নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন পাঠক। পড়তে ভালোবাসি। মাঝেমধ্যে একটু আধটু লিখার চেষ্টা করি। পড়ালেখা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফাইন্যান্স বিভাগে।

জাবির আহমেদ জুবেল

আমি জাবির আহমেদ জুবেল, একটু আধটুকু গল্প লিখি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে বিবিএ পড়ছি ( ব্যাচ ২৪)

জাবির আহমেদ জুবেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প : হাসি

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:১৭

গৌরিত্রার হাসি দেখলে মনে হবে সে শুধু মুখ দিয়ে হাসছে না, সর্বাঙ্গ দিয়ে হাসছে। এই বৃদ্ধ বয়সেও গৌরিত্রার হাসিতে মুগ্ধ হয়ে যায় অনিন্দ্য লোহারী। গৌরিত্রার আলকাতরার মতো কালো শরীরের বাহিরে যখন তার হলুদ হয়ে যাওয়া দাঁত বের হয় তখন অনিন্দ্যের বড্ড ভালো লাগে। অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও গৌরিত্রার সামনের কয়েকটা দাঁত বের হলেইও অনিন্দ্য লোহারীর সারাদিনের ক্লান্তি যেনো মুহুর্তেই চলে যায়। তখন তার কাছে মনে হয় জীবনটা অাসলেই সুন্দর। বয়স হলেও মনেহয় এ জীবনের সৌন্দর্য্য এখনও অনেক দেখার বাকি রয়েছে। তখন অারো অনেক বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। এখনো যৌবনের সেই দিনগুলোর মতো পাহাড়ে, চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে গৌরিত্রার হাত ধরে হাটতে ইচ্ছে করে। তবে তা কি এখন আর সম্ভব ? সেই দিন কি এখন আর আছে ? গৌরিত্রা এখন সারাদিন তালপাতার একটা চাটাইয়ে শুয়ে থাকে। তাঁর ডান পা সম্পূর্ণ অবশ। নানা অসুখে বিসুখে শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অথচ প্রাণশক্তির এতটুকুও কমতি নেই। দিনশেষে যখন অনিন্দ্য বাড়িতে ফেরে তখন কত চুটকিই না গৌরিত্রা বলে আর নিজেই খিলখিল করে হাসে। তাঁর হাসির চোটে সম্পূর্ণ দেহ অদ্ভুতভাবে নড়ে উঠে। অথচ অন্য সময় শরীর এদিক থেকে ওদিকে কাৎ করতেই তাঁর কত কষ্ট হয়। কে জানে হয়ত তাঁর হাসতেও প্রচন্ড কষ্ট হয় তবুও সে হাসে।
গৌরিত্রাকে খুশি করানোর জন্য মাঝেমাঝে অনিন্দ্যও হাসার চেষ্টা করে। তবে তা পারে না। পেটে যদি কোনো দানা না থাকে তখন কি কেউ হাসতে পারে ? পারে ! শুধু গৌরিত্রাই পারে। অসুস্থ শরীর নিয়ে, বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়েও হাসতে জানে। হাসিটাই যেনো ওর প্রাণ। ওর এই প্রাণে আরো উচ্ছ্বাস এনে দিতে কখনো কখনো অনিন্দ্য একটু হাসার চেষ্টা করে। তবে তাঁর হাসিটা খুবই করুণ লাগে। তার সকরুণ হাসি যেনো বিশ্ববাসীকে উপহাস করে বারবার তাদের নিষ্ঠুরতার কথা বলে যায়।
গৌরিত্রার একসময়ের কৃষ্ণদিঘির মতো চোখে হয়তো আজ ঝাঁপসা দেখে, সবসময় পিচুটি লেগে থাকে তবুও কি গৌরিত্রা অনিন্দ্য লোহারীর চোখের দৃষ্টির মানে বুঝতে পারে না? সে কি তার চোখের ভাষা পড়তে জানে না ? সবই জানে গৌরিত্রা। তাছাড়া গৌরিত্রা কি নিজেও এমন খিলখিলিয়ে হেসে জীবনের নিষ্ঠুরতার কথা নিজের কাছে , অনিন্দ্যের কাছে আড়াল করতে চায় না ?
গৌরিত্রা জানে অনিন্দ্য সারাদিন টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়ায়। কখনোবা গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের ব্যর্থ চেষ্টা করে। সারাদিনে কিছুই খায় না, শুধু ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি ছাড়া। সে এভাবে বাহিরে বাহিরে দিন কাটায় গৌরিত্রাকে এড়িয়ে চলার জন্য, নিজের অন্য আরেকটি সত্ত্বাকে এড়িয়ে চলার জন্য, নিজের অক্ষমতাকে নিজের সম্মুখে তুলে না ধরার জন্য। অনিন্দ্য ঘরে ফিরবে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে। কোনোকোনো দিন সে কোথাও হতে কিছু খাবার হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরবে, নয়তো খালি পেটে সারারাত স্বামী স্ত্রী পার করে দেয়। তখন কেউ খাবারের কথা একটি বারের জন্যও মুখে আনে না।
