![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(১)
অন্ধকার রুমটাতে গুমোট একটা ভাব বিরাজ করছে।রুমের মধ্যে থাকা আসবাবপত্রের আবছা ছায়া বিরাজ করছে।বারান্দার দরজাটা খোলা।পাতলা পর্দাটা সরানো।আশেপাশের অন্যান্য বিল্ডিং থেকে আসা টিউব লাইটের ক্ষীণ সাদা আলো বারান্দার মেঝের কালো অংশটার কিছুটা দখল করে আছে।দক্ষিণ দিকে একটা জানালা আছে।পুরো বাড়ির সবচেয়ে বিচিত্র আর আলাদা অংশটা হল এই জানালা।বাড়ির অন্যান্য জানাগুলো লোহার গ্রিল আর কালো রংয়ের থাইয়ের গ্লাসে ঘেরা।আর এই জানালাটাই শুধুমাত্র কাঠের তৈরি।লম্বা লম্বি ছয়টা কাঠের শিক লোহার গ্রিলের জায়গা দখল করেছে।গ্রামের মাটির ঘরে যেরকম জানালা থাকে অনেকটা সেরকমের।
সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই।সূর্যটা ডুবে যাওয়ার পর দিনের আলোটা আজকের মত তার কর্তৃত্বটা অন্ধকার রাতের হাতে তুলে দিয়েছে।আর রাত নামক এ অন্ধকারাচ্ছন্ন জগত্টা তার কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে বাড়াতে শুরু করেছে।আমি এখন এই আঁধার জগতের এক প্রজা।
ঝিঁঝিঁ পোকারা আরো অনেক আগেই ডাকা শুরু করেছে।রাতের নিঃস্তব্ধতা যেন খানখান হয়ে যাচ্ছে সে শব্দে।কিন্তু সে শব্দটা আমার কানের পর্দায় বিরক্তিকর সুর হিসেবে আঘাত করছে না।যেন অনুভূতিহীন এক জীব হয়ে গেছি।
সময়টা গরমকাল।গরম পরাটাই স্বাভাবিক।তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে গরমটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে।কিন্তু আমার কাছে তা মনে হচ্ছে না।কারেন্ট থাকা সত্বেও ফ্যানটা অফ।সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।অথচ সেদিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।ঘামের বিন্দু বিন্দু কণাগুলো লোমকূপ থেকে বের হয়ে শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।কিন্তু আমি এক নিবিষ্ট মনে,পলকহীন চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে আছি।নিথর,নির্জীব হয়ে পড়ে আছি।কোন নড়াচড়া নেই।জানালার কাছে কয়েকটা সবুজ ক্ষুদ্র আলোকবর্তিকার দেখা পাওয়া যাচ্ছে।মিটিমিটি করে সবুজ আলোটা জ্বলছে।তাকিয়ে থাকতে থাকতে হটাত্ করে সব কিছু ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে লাগল।সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে।কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ঐ ক্ষুদ্র সবুজ আলোটা এখনো চক্ষুলেন্স একবার স্পষ্ট আবার একবার অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।একসময় চোখটাও আর সায় দিতে চাইল না।অক্ষিকোটরে ব্যাথা অনুভত হচ্ছে।দুচোখের দুকোণ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললাম।আবার খুললাম।মনে হল যেন বাস্তবে ফিরে এসেছি।
ক্ষণিকের জন্য এক অনুভূতিহীন এক জগতে চলে গিয়েছিলাম।এখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছি।পুরো শরীর ঘামের স্রোতের ভিজে গিয়েছে।বিছানার যে অংশটাতে পিঠ ছিলো সে অংশটুকু ভিজে গেছে।হটাত্ মনে হল গরমের তীব্রতা আমায় ছেকে ধরেছে।সিলিং এর দিকে তাকিয়ে দেখি ফ্যান ঘুরছে না।তিনটা পাখা নিশ্চল হয়ে আছে।বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।এগিয়ে গেলাম সুইচ বোর্ডের দিকে।শাহাদাত্ আঙ্গুলটা দিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করলাম।লাইটের সুইচের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়েও আবার মুঠোর মধ্যে পুরে নিলাম।পাখা তিনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে।যান্ত্রিক পাখার যান্ত্রিক বাতাসের ঝাপটা ঘর্মাক্ত শরীরটাতে হটাত্ একটা কাঁপুনির সূষ্টি করল।বিছানায় যেয়ে বসলাম।শরীরটা শুকিয়ে নিই।তারপর গোসল করা যাবে।হটাত্ তীব্র আলোর ঝলকানিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।বাম হাতটাকে সামনে এনে চোখটাকে সেই তীব্র আলোর হাতে থেকে রক্ষা করলাম।এতক্ষণ অন্ধকারে থাকার কারণে চোকটা তীব্র আলোর সাথে হটাত্ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না।ধীরে ধীরে চোখটা তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পেল।ঐ তীব্র আলোক উত্সটা এখন আর পারছে না যুদ্ধ করতে।ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।আলোটা কে জ্বালালো তার জন্য পাশ ফিরে তাকালাম।মায়াবী,কিশোরী চাঞ্চল্যে ভরা এক মানবী দাঁড়িয়ে আছে।চেহারায় বিরাজ করছে সেই হাসি।তবে সেই চেহারায় একই সাথে বিরাজ করছে কপট রাগ,মধুর আদেশ দেয়ার চিহ্ন আর আদর পাওয়ার আকুলতা।
(২)
>কিরে কি করিস বসে বসে?আর রুমের লাইট অফ কেনো?
