নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবছি

যুক্তিতে মুক্তি

কবীর নয়ন

যুক্তিতে মুক্তি

কবীর নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গ্রন্থ আলোচনাঃ রাহুল সাংকৃত্যায়নের

০৭ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১০:১৪

'নতুন মানব সমাজ' বইটি রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছিলেন জেলে বসে। ১৯৩৯ সালে তিনি এটি রচনা করেন হিন্দি ভাষায় 'তুমহারি ক্ষয়' নামে। এই বইয়ে রাহুল পরিষ্কার ভাষায় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বহুমাত্রিক শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তাঁর নিজের ভাষায় " তুমহারি ক্ষয় -এ আমি আমার মনের কয়েকটি কথা বলিয়াছি। বস্তুত বিষয় আরও কঠোর ভাষা দাবী করে, কিন্তু পাঠকদিগের কথা মনে রাখিয়া তাহা করিতে পারি নাই। বইখানি ছাপরা জেলে লিখা হইয়াছিল।"



বইটি সমাজ, ধর্ম, ঈশ্বর, সদাচার, জাতিভেদ এবং শোষক শ্রেণী নামক ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করা হলেও মূল সুর এক, আর তা হল সমাজের অন্যায় ও শোষণের স্বরূপ উন্মোচন ও প্রতিবাদ। যদিও ধর্ম, ঈশ্বর, সদাচার, জাতিভেদ, শোষক শ্রেণী সবগুলো এ সমাজেরই প্রপঞ্চ কিন্তু গুরুত্ব বিচারে প্রতিটি পৃথকভাবে আলোচনার দাবী রাখে বৈকি!



প্রকৃতিতে লড়াই করে টিকে থাকার তাগিদে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছিল সমাজ। সমাজের শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে মানুষ পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে রাজত্ব করছে। কিন্তু যে সমাজকে মানুষ গঠন করেছিল নিজ প্রজাতিকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য, সে সমাজকেই ব্যাবহার করে তারা আজ এমন ব্যবস্থা তৈরি করেছে যে মানুষ নিজেই নিজের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সমাজের কর্তব্য ছিল মানুষের প্রতি সুবিচার করা, অথচ এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আর তার ফল ভোগ করে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করে শস্য ও পণ্য, তাদের কপালে জোটে অর্ধাহার-অনাহার, নির্যাতন, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও অপমৃত্যু। তাদের বসবাস সমাজের সবচেয়ে নোংরা-অস্বাস্থ্যকর স্থানে। তাদের পরনে মলিন ও ছিন্ন বস্ত্র। তাদের উৎপাদিত ধনে প্রথম অধিকার জমায় অলস ও অপদার্থ মহাজন-মালিক শ্রেণী, তারপর অধিক বেতন ভোগী কর্মচারী ও পুরোহিতরা। এখানেই শেষ নয়, ধনোৎপাদনকারী কৃষক-শ্রমিকদের পদে পদে জোটে অপমান ও গ্লানি। শোষকরা উঠতে-বসতে তাদের গালি দেয়। তাদের সন্তানদের কপালে শিক্ষা জোটে না মেধাবী হলেও অথচ শোষকদের মাথামোটা অকর্মণ্য সন্তানরাও টাকার জোরে অনায়াসে জুটিয়ে ফেলে ডক্টরেট ডিগ্রি পর্যন্ত। এ সমাজের আপাদমস্তক অন্যায় ও অবিচারে ভরা। রাহুলের ভাষায়, "বাহিরে ধর্মের মুখোশ, সদাচারের অভিনয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের তামাশা এইদিকে ভিতরে জঘন্য কুৎসিত কার্যকলাপ। ধিক এই সমাজকে, নিপাত যাক এই সমাজ।"



ধর্ম সমাজের সবচেয়ে পুরনো ও অন্যায্য প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এর সৃষ্টি হয়েছিল শান্তির মুখোশ পরে কিন্তু শান্তি রক্ষায় এর কোন ভূমিকাই নেই। বরং পৃথিবীতে যত অশান্তি হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই -হয় সরাসরি ধর্মের জন্য নতুবা ধর্মকে অবলম্বন করে। ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদকে স্বীকৃতি দেয়। এটা মানুষকে মানুষের রক্তপিপাসু বানায়। এটা শোষণের একটি প্রাচীন ও শক্তিশালী হাতিয়ারও বটে। আর্থসামাজিক বৈষম্যমূলক নীতি ও শোষণের ফলাফলই যে দারিদ্র, ধর্ম শুধু তা অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়না, বরং শেখায় ধনি-গরিব ঈশ্বরের সৃষ্টি। চিরকাল শোষকের অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে তারই সেবা করে যাওয়াই ধর্ম। যারা অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ চালায় তাদের ইহকালেও স্বর্গবাস পরকালেও স্বর্গবাস আর শোষিতের, নিপীড়িতের, নির্যাতিতের সর্বকালেই সর্বনাশ।



