![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য ন্যায়ে সন্ধানে, আকাশে উড়িয়ে শান্তির নিশান। মুক্তমনে উদার কণ্ঠে, গেয়ে যাবো সত্যের জয়গান।
একদা এক সময় এক পণ্ডিত ব্যক্তি 'বুদ্ধির দোকান' দিয়েছিল। সেখানে পণ্ডিত মহাশয় টাকার বিনিময় বুদ্ধি বিক্রি করত। দোকানের উপর সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল- 'বুদ্ধির দোকান, এখানে টাকার মিনিময় বুদ্ধি বিক্রি করা হয়। এবং বুদ্ধি ক্রয় করলে তা বিফলে যাবে না।' লোকজন এসব অন্তঃপাতী কাণ্ড-কাহিনী দেখে পণ্ডিত মশাইকে পাগল বলে প্রচার করতে লাগল। তারা বলতে লাগল- 'বুদ্ধিও আবার ক্রয় করা যায় নাকি? এটা কিভাবে সম্ভব! তাও আবার সাইনবোর্ডে লিখে দিয়েছে, তা ক্রয় করলে নাকি বিফলে যাবে না। নিশ্চয় এই পণ্ডিত ব্যক্তি পাগল হয়ে গিয়েছে।'
কেউ আর সেই দোকানে পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে যায় না। কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তি এ নিয়ে হতাশাবোধ করে নয়। তিনি তার দোকানে বসে বসে বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়েই দিন কাটায়।
মাঝে মধ্যে তিনি ভাবে- 'মানুষ তাদের সান্তানদের জ্ঞান অর্জনের জন্য টাকা দিয়ে গৃহশিক্ষক রাখে। হাজার হাজার টাকা তাদের পিছনে ব্যয় করে। অথচ আমিও সেই জ্ঞান দানের দোকান দিয়েই বসেছি। কিন্তু তা নিতে কেউ আসছে না। বরঞ্চ লোকজনেরা আমাকেই পাগল বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কী অদ্ভুত এ জাতি!' এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক যুবক এসে তার দোকানের সামনে হাজির। তার সামান্য লেখা-পড়া থাকার কারণে অতি সহজেই বুঝতে পারলো এটা কিসের দোকান। যুবকটি পণ্ডিত ব্যক্তিকে বলল, 'আমি বুদ্ধি ক্রয় করতে চাই। প্রতি বুদ্ধির মূল্য কত?'
পণ্ডিত মশাই আশ্চার্যিত হয়ে বলতে লাগল- 'যেখানে কেউ আমার দোকানের মর্ম বুঝতে পারছে না, সেখানে তুমি কেন এসেছো বাবা?'
- 'মাফ করবেন মহাশয়। আমি আপনার দোকানের মর্ম ও গুরুত্ব বুঝেছি।'
- 'তুমি কি বুদ্ধি ক্রয় করতে চাও?'
- 'জ্বী মহাশয়, আমি বুদ্ধি ক্রয় করতে চাই। কারণ, আপনার দোকানের উপরের লেখাটির প্রতি আমার আস্থা আছে। নিশ্চয়ই বুদ্ধি বিফলে যাবে না।'
- 'আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস দেখে খুব খুশি হলাম।'
- 'শুকরিয়া! মহাশয়, এখন তাহলে আমাকে বুদ্ধি দিন। আমি বুদ্ধি ক্রয় করতে চাই।'
- 'ঠিক আছে। তুমি বসো।'
.
পণ্ডিত মশাই এক টুকরো কাগজে লিখে দিলো- 'খানা খাওয়ার আগে তোমার ডান-বামের দিকে ভ্রক্ষেপ করে তারপর খাওয়া শুরু করবে।' [১]
যুবক বাড়িতে এসে তা প্রাকটিস করতে থাকে। এখন সে প্রতিনিয়ত খানা খাওয়ার আগে ডানে-বামে তাকিয়ে তারপর খাওয়া শুরু করে। কিন্তু এখনো এ বুদ্ধিটির উপকার কি তা বুঝতে পারল না। সে হতাশ না হয়ে আবার পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে বুদ্ধি ক্রয় করতে আসলো। এবার পণ্ডিত ব্যক্তি কাগজে লিখে দিল- 'প্রতিদিন ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়ু দিয়ে তারপর ঘুমাবা।' [২]
যুবক বাড়িতে এসে এটাও প্রতিদিন প্রাকটিস করতে লাগল। কিন্তু তেমন কোনো সফলতা বুঝতে পারল না। তবুও সে হতাশ হলো না। বরং যুবক আবার পণ্ডিতের নিকট আসলো। এবার পণ্ডিত ব্যক্তি বলতে লাগল- 'যে কোনো ধরনের বড় বিপদ আসুক মনোবল না হারিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করবে।' [৩]
যুবক বাড়িতে আসলো। বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু তেমন বিপদ-ই দেখা দিচ্ছে না। তাই এই বুদ্ধিটা আর প্রয়োগ করাও যাচ্ছে না।
সে আর পণ্ডিত ব্যক্তির কাছেও যায় না। কেননা, পণ্ডিত ব্যক্তির শর্ত ছিল- বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। এবং তা অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরবর্তী বুদ্ধি নেয়ার জন্য যেতে হবে। কিন্তু এই বুদ্ধিটা প্রয়োগের অপশন-ই সে পাচ্ছে না। তাছাড়াও ইতোমধ্যে বুদ্ধি ক্রয় করতে যেয়ে তার সব টাকা-কুড়িই ফুরিয়ে গিয়েছে। এমনিতেই ভবঘুরে যুবক! তাতে আবার যা সম্ভল ছিল তা বুদ্ধি ক্রয়ের পিছনেই শেষ করে ফেলেছে। এখন সে ভবঘুরে নিঃস্ব! পথহারা পথিকের মতো চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। তার মাথায় একটাই চিন্তা- বিপদ দেখা দিলেই তৃতীয় বুদ্ধিটা প্রয়োগ করবে। তার বিশ্বাস, বিপদের মধ্যেই সফলতা নিহিত রয়েছে।
.
