলাদেশের হরকতুল জেহাদের দুই জঙ্গীকে বিস্ফোরক সহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারাও কবুল করেছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তারা জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের সমাবেশে নৃশংস গ্রেণেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যথারীতি এর জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতকে দায়ী করে প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে চেয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গোয়েন্দা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষনেতারা এই বর্বরোচিত হামলার জন্য জঙ্গীদের নিযুক্ত করেছিলেন। এর আগে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার পর আমরা জানতে পেরেছি বাংলাদেশের জঙ্গীরা বিপুল পরিমাণ এই অস্ত্র অবৈধভাবে আমদানি করেছিল পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীদের জন্য এবং এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং জামায়াত বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবনে বার্মার রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এমন কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের যুক্ত যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্তি গোপন কোন বিষয় নয়। বাংলাদেশের হরকতুল জেহাদের জঙ্গীরা আরাকানেও জেহাদ করতে গিয়েছে। বার্মার হরকতুল জেহাদ ও জঙ্গী রোহিঙ্গাদের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করে জামায়াতের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক। এভাবেই বাংলাদেশের জঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জঙ্গীদের সৌহার্দ্যরে সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।
সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া জঙ্গী মৌলবাদীদের নেটওয়ার্ক বিস্তার সম্ভব নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জঙ্গীদের বিস্তার ঘটেছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। বিভিন্ন দেশে সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি, দারিদ্র এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয় স¤প্রদায় ও প্রান্তিক জাতিসত্তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নির্যাতনও জঙ্গীবাদের ক্ষেত্র তৈরি করে। যে সব দেশে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটেছে একসময় তা সরকারের জন্যেও বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। তারপরও জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশে আমরা বিগত জোট সরকারের সময়ে দেখেছি জঙ্গী মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে সিভিল সমাজের উদ্বেগের প্রতি সরকার বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি যতক্ষণ না চাপ এসেছে পশ্চিমের দাতা দেশসমূহ থেকে। কোথাও সরকার জঙ্গীদমনে আন্তরিক হলেও জঙ্গীদের আন্তঃরাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্কের কারণে তাদের প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সব ধর্মের ভেতর মৌলবাদের উপাদান যেমন রয়েছে উদারনৈতিকতা, মানবিকতা ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির উপাদানও রয়েছে। ধর্মপ্রচারকদের স্থির করতে হবে কীভাবে তাঁরা ধর্মকে মানুষের কল্যাণে প্রচার করবেন। বর্তমানে ইসলামের নামে জঙ্গী মৌলবাদের বিশ্বব্যাপী যে উত্থান ঘটেছে তেমনটি অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে ঘটেনি। মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর ভেতর শক্তিশালী আন্তঃরাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে গত ২৫ বছরে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই সব দেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যারা লড়ছে সেই সব সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সংগঠন ও ব্যক্তির ভেতর কোন কার্যকর যোগসূত্র এখনও গড়ে ওঠেনি। জঙ্গী মৌলবাদের কারণে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, নারীর সমঅধিকার, মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান ও শিল্পসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। জঙ্গী মৌলবাদীরা সন্ত্রাস ও হত্যার মাধ্যমে সমাজে আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করছে, মানুষকে নিয়তিবাদী, হতাশাগ্রস্ত ও সহিংস করে তুলছে। ধর্মান্ধতা ও ধর্মোন্মাদনা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও ঘৃণা। ধর্মের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসকে বৈধতা প্রদান করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বিশ্বশান্তি ও বিশ্বসভ্যতার জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার নিরবচ্ছিন্ন চর্চা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন, যেখানে নিষিদ্ধ ছিল ধর্মের নামে রাজনীতি।
(দুই)
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দেশ যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল তার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিত্বের চেতনা। ১৯৭২ সালে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘গণতন্ত্র’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ নতুন প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।
বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারণা পশ্চিমের চেয়ে বহুলাংশে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশে এবং ভারতেও সেক্যুলারিজম বলতে বোঝায় রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছিন্নতা (ঝবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ ংঃধঃব ভৎড়স ৎবষরমরড়হ), ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দিবার মত ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিষ। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল যা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে কোন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব হয়নি। এই সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার ও জঙ্গী মৌলবাদের জেহাদী উন্মাদনা দেখতে হতো না।
’৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পর এটি দুই ধরনের সমালোচনা শিকার হয়। এক পক্ষ হচ্ছে সা¤প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, যারা ইসলামকে মনে করে পরিপূর্ণ জীবনবিধান যা রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। অপরপক্ষ হচ্ছে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা যারা পশ্চিমের প্রভাবে ধর্মকে ব্যক্তি ও সমাজজীবন থেকে নির্বাসনের পক্ষে। মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে আক্রমণ করেছে এই বলে যে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ হচ্ছে নাস্তিকতা, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে মানুষের ধর্মপালন ও প্রচারের স্বাধীনতা থাকবে না। মৌলবাদী নয়, এমন দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা ছিল ’৭২-এর সংবিধানপ্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ঢুকিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মের প্রতি অনুরাগের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। শতকরা ৮৫% মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী যাঁরা ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তাঁরা ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার বার তাদের বলতে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়।
অপরদিকে বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারজিম সম্পর্কিত ধারণাকে গোঁজামিল আখ্যা দিয়ে বলেছেন সেক্যুলারিজমের অর্থ হচ্ছে ইহজাগতিকতা, রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও ধর্মের স্থান থাকবে না, কারণ ইহজগতের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এদের সমালোচনার বিষয় ছিল সরকারী বেতার ও টেলিভিশনে সব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ ও আলোচনা, এমনকি রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশের আরম্ভে সব ধর্মগ্রন্থ পাঠ প্রভৃতি সেক্যুলারিজমের পরিপন্থী। সেক্যুলার ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ঘঅগ) সদস্য হয়েও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ঙওঈ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং এর সদস্যপদগ্রহণও তখন সমালোচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক ইসলামিক একাডেমীকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে রূপান্তর, মদ্যপান ও ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রীয় খরচে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ এ সবই তখন সেক্যুলারিজমের বিচ্যুতি হিসেবে সমালোচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলাজিরমকে বামপন্থীরা ঢ়ংবঁফড়-ংবপঁষধৎরংস বলেছেন যেমনটি তারা বলেন ভারতের সেক্যুলারিজম সম্পর্কে। অথচ ৪০ বছর পর পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমরা উপলব্ধি করছি ’৭২-এর সংবিধানপ্রণেতারা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ধর্মের অবস্থানকে মেনে নিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে দূরে রাখার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার যে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেটা আমাদের মতো দেশের কয়েক হাজার বছরের মানবিকতার লোকায়ত দর্শনেরই অভিব্যক্তি।
(তিন)
বাংলাদেশের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব সেক্যুলারিজমের চেতনা এদেশে পশ্চিম থেকে আমদানি করা হয়নি। ভারতবর্ষে যখন প্রথম বৈদিক ধর্মের প্রবর্তন হয় তখন থেকেই উদ্ভব ঘটেছে ধর্মের বিরোধী চিন্তা। খৃষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে চার্বাক দর্শন ঈশ্বর, পরলোক, স্বর্গ, নরক, জন্মান্তর প্রভৃতি বৈদিক ধর্মের মূল বিষয়সমূহ অস্বীকার করে ভারতীয় উপমহাদেশে বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছে। ঋগবেদে এই দর্শনের আদিগুরু বৃহস্পতি বলেছেন, ‘বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা’। চার্বাক দর্শনের অনুসারীরা জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের কথা বলেছেন। এই ভোগবাদ ধর্মবিশ্বাসীদেরও প্রভাবিত করেছিল। হিন্দুর বৈদিক ধর্মকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছিল জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম যা বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে নাস্তিকতা হিসেবে।
