নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবি গোলাম মোস্তফা ‘বনভোজন’ নামে একটি মজার কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি একসময় স্কুলপাঠ্য ছিলো। কবিতাটি এরকম-
নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছে ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
বাপমা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে,
বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে।
বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে,
ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে।
কেউবা বসে হলদি বাটে কেউবা রাঁধে ভাত,
কেউবা বলে দুত্তুরি ছাই পুড়েই গেলো হাত।
বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা’
তবুও সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা।
কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন,
অকারণে বারে বারে হেসেইবা কেউ খুন।
রান্না তাদের শেষ হল যেই গিন্নী হলো নুরু,
এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু।
ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়ে সবাই, বলে-বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।
এ রকমের মিছিমিছি বনভোজনে এখনো ছোট ছেলেমেয়েরা মেতে ওঠে। বনভোজনের আরেকটা নাম চড়ুইভাতি বা চড়িভাতি। ইংরেজী শব্দ পিননিকও বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত। গ্রামের ছেলেমেয়েরা হেমন্তের শেষে চড়ুইভাতিতে মেতে উঠতো একসময়। ধান কাটার পরে জমিতে পড়ে থাকা ধান, এর ওর জমি থেকে শীতের শাকসবজি তুলে আনতো একদল। আরেক দল ছুটতো মাছ ধরতে। ভাগ্য খুব ভালো হলে বাড়িতে পালা মুরগির বাচ্চা জুটতো। এর ঘর থেকে তেল, ওর ঘর থেকে নুন, আর কারো ঘর থেকে বাটামসলা জড়ো করে বাড়ির পেছনে বা সামনে গাছের নিচে চুলো বানিয়ে ছোটরাই রান্নাবান্না করতো। সেই রান্না শেষ করে খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে যেতো। ক্ষুধার তীব্রতার কারণে প্রায় অখাদ্য রান্নাই অমৃতজ্ঞান করে সবাই খেতো। সেই চড়ুইভাতির মূল উপভোগ্য ছিলো আনন্দ। আমাদের অনেকের শৈশবে এই চড়ুইভাতিই ছিলো বিনোদনের উৎস।
কবে থেকে শুরু
আমাদের দেশে বা এই উপমহাদেশে কবে থেকে বনভোজন বা চড়ুইভাতি শুরু হলো তার ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে এটা ইংরেজরা আসার পরের ঘটনা বলেই অনুমান করা যায়। বিশ্বে কবে থেকে বনভোজন শুরু হয়েছে সেটা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ গুণীর মত হচ্ছে বনভোজন বা পিকনিক শুরু করেছেন ফরাসিরা। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের পর রাজউদ্যানগুলো সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেবার পরই সেখানে পিকনিক করার প্রথা জনপ্রিয় হয়। পিকনিক (pique-nique)শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় টনি উইলিসের “Originies de la Langue Française de Mènage”- গ্রন্থের ১৬৯২ সংস্করণে, যেখানে পিকনিক অর্থ “a group of people dining in a restaurant who brought their own wine”। Walter W. Skeat এর “A Concise Etymological Dictionary of the English Language” (১৮৮৮)- এ একই তথ্য পাওয়া যায়। এতে আরো বলা হয়েছে, শব্দটি সুইডিশ ভাষায় প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। অনুমান করা হয়, শব্দটি কথ্য গ্রীক থেকে নেয়া হয়েছে এবং ইংরেজি Pic শব্দটি নেয়া হয়েছে কথ্য শব্দ peck (খুঁটে খাওয়া) বা peckish (ক্ষুধার্ত/খিটখিটে) থেকে এবং Nic শব্দটি নেয়া হয়েছে কথ্য শব্দ knick (তুচ্ছ বা মূল্যহীন বস্তু) থেকে। অন্যদিকে Robert Hendrickson এর “The Facts on File Encyclopedia of Word and Phrase Origin” - এ উল্লেখ করা হয়েছে পিকনিক শব্দটি ইংরেজিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে Lord Chesterfield’s Letters গ্রন্থে। Oxford English Dictionary (2nd edition, volume XI, p. 779)-এ উল্লেখ করা হয়, a fashionable social entertainment in which each person present contributed a share of the provisions;” সেখানে এর উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য জানা যায় না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমাদের দেশ বা এ উপমহাদেশে কবে থেকে বনভোজন বা চড়ুইভাতি/চড়িভাতি হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত শ্রীকেশবচন্দ্র রায় কর্ম্মকার সংগৃহীত অভিধান‘শব্দার্থ প্রকাশিকা’তে বনভোজন বা চড়ুইভাতি কোনটিরই উল্লেখ নেই। সুবল চন্দ্র মিত্রের‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’(১৯০৬)-এ চড়ুইভাতি এবং বনভোজন দুটি শব্দই আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’(১৯১৭)-এ চড়ুইভাতি শব্দটি আছে। এতে বনভোজন শব্দটি চড়ুইভাতির অর্থ হিসাবে আছে, আলাদা ভুক্তি হিসাবে নেই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’(১৯৩২)-এ দুটি শব্দই আছে। তিনটি অভিধানেই Picnic শব্দটি বনভোজনের অর্থ বা প্রতিশব্দ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বনভোজন ও চড়ুইভাতি শব্দ দুটি সংস্কৃত হতে এসেছে এটুকুই বলা হয়েছে, কিন্তু এর কোন ইতিহাস উল্লেখ করা হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে শব্দমঞ্জুরী নামে একটি অভিধানে শুধু ‘অ’ আদ্যক্ষরের শব্দ অন্তর্ভুক্ত করেন। এর পাশাপাশি ‘শব্দসংগ্রহ’ (প্রকাশকাল উল্লেখ করা হয়নি) নামে একটি গ্রন্থে বাংলা শব্দের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। এতে ‘চড়ুইভাতি’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হলেও বনভোজন শব্দটি নেই। বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ‘চড়িভাতি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে (দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক)। বিদ্যাসাগর চড়ুইভাতি ব্যবহার করেন ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। বনভোজন শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে (আজ আমাদের বনভোজন)। শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক সঙ্কলিত ও প্রকাশিত ‘বিশ্বকোষ’ সপ্তদশ ভাগে (১৯০৭) বনভোজনকে দেশান্তরের প্রথা বলে উল্লেখ করেন (ইংরেজিতে Pic-nic)। কিন্তু পাশাপাশি বলেছেন, ‘আমাদের দেশেও বনভোজন শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রচলিত। বভোজন---পুণ্যাহ-বচন-প্রয়োগ এবং বনভোজন-বিধি গ্রন্থ পাঠ করিলে উহার বিশেষত্ব জানিতে পারা যায়।’ এতে মনে হচ্ছে, বনভোজন একটি ধর্মীয় আচার হিসেবে এ উপমহাদেশে আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো। এ প্রসঙ্গে তিনি ওলাবিবির পূজা দিয়ে বনভোজন করার প্রথা প্রচলিত আছে বলেও উল্লেখ করেছেন।
