![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য ন্যায়ে সন্ধানে, আকাশে উড়িয়ে শান্তির নিশান। মুক্তমনে উদার কণ্ঠে, গেয়ে যাবো সত্যের জয়গান।
আরিফ নামের ছেলেটা ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে কাঁচা ছাত্র ছিল। একদিন সে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী ও ব্রিলিয়ান্ড ছাত্রী তামান্নাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সেদিন মেয়েটা তাকে যথেষ্ট অপমান করেছিল। ছেলেটার গালে একটা স্ব-জোরে থাপ্পড় মেরে বলেছিল,- 'তুমি কোন সাহসে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দাও? তুমি কি জানো, আমার পিছনে কত স্মার্ট ছেলেরা ঘূর-ঘূর করে বেড়ায়! তুমি তো লেখা-পড়াতেও ঘোড়ার ডিম। যত্তসব!'
ছেলেটা সেদিন তার সামনে আর কিছুই বলেনি। মন খারাপ করে বাড়িতে চলে এসে খুব কেঁদেছে, খুব! আর মনকে প্রশ্ন করেছে,- 'সে কিভাবে পারল এত অপমান করতে! থাপ্পড় মেরেছে, এতেও ক্ষ্যন্ত হয়নি? এতগুলো অপমানজনিত কথা শোনানোর কি দরকার ছিল? আমার প্রস্তাব এ্র্যক্সেপ্ট না করে ফিরে দিলেই তো হতো! কাউকে ভালোবাসা কি অপরাধ? হ্যাঁ, আমার জন্য অপরাধ। কারণ, আমি স্মার্ট না। ভালো ছাত্র না। মানিব্যাগে টাকা নাই। আচ্ছা, মেয়েরা কি এমনই হয়?'
ছেলেটা আর কখনই ঐ স্কুলমুখী হয়নি। স্কুল থেকে টিসি নিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হয়েছিল। প্রেমের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে লেখা-পড়ায় যথেষ্ট মনযোগ দিয়েছিল। তার মনে একটাই রাগ ছিল যে, ভালো ছাত্র না হলে কি কোনই মূল নেই?
.
এত এত পরিশ্রম করে লেখাপড়ার ফলে SSC & HSC-তে ছেলেটা যথেষ্ট ভালো ফলাফল পেয়েছিল। এবং ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। ছেলেটা মাঝে মধ্যেই ভাবে,- 'মেয়েটার একটা থাপ্পড় ও অপমানই আজ আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। তাকে জীবনে একবার দেখা পেলেও এই সফলতার কথা জানিয়ে অনেক ধন্যবাদ দিব।'
.
অপরদিকে মেয়েটা এস.এস.সি-তে দুই সাবজেক্টে ফেল করেছিল। পরেরবার আবার পরীক্ষা দিয়ে কোনো রকম পাস করে। এরপর কলেজে ভর্তি হতে না হতেই তার বাবা-মা ভালো একটা ধনীর দুলালের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারে,- ছেলেটার চরিত্র ভালো নয়। নেশা করে গভীর রাত্রে বাড়িতে ফিরে। তাকে কিছু বললেই শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
মেয়েটা এখন নীরবে খুব কাঁদে আর ভাবে,- 'এটা কি আমার অহংকারের ফল নয়? একটা সময় নিজেকে খুব অহংকারী মনে করতাম। নিজের রূপ নিয়ে খুব গর্ব করতাম। আজ কোথায় গেল আমার অহংকার? আচ্ছা, স্কুল জীবনে প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার কারণে একটা ছেলেকে তো খুব অপমান করেছিলাম। ছেলেটা কি এখনো বেঁচে আছে? না, তাকে তো আর কখনো স্কুলেও দেখিনি। খুব বড় ভুল করেছি তাকে অপমান করে। কেন তাকে থাপ্পড় মেরেছিলাম? কিসের এত অহমিকা ছিল আমার? আজ কোথায় গেল সেই দাম্ভিকতা? এখন নিজেকেই তো ধীক্কার দিতে মন চাইতেছে। আচ্ছা, ছেলেটাকে কি কখনো খুঁজে পাব না? পেলে হয়তো তার থেকে মাফ নিতে পারতাম। খুব বড় অন্যায় করেছি। যা হয়তো ক্ষমার যোগ্য নয়।'
এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখতেছে, এক সুদর্শনীয় চেহারার যুবক এসে তাকে বলতে লাগল,- 'আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার জন্যই আজকে আমি এত দূর এগোতে পেরেছি।'
যুবককে কিছু বলার আগেই ঘুম ভেঙে গেলো। সে ভাবতে লাগল,- 'কে এই যুবক? কি তার পরিচয়? আর সে কেন আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে? আর আমার জন্যই-বা কেন সে এগোবে! অবিশ্বাস্য!'
