নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন সুন্দর করে সাজাও । আমি নারী তাই কথাও বলি নারীদের নিয়ে।

কামরুননাহার কলি

আমার নাম কামরুননাহার কলি, আমি একজন ভার্সিটির ছাত্রী। আমার সখ লেখালেখি আর বই পড়া। আমি দেশকে ভালোবাসি, ভালোবাসি দেশের মানুষদের।

কামরুননাহার কলি › বিস্তারিত পোস্টঃ

“সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস”

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১২:১১

২৩ আগস্ট, ২০১৯, শু্ক্রবার ঘুড়ে এলাম শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্যে “সোনারগাঁও পানাম সিটি, সোনারগাঁও যাদুঘর, জিন্দাপার্ক এলাকার শাপলা বিল আর জঙ্গল বাড়ির এলাকা”। সাথে ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় হাসান-আল- জোবায়ের রনি স্যার সহ আরো তিনজন স্যার ম্যাডাম। তাদের প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞ জানাই। কারণ তারা আমাকে এতো সুন্দর একটি আকর্ষনীয় স্থানে নিয়েছেন। আগে কখনো এই ভাবে শিক্ষাসফর বা ঘুড়তে যাওয়া উয়ে উঠেনি। তাই এটি ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

আমাদের তিন শিক্ষক মাঝের স্যার হলেন ইউএস বাংলার পাইলট

এবারের শিক্ষাসফর-২০১৯ “গ্রনী ইউনিভাসির্টি অব বাংলাদেশ” সম্মানিত স্যারেরা আমাদের ক্যাম্পাস থেকে দু’তিন ব্যাচের, এই প্রায় দু’শত এর মতো শিক্ষার্থীদের নিয়ে সোনারগাঁও পানাম সিটির উদ্দেশ্যে গিয়েছেন। প্রথমতো আমরা আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পাস মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাস পূর্বাচালে চলে যাই। সেখানে যেয়ে সবাই গাড়ী থেকে নেমে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। একটু সুযোগে স্যারদের নিয়ে সবাই মিলে ছবি তুললাম।


সবাইকে নিয়ে স্যার সেলফি তুলছেন

স্থায়ী ক্যাম্পাস

এরপর গাড়ী ছেড়ে দিলো, পূর্বাচাল থেকে সোনারগাঁও পানাম সিটির উদ্দেশ্যে। পূর্বাচালের রাস্তাগুলো বেশ মুগ্ধ করা। কারণ মনোরম, জ্যামবিহীন আর চারপাশ গাছ-পালা ঘেরা, আদূরে বিল-ঝিল ঢাকার শহরের এই ধরনের রাস্তা-ঘাট নেই বললেই চলে। আমি গাড়িতে বসলে সবসময় জানালার পাশেই বসি। কেনোনা জানালা ছাড়া আমার একদম চলে না। বসে বসে আমি মুগ্ধ হয়ে চারপাশটাই উপভোগ করলাম। আর ভাবছি কখনো যাবে, সেই স্বপ্নের পানাম সিটিতে। না জানি ওখানে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।

চলেও আসলাম আমার স্বপ্নের পানাম সিটিতে। ১ ঘণ্টার যাত্রাপথ শেষ করে পা রাখলাম স্বপ্নের পানাম সিটিতে। পানাম সিটির মাটিতে যখন পা রাখলাম তখন মনে হলো এটা বিষন অদ্ভুত একটি শতাব্দী। গেটের সামনেই চোখে পড়লো একটি বড় আকারের বই। যা ইট-বালু আর সিমেন্ট দিয়ে বাধাঁই করা। যাতে লেখা আছে এই পানাম সিটির ইতিহাস।

খোদাই করা ইট পাথরের বাঁধাই করা বই

স্বপ্নের পানাম সিটি:
পানামনগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক নগরের মধ্যে একটি নগর। যা প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে নগরটি। তৎকালীন অন্য সব নগর থেকে এটা ছিল সবচেয়ে আকর্ষনীয় নগর। আমার চোখের সামনে দাড়িয়ে আছে পঞ্চদশ শতকের হারিয়ে যাওয়া একটি রাজ্য, যা সাড়ে চারশত (৪৫০) বছরের একটি পুরোনো পানামনগর।

সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে এই পানামনগর, অথবা ঈশা খাঁর নগর। পনেরো শতকে ঈশা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপনে নগরটি গড়ে উঠে, সোনারগাঁও নামে। ঈশা খাঁ তাঁর স্ত্রী সোনাবিবি’র নামে নামকরণ করেন সোনারগাঁও। এর পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথ। এই পথ দিয়ে বিলেত থেকে আসতো “বিলাতি থানকাপড়, আর দেশ থেকে যেতো মসলিন কাপড়”। এই নগর ছিল তাঁত ব্যবসায়ীদের আবাসস্থল বলতে পারেন বাংলার মসলিম ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে ভিড়তো পালতোলা নৌকার সারি। আর ঠিক সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোসবস্তের কারণে ইউরোপীয়রা নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠে এই শহরে। ইংরেজরা এখানে নীল বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। আর তখননি মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্যিকরা।

বাংলার স্বাধীন রাজা ঈশা খাঁর পদচারণা ছিলো এই নগরে। আনুমানিক ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে মুসলিমদের সূচনা ঘটে। তবে সুলতানী আমল থেকে এখানে প্রচারণ ছিলো বাংলার সংস্কৃতি। ডব্লিউ.ডব্লিউ. হান্টার এর মতে, সুলতানি আমলে পানামগনর ছিল সোনারগাঁওয়ের রাজধানী। কিন্তু সুলতানী আমলের তেমন কোন স্থাপত্য এখনো নজরে আসেনি, তাই এই দাবির সত্যতা ঠিক নয়।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোঘলরা সোনারগাঁও অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে যার ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানামনগরের যোগসূত্র গড়ে উঠে। পানাম পুল (এখন সেটা বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানামনগর সেতু এবং তিনদিক দিয়ে খাল হওয়ার কারনে বোঝা যা যে, পানাম সোনারগাঁওয়ের একটি উপশহর ছিল। পানামনগর ছিল হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বাসস্থান। ব্যবসায়ীদের যাতায়েত ছিল ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই শহর।

পানাম পুল

ভবনগুলো বিবরণ:
পানামনগর ও এর আশপাশ ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জনজীবনের অস্থিত্ব আছে। সেকালে এই শহরটিতে গড়ে উঠেছে একতালা, দু’তালা ও তিনতালা কতগুলো ভবন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫২টি ভবন। ভবনগুলো মাজ দিয়ে বয়ে গেছে ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটারের দীর্ঘ একটি সড়ক। ভবনগুলো রয়েছে সড়কের দু’পাশে। সড়কের উত্তর দিকে রয়েছে 31টি ভবন আর দক্ষিণ দিকে আছে ২১টি ভবন। শতাব্দীর এই পুরনো ভবনগুলো বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে।

শুধু দালান নয় এখানে মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাকশাল, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ প্রশস্থ দেয়াল, প্রমোদালয়, চিত্রশালা কুপ, পুকুর, সরাইখানা, পঞ্চপীরের মাজার। এই নগরে রয়েছে ৪০০ বছরের পুরনো মঠবাড়ি। পানামনগরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল এই খালটি পানামের গুরুত্বপূর্ন ভবনগুলো ছুঁয়ে পূর্বদিকে মেনিখালি নদ দিয়ে মেঘনা নদীতে বয়ে গেছে।
ভবনগুলো আয়তাকার উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। ভবনগুলো ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রীক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের কারুকাজে অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে। এই ভবনগুলো চুনা শুরকি, ইটের সাথে ঢালাই লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর এবং জানালায় আছে গ্রিল। মেঝেতে আছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। সবগুলো বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল-সাদা ছাপ রয়েছে। ভবনগুলোতে কাস্ট আয়রনের কাজও রয়েছে। এই কাস্ট আয়রনের কাজগুলো ইউরোপের কাজের সাথে সমতুল্য। সব ভবনগুলোই আন্দরবাটি আর বহির্বাটি এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।