ড. নারায়নচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘মৌর্য্যযুগের ভারতীয় সমাজ’ (১৯৪৫) গ্রন্থে সরাসরি বনভোজন বা চড়ুইভাতির সাথে তুলনা করা যায় এমন কোন প্রথার উল্লেখ না থাকলেও কিছ অনুষ্ঠানের, বিশেষতঃ ধর্মীয় আচারের কথা আছে যার সাথে বনভোজনের কিছু মিল পাওয়া যায়।এর একটি হচ্ছে ‘উৎসব বা সমাজের অধিবেশন’। সমাজের প্রাথমিক উদ্দেশ্য পূজা হলেও পরে সেগুলো আমোদের স্থান হয়ে ওঠে। জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য, মহাভারত ও হরিবংশে সমাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। ড. নারায়নচন্দ্রের মতে,‘সমাজগুলি যে মদ্যপান, নৃত্যগীতাদি, ইন্দ্রজাল বা দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের স্থান ছিল, তাহা শিগালোবাদসূত্তন্ত হইতে জানা যায়। আবার অশোকের একটি অনুশাসন হইতে বুঝা যায় যে সমাজগুলিতে পশুবধ, মদ্যপান ও মাংসভোজন চলিত।’ আরেকটি অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘সমাপানক’। সমাপানক কোনো স্থান বা বাড়িতে অনুষ্ঠিত হতো। এ প্রসঙ্গে ড. নারায়নচন্দ্র বলেন,‘সমাপানক শব্দটি অর্থশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় নাই। তবে বাৎসায়নে উহার উল্লেখ ও বর্ণনা আছে। সেখানে নানা প্রকার মধু. মৈরেয়, আসব ও সুরা ব্যবহৃত হইত। সঙ্গে বোধ হয় খাদ্যাদির ব্যবস্থা থাকিত।’
বনভূজি-এক অন্য পিকনিক
মৃণাল মাহাতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জঙ্গলমহলের (বীরভূম, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদেনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও ছোটোনাগপুর মালভূমির বন ও পর্বতময় অংশ) গ্রামগুলিতে আদিবাসী কুরমি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত বনভুজি নামক পিকনিকের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রচলিত পিকনিকের সাথে এর কিছু পার্থক্য আছে। প্রথমত, বনভুজিতে কোন চাঁদা তোলা হয় না। যে যার সাধ্যমতো আয়োজন করেন। দ্বিতীয়ত, যে কোন ধরণের নেশা নিষিদ্ধ। মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহৃত হয় না। মহিলারা সবশেষে বাড়ি ফেরার আগে নিজেরা ঝুমুর গান গেয়ে নাচ করেন। তৃতীয়ত, বনভুজির সাথে একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িত। যে দিন বনভুজিতে যান মহিলারা সেদিন ওই পাড়া বা গ্রামের প্রতিটিবাড়ি গোবরজল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। বাড়িতে উনুন জ্বলে না।
হাঁড়ি-কড়া, চাল-ডাল সব বনভুজির নির্ধারিত স্থানে বয়ে নিয়ে আসা হয়। শুদ্ধবস্ত্রে উপবাস থেকে অস্থায়ী উনুনে আগুন জ্বালান মহিলারা। রান্না শেষ হলে সব ক’টি পদ বনদেবীর নামে আগে সমর্পণকরা হয়। তারপর বাড়ির সবাই খাওয়া দাওয়া করেন। যার যা রান্না হয় তা উপস্থিত সবার মধ্যে পরিবেশন করা হয়। বাড়তি খাবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় না।
ধারণা করা হয়, বনভোজন থেকে বনভুজি কথাটা এসেছে। যদিও এর প্রাচীন নাম ডিবুভাত। অতীতের অরণ্যচারী গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনকে স্মরণ করার জন্য আদিবাসী কুরমিরা একদিনের জন্য ঘর সংসারকে তুলে আনেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। এর সম্পূর্ণ কর্র্তৃত্ব থাকে মহিলাদের হাতে। পহেলা মাঘ থেকে এক মাস ধরে করা যায় ডিবুভাত। পুরুলিয়াতে পৌষ মাসেও করা হয়। যে কোন মঙ্গলবার বা শনিবার দেখে করা হয় ডিবুভাত। সেদিন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা যাবে না। কথিত আছে, শেয়ালের ডাক না শুনলে বাড়ি ফেরা নিষিদ্ধ। বনভুজির জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হয় পাহাড় বা ডুংরির ঢাল, জঙ্গলের ধার, ফাঁকা মাঠ, নদীর তীর বা শাল-পলাশ বন। বনভুজির পেছনে যা কিছুই কিংবদন্তি থাক না কেন, মূল উদ্দেশ্য হল সংসারের এক ঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি পাবার জন্য নির্মল আনন্দে মেতে ওঠা।
পিকনিক আর বনভোজনের তুলনা
