![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। তা'হলো, জাতি সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি। “মানুষ এক জাতি বই নয়’। এ হলো কুরআনের সুস্পষ্ট এবং মৌলিক বক্তব্য। পরে মানুষ বিভিন্ন হয়েছে। মানুষের এ বিভিন্নতাকে কুরআন চিহ্নিত করেছে ভাষার দ্বারা। সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার সময়ে কুরআনে উম্মৎ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে- 'সমগ্র জাতিতে রাসুল রয়েছেন' (সূরা ইউনুসঃ৪৭)। কিন্তু এখানে নবীর ভাষার কথা বলা হয়নি। অপরদিকে কোন জাতি খণ্ডকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার সময় কুরআন 'কওম' শব্দ ব্যবহার করেছে এবং সেখানে নবীর ভাষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- “আমরা কোন কওমে তার ভাষাতেই রাসুল পাঠিয়েছি (সূরাঃ ইব্রাহীম-৪)। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, ভাষা ও যুগনিরপেক্ষভাবে সমগ্র মানুষ জাতিকে কুরআনে উম্মত বলা হয়েছে। অপরদিকে 'কওম' শব্দ দ্বারা কুরআন ভাষাভিত্তিক জাতিখণ্ডকে বুঝিয়েছে। মানব জাতির এ ভাষাভিত্তিক জাতিখণ্ড ও বিভাজনকে কুরআন স্বীকৃতি দিয়েছে, জাতিখন্ডের ভাষায় রাসুল প্রেরণের মাধ্যমে। মানব জাতির ভাষাভিত্তিক বিভাজন প্রাকৃতিক এবং স্থায়ী। এ ছাড়া মানবজাতির অন্য যে কোন বিভাজন- রাজনৈতিক কিংবা আদর্শিক, কোনটাই স্বাভাবিক এবং স্থায়ী নয় বরং এ বিভাজন অপ্রাকৃতিক, অস্বাভাবিক, কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী। মানুষের এ প্রাকৃতিক বিভাজনের একমাত্র ভিত্তি যে ভাষা, তাকে অস্বীকার করে যা-ই করা হোক বা করার চেষ্টা করা হোক, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র; তা ব্যর্থ হবেই। পাকিস্তান এর নগদ প্রমাণ।
সে আলোচনা পরে আসছে। এখানে যে বিষয়টির প্রতি সুধি পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো এই যে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ একটি জাতি আর বাঙালি, একটি ভাষাভিত্তিক কওম অর্থাৎ জাতিখণ্ড। বর্তমান বিশ্বে অনুরূপ প্রায় ছয় হাজার সাত শতটি জাতিখণ্ড রয়েছে এবং বাঙালি এদের অন্যতম। বৃহত্তর মানবজাতির স্বতন্ত্র ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র অংশ হিসেবেই বাঙালিকে এখানে আমরা একটি জাতি হিসেবে উল্লেখ করবো।
এ প্রসঙ্গে বিশেষ স্মরণীয় যে, মানুষের ভাষাভিত্তিক জাতিত্ব বৃহত্তর মানবজাতির বিরোধাত্মক নয়, বরং গোষ্ঠীগত পরিচয় মাত্র। এখানে আরও স্মরণীয় যে মানুষে মানুষে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করে এমন কিছু তা যদি ভাষা, মতাদর্শ বা ভৌগলিক অবস্থান অথবা তথাকথিত ধর্মও হয়, তাও আল্ কুরআনসহ কোন ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে অনুমোদনযোগ্য নয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি অনন্য স্মরণীয় দিন। ১৯৫২'র এ - দিনে রফিক, জব্বার, বরকত ও সালাম- বাংলার এ চার সূর্য সন্তান সাবেক পূর্ব পাক-সরকারের পুলিশের গুলিতে ঢাকার রাজপথে শহীদ হন। কারণ, তাঁরা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে গণপরিষদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ঢাকার রাজপথে মিছিল করছিলেন। এরপর থেকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে, প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসাবে, অন্যান্য বার্ষিক অনুষ্ঠানের মতোই পালিত হচ্ছে। অন্যান্য বার্ষিক অনুষ্ঠানের মতোই বললাম এ জন্য যে, পাকিস্তান আমলে তো সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের প্রশ্নই আসেনা। স্বাধীন বাংলাদেশের চুয়াল্লিশ বছরেও বিশেষ করে সরকারের সর্বস্তরে এবং যে সব ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন, সে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু, যেসব বুদ্ধিজীবী এবং নেতা-নেত্রী এ দিবসে ধবধবে সাদা পোশাকে একটুকরো নতুন কালো কাপড় ঝুলিয়ে শহীদ মিনারে মঞ্চ গরম করেন, সর্বত্র বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের তরফ থেকেও তেমন একটা আপোষহীন উদ্যোগ বা চাপও লক্ষ্যণীয় নয়। এজন্য এ-দিবস উদযাপনটা আমার কাছে অন্যান্য অনেক আনুষ্ঠানিকতার মতই মনে হয়। আর আমার দোষ হলো, নিরেট আনুষ্ঠানিকতায় আমার কোন আকর্ষণ নেই।