এই এলাকায় রয়েছে পুরনো ৫২টি ভবন:

ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ বাড়ীগুলোতে উন্মুক্ত উঠান ছিলো। প্রতিটি বাড়ির সাথে একটি করে কুয়া ও কুপ ছিলো। নগরীদের পানি সংগ্রহণের জন্য দু’পাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর ছিলো। এবং বাড়ীগুলো পরস্পর থেকে কিছুটা দূরত্বে বজায় ছিলো। ধারণা করা হয়েছে এই বাড়িগুলো বেশির ভাগই হিন্দু বণিকদের।

পানাম পুরনো পুকুর

সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিমে একটি গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ আছে। কথায় আছে এই মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসন আমলে নির্মিত হয়েছে। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তার দক্ষিণ দিকে রয়েছে ইমারত, বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, দমদম গ্রামে আছে দমদম দুর্গা। এছাড়ও এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঈশা খাঁ ও তার ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গা, কদম রসুল, চিলেকোঠা।

সোনাকান্দা দুর্গা

সোনারগাঁও জাদুঘরের বিবরণ:
পানামসিটি থেকে বের হয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলে দুপুরের খাওয়ার জন্য একটি হোটেলে। খাওয়া শেষে চলে গেলাম আমরা জাদুঘরের ভিতর। যাদুঘর এলাকা টি পানামনগর থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পানামনগরের ঠাকুরবাড়ি ভবন ও ঈশা খাঁর তোরণের আকার প্রায় ১৬ হেক্টর স্থান জুড়ে আছে। কারুশিল্প ও লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে উঠেছে একটি বিশাল এলাকা জুড়ে। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর এলাকটি একটি কারুপল্লী হয়ে উঠেছে। এখানে ১টি জাদুঘর, ১টি লোকজ মঞ্চ, সেমিনার কক্ষ ও কারুশিল্প গ্রাম রয়েছে। জাদুঘর এলাকার মধ্যে কিছু ছোট ছোট পুল রয়েছে, এবং কৃত্রিম লেক আছে। এই লেকে নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থাও আছে। প্লাস্টিক ও কাঠের দুই ধরনের নৌকা রয়েছে।


জাদুঘরের লেক

এখানে সুলতানী ও মোগল আমলের বেশ কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এ অঞ্চলে চারু ও কারুশিল্প এবং বস্ত্র বয়ন শিল্প সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। এই অঞ্চলের সুতি কাপড় মিশরীয় ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। বাংলার বারো ভূাঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর রাজধানীতে সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন বাংলার লোকশিল্প যাদুঘর। এখানে বাংলার প্রাচীন সুলতানদের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র, তৈজসপত্র, পোশাক, বর্ম অলংকর ইত্যাদি রয়েছে। আরো রয়েছে বাংলার প্রাচীন মুদ্রা। প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া রয়েছে গ্রন্থাগার জাদুঘর, খোদাই করা বিভিন্ন বেত-বাঁশ কাঠ, মাটি, পাথর, জামদানি, নকশিকাঁথা একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎশিল্প দিয়ে তৈরি কারুশিল্পী পণ্য।