একইভাবে দ্বিতীয় দিনও সেই একই স্বপ্ন দেখতে লাগল। এবার যুবক কিছু বলার আগেই সে তাকে প্রশ্ন করল,- 'কে আপনি? আর আমাকেই-বা কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন?'
- 'আমি আরিফ! চিনতে পেরেছেন?'
- 'আরিফ! কোন আরিফ?'
- 'যখন নবম শ্রেণীতে ছিলাম, তখন আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আপনি তা এ্যকচেপ্ট না করে আমাকে অনেক বকা দিয়েছিলেন...'
এবার মেয়েটি কান্নার স্বর নিয়ে বলতে লাগল,- 'ওহ্ আরিফ ভাইয়া! স্যরি, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। হয়তো, তোমাকে অপমান করার দায়ে সেই কষ্টটা এখনো আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আপনার কাছে বিনিত অনুরোধ, আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ।'
.
ছেলেটা কিছু বলার আগেই আবার ঘুম ভেঙে গেলো। সমস্ত শরীর ঘেমে ছলবল হয়ে গেছে। সে ভাবতে লাগল,- 'কি হচ্ছে এসব? স্বপ্নের মধ্যেও কি এসব সম্ভব? সে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। আর আমি তার থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। এটা কিভাবে সম্ভব? নাহ, কালকেই আমাকে তার খোঁজে বের হতে হবে।'
.
তার (তামান্নার) মনে আছে শুধু ছেলেটার নাম ও গ্রামের নাম। তারা ঐ সময়ে শহরের স্কুলেই পড়ত। তামান্নাদের বাসা শহরেই ছিল। কে কোত্থেকে স্কুলে পড়তে আসে অত-শত ভাবার সমই নাই। এতটুকু বায়ো-ডাটা পেয়ে তাকে কিভাবে খুঁজে বের করবে! এসব ভাবতেই যেন আঁকাশ ভেঙে মাটিতে পড়ে। তবুও সে ঐ গ্রামটিতে যেয়ে 'আরিফ' নামের কাউকে খোঁজ করতে লাগল। ভাগ্যিস গ্রামে আরিফ নামের একজনই ব্যক্তি আছে। এবং সে ভালো ছাত্রের সুনামে পুরো গ্রামেই জস-খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তাই তাকে সহজেই সে খুঁজে পেল।
তামান্না তাদের বাসায় সামনে গিয়ে 'বাড়িতে কেউ আছেন' বলে ডাকতে লাগল। বাড়ির পরিবেশ দেখে বোঝা যাচ্ছে, আরিফ মধ্যবৃত্ত পরিবারের সন্তান। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্র মহিলা এসে গেট খুলে দিল। সম্ভবত ইনি আরিফের মা হবে। ভদ্র মহিলা বলতে লাগল,- 'জ্বি, ভিতরে আসেন।'
- 'ধন্যবাদ আন্টি। আচ্ছা, আপনার ছেলের নাম কি আরিফ?'
- 'আপনাকে চিনলাম না তো!'