ঈশ্বর নামক প্রকল্পটি মানব সমাজের একটি আদিম প্রকল্প। আসলে এটি ভীতি ও অজ্ঞতা প্রসূত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আদিকালে যখন মানুষের মানসিক বিকাশ সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল তখন থেকেই তারা ভয় পেত প্রকৃতির শক্তিকে ও তাদের দলনেতাকে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছে রাতের খোলা আকাশের দিকে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে প্রত্যক্ষ করেছে গ্রহণ, জড়া, মৃত্যু, মহামারী, বজ্রপাত, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, দাবানল, বন্যা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি। আবার লক্ষ্য করেছে ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে বন, নদীনালা খালবিল হয়ে উঠেছে জলে ও মাছে টইটুম্বুর, প্রকৃতি দুহাত ভরে মিটিয়ে চলেছে তাদের সমস্ত প্রয়োজন। এইযে সবকিছু, জন্মমৃত্যু; কিভাবে হচ্ছে এতকিছু? ভীত ও অনগ্রসর মানুষ এর উত্তর খুঁজেছে ঈশ্বর প্রকল্পে। তারা তাদের জ্ঞানের সীমানায় যে প্রশ্নের উত্তর পায়নি তার সমাধান মিলিয়েছে ঈশ্বরের অলৌকিকতায়। মানুষের এরূপ শিশুসুলভ অজ্ঞতার বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে অন্যায়-অত্যাচার করে চলছে চতুর ক্ষমতাবানরা, আর ক্ষমতাহীনরা সবকিছু সয়ে চলছে ঈশ্বরের দয়ার আশায়।



সমাজে সদাচারের ব্যবস্থা দেখলে বিস্মিত ও লজ্জিত হতে হয়। একে তো বস্তু স্থানকাল ভেদে বিভিন্ন, তার উপরে আছে এর অন্যায্যতা। প্রাকৃতিক বা সহজাত প্রবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণের নাম দেয়া হয়েছে সদাচার। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ কার জন্য? উত্তর সহজ। শুধু এবং শুধুই দরিদ্রের জন্য। যার প্রচুর সম্পদ আছে তার জন্য সদাচার নিষ্প্রয়োজন। সবচেয়ে কৌতুকের বিষয় হল, সর্বযুগে যারা সদাচারের দীক্ষা দেয়, হয় তারা নিজেরাই দুরাচারি নতুবা বিত্তশালীর দুরাচারের প্রশ্রয়দাতা। গরিবের জন্য মদ্যপান হারাম হলেও ধনীদের জন্য কোন কালেই তা নিষিদ্ধ ছিল না। যে সমাজ যত কৃত্রিম সেখানে সত্য বলা তত কঠিন। আমাদের চারপাশে শুধুই মিথ্যার চাষবাস। এখানে ব্যাক্তি পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত সকলে মিথ্যার চর্চায় ব্যস্ত। কেউ যদি শতভাগ সত্যবাদী হয়, সে নির্ঘাত না খেতে পেয়ে মরবে। প্রতিটি মানুষকে মিথ্যুক হতে বাধ্য করে এই সমাজ। চুরি করা অপরাধ আইনে, কিন্তু বাস্তবে চোরদের জয়জয়কার। চোর ধরার জন্য যারা নিয়োজিত তারা নিজেই বড় চোর। যে পেটের দায়ে চুরি করে সে ধরা পড়লে শাস্তি অনিবার্য, কিন্তু রুই-কাতলা-রাঘববোয়ালরা চিরকাল নমস্য। ন্যায়বিচার এ সমাজের সবচেয়ে বড় প্রহসন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নামে স্থাপন করা হয়েছে বিচারালয়, নিয়োগ করা হয়েছে বিচারক, আইনজীবী, পেশকার, আর্দালি, চাপরাশি সহ আরও কত পদের লোক। প্রণয়ন করা হয়েছে শত শত আইন। কিন্তু সবই নিরর্থক। অর্থই সর্বত্র ন্যায়বিচারের নিয়ন্ত্রক। বরং ন্যায়বিচারের নামে শোষণের ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে। সমাজের রঙ্গমঞ্চে আরেক সঙের নাম হল ইতিহাস ও সংস্কৃতি। শুধু ভাঁড়ামি করেই এটা ক্ষান্ত হয় না, সুকৌশলে প্রাচীন শৃঙ্খলকে করে দৃঢ়তর। অতীতের অনৈক্য ও বৈরিতাকে জিইয়ে রাখা এবং সফল হত্যাকারী ও লুণ্ঠনকারীদের প্রশংসার স্বর্গে তোলাই এর কাজ। ইতিহাস অতীতকে সুসময় হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তা যে ডাহা মিথ্যা তার একটি সহজ প্রমাণ হল প্রাচীন দাস প্রথা। ইতিহাস ও সংস্কৃতির দোহাই দেয়া শোষকের শোষণ টিকিয়ে রাখার ফন্দি বৈ আর কিছুই নয়।