সুতরাং মাতমের মহররম ইত্যাদির মতো একুশের আনুষ্ঠানিকতার সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারিনা। তাই এগুলোতে জড়াই না। বস্তুতঃ ত্যাগের মহিমায় মণ্ডিত জাতীয় চেতনা ও প্রেরণার উৎসগুলো যখন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয় তখন তা কাউকেই জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ করে না। এগুলো আবেদনহীন হয়ে পড়ে। বর্তমানের একুশও আমার কাছে তা-ই মনে হয়। তা হলেও একুশের চেতনা এবং এর যে উৎস জাতিসত্তা, সে সম্পর্কে উদাসীন থাকা যায় না। কারণ, এ সম্পর্কিত ঔদাসীন্য আত্মবিস্মৃতি, যা জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারে।
বলা বাহুল্য, নিজের দেশ ও ভূখণ্ড, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা, জীবনবোধ ও জীবনদর্শন, সর্বোপরি ভাষা ও সাহিত্য, যে কোন জাতির নিজস্ব সম্পদ, জাতিসত্তার একান্ত উপাদান। তবে নিজের দেশ ও ভূখণ্ড, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পরিত্যাগ বা অস্বীকার করে কেবলমাত্র নাগরিকত্ব বর্জন ও গ্রহণের দ্বারা যে কেউ পাকিস্তানী থেকে ইরাকী, ইরাকী থেকে পাকিস্তানী অথবা বাংলাদেশি থেকে ইন্ডিয়ান হতে পারে। এমনকি জীবনবোধ, জীবনদর্শন ও ধর্মীয় শাস্ত্র পর্যন্ত ত্যাগ করেও মুসলমান থেকে খৃষ্টান বা হিন্দু, হিন্দু থেকে মুসলমান হতে পারে, হতে পারে আস্তিক থেকে নাস্তিক আর নাস্তিক থেকে আস্তিকও এবং এ পরিচয়ে তাকে সবাই ইরাকী, পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, মুসলমান, খৃষ্টান বা আস্তিক অথবা নাস্তিকরূপে গ্রহণও করবে। অপরদিকে কোন বাঙালি তথা বাংলা ভাষাভাষীও ইংরেজী ভাষায় পি.এইচ.ডি. নিতে পারেন এমনকি কোন বাঙালি মায়ের সন্তান লন্ডনে জন্মগ্রহণ করে এক অক্ষরও বাংলা না শিখে, কেবল ইংরেজি শিখে যুগ যুগ ধরে বৃটিশ নাগরিক হয়ে সে দেশে বসবাস করতে পারে। কিন্তু নিজের বাঙালিত্বকে মুছে ফেলতে পারবে না এবং কেউই তাকে ইংরেজ বলে স্বীকার করবে না। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ভাষা ছাড়া অন্য কিছুই মানব জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করতে পারে না। অন্য কথায়, মানব জাতির ভাষাগত বিভাগ ও পরিচয় চিরন্তন, শ্বাশত এবং অবিনাশি। তাইতো ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন- “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এ'টি কোন আদর্শের কথা নয়, এ'টি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে, তা মালা, তিলক, টিকিতে কিংবা টুপি, লুঙ্গি দাঁড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’
একমাত্র ভাষাই মানবজাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করতে পারে এবং করেছে। এ ছাড়া মানব জাতির অন্য সব বিভক্তিই অস্থায়ী, সাময়িক এবং মেকী। সুতরাং বৃহত্তর মানবজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর একমাত্র ভাষাই তাদের অবিচ্ছেদ্য জাতিসত্তা, জাতীয়তার স্থায়ী ভিত্তি এবং উপাদান। সুতরাং বৃহত্তর মানবজাতিকে যদি অন্য কোন ক্ষুদ্র জাতিসত্তায় নামকরণ করতেই হয়, তা' তার ভাষার ভিত্তিতেই করতে হবে। সে হিসাবে বাংলা ভাষাভাষীর জাতিগত বিশেষণ হতে হবে বাংলা ভাষাভাষীরা বাঙালি জাতি আর