নাস্তিকতার প্রভাবে বাঙালি হয়েছে সেক্যুলার। তবে বাঙালির চেতনায় সেক্যুলারিজম ধর্মের বহু আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সহ অবস্থান করেছে বিশেষভাবে যে সব আচার-অনুষ্ঠান পার্থিব প্রাপ্তির সন্ধান দেয়।
অধ্যাপক আহমদ শরিফ বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলেছেন ‘আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, তাই ভাষার নাম বাঙলা এবং তাই আমরা বাঙালী। আমরা এদেশেরই জলবায়ু ও মাটির সন্তান। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এদেশের মাটির পোষণে, প্রকৃতির লালনে এবং মানুষের ঐতিহ্য-ধারায় আমাদের দেহ-মন গঠিত ও পুষ্ট। আমরা আর্য নই, আরবি, ইরানি কিংবা তুর্কিস্তানিও আমরা নই। আমরা এদেশেরই অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। আমাদের জাত আলাদা, আমাদের মনন স্বতন্ত্র, আমাদের ঐতিহ্য ভিন্ন, আমাদের সংস্কৃতি অনন্য। আমরা আগে ছিলাম ধহরসরংঃ, পরে হলাম ঢ়ধমধহ, তারও পরে ছিলাম হিন্দু-বৌদ্ধ, এখন আমরা হিন্দু কিংবা মুসলমান। আমরা বিদেশের ধর্ম নিয়েছি, ভাষা নিয়েছি, কিন্তু তা কেবল নিজের মতো করে রচনা করবার জন্যেই। তার প্রমাণ নির্বাণকামী ও নৈরাত্ম-নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ এখানে কেবল যে জীবনবাদী হয়ে উঠেছিল, তা নয়, অমরত্বের সাধনাই ছিল তাদের জীবনের ব্রত। বৌদ্ধচৈতন্য ভরে উঠেছিল অসংখ্য দেবতা ও উপদেবতার প্রতিমায়। হীনযান-মহাযান ত্যাগ করে এরা তৈরি করেছিল বজ্রযান-সহজযান, হয়েছিল থেরবাদী। এতে নিহিত তত্ত্বের নাম গুরুবাদ।
‘সে জীবনবাদী, তাই বস্তুকে সে তুচ্ছ করে না, ভোগে নেই তার অবহেলা, তাই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যা কর্তব্য, তাতেই সে উদ্যোগী। সেজন্যেই সে তার গরজমতো জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার দেবতা সৃষ্টি করেছে। পারলৌকিক সুখী জীবনের কামনা তার আন্তরিক নয় পোশাকীই। তাই সে মুখে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ গ্রহণ করেছিল, অন্তরে কোনোদিন বরণ করেনি। তার পোশাকী কিংবা পার্বণিক জীবনে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং আচার আবরণ ও আভরণের মতো কাজ দিয়েছে, কিন্তু তার আটপৌরে জীবনে ঠাঁই পায়নি।’ (বাংলা, বাঙালী ও বাঙালিত্ব, অনন্যা, ঢাকা, ২০০১)
হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মকে বাঙালি যেভাবে নিজের বস্তুবাদী চেতনার উপযোগী করে গ্রহণ করেছে পরবর্তীকালে একইভাবে গ্রহণ করেছে ইসলাম ও খৃষ্টধর্মকে। ইসলাম এ দেশে এসেছে এক হাজার বছর আগে এবং তা প্রচারিত হয়েছে সুফীদের দ্বারা। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুফীরা তলোয়ারের জোরে নয়, মানবপ্রেম অবলম্বন করে ইসলাম প্রচার করেছেন। হিন্দু ধর্মের বর্ণবৈষম্যের শিকার নিম্নবর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণের সমান হওয়ার জন্য কিংবা পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকদের অনুগ্রহভাজন হওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে। তবে এই ইসলাম আরবের রক্ষণশীল সালাফি ইসলাম ছিল না। ইরানে উদ্ভূত সুফীবাদের উপর মুতাজিলাদের প্রভাবের ফলে কিতাবসর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে উদারনৈতিক মানবিকতার যে পরিচয় ইসলামে পাওয়া যায় তা এতদঞ্চলের মানুষদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
সালাফী বা ওহাবি ইসলামে নৃত্যকলা, সঙ্গীত ও চিত্রকলা নিষিদ্ধ। সুফীরা মুতাজিলাদের মতো নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে এর চর্চা করেছেন। বিশেষভাবে চিশতিয়া ও সোহরাওয়ার্দী তরিকার সুফীদের প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চায় মুসলিম শিল্পীরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ নৃত্যশিল্পের বিকাশেও মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলার হিন্দু জমিদাররা লক্ষেèৗ, জয়পুর, আগ্রা ও এলাহাবাদ থেকে মুসলিম ওস্তাদ ও বাঈজীদের আনতেন দুর্গোৎসবে কিংবা কোন পারিবারিক উৎসবে।
সুফীবাদের সাম্য ও মানবিকতা বাংলার সনাতন হিন্দু ধর্মকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম। বৈষ্ণব কবিদের রচনায় মানবপ্রেম নানাভাবে মূর্ত হয়েছে। এ সময়ের কবি চন্ডিদাসই মানবতার শাশ্বত বাণী উচ্চারণ করেছিলেন ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
এর আগে চর্যাপদের যুগে বৌদ্ধ কবিরাও মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন এবং জীবনবিমুখ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন। এগারশ বছর আগে চর্যাপদকর্তা সরহপার একটি দোহা গানের কথা হচ্ছে ‘কী হবে তোর দীপে, কী হবে তোর নৈবদ্যে?/ কী হবে তোর মন্ত্র ও সেবায়?/ তীর্থে তপোবনে গিয়েই বা তোর কী হবে?/ মোক্ষ কি লাভ হয় জলে স্নান করে?’ (চর্যাগীতি পদাবলী, সম্পাদনা সুকুমার সেন, কলকাতা ১৯৬৬)
এরই চূড়ান্ত রূপ আমরা পাই ফকির লালন শাহ ও তার সমগোত্রীয় বাউলদের গানে। দেড়শ বছর আগে লালন লিখেছেন, ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে / যবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতিগোত্র নাহি রবে।’
