![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য ন্যায়ে সন্ধানে, আকাশে উড়িয়ে শান্তির নিশান। মুক্তমনে উদার কণ্ঠে, গেয়ে যাবো সত্যের জয়গান।
আমার বউ কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিদিন আমার সাথে ঝগড়া করে। যেন এটা তার প্রতিদিনের রুটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বেশি করে ঘুম পাড়লে ঝগড়া। বাসায় দেরি করে আসলেও ঝগড়া। খানা বেশি খাইলে ঝগড়া, কম খাইলেও ঝগড়া। মোবাইল টিপলে ঝগড়া, ফেসবুক চালালে ঝগড়া। কোনো মেয়ে আমার স্ট্যাটাসে লাভ রিয়্যাক্ট দিলেও ঝগড়া। ঝগড়া আর ঝগড়া। ফোনে ২০ টাকার বেশি থাকলেও ঝগড়া। আবার ফোনে টাকা না থাকলেও ঝগড়া।
কচুপোড়া! আর ভালো লাগে না এসব ঝগড়া। কি একটা ডাইনী মেয়েকে বিয়ে করেছি! সব আম্মুর চক্রান্তের জাল। ওই মেয়েটাই নাকি তার কাছে সবচেয়ে ভালো। সে আমার মায়ের কাছে মেয়ের মতো। কী তাদের ভালোবাসা মাইরী! অথচ আমার সাথে সারাটা দিন ঝগড়া করে।
.
বিয়ে হয়েছে অবধি তার সাথে আমি নিজেত্থেকে কখনো ঝগড়া করিনি; বরং সে-ই আমার সাথে ঝগড়া করে। তবে আজকের ঝগড়ার সূচনা আমিই শুরু করেছি।
সে আমাকে বলতেছে, “নাঈম, আমার দাঁতে খুবিই ব্যাথা করতেছে।”
— তো আমি কি করব! দাঁতে ব্যাথা দাঁত ভেঙে ফেলাও।
— কচু! তোমার মাথায় কচু ছাড়া আর কী আছে!
— না কিচ্ছু নাই। হালকা গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে দাঁতে লাগাও।
— এটা দিয়ে ব্যাথার কিছুই হবে না।
— তাহলে কাঁচা কচু চাবাও।
— দেখো, লিমিট ক্রস হচ্ছে কিন্তু!
— তাহলে আমার সাথে ঝগড়া করো। এতে করে তোমার দাঁতের ব্যাথা ভালো হলেও হতে পারে।
— ভালো হচ্ছে না কিন্তু!
— তাহলে ঘুমাও।
— আমার মাথা গরম হচ্ছে কিন্তু!
— মাথায় পানি ঢালা লাগবে নাকি?
— মেজাজ বিগ্রে যাচ্ছে কিন্তু!
— আইসক্রিম খাবা?
— কচু, কচু, কচু!
— হুঁ কচুর বউ।
— ইউ আর পাগল। একটা আস্ত পাগল। মাকে ডাকবো নাকি! যত্তসব!
— ডাকো! আমি তাকে ভয় করি নাকি!
.
এবার সে সত্যি সত্যি আম্মুকে ডাকতে লাগল। এমনভাবে ডাকতে লাগল, যেন আমি তাকে সেই মাইর মেরেছি। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাবধানেই চোখের পানি টলমল করতেছে। আর এদিকে আম্মু এসে হুদাই আমাকে বকাঝকা করতে লাগল। এমনভাবে বকতে লাগল, যেন আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি। আমি যে তার ছেলে, ইতোমধ্যে তাও মনে হয় ভুলে গিয়েছিল। কি করব? মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মা ও স্ত্রী দু’জনের উপরই বেশ রাগ হচ্ছে। আবার ভালোও লাগছে। কারণ আপন মানুষকে অন্য একজন আপন মানুষ যদি আদর-স্নেহ করে, সেটাতো ভালো লাগারই কথা।
.