আরবী ভাষাভাষীরা আরব। উল্লেখ্য যে, ভাষাগত জাতিত্ব বা জাতীয়তা স্থায়ী বিধায় এর ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র গঠিত হলে তাও স্থায়ী হয়। আর ধর্ম বা কেবল ভৌগলিক সীমারেখার মতো পরিবর্তনশীল কিছুর ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র গঠিত হলেও তা স্থায়ী হয় না। যেমন পাকিস্তান। বলা বাহুল্য যে, কুরআনে প্রত্যেক জাতিতে তাদের ভাষায় রাসুল পাঠানোর ঘোষণা, এ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার স্বীকৃতির সুষ্পষ্ট প্রমাণ।
সে যাই হোক, নিজস্ব ভাষার ভিত্তিতে স্বীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বাংলার অধিবাসীগণ স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ, যুগ-যুগান্তর থেকেই। এ স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয় চেতনাই বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে মুগ্ধ রেখেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে বার বার সার্বিক মুক্তির নেশায় বুকের রক্ত ঢেলে দিতে। এমনি করে সুদীর্ঘ রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে বাঙালি উপনীত হলো লাহোর প্রস্তাবের দ্বারপ্রান্তে; আশান্বিত হলো তারা, ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা বুঝি বাস্তবায়িত হচ্ছে। অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান দল বেঁধে ভোট দিল লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুসলিম লীগকে ১৯৪৬ সালে।
কিন্তু পাঞ্জাবী চক্র বাঙালিদের সে যুগযুগান্তের লালিত আশায়ও আঘাত হানলো, এ অঞ্চলীয় মোহাজের নেতাদের সক্রিয় অংশিদারিত্বে এবং তাদের তল্পিবাহক পরকীয় বাঙালিদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ বে-আইনীভাবে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে পাশকৃত লাহোর প্রস্তাব সংশোধিত হলো প্রতিনিধি পরিষদে; পাশ হলো এক পাকিস্তানের প্রস্তাব। বাংলার বিরুদ্ধে অবাঙালি নেতৃত্বে লীগ-কংগ্রেসচক্র দুধ-কলায় মিশে গেল, বাংলা বিভক্ত হলো, পূর্ব বাংলা বিভক্ত হলো, পূর্ব বাংলা পাঞ্জাবী চক্র তথা পাকিস্তানের ভাগে পড়ল আর পশ্চিম বাংলা পড়লো দিল্লীর ভাগে। অথচ এরই নাম দেয়া হলো, স্বাধীনতা। উল্লেখ্য যে, মূল লাহোর প্রস্তাবের খসড়া রচনা এবং তা উত্থাপন করে শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক আর এর সংশোধন করে এক পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম ও প্রধান উপাদান ও শর্ত হলো, একটি সংযুক্ত ভূ-খন্ড। কোন একটি জনগোষ্ঠী চাইলেই একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারে, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এ মতও একটি মীথ এবং অলীক কল্পনা। বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডের বিভিন্ন ভাষাভাষী অধিবাসীরা এমনটা চেয়েছেন এবং স্বেচ্ছায় একটি রাষ্ট্র গঠন করেছেন, তেমন নজীর আমার জানা নেই। ইসরাইলীরা নীড়ভাঙ্গা রাজনৈতিক ঝড়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। অবস্থার আনুকূল্যে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে এসেই আবার তাদের নীড় বাঁধতে হয়েছে। কিন্তু জাতিসত্তাসহ জাতীয় বৈশিষ্ট্যের সমস্ত বৈসাদৃশ্যকে অস্বীকার করে, দাবি করা হলো, পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র, দুটি বিশাল ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডের সমন্বয়ে। পরবর্তী ইতিহাস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রমাণ করেছে, এ দাবি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, স্বাভাবিক ছিল না বরং যা সত্য ও স্বাভাবিক ছিল, তা হলো, লাহোর প্রস্তাবে এ অঞ্চলে বাঙালিদের একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি, যার মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বাঙালির শত শত বছরের লালিত স্বপ্নসাধ। এর প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ।