লালন আরও বলেছেন ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে .../ জগৎ জুড়ে জাতের কথা/ লোকে গল্প করে যথাতথা/ লালন বলে জাতের ফাতা/ ডুবাইছি সাত বাজারে।’
লালন ফকির প্রভাবিত হয়েছিলেন ইসলামের আদিযুগের সুফীদের দর্শনের দ্বারা। ইরানের সুফীসাধক মওলানা জালালউদ্দিন রুমী (১২০৭-১২৭৩ খৃস্টাব্দ) ‘দিওয়ান-এ শামস-এ তাবরিযি’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন ‘আমি কী করতে পারি, হে আল্লাহর অনুসারীগণ বল? আমি তো নিজেকেই চিনি না।/ আমি খৃস্টান নই, ইহুদি নই, অগ্নিউপাসক নই, মুসলিমও নই,/ আমি প্রাচ্যের অথবা পাশ্চাত্যের নই, জলের নই, স্থলেরও নই,.../ আমি ভারতের নই, চীনের নই, বুলগারের নই, সাকসিনের নই,/ দুই ইরাক দেশের নই, খোরাসানেরও নই,/ আমি এ জগতের নই, জগতাতীতও নই,/ আমি স্বর্গের নই, নরকেরও নই, আমি যাঁকে চাই, যাঁকে আমি চিনি, যাঁকে আমি দেখি, যাঁকে আমি ডাকি।/ তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনি বাহিরের, তিনি অন্তরের/ তাঁকে ছাড়া আমি আর কাউকে জানি না। ...’ সাধক রুমী তাঁর গুরু ও বন্ধু শামস তাবরিযির ভেতর ঈশ্বরকে অবলোকন করেছেন।
চতুর্দশ শতকের সুফী সাধক মাহমুদ শাবিস্তারি লিখেছেন “আমি” ও “তুমি” স্বর্গ ও মর্তের মাঝখানে পর্দার মতো/ এই পর্দা সরিয়ে দাও, তুমি দেখবে/ ধর্ম ও স¤প্রদায়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই,/ যখন “তুমি” আর “আমি” থাকব না/ তখন কীসের মসজিদ, কীসের উপসনালয় আর কীসেরই বা অগ্নিমন্দির?’ সুফীরা ধর্মের আধ্যাত্মিকতার কথা বলেছেন, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্কের কথা বলেছেন, ওহাবিরা ধর্মের আধ্যাত্মিকতা প্রত্যাখ্যান করে জাগতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক ইসলাম প্রচার করছে, যার কোন উপাদান বাংলার মাটিতে নেই।
মধ্যযুগের সুফী সাধক ও লালন ফকিরের বহু গানে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। লালনের মানবিক সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও প্রভাবিত করেছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধ দেশ ও কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। তাঁর জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ-এ তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘গু ৎবষরমরড়হ রং ঃযব ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ংঁঢ়বৎ-ঢ়বৎংড়হধষ সধহ, ঃযব ঁহরাবৎংধষ যঁসধহ ংঢ়রৎরঃ রহ সু ড়হি রহফরারফঁধষ নবরহম.’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ভগবানের বুকে লাথি মেরে মানবতার জয়গান গেয়েছেন এই বলে ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড়, নাহি কিছু মহিয়ান।’ নজরুলের সমসাময়িককালে ১৯২৫ সালে কলকাতায় সূচিত হয়েছিল ‘বুদ্ধিমুক্তি’র আন্দোলন যা শহরের শিক্ষিত মুসলমানদের ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছে। আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ ও কাজী মোতাহার হোসেন এই আন্দোলনের সূচনা করেছেন, যার শ্লোগান ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এদের সমসাময়িক বাঙালি এমএন রায় ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন, যার ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি-নীতি-স্বাধীনতা। তিনি মানুষের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সকল প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। উনিশ শতকে বাংলার বিদ্বৎ সমাজে ইউরোপের রেনেসাঁর প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার চর্চা যেমন নতুন মাত্রা লাভ করে, এর বিপরীতে ইংরেজ শাসকদের উপনিবেশ-নীতি ধর্মে ধর্মে বিভাজন ও বিরোধকে সমানভাবে উৎসাহিত করেছে।
গ্রাম-বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে সেক্যুলার মানবিকতার বোধ যতটা প্রবল নগরকেন্দ্রিক বিত্তবান এলিটদের চেতনায় ততটা কখনও ছিল না। বাঙালির লোক-ঐতিহ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান ধর্মের এক ধরনের সমন্বয় ঘটেছে যা গ্রাম বাংলার বাউল, জারি, সারি গানে, কবি গানে, বাংলা নববর্ষ, চৈত্র সংক্রান্তি ও নবান্নর উৎসবে আমরা দেখতে পাই। এসব সাংস্কৃতিক আয়োজন একান্তভাবেই সেক্যুলার, যা শত শত বছর ধরে গ্রাম বাংলার মানুষ চর্চা করেছে।
রাজা ও ভূস্বামীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বিভিন্ন সময়ে ধর্মে ধর্মে বিরোধ ও হানাহানির ঘটনা ঘটলেও গ্রাম বাংলার মানুষ তাতে খুব একটা সাড়া দেয়নি। এমনকি ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে হিন্দুরা যেমন মুসলিম পীরের মাজারে গিয়ে মানত করেছে, মুসলমানরাও হিন্দুদের অনেক কাল্পনিক দেবদেবীর শরণাপন্ন হয়েছে, যাদের ভেতর সত্যনারায়ণ, ওলাইচণ্ডী, শীতলা দেবী, বনদেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
হিন্দুদের সত্যনারায়ণ ছিলেন মুসলমানদের সত্যপীর। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ‘সত্য’র সাধনা করেছেন। সেই সময়ে সত্যপীর বা সত্যনারায়ণকে বন্দনা করে বহু পুঁথি লেখা হয়েছিল। একটি পুঁথিতে বলা হয়েছে‘হিন্দুর দেবতা হইল মুসলমানের পীর/ দুই কুলে সেবা লয় হইয়া জাহির।/ ...মক্কার রহিম আমি অযোধ্যার রাম/ কলিতে স¤প্রতি আমি সত্যনারায়ণ।’