আজকে অনেক রাতে বাড়িতে ফিরলাম, তবুও আমার সাথে ঝগড়া করছে না। সেই ঝগড়া থেকে আজ অবধি তিন দিন হয়ে গেল। একই খাটে পাশাপাশি ঘুমাচ্ছি; অথচ কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছি না। অবশ্য সে কথা বলার জন্য অনেক ফাঁদ পাতলেও আমি চুপ ছিলাম। কারণ, সেদিন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। তাই তার উপর এখনো যথেষ্ট রাগ আছে।
.
রাত অনেক গভীর ও চারদিকে ঘন অন্ধকার। বাড়ির আশপাশে ঝিঝি পোকার শব্দ। আমার পাশেই একজন মানুষ শুয়ে আছে। তবে কথা-বার্তা না বললে কী ঘুম ধরে! আমার ঘুম কোনো ক্রমেই আসছে না। সে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার একটা সমস্যা হচ্ছে- ঘুমের মধ্যে প্রলাপ তথা কথা বলা। অনুরূপ আজকেও শুরু করেছে, ‘নাঈম, তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। তুমি দেরি করে বাসায় ফিরলে আমার খুব ভয় লাগে। কেন জানি অন্তরে শূণ্যতা অনূভব করি। আর এজন্যই তুমি দেরি করে বাসায় ফিরলে তোমার সাথে ঝগড়া করি।’ কিছুক্ষণ পর সে লাফ দিয়ে উঠে ভয়ে ভীতুচ্ছন্ন হয়ে কাঁদতে লাগল। আমি বলতে লাগলাম, “কি হয়েছে আতকিয়া? তুমি কাঁদছ কেন?”
— পানি খাবো, আমাকে পানি দাও।
— আমি তাকে গ্লাসে করে পানি দিয়ে বললাম, কি হয়েছে তোমার?
— না কিছু হয়নি, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
— আচ্ছা তুমি ঘুমাও। এসব স্বপ্ন-টপ্ন তেমন কিছু নয়।
— কিন্তু আমার দেখা প্রায় স্বপ্নগুলোই যে বাস্তবে পরিণত হয়।
— ওসব কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়, তা ছাড়া আর কিছু নয়। আর ভয় পাবার কি আছে! আমি তো আছিই।
.
সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলতেছে, “নাঈম, তুমি আমাকে ছেড়ে একায় থাকতে পারবা না?”
— কি সব আজেবাজে বলতেছ। হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেন?
— কারণ, আমি যা স্বপ্নে দেখি তা বাস্তবে পরিণত হয়।
— কি দেখেছ স্বপ্নে?
— আমি বাচ্চা প্রসব করতে যেয়ে অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে মারা গিয়েছি।
— হাহাহা, কি কাণ্ড! জীবন-মরণ সব আল্লহর হাতে। এটা তিনি ছাড়া কেউ জানে না। আর তুমি কি-না কি স্বপ্ন দেখেছ, সেটাতেই মৃত্যু নির্ণয় করতেছ!!
— তুমি হাসতেছো! হাসারই তো কথা। আমি মরে গেলে আবার নতুন একটা বিয়ে করবা। সে হয়তো আমার মতো ঝগড়াটে হবে না। আমার থেকেও অনেক সুন্দরী হবে। তোমাকে খুব ভালোবাসবে। তোমার আদেশ-নিষেধ সব পঙ্খানুপঙ্খানুভাবে পালন করবে। তোমার সাথে রাগ করবে না। তোমা...
— চুপ করো!! এত রাতে আবার ঝগড়া!!
— স্যরি, নিজের অজান্তেই অনেক কিছু বলে ফেললাম। তোমার সাথে ঝগড়া করার কোনো ইচ্ছে নাই আমার।
.