সে বিরামহীনভাবে পথ চলতেই থাকে। জীবনে তার আছেই-বা কি? নাই পরিবার, নাই সংসার ও নাই কোনো আপনজন। ভবঘুরে বলে কথা! পথ চলাই তার পেশা। কবিদের কবিতা চর্চা করা ও প্রাকৃতির অপরূপা সৌন্দর্যময় দৃশ্যের বিচিত্র সমারোহকে নিয়ে কবিতা রচনা করাই তার নেশা। সে যেন এক ভবঘুরে কবি। সে কবিতা পাঠ করছে আর পথ চলছে-
'বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে,
বহু শ্রম ব্যয় করি বহু পথ ঘুরে।
দেখতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখতে গিয়েছি সিন্ধু।'
.
পথ চলতে চলতে সে একটা রাজ্যে প্রবেশ করল। কিন্তু সেই রাজ্যে একটা খবর শুনে সে অবাক হয়ে গেল। রাজ কন্যার বিয়ে! ঢোলাই দেয়া হয়েছে- 'যে বিয়ে করতে ইচ্ছুক তাকে রাজ দরবারের একটা গোপন কক্ষে একদিন একাই রাত্রি যাপন করতে হবে।' ব্যাপারটা যদিও সহজ মনে হচ্ছে। কিন্তু এমনটা মোটেও নয়। কারণ ঐ কক্ষে রাত্রে প্রবেশ করে সকালে কেউ আর জীবন্ত বের হয়নি। কি অদ্ভুত কক্ষ!
.
ভবঘুরে যুবক এতকিছু শোনার পরও উক্ত শর্তে রাজি হলো। সে বলতে লাগল, এ জীবন রেখে লাভ কি? মরতে হলে সংগ্রাম করেই মরব। তৃতীয় বুদ্ধিটা এই মহা বিপদে প্রয়োগ করেই মরব। আর বাঁচতে হলে রাজ কন্যার পতী হয়েই বাঁচব। যেই ভাবা সেই কাজ।
সে রাজার নিকট গিয়ে বলল- 'জাহাপনা, আমি আপনার কন্যাক বিয়ে করার জন্য দেয়া শর্তে পরীক্ষা দিতে চাই।'
রাজা ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন- 'বাছা, জীবনটাকে স্ব-ইচ্ছেই কেন দিতে এসেছ? কত শিক্ষিত, ভদ্র ও শক্তিশালী যুবকরাও এই পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। রাতে জীবন্ত মানুষ ঢুকে সকালে মরা লাশ হয়ে বের হয়েছে। আর তুমি তো...'
যুবক বলতে লাগল- 'শরীরে শক্তি থাকলেই কি সে প্রকৃত শক্তিশালী? যাকে আপনি ভাবতেছেন দূর্বল, সে হতেও তো পারে সবল! দেহের শক্তি নয়। প্রকৃত শক্তিশালী তো সেই, যার আছে মনোবল।'
যুবকের কথা শুনে রাজা চুপশে গেলেন। এরকম যুবক তিনি তার লাইফেও দেখেনি। তিনি যুবককে অনুমতি দিলেন। বলা যায় না, হতেও তো পারে এই যুবকই রাজ কন্যার জামাই।
.