এই সব দেবদেবী কিংবা পীর মুর্শিদের কাছে হিন্দু মুসলমান গিয়েছে পার্থিব প্রয়োজনে, পরকালে কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়। বাঙালির চেতনায় পরকালের চেয়ে ইহকাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগে বহু বাঙালি মুসলমান কবি হিন্দুর দেবদেবীর বন্দনা করে কবিতা লিখেছেন, হিন্দু কবি ও শিল্পীরা মুসলিম পীর-মুরশীদ ও শাসকদের বন্দনা করেছেন, তাদের রাজসভা অলংকৃত করেছেন।
তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এটাও আমরা দেখেছি এক শ্রেণীর গোঁড়া ধর্মপ্রচারক বাংলায় সাধারণ মানুষের জীবনে সেক্যুলার জীবনযাপন বা ধর্মসমন্বয়ের আচরণকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। মধ্যযুগে দিল্লীতে সম্রাট আকবরের ‘দীন ই এলাহী’র মাধ্যমে সর্বধর্ম সমন্বয়ের উদ্যোগ এবং বাংলায় সুফী-বৈষ্ণবদের সর্বধর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমে মানবধর্মের আবাহনকালে আবির্ভাব ঘটেছিল শেখ আহমদ সিরহিনদ-এর নেতৃত্বে একদল কট্টর উলামার, যাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের প্রভাব থেকে মুসলমানদের বের করে আনা এবং শরিয়তের বিধানসমূহ কঠোরভাবে পালন করা। এরই ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় ওহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। শুরুতে ওহাবিরা বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও পরে তাদের বিরোধিতার লক্ষ্য ছিল ভারতের অমুসলিম ধর্মীয় স¤প্রদায় এবং আখেরে ইসলামি হুকুমত কায়েমের উদ্যোগ।
(চার)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতম গণহত্যা ও এর পর সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে আরম্ভ করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দল সরকারি হিসেবে তিরিশ লক্ষ নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে প্রায় ২ লক্ষ নারীকে। এই সময় এক কোটি মানুষ নিজেদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদ ও মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যূত হয়েছিল আরও তিন কোটি মানুষ।
’৭১-এ এই সব হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনে তাদের বক্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ইসলাম রক্ষার জন্য তারা এসব করেছে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের তারা ’৭১-এ আখ্যায়িত করত ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের চর’ ও ‘ইসলামের শত্র“’ হিসেবে। তারা দলীয় কর্মীদের ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার জন্য গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে উদ্বুদ্ধ করত। একইভাবে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকেও প্ররোচিত এবং কখনও বাধ্য করেছে অধিকতর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞে। ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে বৈধতাপ্রদান হচ্ছে আধুনিক ওহাবিবাদ তথা মওদুদিবাদের বৈশিষ্ট্য।
১৯৭১-এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫-এ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ’৭১-এর শীর্ষস্থানীয় ঘাতক ও দালালদের সমন্বয়ে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার বর্তমান নাম বিএনপি। এর তেত্রিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বপ্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী ২০১০-এর ২৬ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম আরম্ভ করেছে।
স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪০ বছর পর ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের প্রধান মিত্র বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। জামায়াত জানে এই বিচার যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকবে না। তারা এই বিচার বাধাগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দেশে বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যে আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ১৯৭৩-এ প্রণীত সেই আইনের বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে এবং ৪০ বছর পর এই বিচারের যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে কথা বলে সমগ্র বিচার প্রক্রিয়াকে তারা নস্যাৎ করতে চাইছে।
’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার জন্য কোনও কোনও দেশ বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে, বিশেষভাবে সেই সব দেশ যারা তখন এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে নিরব ছিল কিংবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখন বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ নাগরিকের দাবি। এমনকি বিএনপিরও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চান। দলনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
(পাঁচ)