জাদুঘরে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের (৪০৫০)টি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। যার মধ্যে আমার চোখে অনেক কিছুই পরেছে। ঊনিশ-বিশ শতাব্দীর অনেক সংরক্ষিত জিনিস। যেমন- কোরআন পড়ার রেহাল, কাঠের তৈরি সিংহ, হাতি, হিন্দুদের কাঠের বিয়ের পিড়ি, কাঠের চটি, পিঠে বানানো কাঠের ছাঁচ, নকশি টেবিল, কাঠের সিন্ধুক, কারুশিল্পের কর্মপরিবেশ গ্রামের, বিভিন্ন ধাচের হাতের সেলাই করা নকশি কাথা, হিন্দুদের পিতলের ছোট ছোট কাসার এবং পিতলের থালা-বাটি, পিতলের বড় কলস, পান-সুপারী খাওয়ার বিভিন্ন ধাঁচের জাঁতা, গানবাজনার বাদ-যন্ত্রর। এছাড়াও রয়েছে- ফুলের টব, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের বড় বড় পিতল রুপার লোকজ অলংকার যেমন-কোমরের বিছা, হাতের কাঁকন, নাকে-কানের দুল পায়ের শিকল, ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাদুঘরের মধ্যে যেটা দেখে আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে সেটা হলো, সেকালের একটি বিয়ের পালকি। আর মেয়েদের অলংকার দেখে আমাকে আরো ভাবিয়ে তুলেছে। ইয়া বড় বড় আর মোটা মোটা অলংকার কিভাবে ব্যবহার করতো মেয়েরা ভেবেই পাচ্ছিনা। এতো এতো অলংকার যা সেকালের মানুষেরা ব্যবহার করতেন! কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো শুধু মেয়েরাই নয় সেকালে ছেলেরাও বিভিন্ন ধাঁচের লোকজ অলংকার হাতে পায়ে ব্যবহার করতো। সেগুলো ছিলো বেশির ভাগই লোহার অলংকার।


জাদুঘরের পুরনো নির্দেশন

ইতিহাসে বড় সরদার বাড়ীঃ
আমরা যখন পুরো জাদুঘর এলাকাটা ঘুরে অর্থাৎ একপাশ থেকে ডুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হলাম ঠিক তখনি চোখে পরলো অপূর্ব একটি রাজপ্রাসাধ। যার সামনে পিছনে দুটি মন-মুগ্ধ করা দীঘি। পশ্চিম পাশের দীঘির বাউন্ডারের উপর দিয়ে আমি কিছুক্ষণ হেটেও ছিলাম। বন্ধুরা আমাকে বারবার বলল পড়ে যাবি তো! দীঘিটিতে শান বাঁধানো একটি ঘাটও রয়েছে। যার উপর বসে আমি কিছুক্ষণ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। এবং ওখানে বসে জানতে পারলাম এর নাম “বড় সরদার বাড়ি”। আসলে এই বড় সরদার বাড়ি কেনো? মনে তখন বিশাল প্রশ্ন জাগলো।

বড় সরদার বাড়ী

এরপর জানতে পারলাম এই ভবনটি প্রায় ছয়’শত (৬০০) বছরের পুরনো একটি ভবন। ১৩৩৮ ও ১৩৩০ সন লেখা দেখে অনুমান করে বলা যায় ভবনটি ছয়’শত (৬০০) বছরের পুরনো। এই নিদর্শনের নাম গোপীনাথ শাহা সরদার বাড়ি। সর্বশেষ হাত বদল হয়ে সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ হয় ১৩৩০ সালে। সুলতানি আমলের পথ ধরে মোঘল আর সবশেষ ব্রিটিশ রাজত্বের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নাম “বড় সরদার বাড়ি”। এই বাড়িটি নির্মাণ করেন ঐশ্বর্যকান্ত শাহা সরদার নামের একজন ব্যবসায়ী। তখন থেকেই এর নাম “বড় সরদার বাড়ি”। ভবনটির আয়তন প্রায় সাতাশ হাজার চার শত বর্গফুট। এর নিচ তলায় ৪৭টি রুম আর উপরতলায় ৩৮টি রুম রয়েছে। বাড়িটির পশ্চিম দিকে চিহৃ রাজমুকুট পরার। পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দুটি সুসজ্জিত প্রবেশ মুখ রয়েছে। বাড়িটির প্রতি তলায় সাতটি করে তোরণ এবং কার্নিশে লতাপাতার কারুশিল্পের কাজ করা। দক্ষিনের প্রবেশমুখের বারান্দাটি ২৫ ফুট দীর্ঘ এবং কাদামাটির ফুলপাতা ও চিনামাটির কাটা টুকরার নকশাসজ্জিত অর্ধবৃত্তাকার তোরণের রয়েছে। বাঁকা তোরণটির মোজাইকের লতাপাতা ও জ্যামিতিক আকৃতির ব্যবহার রয়েছে। বাড়িটিতে প্রায় ৭০টি কক্ষ রয়েছে বিভিন্ন আয়তনে। পুর্বদিকে ৫০*৫০ ফুট, পশ্চিম দিকে ৫০*২৫ ফুট খোলা আঙিনা আছে। দক্ষিণ বারান্দাটি তিনদিকে রয়ছে কামরা, পূর্ব পাশে রয়েছে একটি কৃষ্ণমন্দির।