সে এমনভাবে কথা বলাতে এবার আমার মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। তাই কান্নার স্বরে বললাম, “ঠিক আছে। এখন ঘুমান।” সে আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলতে লাগল, “তুমি আমার কথায় রাগ করো কেন? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”
— নাহ্, তোমাকে ভালোবাসি না। তুমি একটা ঝগড়াটে, ডাইনী, বাচাল ও আলেয়া ডাকনী।
— উঁ-উঁ-উঁ...!
— ভ্যাঁ, মায়া কান্না থামাও। এখন শান্তিতে একটু ঘুমাও।
— কচু, কচু, কচু! আমি ঘুমাবো না, তাতে তোমার কি?
— আমি একজনকে খুব ভালোবাসি।
— কাকে?
— আমি বলব না, তাতে তোমার কি?
— লুচু একটা!
.
আমি তার কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বললাম, “আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু...”
— ‘কিন্তু’ কী?
— কচু!
— আসলেই তুমি একটা বলদ।
— সত্যি? প্রমাণ আছে? সেই সূত্রানুযায়ী তুমিও তাহলে মহিলা বলদী।
— ধুর কচুপোড়া, ঘুমান এখন!
.
আমরা দু’জনে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরই সে ডাকা-ডাকি শুরু করল, “এই ওঠো ওঠো, ফজরের নামাজ পড়বা না? ওঠো...”
— ধেৎ, কেবলই তো ঘুমাইলাম!
— পানি আনব!
— কী? এই না না, আমি উঠছি।
— ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো- সকাল হয়েছে। প্রায় ছ’টা বেজেছে। আর কিছুক্ষণ পর সূর্য উঠবে। যাও অযু করে আসো।
.
এভাবে রাগ, অভিমান, ঝগড়া, খুনশুটি, আড়ি ও ভালোবাসার মধ্য দিয়েই কেটে গেলো দীর্ঘ এগারোটি মাস। সে প্রায়ই আমাকে ঐ একই স্বপ্নের কথা বলে। আমার মনে খুব ভয় করে। না জানি আবার তার কী হয়! কারণ, তার পেটে এখন আরও একটি জীবনের অস্তিত্ব বিরাজ করতেছে। তার দেখা দুঃস্বপ্ন কী সত্যিই বাস্তবে পরিণত হবে! নাহ্, এটা হতে পারে না। আমি এমন কোনো দিন নাই যে তার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করিনি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষেই তার জন্য দোয়া করতাম। আল্লাহর কাছে কান্না-কাটি করতাম। বিশ্বাস করতাম- স্ত্রীর জন্য স্বামীর দোয়া বিফলে যায় না।
.
গভীর রাতে সে যখন ব্যাথার যন্ত্রনায় কুঁকড়িয়ে ওঠে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, তখন আমার কলিজাটা যেন ছিড়ে যায়। ওই মুহূর্তে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কি করবে! কেবল মা জাতিরাই বোঝে- সন্তান ধারণে দীর্ঘ নয়টি মাসের তীব্র কষ্ট। কিন্তু তবুও তারা সহ্য করে। কারণ সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে।
.
যাহোক, পরবর্তীতে খুব নরমালভাবেই সন্তান ডেলিভারি হয়েছে। আল্লাহ্ আমাদের উপর রহম করেছে। যেমনটা আমার স্ত্রী দুঃস্বপ্ন দেখেছিল, আসলে তা বাস্তবে কিছুই নয়। এখন আমার মেয়ের বয়স তিন বছরে পা দিয়েছে। আমার সেই ছোট্ট মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই কলিজাটা ঠাণ্ঠা হয়ে যায়। অন্তরে প্রসন্ন বাতাস বয়ে যায়। আজ আমার স্ত্রীকে অতীতের কথা স্মরণ করে দিয়ে অনেক হাসা-হাসি করলাম। সাথে অবুঝ খোকীটাও হাসছে, একদম তার মায়ের মতো করে। এরকম ভালোবাসার স্ত্রী ও কন্যা কয়জনের কপালে জোটে!
.
‘দুঃস্বপ্নের সাদা মেঘ’/কাওছার আজাদ (নাঈম)
©somewhere in net ltd.