>এমনিই বসে আছি।
>এমনিই বসে আছিস মানে!
>মানে কিছু না।খাবার রেডি করেছিস?
>হুম রেডি।
>আচ্ছা তুই যেয়ে বোস।আমি গোসল করে আসতেছি।
>আচ্ছা,তাড়াতাড়ি আয়।
আমার বোন।নিধি।আমি আদর করে জোনাকি ডাকি।জোনাক যেমন মিটিমিটি করে আলো জ্বলে,নিধিকে দেখলে মনে হয় তার চেহারায় মিটিমিটি করে যেন নূর চমকাচ্ছে।আমার সকল অস্তিত্বই এই বোনটাকে ঘিরে।আমার থেকে বছর তিনেক ছোট।আমি যখন কলেজের ১ম বর্ষে পড়ি তখন বাবা-মা আমাদের এতিম করে চলে যান।আমি তখন নিজেকে কিছুটা বুঝ দিতে পারলেও কোনভাবেই বোনটাকে বুঝাতে পারছিলাম না।রাতের বেলা হটাত্ ঘুম থেকে উঠে 'মা','বাবা' বলে ডাকছে।আর সাড়া না পেয়ে কাঁদছে।ডাকতে ডাকতে আর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমার ছোট্ট জোনাকটা ঘুমিয়ে পড়ত।আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম।সারারাত ওকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম।কাঁদতে আমার অনেক কষ্ট হত।টু শব্দটি যেন না হয় তার জন্য ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাঁদতাম।পাছে আমার বোনটার ঘুম ভেঙ্গে যায়।বাবা মায়ের আদরটাই তো ভালোভাবে পেলো না আমার বোনটা।এরপর থেকে ওকে আগলে রেখেছি বুকের মাঝে।স্নেহ,ভালোবাসা,শাসন সব কিছুই দিয়েছি ওকে।চেষ্টা করেছি আমার সর্বোচ্চ।
আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল।আমি তখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছি।দু ভাই বোনের কালাতিপাত করার জন্য তো আরো আগে থেকেই টিউশনি করতাম।ওটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।যতদিন পর্যন্ত চাকরিটা না পাচ্ছি ততদিন এভাবেই চলতে হবে।
নানান রকমের আবদার করত সে।আর করবেই বা না কেন?ওর শত আবদার পূরণের জন্য তো ওর ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নেই।কখনোবা সময়মত পূরণ করতে পেরেছি তার আবদার আবার কখনোবা নানাবিধ সমস্যায় থাকায় সময়মত দিতে পারি নি।জোনাক আমার তার আলোটা বন্ধ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকত।বোনটার মুখে হাসির রিনিঝিনি শব্দটা শুনতে না পেলে আমার বুকটা মনে হত কেউ ছুড়ি দিয়ে এফোড় ওফোড় করে দিয়েছে।আমি আর থাকতে পারতাম না।যত কষ্টই হোক জোনাকের আলো জ্বালাতে আমি নেমে পড়তাম।যখন তার আবদার পূরণ করতাম তখন তার এই নূরে চমকিত মুখটা দেখতে পেতাম।আমার মনটা তখন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠত।
>কিরে ভাইয়া,গোসল করতে কি এতক্ষণ লাগে নাকি!