স্বামী ফিরলে গৌরিত্রাও যেনো প্রাণ ফিরে পায়। তখন সে কারণে অকারণে হাসে। সে ভাবে তার হাসিতে হয়তো অনিন্দ্য কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুঃখকে ভুলে থাকতে পারবে। তবে তাঁর হাসির এ অভ্যাসটা আজকের না, অনেকদিনের। প্রথম যৌবনে এমন হাসির জন্য গৌরিত্রা অনিন্দ্যের কাছ থেকে অনেক মারও খেয়েছে।
অাজ সারাদিন অনিন্দ্য লোহারী লাক্কাতুরা চা বাগানের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছে। এখন আর আগের মতো হাটতে পারে না অনিন্দ্য। কিছু সময় একটানা হাটার পরই পা ঝিনঝিন করা শুরু হয়ে যায়। তখন কিছুসময় বসে থাকতে হয়।
অপরূপ সৌন্দর্য্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তা এই লাক্কাতুরা বাগানকে গড়ে দিয়েছেন। কখনো অালাদাভাবে, সচেতন মনে লাক্কাতুরার সৌন্দর্য্য অনুভুব করে নি অনিন্দ্য। কিন্তু এখন সে এর সৌন্দর্য্যকে অনুভব করে। এর বাগানের চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাটতে হাটতে তার মনে পরে পুরোনো দিনের কথা। সারাদিন চা ফ্যাক্টরিতে কাজ করার পর প্রায় দিনই অনিন্দ্য আর গৌরিত্রা একসাথে হাটত। কখনোবা একজন অন্যজনের হাত ধরে হাটত। হাটতে হাটতে ওরা চলে যেত অনেকদূর, বাগানের গহীনে একটা ঝর্ণা আছে। ঠিক ঝর্ণা না টিলা বেয়ে আসা একটি পানির নালা। ক্লান্ত হয়ে সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রাণভরে পানি পান করত। অনিন্দ্য যখন আঁজলা ভরে পানি পান করত তখন তাঁকে বড় বিশ্রী দেখাত। তা দেখে গৌরিত্রা খুব হাসত। তখন অনিন্দ্য হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই মারার জন্য দৌড়ে গৌরিত্রাকে ধরার চেষ্টা করত। কিন্তু চিমচিমে গড়নের গৌরিত্রার সাথে সে দৌড়ে পেরে উঠত না।
আজ দুপুর পেরিয়ে গেলে হাটতে হাটতে একসময় দেখা হয় রঞ্জন লোহারীর সাথে। অনিন্দ্যের থেকে বছর সাতেকের ছোট রঞ্জন। দেখতে এখনো বেশ! কাজও করতে পারে।আজ থেকে দু বছর আগে তার জীবনেও এসেছিল অন্ধকার। তবে সে এখনো বেশ ভালো আছে। কাজ করার সামর্থ্য আছে তাই এখনো বাগানে কাজ করে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে পারে। যা অনিন্দ্য পারে না। দু বছর আগে তাঁর জীবন শেষ হয়ে গেছে। যদিও বেঁচে আছে তবুও কোনো কাজ করতে পারে না, সে শক্তি তাঁর নেই।
রঞ্জনের হাতে ছিল একটা দেশি মদের বোতল। সেখান থেকেই অনেকদিন পর দু'ঢোক মদ খায় অনিন্দ্য। খেয়ে শরীরটা কেমন যেনো অবশ হয়ে আসে, চোখে ঘুম পায়। সেই সাথে মনটাও অনেক বিষণ্ণ্য হয়ে উঠে। হৃদয়টা কিছু একটা পাওয়ার জন্য হাহাকার করে উঠে। একে অনেকদিন ধরে ঠিকমতো খায় নি আবার মদও মদও অনেকদিন পরে খেয়েছে সেজন্যই তার শরীরটা কেমন করছিল। তাই ফাল্গুনের দক্ষিণা বাতাসে গাছের ছায়ায় অনেক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যের আগে আগে।
তালপাতার চাটাইয়ে একটি তেল চিটচটে বালিশের ওপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে মুড়ি খাচ্ছে গৌরিত্রা। তার পাশেই বসে মুড়ি খাচ্ছে অনিন্দ্য লোহারী। আজ তিনদিনে পানি ছাড়া কোনো খাবার পড়ল অনিন্দ্যের পেটে।