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে মিছিল রাজধানী ঢাকায় দেখা গিয়েছিল সেটি ছিল ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে। ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে প্ল্যাকার্ড সহ মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মারকপত্র দিয়ে ’৭১-এর গণহত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। এই মিছিলের অধিকাংশ ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক বাহিনী আলবদরের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের স্ত্রী, ভাই-বোন ও স্বজনরা। এই মিছিল কোনও রাজনৈতিক দল আয়োজন করেনি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২-এর ২৪ জানুয়ারি প্রণয়ন করেছিল ‘ঞযব ইধহমষধফবংয ঈড়ষষধনড়ৎধঃড়ৎং (ঝঢ়বপরধষ ঞৎরনঁহধষং) ঙৎফবৎ, ১৯৭২, যা দালাল আইন নামে বেশি পরিচিত। দালাল আইন অনুযায়ী ’৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হচ্ছিল প্রচলিত সাক্ষ্য আইনে, যার দ্বারা এসব অপরাধের যথাযথ বিচার সম্ভব ছিল না। বিচারের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করে সরকার ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে প্রণয়ন করেছিল ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলায় স্থাপিত ট্রাইবুনালে যে বিশেষ নীতি ও আইন প্রণীত হয়েছিল তারই আদলে ’৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩’ প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইবুনালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন, লুণ্ঠন, গৃহে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অপরাধের দায়ে প্রায় ১১ হাজার ব্যক্তির বিচার চলছিল, যাদের ভেতর ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকারের প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিপ্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য উন্মুখ মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিম ৩০ লক্ষ নিহতের পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক সমাপ্তি এভাবেই ঘটেছিল।
১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সদ্যজাত রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার গ্যারান্টি ক্লয হিসেবে এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সহ যাবতীয় নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল ইসলাম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার দোহাই দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর প্রধান গোলাম আযম তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন পাকিস্তান হচ্ছে আল্লাহর ঘর। আল্লাহর ঘরের হেফাজত করার জন্য ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্র“দের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও সমচরিত্রের ধর্মভিত্তিক দলগুলি ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিতে চেয়েছে। জিয়াউর রহমান সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীদের ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
দলগঠনের সুযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েক ডজন ইসলামীপন্থী দলের অভ্যুত্থান ঘটে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় গিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট সারা দেশে শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দেয়। যাদের গ্রেণেড-বোমা হামলা ও হত্যার লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মী, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয় স¤প্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ বেন কিরনান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে অব্যাহতিকে দায়ী করেছেন আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আলকায়দা, তালেবান ও সমচরিত্রের জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের অভ্যুত্থানের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় মৌলবাদের সঙ্গে আপোষ করেছে, কখনও অপেক্ষা করেছে, কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজ সব সময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
(ছয়)
’৭১-এর ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমাম এক অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি, গঠন করেছিলেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। গত ২০ বছর বহু ঝড়ঝঞ্ঝা ও ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে এই আন্দোলন এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ৩০ লক্ষ স্বজনহারা ভুক্তভোগী পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং নাগরিকদের অব্যাহত আন্দোলনের পর বিশেষ ট্রাইবুনালে’ ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছে।
’৯২-এর ১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহ আগে মুক্তিযুদ্ধের আত্মস্বীকৃত প্রতিপক্ষ, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সংবিধান লংঘন করে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দলের আমীর ঘোষণা করেছিল। তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল বের করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এই জনবিক্ষোভের ফলশ্র“তি ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’।
দেশের ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত নির্মূল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়েছিল ‘আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনীভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয় তাহলে আগামী ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণ-আদালতে গোলাম আজমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আজম অপরাধ করেছে এদেশের সমগ্র জনগণের কাছে সেহেতু গণ-আদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান।’