পাশ্চাত্যে পিকনিক হয় সাধারণত গ্রীষ্মকালে (summer) অর্থাৎ জুন জুলাই মাসে আর আমাদের দেশে বনভোজনের মৌসুম হলো শীতকাল। আসলে তাদের গ্রীষ্ম আর আমাদের শীতের সময়ের তাপমাত্রা কাছাকাছি। বনভোজনের আনন্দকে পূর্ণতা দেয় আরামদায়ক আবহাওয়া। পিকনিকের আয়োজন করা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কোন স্থানে ( পার্ক, নদীতীর, লেকের ধারে, পাহাড়ের পাদদেশে ইত্যাদি)। পাশ্চাত্যের শহরগুলোতে নাগরিকদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিশাল সব পার্ক বা উদ্যান থাকে। তাদের পিকনিক বেশিরভাগ সময় সেখানেই হয়। আমাদের দেশে তেমন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তাই শহর থেকে দূরে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পট। বেশিরভাগ বনভোজন হয় সেগুলোতেই। এ ছাড়া কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, সিলেট বা চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়ও বনভোজন হয়।
পাশ্চাত্যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে সবার অংশগ্রহণে বাড়ির বাইরে গিয়ে পিকনিক করা বেশি জনপ্রিয় হয়। পারিবারিক পিকনিকের পাশাপাশি বড় পরিসরের পিকনিকও (কোম্পানি পিকনিক বা চার্চ পিকনিক) হতো। সেখানে খেলাধুলা আর গানবাজনাসহ নানা আনন্দ আয়োজন থাকে। প্রিয়জনের সাথে রোমান্টিক পিকনিকের সংবাদও পাওয়া যায়। এখন যে পিকনিক আমেরিকায় বেশি জনপ্রিয় তার নাম potluck , এতে পিকনিকে অংশ নেয়া সবাই খাবারের একেকটা পদ রান্না করে সাথে নিয়ে আসেন। পার্কে বসে সবার আনা খাবার সবাই ভাগাভাগি করে খান। আমাদের দেশেও পারিবারিকভাবে বা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ছোট পরিসরে পিকনিক হয়। তবে এখনকার পিকনিকগুলো হচ্ছে বড় পরিসরে-অফিস, কোম্পানি, সমিতি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক। অনেকগুলো বাস ভাড়া নিয়ে হৈচৈ করতে করতে অনেক দূরে গিয়ে সবাই পিকনিক করেন।
আমাদের বনভোজনের স্বাতন্ত্র্য
আমাদের এখনকার বনভোজনে পাশ্চাত্যের প্রভাব থাকলেও কিছু স্বাতন্ত্র্যও আছে। ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির কাছে যে চড়ুইভাতি করে সেটা একেবারেই আমাদের নিজস্ব ঘরানার পিকনিক। বড় পরিসরের বা ছোটখাট পিকনিক আমরা যেভাবে গাড়ি ভাড়া করে অনেক দূরে গিয়ে ( কখনো ২/৩ দিন সময় নিয়ে) করি এটাও আমাদের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে। এ ছাড়া ধর্মীয় আচার হিসাবে পিকনিক করাও একটি স্বতন্ত্র ঘরানা।
আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবস
প্রতি বছর ১৮ জুন পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবস’। কোনো কোনো বনভোজন দিবসের থিমও থাকে। ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবসের থিম ছিল, ‘Heart of Our Community’। এ দিবস পালন কবে থেকে হচ্ছে বা কারা এটা শুরু করেছেন সেটাও অজ্ঞাত। কেউ বলেন এটাও ফরাসীরাই শুরু করেছেন। কেউ বলেন এটা রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে বৃটেন থেকে শুরু হয়েছে। এ দিবসটি নানা উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এ উপলক্ষে বনভোজনের আয়োজনও করা হয়। বিশেষ দিনে পিকনিক করার প্রথাও আছে। যেমন আমেরিকায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পিকনিকের আয়োজন করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরিতে ‘জাতীয় পিকনিক দিবস’ পালিত হয়। তারা সেটা পালন করেন আগস্ট মাসের প্রথম সোমবার। সে হিসাবে গত বছর পিকনিক দিবস পালিত হয়েছিল ৬ আগস্ট, ২০১৯ সালে পালিত হয় ৫ আগস্ট। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে ১৪ থেকে ২৫ জুন জাতীয় পিকনিক সপ্তাহ পালিত হয়েছে।