ঘুরে এলাম ঝিন্দাপার্কঃ
আসলে ঝিন্দাপার্ক তেমন কিছু দেখতে পারিনি। কারন, রাতের ছায়াটা পড়ে গেছে ততক্ষণে। তবুও যা দেখেছি বেশ আনন্দই দিয়েছে। আমরা ঝিন্দাপার্কের পাশ দিয়ে ছোট চিপা রাস্তার দিকে হাটা শুরু করি।স্যার বলেছে সবাই মিলে যাবো এবার “শাপলা বিল”। এখানে প্রচুর পরিমানে লাল রংয়ের শাপলা ফোটে। কারণ এই এলাকাটা একটি বিল-ঝিল এলাকা। এখানে জনসংখ্যা একে বারেই কম। বলতে গেলে শ’খান বাড়ি ছাড়া তেমন কিছুই নাই। নাই মার্কেট, বাজার, হাসপাতাল, এগুলো হয়তো আছে তবে ঐ এলাকার মধ্যে নাই সেই কত দুরে হয়তো থাকতে পারে। তাই এই এলাকার নাম দিয়েছি আমি “জঙ্গল বাড়ির এলাকা”। আসলে এই এলাকাটা খুবই ভয়ংকর। চারপাশে বিল-ঝিল আর গাছপালার ঝোপ-ঝার। নিস্তব্দ একটি এলাকা। সন্ধ্যার দিকে কেউ বের হয়না। তেমন গাড়িঘোড়াও নেই যাতায়েতের জন্য। আছে কিছু অটোরিক্সসা। তবে পরিবেশটা বেশ সুন্দর, এখনো আধুনিকতার ছোয়া পায়নি। তবে হয়তো পেয়ে যাবে আর কয়েক বছরের মধ্যে । কারণ আমাদের দেশের মানুষেরা এখন বেশ আধুনিকতা। তবে আমি চাই না এই রকম সুন্দর পরিবেশে আধুনিকতার ছোয়া পাক। কারণ এই রকম সুন্দর আর বিশুদ্ধ পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেলে দেশ একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। এরকম কিছু তো বিশুদ্ধ অক্সিজেন থাকতে হবে। তা না হলে আমরা বেচে থাকবো কি করে!


শাপলা বিল ও সেই এলাকা

আমার কিছু কথাঃ
তবে আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়, আমি হতম্ভব অন্য জায়গায়, আমার মন খারাপ অন্য জায়গায়। আমি যখন পানাম সিটিতে যাই তখন আমাকে কেউ! কেউ হয়তো পিছন দিকে ডাকছে! কিন্তু কে? কোন ভুত নয়তো আবার। না কোন ভুত নয়, এই যে সেই সাড়ে চার’শত (৪৫০) বছরের বিল্ডিংগুলো। ওরাই আমাকে ডাকছে।

কেনো ডাকছে আমাকে? কোন নির্দেশনা নাকি অন্য কিছু, হ্যা নির্দেশনাই। আমি যখন মনে মনে ভাবলাম অর্থাৎ বিল্ডিংগুলো আমাকে যখন ভাবিয়ে তুলল। তখন মনে হলো- আসলে ভবনগুলো আর কত বছর টিকে থাকবে? ভবনগুলো আরো বহু বছর টিকে থাকবে তো? নাকি হারিয়ে যাবে কালেরক্ষেয়ায়?