যুগে যুগে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে জাতিভেদের বিষ। জাতিভেদ সমাজে সাম্য সৃষ্টির প্রধান অন্তরায়। এটা মানুষের মনে উচ্চ-নীচের মনোভাব সৃষ্টি করে। এক জাত মনে করে তারা অন্য জাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এক জাত অন্য জাতকে ঘৃণা করে। তারা একে অপরের উপর গণহত্যা চালাতেও দ্বিধা করে না। ফলে মানুষ বিভক্ত হয়ে আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে আর এই সুযোগে লুটেরারা মানুষের জানমাল লুট করে চলছে মহা উল্লাসে। জাতিভেদের বিষে অন্ধ মানুষ শত্রু চিনতে পারে না।



সমাজের বিস্তর মিথ্যা ও অন্যায়ের মূলে যে শোষক শ্রেণী, তার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা আছে বইটির শেষ অধ্যায়ে । মানুষ যখন অরণ্যচারী পশু শিকারি জীবন ছেড়ে পশুপালন শুরু করল, তখন থেকে ধীরেধীরে সমাজে শোষক শ্রেণী বা রাহুলের ভাষায় 'জোঁক' -এর উৎপত্তি। অরণ্যচারী জীবনে মানব গোষ্ঠীর সকলে পরিশ্রম করত, কেউ অন্যের শ্রমে জীবিকা নির্বাহ করত না। কিন্তু পশুপালন শুরু করার পর মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত সম্পদ এলো এবং গোষ্ঠীপতিরা দুয়েকটি পশু উপঢৌকন পেতে লাগলো। এভাবেই ক্ষুদ্র পরিসরে মানব-জোঁকের উৎপত্তি। সমাজে যখন কৃষিকাজ চালু হল, গোষ্ঠীপতিরা তখন রাজা হয়ে বসলো। তাদের হাতে জমা হতে লাগলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন। ধীরেধীরে রাজাদের সাথে যোগ হল তাদের পর্ষদ, পুরোহিত, কর্মচারী ও ভূস্বামীগণ। এভাবে একটি শক্তিশালী জোঁক শ্রেণীর উদ্ভব হল যারা অন্যের রক্ত শোষণ করে জীবন ধারণ করে। সাধারন মানুষ পরিণত হল দাস ও ভূমি দাসে। পরে বাজার ব্যবস্থার উন্নতির সাথে বিকাশ ঘটল পুঁজিবাদের। পুঁজিপতিরা পরিণত হল প্রধান জোঁকে আর সাধারণ মানুষ দাস ও ভূমি দাস থেকে পরিণত হল অর্থের দাসে। বাজার দখল করতে এরই মধ্যে পুঁজিপতি জোঁকেরা বাধিয়ে ফেলেছে দু'দুটি হুলুস্থুল মহাযুদ্ধ। এ বইয়ে লেখক সবকিছুই খুব সহজ ভাষায়, সংক্ষিপ্ত আকারে অথচ গভীর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।



"নতুন মানব সমাজ" নামক কলেবরে ক্ষুদ্র কিন্তু আবেদনে বিশাল বইটি দিয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ন পুরোপুরি অন্যায়ে ডুবে থাকা এই সমাজের প্রতি আঘাত হেনেছেন দৃঢ় ভাবে। তাঁর অপূর্ব লেখনী শৈলী এই প্রয়াসকে পূর্ণতা দিয়েছে। বইটি পড়ার সময় প্রতি মুহূর্তে মনে হবে, শঠতায় ভরা এই কৃত্রিম সমাজকে ভেঙ্গেচুরে নতুন মানব সমাজের সূচনাটা কত জরুরী! শোষকদের উচ্ছেদ মানবতা তো বটেই মানব প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য কতটা অনিবার্য! রাহুলের কথা দিয়েই শেষ করছি, "যে সময়ে মনুষ্যজাতি তাহাদের মধ্যে প্রথম শোষক সৃষ্টি করিয়াছিল সেই সময় কি সে জানিত যে সেই শোষকেরাই বৃদ্ধিলাভ করিয়া তাহাকে আজ এই দুর্দিনের সম্মুখীন করিবে? ইহার বিনাশ ছাড়া বিশ্বের কল্যাণ নাই। শোষকগণ- তোমরা ধ্বংস হও!"

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:১০

কবীর নয়ন বলেছেন: এটা আমার প্রথম ব্লগ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.