![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখক সমাজেরই মানুষ। সামাজিক বৃত্ত বলয়েই তার বসবাস। সাধারণ মানুষের মতো তারও দায়বদ্ধতা আছে। এই দায়বদ্ধতার কারণেই সমাজ টিকে আছে, আছে রাষ্ট্রও। একজন সাধারণ মানুষ যেমন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, একজন লেখকও সমভাবে তা ভোগ করে। কাজেই স্বাভাবিকভাবে লেখকেরও দায়বদ্ধতা চলে আসে। তার নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হন। তবে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে লেখক-সত্তাটা একটু উন্নত। লেখকের নিজস্ব অন্তর্লোক আছে, আছে অর্ন্তদৃষ্টিও। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তিও প্রখর ও তীক্ষ্ণ। লেখকের পক্ষে সবকিছু অবলোকন করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের পক্ষে যা সম্ভব নয়। যেমন একটি গোলাপ। এই গোলাপটি একজন সাধারণ মানুষের নিকট শুধুই একটি গোলাপ ফুল। গন্ধ নেয়ার মধ্যেই তার আনন্দ। কিন্তু একজন লেখকের নিকট একটি গোলাপ বিশাল একটি জগত। গোলাপের গন্ধের প্রতিটি অনু-পরমাণু তাঁর নিকট ভিন্ন ভিন্ন জগতে প্রবেশের দ্বার খুলে দেয়। সে সব জগতে তিনি কল্পনার বিস্তৃতি ঘটান। সৃষ্টি করেন অপরূপ লিখন কর্ম। একেকটি কল্পনা আলাদা-আলাদা সত্তা নিয়ে প্রকাশ পায় এবং এসব কল্পনা কিন্তু বাস্তবতার দিকেই ধাবিত হয়। বাস্তবতার বাইরে মানুষের কোনো কল্পনা নেই।
একজন লেখক, লিখতে ভালো লাগে বলেই লেখেন। অনেক সময় অনেক কথা বলতে ইচ্ছা হয় তাঁদের, যা সব সময় বলতে পারেন না তাঁরা, বলা যায় না, অব্যক্ত থেকে যায়। মনের ভিতরে আন্দোলন শুরু হয়। তখনই তা লেখন আকারে বের হয়ে আসে। লেখনীর মাধ্যমেই বলেন মুক্তভাবে। গণমানুষের জন্য লেখেন। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য লেখেন। এর চেয়ে বড় কাজ আর কি হতে পারে। এজন লেখক তাঁর লেখা দ্বারা প্রভাব বিস্তার করেন সমাজে, রাষ্ট্রে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য, দিন বদলের জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের। নেতৃত্বের দ্বারা ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। একজন লেখক লেখনীর মাধ্যমেই নেতৃত্ব দেন। তা তিনি কবিতার মাধ্যমেই দেন না কেন অথবা অন্য কোনো সাহিত্য ভাষার মাধ্যমেই দেন। একজন রাজনীতিক ও একজন লেখক একই মানুষ। তবে পার্থক্য হচ্ছে - রাজনীতিককে যেমন কথা বলায় পরদর্শী হতে হয়, তেমনি নেতৃত্বেও কুশলী হতে হয়। দু'টো গুণই থাকতে হয়। তাঁর কথা দ্বারা, নেতৃত্বের গুণে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়। আর একজন লেখক নেতৃত্ব দেন লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর বাগ্মীতা নাও থাকতে পারে। কিন্তু লেখনী দ্বারা প্রেরণা দিতে পারেন। জনগণকে উৎসাহী করে তোলেন। সাধক নজরুল তার কবিতার মাধ্যমেই রাজনীতি করেছেন। তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে। নির্যাতিত হতে হয়েছে। কাজেই একজন কবিও রাজনীতির বাইরে নন। রাজনৈতিক বলয়েই তাঁকে বসবাস করতে হয়। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। কার্ল মার্কস, পাবলো নেরুদা, মাও সেতুং, ম্যাক্সিম গোর্কি-এরা একেকজন কবি ও লেখক ছিলেন। তাঁদের লেখা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কাজেই লেখক ও লেখনী রাজনীতির বাইরে নয়। বলা যায় একে অপরের পরিপূরক।
'একুশ' মানেই ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলন মাতৃকা ও মৃত্তিকার আন্দোলন। আর তা লেখনীর দ্বারা প্রস্ফুটিত হয়। ব্যানার, পোষ্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড আর দেয়াল লিখনে উজ্জীবিত হয় জাগ্রত জনতা, দেশ ও জাতি। দৈনিকী, সাপ্তাহিকী, পাক্ষিকীতে বিক্ষুব্ধ লেখদের প্রতিবাদী লিখন। সে প্রতিবাদ মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ঘিরে হলেও তাতে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য প্রভাব রাখে। প্রাক-বায়ান্নো পর্বের পাকিস্তানীবাদীদের বিপরীত ধারার লেখনী ধীর পায়ে হেঁটেছে। বায়ান্নো'র