![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য ন্যায়ে সন্ধানে, আকাশে উড়িয়ে শান্তির নিশান। মুক্তমনে উদার কণ্ঠে, গেয়ে যাবো সত্যের জয়গান।
আমি জন্ম থেকেই মায়ের আদর পাইনি। এর নেহাৎ একটা কারণ আছে। বাবার মুখ থেকে শুনেছিলাম, “অনেকদিন যাবৎ তাদের কোলে কোনো সন্তান ছিল না। বিয়ের সপ্তম বছর পর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ফুটফুটে একটা সদ্য শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য, জনম-দুঃখিনী মা তাঁর এই হতভাগা সন্তানকে প্রসব করতে যেয়েই এই দুনিয়াকে বিদায় জানাইছে।”
·
আম্মু নাকি মৃত্যুশয্যাহিত অবস্থায় আব্বুর হাত ধরে বলেছিল, “প্লিজ কেঁদো না, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি হয়তো এ পৃথিবীতে আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমার এই কলিজ্বার টুকরারে তোমার কাছে রেখে গেলাম। এরে কোনদিন কষ্ট দিবে না।”
·
আমাকে প্রসব করতে যেয়ে তাঁর অতিরিক্ত রক্তপাত হয়েছিল। তাই ডাক্তারদের শত চেষ্টাতেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অবশেষে আমার মুখের দিকে এক নজরে চেয়ে থেকে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
·
এ কেমন মা, যে তাঁর সন্তানের জন্য নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারে। মা, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কেমন ছিল তোমার মায়াভরা আদর-স্নেহ মাখা সোনা মুখটি...
·
মা, আমায় এতিম করে তুমি,
কোথায় দিলে রওয়ানা!
এই জীবনে আমি তোমায়,
ভুলতে পারবো না।
এত ডাকি মাগো তোমায়,
সারা তুমি দাও না আমায়।
কে দিবে আর তুমি ছাড়া,
আমায় সান্ত্বনা...!
আমায় এতিম করে তুমি,
কোথায় দিলে রওয়ানা!!
·
একজন নতুন অতিথির আগমনে পুরাতন অতিথিকে বিদায় নিতে হলো। জানি না, আম্মুর মৃত্যুতে আব্বুর করুণ আর্তনাদ কেমন ছিল। তাঁর অবস্থা কেমন শোকাভিভূত ছিল। তবে এটা নিশ্চিত, আব্বু তখন লোকদের সামনে না কাঁদলেও লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল।
·
যাইহোক, আমাকে মায়ের কষ্ট না বুঝতে দেয়ার জন্য আব্বু ২য় বিয়ে করেছিল। এরপর আব্বু ও সৎমায়ের কোলে অতি আদর-যত্নেই বড় হয়েছি। সময়ের পরিক্রমায় কৈশর জীবনে পা দিয়েছি। এখন আমি মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ে অধ্যয়নরত।
·
আমাদেরকে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে স্কুলে যেতে হয়। সেই পথের ধারে একটি অতি পুরনো বটগাছ আছে। গাছটি যে কতকালের বৃদ্ধ তা আদৌ কেউ ঠিকভাবে বলতে পারে না। তবে আন্দাজ করা হয় অষ্টাদশ অথবা ঊনবিংশ শতাব্দীর গাছ হিসাবে। শুধু কর্মঠ কৃষকরা কাজের বিরতিতে বটতলায় এসে বিশ্রাম নেয়। এছাড়া সেখানে লোকজনের তেমন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
·
সেই বটতলা থেকেই এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়ের সাথে আমার প্রেমের সূচনা ঘটে। এই প্রেমের সম্পর্কটা অন্য সাধারণ প্রেমের মতো নয়। কেননা, তাঁর সাথে এই ভালোবাসার সূত্রটা সম্পূর্ণই অদ্ভুতভাবে হয়েছিল।
·
দুই ছেলের পর ‘রায়-ঠাকুর’ বংশে এক কন্যা সন্তান জন্মিলেন। বাবা-মা অনেক আদর করে তাঁর নাম রাখলেন অত্রিদেতী। তবে সবাই তাকে সংক্ষেপে অত্রিদি বলে ডাকে। সবার ভালবাসা ও আদর-যত্নেই বড় হয়ে উঠেছে। পিতামাতার একমাত্র মেয়ে বলে কথা।
·
একদিন পড়ন্ত বিকালে আমি প্রাইভেট পড়ে আনমনে বাড়িতে আসতেছি। হঠাৎ পিছন থেকে একজন মেয়ে বলতে লাগল, ভাইয়া বাঁচাও---! [আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই হিন্দু মেয়েটি।]
·
আমি বললাম, “কি হয়েছে? কই তোমাকে পিছন থেকে কেউ ধাওয়া করছে বলে মনে হচ্ছে না তো।”
— ঐ যে কালো কুকুরটা আমাকে তাড়া করতেছে। সে আমাকে কামড়ানোর জন্য জিহ্বা বের করে আছে। প্লিজ আমাকে ঐ কুকুরটা থেকে রক্ষা করুন। [সে এরকম আবোল-তাবোল বকতে বকতে আমার পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ল।]
·
আমি ভাবতে লাগলাম, “এই মেয়ে মনে হয় পাগল হয়েছে। কোথায় কালো কুকুর আর কোথায় কি? আমি তো কিছুই দেখছি না।”
·
দিন-দুপুরে একজন অজ্ঞান মেয়েকে আমার সামনে এ অবস্থায় দেখলে লোকজন আমাকেই তো খারাপ ভাববে। এমনিতেই এই বটতলা দিয়ে যেতে খুব ভয় করি। তাতে আবার মেয়েটিকে নাকি কালো কুকুর তাড়া করেছে। ভয়ের উপর আরও ভয়। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
·
অবশেষে একটা আইডিয়া মাথায় আসলো। ঈমাম সাহেব হুজুর বলেছিল, “পাগল, মৃগী, ভয় কিংবা জ্বিনে পাওয়া ব্যক্তির কানে ‘বিসমিল্লাহ্’ ৪১বার পড়ে ফুকিলে তৎক্ষণাৎ তাঁর চৈতন্য হয়।”
·
আমিও তাই করলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য! সত্যিই তৎক্ষণই তাঁর জ্ঞান ফিরল। আমি আরও আশ্চর্য হলাম যে, মেয়েটার জ্ঞান ফেরার পর বলতে লাগল, “আমি এখানে কিভাবে আসলাম? আর তুমি কে?” [অথচ সে আমাকে গ্রামবাসী ছেলে হিসাবে আগে থেকেই চিনে]
·
আমি তাকে এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, “আগে তুমি বাড়িতে চলো, তারপর সব বলব।”
·
তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের বাড়িতে আসলাম। তাঁর মাকে গিয়ে সব কথা খুলে বললাম। [আমি মাতৃহার ছেলে, এ জন্য গ্রামের সবাই আমাকে স্নেহ ও ভালোবাসার দৃষ্টিতেই দেখে।] তাই কাকিমাও আমার কথাগুলো অতি সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছে।
অতঃপর আমাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য খুব জেদ করল, তবুও আমি খাইনি। অন্য দিন খাবো, এই বলে চলে এসেছি।
·
কিছুদিন পরে...
আমি নানুবাড়িতে যাবো এ জন্য স্যারের থেকে ১ম ক্লাস করেই ছুটি নিয়ে বাড়িতে ফিরতেছি। কিন্তু এ কি! মেয়েটা বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। কিংবা পেত্নী নয়তো! এমনিতেই ঐ গাছের তল দিয়ে চলতে খুব ভয় লাগে। তাতে আবার যতসব।
·
চিন্তা করলাম বাড়িতেই আর যাবো না; বরং উল্টো পথ অতিক্রম করে নানুবাড়িতে যাবো। কিন্তু মেয়েটা আমাকে পিছনে ফিরে যাওয়া দেখে দ্রুত আমার কাছে আসতে লাগল। আর বলতেছে, “এই নাঈম ভাইয়া, প্লিজ একটু দাঁড়াও বলছি। এত ভয় করছো কেন? আমি অত্রিদি।”
·
আমি ভয়ে ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ালাম। সে এসে আমাকে বলতে লাগল, “সেদিন সাহায্য করার জন্য কৃতজ্ঞ ও অসংখ্য ধন্যবাদ। আম্মু তোমাকে আমাদের বাসায় ডেকেছে। তাই ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন চলো...।”
— কিন্তু আজকে নানুবাড়িতে যাবো তো।
— ধুর রাখো তোমার নানুবাড়ি। আগে আমার সাথে চলো তো।
·
সে আমার শার্ট ধরে বাড়ির পথে টানছে। কোন পাগল মেয়ের খপ্পরে পড়লামরে খোদা! অবশেষে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেয়েই ছাড়লো।
·
আম্মু এই যে ঠাকুর মশাইকে ধরে এনেছি। [কি আমি ঠাকুর! এই মেয়ে বলে কি রে! আমি মুসলমান ঘরের সন্তান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আর এই মেয়ে আমাকে ঠাকুর বলতেছে। আল্লাহ্ বাঁচাও...!]
·
তাঁর মা এসে বলতে লাগল, “মাবা তুমি এসেছে! তো সেদিন থেকে তোমার কোনো খোঁজই নাই! একবার এদিকে আসলেও তো পারতে।”
— আসলে কাকিমা আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই হয়ত এদিকে আসা হয়নি।
— ও আচ্ছা এখন খেতে চলো। খাওয়ার পর কথা বলি।
[আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। হিন্দুদের বাড়িতে আমার খাওয়া কি ঠিক হবে!]
— কি হলো খাচ্ছ না কেন? এখানে সংকোচবোধ করার কী আছে!!