শিল্প সাহিত্যে বনভোজন
বনভোজন মানুষের অন্তরে কতোটা প্রভাব ফেলেছে তার প্রমান মেলে বনভোজন নিয়ে শিল্প সাহিত্যের চর্চায়। ১৭২৩ সালে François Lemoyne এর আঁকা ছবি Hunt Picnic, ১৮৬০ সালে Thomas Cole এর আঁকা ‘The Picnic’ এবং ১৮৬২ সালে বিশ্বখ্যাত পোস্ট ইস্প্রেসনিস্ট শিল্পী এদুয়ার মানে (Édouard Manet) এর আঁকা ’ঘাসের বুকে মধ্যাহ্নভোজ’ (Le déjeuner sur l'herbe /The Luncheon on the Grass) ধ্রুপদী চিত্রকর্মের মর্যাদা পেয়েছে।
William Inge এর পুলিৎজার পুরস্কারবিজয়ী নাটক ’পিকনিক’ অবলম্বনে ১৯৫৫ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘পিকনিক’ একাধিক বিভাগে অস্কার পুরস্কার লাভ করেছে। ১৯৮৬ ও ২০০০ সালে চলচ্চিত্রটি পুনর্নির্মিত হয়। Tom Cowan ১৯৭২ সালে নির্মান করেন The Office Picnic, ১৯৭৫ সালে Peter Weir নির্মান করেন Picnic at Hanging Rock, ১৯৯৩ সালে নানা বয়সী ৯ জন ভারতীয় নারীর রোমাঞ্চকর পিকনিক নিয়ে নির্মান করা হয় Bhaji on the Beach (এটি জার্মান ভাষায় পুনর্নিমিত হয়), ২০০২ সালে জঙ্গলে গিয়ে পিকনিক করার কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয় Blissfully Yours নামক চলচ্চিত্র। এএমসি টেলিভিশনের জনপ্রিয় সিরিজ Mad Men এর অনেকগুলো পর্ব নির্মিত হয়েছে বনভোজন নিয়ে।
Fernando Arrabal এর উপন্যাস Picnic in the Field রচিত হয়েছে বনভোজন নিয়ে। Jane Austen এর বিশ্বখ্যাত উপন্যাস Emma, Charles Dickens এর উপন্যাস The Mystery of Edwin Drood এবং Kenneth Grahame এর উপন্যাস The Wind in the Willows এ বনভোজনের উল্লেখ আছে। এ ছাড়া বনভোজন নিয়ে ১৯৭২ লেখা Boris and Arkady Strugatsky অবলম্বনে ১৯৭৯ জনপ্রিয় চলচ্চিত্র Roadside Picnic নির্মান করেন পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভোস্কি এবং Felice Benuzzi রচনা করেন উপন্যাস No Picnic on Mount Kenya।
মার্কিন গীতিকার John Walter Bratton ১৯০৬ সালে "The Teddy Bear Two Step" শিরোনামে একটি গান রচনা করেন। ১৯০৮ সালে এর শিরোনাম হয় "Teddy Bears’ Picnic"। গানটিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গীতিকার শব্দ ও সুর বদল করেন, ফলে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। গীতিকার Laura Nyro এর "Stone Soul Picnic" শিরোনামের গানটি (১৯৬৮) গেয়ে ব্যান্ড দল “Stone Soul Picnic” ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সব শেষে বাংলা সাহিত্য থেকে একটি লেখা স্মরণ করছি। আবদার রশীদ লিখেছেন ’চড়ুইভাতি’ নামের এই মজার ছড়াটি-
চড়ুইভাতির পাশেই নদীর কূল ছিল,
আনন্দে তাই সবার গলাই খুলছিল।
ফুর্তিতে, খোশ গল্পেতে মশগুল ছিল,
মাথায় তাদের হাল ফ্যাশনের চুল ছিল।
জনাচারেক আলুর খোসা ছুলছিল,
গলায় তাদের রুমাল কি টাই ঝুলছিল।
দলের সাথে তিনঠেঙে এক টুল ছিল,
সেটায় বসে দলের নেতা ঢুলছিল।
আরো ক’জন বালতিতে জল তুলছিল
জল তোলাতেও অনেক হুলস্থুল ছিল,
কেউবা গাছে দোলনা ছাড়াই দুলছিল,
খানিক দূরে খালের ওপর পুল ছিল
সেই খানে এক ডালিম গাছে ফুল ছিল,
ডালিম গাছের মগডালে বুলবুল ছিল।
সবাই তখন বাড়ির কথা ভুলছিল,
চড়ুইভাতির আনন্দটাই মূল ছিল।
জানতো না কেউ কোথায় যে ভীমরুল ছিল,
কামড় খেয়ে বুঝলো, তাদের হুল ছিল।
২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৪৮
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
২| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:০২
ইসমত বলেছেন: ১টা টাইপো আছে ২১০৬ নয় হবে ২০১৬।