নির্মূল কমিটির ঘোষণা ও ইশতেহার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। দেশের সকল জনপদের সর্বস্তরের মানুষ নির্মূল কমিটির ঘোষণার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে স্বতস্ফূর্তভাবে গঠিত হয়েছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে লক্ষ লক্ষ গণস্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। জাহানারা ইমামের জনসভায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে। ’৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ছুটে এসেছিলেন। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার দূরপাল্লার বাস, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ করে রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে, ১৪৪ ধারা জারি করেও গণআদালতঅভিমুখী প্রবল জনস্রোত রুদ্ধ করতে পারেনি। তবে ক্রোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার জাহানারা ইমাম সহ গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিল।
গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের ধারণা নেয়া হয়েছিল ভিয়েতনামে আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইবুনাল অন ভিয়েতনাম’ থেকে। এটি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদের অভিব্যক্তি। এই ট্রাইবুনালের কোন আইনি বৈধতা বা দণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৩ নবেম্বর লন্ডনে এই ট্রাইবুনালের প্রথম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাইবুনালের অনারারি প্রেসিডেন্ট ছিলেন বৃটিশ লেখক ও দার্শনিক লর্ড বার্টান্ড রাসেল, নির্বাহী সভাপতি ছিলেন ফরাসী লেখক জাঁ পল সার্ত্র এবং অধিবেশনসমূহের সভাপতি ছিলেন রুশ আইনজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ভাদিমির দেদিজের। ট্রাইবুনালের সদস্য ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৩ জন আইনজ্ঞ, লেখক, অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। একইভাবে বিভিন্ন দেশের ৩১ জন বিশিষ্ট নাগরিক এই ট্রাইবুনালে সাক্ষ্যপ্রদান করেছিলেন। বার্টান্ড রাসেল ও জাঁ পল সার্ত্রের এই ট্রাইবুনাল বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজকে যুদ্ধাপরাধেিদর বিচারের জন্য আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে।
গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের পর জাহানারা ইমামের আন্দোলনের বড় সাফল্য ছিল গোলাম আযম ছাড়া অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধান এবং মাঠপর্যায়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা। বরেণ্য কবি ও সমাজকর্মী সুফিয়া কামালকে চেয়ারপার্সন করে ’৯৩-এর ২৬ মার্চ ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন প্রথম পর্যায়ে আটজন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সাতজন যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্ম সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দুটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে।
২০০৭ সালে ডঃ ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। এই সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ২০০৭-এর ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বললেন, এদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। এরপর সরকারপ্রধান সহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রধানও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছেন। সরকারপ্রধান অবশ্য বলেছেন, সরকার বিচার করবে না, তবে কোন ভুক্তভোগী যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয় সরকার তাদের সহযোগিতা করবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে তখন অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন কিংবা পৃথকভাবে মাঠে নেমেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা যখন দলীয় রাজনীতির উধের্ক্ষ উঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’ গঠন করেন তখন সারা দেশে যথেষ্ট উৎসাহ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্মের এক বিপুল অংশ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নানাবিধ কর্মসূচী পালন করে। ’৯২-এ জাহানারা ইমাম যে স্রোতধারা সৃষ্টি করেছিলেন তাতে নতুন প্রবাহ যুক্ত হয়, স্রোত তীব্রতর হয়। যার যৌক্তিক পরিণতি ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিশাল বিজয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন। মহাজোটের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
(সাত)