এই সাড়ে চার’শত (৪৫০) বছরের ভবনগুলো দাড়িয়ে আছে এখন কালের সাক্ষি হয়ে। তবে এগুলো হাড়িয়ে যেতে আর বেশি সময় নেই। হয়তো এর পর আরো পাঁচ (৫)প্রজন্ম এর চিহৃ পাবে কিনা আমার জানা নাই, হয়তো পাবেনা। কারণ ভবনগুলো এখন বেশ ঝুকিপূর্ণ ভাবে দাড়িয়ে আছে। আমরা যে ভবনের সামনে যাই সেই ভবনই ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু কেনো? কেনো এই ইতিহাসকে নিস্তব্দ করে দেওয়া হবে।

শুনেছি বিদেশীরা তাদের দেশের এইরকম ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য হাজার হাজার টাকা আর শ্রম ব্যয় করে। তবে আমাদের দেশ কেনো নয়? শুনেছি প্রতিটি দেশকে জাতিসংঘ পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থ দেয়। আমাদের দেশকেও তো দেয়? তাহলে সেই অর্থ কোথায় যায়? এই ৫২টি ভবন মনে হয়না যে আর ৫০ বছর টিকে থাকবে। হয়তো ৫০/60 বছর টিকে থাকবে তারপর বৃষ্টির পানি আর অযত্নের অভাবে নিস্তব্দ হয়ে যাবে এই ইতিহাস।

আমি সবগুলো ভবনের মধ্যে ডুকতে না পারলোও ২/৩ টি ভবনের মধ্যে ডুকেছি। তাও দেওয়াল টপকিয়ে কিংবা লোহার গেটের ছোট ফাঁকা দিয়ে। একটি ভবনের দোতালায় আমি উঠেছে। মনে হচ্ছে ওরা কাদছে হাহাকার করছে যত্নের অভাবে। যত ধুলো বালি, নোংরা কাগজপত্র। অনেকে বলেছে এখানে রাতের আধারে নাকি জুয়ারিদের জুয়ার আড্ডা চলে হাসি পায় আমার। আমার মনটা হাহাকার করলো আমাদের দেশের মানুষের নির্মমতা দেখে। এই পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য দিয়ে আমার দেশের মানুষ মাসে আয় করে লক্ষ/কোটি টাকা, বিদেশ থেকে অর্থ আসে লক্ষ/কোটি টাকা কিন্তু সেই গুলো কোথায় যায়? কি হয় সেই অর্থ দিয়ে। সবটাই কি পেটে পুরতো হয়? আমার দেশের মানুষের এতো লোভ, এতো ললসা। ধিক্কার জানাই এই ধরনের অন্যয়ের বিরুদ্ধে।

যদি কিছু অর্থ খরচ করে বৃষ্ট্রির পানি থেকে রক্ষা, আর পুরনো সেই ডিজাইনটাকেই নতুন করে নির্মাণ করে হয়তো সেই ৬০০/৪০০ বছরের ইতিহাস আবার ফিরানো যেতো। হয়তো এগুলো টিকে থাকতে আরো বহু বছর বহু যুগ ধরে। শুধু সোনারগাঁও নয় বাংলাদেশের এরকম প্রতিটি ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে এর পিছন শ্রম আর অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটাই আমি চাই বেচে থাকুক হাজার বছরের ইতিহাস।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:২৬

ঋতো আহমেদ বলেছেন: বছর দশেক আগে যখন কাঁচপুর ছিলাম তখন প্রায়ই যেতাম। প্রিয় একটা জায়গা আমার পানাম সিটি। ছবি ও বর্ণনা সুন্দর হয়েছে।

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৯

কামরুননাহার কলি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া্।

২| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৩:০১

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার সোনার গা ভ্রমনের সাথে সাথে আমিও ঘুরে এলাম।

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৩

কামরুননাহার কলি বলেছেন: তাই, খুব ভালো।

৩| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ২:১৭

নাহিদ০৯ বলেছেন: আমার ছোট ভাই চাকুরিসূত্রে এখানে থাকে। তাই একদিন ঘুরে এসেছিলাম পানাম সিটিতে। আপনার বর্ননায় পড়ে ভালো লাগলো।

৪| ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:২৯

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: কদিন আগেই ঘুরতে এলাম।
প্রাঞ্জল বর্ণনায় মুগ্ধতা++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.