একুশে ফেব্রুয়ারীর বিস্ফোরক ভাষা-আন্দোলন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। সমাজচেতনার পাশাপাশি স্বশাসনের দাবি প্রখর হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এবং খাদ্য সংকট, শিক্ষা সমস্যা ইত্যাদি ঘিরে ছাত্র-আন্দোলন, গণ-আন্দোলনের মুখে পরিস্থিতি যখন শাসক-বিরোধী পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন বিশেষ করে ঊনসত্তরের প্রবল প্রতিবাদী লেখনী বাঙালির জাতীয় চৈতন্য স্পর্শ করে। এসব লেখনীতে ভাষা থেকে ভূমি ও ভূমি সংলগ্ন মানুষ ক্রমে ক্রমে জায়গা করে নিয়েছে। ভাষা, ভূখন্ড, প্রকৃতি ও জাতিসত্তার মেলবন্ধনে একুশ কেন্দ্রিক লেখনীর নতুন ধারার পরিচয়ের ভিন্ন মাত্রিক প্রকাশ ঘটে। লেখনী দশকের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম হচ্ছে ষাট ও সত্তর দশক। এই দশকগুলোতে অনেক সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লেখকের আবির্ভাব ঘটে। এ সময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, শামসুর রহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ।
বাংলাদেশ উত্তরকালের দশকগুলো সৃজনের স্ফূর্তি, স্বাধীনতার উল্লাস, আর্তনাদ, আকাঙ্খার দশক। স্বাধীনতার স্বাদ, নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন এ সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠেন লেখকরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনকভাবে সৃষ্টির এ আনন্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে স্বপ্ন ও সৃষ্টি হতাশা আর অবসাদে পরিণত হয়। মানুষের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, তবু তাকে জীবনে চাই, আর তার জন্য আজীবন যারা দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে তারা প্রকৃত স্বভাবসিদ্ধ লেখক নয়, স্বাভাবিকভাবেই লেখক-আত্মা রয়েছে তাঁদের। প্রকাশের মধ্যে থাকে চূড়ান্ত বোধ, বোধি ও শিক্ষা। যার অভাব এখন খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের লেখনী আশির দশকে পৌঁছে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাব। সামরিক শাসকদের কথিত শাসন যেন ফ্যাসিষ্ট ঐতিহ্যের আরেক রূপ। 'স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক' কিংবা 'রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ' হৃদয়াবেগ মথিত করা উচ্চারণ হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রের আদলে গণতন্ত্র কতটা মুক্তি পেয়েছে তা নিয়েও সংশয় থেকে যায়। বিভাজিত লেখককূলের ভুয়ো আদর্শবাদিতার টানে লেখনীতে ফোটে হতাশার সুর। এর কারণ কি গত কয়েক দশকে লিখনীতে তেমন কৃতিত্ব কারোর নেই - গুণমানে ও পরিমাণে? নাকি এ কালের সমাজে লেখনী আগের মতো আর ঢেউ তোলে না। বাংলা আর বাঙালির চরম আশা, স্বপ্নপূরণে সংবেদনশীল লেখককূলের সার্বিক সচেতনতাই আমাদের প্রত্যাশা।
বলতে হয় 'জীবনের তটে জোয়ার-ভাটার ঢেউ'। এখন ভাটার টানের বাস্তবতা। ভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের কারণে বাংলাদেশের অবস্থা বরাবরই কিছুটা ভিন্ন। ভাষা থেকে ভূখন্ড চেতনা, জাতিচেতনা, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্খা এবং সেই আকাঙ্খার টানে বরাবরের মতোই 'একুশ' আসে স্বাদেশিকতা আর ভাষা ঐতিহ্য নিয়ে। আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্বরাজনীতি, কখনো কখনো পরাবাস্তবতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাংলার ভূ-খন্ডে- এর পাশাপাশি একুশে'র লেখনীগুলো ফি-বছরে নতুন মাত্রায়, নতুন বৈশিষ্ট্যে, নতুন আঙ্গিকে, প্রকরণ; বিষয়-নুতন চিন্তার বিকাশ, আবেগের বর্ষণের জলে ভিজিয়েছেন একুশ সিক্ত লেখক প্রজন্ম। রাজনীতির বিষয়াবলীকে শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার-পোষ্টার-ফেস্টুনে আকণ্ঠ শিল্পের গাঁথুনিতে গেঁথে মুগ্ধতার অলংকার পরিয়ে লেখনীকে শিল্পজাত উপাদান হিসেবে তুলে ধরে থাকেন তারা। 'একুশ' ও 'আমাদের লেখনী'যেন একই বৃন্তে দু'টি ফুল হয়ে যুগ-যুগান্তর বহতা সাথী।
©somewhere in net ltd.