মুড়ি দিয়ে গেছে হরিৎ খ্রিষ্টানের বৌ। মেয়েটা বড্ড ভালো। প্রায়ই গৌরিত্রাকে এটা সেটা এনে দেয়। বড় দুখিনী মেয়ে। সংগ্রামের সময় পাঞ্জাবিদের হাতে নিজের সবাইকে হারিয়েছে। এক স্বামী ছাড়া এ জগতে কেউ তার বেঁচে নেই। দুই ছেলে, শশুড় শাশুড়ি, নিজের বাবা আর ভাইকে মিলিটারিরা ক্রসফায়ার করে মারে। ভগবানের কৃপায় স্বামী হরিৎ কিভাবে যেনো নরপশুদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। নয়ত সেদিন তার প্রাণটাও যেত। আর হরিৎ খ্রিষ্টানের বৌ নিজে ? সে নিজেও যে কতবার ঐ পিশাচদের হাতে কতবার প্রাণ হারিয়েছে তার হিসাব নেই, শুধু একটা দেহ নিয়েই বেঁচে আছে।
মুড়ি চিবোতে চিবোতে অনিন্দ্যের মনে পড়ে কিছুদিন আগের কথা। কত ভয়াবহ ছিল সে দিনগুলো। তাঁর চোখে ভাসে তাঁদের ছুটাছুটির কথা, এ বাগান থেকে ঐ বাগানে প্রাণ বাচাঁনোর জন্য আশ্রয় নেওয়ার কথা। অনিন্দ্যের আজকে খুব মনে পড়ে তার তিন জোয়ান মরদ ছেলেগুলোর কথা। ওরা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আর অনিন্দ্যের একমুঠো খাবারের জন্য এমন কষ্ট হত না। আর গৌরিত্রাকেও হয়ত এভাবে এক পা অবশ।হয়ে চাটাইয়ে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।
রাত্রে কলোনির সবাই যখন ঘুমিয়ে পরে, চারপাশে বিরাজ করে থমথমে নিস্তব্ধত তখন অনিন্দ্যের কানে ভেসে আসে তার ষোড়শী মেয়ে সর্বাণী লোহারীর অাত্মচিৎকার। কি জানি হয়তো গৌরিত্রাও সে চিৎকার শুনতে পায়। তবে কেউ তাঁরা সে ব্যাপারে কথা বলে না। সারারাত দুজনেরই নির্ঘুম কাটে। সেই চিৎকারের আজ দুটি বছর পেরিয়ে গেছে। এতদিনে এখনো কিছুই ঠিক হয়নি। বাগানের হাসপাতাল কিংবা বড় সাহেবের পুড়ে যাওয়া অফিস ঘর কোনো কিছুই ঠিক হয়নি। আর যাদের বেঁচে থাকার মেরুদণ্ডটা ভেঙে তাঁদের ? তাঁদের জীবনও এখনো ঠিক হয়নি। জীবন মৃত্যু মাঝখানে দাড়িয়ে ওরা মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় অনিন্দ্য লোহারী। কিভাবে যেন মরে গিয়েও বেঁচে গেল। অথচ এই বেঁচে থাকার কোনোই মূল্য নেই। আছে শুধু আক্ষেপ।
আকস্মাৎ অনিন্দ্য জোরে জোরে হেসে উঠল ! তার হাসির সাথে সাথে তাঁর মুখ থেকে একটা বোটকা গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তার হাসি আরো বেড়ে গেল। এমনটা অন্যকোনো সময় করেনা অনিন্দ্য।
দুঃখের কথা, দুঃসময়ের কথা ভাববার কোনো মানে নেই। বেঁচে থাকতে হলে তাকে আর পুরোনো দিনের কথা মনে করে কাঁদলে চলবে না। কেউ কেউ চলে গেছে বহুদূরে তাই ভেবে দুঃখ করে বেঁচে থাকা যায় না। জীবন এমনই। জীবনের সার চোখের জলের মধ্যে। অনিন্দ্যকেও বেঁচে থাকতে হবে প্রিয়জনকে নিয়ে যতদিন বাঁচা যায়। সে আরো জোরে জোরে হাসে। হাসতে হাসতে একসময় চাটাইয়ের উপর আলগুছে শুয়ে পড়ে।
এ দৃশ্য দেখে গৌরিত্রা অবাক হয়ে যায়। এ দৃশ্য কি সে কল্পনায় দেখে নি অনেকবার ? দেখেছে তো, তার স্বামীও এমনভাবে হাসবে। গৌরিত্রাও হাসতে শুরু করে দেয়। বেঁচে থাকলে ওরা হেসে হেসেই বাঁচবে! আর কখনো কাঁদবে না, নিরবে নিবৃতেও না। দুজনেই খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। প্রদীপের অাবছা অালোয় ঘরময় এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বড় বিচিত্র এ পরিবেশ।
--------------------------------------------------------
খাদিমপাড়া, সিলেট।
০৫.০৯.২০১৬ খ্রি.

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:১১

অপ্‌সরা বলেছেন: একদম প্রিয়তে!!!!!

অনেক ভালোলাগা ভাইয়া!!!!!!:)

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৫২

জাবির আহমেদ জুবেল বলেছেন: ধন্যবাদ আপু।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.