বাংলায় বহু বিদেশী শাসক এসেছে, আবার চলে গেছে। বাঙালি সত্তার বিলুপ্তি সাধনের কোন পদক্ষেপ তারা নেয়নি। কিন্তু পাকিস্তানীরা এ অঞ্চলে তাদের শাসন-শোষণকে চিরস্থায়ী করার দূরাশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার পরিবর্তে 'পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণ করা হয় এবং বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা প্রদানে অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তার বিলুপ্তি সাধনে উদ্যত হয়।
একটি জাতিকে চিরদিন শাসন-শোষণ করতে হলে তার জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করতে হবে এবং তার জাতীয় চেতনার অবসান ঘটাতে হবে। জাতিসত্তার মূল উপাদান, জাতীয় চেতনার প্রধান উৎসগুলোকে ধীরে ধীরে নস্যাৎ করতে না পারলে জাতিসত্তার বিলুপ্তি ও জাতীয় চেতনার অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। পূর্বেই বলেছি, ভাষাই জাতিসত্তার মৌল ও অবিচ্ছেদ্য উপাদান এবং জাতীয় চেতনার সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস। তাই, পাকিস্তানীরা আঘাত হানে বাংলা ভাষার ওপর। প্রস্তাব এল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। বন্তুতঃ গণতান্ত্রিক আইনে, তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা, বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়ার অধিকারী ছিল। অথচ ১৯৪৮ সনের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙালির পক্ষ থেকে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম কেন্দ্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উত্থাপন করে যথেষ্ঠ উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু, পাঞ্জাবীরা বাংলার সে অধিকারের উদার দাবিকে অস্বীকার করে নগ্নভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলা স্বাধীন নয়, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং পাঞ্জাবীদের চারণভূমি ছাড়া কিছুই নয়।
বাংলা ভাষার প্রতি এ আঘাত বাঙালিত্বে ধাক্কা মারে, বাঙালির নাড়িতে ঘা দেয়, বাঙালি প্রকৃতস্থ হয়। বাঙালি উপলব্ধি করে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলে, বাঙালিত্বের অবমাননা হবে, বাঙালির জাতিসত্তা বিলীন হয়ে যাবে, জাতীয় চেতনার বিলুপ্তি ঘটবে এবং বাংলা পাকিস্তানের স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত হবে। তাই বাঙালি সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার মরণপণ সংগ্রামে। গড়িয়ে যায় বহু তাজা রক্ত, লাল হয় ঢাকার রজপথ, শহীদ হন, রফিক, জব্বার, বরকত ও সালাম, সৃষ্টি হয় একুশ। কাগুজে স্বীকৃতি পায় বাংলা, অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায়। গাধা পানি ঘোলা করে খায়। বাংলা তারা গলধঃকরণ করল, তবে অনেক দেরীতে। ফল হলো উল্টো।
আরো অনুপ্রাণিত হলো বাঙালি। উদ্বুদ্ধ হলো মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে, অগ্রসর হলো ধাপে ধাপে, রক্ত দিল স্তরে স্তরে। এলো চূড়ান্ত পর্যায়, শুরু হলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। অর্জিত হলো এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বিক মুক্তির প্রধান শর্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতা ১৬ ডিসেম্বর'১৯৭১-এ। অতিক্রান্ত হলো সার্বিক মুক্তির প্রথম সোপান। কিন্তু মুক্তির সুদীর্ঘ পথ এখনো বাকী।