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ বিভিন্ন কারণে যুদ্ধের শিকার হয়েছে। গোত্রপ্রধান বা রাজন্যবর্গ কখনও রাজ্য বিস্তারের জন্য, কখনও সম্পদ লুন্ঠনের জন্য, কখনও অতীতের কোনও পরাজয় বা অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সবলের দ্বারা দুর্বল নিহত, নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। সভ্যতার মানচিত্রে যুদ্ধের আইন প্রণীত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে ভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় থেকে। যুদ্ধের আইন লংঘনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ইউরোপে আড়াই হাজার বছর আগে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আইনশাস্ত্রে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ সংজ্ঞায়িত হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথমে নুরেমবার্গ, টোকিও, ম্যানিলা এবং পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল ও ম্যানিলা ট্রয়ালের অভিজ্ঞতা এখনও প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের যে বিচার কার্যক্রম চলছে সেখানে অতীতের এসব ট্রায়ালের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সব দিক বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের গণহত্যার পৃথক কোন সংজ্ঞা ছিল না, ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তের আপিল করার সুযোগ ছিল না। বাংলাদেশের আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে অন্যান্য দেশের কিংবা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের সংজ্ঞার মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের আইনে অভিযুক্তের আপিল করার সুযোগ রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। নুরেমবার্গ, টোকিও বা ম্যানিলা ট্রয়ালের তুলনায় বাংলাদেশের আইনে অভিযুক্তের সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ’৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে নিজস্ব আইনে। পৃথিবীর সব দেশের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন ও সার্বভৌম বলে মান্য করা হয়। ’৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটেছে বাংলাদেশে, অভিুক্তরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের, ভিকটিমরাও বাংলাদেশের। এসব অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশে যোগ্য বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার অভাব নেই। আমরা যেমন অন্য কোনও দেশের বিচার ব্যবস্থার সমালোচনা করি না, অন্যদেরও উচিৎ আমাদের বিচার ব্যবস্থা কিংবা বিশেষ কোন বিচার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার আগে বিষয়টি নিয়ে দুবার চিন্তা করা।
আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় নিশ্চয় কোনও দেশে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে আইনের ফাঁক দিয়ে কোন ভয়ঙ্কর অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে কি না। বিচার না করার কারণেই বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধীরা ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়েছে। তারা দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ, মানবাধিকার এবং আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার পথে বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বাংলাদেশে যে জঙ্গী মৌলবাদের জন্ম দিচ্ছে এসব সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপ ও আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে।
আমরা যদি ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তাবাদ বা কোন মতবাদের নামে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করতে চাই অতীতে যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। বাংলাদেশে গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী এবং মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা একই দলের অন্তর্ভুক্ত, একই আদর্শের অনুসারী। যে কারণে সচেতন নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণেরও দাবি করছে। ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন কিংবা গণতান্ত্রিক ও মানবিক সংস্কৃতির অনুশীলন সম্ভব হয়নি। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যাদের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যে রাজনীতি ধর্মের নামে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে বৈধতা দেয় তা নিষিদ্ধকরণ। মৌলবাদী সন্ত্রাস ও যুদ্ধ দুটোই মানবসভ্যতার জন্য ভয়ঙ্কর অভিশাপ। যুদ্ধাপরাধের বিচার না করলে এই অভিশাপ অনন্তকাল আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। মননে ও সমাজে ন্যায়বিচার ও সভ্যতার বোধ কখনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
উৎস : -
যুদ্ধাপরাধের বিচার নুরেমবার্গ থেকে ঢাকা ---- শাহরিয়ার কবির
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩২
পথিক০২১ বলেছেন: Don't you people ever get tired ? Why are you carefully side stepping the fact that AL was in bed with Jamat as well in 1995 - '96. What happened to the supporting figures for freedom fight then ? What about the fact that this one party has been using this support of for freedom fight to get elected every time so that they can loot general people of this country even to a greater shame. Evidence is in front of you some of the incumbent leaders of AL's financial health has gained a growth of 5000% while the country suffers through inflation. Are you going to turn a blind eye to that as well ?