- 'জ্বি না মানে, আমি তার ক্লাস ফ্রেন্ড।'
- 'তার ফ্রেন্ড হলে তো এভাবে প্রশ্ন করার কথা নয়।'
- 'সত্যি বলতে কি আন্টি, স্কুলে আমরা একই সাথে পড়তাম। তবে ঘনিষ্ঠ না থাকায় তেমন কথা হতো না।'
- 'ও আচ্ছা। তো এখন কি মনে করে আসলেন?'
- 'না, তেমন কিছু না। প্লিজ আন্টি, তাকে একটু ডেকে দিন না? সে আমাকে দেখলেই চিনবে।'
- 'কিন্তু সে তো বাসায় নেই। বাজারে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরই হয়তো আসবে। একটু অপেক্ষা করো।'
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আসলো। তাদের বাসায় তামান্নাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেলো। দীর্ঘ ৭ বছর পর আবার দেখা হবে, ভাবতেই অবাক লাগে! আরিফ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ল, সেই ৭ বছর আগের কথা- যেই মেয়েটি তার গালে থাপ্পড় মেরেছিল। আজ সেই মেয়েটি তাদের বাড়িতে এসে অপরাধীর মতো বসে আছে।
.
তামান্না চুপ থাকতে না পেরে নিজেই কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,- 'আরিফ ভাই, আমাকে ক্ষমা করবেন না? আজ আমি অপরাধী হয়ে আপনার বাসায় ক্ষমা চাইতে এসেছি। প্লিজ, ক্ষমা না করে ফিরিয়ে দিও না।'
আরিফ কিছু বলার আগেই তার মা তাকে বলতে লাগল,- 'আরিফ, কি হয়েছে বাবা? তুই আমাকে সব কথা খুলে বল।'
- 'কিছু না আম্মু।'
পাশ থেকে তামান্না বলে উঠল,- 'আন্টি, কিছু মনে না করলে আমি সব কথা খুলে বলতেছি।'
- 'জ্বি বলো।'
- 'আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা। যখন আমরা নবম শ্রেণীতে পড়তাম। তখন আরিফ আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর আমি নিজেকে অহংকারী মনে করে তাকে অনেক অপমান করেছি...'
তামান্নার কথার গতি কেড়ে নিয়ে আরিফ বলতে লাগল,- 'তারপর আমার গালে একটা থাপ্পড়ও মেরেছিল। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে স্কুল থেকে টিসি নিয়েছিলাম...'
- 'ওহো, তাই জন্যি তুই স্কুল পরিবর্তন করেছিলি?'
- 'জ্বি আম্মু।'
- 'তারপর কি হয়েছে?'
- 'আম্মু, তুমি তো জানো- আগে আমি থার্ড-ক্লাস মার্কা স্টুডেন্ট ছিলাম।'
- 'হ্যাঁ, তাই তো রে! তবে তুই এতটা ভালো ছাত্র কিভাবে হয়েছিস! এটা তো কখনো ভেবে দেখিনি!'
- 'নিশ্চয়ই এর পিছনে কারো হাত রয়েছে আম্মু। আর তা হচ্ছে, এই মেয়েটার হাত! এই মেয়েটার হাতের থাপ্পড়। তার অপমানই আজ আমাকে এতদূর পৌঁছিতে সাহায্য করেছে। তার কথাগুলো আমার অন্তরে একটা জেদ তৈরি করে দিয়েছিল। তাই আজ আমি সফল হতে পেরেছি।'
তামান্না আবার কান্নার কণ্ঠে বলতে লাগল,- 'ভাইয়া, কেন অতীতকে স্মরণ করে দিয়ে আমাকে আরো কাঁদাচ্ছেন? আপনি আমার থাপ্পড় খেয়ে নিজেকে সফল বলে দাবি করতেছেন। কিন্তু আমি বেঁচে থেকেও তো মৃত্যু ব্যক্তির মতো। কেন আমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন না?'