>গোসল শেষ।তুই টেবিলে যেয়ে বোস আমি আসছি।
>তাড়াতাড়ি আয়।
ডাইনিং রুমে যেয়ে দেখি আজ টেবিলের বদলে ফ্লোরে খাবার দেয়া।মাদুর পেতে দেয়া হয়েছে।এটা আমার কাছে ব্যতিক্রম কিছু না।আমি ভালো করেই জানি এর মানে।আজ ওকে খাইয়ে দিতে হবে।এটা ওর একধরনের পাগলামি।অবশ্য এই পাগলামিটা আমি ভালোই উপভোগ করি।টেবিলে বসলে ওকে আমি যতই খাইয়ে দিতে চাই ও খাবে না।কপট রাগ দেখিয়ে বলে 'আমি কি আর ছোট আছি নাকি।আমি নিজেই এখন খেতে পারি,হু।'আমি ওর কথা শুনে হাসতাম।কিন্তু যখন ফ্লোরে মাদুর পেতে খাওয়া হয় তখন আমার জোনাকটা যেন সেই ছোট্ট শিশু হয়ে যায়।এমন একটা ভাব চেহারায় ফূটে উঠত যেন ও কিছুই নিজে করতে পারে না।আমি শুধুই হাসতাম।আর মনের আনন্দে ওকে খাইয়ে দিতাম।
ঢাকনা উল্টিয়ে দেখতে লাগলাভ আজকের খাবারের পদ।কয়েক পদের শাক ভাজি,৪/৫ পদের ভর্তা আর ডাল।অন্যান্য দিন শাক ভাজি কয়েক পদের থাকলেও ভর্তার মধ্যে থাকত শুধু আলুর ভর্তা।আজকে আলু ভর্তার সাথে আরো কয়েক পদের ভর্তার আয়োজন রয়েছে।আমাদের নিত্যদিনের খাবার এগুলোই।মাঝে মাঝে গোশত কিনে আনি।ও তখন কপট রাগান্বিত হত।কি দরকার ছিলো গোশতের।আমি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম।বুয়ার সাথে রান্নার সময় থাকত।কিভাবে রান্না করতে হয় তা শিখে নিত।আজ যদি মা থাকত তাহলে তো তিনিই শিখিয়ে দিতেন।
>নে হা কর।
>ভাইয়া আজ আমি তোক খাইয়ে দিবো।
>দূর পাগলী,কি যে বলিস।আমি তোকে খাইয়ে দিবো।
>না ভাইয়া।আজকে আমি তোর কোন কথা শুনবো না।আমি তোকে আজ খাইয়ে দিবো।হা কর বলছি।
ওর কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে হাসছি।
>তোর মাথায় কখন যে কি পাগলামি চাপে!
>কথা না বলে হা কর।
>আচ্ছা,দে খাইয়ে দে।
আমাকে ও খাইয়ে দিতে লাগল।ভাইকে খাইয়ে দিতে পেরে ওর যেন আর খুশি ধরে না।চেহারার উজ্জ্বলতা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।মনে হল হটাত্ করে ও আমার থেকে কয়েক বছরের বড় হয়ে গেছে।
আমিও ওকে খাইয়ে দিতে চাইলাম।কিন্তু ও কিছুতেই খাবে না।পরে আমি বললাম 'তুই যদি আমার হা না খাস,তাহলে আমিও তোর হাতে খাব না।'জোনাক আমার বাধ্য হয়ে রাজি হল।আমি ওকে এক লোকমা খাইয়ে দিই,আর ও আমাকে।তাকিয়ে দেখি ওর চোখে পানি।বুঝতে পারছি ও কাঁদছে।হযত ভাবছে ভাইয়াটা ওকে কেন এত ভালোবাসে।প্লেটটা নিচে নামিয়ে বাম হাত দিয় ওর চোখের পানি মুছে দিলাম।দেখলাম ওর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে উঠেছে।
খাওয়া দাওয়া করে বারান্দায় যেয়ে বসলাম।মুখ অকাশপানে।হটাত্ শুনতে পেলাম নিধি ডাকছে।
>ভাইয়া,এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।
>কিরে কি হয়েছে?
>তুই রুমে আয়।
রুমে ঢুকে দেখি রুমের লাইট অফ।নিধি জানালার কাছে বসে আছে।
>কিরে তুই এখানে বসে বসে কি করিস?
>দেখ ভাইয়া,জোনাক গুলোকে কত সুন্দর লাগছে।সবুজ আলোটা কেমন মিটিমিটি করে জ্বলছে।
>হুম তোর মতন।
>হি হি হি।
রিনিঝিনি হাসির শব্দে আমার বুকে এক অনাবিল প্রশান্তির হাওয়া বইতে লাগল।আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।আর ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.