যে বাংলা যুগ যুগ ধরে বাঙালির স্বাতন্ত্র্যকে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অক্ষুন্ন রেখেছে এবং রক্তদানে প্রেরণা যুগিয়েছে, একুশের সৃষ্টি করেছে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে, আমার বিশ্বাস-দৃঢ় বিশ্বাস, সে বাংলাই কেবল আমাদের প্রকৃতস্থ রাখতে পারে, মুক্তির অবশিষ্ট পথ-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অবশিষ্ট পথ অতিক্রমে সাহায্য করতে পারে- তবে, এজন্য আমাদের মন-মানসিকতা থেকে অফিস-আদালত পর্যন্ত জীবনের সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, বর্ণসহ এর সার্বজনীনতাকে। হতে হবে আমাদের যথার্থ বাঙালি, ঠিক সে অর্থে, যে অর্থে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সর্বত্যাগী সর্বহারাদের নেতা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ (সঃ) নিজেকে আরবী বলে দাবি করেন। বস্তুতঃ যথার্থ বাঙালি হওয়াই একুশের একমাত্র দাবি, আর কেবল তাতেই হবে একুশের শহীদদের আত্মার পরিপূর্ণ তৃপ্তি এবং তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন। কিন্তু আমরা কি-তা হতে পেরেছি? আর তা পারিনি বলেই বাঙালি থেকে বাংলাদেশি হয়েছি, বেতার থেকে রেডিও করেছি, এতে কোন দ্বিধা করিনি, লজ্জিতও হইনি।
যে জাতিতে আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন হয় না, ত্যাগের উপযুক্ত মর্যাদা পাওয়া যায়না, সে জাতিতে আর ত্যাগী জন্মায় না। ত্যাগ স্বীকারে আর কেউ অনুপ্রাণিতও হয় না। আমার কী মনে হয় জানেন? ঐ বিশেষ দিনটিতে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরী করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং ধপ ধপে কড়া ইস্ত্রি করা শার্ট-কোর্তায় গাঢ় কালো রঙের এক টুকরো নতুন কাপড় ঝুলিয়ে, বড়জোর একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে, একুশের দাবি পূরণ করেছি বলে, আমরা যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করি, তা-ই আমাদেরকে একুশের মূল দাবির যথার্থ উপলব্ধি ও রূপায়ণ থেকে বিরত রাখছে। তাই আমি বলছিলাম, একুশের দাবি পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত নিজ জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে আমরা একুশ মনে করতে পারি না? পারি না কী একুশের চেতনায়, আত্মত্যাগের মহিমায় মন্ডিত রাখতে? স্মরণীয় যে, ভাষাপ্রীতিই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। সুতরাং এ ভাষাভিত্তিক পরিচয় আর অটুট ভাষাপ্রীতিই স্বাধীনতাকে চিরস্থায়ী করতে পারে। বলা বাহুল্য যে, ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে 'বাঙালি' শব্দের কোন বিকল্প নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতিলাভের মধ্য দিয়ে এ সত্য বিশ্ব-স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
এটা বাঙালির অনন্য অর্জন; এ অর্জনের সম্যক রূপায়ণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলা ও বাঙালির ভাবী উন্নয়ন, উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সম্মান। এ প্রসঙ্গে বিদেশে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সে সময়ের বাংলাদেশ সরকার এ উদ্যোগের সাথে যথাযথ সহযোগিতা করেছেন তাদের সকলের প্রতি রইল বিশ্ববাঙালির সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।
২| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০০
ইনফা_অল বলেছেন: পাঠক ১৯৭১, এবার কুরআন দেখে নতুন কিছু লিখে ফেলেন যদি পারেন- " বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না"। (Al-Israa: 88)
আল্লাহর তরফ থেকে পৃথিবীবাসীর প্রতি কেয়ামত পর্যন্ত চেলেঞ্জ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৩
পাঠক১৯৭১ বলেছেন: কুরান লেখা হয়েছে তোরাহ ও বাইবেল দেখে; তোরাহ লিখেছেন নবী মুসা; বাইবেল লিখেছেন ঈশার সাগরেদেরা।