- 'হোয়্যাট? কি বলতেছেন এসব? আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন? সেদিনের ভুলটা তো আমারই ছিল। ক্ষমা চাইতে হলে আমিই আপনার থেকে ক্ষমা চাবো। এবং আপনার জন্যই আজকে সফল হতে পেরেছি। এর জন্য আপনাকে অবশ্যই অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।'
- 'প্লিজ, এসব কথা বন্ধ করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি এখন বাসায় চলে যাবো...'
হুট করে আরিফের মা বলে উঠল,- 'এ-মা, কিছু না খেয়েই চলে যাবা? এটা তো হতে পারে না। ওয়েট ওয়েট...'
- 'না আন্টি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিন এসে খাবো।'
- 'যদি কিছু মনে না করো তবে একটা কথা বলতে পারি?'
- 'জ্বি অবশ্যই, আন্টি।'
- 'তোমাকে যদি এই ঘরের বউ করে আনি! তবে তোমার আপত্তি আছে?'
- 'স্যরি, সম্ভব না আন্টি।'
- 'কিন্তু কেন?'
তামন্না কান্নার স্বরে বলতে লাগল,- 'কারণ, আমি ডিভোর্সী মেয়ে। গত বছরে আমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর জানতে পারি, ছেলেটা ক্যারেক্টর লুজার ও নেশাখোর ছিল। যখন তখন আমাকে নির্যাতন করত। এসব সহ্য করতে না পেরে তাকে তালাক দিতে বাধ্য হয়েছি। হ্যাঁ আন্টি, এখন আমি বুঝতে পেরেছি- এসবই আমার অহমিকার ফল।'
- 'প্লিজ, কান্না বন্ধ করো। আর হ্যাঁ, আমি তোমার আন্টি নই। আজ থেকে তোমারও মা। কেমন?'
এই মুহূর্তে তামান্না কি বলে তাকে ধন্যবাদ দিবে বুঝতে পারছে না। সে সত্যিই আশ্চর্যিত! এই জগতে এখনো ভালো মানুষ রয়েছে! তা ভাবার বাইরে।
.
অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। ফুলশয্যার রাত্রে এক গাছা বকুল ফুলের মালা হাতে নিয়ে আরিফ তামান্নার সামনে ভীতুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। তামান্না মুচকি হেসে আরিফের কপালে একটা চুমো এঁকে দিয়ে বলতে লাগল,- 'কি জনাব, আবারও থাপ্পড়ের ভয়?'
- 'ভাবতাছি...'
- 'কি ভাবতেছেন?'
- 'নিয়তি!'
- 'হুম, একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা।'
- 'এ্যনিওয়ে, তোমাকে কিন্তু এখনও পাগলের মতো ভালোবাসি। তুমিই আমার প্রথম-শেষ ভালোবাসা।'
- 'আমাকে ক্ষমা করেছ কি-না সেটা বলো আগে।'
- 'হাহাহা, পাগলী একটা!'
- 'ধুর...'
.
নিজের অজান্তেই তামান্নার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। এটা দুঃখের অশ্রু নয়, যেন আনন্দের অশ্রু। এই আনন্দে আরিফকে জড়িয়ে ধরে তামান্না বলতে লাগল,-
'অশ্রু বিসর্জন দিয়ে অবিরত,
মনের মধ্যে তোকে খুঁজেছি কত!
পথে চেয়ে দেখি তুই আসবি কবে?
ধৈর্যের বাঁধন ছিঁড়ে তিলোত্তমা,
তবুও তোর জন্য এই মনে...
প্রেমের শেষ বিন্দু ছিল জমা।'
.
এবার আরিফ বলতে লাগল,-
'অশ্রু বিসর্জন দিয়ে অবিরত,
ধৈর্যের বাঁধন ছিঁড়ে কেঁদেছি কত!
তবুও তোমার মুখের চাহনি,
এখনও আমার হৃদয়ে খেলা করে,
শৈশবের সেই লুকোচুরির মতো।'
.
লেখা : কাওছার আজাদ (কচু)
©somewhere in net ltd.