·
আমি কোনো কথা না বলে নির্বাক হয়ে ইচ্ছের বাহিরেই খানা খাচ্ছি। কিন্তু অত্রিদি অস্তমান চন্দ্রের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। যেন বিয়ের প্রথম রাতের শুভ দৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার পূর্বলক্ষণ, নিশ্চয়ই এই মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে। নিম্নচাপ থেকে উচ্চচাপ তারপর রিঅ্যাক্টশন শুরু। দুজনের দৃষ্টি একে অপরের প্রতি স্বচ্ছ দ্রবীভূত। আমি এই প্রথম তাঁর দিকে স্পষ্টভাবে তাকালাম। বাহ কী সুন্দর সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট দুটি কালো চোখ! আকর্ণ বিস্তৃত নেত্রদ্বয়ের মণি ও ভুরু দুটি অনুপম সৌন্দর্যময়।
·
সত্যিই কি আমি তাঁর প্রেমে পড়েছি? এই প্রেম কি ধর্ম, পরিবার, সমাজ মেনে নিবে? নাহ, কখন-ই না। জাতি মানব্য হলেও ধর্মের ভিন্নতার কারণে ভালবাসার মানুষটিকে ‘ভালবাসি’ কথাটা বলতে খুব ভয় ও কষ্ট লাগে। কেননা, এতে ধর্মের বাধা পর্যাপ্ত পরিমাণ আছে। এজন্য আমি তাঁর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করি।
·
বেশ কিছুদিন পরে সেই বটতলায় তাঁর সাথে আমার দেখা হলো। সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বলতে লাগল, “আমি জানি, তুমি আমাকে ভালবাসো। তবে একটা কথা মনে রেখো, প্রেম-ভালবাসা হচ্ছে দুটি পবিত্র মনের মমত্ববোধে তৈরি। অতসত ভেবে হয় না। তোমার জন্য নিজের জীবন, পরিবার ও ধর্ম সবকিছুই সেক্রিফাইস করতে রাজি আছি। তবে শর্ত হচ্ছে- এক টুকরো ভালবাসা চাই। কি দিবে?”
·
তাঁর কথাগুলো শুনে নিজের অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে। আমি তখন বাকরুদ্ধ, কণ্ঠনালী শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার কান্না ও চোখের অশ্রুতেই সে বুঝে নিয়েছে, আমিও তাকে খুব ভালবাসি। তারপর আমরা দ্রুত বটতলা ত্যাগ করলাম।
·
এরপর থেকে তাঁর সাথে আমার বটতলায় ও চলার পথে প্রায় কথা হতো। কিন্তু আমাদের এই প্রেম-কাহিনী এক পর্যায়ে সবার কানাকানি হয়ে যায়। অত্রিদির মা! যার কাছে আমি অত্যন্ত স্নেহপাত্র ছিলাম, তিনিও আজকে আমাকে বিষ নজরে দেখছে। আর এদিকে তাঁর বাপ-চাচা ও ভাইয়েরা আমাকে মারার জন্য অনেক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সেদিন রাস্তায় তাঁর ভাই আমাকে অনেক চড়-থাপ্পর মেরেছে এবং অনেক হুমকিও দিয়েছে।
·
আমার আব্বু খুব কঠোর ও প্রেম বিদ্বেষী লোক। এটা আমি ভালো করেই জানি। তবুও তিনি আমাকে কিছু বলেনি। কেননা, তাঁর ‘মৃত্যু স্ত্রীর’ কাছে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। তাই হয়তো আব্বু তাঁর ‘২য় স্ত্রীর’ পরামর্শে আমাকে নানুবাড়িতে জীবনের মন ট্রান্সফার করেছে।
এখন চাইলেও আর নিজের জন্মস্থানে আসতে পারি না। সেদিন ঐ পিতৃভূমি থেকে চলে এসেছি সেদিন খুব কেঁদেছি। জানি না কার জন্য এত কেঁদেছিলাম, মায়ের শূন্যতা নাকি অত্রিদির জন্য। আব্বুকে কাঁদতে দেখিনি। তবে এটা অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি যে, তাঁর নয়ন দিয়ে অস্পষ্ট অশ্রু ঝড়ছে।
·
কাউকে ভালোবাসা কি অপরাধ? এর পরিণতি কি এমনই হয়? এটা বিশ্বাস করি যে, [Real love is equal to problem.] সাথে এটাও বিশ্বাস করি, প্রকৃত ভালোবাসা একদিন পরিপূর্ণ হবেই। এটাকে শত আঘাতেও বিচ্ছেদ করা যায় না। তবে জানি না, পাগলিটা কেমন আছে? কি করছে? সেও কি আমার মতো নির্জন কান্নায় বালিশ ভিজাচ্ছে!!
·
‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম।’
‘প্রিয়া তোর কাছে মনের খবর, কেমনে পৌঁছাইতাম।’
‘প্রিয়ারে তোর লাগি, বনবাসী হইলাম...
··
লেখাঃ কাওছার আজাদ (নাঈম)
©somewhere in net ltd.