ছেলেবেলায় সায়েন্স ল্যাবরেটরী কোয়ার্টারে থাকতাম, সেখানে এই ডিসেম্বরে স্কুল ফাইনালের পর মা-খালাদের শাড়ি ঘিরে বন্ধুরা মিলে এইভাবেই পিকনিক করতাম। বহু দিন পর আজ মনে করিয়ে দিলেন।
২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫১
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: ধন্যবাদ। সংশোধন করে দিয়েছি।
আমরা ছোটবেলায় গ্রামে পিকনিক করেছি।
ভালো থাকবেন।
৩| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:২৩
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: দারুন একটা পোস্ট
ধন্যবাদ আপনাকে
২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫২
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। আজকের অনুষ্ঠান নিয়ে ছবিপোস্ট হয়ে যাক একটা।
৪| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:০৫
জগতারন বলেছেন:
তথ্যবহুল পোষ্ট।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫২
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: পাঠ এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
৫| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৩৩
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনিও ভালো থাকবেন।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫২
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: ধন্যবাদ।
৬| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:১৪
স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:
বনভোজন আর পিকনিকের মধ্যেও যে এতো কিছু আছে !! অনেক কিছু জানতে পারলাম স্যার। তথ্যবহুল পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
কাল দেখা হয়ে ভালো লাগলো। চমৎকার একটা সময়।
৭| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৪
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। ব্লগ ডে'র অনুষ্ঠানে চমৎকার সময় কাটলো।
৮| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:২৬
আরজু পনি বলেছেন: অসাধারণ পোস্ট!
অনেক কিছু জানা হলো।
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৯
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
৯| ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:২৬
জুল ভার্ন বলেছেন: তোমার লেখা পড়া মানেই অনেক কিছু জানা, জ্ঞানের ভাণ্ডারে আরো কিছু সঞ্চিত করা।
ভালো লাগা অফুরান।
০৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪৫
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: কি যে বলেন ভাইয়া ! আপনাকে ফিরে পেয়ে কী যে আনন্দ লাগছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। ভালো থাকবেন ভাইয়া।
১০| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:১৭
শের শায়রী বলেছেন: এতো দারুন একটা পোষ্ট কিভাবে আমার নজর এড়িয়ে গেল ভাবছি। পাশাপাশি দেখলাম আপনি শায়রীর ও সমাজদার। সামনে থেকে আপনার পোষ্ট আর মিস যাবে না আশা রাখি। আপনি অনুসারিত।
১১| ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:০৭
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। উর্দু থেকে শের বাংলায় অনুবাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যের পাশাপশি শের'কে ফর্ম হিসাবে ব্যবহার করে বাংলায় মৌলিক শের রচনার সিলসিলাও পুরনো। আমি বাংলায় শের রচনা করছি সেই ঐতিহ্যের অনুসরনে। বাংলায় রুবাইও লিখেছি। বই করেছি রুবাইয়ের। আমার ব্লগবাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১৯
রাজীব নুর বলেছেন: পিকনিক আর বনভোজন নিয়ে অনেক কিছু জানলাম।