![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, তখন এই স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিতে হত্যার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছিল শাসক গোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুর জন্য কারাগারের পাশে কবরও খোড়া হয়েছিল। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল এই ফাঁসির ভয় দেখিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সাথে আপোষ করতে বাধ্য করা, অপর দিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে পাকিস্তানীদের সাথে আপোষের পথে ফিরিয়ে নেয়া। তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের উদ্দ্যেশ্যে বলেছিলেন, 'ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা' যা বাংলা ও বাঙালি জাতির প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দেশপ্রেম ও এ জাতির পরিচয় ও অস্তিত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্য থেকে এ কথাই শুধু সত্য হয়ে দেখা দেয় যে, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে তিনি কতটুকু ভালোবাসতেন। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে তিনি কীভাবে নিজের মধ্যে ধারণ, লালন ও পালন করতেন। এ ছাড়া, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তাঁর ডাকে এদেশের মানুষ তখন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, প্রধানমন্ত্রী না হয়েও এদেশের মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু তখন ১৯শে মার্চ তারিখে 'জয়বাংলা' শ্লোগানের ব্যাখ্যার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি কলেমা পাঠের সাথে 'জয়বাংলা' উচ্চারণ করবেন।
ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মাতৃভূমি মক্কাকে কী রকম ভালোবাসতেন তা বোঝা গিয়েছিল যখন তিনি তাঁর শত্রুদের অত্যাচারে মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। আরবী ভাষায় বলা হয়, 'হোব্বুল ওয়াতানা মিনাল ঈমান', যার স্পষ্ট বাংলা হচ্ছে, 'দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ'। ইসলামের নবী গর্ব করে বলতেন তিনি একজন আরব, আরবী তাঁর মাতৃভাষা। বর্তমান সময়ের আরবরাও বলে থাকেন, তারা আগে আরব, তারপর মুসলমান। অর্থাৎ একজন মানুষের জাতিগত পরিচয় অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ ইচ্ছা করলে তার ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন-খ্রীষ্টান থেকে মুসলমান হতে পারেন, আবার মুসলমান থেকে কেউ খ্রীষ্টান বা হিন্দু থেকে মুসলমান হতে পারেন, এবং তা সময়ে সময়ে হচ্ছেও বিভিন্ন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায়। কিন্তু একজন মানুষ ইচ্ছা করলেই তার জাতিগত পরিচয় বদলাতে পারে না। যেমন-আরবী লোক ইচ্ছা করলেই হঠাৎ করে বাঙালি হতে পারবেন না, ইরানী, পাঞ্জাবী বা জার্মান হতে পারবেন না, কিন্তু ইচ্ছা করলেই সেই আরবী লোকটি ইহুদী বা খ্রীষ্টান অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারবে। প্রায় চারশ বছরেরও আগের মুসলিম কবি সৈয়দ সুলতানের একটি কবিতার লাইন এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, 'যারে যেই ভাষে প্রভু করেছেন সৃজন, সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন'। অর্থাৎ যেভাবেই বলি না কেন মানুষের জাতিগত পরিচয়ই বড় এবং কোনো মানুষ তার সেই জাতিগত পরিচয়কে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করে কখনো ধার্মিক হতে পারবে না। অথচ এই সত্যকে অস্বীকার করে আজও ইসলামের নামে কিছু কিছু ধর্মজীবী এদেশের মানুষকে ধর্মান্ধ করে রাখতে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি তথা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা পারলে এই বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালাকে নিষিদ্ধ (হারাম) ঘোষণা করতেন। ধর্মকে এরা নিজেদের ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ও জীবিকা তথা দুনিয়াদারির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন বলেই এমনটি হচ্ছে। অথচ এরা এই দেশেই বসবাস করছেন, খাচ্ছেন। আজকের দিনে তাই এই ধর্মজীবীদেরকে যখন বিজ্ঞানের সর্বশেষ আশীর্বাদ মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে দেখা যায় তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। কারণ, এক সময় এদেশে যখন বেতার (রেডিও)'র কার্যক্রম শুরু হয় তখন এরাই রেডিও'র অনুষ্ঠান শোনাকে পর্যন্ত গুণাহ্র কাজ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বাস করে, এর আলো-বাতাসে বড় হয়ে, এর স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে যখন কাউকে কাউকে তাদের বাঙালি পরিচয়ে গর্বিত হতে দেখা যায় না তখন তাকে দুঃখজনক ছাড়া আর কী বলা যায়?। যে জাতি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিশ্বে রক্ত দানের মতো ইতিহাসের অবতারণা করেছে, যে জাতির সূর্য সন্তানেরা অকাতরে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে জাতির লোকদের কারো কারো মধ্যে আজ দেখা যাচ্ছে, তারা খায় বাংলাদেশে, বাস করে এদেশের আলো-বাতাসে, কিন্তু গুরুত্ব দেয় বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতিকে। এরাই আকাশ সংস্কৃতির ভয়াবহ শিকার হয়ে তারা দেশীয় টিভির অনুষ্ঠান না দেখে ভারতীয় হিন্দী ও আজগুবি বাংলা অনুষ্ঠানের দিকে ধাবিত হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে নিজেকে ধন্য মনে করছে। সমাজের এই পরিস্থিতিকে হাক্কানী ভাবনায় তুলে ধরা হয়েছে এই ভাবে-'শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী, সংস্কৃতির নামে হিন্দী, বিপন্ন বাংলা'।
ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় ধর্মজীবী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের (যাদের প্রভু সেই ঘৃণ্য ইহুদী, এজিদী, সৌদী তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ) মিথ্যা প্রচারে তারা সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এমন অবস্থা সব সময়ই ছিল। তাইতো দেখা যায়, আজ থেকে প্রায় চারশ' বছর আগে বাংলার কবি আব্দুল হাকিম লিখেছিলেন,
'যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ণ জানি।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়
নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশ ণ যায়।'
আর বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলায় যখন নানামুখী আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে, তখন সাধক গুরুসদয় দত্ত বলেছিলেন, 'মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ, বিশ্বমানব হবি যদি তুই কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ।' এসব কথা ও কবিতায় স্পষ্টতই বোঝা যায়, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির শত্রুরা সবসময়ই সক্রিয় ছিল, তৎপর ছিল। যারা বলতে চেয়েছে, বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা, মুসলমানদের নয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপন হিন্দুদের সংস্কৃতি। আর এইসব কথা বলে এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষকে তারা ধর্মান্ধ বানিয়ে রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টাই চালিয়েছে শুধু। অথচ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, যারা ধর্মের নামে এসব কাজ করছে তারা পাশ্চাত্য তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়ণক হিসেবেই কাজ করছেন। কেউ হয়তো বিভ্রান্ত হয়ে, আবার কেউ বা সচেতনভাবে বিদেশি প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করছেন। এই বিদেশি প্রভুরা কখনো চায় বাংলার মানুষ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াক। তাই দেখা যায়, বিদেশি শক্তির এজেন্টরা যখন সমাজ ও দেশের হর্তা-কর্তা হয়েছে তখনই বাংলা নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা হুমকির মুখে পড়েছে। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ-১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে দেশ যখন পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় এজেন্ট রাজাকার-আলবদরও শান্তি কমিটির লোকদের হাতে ছিল তখন এদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়নি এবং এ সংক্রান্ত কোনো খবর সে সময়ের পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায় না।
এছাড়া, স্বাধীনতার ৪৩ বছরের এই সুদীর্ঘ সময়ে এদেশে কখনো কখনো ক্ষমতাসীন হয়েছে এমন অপশক্তি যাদের ছত্রচ্ছায়ায় বিদেশি এজেন্টরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এদেশের ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু মানুষদেরকে ধর্মান্ধ বানিয়ে চিরকালের জন্য পঙ্গু বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রও তারা চালিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে তারা রমনার বটমূলে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনে সবচেয়ে বড় মিলন মেলায় বোমা হামলা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা ও আহত করেছিল। বাঙালিরা যেন তাদের নববর্ষ উদযাপন করতে সাহস না পায়, সেই ভয়টুকু দেখানোই যে ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান লক্ষ্য সে কথা বুঝতে কোনো সচেতন বাঙালির অসুবিধা হয় না। কিন্তু এত সব বাধাবিঘ্নের পরও বাঙালিরা তাদের নববর্ষ উদযাপন করে চলেছে। দিন যতই যাচ্ছে, বাংলাদেশের বাঙালিরা ততই আবারও সচেতন হচ্ছে। নিজেদের উৎসব উদযাপনে তারা সচেতন হচ্ছে। বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ কথা ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই সমীচিন হবে না যে, আজকের দিনে কেউ বিশ্বমানব হতে হলে প্রথমেই তাকে মনে প্রাণে বাঙালি হতে হবে। ধর্মান্ধতা পরিহার করতে হবে, বিদেশি এজেন্টদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এদেশের মানুষ খাঁটি বাঙালি না হয়ে কোনোদিন ধার্মিক হতে পারবে না এ কথা আজ সম্যকভাবে উপলব্ধি করার সময় এসেছে। বাঙালিকে আজ মাথা উঁচু করে বলতে হবে - 'আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা'।
২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:১০
করিম বস বলেছেন: অতিব চমৎকার লিখনি ...খুব ভালো লাগল
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৫৮
জগ বলেছেন: বাংলা আমার দেশ নাকি ভাঁড়ত আমার দেশ?