রাজ্যে সন্ধার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হবে যুবকের জন্য ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। ভয়ঙ্কর শয়ন কক্ষে প্রবেশের আগে নিয়মানুযায়ী রাজ দরবার থেকে তাকে খানা দেয়া হলো। সে খানার প্লেট সামনে রেখে ক্রয় করা বুদ্ধির অভ্যাস অনুযায়ী ডান-বামে তাকালো। হঠাৎ তার বাম পার্শ্বে একটা সাদা বিড়ালকে দেখতে পেল। সে প্লেট থেকে এক মুষ্ঠি ভাত বিড়ালকে দিলো। বিড়ালটি তা ভক্ষণ করে তৎক্ষণাৎ দাফা-দাফি শুরু করল। তার বোঝার বাকি রইল না যে, এই ভাতে বিষ মিশ্রিত আছে। যা খেলে ধীরে ধীরে ক্রিয়া করে তাকেও মরতে হত। সে মনে মনে বলতে লাগল- 'শুকরিয়া পণ্ডিত মশাই। আপনার বুদ্ধি আজকে আমার কাজে লেগেছে।'
এবার যুবক সেই ভয়ঙ্কর শয়নগৃহে প্রবেশ করল। যেখানে এসে ইতোমধ্যে অনেক যুবক প্রাণ হারিয়েছে। আজ এই গৃহে ভবঘুরে যুবকটি এসেছে। সে কক্ষের চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তেমন ভয়ানক নিদর্শন কিছুই চোখে পড়ল না। কক্ষটি একদম পরিপাটি ও সুন্দর। দেখে মনে হচ্ছে না যে, এখানে এসে কেউ মরে যায়। তাহলে বিষ মিশ্রিত খাদ্যই কি এসব মৃত্যুর আসল সূত্র?
যুবক এসব ছাইপাস ভাবতে ভাবতে ঘুমাবার জন্য খাটের কাছে আসলো। ক্রয় করা দ্বিতীয় বুদ্ধি- ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়ু দিতে হবে। বিছানার পাশেই ছিল ঝাড়ু। যুবক তা দিয়ে ঝাড়ু দিতে লাগল। বালিশটা সরাতে যেয়ে হুট করে একটা ধাঁরালো ছুরি বের হয়ে আসলো। প্রথমে চমকে উঠলেও পরে ছরিটা সে হাতে নিলো। যুবক মনে মনে ভাবতে লাগল, 'দুইটা বুদ্ধিই প্রয়োগ হয়েছে। এবং তা বিফলেও যায়নি। সুতরাং সূত্রানুযায়ী তৃতীয় বুদ্ধির সাপেক্ষে মহা বিপদ অপেক্ষা করতেছে। তাই আর ঘুমানো উচিত হবে না।'
.
এবার যুবক মনের মধ্য অদম্য সাহস ও ডান হস্তে ধাঁরালো ছুরি নিয়ে খাটের মধ্যে বসে পড়ল। নাহ্, রাত অনেক হয়েছে। তবুও মহা বিপদের কোনো খোঁজ-পাত্তাই নেই! রাত তিনটা বেজে গেল। হঠাৎ একটা অজানা ঘ্রাণ নাকের মধ্যে এসে প্রবেশ করলো। যুবকের নাকে ভয় থাকলেও মনোবল এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। হঠাৎ খাটের পাশ থেকে একটা বিষাক্ত সর্প বের হচ্ছে। যুবক বুঝতে পারল- এটাই মহা বিপদ। এবার মোকাবিলা করার পালা। হাতে তো ছুরি আছেই! ঘ্যাঁচ-ম্যাঁচ-ক্যাঁচ! ছুরি দিয়ে চোটের উপরে চোট। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্পটি চাকা-চাকা ডুমো-ডুমো হয়ে গেলো। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে প্রভাত ঘনিয়ে এলো। মহা বিপদ কেটে গিয়েছে। পণ্ডিতের বুদ্ধি বিফলে যায়নি।
.
এদিকে রাজা মশাই সকাল হতে না হতেই তার তৈরি সেই ভয়ঙ্কর কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। রাজা ভাবছে- 'ছেলেটা তো কালকে ভালই লেকচার মারলো! আজকে দেখা যাবে কত ধানে কত তুষ।'
রাজা মশাই কক্ষের দরজায় হালকা নক করার সাথেই দরজা খুলে গেলো। রাজা যুবককে দেখে আশ্চর্য হয়ে পড়ল। যুবক এখনো জ্যান্ত! এটাই আসল যুবক। এটাই আমার মেয়ের জামাই হওয়ার যোগ্যতা রাখে। রাজা মশাই দু'হাত মেলিয়ে দিয়ে বলল- 'আসো বাবা আমার বুকে আসো। তুমিই আমার মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র।' যুবক আনন্দিত হয়ে মনে মনে বলতে লাগল- 'সত্যিই পণ্ডিতের বুদ্ধি তথা জ্ঞান বিফলে যায়নি। জি হ্যাঁ, জ্ঞান আহরণ করলে তা কখনো বিফলে যায় না। আজ জ্ঞানের শক্তিতেই ভবঘুরে যুবক থেকে আমি রাজ কন্যার জামাই।'
.
মন্তব্য : 'আশা করছি, গল্পটিতে কিসের গুরুত্ব বর্ণনা করেছি তা অলরেডি আপনারা বুঝেই নিয়েছেন। তাই মার্ক করে আর কিছু বলার প্রয়োজনবোধ মনে করছি না।'
.
লেখা : কাওছার আজাদ।
©somewhere in net ltd.